কাগজের তুমি আমি পর্ব-০৭

0
2422

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৭ম_পর্ব

– তুই তো মানুষ ভালো না, বউ হওয়ার আগেই টিপিক্যাল বউদের মতো স্পাইগিরি করছিস।

কথাটা কানে আসতেই চমকে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। বুকের উপর হাত বেধে সুক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে অনল। আসলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিলো ধারা। যদিও ইচ্ছেকৃত নয়, কিছুক্ষণ আগে সুভাসিনী বেগম অনলকে খুজছিলেন বিধায় ধারাকে পাঠিয়েছেন তার ছেলেকে ধরে আনতে। অনলকে খুজতে বাগানের কোনায় আসতেই মাহি এবং তার কথোপকথন শুনতে পায়। তখন আর তাদের সামনে যেতে ইচ্ছে হয় নি, লজ্জায় একেই অনলের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না, তার উপরে অনলের এমন কথা শুনে আরো অপ্রীতিকর অবস্থাতে পড়ে যায় ধারা। আমতা আমতা কর বলে,
– না, আসলে
– কি আসলে? আসল কথা তুই আমার স্পাইগিরি করতে আসছিস। তোদের মেয়েদের সমস্যা কিরে? এতো সন্দেহপ্রবণ কেনো? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতি। না তোর তো সি.আই.ডি এর এ.সি.পি হওয়া লাগবে। আমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশ সন্দেহ হচ্ছে। কোনো মেয়ের সাথেই তো কথা বলতে দিবি না দেখছি বিয়ের পর। হায় খোদা আমার কি হবে

মাথায় হাত দিয়ে এমন ভাবে কথাগুলো বলছে অনল যেনো সত্যি খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছে ধারা। হা করে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধারা। কি বলবে শব্দ খুজে পাচ্ছে না। নিজের বোকামির উপর নিজের ই রাগ উঠছে, নিজের কপালে জোরে চাটি লাগাতে মন চাচ্ছে। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই ধারা বললো,
– তুমি ভুল বুঝছো, আমাকে তো ফুপি
– কিহ! লুকিয়ে কথা তুই শুনছিলি, আমার উপর নজরদারি তুই করছিলি আর দোষটা দিচ্ছিস আমার মার। মা বলেছে তোকে এগুলো করতে?

অনলের কথা শুনে আবার ও ভাষাহীন হয়ে যেতে হলো ধারাকে, এই মানুষটাকে বুঝানো অসম্ভব। এখন নিজের মনেই নিজেকে হাজারো বকা দিয়ে নিলো ধারা। এই লোকের এমন বিদিকিচ্ছির স্বভাব জানা সত্ত্বেও প্রতিবার একই ভুল করে ধারা। এই লোকের প্রতি যখন ই একটু কৃতজ্ঞতা বোধ হতে লাগে, যখন ই ভাবে অনলকে সম্মান করবে তখন ই এমন কিছু কথা শুনতে হয় সে অনলের মাথা ভেঙ্গে ফেলতে মনে চায় তার। তার খুব ইচ্ছে দেখার লোকটার মাথায় কি আসলেই ভুষি ভরা কিনা! সবসময় দু কদম বেশি বুঝে।
– তার কত গালাবি, মনে মনে তো গালি দিতে দিতেই মেরে ফেলসিস। কি বউ জুটলোরে বাবা।

অনলের কথা শুনে বেশ চটে গিয়েই বললো ধারা,
– তোমাকে গালাবো কেনো? গালাচ্ছি নিজেকে। নিজের গাধামির জন্য নিজেকে গালাচ্ছি। গাধা না হলে কি বারবার তোমার মতো মোটা বুদ্ধিকে বুঝানোর মতো কাজ করতে যাই। ক্ষেমা দাও, ফুপি তোমাকে ডাকছিলো বিধায় আমার এখানে আসা। তোমার উপর নজরদারি করতে না বয়েই গেলো বুঝলে

বলেই সামনে হাটা দিলো ধারা। মনে মনে অনলের গুষ্টির ষষ্ঠী করছে সে। তার মধ্যেই কানে আসে,
– আমার উপর ই তোর যত চোটপাট, বাহিরের মানুষ যখন দু কথা শোনায় তখন এই তেজ কোথায় যায়?

অবাক নয়নে পেছনে তাকাতেই আবার অনল বলে উঠে,
– কি ভুল বললাম? আর একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদছিলি, সেটা কেনো? তেজ দেখানোর বেলায় অনল আর এমনি সময় লবডংকা
– মাহি আপু তো ভুল কিছু বলেন নি।
– সে ভুল কি ঠিক সেটা টো আমি জানতে চাচ্ছি না। আমার বউ হতে যাচ্ছিস এখন খামছি দিতে আসলে কামড়ে দিবি। বাকিটুকু আমি দেখে নিবো। আমি তোকে এই শেষবারের মতো বলছি, এই ফ্যাসফ্যাসানি যদি আরেকবার দেখি না ঠাটিয়ে কান লাল করে দিবো বলে দিচ্ছি। চল মা অপেক্ষা করছেন

বলেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো অনল। ধারা অনলের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। বড় অদ্ভুত এই লোক, এতো রহস্যময়ী এই লোকটা। তার ট্যারা ট্যারা কথাগুলো শুনে মনে অজানা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধারার। কেনো যেনো মনটা খুব সহজেই চাঙ্গা হয়ে গেলো। না জানি কি জাদু আছে লোকটার মাঝে। মন খারাপের রেশটা ঝাড়ি দিয়েই হাওয়া বানিয়ে দেয়। এর সাথে সারা জীবনের পথচলাটা খুব মন্দ হবে না_____

_____________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

রাত ১১টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা, এলোকেশে মন্দ লাগছে না মেয়েটিকে। বারান্দার গ্রিল ধরে বাহিরের মনোরম প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। হীম বাতাসে চুল উড়ছে ধারার। নভেম্বরের এই সময়ে বেশ কুয়াশা পড়ে। খুব দ্রুত পৌষে পা রাখবে প্রকৃতি। এই সময়টা খুবই প্রিয় ধারার। আকাশে আজ চিকন শুভ্র চাঁদ উঠেছে। নতুন চাঁদ, আমাবস্যার অন্ধকার কাটিয়ে ক্ষীণ আলোতে প্রকৃতিকে একটা মায়াময় সাজে সাজিয়েছে। অনেকটা তার জীবনের মতো, ঘন কালো আধারের মাঝে অনল এই শুভ্র চাঁদটির ন্যায় তার জীবনকে নতুন রুপ দিয়েছে। আজকাল মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে, মুড সুইং এর জন্য হয়তো এমন হয়। এই ভালো থাকছে আবার থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। কাল অনলের সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। কথাটা ভাবলে একদিকে যেমন নিজের বাচ্চার কথা ভেবে ভালো লাগছে আবার খারাপ লাগছে নিজের আপনদের ফেলে যেতে হবে বিধায় কান্না পাচ্ছে। অবশ্য তার পরিবারের মানুষেরা তাকে পার করতে পারলেই হয়তো বাঁচেন তবুও ধারার খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে নিজের মার কোলে আচড়ে পরে কাঁদতে, কিন্তু আপনজনের সাথে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। চাইলেও তারা তাকে আপন করে নিচ্ছেন না, সেও আগাতে পারছে না। কথাটা ভাবতেই মনটা আবার হু হু করে উঠলো। আনমনেই পেটে হাত চলে গেলো ধারার, মলিন কন্ঠে বলতে লাগলো,
– তুই ও কি আমাকে এমন একা করে দিবি? যখন নিজের পরিচয় জানতে পারবি তুই ও কি আমাকে ভুল বুঝবি?

উত্তর পাবে না জেনেও কথা বলছে। মনের শান্তি, কেউ তো কথা বলছে না, লাবণী, ছোট বোনটাও কথা খুব কম কথা বলে। হয়তো বুঝেও না কি বলতে হবে। শুধু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। এই দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলতে পারতো! কিন্তু ওই ভাগ্যের পরিহাস। সহ্য করতেই হবে
– ধারা কি ঘুমিয়ে গেছো?

সুরাইয়া বেগমের কন্ঠ কানে আসতেই বারান্দা থেকে রুমে আসে ধারা। বেশ কিছু গয়না, শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোটের কোনায় হাসির রেখা একে ধারা বললো,
– আমার ঘরে আসতে কি এখন তোমার পারমিশন লাগে মা
– না ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছিস কি না
– আসো না মা

ধারার কন্ঠের আকুতি দেখে সুরাইয়া বেগমের চোখ ছলছল করছে। মেয়েটাকে কাল অন্যের হাতে তুলে দিবেন। এই একটা সপ্তাহ তার মুখ দর্শন ও করেন নি। কিন্তু মা তো আর থাকতে পারছিলেন না। নাহয় একটা পাপ করেই ফেলেছে তাই বলে নিজের নাড়ির টানকে অস্বীকার করবেন কিভাবে। সেদিন মেয়েটা তার মা আকড়ে বসেছিলো শুধুমাত্র নিজের অংশকে বাঁচাতে। মেয়েটার মুখটা দেখে মনটা কেঁদে উঠলো। পুতুলের মতো মেয়েটা এই এক সপ্তাহেই কি লাশের মতো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির স্তর। মুখটা যেনো শুকিয়ে আছে। হাসতে গেলেও দশবার ভাবে। তবুও নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করলেন না; শক্ত কন্ঠে বললেন,
– এই গয়না গুলো তোমার জন্য গড়িয়েছিলাম। কাল এগুলো পড়বে। আর এই শাড়িটা তোমার ফুপি পছন্দ করেছেন। কালকে এটাই পড়বে তুমি। এই শাড়িগুলো আমার কাছে ছিলো। বেশ কিছু কেনার সুযোগ দেয় নি তোমার ফুপি। তাই এগুলোই সুটকেসে গুছিয়ে নাও।
– আর কিছু বলবে না মা
– ধন্যবাদ, চুপচাপ বিয়ে করার জন্য। অনল ছেলেটা অনেক ভালো, আমরা সারাটাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ। তোমার বিয়েটা না হলে লাবনীর জন্য ও আমাদের কষ্ট পোহাতে হত। এই বিয়েটা শুধু তোমার বাচ্চাকে প্রাণে বাছাচ্ছে তা নয়, আমাদের সম্মান ও বাচাচ্ছে। ও বাড়িতে ফুপির খেয়াল রেখো। তিনি যে কাজ করছেন, তার জায়গায় আমি হলে এতো মহত্ব দেখাতে পারতাম না। তাকে কোনো কষ্ট পেতে দিও না। এমন কোনো কাজ আবার করো না যাতে তার কাছে আমরা ছোট হয়ে যাই।

সুরাইয়া বেগমের গলা ধরে এসেছে, আর দাঁড়িয়ে থাকলে তার দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি জিনিসগুলো খাটের উপর রেখেই বেড়িওয়ে গেলেন তিনি। ধারার মনে এক রকম চাপা কষ্টের আবির্ভাব হলো, সেখান থেকে অভিমান। এই অভিমানের রেশটা নিজের কাছেও একটা দূরত্বের তৈরি করছে। মা-মেয়ের অভিমানের পালা যে কবে শেষ হবে তা হয়তো উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না______

পরদিন,
রাত ১২টা,
অনলের রুমে বসে রয়েছে ধারা। বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ঘন্টা দুয়েক আগে এ বাড়িতে এসেছে সে। লাল বেনারসি পড়ে বধুবেশে অনলের খাটে বসে রয়েছে। যদিও এইটাও সুভাসিনী বেগমের আইডিয়া। ধারা চেয়েছিলো সুভাসিনী বেগমের রুমেই থাকবে। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতে শাশুড়ির ঘরে বউ থাকছে ব্যাপারটা হাস্যকর। মানুষ তো জানে না এই বিয়েটা কাগজের একটা সই মাত্র। এর মর্ম বর বউ কারোর কাছেই নেই। তবুও সামাজিক জীব হওয়ার দায়ে মানুষ কি ভাবছে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। বুকটা কেনো জানে টিপটিপ করছে। কেনো সেই উত্তর জানা নেই ধারার। যতই হোক বিয়ে তো হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে…………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি