কৃষ্ণাবতী পর্ব-০২

0
2016

#কৃষ্ণাবতী
#২য়_পর্ব

“আমার দেবের বউ” কথাটা শুনে সৌদামিনীর পাগুলো স্থির হয়ে যায়। দেবব্রত তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন অবন্তীকা দেবী এগিয়ে এসে বজ্র কন্ঠে বললেন,
– কি যা তা বলছেন বাবা? দেবের বউ মানে টা কি?
– মানে টা বাংলা ভাষার মতো স্পষ্ট। দেবব্রত যাকে বিয়ে করেছে সেই তো দেবব্রতের স্ত্রী হবে তাই না? আসো বউ মা বরণ করে নেও কৃষ্ণাকে।

প্রদীপ বাবুর নির্বিকার উত্তরে উপস্থিত সবার মুখ হা হয়ে যায়। অজান্তেই টুপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে যায় সৌদামিনীর। অবন্তীকা দেবী ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সৌদামিনীর সাথে দেবব্রতের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এ কথা প্রদীপ বাবুর অজানা নয়। তবুও এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে নিলেন। আর দেবব্রত ও তার প্রতিবাদ করলো না। কি মুখ থাকবে তবে সৌদামিনীর কাছে তাদের! সৌদামিনী ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ছুটে ভেতরে চলে গেলো। দেবব্রত ও সৌদামিনীর পিছু নিলো। পিছে রয়ে গেলো গাঁটছড়া এবং কৃষ্ণা। ফ্যালফ্যাল নজরে কৃষ্ণাবতী তাকিয়ে রইলো তার মাষ্টারমশাই এর দিকে। বরণ না করলে ঘরের চৌকাঠ যে পেরোতে পারবে না কৃষ্ণা। প্রদীপ বাবু এবার কড়া কন্ঠে বললো,
– অবন্তীকা, বরণ করছো না কেনো বউ কে। বাড়ির বউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
– মাফ করবেন বাবা, কোনো কুলগোত্রহীন, চালচুলোহীন মেয়েকে আমি আমার ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। আমার বাড়ির বউ সৌদামিনী। আর ওই থাকবে।

অবন্তীকা দেবীর দৃঢ় কন্ঠের জবাবে প্রদীপ বাবুর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তার বউ মা এভাবে তার বিরোধীতা করবে এটা যেনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এবার তিনি হুকুমের স্বরে বললেন,
– এ বাড়িতে কি আমার কথার কোনোই দাম নেই? নাকি বুড়ো হয়েছি বলে আমার কথার গুরুত্ব দেওয়াটা জরুরী নয় নারায়ন? যদি সেটাই হয় তবে আমি আর এক মূহুর্ত এই বাড়িতে থাকবো না।

প্রদীপ বাবুর রাগ সম্পর্কে বাড়িতে এমন কেউ নয় যে অবগত নয়। কিন্তু অবন্তীকা দেবীও তার কথায় অবিচল। সে কৃষ্ণাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে একেবারেই মানতে নারাজ। বাবা এবং স্ত্রীর মাঝের এ দ্বিমতের যুদ্ধে নারায়ন বাবু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি দেবব্রতের ছোট কাকীমা রীতা দেবীকে কৃষ্ণাকে বরণ করবার আদেশ দিলেন। নারায়নবাবু মনে মনে কৃষ্ণাকে নিজের পুত্রবধু না মানলেও বাবার উপর তার উচ্যবাচ্য করার অধিকার বা শিক্ষা কোনোটাই নেই। এভাবেই সবার অমতের সত্ত্বেও ভট্টাচার্য মঞ্জিলের বড় পুত্রবধু রুপে গৃহপ্রবেশ হলো কৃষ্ণাবতীর; কিন্তু গৃহপ্রবেশ হলেই কি বাড়ির বউ হওয়া যায়! যে জায়গাটা তার নয় সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসলেই তো আর অধিকার পাওয়া যা না। কিশোরী কৃষ্ণা একটু হলেও এটা বুঝতে পারছে। তার মাষ্টারমশাই এর উপর তার অধিকারটুকু অযাচিত! আসলে সৃষ্টিকর্তার লীলা বুঝা যে ভার; তিনি এই পৃথিবীটাকে একটা রঙ্গমঞ্চ হিসেবে যেখানে সবাই তার লিখিত উপন্যাসের এক একটা চরিত্র। তিনি যার জীবন যেভাবে পরিচালনা করতে চাচ্ছেন ঠিক সেভাবেই তার জীবন পরিচালিত হচ্ছে। নিজেদের জীবনের উপর যে এই চরিত্রদের কোনোই অধিকার নেই। এটা জানা সত্ত্বেও মানুষ নিজদের জীবন নিজেদের মতো করে চালাতে চায়, বারবার লাগাতার_______

