#কৃষ্ণাবতী
#১৪ম_পর্ব
কৃষ্ণা তখন অবাক চোখে অর্জুনের যাবার পথে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা একজনের চোখ এড়ালো না। সূক্ষ্ণ চোখে কৃষ্ণাবতীর দিকে সে তাকিয়ে থাকলো। মুখে একটা প্রশান্তির হাসি টেনে নিজ গন্তব্যে রওনা দিলো সে। কৃষ্ণা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই পেছন থেকে একটা চাপর মেরে তার ভাবনার জগতে ছেদ করে অন্না।
– অর্জুন দা কি বলে গেলো রে? তার তুই এমন হা করে কি ভাবছিলি? প্রেমে ট্রেমে পড়লি না কি?
– তোর মাথায় প্রেম বাদে কি কিছুই আসে না? আমি কোনো প্রেমে ট্রেমে পড়ি নি বুঝেছিস।
বেশ ক্ষেপেই কথাটা বলে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার কথা শুনে অন্না একটু ভ্রু উচিয়ে বলে,
– তুই নাহয় প্রেমে পড়িস নি কিন্তু অন্য কারোর মনের আবহাওয়া কিন্তু ভালো ঠেকছে না।
– মানে?
– মানে টা সময় হয়ে বুঝিয়ে দিবো। আন্দাজটা ঠিক না ভুল এটা তো জানতে হবে তাই না! চল ক্লাসে চল
বলেই টানতে টানতে কৃষ্ণাকে ক্লাসে নিয়ে গেলো অন্না। কৃষ্ণার মনে এখনো একটি প্রশ্ন ঘুরছে অর্জুন কিভাবে জানে তার কখন পড়া থাকে! এটা তো দেবব্রত ও জানে না__________
দুপুর ৩টা,
সূর্য্যি মামা মাথায় উঠে নিত্য করছেন। কড়া রোদে শীতের চিহ্নটুকু হারিয়ে গেছে। বাইলোজি পড়ার জন্য ছুটে এসেছে কৃষ্ণা এবং অন্না, কিন্তু আফসোস আজ স্যার ব্যাস্ত থাকায় কৃষ্ণা এবং অন্নার পড়া বাতিল হয়েছে। এতদূর স্যারের বাড়ি অবধি যেয়ে ফিরে যেতে হবে তাদের। রাস্তার ধার দিয়েই হাটছিলো তারা; তখন পেছন থেকে ডাক পড়লে তারা পেছনে ফিরে দেখে বাইকে হেলান দিয়ে অর্জুন দাঁড়ানো। কালো শার্টে মন্দ লাগছে না তাকে, চুল গুলো হাত দিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে, চোখের চশমাটা মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো সে। অন্না অবাক হয়ে বললো,
– একি অর্জুন দা আপনি এখানে?
– কাজ ছিলো, তোদের ক্লাস শেষ?
– না না, আজ স্যার নেই তাই কোচিং বন্ধ। বাসায় ই যাচ্ছিলাম
– অহ, কৃষ্ণাবতী তুমি কি বাসায় যাবে এখন? যদি না যাও আমার সাথেও যেতে পারো।
মৃদু কন্ঠের প্রশ্নটা কঠিন কোনো প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু কৃষ্ণা যেনো কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটার চোখজোড়া বেশ অদ্ভুত। উদাসীন কিন্তু মায়ায় ভরা৷ কৃষ্ণা কিছু বলতে যাবে তখনই কেউ বলে উঠে,
– হ্যা, ও এখন বাসায় ই যাবে।
কন্ঠটা খুব পরিচিত একজনের। কৃষ্ণা অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেড়েই যাচ্ছে কন্ঠটা শুনে। পেছনে না ফিরলেও কৃষ্ণা বলে দিতে পারছে কন্ঠটা আর কারো নয়, বরং তার মাষ্টারমশাই এর। দেবব্রত দ্রুত এসে কৃষ্ণার হাত চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসে। অন্নাকে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– গাড়িতে যেয়ে বস।
অন্না কথা না বাড়িয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। দেবব্রতকে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে অর্জুন বলে,
– আরে দেব দা তুমি এখানে? অন্নাকে নিতে এসেছো বুঝি?
– শুধু অন্নাকে নয়, কৃষ্ণাকেও নিতে এসেছি৷
দেবব্রত এখনো কৃষ্ণার হাত ধরে আছে। এই ব্যাপারটা অর্জুনের দৃষ্টি এড়ালো না। কলেজের সবাই জানে দেবব্রত এবং সৌদামিনীর কথা। তারা এই কলেজেই পড়াশোনা করেছে। তাদের ভালোবাসার স্তম্ভ গড়েও কলেজ থেকে। দেবব্রত যে অন্য কারোর হাত এতোটা অধিকারের সাথে ধরবে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে অর্জুনের জন্য। অর্জুন ধীর কন্ঠে বলে,
– কৃষ্ণাবতী আর তোমার সম্পর্ক কি দেব দা? না আসলে কৃষ্ণাবতীর হয়ে তুমি ডিসিশন নিচ্ছো তো তাই প্রশ্ন জাগলো মনে।
– আমার আর কৃষ্ণার সম্পর্কটা নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। তোর কৃষ্ণার সাথে কি কাজ সেটা আমাকে বললি না যে! আমি যতটুকু জানি তোর সামনে ফাইনাল। এখানে অহেতুক সময় নষ্ট করার ছেলে তো তুই নস। আর কৃষ্ণার সাথে এতোও জরুরি ও কোন কাজ থাকার কথা বলে আমার ধারণা নেই। তাই নয় কি অর্জুন?
দেবব্রতের তীক্ষ্ণগলায় প্রশ্নে অর্জুন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সত্যি ই প্রেমের তীব্রতার কারণে অর্জুন আজকাল নিজের সব কাজ ছেড়ে শুধু কৃষ্ণার এক ঝলক দেখবার জন্য উতলা হয়ে থাকে। ধীর কন্ঠে বললো,
– একটা কাজে এসেছিলাম, আসলে সামনের এন্যুয়াল ফেস্টে কৃষ্ণাবতীর সাথে আমার গাণ গাইবার কথা। বিকেলে রিহার্সাল ছিলো। কৃষ্ণাবতীর সাথে যেহেতু দেখাই হয়ে গিয়েছে তাই….
– কিন্তু কৃষ্ণা এখন যাবে না। কলেজের ফেস্ট। রিহার্সাল টাও কলেজের ফাকেই করে নিস। এখন বিকেল হয়ে গেছে। ও আমার সাথে বাসায় যাবে এখন। আসছি তাহলে
বলেই দেবব্রত কৃষ্ণার হাত ধরে গাড়িতে তুললো। পুরোটা সময় বান্দা তার হাত ধরেই ছিলো। কৃষ্ণার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো। এই প্রথম তার মাষ্টারমশাই তার হাত এতোটা সময় ধরেছিলো। মাষ্টারমশাই এর হাতের উষ্ণতা তার হাতের ভেতর অনুভব করছিলো কৃষ্ণা। তবে আরেকটি মানুষের মুখে একটা দুঃখের ছাপ নেমে এসেছে। সে যদি একটা বার পেছনে ফিরে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেতো। অর্জুন তখন ও দেবব্রতের গাড়ি যাবার পানে চেয়েছিলো। চোখের সামনে এখনো কৃষ্ণাবতীর হাতে হাত রাখা দেবব্রতের দৃশ্যটি ভাসছে_______
১১.
ছাঁদে চাঁদর পেছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। দেবব্রতদের ছাঁদটা বেশ পুরোনো ধাচের। কর্ণিশ মাজা অবধি। তাও ইটের গাটনি। ঠিক মাঝ বরাবর একটি তুলসি গাছ ইট দিয়ে বাধানো। মা, কাকীমা জল ঢালে তাতে। আজ বেশ কুয়াশা পড়েছে। মাঘ মাসের প্রথম দিন বলে কথা। কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া ক্ষনে ক্ষণে বইসে। দেবব্রতের ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোয়া কুয়াশায় মিলে যাচ্ছে। মাথায় একটা চিন্তা বেশ চড়াও হয়ে উঠেছে দেবব্রতের। সেই চিন্তার উৎস অর্জুনের চাহনী। অর্জুনকে কলেজের থেকেই দেবব্রত চিনে। তার খুব ভালো জুনিয়র ছিলো। তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো। ছেলেটা কখনোই মেয়ে নামক চক্করে পড়ে নি। সারাক্ষণ গাণ, পড়ালেখা আর রাজনীতিতে ব্যাস্ত ছিলো। কিন্তু আজ তার চাহনী যেনো অন্যকিছু বলছিলো। যে আবেগী চাহনীতে সে কৃষ্ণার দিকে দেখছিলো এই চাহনী একট সময় সে সৌদামিনীর প্রতি দেবব্রতের ছিলো। তবে কি!! দেবব্রতের বুক জ্বলছে, এটা কেনো যে বুঝতে পারছে না। হয়তো আজ নিকোটিনের ডোজ বেড়ে গেছে। তাই হবে। হঠাৎ একটা মৃদু স্বরের আওয়াজ পেতেই সব ক্লান্তির অবসান ঘটলো যেনো। হ্যা কৃষ্ণা গাণ গাইছে।
“বেলা গেল সন্ধ্যা হলো, আর কি বাকি আছে বলো
কার-বা আশে রইয়াছ বসিয়া রে।।
পাগল মন রে, আগবাজারে আইল যারা
বেপার করিল তারা, ভরল নৌকা হীরামুক্তা দিয়া
শেষবাজারে দোকান খুলে, সব হরাইলাম লাভে মূলে
পাগল মন রে, মহাজনকে বুঝাব কী করিয়া রে।।
পাগল মন রে, পুঁজি ছিল ষোলোআনা, বেপার করিতে দু’না
এসেছিলাম সঙ্গী ছয়জন লইয়া
কাম কামিনীর ফেরে পড়ে, নাও ভিড়াইলাম মদনপুরে
পাগল মন রে, সোনা নিল শিসা বদল দিয়া রে।।
পাগল মন রে, আকাশে ডুবিল বেলা, সঙ্গে ছয়টা চোরশালা
সন্ধ্যা বেলা আমায় গেল থইয়া
বিপদে মুর্শিদ ভরসা, বলে পাগল দুর্বিন শাহ্
পাগল মন রে, দয়া হলে নিবে উদ্ধারিয়া রে।।”
দেবব্রত চোখ বুঝে কৃষ্ণার আরতী উপভোগ করতে লাগলো। কি মধুর কন্ঠ। এই মেয়েটা এখনো তার বাড়ির ই বউ। এবং সারাটাজীবন সেটাই থাকবে_____
সকাল ৮টা,
আজ শুক্রবার, কলেজ বন্ধ। সকাল থেকে শাশুড়ী মা এবং কাকী শাশুড়ী মার সাথে রান্নাঘরে কাজ করেছে কৃষ্ণা। অবন্তীকা দেবী খিটখিট করলেও খুব খারাপ ব্যবহার তিনি করছেন না আজকাল কৃষ্ণার সাথে। উনার মুখটাই এমন, যদি ভালোভাবে কেমন আছো ও জিজ্ঞেস করেন তখন মনে হয় ঝগড়ায় নেমেছেন। রান্নাঘরে বউমা, শাশুড়ী মায়ের মোটামুটি দুতিন বার বিশ্বযুদ্ধ হয়েও গিয়েছে৷ হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ পেলে ছুটে যায় কৃষ্ণা দরজা খুলতে। এতো সকালে কারোর আসার কথা নয় তেমন ভাবে। দরজা খুলতেই দেখে……
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#১৫ম_পর্ব
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ পেলে ছুটে যায় কৃষ্ণা দরজা খুলতে। এতো সকালে কারোর আসার কথা নয় তেমন ভাবে। দরজা খুলতেই দেখে তার মামা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে। রিপন বাবু কৃষ্ণাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন,
– ভালো আছিস মা?
– মামা, তুমি আসো না ভেতরে আসো৷
রিপন বাবু হালকা ইতস্তত বোধ করছিলেন। তাদের তুলনায় দেবব্রত অর্থের দিক দিয়ে অনেক উপরে। রিপন বাবুর পরণে সাদা কুর্তা, সাদা ধুতি এবং তিন বছর পুরোনো চটি। এতো বড় ঘরের বউ তার ভাগনী। এটা যেনো তার কাছে স্বপ্ন। আরো ইতস্ততবোধ হচ্ছে এতো সকালে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন। না জানি তারা কি মনে করেন। আসলে তিনি রাতেই রওনা দিয়েছিলেন৷ আসতে আসতে সকাল হয়ে গিয়েছে। আজ একটু সকাল সকাল পৌছে গিয়েছেন। কৃষ্ণা তার মামার অস্বস্তি বোধ বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলে,
– উনারা খুব ভালো, কিছুই মনে করবেন না। আসো।
কৃষ্ণার সাড়া না পেয়ে অবন্তীকা দেবী রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন। হিনহিনে কন্ঠে বলেন,
– কে এসেছে কৃষ্ণা?
বসার ঘরে যেতেই অবন্তীকা দেবীর চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠেন,
– এ কি রিপন দাদা তুমি? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম বলো! কেমন আছো?
– এইতো বৌদি ভালো। ক্ষমা করবেন এই সকালে এসে উঠেছি।
– ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন। মনে করতে যাবো কেনো। দাড়ান বাবুর বাবাকে ডাকছি। কৃষ্ণা যাও তো বাবাকেও ডেকে আনো। তুমি এসেছো জানলে বাবা ও কম খুশি হবেন না। আজ কিন্তু থেকে যেতে হবে। কোনো কাজে এসেছিলে বুঝি?
কৃষ্ণাও দেরি না করে শাশুড়ি মায়ের কথা পালনের জন্য ছুটলো। অবন্তীকা দেবীর প্রশ্ন শুনে রিপন বাবু একটু অনুরোধের স্বরে বলে,
– আসলে কৃষ্ণাকে দেখি না তিন মাস হতে চললো, আমার ভাগনী বললে ভুল হবে, ওতো আমার মেয়েই। ওরা তো দ্বিরাগমনেও গেলো না। তাই ভাবলাম যদি তাদের এসে নিয়ে যেতে হয়।
– ভাগনী মানে? কৃষ্ণা?
– হ্যা, বৌদি। আসলে শ্যামলী মারা যাবার পর থেকে ও আমার কাছেই ছিলো। মা মরা মেয়ে, একটু চঞ্চল। ছোট তো। ভুল ত্রুটি করলে ক্ষমা করে দিয়েন বৌদি।
-… …..
