কুহুকথা পর্ব-০৪

0
461

#কুহুকথা
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৪

,
,
সকাল সকাল সাধারণত সবার ঘুম ভাঙে পাখির কুহুতানে নয়তো মায়ের মিষ্টি শাসনে।কিন্তু কুহুর ঘুম ভাঙলো বিকট চেচামেচিতে।
কাঁচা ঘুম হঠাৎ করে ভাঙার দরুন কুহু চুপচাপ কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইলো।মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার।
রুম থেকে বেরোতেই বসার ঘরে চোখ পরলো।
পাশের বাড়ির আন্টি এসেছেন।
তিনি প্রায়ই এ বাড়িতে আসেন এবং মায়ের সাথে নানাবিষয়ে গল্প করেন।এবং মাঝেমাঝেই কুহুর বিরুদ্ধে কটুক্তি করেন।
নিজের মেয়ের প্রশংসা করতেও ভোলেননা।আন্টির ভাষ্যমতে তার মেয়ে বিশ্বসুন্দরী,বিশ্ব জ্ঞ্যানী।তার মতো মেয়ে এই দেশে কেনো পুরো দুনিয়ায় আর একটি নেই।
তার কাছে কুহু পিহু হচ্ছে তুচ্ছ মানবী।
যারা তার মেয়ের বাড়ীর কাজের লোক হবারও যোগ্য নয়।
তারপরও এই মহিলাকে কুহুর বেশ পছন্দ। কষ্ট আর বাস্তবতায় মোড়া এই পৃথিবীতে একটু বিনোদন হলে মন্দ হয়না।এই আন্টিটা হচ্ছে সেই বিনোদনের উৎস।
তার এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনলে কুহুর ইচ্ছে করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আন্টিটার নাম দিয়েছে সে বিনোদন আন্টি।
যে কিনা মুখ বাঁকা করে করে প্রত্যেকটা মেয়ের দোষক্রুটি বের করেন।
কুহুর মা আসমা বেগম নিতান্তই সহজ সরল মানুষ।তিনি পাশে বসে হু হা ছাড়া বারতি কোন কথাই বলেননা।
কুহু তাকে দেখেই হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলো।
পাশের বেতের মোড়াটা টেনে নিয়ে টুপ করে বসে পরলো।
আসমা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন,কুহুকে উঠে চলে যাবার জন্য।
কিন্তু কুহু নড়লো না।
সে এই মুহুর্তে বিনোদন পেতে চায়।তাছাড়া ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকে কেউ তাকে কিচ্ছুটি বলেনি।মা যদিও একটু ঘ্যানঘ্যান করেছিলো কিন্তু সেটা তেমন কিছুই না।
আর বাবা তো কিচ্ছু বললো না।
এখন কুহু হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর আন্টি তাকে সে বিষয়ে কথা শুনাতেই এসেছেন।
কুহু আগ্রহ নিয়ে বসে রইল।
মহিলা কুহুকে দেখে মুখ বাঁকা করলেন।
আসমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—আপা,আপনার এই মেয়েটার না বিয়ে হয়েছিলো?পরশু বিয়ে হয়েছিলো তাইনা?
তো সে এখানে কেনো?

মা মুখ কাঁচুমাচু করলেন।মেয়েদের দোষক্রুটি প্রতিবেশীদের কাছে বলে বেড়াতে কোন মা ই চাননা।তিনি আমতাআমতা করে বললেন,

—না মানে,আসলে।

–কি মানে মানে করছেন আপা?এই মেয়েটাও কি পিহুর মতো কাজ করলো নাকি?পিহু তো বিয়ের আগে পালিয়েছে,কুহু কি বিয়ের পর পালালো?

মা চুপচাপ মুখ ভার করে বসে রইলেন।
মায়ের কোন প্রতুত্তর না পেয়ে মহিলাটি কুহুর দিকে ফিরলো।বললো,

—তোমারও কি কুহুর মতো কেউ আছে?তা আগেভাগে বাবা মাকে বললেই তো পারো।শুধু শুধু বাবা মাকে হেনস্তা করা।
এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা যে কি হয়েছে না!

কুহু এতক্ষণ যাবত চুপচাপ কথা গিলছিলো।এবার সে আগ্রহ সহকারে বলে উঠলো,

—একদম সত্যি কথা বলেছেন আন্টি।

মহিলাটি ভ্যাবাচেকা খেলেন।সে বোধহয় কুহুর কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেননি।

—মানে?

—আরে মানে আবার কি?আপনার কথাটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাটি!
সত্যি এখনকার ছেলেমেয়েরা একদম বখে গেছে।বাবা মাকে কিচ্ছুটি বলেই না,শুধু শুধু তাদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করে।
বয়ফ্রেন্ড আছে বললেই পারে,তা না হাটে মাঠে, পার্কে তার সাথে চিপকাচিপকি করে বেড়ায়।

আন্টি নিজেকে সামলে নিলেন।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো।সব মেয়েগুলোরই এই দশা।
শুধু আমার সীমা আলাদা।ছেলেদের সাথে সম্পর্ক করা দুর তাদের সাথে কথা পর্যন্ত
বলেনা।কি ভালো মেয়ে!একেবারে আমার স্বভাব পেয়েছে!

কুহু অবাক হবার ভান করে বললো,

—তাই নাকি আন্টি? কিন্তু সেদিন যে শুনলাম সীমা নাকি কোন ছেলের সাথে কোথায় গিয়ে ধরা পরেছে?সে কি সত্যিই আপনার স্বভাব পেয়েছে?
ওমা!আপনি এমন ছিলেন নাকি?

আন্টি ফুঁসে উঠলেন।

—আপা,আপনার মেয়েটা তো বড্ড বেয়াদব!

আসমা বেগম কুহুকে শাসনের সুরে চোখ রাঙালেন।

—আহ, কুহু থাম তো!

কুহু অবাক হয়ে বললো,

—যাহ বাবা,আমি আবার কি করলাম?

,

আবির এইমাত্র রুমে ঢুকেছে।সে এতক্ষণ যাবত দাদুর রুমে ছিলো।
কাল থেকে দাদুর মন খারাপ।তিনি চুপচাপ ঘরে বসে ছিলেন।
খাওয়াদাওয়াও খুব একটা করেননি তিনি।মন খারাপের অন্যতম কারণ কুহু নামক মেয়েটা।
সে নাকি কাল বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
আবির মনে মনে খুশি হয়েছে খুব।বিয়েটা মানতে তার কষ্ট হচ্ছিল। কনের জায়গা তার ছোট বোনকে বউ হিসেবে সহজে মেনে নেওয়া যায় নাকি?
তবুও বুকের কোথাও একটা ভালোলাগা কাজ করছে।নিজের জন্য না,কুহুর জন্য।
মেয়েটার এই আত্মসম্মানবোধ আবিরের খুব ভাল লেগেছে।
আত্মসম্মানবোধহীন ব্যক্তি মেরুদণ্ডহীন সম।
আবির হোসেনের বউএর আর যাই থাক আর না থাক আত্মসম্মানটা থাকা খুব জরুরী।এবং সেটা কুহুর ভেতর আছে।
সে বিছানার উপর বসতেই রুনা বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
মুখটা তার ভার ভার।
আবির ভ্রু কুঁচকে মায়ের মুখপানে চাইলো।
তার মা কখনোই এমন চেহারা নিয়ে থাকেননা।তিনি থাকেন হিংস্র বাঘিনীর ন্যায়।যেনো উল্টা পাল্টা কিছু বললেই ঝাপিয়ে পরেন।
আবির রুনা বেগমের মন খারাপের বিষয় উদ্ভাবন করার জন্য বললো,

—মন খারাপ কেনো মা?

রুনা বেগম হয়তো এমনটাই চাইছিলেন।এইযে সারাটাদিন তিনি মুখ ফুলিয়ে ঘুরছেন কেউ জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি যে তোমার হয়েছে টা কি?জিজ্ঞেস করা দুর কেউ বুঝতেও হয়তো পারেনি।
শুধু একমাত্র আবিরই বুঝতে পারলো!
অতিরিক্ত খুশিতে রুনা বেগমের চোখে জল ভরে এলো।
চটজলদি জল মুছে আবিরের পাশে বসে পরলো।

—তোর দাদু আমায় পরশু কি বলেছে জানিস?

—এসব কথা আমি শুনবো না মা,তাছাড়া আজ তো আর কিছু বলেনি?বলেছে সেএএএই পরশু।ওতো পুরোনো কথার দাম থাকেনা।

রুনা বেগম ফুঁসে উঠলেন। এতক্ষণ যেই ছেলেকে মাথায় চড়াতে ইচ্ছে করছিলো এখন তার গালে ঠাস করে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে।রীতিমতো হাতের ভেতর চড় মারার জন্য নিশপিশ করছে।কিন্তু এতো বড় ছেলের গায়ে হাত তোলাটা বড্ড অনুচিত।
রাগে দুঃখে বললেন,

—আমার কষ্ট নতুনই হোক বা পুরোনো তবুও কষ্ট তো?আমার অপমানের দাম নেই তোর কাছে?
এতক্ষণ যাবত ফুলিয়ে ছিলাম কেউ লক্ষ পর্যন্ত করেনি,তুই একটু করলি।
ভাবলাম তোকে তোর পছন্দের পায়েশ রান্না করে খাওয়াবো।
কিন্তু নাহ্।খাওয়াবোনা।একদম না!
যা তুই তোর দাদু আর বাপের কাছে গিয়ে পায়েস চা গিয়ে।

—তাদের কাছে কেনো চাইবো?

—কারন তারাই তোর সব।আমি কেউ না।
আমার ফুটো পয়সার দামও নেই তোর কাছে।

আবির শব্দ করে হেসে উঠলো। তার মা এতো পাগল কেনো?কোথায় মায়ের উপর ছেলে মেয়েরা রাগ করবে,অভিমান করবে,তা না।উল্টো তার মা তার উপর রাগ করছে।

আবিরকে হাসতে দেখে রুনা বেগম মুখ আলুর আকৃতি করলেন।

—তুই আমার কষ্টে হাসলি আবির?তুই পারলি?দশমাস তোকে পেটে ধরেছিলাম আমি।আর তুই এই প্রতিদান দিলি?

আবির হাসতে হাসতেই মাকে একহাতে জড়িয়ে নিলো।
বললো,

—তুমি এমন বাচ্চামো কেনো করো বলোতো?

রুনা বেগম উত্তর দিলেননা।তিনি এখন নাক টানতে ব্যস্ত।
,

,
চলবে……