কৃষ্ণডাহুক পর্ব-৮+৯

0
249

#কৃষ্ণডাহুক – ০৮
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

‘ হুমায়ূন প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘ বংশের নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই বিদ্যালয়। আনন্দ হুমায়ূনের শেষ ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ছোট বাচ্চাদের কেজি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ দান করা হয়। মীরার সামনে জ্বলজ্বল করছে বিদ্যালয়ের নামটি! ঢাকায় পা দেওয়ার পূর্বে ভেবে নিয়েছিলো চাকরী না পেলে রাস্তাই হবে তার বাসস্থান! তবে ভাগ্যের কারণে নিজের আয়ের উৎসও পেয়ে গিয়েছে মীরা। অন্তরে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো! সে যদি তার দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দিতো হয়তো মীরা এই মূহুর্তে আসলেই রাস্তায় বাস করতো।

মীরার ধ্যান ভাঙ্গে আদ্রিকের বিরক্তি মাখা ডাকে।

‘ এ্যাই মীরা? এইভাবে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাও ভিতরে! ‘

আদ্রিকের কথায় মীরা অপ্রস্তুত দৃষ্টিপাত ফেললো তার দিকে। বিরক্তিতে কপালে দুটো ভাজ পরেছে আদ্রিকের। গালের কালো কুচকুচে তিলটা আদ্রিকের বিরক্তি মাখা মুখশ্রীকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়! মীরা তড়িঘড়ি করে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো আদ্রিকের দিকে। এখন তার পরপুরুষের দিকে তাকানোও পাপ! এই মূহুর্তে তার লক্ষ্য হচ্ছে সফলতা! নিজেকে সফল করেই সে দাঁড়াবে ইয়ামিনের মুখোমুখি! যে ইয়ামিন অশিক্ষিত ভেবে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সেই ইয়ামিনের জন্য নিভৃতে উত্তর প্রস্তুত করবে সে।

মীরা মন্থর পায়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলো। বাচ্চাদের দৌঁড়া দৌঁড়ি, দুষ্টুমিতে মুখোরিত বিদ্যালয়! ছোট এই পাঠশালায় শ’খানেক বাচ্চা পড়ালেখা শিখার জন্য আসে। এইখানের সব বাচ্চারাই মধ্যবিত্ত পরিবারের।

এক বাচ্চা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে মীরার পিছে লুকিয়ে পড়লো। মীরা তাতে হচকিয়ে গেলো। বাচ্চার হাত ধরতেই বাচ্চা তাকে অন্যদিকে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলল,’ এখন কিছু বলো না, আমাকে ধরে ফেলবে ওরা। ‘

মীরা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে আদ্রিকের তাকালো। আদ্রিক মীরার দিকে তাকালো, দুজনেরই চোখাচোখি করে। মীরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। আদ্রিক তা পরখ করে বলল,’ মীরা, অনন্ত আব্বুর কাছে যেতে হবে আমাদের। দ্রুত আসো। ‘

বলেই পা বাড়ালো আদ্রিক। মীরা বাচ্চাটাকে বিদায় জানিয়ে ধীর পায়ে আদ্রিককে অনুসরণ করে যেতে লাগলো। যাওয়ার পথে মৃদু স্বরে আদ্রিককে বলল,’ আপনি কি এখানে আগেও এসেছেন? ‘

আদ্রিক মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’ হু, অনেকবার এসেছি। দেশে আসলেই এখানে আসি। ওদের ক্লাস ও নেই। ‘

মীরা অবাক সুরে বলল,’ ক্লাস নেন? আপনি পড়াতেও পারেন? ‘

মীরার কথায় আদ্রিক বলল,’ বিদেশে এতো বড় অফিস সামলাচ্ছি সামান্য ক্লাস সামলাতে পারবো না! এতোটাই মূর্খ ভাবো তুমি আমাকে? ‘

মীরা হচকিয়ে গেলো আদ্রিকের কথায়, জোরপূর্বক হেসে বলল,’আপনি দেশে আসলে অফিস সামলায় কে? ‘

‘ সাহিল আব্বু। আমার অফিস থেকে শুরু করে বাড়ি ঘর সব কিছুই হতে পেরেছে সাহিল আব্বুর জন্য। প্রথম প্রথম আমি এইগুলো সামলাতে হিমশিম খেতাম তখন উনি আমাকে সাহায্য করতেন। ‘

মীরা প্রতুত্তরে মুচকি হাসলো।

কিছু কিছু মানুষ এই ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে থাকার জন্য শিক্ষক পেশাটা নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় কেউ কেউ পেটে এক দানার দায়ে পরে। শিক্ষকরা ছাত্র ছাত্রীদের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেও দিনশেষে এই সমাজে তারা সবচেয়ে অবহেলিত! তাদের এই পেশাটাকে উর্ধ্বে না রাখলেও নিম্নে রাখে নি এই সমাজ।

ছাত্রছাত্রী পড়ানোর প্রথম অভিজ্ঞতা মীরার। সবার মাঝে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। কক্ষে মোট ত্রিশজনের মধ্যে প্রায় তেইশজন শিক্ষার্থী উপস্থিত। তারা নিজেদের দুষ্টুমির মধ্যে মজে আছে। মীরা তাদের কি বলে শান্ত করবে ভেবে পেলো না। বাচ্চাদের ধমকাতেও খারাপ লাগছে। সে অবশ্য এমন অনেক বাচ্চার সাথেই থেকেছে এতিমখানায় থাকতে। এতিমখানায় সবাই তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো! এতিমখানা যে চালাতো সে সবসময় মীরাকে চোখে হারাতো। মীরাকে সব শিশুর চেয়ে বেশি যত্নে বড় করেছেন তিনি। মীরাও তাকে নিজের মা সমতুল্য মনে করে।

‘ স্টুডেন্টরা চিল্লাচ্ছে আর আপনি এইভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন মিস মীরা? ‘

আকস্মিক কথায় মীরা হচকিয়ে বাহিরে তাকালো। আদ্রিকের গম্ভির মুখশ্রী দেখে বোকা চোখে সারা ক্লাসে চোখ বুলালো।

‘ মীরা! ‘

আদ্রিকের মৃদু স্বরে মীরা কেঁপে উঠলো৷ ঘাড়কাত করে বলল,’ হ্যাঁ? ‘

‘ ওরা চিল্লাচ্ছে আর আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ‘

মীরা বোকা হেসে বলল,’ আসলে আমি নতুন তো ওদের বকতেও কেমন যেনো খারাপ লাগছে। ‘

আদ্রিক প্রবেশ করতে করতে আড়চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,’ মনে গিল্টি রাখলে তো এই প্রফেশন আপনার জন্য না। শিক্ষকরা থাকবে স্ট্রং পারসোনালিটির! সোজা ভাষায় কথা না মানলে শাসন করতে হবে। এরকম নরম মনের হলে চলবে না। ‘

মীরা শুকনো ঢোক গিললো। ইতিমধ্যে সকল শিক্ষার্থী আদ্রিককে দেখে নিজেদের মাঝের কথা বার্তা বন্ধ করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আদ্রিক মৃদু হেসে বলল,’ শিক্ষক হলে এমন হবেন যে শিক্ষার্থীরা আপনাকে দেখে স্বসম্মান দেখিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। ‘

মীরা উপর নিচ মাথা দুলালো। আদ্রিক উচ্চস্বরে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’ উনি তোমাদের নতুন শিক্ষক, মীরা। আজ থেকে তোমাদের গণিত ক্লাস উনিই নিবেন আশা করি তোমরা কেউ উনাকে কোনোরকম জ্বালাবে না। ‘

মঞ্চ থেকে নেমে হাঁটা ধরলো আদ্রিক। সকলে আরেকবার দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে তাকে সালাম দিলো। আদ্রিক মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে চলে গেলো।

প্রায় চার ঘন্টা ক্লাস নিয়ে বের হলো মীরা। অনন্ত হুমায়ূনের বরাদ্দকৃত ঘরে তাকে না পেয়ে চিন্তিত মুখে বাহিরে এলো। সে তো চিনে না এখানের কিছুই! কার সাথে যাবে? আদ্রিককেও পাচ্ছে না।

‘ এখানে দাঁড়িয়েছো কেনো? ‘

পুরুষালি কণ্ঠে মীরা তাকালো। আদ্রিককে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছলছল দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো তাতে আদ্রিক ভড়কে গেলো। থতমত খেয়ে বলল,’ কাঁদছো কেনো? ‘

‘ কাঁদিনি! কেউ ছিলো না দেখে চিন্তিত ছিলাম। ‘

আদ্রিক মৃদু স্বরে বলল,’ অনন্ত আব্বু তো চলে গিয়েছিলো আমি রয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো বলে। ‘

মীরা অস্ফুটসুরে ‘ওহ’ বলে গাড়িতে উঠে বসলো। আদ্রিকও তার পাশে যেয়ে বসলো।


বিলাসবহুল এক রেস্তোরাঁর সামনে এসে ব্রেক কষলো আদ্রিক। হঠাৎ ব্রেক কষায় আকস্মিক ভাবে মীরা ঝুঁকে পড়লো। ভয়ে তটস্থ হয়ে মীরা চোখদুটো মুদে নিলো। তবে কপালে ব্যথা অনুভব করলো না মীরা, পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। উষ্ণ হাতের ছোঁয়া যেনো তার শিরদাঁড়া দিয়ে আলাদা শিহরণ বয়ে নিয়ে গিয়েছে। মীরা তড়িঘড়ি করে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। আড়চোখে আদ্রিকের দিকে তাকাতেই দেখলো আদ্রিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার তাকানোতে বলল,’ স্টুপিড! এখনই তো ব্যথা পেতে। ‘

মীরা ভার কণ্ঠে বলল,’ খেয়াল করিনি! আমরা এখানে এসেছি কেনো? ‘

আদ্রিক জবাব দিলো না। তাতে মীরা অপমানিতবোধ করলো ক্ষাণিকটা। আদ্রিক সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে বের হলো মীরা তাকে অনুসরণ করে তার পিছ পিছ রেস্তোরাঁয় ঢুকলো।

ভিতর দিক থেকে রেস্তোরাঁটা ভীষন আকর্ষনীয় দেখতে। সবাই আশেপাশে দাঁড়িয়ে তাদের হাতের ফোন দিয়ে ছবি তুলছে! মীরা আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে টেবিলে বসলো। আদ্রিকের হাতে ফোন বহমান। মীরা আড়চোখে আদ্রিককে দেখলো! আদ্রিক কাকে যেনো বারংবার ফোন করছে। কপালে বিরক্তমাখা দুটো ভাজ পরেছে। বিরক্তিতে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে টেবিলে বসলো। মীরা মন্থর গলায় বলল,’ আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে যে? ‘

আদ্রিক পুনরায় ফোন কানে দিয়ে বলল,’ আমার একটা ফ্রেন্ড আসবে এখানে। বারবার কল করছি তারপরও উঠাচ্ছে না। ‘

‘ হয়তো রাস্তার জ্যামে আটকা পরেছে। অপেক্ষা করুন কিছুক্ষণ এসে পড়বে। ‘

আদ্রিক ছোট করে ‘হুম’ বলে ফোন কান থেকে নামালো। মীরাকে বলল,’ এখানের আশপাশ ঘুরে দেখবে? অনেক সুন্দর! এই রেস্তোরাঁটা এক, দেড় বছর আগেই তৈরি করা হয়েছে, কয়েকদিনের মাঝেই অনেক সুনাম অর্জন করেছে। ‘

‘ আদ্রিক। ‘

হঠাৎ মেয়েলি গলায় আদ্রিকের নাম শুনে,তার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকালো মীরা ও আদ্রিক। আদ্রিকের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো

চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ০৯
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

এক দমকা হাওয়া মীরার মুখশ্রী পেরিয়ে গেলো। ঘন কালো চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে গেলো সাথে সাথে। মীরা বিরক্ত বোধ করলো। তর্জনী দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে তাকালো আদ্রিকের মুখ পানে। তার ঠোঁটে বহুদিন পর কাউকে কাছে পাওয়ার হাসি লেগে আছে। মীরা আদ্রিকের নিকটবর্তী চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালো! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এতো সুন্দর মেয়েটিকে না দেখলে মীরা বুঝতো না। মেয়েটার মুখ ভরে অগাধ মায়া! মীরা শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিকের দিকে তাকালো। তাদের দুজনের মাঝে যেনো সে অদৃশ্য! আদ্রিক আর মেয়েটির কথা বলার মাঝে মীরা বুঝতে পারলো মেয়েটি আর কেউ না স্বয়ং আদ্রিকের বান্ধুবি!

অরিনের দৃষ্টি পড়লো কপাল কুঁচকে বসে থাকা মীরার দিকে। মীরা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। অরিন মুচকি হেসে বলল,’ দেখ! আমাদের কথার মাঝে আমরা তো মেয়েটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম! মেয়েটা কে রে আদ্রিক? ‘

আদ্রিক মীরার দিকে স্থির দৃষ্টিপাত ফেললো। মীরা ক্ষাণিক অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। আদ্রিক মীরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে অরিনকে বলল,’ ও আদ্রিকার ভার্চুয়াল লাইফের ফ্রেন্ড! ঢাকায় পড়াশোনা করতে এসেছে। ‘

অরিন মুখে হাসি রেখে বলল,’ এই যুগে এসেও এতো বিশ্বস্ত বান্ধুবি পাওয়া অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার! আদ্রিকার কপাল খুলে গিয়েছে। ‘

আদ্রিক প্রতুত্তর করলো। মীরা অপ্রস্তুত হাসলো অরিনের দিকে তাকিয়ে। অরিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ তোমার নাম কি? ‘

‘ মীরা। ‘

‘ অনেক সুন্দর নাম তারচেয়েও বেশি সুন্দর তুমি! আমি মেয়ে হয়েও তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। তোমাকে যে যাবে সে অনেক ভাগ্যবতী। ‘

মীরা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। আদ্রিক আড়চোখে তা দেখলো।

‘ অরিন তাহলে এখন উঠা যাক? অনেকক্ষণই তো হয়েছে বসলাম। বাসার সবাই চিন্তা করবে নয়তো। ‘

তাড়াহুড়া দেখিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আদ্রিক। অরিন চকিত নয়নে নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,’ হ্যাঁ হ্যাঁ! চল। ‘

দুজন উঠে হাঁটা ধরলো। মীরা গুটি গুটি পায়ে আদ্রিকের পিছ পিছ যেতে শুরু করলো।

গাড়ির কাছে আসতেই অরিন ফ্রন্ট সিটে বসার জন্য দরজা খুলতেই আদ্রিক তাড়াহুড়ো করে বলল,’ অরিন আমি পিছনে তোর একটা লাগেজ রেখেছি। তুই ফ্রন্ট সিটে বসলে ওটা পরে যাবে তাই তুই বরং পিছেই বোস তোর যাবতীয় জিনিস নিয়ে। ‘

অরিন থমথমে মুখে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক চোখ সরিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো অরিন আর কথা না বাড়িয়ে পিছে উঠে বসলো। অরিনের মন খারাপ হবে ভেবে মীরা অরিনের পিছে পিছে তার সাথে বসতে নিলে কারো ভরাট কণ্ঠে তার চরণদুটো থেমে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক মীরাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,’ আমি কি ড্রাইভার? তুমি সামনে এসে বসো। ‘

আদ্রিকের থমথমে মুখশ্রী দেখে মীরা ইতস্ততবোধ করলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হেলেদুলে উঠে বসলো। আদ্রিক মীরার ক্লান্ত মুখপানে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।


জ্যামের কারণে ত্রিশ মিনিট বাদে হুমায়ূন মঞ্জিলের সামনে এসে থামলো গাড়ি। আদ্রিক মীরাকে ডাকতে নিলে ক্লান্ত মীরার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখলো। শ্যামবর্ণের কি নিষ্পাপ তার মুখশ্রী! আদ্রিক শুকনো ঢোক গিলে মীরার হাতের উপর হাত রেখে ধাক্কা দিলো মীরাকে। মীরা উঠলো না তবুও। মীরার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে মীরাকে আর জাগতে দিতে মন চাইলো না আদ্রিকের।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে বিপরীত দরজা দিয়ে মীরার নিকট গেলো। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া মীরার ঘুমের কারণে মুখ বেকিয়ে গেছে। আদ্রিক মীরার হাত শক্ত করে চেপে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। অতঃপর মীরাকে কোলে তুলে হাঁটা ধরলো। অরিন স্তব্ধ হয়ে দেখে গেলো আদ্রিকের এরূপ আচরণ! অরিনের টনক নড়লো! আদ্রিক মীরাকে পছন্দ করে না তো? নাহ! এমন হতেই পারে না! আদ্রিক তো তাকে পছন্দ করে! আদ্রিকের বিদেশ থাকাকালীন পর্যন্ত আদ্রিকের সাথে সম্পর্ক ছিলো তার! সেটাকে কোনোমতেই প্রেমের সম্পর্ক বলা যায় না কিন্তু সম্পর্ক তো সম্পর্কই! তবে আদ্রিক অন্য কোনো নারীকে ছুঁলো কেনো? আদ্রিকের জীবনে কি অন্য কোনো নারীর আগমণ হয়েছে?

অরিন কাঁপা কাঁপা পায়ে নিজের লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভিতরে গেলো। মার্জিয়া বেগম ও তার জা দাঁড়িয়ে আছে দরজা খুলে। তাদের সবার চোয়াল হতবাকে হা হয়ে গিয়েছে! কেনো হয়েছে তা অরিনের বুঝতে বাকি নেই। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তটস্থ পায়ে আদ্রিকের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। মার্জিয়া বেগম ও অনন্ত হুমায়ূনের স্ত্রী তনিমা খাতুন তাকালেন অরিনের দিকে। মার্জিয়া বেগম একনজর আদ্রিকের দিকে তাকালেন। শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে! যেনো কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।

তনিমা খাতুন মুখ খুললেন! রীতিমত আদ্রিকের কোলে ঘুমন্ত মীরাকে দেখে তিনি ভড়কে গেছেন!

‘ আদ্রিক তুমি মীরাকে এইভাবে কোলে নিয়েছো কেনো? ‘

আদ্রিক সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,’ মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো গাড়ি! ডেকেও উঠেনি তাই আর ডাকিনি সোজা কোলে তুলে নিয়েছি। কোনো মানুষকে ডেকে তুলার মতো এতো ধৈর্য আমার মধ্যে নেই জানোই তো ছোট আম্মু! ‘

তনিমা খাতুন জোরপূর্বক হাসলেন। আদ্রিকের কথার উল্টোপিঠে তিনি বা মার্জিয়া বেগম কেউই কিছু বললেন না।

‘ অরিন মা দেশে ফিরলে কবে? ‘

ক্লান্ত অরিন জোরপূর্বক হেসে বলল,’ গতকাল ফিরেছি আন্টি। ‘

মার্জিয়া বেগম অবাকসুরে বললেন,’ দেশে ফিরলে জানালে না যে? ‘

‘ চমকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখানে এসে আমি নিজেই চমকে গিয়েছি। ‘

বলেই আদ্রিকের দিকে আড়চোখে তাকালো। মার্জিয়া বেগম অরিনকে কিছু বলবেন তার আগেই অরিন বলে উঠে,’আন্টি আমি খুব খুব বেশি ক্লান্ত! আমি রেস্ট নিয়ে আসি? তোমার সাথে আজকে সারাটা দিন গল্প করবো। ‘

অরিনের কথায় মার্জিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে বললেন,’ হ্যাঁ হ্যাঁ, ভিতরে আসো। আদ্রিক তুই ওর ব্যাগগুলো ওর রুমে নিয়ে যাস। ‘

‘ যে রুমে মীরা থাকছে? ‘

আদ্রিকের কথায় মার্জিয়া বেগম থতমত খেলেন কিছুটা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,’মীরা নাহয় আদ্রিকার রুমে থাকবে। তুই দিয়ে আয় অরিনকে। ‘

আদ্রিক মার্জিয়ার বেগমকে কিছু না বলে গটগট পায়ে মীরাকে নিয়ে ওইখান থেকে চলে গেলো। তনিমা, মার্জিয়া, অরিন স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আদ্রিকের পানে। অরিন অনুভব করলো তার কষ্ট হচ্ছে! আদ্রিক তারই সামনে অন্য এক মেয়েকে ছুঁয়েছে তাতেই যেনো তার খারাপ লাগছে! তার মনে ভীষণ ভাবে আঘাত লেগেছে। আদ্রিক তো তাকে কোনো ছুঁয়ে বলেনি ভালোবাসে বা পছন্দ করে? তবে কেনো মীরার প্রতি আদ্রিকের এতো যত্ন? যেনো মীরাকে আগলে রাখাটাই তার দায়িত্ব।

মার্জিয়া বেগম অরিনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,’ আদ্রিকের ব্যবহারে মন খারাপ করো না অরিন মা। আসলে ছেলেটা একটু বেশিই দয়ালু। ‘

অরিন জোরপূর্বক হাসলো! নিজের লাগেজ শক্ত করে চেপে ধরে বাড়ি ভিতরে প্রবেশ করলো। মার্জিয়া বেগমের বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! আদ্রিকের প্রতি অরিনের যত্ন, ভালোবাসা এতোদিন এইসব কিছুই তিনি লক্ষ্য করতেন। তখন থেকেই অরিনকে আদ্রিকের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা করেছে এসেছেন যা আদ্রিক বা অরিন কেউই জানে না। তিনি ঠিক করেছিলেন তারা দুজন দেশে আসলে তাদের দুইজনের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন যেকোনো মূল্যে! আদ্রিক না চাইলে তিনি হুমকি দিবেন আদ্রিককে তবুও এই বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন মনে মনে পণ করলেন মার্জিয়া বেগম।

অরিন লাগেজ হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে নিলে তার চোখ পরে আদ্রিকের রুমে। দরজা ভীরে রাখা হয়েছে আদ্রিকের রুমের। না চাইতেও যেনো পা দুটো ওই রুমেই যেতে চাইছে। মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে যেয়ে লাগেজ ছেড়েই আদ্রিকের রুমের দিকে পা বাড়ালো অরিন। মনে ভয় কাজ করছে তার৷ কাঁপা কাঁপা পায়ে আদ্রিকের ঘরে প্রবেশ করলো যা দেখলো তাতে অরিনের পা অবশ হয়ে গেলো। শ্বাস আটকে এলো অরিনের।

চলবে?