২.
সৌদামিনী দৌড়ে দেবব্রতের রুমে এসে দরজা লাগাতে যায়, কিন্তু দেবব্রতের গতির সাথে সে পেরে উঠে না। দেবব্রত তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। সৌদামিনীর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে, তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চোখে স্পষ্ট। গ্লানি, অপরাধে ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে দেবব্রতের। এতোটা অসহায়বোধ সে কখনোই করে নি।
– দামিনী আমার কথাটা
– ওখানেই থেমে যা দেব, আমার দিকে পা বাড়াবার অধিকার তুই হারিয়েছিস।

সৌদামিনীর ঠান্ডা কন্ঠে পা জোড়া স্বয়ংক্রিয় কোনো যন্ত্রের মতো থেমে যায়। ভেতরটা ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে সৌদামিনীর। এই মানুষটার জন্য এতোটা সময় অপেক্ষা করেছিলো সে, কিন্তু তার প্রতিদান যে এমন হবে এটা তার অজানা ছিলো। চোখগুলো জ্বলছে, কিছুতেই পানিধারা আটকে রাখতে পারছে না। ভাঙা কন্ঠে অভিযোগ করে উঠে,
– আমার সাথে এমনটা কেনো হলো দেব? আমি বুঝি খুব পাপী একজন মানুষ? আমার সাথে এমনটা কেনো হলো?
– দামিনী আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর
– ক্ষমা? দুই অক্ষরের এই শব্দটা কি আমার জীবনটাকে পুনরায় সাজিয়ে দিবে দেব?

সৌদামিনীর প্রশ্নের উত্তর দেবব্রতের কাছে নেই। কি উত্তর দিবে সে। সেও যে পরিস্থিতির শিকার ছিলো। সৌদামিনী দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– আমি তোর বাগদত্তা ছিলাম দেব। আমাদের আশীর্বাদ হয়েছিলো। কেনো করলে এমন? কেনো?

ছুটে যেয়ে দেবব্রতের পাঞ্জাবীর কলার ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো সৌদামিনী। সৌদামিনীর চোখের জল দেবব্রতকেও আসক্ত করে ফেললো। পুরুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু তার চোখ ও ছলছল করছে। বিনীত গলায় বললো,
– মেয়েটা যে অসহায় ছিলো দামিনী, কি করতাম বল? লগ্নভ্রষ্টা হবার দায়ে তাকে আত্নহত্যার পথ বেছে নিতে হতো, আর কোথাও না কোথাও সেটার দায়ভার আমার উপর ও বর্তাতো। এবোভ অল দাদানের সম্মানের ও একটা প্রেসার ছিলো। সে সবার সামনে বড় গলায় কথাটা বলেছিলো।
– বেশ, এখন তো আর লগ্নভ্রষ্টা নয় সে। তবে কেনো তোর সাথে এ বাড়ি অবধি এলো। রেখে এতি তাকে গ্রামে।
– দামিনীইইইই, কি বলছিস তুই? আমার দায়িত্ব সে।
– আর আমি? আমি বুঝি কিছু নই দেব? তার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি দেব? এটুকুই না তার সিঁথিতে তোর নামের সিঁদুর আছে! সে তোর সাথে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেছে! তার হাতে শাখা পলা আছে! এগুলো তো আমার ছিলো দেব। আমার একান্ত, আমার জিনিস অন্যকে দিয়ে দিবো আমি? এসবের জোরেই তো ও তোকে আমার থেকে কেড়ে নিলো, কেঁড়ে নিলো।

বলতে বলতে বসে পড়লো সৌদামিনী। দু হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো সে। তার চাপা আর্তনাদ দেবব্রতকে গলাতে যথেষ্ট ছিলো। হাটু গেড়ে বসে আলতো পরশে সৌদামিনীর মুখটা তুলে ধরে দেবব্রত। চোখের অশ্রুগুলো মুছিয়ে শান্ত গলায় বলে,
– এতো সহজ কাউকে কেড়ে নেওয়া? তুই এখনো আমার দামিনী।
– কিন্তু তুই যে আমার দেব নস, তুই আমার দেব নস।

দেবব্রতের বুকে মুখ গুজে কথাগুলো বললো সৌদামিনী। দেবব্রত পারছে না বুকচিরে তাকে আশ্বস্ত করতে। তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে যে শুধুই সৌদামিনী হয়েছে। তার প্রথম ভালোলাগা, প্রথম ভালোবাসা। ঘরের চার দেয়ালের ভেতরের আর্তনাদ, দুঃখবিলাপ কেউ না জানলেও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি ঠিক বুঝতে পারছে। কিশোরী কৃষ্ণা দাদানের কথা মত দেবব্রতের দরজার কাছে তো চলে এসেছে কিন্তু ঘরে ঢোকার সাহস কিংবা অধিকার কিছুই তাকে দেবব্রত দেয় নি। সে এখন সৌদামিনীকে শান্ত করতে ব্যস্ত। বর, স্ত্রী, ঘর সংসার সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও মামী তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে একজন পোড়াকপালী। যাকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে সেটাই তার থেকে দূর হয়ে যাবে। তাই হয়তো মাষ্টারমশাই ও তার একান্ত নয়। তার উপর তার অধিকারে পূর্বে অন্য নারীর অধিকার আছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোথায় যাবে বুঝে উঠে না কৃষ্ণা। সেখানে হাটুগেড়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়। ঠান্ডা টাইলস এর ফ্লোরে বসতে প্রথমে বেশ কষ্ট হলেও বেশি বেগ পেতে হয় না তার। কারণ মামীর বাড়িতে ঠান্ডা মাটিতে ঘুমাতে হতো তার। গতকাল থেকে এই অবধি কম ধকল যায় নি মেয়েটির উপর। হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে তার ঠিক থাকে না কৃষ্ণার।

বেশ কিছুক্ষণ পর সৌদামিনী উঠে দাঁড়ায়। দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– আমি সতীনের ঘর করবো না দেব। হয় সে, নয় আমি। একজনকে বেছে নিতে হবে তোর।
– আমি কৃষ্ণাকে ছাড়তে পারবো না দামিনী। সে আমার দায়িত্ব। আমি যে মানুষটা দায়িত্ব কখনোই এড়াই না, কথাটা তোর অজানা নয়। বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়। হোক পরিস্থিতির দায়ে
– তুই আমাকে ছাড়তে পারবি? আমাকে দেয়া কথা ভাঙ্গতে পারবি?

সৌদামিনীর প্রশ্নের উত্তরগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে দেবব্রতের। চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। এরপর শান্ত গলায় বলে,
– ক্ষমা চাওয়ার মুখ হয়তো নেই আমার। তবে পারলে ক্ষমা করে সামনে এগিয়ে যাস। আমাদের রাস্তা এখন রেলগাড়ির লাইনের মতো হয়ে গেছে। একসাথে চলতে পারলেও এক হওয়াটা সম্ভব নয়। কষ্ট হচ্ছে, হবে; কিন্তু তোকে ছাড়া বাঁচবো না এমনটা তো নয়। তবে দায়িত্ব আমি এড়াতে পারবো না। এমন তো কথা নেই দায়িত্বকে ভালোবাসা লাগবে।

দেবব্রতের শান্ত কথাগুলো সৌদামিনীকে আরো দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে ফেলছে। আসলে তার দেব আর তার নয়। এখন সে কৃষ্ণার বর। আর বিয়ে নামক সম্পর্কের পবিত্রতার কাছে ভালোবাসাও মাঝে মাঝে হেরে যায়। সৌদামিনী এক মূহুর্ত আর সেখানে দাঁড়ায় না। নিথর পাগুলো মনের বিরুদ্ধে চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। দরজা খুলতেই দেখে দরজার বাহিরে দেবব্রতের নববধু ফ্লোরে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে। পুতুলের মতো একটি মেয়ে। দূর্গা প্রতিমার মতো মুখের ধরণ, চোখে মুখের তেজ ই আলাদা, কিন্তু নিতান্ত স্নিগ্ধ একটা কিশোরী নিচে বসে রয়েছে। দরজা খুলতেই কৃষ্ণার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কৃষ্ণা অবাক চোখের চাহনী আরোও রাগ ধরিয়ে দেয় সৌদামিনীর মনে। হিংসা, বিদ্বেষ, দুঃখ, প্রতারণায় সে যেনো অন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির করুণ মুখ ও তার মনে দয়া জাগাতে পারলো না। তীব্রগতিতে টেনে তুলে ফ্লোর থেকে তাকে। তারপর……………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি