কারণে অকারণে ভালোবাসি০২ পর্ব-৫০

0
723

#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি০২
#সুরাইয়া_আয়াত

৫০.

‘আচ্ছা আমার ডেলিভারির ডেট তো এগিয়েই এলো। সব মেয়েরা বাবার বাসায় গিয়ে থাকে ডেলিভারির আগে। আমি থাকবোনা? ‘

আরিশ আরুর পায়ের পাতায় তেল মালিশ করে দিতে দিতে বলল,
‘মামা মামী সপ্তাহে তোমাকে তিনদিন করে এসে দেখে যায়। আম্মু দিনের ১৬ঘন্টা তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। সানা কলেজ শেষে রোজ তোমার সাথে দেখা করে যায়। দুইজন এক হলে তো গল্প তো আর শেষ হয় না। আর আমি আবুলের মতো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। রুমে তো গল্পের সময় নো এন্ট্রি বোর্ড টাঙিয়ে দাও কি না।’

আরু আরিশের দিকে করুন ভাবে হেসে বলল,
‘তো কি হয়েছে। আপনি হসপিটালে থাকেন বলেই তো ওরা এতো বার আসে তাইনা। আপনি বাসায় থাকলে তো আর কাওকে লাগে না। আর সবাই আসছে তো কি হয়েছে। আমার কি ইচ্ছা করে না নাকি তাদের সাথে দেখা করতে। ‘

আরিশ আরুর দিকে বেশ রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কোথাও যাবে না তুমি বাসা ছেড়ে। দরকার হলে তোমার পুরো গুষ্ঠির লোককে আমি আমার বাসায় এনে রাখবো। এখন চুপ করো। মাঝরাতে এসব অন্যায় আবদার করো না আরুপাখি। ‘

আরু চুপ হয়ে গেল কিছু বললো না। মুখ গোমরা করে রইলো। আরিশ কিছুখন পরপর আরুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আরুর প্রেগন্যান্সির সাত মাস সময় থেকেই আরুর রাতে ঘুম আসে না আরিশকেও যেগে থাকতে হয় আরুর সাথে। আরুর পা গুলোও ফুলে গেছে বেশ। আরিশ রোজ বাসায় ফিরে আরুর পায়ে মালিশ করে দেয়, যদিও আরুর তাতে আপত্তি ছিল। আরিশ এবার তাকিয়ে দেখলো আরু চোখ বন্ধ করে আছে। আরিশ আরুর মুড ঠিক করতে বললো,
‘আরুপাখি। ‘

আরু উত্তর দিলো না। জবাব না পেয়ে আরিশ বলল,
‘আর মাত্র পনেরো দিন দেরি আছে তোমার ডেলিভারির। ‘

আরু রেগে উত্তর দিলো,
‘হ্যাঁ তো। ‘

আরুর কথা শুনে আরিশ বুঝলো আরু রেগে আছে। তাই শান্ত কন্ঠে বলল,
‘তারপর তোমার ডেলিভারি হবে আর আর্শিয়ান আসবে তাইনা। ‘

আরু রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ আর্শিয়ান আসবে কিন্তু আমি ওকে একদম আপনার কোলে দেবো না। আপনি এখনও আমার সাথে রেগে রেগে কথা বলেন হু। ‘

আরিশ বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে রইলো। আরিশ হাত মুখ ধুয়ে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ঠিক আছে ভুল হয়ে গেছে আর বকবো না তোমাকে। ‘
আরু মুখ গোমরা করে বলে উঠলো,
‘আপনি কি বুঝবেন আর। সেই রাত আটটা থেকে কেমন জানি হচ্ছে আর তারওপর আপনি বকাঝকা করছেন। ‘

আরিশ আরুর গালে হত রেখে বলল,
‘কেমন হচ্ছে তোমার? অসুস্থ লাগছে? কই একবারও বলোনি তো। ‘

আরু আরিশের বুকে মাথা রেখে বলল,
‘সব বলবো আগে সরি বলুন। ‘

আরিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
‘আমি সরি বলিনা। ‘

আরু মুখ গোমরা করে বলল,
‘ যান তাহলে বলবো না। ‘

আরিশ ধমকের সুরে বলল,
‘আরু পাখি কি হয়েছে বলো। নাহলে সমস্যা হতে পারে। ‘

‘ আমার ক্ষুদা লেগেছে তাই পেটের মধ্যে কেমন হচ্ছে। আপনি একটু খাবার নিয়ে আসেন না প্লিজ। দয়া করে ফল মূল খাওয়াবেন না যেন এই রাতে তাহলে কিন্তু আপনার গায়েই উল্টি করে দেব। ‘

আরিশ আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। আরুর দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘বিছানা থেকে এক পা ও নামাবেনা। পায়ে তেল দেওয়া আছে। ফ্লোরে পিছলে যাবে কিন্তু নাহলে। ‘

আরু মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘হমম হমম। আপনি এখন যান। আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন। আমার আর আর্শিয়ান দুজনেরই খুব ক্ষিদে পেয়েছে। ‘

আরিশ যেতে যেতেও বলল,
‘কোন রকম কোন সমস্যা হলে আমাকে ডাকবে। ‘

আরু মুখ গোমরা করে বলল,
‘ আরে আপনি যান না। ক্ষুদা লেগেছে তো। ‘

আরিশ দ্রুত গেল। মেয়েটা ওর অবাধ্য তা ও বরাবরই জানে তাই চিন্তা বেশি হয়, চোখেচোখে রাখতে হয়। আরিশ চলে যেতেই আরু হাই তুললো। বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন ঘুমায় তার জন্য রাতে আর ঘুম আসে না। আরু ওপর পাশে রাখা চিপসটা নিয়ে খেতে লাগলো। আরিশ আরুর হাতের আশেপাশেই ওর সব দরকারি জিনিস পত্র রেখে দেয় যাতে রাতবিরেতে বিছানা থেকে উঠতে না হয়।
চিপসটা খেয়ে আরু জল খেয়ে চোখটা বন্ধ করলো। আরিশ গেছে তাও দশ মিনিট হতে চললো। আরু বিড়বিড় করে বলল,
‘ বিরিয়ানি তো বানাতে বলিনি যে এতখন লাগবে। ‘

আরু আর একবার জল খেয়ে বোতলটা রাখতেই ওর টয়লেট পেলো। প্রেগন্যান্সিতে ইউরিন কন্ট্রোল হয় না খুব বেশি সময় এর জন্য। আরিশ আসছে না দেখে আরু নিজেই নামলো। ওর সেই পিঙ্ক কালারের টেডি দেওয়া জুতোটা পায়ে দিল যেটা আরিশ এনে দিয়েছিল। আরু গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই দরজার কাছে যেতে না যেতেই ওর প্রচন্ড লেবার পেইন শুরু হলো। পেটে হাত দিয়ে আরু বসে পড়লো। ব্যাথায় আহহহ করে চিৎকার দিতেই হঠাৎ অনিকা খান দ্রুত ছুটে এলেন। আরিশ খাবারটা ট্রে তে রাখতেই আরু আর ওর মায়ের চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে জলদি খাবার রেখে দৌড়ে ছুটে এলো। রুমে এসে দেখলো আরু ফ্লোরে বসে কাতরাচ্ছে। ওর আম্মু আরুর মাথাটা কলে নিয়ে বসে আর আরু কে ডাকছে ক্রমাগত। আরিশ আরুর হাতটা ধরতেই দেখলো আরুর চোখের কোনা বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়াচ্ছে। আরিশের বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। আরু ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে আর আরিশ কে যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। জলদি আরু কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে ভেবে আরিশ আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। কখনো কখনো ডেলিভারি ডেটের আগে অথবা পরেও হয়। তাই এটা সম্পূর্ণ বলা অনিশ্চিত নয় আবার হয়তো।

।।।।

হসপিটালের স্ট্রেচারে আরু কে রাখতেই হঠাৎ জ্ঞান হারালো আরু। আরিশ ডেকে উঠলো।
‘আরু পাখি। চোখ খোল। আমরা চলেই এসেছি হসপিটাল এ। দেখ। ‘

আরু চোখ খুললো না। আরাভ রয়েছে আরিশের পাশে। আরিশের পাশে থাকা আরিশের সিনিয়র ডক্টর মাহিন বলে উঠলেন,
‘ওনার যা অবস্হা তাতে ওনার নরমাল ডেলিভারি হওয়ার কথা কিন্তু ওনার তো জ্ঞান না ফিরলে ডেলিভারি করা যাবে না তাছাড়া বেশি লেট করলে বাচ্চাকে আর বাঁ*চা*নো যাবে না। ‘

আরিশের গলা শুকিয়ে এলো। বাইরে থেকে আরুর মায়ের আর অনিকা খানের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। চারিদিক যেন ঘোলাঘোলা লাগছে কেমন আরিশের কাছে।
আরিশের কান আর মাথা যেন একই সময় একটা নো সাউন্ড মোডে চলে গেল। কি করবে মাথায় আসছে না। আরিশ আরুর দিকে তাকালো, আরুর দু বাহু ঝাঁকিয়ে ধমকের সুরে বললো,
‘ এই মেয়ে চোখ খোল। তাকাচ্ছ না কেন? অন্য সময় তো কথা বলে বলে পাগল করে দাও এখন চুপ করে আছো কেন? ‘

আরাভ আরিশ কে টেনে ধরে বলল,
‘ দোস্ত শান্ত হ। এরকম করলে অবস্থা বেগতিক হবে। কি করবি এখন সেটা দেখ। ‘

ডক্টর মাহিম বলে উঠলেন,
‘দেখ আরিশ তোমার ওয়াইফের জ্ঞান ফিরছে না। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বেবির পোজিশান ও উল্টো। আর বেশি দেরি করলে বেবিকে হয়তো বাঁ*চা*নো যাবে না।
আরিশ আরুর দিকে তাকালো। বেশ কিছুখন তাকিয়ে রইলো। পাশ থেকে নার্স বলে উঠলেন,
‘স্যার ওনার জ্ঞান ফিরেছে। ওনার ডে*লি*ভা*রি করার ব্যাবস্থা করুন। ‘

আরিশ আরুর হাতটা ধরলো শক্ত করে। আরু আরিশ কে কিছু বলতে চলছে কিন্তু বলার ক্ষমতা টুকু আরুর মাঝে নেই। আরিশ আরুর গালে হাত রেখে বলল,
‘এই মেয়ে চোখ খুলে রাখো। একদম ঘুমাবেনা বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে। ‘

আরুর আর কোন সাড়া শব্দ পেলো না। আরিশ আরুর হাত ধরে ডাকতে লাগল কিন্তু আরুর জ্ঞান নেই। ডক্টর জলদি আরু কে ওটিতে নিয়ে গেলেন। আরিশও গেল। অবস্থা খুব বেগতিক হলে কাওকেই বাঁ*চা*নো সম্ভব হবে না হয়তো।

অপারেশন চলছে, সিনিয়র আরও দুজন ডক্টর দের সাথে রয়েছে আরিশ। আরিশকে দেখে আরুর হাত কাঁপছে। সিজার করার পর আরিশ সদ্যজাত বাচ্চাটা হাতে নিতেই আরিশের চোখ ভিজে এলো। এটা ওর ছেলে, তার আরুপাখির আর্শিয়ান। আর্শিয়ান কেঁদে উঠতেই ডক্টররা আরিশকে অভিবাদন জানতেন পাশ থেকে নার্স বলে উঠলেন,
‘স্যার পেশেন্টের হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। ‘

আরিশ আরুর দিকে তাকালো। একটা নিথর শরীর পড়ে আছে, না আছে কোন জ্ঞান আর না আছে কোন সাড়া শব্দ। যেই মেয়েটা সারাটা দিন একদন্ড চুপ করে থাকতো না সবসময় লাফালাফি ছটফট করতো আর আজ সে কতো নির্বাক, নিষ্প্রাণ। আরিশ বাচ্চাটাকে নার্সের হাতে দিয়ে আরুর কাছে ছুটে গেল। আরুর নাম ধরে ডাকলেও আরুর কোন সাড়াশব্দ নেই। আরিশের ক্রমাগত আরুপাখি ডাকেও আরু আর উঠলো না।

#চলবে,,,