কৃষ্ণডাহুক পর্ব-১০+১১

0
223

#কৃষ্ণডাহুক – ১০
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

থমথমে পরিবেশ! অরিনের স্থির দৃষ্টিপাত বিছানায় নিস্তেজ হয়ে পরে থাকা মীরার দিকে। নেত্রপল্লবে অশ্রু চিকচিক করছে যেনো যেকোনো সময় গাল বেয়ে টুপ করে মেঝেতে পড়বে!

বাথরুমের দরজা খট করে খুলে আদ্রিক বের হলো। বিরক্তিমাখা দৃষ্টিপাত তার। আদ্রিক অরিনকে নিজের রুমে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। অরিনের দৃষ্টিপাত অনুসরণ করে ঘুমন্ত মীরার দিকে তাকালো। সামান্য স্তম্ভিত হয়ে অরিনের দিকে ফের তাকালো। অরিন আদ্রিককে উদ্দেশ্য করে বিচলিত কণ্ঠে বলল,’ মীরা এখানে কি করছে আদ্রিক? ‘

অরিনের রুদ্ধ কণ্ঠস্বর! মানুষ কিছু পারুক আর না পারুক নিজের প্রিয় মানুষটিকে স্বচোখে কারো অধীনে দেখতে পারবে না! প্রিয় মানুষটা যে মানুষের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়!

আদ্রিক প্রথমে থতমত খেলেও পরমূহুর্তে নির্দ্বিধায় বলল,’ দেখতে পারছো না? ‘

অরিন আঁখিযুগল বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিলো! রাগের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে যে তার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ তুই এতো কথা প্যাঁচানো কিভাবে শিখেছিস আদ্রিক? ‘

আদ্রিক তাচ্ছিল্যের হাসলো। গম্ভিরমুখে বলল,’ তুই চলে যা। ‘

অরিন ঘৃণিত দৃষ্টি ফেলল আদ্রিকের উপর। আদ্রিক পরোয়া করলো না। অরিনের দৃষ্টি উপেক্ষা করে আলমারী থেকে নিজের শার্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অরিনকে পাশ কাটিয়ে। অরিন নির্বিকার ভঙ্গিতে আদ্রিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো! আদ্রিক কি মীরাকে পছন্দ করে? কেনো মীরার প্রতি তার এতো ভালোবাসা? এতো যত্ন! মীরার প্রতি আদ্রিকের এই অসীম ভালোবাসা ও যত্ন মানতে যেনো মীরার কষ্ট হচ্ছে! মানবেই বা কি করে? কেউ তার প্রিয় মানুষের ভাগ, তার ভালোবাসার ভাগ কি করে অন্য কাউকে দিবে? আদৌ কি আদ্রিক তাকে ভালোবাসে?

‘ অরিন? আমি কি ভিতরে আসবো? ‘

মার্জিয়া বেগম মন্থর কণ্ঠে বলে উঠলেন। অরিন দ্রুত দরজা খুলে দিয়ে বলে,’ অনুমতির কি প্রয়োজন ছিলো?তুমি আমার মা সমতুল্য যখন ইচ্ছা তখন আসতে পারো। ‘

বলতে বলতে নিজের চোখের পানিটুকু মুছে নিলো অরিন। তা খেয়াল করলো মার্জিয়া বেগম। সন্দিহান দৃষ্টি তাকালেন তিনি অরিনের পানে! অরিন অপ্রস্তুত হাসলো। মার্জিয়া বেগম বললেন,’ তুমি কাঁদছিলে অরিন? ‘

‘ কোথায়? না তো! ‘

প্রতুত্তর করলেন না মার্জিয়া বেগম। বিছানায় বসতে বসতে বললেন,’ তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো! ‘

একটু দম নিয়ে নিজের পাশে ইশারা করে বলেন,’ আমার পাশে এসে বসো। ‘

অরিন বাধ্য মেয়ের মতো মার্জিয়া বেগমের পাশের স্থানে যেয়ে নতজানু হয়ে বসলো। মার্জিয়া বেগম স্মিত হেসে বলেন,’ তুমি আদ্রিককে পছন্দ করো? ‘

মার্জিয়া বেগমের কথায় অরিন চমকে তাকালো তার দিকে। তার ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান!

‘ বলো? করো আদ্রিককে পছন্দ? ‘

অরিন নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,’ করি। ‘

মার্জিয়া বেগম চমৎকার হাসলেন প্রতুত্তরে! ঠোঁটে যেনো তার বিশ্ব জয়ের হাসি!

‘ আদ্রিককে বিয়ে করতে চাও? ‘

মার্জিয়া বেগমের বিচলিত কণ্ঠস্বর অরিনের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অরিন আকাশ সমান চমকে গেলো! বিস্ফোরিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মার্জিয়া বেগমের দিকে। অরিনের বোধগম্য হলো না এর প্রতুত্তরে সে কি বলবে? তবে যদি না বলে তাহলে তার আদ্রিককে হারাতে হবে! আদ্রিককে সে কিছুতেই হারাতে পারবে না! অরিনের মনে হলো আদ্রিককে নিজের বাঁধনে ধরে রাখার এক মাত্র উপায় হলো বিয়ে! বিয়ে ছাড়া আদ্রিক কিছুতেই তাকে ভালোবাসবে!

অরিন সাত পাঁচ ভেবে চট জলদি মাথা নাড়ালো উপর নিচ। মার্জিয়া বেগম ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন। অরিনকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’ আমার আদ্রিকের জন্য তুমি ছাড়া আর কোনো ভালো মেয়ে আমি পাবো না! আমি সেই কবে থেকেই তোমাকে আদ্রিকের বউ হিসেবে কল্পনা করে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম আদ্রিকের জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ আনবো ঠিক তোমার মতো। ‘

অরিন জবাবে হাসলো পরক্ষণেই চিন্তিত মুখে বলল,’ আদ্রিক রাজী না হলে? ‘

মার্জিয়া বেগম উৎসুক চোখে বলেন,’ আদ্রিক আর তুমি কতো বছর ধরে একসাথে আছো? ‘

‘ প্রায় দশবছর ধরে, কিন্তু কেনো বলো তো? ‘

‘ একটা ছেলের সাথে তুমি দশ বছর ধরে আছো, ছেলেটা অবশ্যই তোমার প্রতি অভ্যস্ত! আদ্রিকের মনে তোমার জন্য ভালোবাসা আছে আমি জানি! আমার ছেলে অনেকটাই চাপা স্বভাবের। কাউকে সহজে কিছু বলতে চায় না। ‘


‘ আদ্রিক আমরা গ্রামে যাবো কাল। ‘

মার্জিয়া বেগমের কথায় আদ্রিক সোফা ছেড়ে উঠে বসলো। হতবাক সুরে বলল,’ হুট করে গ্রামে যাওয়ার কথা বলছো কেনো? ‘

‘ কতদিন ধরে গ্রামে যাই না আমরা! তুইও তো দেশে এসেছিস তাহলে তো যাওয়া উচিত তাই না? ‘

মায়ের কথায় আদ্রিক সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো মার্জিয়া বেগমের দিকে! মার্জিয়া বেগম তাতে থতমত খেলেন। আদ্রিক বলল,’ তুমি কোনো মতলব আটছো না তো? না মানে তুমি তো গ্রামে যাওয়ার মতো মানুষ নও। ‘

‘ ওখানে তোর দাদার ভিটেমাটি রয়েছে! তোর বাবার জন্মস্থান ওটা। বছরে তো একবার যাওয়াই উচিত! ‘

আদ্রিক প্রতুত্তর করলো না। মার্জিয়া বেগম ফের বললেন,’ তুই কি যাবি আদ্রিক? ‘

‘ মীরা যাবে? ‘

আদ্রিকের কথায় মার্জিয়া বেগমের মনে সন্দেহ জাগলো! তার ছেলে হঠাৎ মীরার কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো?

আদ্রিক ফের বলল,’ মীরা গেলে আমি যাবো, নয়তো বাদ দাও। ‘

আদ্রিকের কথায় মার্জিয়া বেগম চিন্তিত হয়ে পড়লেন! ছেলেকে গ্রামে নিতে হলে মীরাকেও নিতে হবে! মীরা গেলে তবেই আদ্রিক যাবে! তিনি তো ভেবেছেন আদ্রিককে তার বিয়ের ব্যাপারে না জানিয়ে গ্রামে নিয়ে যেয়ে একেবারে তার বিয়ের কথা বলবেন। মার্জিয়া বেগম আর না ভেবে বললেন,’ হ্যাঁ অবশ্যই যাবে মীরা। ‘

মার্জিয়া বেগমের কথায় আদ্রিক প্রতুত্তর করলো না। মার্জিয়া বেগম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। মার্জিয়া বেগমের যেতেই আদ্রিক উঠে নিজের রুমে গেলো। সারাদিন বাদে সে নিজের ঘরে প্রবেশ করছে! না জানি মীরা এখন কি করছে? ঘুম থেকে উঠে নিজেকে তার রুমে আবিষ্কার করে হয়তো ভীষণ চমকিয়েছে, হয়তো এখন তাকে বসে বসে মনে মনে বকছেও! মীরার কথা ভাবতেই আনমনে ঠোঁটের কোণে আদ্রিকের হাসি ফুটে উঠলো! মনে মনে ভাবলো,’ জানি না মেয়েটার কি আছে কিন্তু জানি এমন কিছু আছে যা আমাকে ভীষণ ভাবে টানে! ‘

‘ আপনার রুমে আপনি আমাকে এনেছেন? আদ্রিক?’

মীরার প্রশ্নে আদ্রিক হচকিয়ে বলল,’ হ্যাঁ, তুমি ঘুমুচ্ছিলে তাই। ‘

আদ্রিকের কথায় মীরার রাগ হলো, মৃদু স্বরে বলল,’ তাই বলে আপনি আমাকে আপনার রুমে আনবেন?’

আদ্রিক নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে বলে,’ তোমার রুম অরিন দখল করে নিয়েছে। তাই তোমাকে বাধ্য হয়েই আমার রুমে আনতে হয়েছে। ‘

আদ্রিকের কথায় থতমত খেলো মীরা। তেজী বাঘের ন্যায় মীরা যেনো মূহুর্তেই চুপসে গেলো। আদ্রিক ভ্রুকুঁচকে তাকালো মীরার দিকে।

‘ আমি এই রুমে থাকবো না আজকে তুমি এই রুমে থাকো কালকে আমরা সবাই গ্রামে যাবো। ‘

আদ্রিকের কথায় মীরা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে বলে,’ গ্রামে? কিসের গ্রাম? ‘

‘ আমার দাদু বাড়ি। ‘

মীরা গোমড়া মুখে বলে,’ ইয়ামিন কখনো আমাকে ওর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাই নি! ‘

কথাটা বলেই নিজের মুখ চেপে ধরে মীরা। মীরার বোধগম্য হলো সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। ইয়ামিনের কথা এমতাবস্থায় তার একদমই বলা উচিত হয়নি! অন্যদিকে মীরার কথায় আদ্রিক ভীষণ অবাক হলো! ইয়ামিন? কে এই ইয়ামিন?

আদ্রিক বিচলিত কণ্ঠে মীরাকে প্রশ্ন করলো,’ ইয়ামিন কে মীরা? তুমি না বলেছিলে তোমার কেউ নেই? ‘

মীরা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ হু কেউ নেই! ‘

‘ তাহলে ইয়ামিন? ‘

‘ রাত হয়েছে। আপনাকে এই রুমে আমার সাথে দেখলে খারাপ ভাববে। আপনি এখন চলে যান। ‘

আদ্রিক বুঝতে পারলো মীরা প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছু বলল না। চুপচাপ তটস্থ পায়ে বেরিয়ে গেলো মীরার দিকে এক নজর তাকিয়ে। মীরা আদ্রিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করলো! আজ কেনো যেনো ইয়ামিনের কথা তার ভীষণ মনে পরছে! তার আর ইয়ামিনের দিত্বীয় বিবাহবার্ষিকী তাই? ইয়ামিনের সাথে আজ সে থাকলে ইয়ামিন তাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কি উপহার দিতো? ফুলের মালা নাকি চুড়ি? নাহ ইয়ামিন তো তাকে কোনো বাহিরে ঘুরতে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি তবে সে একটু বেশিই আশা করে ফেলেছে।

চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ১১
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

‘ এই ছেড়ি কেডা গো মার্জিয়া? ‘

মীরার দিকে ইশারা করে কথাটা বললেন বৃদ্ধা এক মহিলা। মীরা থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মার্জিয়া বেগম আড়চোখে মীরাকে দেখে বলেন,’ আম্মা, ও আদ্রিকার বান্ধুবি। ‘

বৃদ্ধাকে আম্মা বলে সম্বোধন মীরা বুঝতে পারলো উনি আদ্রিক ও আদ্রিকার দাদি হন সম্পর্কে। মীরা ম্লান হেসে সালাম দিলো উনাকে। মার্জিয়া বেগম মীরাকে বললেন,’ উনি হচ্ছেন আমার শাশুড়ির ছোট বোন মানে আমার খালা শাশুড়ি। ‘

প্রতুত্তরে মীরা মুচকি হাসলো। মার্জিয়া বেগম অজান্তা খাতুনের সামনে অরিনের হাত টেনে এনে বলেন,’ আম্মা, ও হলো আদ্রিকের হবু বউ৷ ‘

মার্জিয়া বেগমের কথায় উপস্থিত সকলে অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। আদ্রিক পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় কিথাটি তার কর্ণকুহর পর্যন্ত গেলো! আদ্রিক থমথমে মুখে নিজের মা ও অরিনের দিকে তাকালো। অরিনের মুখে লাজুক আভাস। লাজুক হেসে একটু পরপর নতজানু হচ্ছে সে। আদ্রিক বিরক্তবোধ করলো, থমথমে গলায় বলল,’ এইসব কি বলছো? ‘

মার্জিয়া বেগম আড়চোখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ কি বলছি মানে? ভুল কিছু কি বললাম নাকি? আমি তোর মা লাগি তুই যে ওকে পছন্দ করিস সেটা জানি! আজ হোক কাল হোক তোদের বিয়েটা হতোই। ‘

বলে দম নিলেন মার্জিয়া। অরিনের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললেন,’ অরিন মা যাও ঘরে যেয়ে বিশ্রাম নাও। আজ রাতেই তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো। ‘

অরিন লাজুক হেসে লাগেজ হাতে নিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত ঘরের দিকে এগুলো। অরিনের যাওয়ার পর আদ্রিক তার মাকে বলল,’ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। এতো দ্রুত বিয়ের সিদ্ধান্তটা নেওয়া ঠিক হয়নি তোমার। ‘

মার্জিয়া বেগম ও আদ্রিকের কথোপকথন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে মীরা। তার মুখে রা নেই। মার্জিয়া বেগম মীরার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কাউকে ডাক দিয়ে বলেন,’ মীরাকে ওর রুমটা দেখিয়ে দে ওকে। ‘

মার্জিয়া বেগমের কথায় মেয়েটা মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,’ আফা আহেন, আপনারে আপনার রুমটা দেখায় দেই। ‘

মীরা মাথা নাড়িয়ে মেয়েটার সাথে রুমে গেলো।

এতো সুন্দর, গোছানো ও পরিপাটি ঘর দেখে মীরা অবাক হলো। এই ঘর নাকি কয়েক বছর ধরে বন্ধ পরে আছে! কিন্তু এই ঘরটা দেখতে নিত্যদিনের ব্যবহৃত ঘরই লাগছে মীরার কাছে। মীরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ আপু, এই ঘরটা এতো সুন্দর আর পরিপাটি ও! একদিনেই সব করেছো কি করে? ‘

মেয়েটি মুখ গোমড়া করে বলল,’ আপামনি, আপনি আমারে আপু বইলা ডাইকেন না। আমি তো সামান্য কাজের মেয়ে এই বাড়ির, আপনি বরং আমাকে আমার নাম ধরেই ডাকেন। ‘

মীরা আড়চোখে মেয়েটিকে দেখে বলল,’ নাম কি তোমার? ‘

মেয়েটি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,’ মিলা। ‘

মীরা মুচকি হেসে বলল,’ বাহ ভীষণ সুন্দর নাম তো তোমার! এতো সুন্দর নাম কে রেখেছে বাবা নাকি মা? ‘

মিলার মুখ আচমকাই কালো হয়ে গেলো এই কথা শুনে, হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল,’ আমার বুঝ হওয়ার আগেই বাপ মা মইরা গেসিলো তারপর চাচিগোর মার খেয়ে বড় হইছি। তাই জানি না আমার নাম কেডা রাখছে। ‘

মিলার কথায় মীরা বলল,’ দু:খিত আমি বুঝতে পারি নি তুমি মন খারাপ করবে এতোটা। ‘

মিলা জোরপূর্বক হেসে বলে,’ সমস্যা নাই। আমি ফেরেশ হন আমি যাইয়া আপনাগো জন্য খাবার তৈরি করি। ‘

মীরা প্রতুত্তরে মুচকি হাসলো। মিলা চলে যেতেই মীরা লাগেজ থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে রাখলো। তারপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।


‘ তুমি আমার ঘরে কি করছো মীরা? ‘

জামার চেইন লাগানোর জন্য মীরা যেই হাত বাড়ালো ওমনি গম্ভির, রাশভারী কণ্ঠস্বর কানে এলো মীরার। আকস্মিক কথায় মীরা তব্দা খেলো। ভয়ে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো মীরা।

‘ এখানে তুমি কি করছো? ‘

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মীরা ঘাড়কাত করলো। আদ্রিককে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলো। শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ এইটা ঘরটা তো আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আপনি কি করছেন এখানে? ‘

আদ্রিক ভ্রুকুঁচকে বলল,’ এটা তোমার জন্য না আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিলো। ‘

কথাকাটাকাটির শব্দে মিলা দৌড়ে আসলো আদ্রিকের ঘরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ আমি পাশের রুম থেকে আপনাগো চিল্লাচিল্লি শুইনা আইলাম। সবাই কয় স্বামী স্ত্রীর এতো জোরে চিল্লায় ঝগড়া করা শোভাজনক না। ‘

মিলার কথায় মীরার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। চোয়াল হা করে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিক মিটমিটিয়ে হাসছে। মীরা রাগী চোখে আদ্রিকের দিকে তাকাতেই আদ্রিক হাসি থামিয়ে গম্ভির কণ্ঠে বলে,’ কিসের স্বামী স্ত্রী হ্যাঁ? ‘

মিলা চিন্তিত হয়ে বলে,’ ভাইসাহেব, আপনি আপনের বউকে চিনতে পারছেন না? ‘

মিলার কথায় আদ্রিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। মিলা বোকা চোখে তাকাতেই আদ্রিক রামধমক দিলো মিলাকে। মিলা মাথা চুলকে বলে,’ মীরা আপারে তো এর আগে কখনো এইহানে দেহি নাই তাই ভাবলাম মীরা আপা হয়তো আপনের বউ। ‘

মীরা জোরপূর্বক হেসে বলে,’ এবার আমাকে আমার রুমটা দেখিয়ে দিবে? আমার বিশ্রামের দরকার খুব। ‘

মিলা তাড়াহুড়া করে বলে,’ জ্বী অবশ্যই আপামনি, আমার সঙ্গে আসুন। ‘

খাবার টেবিলে হরেকরকমের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে! গ্রামের বাড়ির তাজা সবজি ও নিজস্ব পুকুরের তাজা মাছ দিয়ে বানানো সব খাবার। গ্রামের বাড়িতে আসার এই এক মজা। সব খাবার পেট পুড়ে খাওয়া যায়।

‘ আমরা সবাই মিলে একদিন মীরার গ্রামের যাবো। আমাদের কি নিবে না মীরা? ‘

খেতে বসে রসিক কণ্ঠে বলল অরিন। অরিনের কথায় সকলে একদফা নিজের মুখে চাওয়াচাওয়ি করলো। মার্জিয়া বেগম অরিনকে শান্ত কণ্ঠে বললেন,’ মীরার কেউ নেই। ‘

সাহিল হুমায়ূন খেতে খেতে বললেন,’ এইভাবে কেনো বলছো মার্জিয়া? ওর হয়তো কেউ আছে সেটা তোমরা কেউ জানো না তাই এভাবে বলতে নেই। ‘

অরিন কিছুটা মন খারাপের ভান করে বলে,’ সো স্যাড মীরা! আমি তোমাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিবো ভেবে পাচ্ছি না। তুমি কার কাছে বড় হয়েছো? ‘

মীরা সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো, ‘ এতিমখানায়। ‘

অরিন ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে,’ এতিমখানা? অনেক বাচ্চাদের সাথে তাই না? সেহেতু অনেক ময়লা হবে ওইখানটা। ‘

অরিনের এহেন কথা কারোরই পছন্দ হলো না বিশেষ করে আদ্রিকের। আদ্রিক গম্ভির কণ্ঠে অরিনকে বলল,’ তুইও এতিমখানায় বড় হয়েছিস ভুলে যাস না। ‘

আদ্রিকের কথায় অরিন থতমত খেলো। অপমানিত হয়ে নতজানু হয়ে খেতে লাগলো। মার্জিয়া বেগম আদ্রিকের বাহু চেপে ফিসফিস করে বলেন,’ কথাটা এইভাবে না বললেও পারতি আদ্রিক। ‘

‘ ও যে মীরাকে বলছে তা দেখো নি? আর আমি ভুল কিছু কি বলেছি? মীরার তো অপমানিতবোধ হয় নি, তাহলে অরিনের হচ্ছে কেনো? নিজের অতীত ও চাইলেও ঢাকতে পারবে না। ‘

আদ্রিকের যুক্তির সাথে না পেরে চুপ করে রইলেন মার্জিয়া বেগম। সবার মন ভুলাতে তিনি বললেন,’ আদ্রিক, তুই তোর ভাইবোনকে নিয়ে গ্রাম থেকে দূরে কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যাস! সবার মন ভালো হবে তারপর নাহয় যেই কাজের জন্য এসেছি তা নিয়ে ভাববো। ‘

শেষের কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না আদ্রিক। খাবার খাওয়া শেষে সবাইকে বলল,’ আদ্রিকা, নিহাল তোরা সবাইকে নিয়ে আমার রুমে আয়। ‘

কথা শেষ করে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’ তুমিও আসবে ওদের সাথে। ‘

বলে হনহন করে চলে গেলো নিজের রুমে। মীরা আদ্রিকের যাওয়ার পানে হা করে তাকিয়ে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এদিকে আদ্রিকের মীরাকে নিয়ে এতো যত্ন যেনো সহ্য হলো না অরিনের। এই মূহুর্তে এইখানে তার মীরাকে সহ্য হচ্ছে না, রাগে সে খাবার না খেয়েই উঠে চলে গেলো!

চলবে?