কুহুকথা পর্ব-০৫

0
379

#কুহুকথা
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৫

,
,
–বাস কখন আসবে বলতে পারেন?

কুহু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।টিউশনিতে যেতে তার আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে তার।টিউশনি সব ছেড়ে চাকরী করার ইচ্ছে থাকলেও সে করতে পারছেনা।চাকরী মায়ের হাতের মোয়া নয়।ইন্টারভিউ দিতে দিতে জুতা খয় হতে চললো তবু একটা চাকরী হলোনা।কাকা-মামার জোর না থাকলে কখনো হবে কিনা তারও ঠিক নেই।
তারউপর আবার এই বাস!কখন থেকে অপেক্ষা করে চলেছে কিন্তু আসার নাম গন্ধও নেই।
সে বিরক্ত মুখে বললো,

—আমি জানিনা!

আবির চুপচাপ পাশে দাড়ালো।আজ তার দিনটাই খারাপ।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হলো মায়ের কান্নাকাটিতে।দাদু নাকি আজ তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।সেই নিয়ে মায়ের কি চেচামেচি। তিনি সাফ সাফ জানালেন তিনি আজই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।যেই বাড়িতে তার কোন দাম নেই সেই বাড়িতে তিনি থাকবেননা।
কাপড় চোপড় গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফেরত এলেন।মুখ ফুলিয়ে বললেন,

—আমাকে কেউ আটকাচ্ছো না কেনো?বাড়ির বউ ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর তোমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছো?

মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে আনার পর হলো আরেক কান্ড! আবিরের অফিসের ফাইল খুজে পাওয়া গেলোনা।পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করেও কোন হদিস মিললো না।জুতো পরার সময় দেখা গেলো একটা জুতা আছে অন্যটা নেই।অবশেষে বাধ্য হয়ে বাবার জুতা পরতে হলো।
যদিও খারাপ লাগছেনা দেখতে।তবুও নিজের কাছে একটু আনইজি লাগছে।

রাস্তায় বেরিয়ে হলো আরো এক মুসিবত। অর্ধেক পথ আসতে না আসতে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলো।আবির ড্রাইভারকে পাঠালো মেকানিকের কাছে।আর নিজে এলো বাস খুজতে।
নেহাৎ আজ অফিসে ইম্পর্টান্ট এক মিটিং আছে,নয়তো এতো কিছুর পর কখনোই অফিসে যেতো না সে।
আবির ভাবলো আজকের ডেটটা সে ক্যলেন্ডারে দাগিয়ে রাখবে এবং মন দিয়ে স্মরনে রাখবে।
এই তারিখে সে আর কক্ষনো বাড়ি থেকে বেরোবেই না।

পাশে দাড়ানো গোমড়ামুখো মেয়েটাকে বারকয়েক আড়চোখে দেখলো সে।কেনো যেনো খুব চেনা চেনা লাগলো।মনে হলো,মেয়েটাকে কোথায় যেনো দেখেছে।
কিন্তু কোথায় দেখেছে?আবির মনে করতে পারলোনা।আশ্চর্য!তার স্মৃতিশক্তিতো এতো দূর্বল ছিলোনা কখনোই।তবে আজ কি হলো?
একটু গলা খুকখুক করে কথা বলার পরিবেশ তৈরী করলো।বললো,

–এইযে,শুনছেন?

কুহু উত্তর দিলোনা,বরং তার গম্ভীর মুখে আরও একটু গম্ভীরতা যোগ হলো।
আবির বললো,

—আপনাকে কি আমি চিনি?

কুহু চোখ কুঁচকে তাকাতেই সে আমতাআমতা করলো।

—না মানে খুব চেনা চেনা লাগছে,কোথায় দেখেছি বলুনতো?

—কোথাও দেখেননি।

—কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে দেখেছি।

–কোথায় দেখবেন আমায়?আপনারা বড়লোক কোটিপতি মানুষ আর আমরা ফকির।আপনারা থাকেন নামীদামী জায়গা আর আমরা থাকি বস্তিতে।আমাদের দেখা হবে কেনো?

কুহুর তেজি কন্ঠে আবির একটু ঘাবড়ে গেলো।

–এমনভাবে কথা বলছেন কেনো?

কুহু তেড়ে গেলো।
—কেমন ভাবে বলছি?খারাপ ভাবে?আমি খারাপ মানুষ,অভদ্র মানুষ তাই এমনভাবে বলি বুঝছেন?

–আরে আমি কি এসব বলেছি?

—তো কি বলেছেন?

—আপনি আমার উপর রেগে আছেন কেনো বলুনতো?

—আমি কেনো আপনার উপর রাগতে যাবো?আপনি কি আমার বিয়ে করা বর?নিজের বউকে চিনতে পারছেননা?তাই রাগবো?কেনো রাগবো আমি আপনার ওপর?কে হন আপনি?

আবির ভেবাচেকা খেলো খুব।তার কেন যেনো মনে হচ্ছে মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে।ব্যাপক সমস্যা! নয়তো অচেনা অজানা কারো সাথে এভাবে কথা বলবে কেনো?তার আফসোস হলো খুব!এতো অল্পবয়সী মায়াবী মুখের মেয়েটার কিনা মাথায় সমস্যা? ইশ!
,

,

টিউশনিতে এসেও কুহুর রাগ কমলোনা।অকারনে তার ছাত্রীকে বকলো খানিক্ষন। রিমা নামক ছাত্রীটা হোমওয়ার্কের অংক করা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললো,

—আপু আজ এই কয়টা অংক করেছি,দুটো পারিনি।একটু বুঝিয়ে দেবেন?

কুহু কথাটা শোনার সাথে সাথেই এক ইয়া বড় রাম ধমক দিলো।ইচ্ছে মতো ঝারলো।তবুও রাগ না কমায় বেত দিয়ে হাতে পটাপট দুটো বাড়ি বসালো।
অবশেষে ক্ষান্ত হয়ে মাথায় হাত পরলো তার।
মেয়েটাকে অংকটা বুঝিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যেতো।শুধু শুধু মারতে গেলো কেনো?রিমার মা বড্ড ত্যাদড় মহিলা।একটু পর পর এসে মেয়ের পড়ার বিষয়ে তদারকি করে যান এবং বারবার সাবধান করেন, তার মেয়ের গায়ে যেনো ফুলের টোকাও না পরে।
তার খুব আদরের মেয়ে!
কুহু বড়সড় ঢোক গিললো।মহিলাকে দেখতেই কেমন দজ্জাল দজ্জাল লাগে।কেমন মোটাসোটা শরীর নিয়ে গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকে।যেনো একটু এদিকওদিক হলেও তার মস্ত ওজনের হাত দিয়ে এক ঘুসি দিয়ে উড়িয়ে দেবেন।
রিমার কাঁদোকাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে কুহু হাসার চেষ্টা করলো।তবে মুখ ফুটে হাসি বের হলোনা।সে কোনমতে বললো,

—আজ আমার মনমেজাজ বেশি ভালো নেই তো,তাই আরকি।আজ আসি হ্যাঁ?
কাল আসবো।

কুহু একথা বললেও সে জানে কাল সে আর আসবে না।কাল কেনো?আর কখনোই আসবেনা।ওই দজ্জাল মহিলার সামনে পরার ইচ্ছে তার আর নেই।তার আদরের মেয়ের হাতে বেতের দাগ দেখলে তিনি কি কান্ড করবেন ভাবলেই কুহুর গা হিম হয়ে যাচ্ছে।
শুধু দুঃখ হচ্ছে বেতনের জন্য।মাসের শেষের দিকে এসে টিউশনিটা ছেড়ে দিতে হলো।আবার আরেকটা টিউশনি খুঁজতে হবে এখন।
সবদোষ ওই আবির নামক লোকটার।কতোবড় সাহস তার,নিজের বিয়ে করা বউকে চিনতে পারেনা?বলে কিনা,আমি কি আপনাকে চিনি?বেটা গর্ধভ!
মনে মনে বেশ কিছুক্ষণ গালাগালি করলো কুহু।
পরমুহূর্তেই চমকে উঠলো।আবির তাকে চেনেনি বলে সে রাগছে কেনো?তার তো খুশি হওয়া উচিৎ। চিনে ফেলে যদি বলে উঠতো,

—আরে আপনি কুহু না?বাড়ি ছেড়ে সেদিন কেনো চলে এসেছিলেন আপনি?চলুন,এক্ষুনি বাড়ি চলুন!বউয়ের দায়িত্ব পালন করে সংসার সামলান।

তখন কি করতো কুহু?কি হতো তার বাবা মায়ের?কে দেখতো তাদের?

,

,

কুহু বাড়ি ফিরলো মুখ গোমড়া করে।আসমা বেগম দরজা খুলেই মেয়ের গোমড়া মুখ দেখে উদ্দিগ্ন হলেন।
বললেন,

—কি হয়েছে তোর কুহু?এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?

—কেমন দেখাচ্ছে?

—কেমন যেনো ক্লান্ত, এলোমেলো!চোখমুখ এমন ফোলাফোলা কেনো তোর?

–গাজা খেয়েছি তো তাই।

আসমা বেগম আঁতকে উঠলেন।

—কিহহ্?

—আস্তে বলো মা,বাবা উঠে যাবে তো!
আরে বাবা,সারাদিন টিউশনি করালে একটু ক্লান্ত তো দেখাবেই নাকি?

—ওহ,তাই বল!আয় তোকে খেতে দেই।

—খেতে ইচ্ছে করছে না মা।

—সেকি?কেনো?শরীর ঠিক আছে তো?
জ্বর টর বাধিয়েছিস নাকি?

তড়িঘড়ি করে কুহুর গায়ে মাথায় হাত রাখলেন।জ্বরের কোন চিহ্ন না পেয়ে হাফ ছাড়লেন।
বললেন,

—একটু খেয়ে নে মা।আয়,নয়তো শরীর খারাপ করবে তো।

কুহু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।কিছু কিছু মমতামাখা ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা কোন মানুষেরই থাকেনা।

,

চলবে…..