কৃষ্ণাবতী পর্ব-০৩

0
1664

#কৃষ্ণাবতী
#৩য়_পর্ব

হিংসা, বিদ্বেষ, দুঃখ, প্রতারণায় সে যেনো অন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটির করুণ মুখ ও তার মনে দয়া জাগাতে পারলো না। তীব্রগতিতে টেনে তুলে ফ্লোর থেকে তাকে। তারপর কর্কশ কন্ঠে বলে,
– এই ভালোমানুষি চেহারার ভেতরে এতো ঘৃণ্যতম মানুষ রয়েছে সেটা আমার জানা ছিলো না। এতো ছোট বয়সে পেটে পেটে এতো শয়তানি? এতোটা স্নিগ্ধ চেহারার আড়ালে সর্বগ্রাসী একজন নারী রয়েছে সেটা কেউ না জানলেও আমি জানতে পেরেছি। মানুষকে অসহায়ত্বের দোহায় দিয়ে অন্যের সুখ কাঁড়লে আদৌও সুখী হওয়া যায় তো?

সৌদামিনীর কথাগুলো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে শুনছিলো কৃষ্ণা। তার মনষা কখনোই কারোর সুখ কারা ছিলো না। তবুও সেই দোষের আরপ তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে অসহায় স্বরে সে বললো,
– সত্যি বলছি দিদিমনি আমি কিছু করি নি।
– আমার জীবন নরক বানিয়ে এখন বলছো কিছুই করো নি।

চোয়াল শক্ত করে কথাটা বলে সৌদামিনী। ভালো মন্দের বিচার জ্ঞানটুকু হারিয়েছে সে। কৃষ্ণার বাহু সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো সে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো কৃষ্ণা। তবুও দয়া হচ্ছে না সৌদামিনীর। তখনই তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় দেবব্রত কৃষ্ণাকে। কঠোর কন্ঠ্র বলে,
– আমার রাগ এই অসহায় নির্দোষ মেয়েটাকে কেনো দিচ্ছিস দামিনী? এতোটা নিচ মন-মানসিকতার মানুষ তো তুই ছিলি না?
– এই কালনাগিনীর জন্য আজ আমি নিচু হয়ে গেলাম তোর চোখে দেব?

সৌদামিনীর প্রতিবাদী কন্ঠের প্রশ্ন শুনে ভ্রু যুগল কুচকে গেলো দেবব্রতের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুই যা করছিস তা কি আদৌ সুস্থ মানুষের কর্ম? ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলতো দামিনী? একজন শিক্ষিকা এরুপ ব্যাবহার করলে কি তার সম্মান বাড়ে? আমার উপর তোর রাগ, দোষ যদি কারোর থাকে সেটার শতভাগ না হলেও কিছুটা তো আমার। তুই আমাকে যা খুশি বলতে পারিস কিন্তু এই মেয়েটাকে কিছু বলার অধিকার আমি অন্তত দেই নি।

দেবব্রতের কথা শুনে সৌদামিনী থমকে যায়। দেবব্রতের সাথে তার সম্পর্কটা প্রেমের কম বন্ধুত্বের বেশি। সে ছোটবেলা থেকে তাদের এই বন্ধুত্ব। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পার হলেও এই বন্ধুত্বটা এখনো অটল। সেই সুবাদেই এই ভালোবাসার সূচনা। মনের অজান্তে কবে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সৌদামিনী নিজেও জানে না। তার মনে সবসময় দেবব্রতের জায়গাটা বন্ধুত্বের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। দেবব্রতের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপারটা ঘটেছে। বন্ধুর থেকে ভালো জীবনসাথী আর কেউ হতে পারে না বলে তার ধারণা ছিলো এবং এই বন্ধুত্বটাকে সারাটাজীবন অটল রাখার এর থেকে ভালো উপায় তার জানা ছিলো না। একারণেই এই বন্ধুত্বটাকে ভালোবাসার জায়গা দিয়েছিলো দেবব্রত। সৌদামিনী ব্যাতীত কোনো মেয়েকে নিজের হৃদয়ের ধার ঘেষতে দেয় নি সে। অথচ আজ কৃষ্ণার অপমানের বিরোধীতা করে সেই সৌদামিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দুবার চিন্তা করে নি দেবব্রত। দেবব্রতের পরিবর্তনটুকু যেনো একেবারেই মানতে পারছে না সৌদামিনী। মনে হচ্ছে তার কলিজায় কেউ ভোঁতা ছুরিঘাত করছে। বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে টেনে সৌদামিনী ধীর কন্ঠে বললো,
– বাহ! আমি সত্যি তোর প্রশংসা না করে পারছি না দেব। কতটা বদলে গেছো একটা দিনে। তুই সত্যি আমার দেব আর নও। অভিশাপ আমি তোকে দিবো না। সুখে থাক এই কামনাই করবো। আর তোমাকে বলবো কৃষ্ণা, মাথায় গেথে নাও। মানুষ সেটাই পায় যা তার ভাগ্যে লেখা থাকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধে অন্যের জিনিস কাঁড়লে সেটা ক্ষণিকের জন্য তোমার হলেও সেটা চিরস্থায়ী হয় না। অভিশাপ দিচ্ছি না, বাস্তবতা বলছি। এই সিঁদুর, শাখা পলা আমার ছিলো। তুমি অযাচিত ভাবে তা কেড়েছো। কেড়েছো বললে ভুল হবে, পরিস্থিতি তোমার ভাগ্যে দিয়ে দিয়েছে। সামলে রেখো। এমন না হয়, এই সিঁদুরটুকু তোমার ভাগ্য থেকে অন্যের ভাগ্যে চলে যায়।

সৌদামিনীর কথাগুলোর মর্মার্থ কৃষ্ণা না বুঝলেও দেবব্রতের বুঝতে বাকি রইলো না। সৌদামিনী তাকে কথার ছলে প্রতারক দাবি করেছে, যে শুধু সময়ে সময়ে নারী পরিবর্তন করে। চাইলে কথাটা প্রতিবাদ সে করতেই পারতো কিন্তু করাটা যৌক্তিক মনে হয় নি তার। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো দেবব্রত। কথাটা শেষ হতেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো সৌদামিনী। দেবব্রত সৌদামিনীর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুক থেকে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। কৃষ্ণা তখন ধীর গলায় বললো,
– দিদিমনি আপনার উপর রাগ করেছেন মাষ্টারমশাই, তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। সাথে আপনিও; আপনি তার রাগ ভাঙ্গাবেন না?

কৃষ্ণার সরল মনের প্রশ্নে স্মিত হাসি ঠোঁটের কোনে টেনে দেবব্রত উত্তর দেয়,
– তার রাগ ভাঙ্গাতে গেলে যে আমাকে পাপ করতে হবে। তা যে আমি করতে পারবো না কৃষ্ণা। সবার ভাগ্যে সব সুখ যে লিখিত থাকে না। তুই নিচে বসেছিলি কেনো?
– দাদান আমাকে আপনার ঘরে যেতে বললেন, তাই সোমা মাসি আমাকে এ ঘর অবধি নিয়ে এলেন। তখন তো দিদিমনির সাথে আপনি একান্ত ব্যাক্তিগত কথা কচ্ছিলেন তাই আর ঘরে ঢুকার সাহস পাই নি। আর পা টা ব্যথা করছিলো তাই এখানেই বসে পড়লাম।
– আমার ঘরে তোর ঠাই যে হবে না কৃষ্ণা।

দেবব্রতের কথার জন্য যেনো আগ থেকেই প্রস্তুত ছিলো সে। তাই জড়তাবিহীন স্বরে বলে উঠলো,
– তাহলে আমি সোমা মাসির সাথে থাকবো?
– সোমা মাসির সাথে থাকতে যাবি কেনো রে?
– সোমা মাসি খুব ভালো, আমাকে এই ঘরে দেবার আগে তিনি বললেন, “যদি বড় বাবুর ঘরে তোমারে ঢুকতি না দেয়; আমার ঘরে চলি আইসো”

কৃষ্ণার সরল মনের হাতছানি দেবব্রতের জটিল আঘাত জর্জরিত মনেও শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। এই মেয়েটার সাথে ভাগ্য থাকে বেঁধে দিয়েছে। এতে কারোর কোনো হাত নেই। ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করার মতো মনোবল বা শক্তি তার নেই, এই বিরুপ পরিস্থিতিতে মেয়েটাকে একা লড়াই করার জন্য ফেলে আসাটা কি কাপুরুষত্ব হতো না? না সে যা করেছে ঠিক করেছে। কেউ না বুঝলেও সে তার কাছে সঠিক। ওই লম্পট, মাতাল, দেহলোভী মানুষটা এই কিশোরী মেয়েটার সরলতা নিজের কুচিন্তার চাপে পিষে ফেলতো। তখন এই ফুলের মতো নিষ্পাপ কৃষ্ণার জীবনটা কর্পুরের মতো উবে যেতো। থাকতো খালি একরাশ কষ্টের ছাই। নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমি কেনো আমার ঘরে ঠায় দিচ্ছি না জানিস?
– না
– কারণ তুই এখনো ছোট। তোর সাথে আমার সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর হলেও কিছু জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তারমধ্যে প্রথম কথা হলো তুই এখনো পূর্ণবয়স্ক নস আর দ্বিতীয় কথা আমার মন থেকে তোকে নিজের স্ত্রী মানতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বিয়েটা পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতির তাড়ণায় আমার তোকে বিয়ে করতে হয়েছে। তোর কাছে লুকিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, আমার দামিনীর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আজ এই বিয়েটা না হলে কিছুদিন অর দামিনীই আমার স্ত্রী হতো। এখন কথা হচ্ছে আমি তাহলে কেনোই বা তোকে বিয়ে করলাম আর কেনোই বা এই অযাচিত সম্পর্কটাকে নাম দিচ্ছি। বিয়ে করেছিলাম দাদানের ইজ্জতের খাতিরে আর সম্পর্কটাকে বয়ে নিচ্ছি দায়িত্বের খাতিরে। যতদিন না তুই বড় হচ্ছিস কিংবা আমার মতো গড়ে উঠছিস ততোদিন তুই আমার বাড়ি থাকলেও সমাজে আমি এই সম্পর্কের কোনো স্বীকৃতি দিতে পারবো না। আমার কথাগুলো পাষন্ডের মতো লাগছে কিন্তু এটা বাস্তব।
-……
– তোর বয়স এখন পড়ালেখা করার, নিজের এই কাঁদামাটির আদল পরিবর্তন করে সত্যিকারের মানু্ষরুপে গড়ে তোলা। এই সংসারের “স” টুকুও বোঝার ক্ষমতা তোর নেই। এমন ও হতে পারে এই সম্পর্কটা তোর ভবিষ্যতের একটা কাঁটা স্বরুপ হয়ে উঠলো। তাই এই সম্পর্কের স্বীকৃতি না দেওয়া উভয়ের জন্যই যথার্থ। তোর এতে আপত্তি আছে?

কৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উত্তর দিলো। কিন্তু কোথাও যেনো একটা শূন্যতার বিস্তার ঘটলো, কিশোরী মনে পুনরায় না পাবার হাতছানি দাগ কেটে গেলো। দেবব্রত তখন তার চাচাতো বোন অন্নাকে ডেকে আনে। দেবব্রতের দুটো চাচাতো বোন রয়েছে। স্বর্ণা এবং অন্না। স্বর্ণার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং অন্না কৃষ্ণার বয়সী। মেয়েটি খুবই মিশুক। অন্না আসলে দেবব্রত বলে,
– বৌদি আজ থেকে তোর কাছে থাকবে। ওর খেয়াল রাখবি।
– ও তো আমার সমান। ওকে আমার বৌদি বলতে হবে কেনো?
– থাপ্পড় খাইছিস? ও তোর ছোট হলেও ও তোর বৌদি।

দেবব্রতের কড়া বাক্যে চুপ মেরে যায় অন্না। তবে মনে মনে নিজের সমবয়সী কাউকে পেয়ে বেশ খুশি খুশি লাগছে আবার। আবার প্রিয় সৌদামিনী দিদিকে আর বৌদি বলা হবে ভেবেও কষ্ট লাগছে। মনের এমন ভিন্ন ভিন্ন ভাবান্তরের জন্য খুবই দ্বিধায় পড়ে গেছে অন্না। এদিকে তার জ্যেষ্ঠীমাও কৃষ্ণাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মানে না, তবুও দাদাভাই এর কঠোর উক্তি মানতে কৃষ্ণাকে তার বৌদি বলেই ডাকতে হবে। কি দোটানা পরিস্থিতি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেচারা মুখে বললো,
– চলো বৌদি, আমার রুমে চলো।

কৃষ্ণা গোবেচারার মতো মাথা নাড়িয়ে অন্নার পিছু নিলেও থেমে যেয়ে পিছন ফিরে বলে,
– আচ্ছা মাষ্টারমশাই কোনোকালে যদি আমি আপনার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি তবে কি সমাজের সামনে আমার হাত গর্বের সাথে বলবেন “ও আমার স্ত্রী কৃষ্ণাবতী দেবব্রত ভট্টাচার্য”?

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসু চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কি উত্তর দিবে দেবব্রত বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি সত্যি কৃষ্ণাকে নিজের স্ত্রীর জায়গাটা দিতে পারবে!!!

৩.
দরজায় টোকা দিয়ে বিনীত কন্ঠে নারায়ন বাবু বলেন,
– বাবা কি ঘুমোচ্ছেন?
– না ভেতরে আসো নারায়ন।

চাদরটা পেচিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন প্রদীপ বাবু। এই সত্তর বছরে এতো ধকলটা শরীর মানতে চাচ্ছে না। নারায়ন বাবু ঘরে প্রবেশ করে তার পাশে বসলেন। মুখে চিন্তার ছাপ। মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে কিভাবে প্রশ্নটা করবে বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। তখন প্রদীপ বাবু ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
– প্রশ্ন করতে এই রাতে ছুটে এয়েছো যখন প্রশ্নটা করে ফেলো নারায়ন
– সব জানা সত্ত্বেও কেনো ওই মেয়েকে দেবব্রতের ঘাড়ে উঠালেন বাবা? সৌদামিনীর ব্যাপারটা তো আপনার অজানা নয়। আমি এখন অনুরাগকে কি উত্তর দিবো বলুন বাবা?

নারায়ন বাবুর কথাগুলো চুপ করে শুনলেন প্রদীপ বাবু। এরপর ঠোঁটে হাসি একে বললেন,
– তোমার ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে যে নারায়ণ। ভুলে যাচ্ছো কেনো শ্যামলীর কাছে আমরা দায়বদ্ধ…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি