কুহেলিকা পর্ব-৪

0
5868

“কুহেলিকা”
পর্ব-৪
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
.
.
বৈঠকখানায় সকলেই গম্ভীর হয়ে বসে আছে সেই হুমকি বার্তাটা নিয়ে। ছোট মা তো রীতিমত ক্ষেপে আছে নন্দিনীর উপর। রাগটা নিজের মধ্যে রাখতে না পেরে বলেই ফেললেন,
“একটা অপরিচিত মেয়েকে বাড়িতে আনার মজা বুঝতে পারছিস তো এখন? এই মেয়ে যদি আমাদের বাড়িতে কোনো ভাবে মারা যায় এর দায় কি তুই নিবি রিশাদ? শেষমেশ আমাদের বাড়িতে এসে জুটল ব্ল্যাক ম্যাজিকের কারবার!
আর রিশাদের বাপ তোমায়ও বলি, তুমি কিছু বলছ না কেন? এই মেয়েকে তুমি বাড়ি থেকে বের করবে নাকি আমি বেরিয়ে যাব বলো তো।”
অপমান আর লজ্জায় নন্দিনী মাটিতে মিশে যাচ্ছে। বড় মা ধমকে বলেন,
“আহ্ ছোট! এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন? মেয়েটা অসহায় বলেই তো রিশাদ এই বাড়িতে এনেছে। আজকে যদি নন্দিনী তোর মেয়ে হতো? পারতি এমন কথা বলতে?”
“আপা অযৌক্তিক কথা বলো না তো। ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাণ্ডকারখানা হচ্ছে বুঝতে পারছ তুমি? এই মেয়ের কারণে যে আমাদের জীবন যাবে না তার কোনো ইয়ত্তা আছে?”
“আমার ছেলেমেয়ে নেই আমি বুঝি নিঃসন্তান হওয়ার কষ্ট ঠিক কতটা। মেয়েটাকে দেখলে আমার মায়া হয়। আমার মনে হয় আল্লাহ্ চাইলে আমাকেও একটা সন্তান দান করতে পারত।”
এবার ছোট মা চুপ হয়ে যায়। এমনিতে যাই হোক না কেন দুজনের মধ্যেই সম্পর্ক খুব ভালো। কেউ দেখলে বুঝবেই না যে ওরা সতীন। বরং সবাই ভাববে ওরা দু’বোন।

হাসিব বড় মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমাদের আগেই কিছু করতে হবে। সতর্ক না হলে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।”
তোয়া এখানেই উপস্থিত ছিল। তোয়া বলে,
“কী করবি শুনি? পুলিশে জানাবি? এই পর্যন্ত পুলিশ কিছু করতে পেরেছে কি?”
“না পুলিশে না। এবার ডিটেকটিভের সাহায্য নেব। এখানকার যে পুলিশ আছে দিদার ভাই? উনার এক বন্ধু শুনেছি ডিটেকটিভ। তিনি নাকি খুনের রহস্য বের করার জন্য চেষ্টা করছেন।”

ডিটেকটিভের কথা শুনতেই তোয়া আর ছোট মা আৎকে উঠে। ছোট মা তড়িঘড়ি করে বলে,
“না, না। কোনো পুলিশে-টুলিশে জড়াবি না একদম।”
রিশাদের বাবা বলেন,
“এছাড়া আর করব টা কী আমরা? চুপ করে হাত-পা গুঁটিয়ে বসে থাকব? নন্দিনীর পরের টার্গেট তো তুমি, আমিও হতে পারি।
হাসিব তুই থানায় ফোন কর। আসতে বল তাদের।”
হাসিব বারান্দায় চলে যায় ফোন করতে। পেছন পেছন তোয়াও যায়। তোয়া হাসিবের হাত ধরে বলে,
“মাঝখানে গোয়েন্দা কেন টানছিস বুঝতেছি না।”
“অদ্ভুত! নন্দিনীকে কেউ মারার হুমকি দিচ্ছে আর আমি চুপ করে থাকব?”
“সেটা বলিনি। অন্যকিছু করার চেষ্টা কর। তবুও ডিটেকটিভ ডাকিস না।”
“তুই বাঁধা দিচ্ছিস কেন? নন্দিনীকে ঐ হুমকি বার্তা তুই দিয়েছিস?”
“আজব! আমি কেন এমনটা করতে যাব?”

হাসিব আর কোনো কথা না বলে দিদারকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়। দিদার বলেছে বিকেলে মুহিবকে নিয়ে আসবে। ফোন রাখার পর তোয়া রেগে বলে,
“বারণ করার পরও শুনলি না তাই না? এর ফল না ভোগ করতে হয় কাউকে।”
কথাটা বলেই তোয়া চলে যায়।
.
নন্দিনী মনমরা হয়ে রুমে বসে আছে। হঠাৎ করে কে ওর পিছে লাগল? নন্দিনী তো কখনো কারো ক্ষতি করেনি। ব্ল্যাক ম্যাজিকের শিকার কি তবে শেষমেশ নন্দিনীও হলো!

বিকেলের দিকে মুহিব আর দিদার আসে। ওদের সামনে বসে আছে রিশাদ, নন্দিনী, হাসিব আর তোয়া। ছোট মা রান্না করছে। বড় মা ঘুম। রিশাদের বাবা ক্ষেতে গেছেন। হুমকি বার্তাটা নিয়ে মুহিব নাড়াচাড়া করছে
ছোট মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে রিশাদকে বলে,
“ম্যাচটা দে তো। রান্নাঘরের ম্যাচের গ্যাস শেষ হয়ে গেছে।”
“তুমি এখনো রান্না করছ? উনারা এসেছে। এখানে বসো এখন।”
“চুলোর জ্বালটা ধরিয়ে দিয়েই আসছি। তুই কিসমতকে বাজারে পাঠা গ্যাস ম্যাচ আনার জন্য।”
“সেটা পরে পাঠাবনি। এখন আসো তো। বড় মাকেও ডাক দিয়ো।”
মুহিব জিজ্ঞেস করে,
“আমি কি বাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে পারি? তার আগে নন্দিনী ম্যামের রুমটা দেখতে চাই।”
রিশাদ বলে,
“হ্যাঁ অবশ্যই। আমার সাথে আসুন।”
সবাই রিশাদের পেছন পেছন যায়। নন্দিনীর রুমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মুহিব।
“নন্দিনীর বামপাশের রুমটা কার?”
“হাসিব আট আমার। আর শেষের ঘরটা মায়ের।”

মুহিব নন্দিনীর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হাসিব আর রিশাদের রুমে যায়। ওদের রুমটাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়েও দেখছে। শেষে যায় বড় মায়ের রুমে। কিন্তু সেখানে সকলেই অবাক হয় একটি ঘটনা দেখে। বড় মায়ের পিছনে একটা মোমবাতি জ্বালানো। শাড়ির আঁচলটাও কাছে। যেকোনো সময়ে আগুন লেগে যাবে। শীতের দিন বিধায় রুমের ফ্যানও বন্ধ। সবাই রুমের ভেতর যায়। রিশাদ মোমবাতিটা নিভিয়ে বড় মাকে ডেকে তোলে।
“বিছানায় মোম জ্বালিয়ে শুয়ে আছো কেন?”
বড় ঘুম ঘুম চোখে বলে,
“কীহ্! কোথায় মোম? আমি তো কোনো মোম জ্বালাইনি। দিনদুপুরে মোমই বা জ্বালাব কেন?”
“তাহলে কেউ কি ইচ্ছে করে এটা করেছে?”
মুহিব বলে,
“ঘটনা কিন্তু এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে মিস্টার রিশাদ। কেউ ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে।”
“বাড়িতে এসব হচ্ছে কী!”
“চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কী করা যায়!”
সেদিনের মতো মুহিব সবার সাথে কথা বলে চলে যায়।
.
রাতের বেলায় খাওয়ার টেবিলে তোয়া একটা চিরকুট পায়। চিরকুটে লেখা,
“ভুলেও নন্দিনীর ক্ষতি করার চেষ্টা করো না। নন্দিনী আমার শিকার। ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করে নিজের মৃত্যু ডেকে এনো না।”
চিরকুটটা দেখে তোয়া একটু ঘাবড়ে যায়। এখানে চিরকুট রাখবে কে? ছোট ভাই? ও তো নন্দিনীকে চিনেই না। তাহলে কে রাখল? দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় তোয়া। পরক্ষণেই ভাবে,
“নির্ঘাত এটা হাসিবের কাজ! কাউকে দিয়ে হয়ত লিখিয়েছে। কিন্তু গাঁধাটা তো আর জানে না, এই তোয়া কাউকে ভয় পায় না। নিজেরটা তো আমি আদায় করে নেবই।”
.
.
বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী। রাত দুটো ছুঁইছুঁই। ঘুম আসছে না একটুও। সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুর পেছনেই নন্দিনী নিজেকে দায়ী করছে।
“তুমি কি ভয় পাচ্ছো প্রিয়তমা?”
অচেনা পুরুষালী কণ্ঠ থেকে কথাগুলো শুনতে পেল নন্দিনী। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না।
“আমায় তুমি দেখতে পাবে না। তবে শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। ভয় পেয়ো না কিন্তু।”
নন্দিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“ক…কে আপনি?সা..মনে আসেন না কেন?”
বিদঘুটে হাসিব শব্দ শুনতে পায় নন্দিনী। ভয়ে দৌঁড়ে যাওয়ার সময় ধাক্কা খায় রিশাদের সাথে। পাশেই হাসিব দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিনী ভয়ে ভয়ে সব বলে। রিশাদ বলে,
“এসব পরে শুনব নন্দিনী। এখন আমাদের তোয়ার বাসায় যেতে হবে।”
নন্দিনীকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মাকে ডাকে রিশাদ। বাবা দরজা খুলে বলেন,
“কী হয়েছে? এত রাতে ডাকাডাকি করছিস কেন?”
“বাবা! তোয়া বিষ খেয়েছে!”
রিশাদের কথা শুনে সবাই বেশ অবাক হয়ে যায়। ছোট মা বলেন,
“এসব কী বলছিস? কে বলল তোকে?”
“তোয়ার মা ফোন দিয়েছিল। এখন আমি আর হাসিব যাচ্ছি।”
“আমরাও যাব সাথে।”
“না। এত রাতে আসার দরকার নেই। সকালে এসো তোমরা।”
হাসিব আর রিশাদ যাওয়ার পরই ছোট মা কথা শোনাচ্ছে নন্দিনীকে।
“তোমার জন্যই সব হচ্ছে। অপয়া মেয়ে একটা। তোয়া বিষ তোমার জন্যই খেয়েছে। রিশাদ আর ওর মাঝে কেন এসেছিলে? প্রেম-পিরিতি চলে রিশাদের সাথে? তোয়া নিশ্চয়ই সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়েছে।”
একের পর এক কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন তিনি। নিরবে চোখের পানি ফেলছে নন্দিনী। নন্দিনী রুমে যাওয়ার সময় রিশাদ ফোন করে বাবার ফোনে। ফোনে জানায় হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তোয়া মারা গেছে।
নন্দিনীর কান্নার বেগ বেড়ে যায়। এখন তো আরো কথা শোনাবে সবাই। দেয়ালের সাথে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো একটা লেখা দেখতে পায় নন্দিনী।
“তুমি তো আমার শিকার নন্দিনী। ঐ তোয়া কেন তোমায় মারবে? তাই আমিই ওকে সরিয়ে দিয়েছি আমার পথ থেকে। আর ঐ ডিটেকটিভের সাহায্য নেওয়া বন্ধ করো। নয়ত এর শিকার কিন্তু ঐ ডিটেকটিভও হতে পারে।”
নন্দিনী অবাক হয়ে যায় লেখাটা দেখে। তার মানে তোয়া স্বেচ্ছায় বিষ খায়নি! ওকে মার্ডার করা হয়েছে! নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কে তুমি? কেন এমন করছ? কেন খুন করছ? আমার সাথে কী শত্রুতা তোমার? আর যদি কোনো শত্রুতা থেকেও থাকে। তাহলে আমায় মেরে ফেলো। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না।”

চলবে…..