কাগজের তুমি আমি পর্ব-৩

0
2411

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৩য়_পর্ব

সুভাসিনী বেগম এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। ধারার এমন আকুতি দেখে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,
– সেলিম, ধারার বাচ্চাকে মেরে ফেলাটা কখনোই কোনো সমাধান নয়। এর চেয়ে বরং ধারার বিয়ের ব্যবস্থা করো। এই সপ্তাহে ধারার বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।

সুভাসিনী বেগমের এমন কথায় সেলিম সাহেব যেনো অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। তার বড় বোন হুট করেই একটা কথা বলে ফেললেন যা তার বুঝার বেশ বাহিরে। অবাক হয়ে সেলিম সাহেব বলেন,
– আপা, মাথা কি গেছে তোমার? কি বলতেছো? ধারার বিয়ের ব্যবস্থা মানে? এই অবস্থায় কে করবে ওকে বিয়ে? যে জানবে সেই তো কু কথা বলে মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে যাবে। আর এমন ছেলে পাবো কই যে সব জেনেও ধারাকে আপন করে নিবে!
– এমন ছেলের সাথেই বিয়ে হবে যে সব কিছু জানবে। দেখো এখন একটা ভুল শুধরাতে যেয়ে আমরা তো নতুন করে ভুল করতে পারি না। আর বাচ্চাটাকে মারার আমরা কে?

সুভাসিনী বেগমের ঘোলাতে কথা সেলিম সাহেব সহ কারোর ই মাথায় ঢুকছে না। অনল তো অবাক নয়নে শুধু তার মাকে দেখে যাচ্ছে। ধারার প্রতি তার মায়ের একটু বেশি টান আছে তা অনলের বেশ ভালোকরেই জানা আছে। কিন্তু টানের কারণে যে পাগলের প্রলাপ দিবে এটা যেনো হজম হচ্ছে না। গলা খাকারি দিয়ে অনল বললো,
– মা, একটু খলসা করে বলবে কি বলতে চাও?

সুভাসিনী বেগম এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা গলায় বললেন,
– আমি ধারা মায়ের বিয়ে আমার অনলের সাথে দিতে চাই। তাতে যদি তোমাদের কোনো আপত্তি থাকে তবে বলো?

সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার বক্তব্য সবার ঘাম ধরাতে যথেষ্ট। উনি যতটা স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে কথাটা বললেন, ততটাই তীব্রগতিতে ধারা এবং অনলের মাথায় বজ্রপাত ঘটলো। অনল এবার যেনো নিশ্চিত হয়ে গেলো তার মা ভাতিজীর শোকে পাগল হয়ে গেছে। নয়তো সব জানা সত্ত্বেও এতো বড় একটা কথা পারতে পারতো না। সেলিম সাহেব পুনরায় অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আপা, তুমি ভেবে বলতেছো তো? অনলের সাথে বিয়ে এটা কিভাবে সম্ভব?
– আমি সব ভেবেই বলছি। আমি এবং অনল এই বাচ্চার ব্যাপারে সব জানি। আর আমার ছেলে, পাত্র হিসেবে তো খারাপ নয়। এখন তোমাদের আপত্তি থাকলে বলতে পারো
– কিন্তু আপা তুমি অনলের কথাটা একটু ভেবে দেখো। আমার মেয়ের জন্য সে তার জীবনটা কেনো নষ্ট করবে?
– সেটা আমি বুঝে নিবো, তোমরা বিয়ের ব্যাবস্থা করো।

সুভাসিনী বেগমের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলো অনল। তার মার উপরে কখনোই কোনো কথা বলতে পারে নি সে। কিন্তু মার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা যে সুভাসিনী বেগম জানেন না তাও নয় তবুও, তবুও জিদে বসে আছেন। অনল কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। ওখানে থেকে তার মাকে বুঝানো সম্ভব নয়। সেলিম সাহেবের কি এখন খুশি হওয়া উচিত নাকি চিন্তা করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেন না। নিজের বোনের বাড়িতে মেয়েটা বউ হয়ে যাবে এটাতো বেশ আনন্দের সংবাদ। নিজের বোন সব জেনেও তার ছেলের বউ বানাচ্ছে ধারাকে এটা ভেবেই মনে একটা স্বস্তি আভাস হচ্ছে তার কিন্তু অনল সব কিছু জানার পর ও কি ধারাকে মেনে নিবে! সেলিম সাহেব বেশ ভালো করেই জানেন তার বোন একবার বলে ফেলেছেন যখন তখন এই বিয়ে হবেই তবুও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ধারা চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না, আজ যদি দিগন্ত তাকে সাপোর্ট করতো তাহলে হয়তো এই দিনটাই দেখতে হতো না। বারবার নিজের মনে একটা চিন্তাই ঘুরছে তার এবং তার বাচ্চার পরিণতিটা কি হবে_____

রাত ১১টা,
নিজের রুমের সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে অনলের। সব ভেঙ্গে ফেললে হয়তো শান্তি হতো তার। মায়ের উপর মারাত্নক রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। অনলের বাবা রাজ্জাক সাহেবের সাথে সুভাসিনী বেগমের ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে অনলের সব কিছুই তার মা ছিলো। তার কাছে মা সবচেয়ে উপরে। আজ পর্যন্ত মা যা বলে এসেছে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। কিন্তু ধারাকে বিয়ে করার কথাটা যেনো মানতেই পারছে না। তার অগোছালো জীবনে কাউকে আনার কথা ভাবতেই পারে না অনল। রাগের বশে ধাপ করে টেবিলের উপর একটা কিল দিয়ে বসলো সে।
– আমার রাগ নির্জীবের উপর ঝেড়ে কি আদৌ শান্তি পাবে?

সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা শুনে চমকে উঠে অনল। পেছনে ফিরে দেখে সুভাসিনী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে মাত্রাতিরিক্ত স্বাভাবিক লাগছে। নিজেকে শান্ত করে অনল জিজ্ঞেস করে,
– তুমি ঘুমাও নি?
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো
– আমি বিয়ে করতে পারবো না মা
– কেনো?
সুভাসিনী বেগমের নির্বিকার ভঙ্গিমাতে প্রশ্ন করা দেখে অনল আরো অবাক হয়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বলে,
– তোমার তো অজানা নয় মা, তুমি ধারার জীবন সাজানোর নামে আরো এলোমেলো করে দিচ্ছো। আমি অকে কেনো কাউকেই নিজের জীবনে আসার অনুমতি দিবো না। একজন মৃত মানুষ কখনোই কারোর নবজীবনদাতা হতে পারে না মা। তোমার তো অজানা নয় একথা। আমি তো অনেক আগেই মরে গেছি। এখন আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
– নবজীবন নাই দিতে পারলো কিন্তু খড়কুটোর মতো বাঁচাতে তো সাহায্য করতে পারে।

অনল অবাক চোখে তাকাতেই তিনি আবার বলেন,
– ধারার এখন অবস্থাটা তোমার অজানা নয়। সে যাকে বিশ্বাস করেছে সে তাকে ঠকিয়েছে। ওই ছেলেটা হয়তো এই বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। নয়তো ধারা একবার হলেও জোর গলায় বলতো আমার বাচ্চার বাবা বেঁচে আছে, তোমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছো কেনো? আমি ধারাকে তোমার সাথে বিয়ে দিচ্ছে একটা কারণে যাতে মেয়েটা সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। তুমি তাকে ভালোবাসবে না, স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না কিন্তু একটা পরিচয় তো দিতেই পারো। তার বাচ্চাটাকে নিজের নাম তো দিতেই পারো। সেটাতেও কি বাঁধা আছে?
– কিন্তু মা?
– এমন ও তো হতে পারে, যে আসছে সে তোমাকে বাঁচতে শিখাবে। নতুন করে উজ্জীবিত হতে উদ্দীপ্ত করবে। হতে পারে না? তোমার আত্নাটা মরে গেছে অনল। কিন্তু সেটা বাঁচবে না এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। একটা মানুষ কিন্তু আবার প্রেমে পড়তে পারে, ভালোবাসতে পারে, বাঁচতে পারে। আর এটা আমার শেষ ইচ্ছে বলেও মেনে নিতে পারো। বয়স তো কম হলো না, একটা পুত্রবধু, নাতী পেলে কি খুব খারাপ হবে? আমি জানি, আমাকে তোমার খুব স্বার্থপর মনে হতে পারে। আমি সত্যি ই স্বার্থপর, এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টায় আছি। কি করবো বলো, আমি ও তো মা। ধারার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম। মেয়েটা তার বাচ্চাকে বাঁচাতে চায়। তার জন্য লড়াই করতে চায়। এটা কি খুব অন্যায় দাবি? হ্যা সে ভুল করেছে। হয়তো তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই ভুলটা করতো না কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করাটা হয়তো এতো বড় ভুল ও নয়। সেই মানুষটা তার হাত ছেড়ে দিয়েছে। এটার শাস্তি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে না নিশ্চয়ই। তাই না? তুমি ভেবে দেখো এক সপ্তাহ তো আছে। তোমার আপত্তি থাকলে আমি অন্য ব্যাবস্থা নিবো।

বলেই সুভাসিনী বেগম নিজের রুমে জন্য পা বাড়ালেন। তার প্রতিটি কথা অনলের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলেই কি আবার বাঁচাটা সম্ভব? আবার ভালোবাসাটা সম্ভব?

সকাল ৯টা,
সারারাত নির্ঘুম কেটেছে ধারার। চোখ মুখ ফুলে আছে। চোখগুলো অবিরাম ধারা বর্ষনে ক্লান্ত। শরীরটাও ভালো নেই। এতো চাপ এই সময়ে নেওয়াটা বাচ্চার জন্য ভালো নয়, কিন্তু এমন একটা ভাগ্য যে এতো সুন্দর সময়টা তার গলার কাটা হয়ে গেছে। একটা নারীকে মাতৃত্ব পরিপূর্ণ করে কিন্তু তার দূর্ভাগ্য এতোটাই যে এই মাতৃত্ব তাকে সমাজের কলঙ্কিনীর পরিচয় দিচ্ছে। সুরাইয়া বেগম একবারো তার সাথে কথা বলছেন না। আর সেলিম সাহেব নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। সব দেখছে আর প্রতিক্ষনে হাজারো বার মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করছে ধারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হিসাব মিলাতে যখন ব্যস্ত ধারা তখন……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি