কালোবউ পর্ব-০১

0
1490

🖤 #কালোবউ 🖤
লেখিকাঃ Tahmina Toma
মেঘ কন্যা তিলোত্তমা (ছদ্মনাম)

পর্বঃ১

বাসরঘরে আমি আকাশকে সালাম করতে গেলেই সে লাথি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো আমাকে। কপাল কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। সেদিকে আমার বা তার কারো খেয়াল নেই। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালাম 🥺🥺🥺।

আকাশঃ নিজের চেহারা দেখেছিস কখনো আয়নায়। তোর চুল আর মুখ এক রকমই লাগে। রাতের অন্ধকারে খোঁজে পাওয়া ও কষ্টকর। একদম আমার সামনে আসবি না। আমার যা দরকার ছিল আমি তা পেয়ে গেছি।

কথাগুলো বলেই সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।আর আমি মেঝেতে পড়ে কাঁদতে লাগলাম৷ আমাদের দেশে কালো আর শ্যামবর্ণ দুটোকেই কেউ কালো আবার কেউ শ্যামবর্ণ বলে। আমার গায়ের রং চুলের মত কালো না হলেও আমাকে শ্যামবর্ণও বলা চলে না। ছোটবেলা থেকে অনেকের অনেক কথা শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু আজকের কথাগুলো ঠিক হজম হচ্ছে না। কারণ আজকের কথাগুলো বলছে আমার ভালোবাসার মানুষ আমার স্বামী। আমি মেঘলা মনি। গায়ের রং দেখেই হয়তো নাম দেওয়া হয়েছিল। আমার গায়ের রঙ কালো।আমরা এক ভাই এক বোন। আমার ভাই আমার দু’বছরের বড়। নাম মাহিন হোসেন, গায়ের রং ধবধবে সাদা না হলেও ফর্সা বলা চলে অনায়াসে। লম্বা, চওড়া, ফর্সা অনায়াসে সুদর্শন বলা যায়, মায়ের রং পেয়েছে ভাই, আমার আব্বাও শ্যামবর্ণ আর আমি কালো। ভাবছেন আমার ফ্যামিলির সবাই ফর্সা তাহলে আমি কার রং পেলাম। আমার ফুপি আমার মত কালো। কিন্তু আল্লাহ তাকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছে।আমার ফুপা অনেক সুন্দর কিন্তু আমার ফুপিকে অনেক ভালোবাসে। গায়ের রং ফুপির মতো পেলেও কপালটা মনে হয় তার মতো পাইনি।ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই তুই তোর ভাইয়ের মত হতে পারলি না। তুই ফর্সা হয়ে তোর ভাই কালো হলেও কোন সমস্যা ছিল না। কারণ তোর ভাই ছেলে মানুষ। গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে সোনার আংটি বাকা ভালো। ছেলে তো ছেলেই কালো আর ফর্সা কী? কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। মেয়েদের হতে হবে দুধে আলতা গায়ের রং তবেই না মেয়ে। আমার আব্বারা তিন ভাই এক বোন। অনেকগুলো কাজিন আছে আমার সবাই সুন্দর শুধু একটা বড় আপু আছে শ্যামবর্ণ তবে আমার মতো কালো নয়। ছোটবেলায় আমার কাজিনরা বলতো এই তুই আমাদের ছুইবি না। আমরা তোর মত কালো হয়ে যাবো। ওরা হয়তো মজা করে বলতো তবু আমার খারাপ লাগতো। আমার সামনেই কত মানুষ আমার আব্বাকে বলেছে কিরে মেয়ে বিয়ে দিবি কীভাবে মেয়েতো কালো। বিয়ে দিতে যে অনেক টাকা লাগবে। আমার আব্বা তখন বলতো আমার মেয়ে আমি পড়ালেখা করাবো। আমার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সবাই অবহেলা করলেও আব্বা মার কাছে আমি রাজকন্যা ছিলাম। বাড়িতে মা আমাকে দিয়ে কখনো কাজ করাতো না। মা নিজে হাতে খাইয়ে দিতো। আমি শুধু পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া, টিভি দেখা নিয়ে থাকতাম। সবাই অনেক কথা বললেও স্কুলে ফ্রেন্ড ছিল অনেক। এভাবেই বড় হতে থাকি। আমার সুন্দরী বান্ধবীদের পেছনে ঘুরতে দেখতাম কতো ছেলেদের। আস্তে আস্তে ওরা প্রেম ও করা শুরু করলো। দু’একজন বান্ধবীদের বিয়ের জন্য দেখতে আসতো সেই গল্প শুনতাম। আবার দু’একজনের বিয়ে হয়েও গেলো। তাতে আমার কী আমিতো পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবো। কিন্তু পড়াশোনা আর করা হল কই। সবে এইচএসসি পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। হঠাৎ মা বিয়ে দিতে ওঠে পড়ে লাগলো। মা আমাকে ভালোবাসলেও যথেষ্ট বাস্তবিক মানুষ। আবেগ দিয়ে না বাস্তবতা দিয়ে সব বিবেচনা করে।মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছি বিয়ে একদিন করতেই হবে। একা একটা মেয়ের জন্য দুনিয়াটা যে বড্ড কঠিন। এমনিতেই কালো বয়স বেশি হয়ে গেলে আরও খারাপ লাগবে তাই ঠিক সময়েই বিয়ে দিতে চান। আব্বাও মার কথায় যুক্তি খোঁজে পান। ভাই রাজি না থাকলেও তার কিছু করার নেই। কারন সে বেকার তার কথা কে শুনবে। অনেক ছেলে দেখা হলো, আমাদের ছেলে পছন্দ হলে আমাকে তাদের পছন্দ হয় না আবার যারা বিয়ে করতে চায় তাদেরকে আব্বা মা পছন্দ করে না। অবশেষে আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে যেহেতু যৌতুক দিয়েই দিতে হবে তখন ভালো ঘরেই দিবে। আব্বার ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল সেটা আর বাড়ি ছাড়া যা ছিলো সব বিক্রি করে ভাইকে একটা সরকারি চাকরি দিলো আর বাকি টাকা আমার বিয়ের জন্য রাখলো। এরপর টাকার লোভে যারা বিয়ে করতে এসেছে তাদের আমি ইচ্ছা করে কোন না কোনভাবে তাড়িয়েছি। হঠাৎ একদিন আকাশ চৌধুরী আসে আমাদের বাড়িতে তার পরিবার নিয়ে। সে জানায় আমাকে নাকি ভার্সিটি থেকে আসার পথে দেখেছে আর ভালো লেগে গেছে। প্রথমে আমার কাছে খটকা লাগলেও তাকে দেখে আমারও ভালো লেগে যায়। তার চোখ দেখে মনে হয়নি সে মিথ্যা বলছে। আব্বা ভাই খোঁজ নিয়ে দেখে ছেলে হিসাবে সে অনেক ভালো তাই তারাও অমত করে না। বিয়ে হয়ে যায় নিয়ম মেনে। আব্বা কোনকিছুর কমতি রাখেনি তার আদরের মেয়ের বিয়েতে। আসার সময় আব্বা মা ভাই সবাইকে ধরে অনেক কেঁদেছি।সেটা হয়তো আমার নতুন করে কাঁদার শুরু ছিলো। আমার বিয়ের যৌতুকের জন্য যা টাকা রেখেছিল তাও দিয়ে দেয় আকাশকে। এবাড়িতে আসার পর তেমন আয়োজন নজরে এলো না আমার, তবু কিছু মনে করিনি। বাড়িটা অনেক সুন্দর বাইরে থেকে যতটা মনে হলো। শাশুড়ি মা আমাকে বরণ করলেন কেমন মুখ কালো করে। ভয়টা অনেক বেড়ে গেলো। আমার ননদ আমাকে আকাশের ঘরে রেখে চলে যায়। অপেক্ষা করতে থাকি উনার আসার, ভেতরে ভয়ে কুকরে আছি। রাত প্রায় ২ টার দিকে উনি রুমে আসে দুলতে দুলতে দেখে বুঝা যাচ্ছে নেশা করেছে। আরো ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকি আমি। কাঁপা কাঁপা পায়ে তার সামনে সালাম করতে গেলেই উপরের কথাগুলো বলে।

মেঘলাঃ হে খোদা সুখ কী আমার জন্য দুনিয়ায় দাওনি 😭😭😭।

(হঠাৎ খেয়াল করলাম সে বিছানা থেকে ওঠে আমার দিকে আসছে। এখন কী আবার মারবে নাকি?? নাকি নিজের অধিকার চাইবে?? 😰😰😰😭😭😭)

চলবে