– দেবব্রত আমার মেয়েটার জন্য কোনো দেবদূতের চেয়ে কম নয়। আসলে ওদের বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে সেই পরিস্থিতিতে আপনারা তাকে যে মেনে নিবেন এটাই আমাদের জন্য অনেক।
অবন্তীকা দেবী চুপ করে রিপন বাবুর কথাগুলো শুনে যাচ্ছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যেই মেয়েকে বের করার জম্য সে উঠে পড়েছিলেন সেই মেয়ে আর কেউ নয় বরং শ্যামলী সাহার ই মেয়ে। সেই শ্যামলী যার ত্যাগের জন্য আজ তাদের এই অবস্থা। অবন্তীকা দেবী ঘাড় কাত করে কৃষ্ণার দিকে তাকালেন। কৃষ্ণা তখন প্রদীপ বাবু কে নিয়ে বসার ঘরে দিকেই আসছিলো। কি মায়াবী একটা মুখ। তাদের সুখের জন্য মেয়েটি পিতৃস্নেহ থেকে আজ বঞ্চিত। না চাইতেও অতীত তিক্ততা চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে জোর পূর্বক হাসি টেনে বললেন,
– রিপন দাদ বসো। আমি জলখাবার নিয়ে আসছি।
গ্লানিবোধ খুব খারাপ। মানুষের ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খায় এই গ্লানি বোধ। যে মানুষের নিজের অপকর্মের জন্য গ্লানি বোধ হয় না সে হয়তো মানুষ ই নয়_______
বিকেল ৪টা,
নিজের ঘরে ব্যাগ গুছাচ্ছে কৃষ্ণা। মনটা বেশ উচ্ছ্বাসিত। গ্রামে যাবে সে। আহা! কতদিন পর আবার পা রাখবে সেই গ্রামে। মামার সাথে সে এবং তার মাষ্টারমশাই গ্রামে যাবে। খুশিতে আটখানা হয়ে আছে কৃষ্ণা৷ মাষ্টারমশাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে মামা। সে তো যেতেই চাচ্ছিলো না। আজ অনেকদিন পর একেবারে রাঙ্গা বউ সাজবে কৃষ্ণা। একটা লাল জামদানি আটপৌরে করে পড়ে নিলো সে। সিঁথি রাঙ্গিয়ে দিলো লাল সিঁদুরে, হাত ভর্তি শাখা পলা। চোখের নিতে মোটা কাজল, কপালে লাল টিপ। চুলগুলো ছেড়ে দিলো, বেলীফুল থাকলে খোপা করতো। তখনই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। দরজা খুলতেই দেখে অবন্তীকা দেবী একটা বাক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলেন তিনি। কর্কশ কন্ঠে বললেন,
– শোন মেয়ে এদিকে আসো। দেখো তো এই গয়নাগুলোর কোনটা পড়ে যাবে।
– এসবের কি দরকার মা?
– অবশ্যই দরকার আছে। তুমি এই ছ্যাবলার মতো কোনো গয়না ছাড়া যাবে নাকি গ্রামে। লোকে দেখলে বলবে ভটাচায্যিরা এতোই কিপটে যে বউকে গয়নাও দেয় নি। এহহ বুঝি না মনে করেছো! তুমি আসলে আমাদের নাক কাটাতে চাও।
– এ বাবা, আমি কি তা বলেছি।
– তাহলে চুপ করে সামনে বসো। আমি ই বেছে দিচ্ছি।
অগত্যা, চুপ করে কৃষ্ণাকে বসতে হলো। ঘন্টা খানিক লাগিয়ে অবন্তীকা দেবী কৃষ্ণাকে সাজালেন। সাজানো শেষ হলে নিজের ই চোখ ফেরাতে পারছেন না। আহা! ঠিক যেনো কিশোরী অন্নপূর্ণা! চোখের থেকে কাজল নিয়ে ঘাড়ের নিচে দিয়ে দিলেন। কেনো আঙ্গুলে একটু কামড়ে থু থু দিলেন যাতে নজর না লাগে তার ঘরের লক্ষীর। কৃষ্ণা যাতে তার মমতাময়ী রুপ না টের পায় তাই একটু কড়া কন্ঠে বললেন,
– ভেবো না তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমার সাজানোই এতোটা সুন্দর।
কৃষ্ণা কিছুই বললো না, সে জানে তার শ্বাশুড়ি মা একটু অন্যরকম। সে শুধু ঘাড় কাত করে সায় দিলো।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। এখন বের হলে রাতের মধ্যেই পৌছে যাবে গ্রামে। সিগারেটে সুখ টান দিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। তিনদিনের ছুটি পেয়েছে মাত্র। তিনদিন গ্রামে কাটালে মন্দ হয় না। রিপন বাবু গাড়িতে সব মালপত্র উঠিয়ে দিয়েছেন। লোকটা বেশ সাদামাটা সরল প্রকৃতির৷ কৃষ্ণাকে খুব ভালোবাসেন তিনি। তাই তো বারবার তার হাত ধরে বলছিলেন মেয়েটাকে একটু নিজের মতো গড়ে নিতে। দেবব্রত আজকাল সেই প্রচেষ্টায় ই আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণার অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিলো দেবব্রত। তখন নুপুরের রুনুঝুনু কানে বাজে। পেছনে ফিরতেই মনে হলো স্বর্গ থেকে যেনো স্বয়ং লাল শাড়িতে কোনো অপ্সরা ধারাতে অবতরিত হয়েছে। একজন স্নিগ্ধ শান্তি বয়ে গেলো দেবব্রতের মনে। ধীর পায়ে হেটে যখন কৃষ্ণা তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন যেনো এক ঘোরের মাঝে ছিলো দেবব্রত। নেশাগ্রস্ত চোখে শুধু দেখেই যাচ্ছিলো কৃষ্ণাকে। এমনটা তো হবার কথা না। তাহলে কি নিকোটিনের পরিমাণ মাথায় জেকে বসেছে! দেবব্রত খেয়াল করলো, বুকের স্পন্দন বাড়ছে। হার্টবিট যেনো বুক ছিদ্র করে বেড়িয়ে আসবে। এমনটা হবার কথা নয়। আসলে এমনটা হবার কথা নয়। কৃষ্ণা তখন ধীর কন্ঠে বললো,
– যাবেন না?
দেবব্রত কিছু না বলেই ধপ করে গাড়িতে উঠে পড়লো। আজকাল মনটা অবাধ্য হয়ে গেছে। না না পাগল হয়ে গেছে। হয়তো ছ্যাকা খাবার ফলাফল। নাকি অন্য কিছু!
১২.
মাঘ মাসের তৃতীয় দিন। ঠান্ডা বাতাস বইসে, কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। ঘড়ির কাটা নয়টার কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু সূর্যের কিরণ এখনো দেখা যায় নি। খেতের মাঝে চাঁদর মুড়ে হাটছে দেবব্রত। আজ দুদিন হয়েছে তাদের গ্রামে আসা। শিশির ভেজা মাঠে খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা। গ্রামের বাতাসে একটা স্বস্তি আছে যা ইটপাথরের শহরে পাওয়া যায় না। বুক ফুলিয়ে বাতাস নেওয়া যায়। তাদের গ্রামটা সেই পিছিয়ে থাকা গ্রামের মধ্যে একটি। যেখানে এখনো খুব উন্নতি হয় নি। বিদ্যুৎ বলতে সৌর বিদ্যুৎ। সুন্দর সুন্দর ঘর দেখতে পাওয়া যায় না অহরহ। প্রায় মাটির, টিনের ঘর ই বেশি। রিপন বাবুদের ও তেমনই। টিনের ঘর। তবে সামনে বিরাট উঠোন। উঠোনে তুলসি গাছ। বেশ পরিপাটি বাড়ি। হাটাহাটি করে ঘরে ঢুকতে যাবে তখনই একটি খিলখিল হাসি কানে এলো দেবব্রতের। সেদিকে নজর দিলে দেখে কৃষ্ণা শিপ্রাদের সাথে কিতকিত খেলছে। কি উল্লাসিত কিশোরী। শাড়িটা তুলে আচল গুটিয়ে ঘাসফড়িং এর মতো লাফাচ্ছে সে। মনে অজান্তেই দেবব্রত একমনেই দেখতে লাগলো তাকে। ফোনটা বের করে বেশ কটা ছবিও তুলে নিলো। কি সুন্দর মুখখানা। হঠাৎ খেয়াল করলো……
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#১৬ম_পর্ব
মনে অজান্তেই দেবব্রত একমনেই দেখতে লাগলো তাকে। ফোনটা বের করে বেশ কটা ছবিও তুলে নিলো। কি সুন্দর মুখখানা। হঠাৎ খেয়াল করলো তার হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কৃষ্ণার স্নিগ্ধ মুখখানা তার মনে শীতল পরশ বুলাচ্ছে। বুকের বা পাশটা চেপে ধরে মনে মনে ভাবতে লাগে,
” কেনো আমার সাথে এমনটা হচ্ছে! এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে এমনটা যেনো প্রথম হচ্ছে। বুকের স্পন্দন বাড়ছে, এ যেনো অন্য অনুভূতি। আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছি! হয়তো কাজের চাপে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই হবে”
নিজের মনকে শান্তনা দিলেও মন যে অবাধ্য। বেহায়া হয়ে কৃষ্ণাকে দেখে যাচ্ছে। কৃষ্ণার উপস্থিতি যেনো মনকে শান্ত করে রাখে৷ তার হাসি, সুর, কথা সবকিছুতেই যেনো একরকম মাদকতা। যে মাদকতা দেবব্রতকে ভুলিয়ে দেয় তার জীবনে আগেও কোনো নারী ছিলো৷ তিন মাস আগের দেবব্রত আর তিন মাস পরের দেবব্রতের মাঝে যেনো অনেক তফাৎ। এই দেবব্রতের সকাল হয় কৃষ্ণার সুরেলা কন্ঠের আরতী শুনে। যে দেবব্রত কখনো ঠাকুরের কাছে মাথা ঠেকায় নি সেই দেবব্রত সকালে স্নান করে ঠাকুর ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে কৃষ্ণার গলার আরতী শুনবার জন্য। মেয়েটা কেমন যেনো অভ্যেসে পরিণত হয়েছে তার জন্য। তার মুখের পাকা পাকা কথাগুলোতে কেনো যেনো সকল ক্লান্তির অবসান ঘটে দেবব্রতের। যখন “মাষ্টারমশাই” বলে তালে সম্মোধন করে এটা যেনো অন্য এক শান্তি। আজকাল সৌদামিনীর জন্য ও তার মন কাঁদে না। দামিনীকে সে এখনো ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসাটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ বরং সেই মনের মণীকোঠায় একটা স্নিগ্ধ মুখ যেনো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এটা সে কখনোই স্বীকার যাবে না। তার কাছে কৃষ্ণা শুধুই দায়িত্ব। শুধুই দায়িত্ব। তাই তো বিকেলে ফিরতেই কৃষ্ণার হাতের কফিটুকু তার চাই ই চাই। কৃষ্ণা এক ঘরে তার সাথে এই দুদিন রয়েছে কিন্তু তাতে খুব যায় আসছি না দেবব্রতের। কিন্তু তবুও স্বীকার যাবে না যে কৃষ্ণাতে মজেছে সে। পাছে তাকে কাপুরুষ প্রেমিকের পদবী নিতে হয়। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে একজন মানুষ কেবল একজন মানুষকেই ভালোবাসতে পারে। যদি তার মনে নতুন ভালোবাসার উদয় হয় তবে সে হয় প্রতারক নয় আগের মানুষটিকে সে কখনোই ভালোইবাসতো না। কিন্তু দেবব্রত তো দামিনীকে ভালোবাসতো। আদৌও বাসতো তো______
সূর্য ঢুবতে বসেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। পাখিরা বাড়ি ফিরছে ঝাকে ঝাকে। ইটপাথরের শহরটা খানিকক্ষণের জন্য লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সৌদামিনী। মনটা তার খুব অস্থির। আজ দু দিন হলো তার দেব গ্রামে গেছে। একটা বার যোগাযোগও হয় নি। একবার ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। দেবব্রত ফোন ধরে নি। ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। আচ্ছা যে সম্পর্কের চিতায় আগুণ দিয়ে দিয়েছে সেটা থেকে কি আদৌও কিছু পাওয়া সম্ভব। হাত দিলে তো নিজের হাত ই পুড়বে। তার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। দেবব্রত তার সাথে শুধু বন্ধুর মতোই আচারণ করছে। এমনটা তো তার ভাবনায় ছিলো না। সারা নানাভাবে তাকে লেগে থাকার জন্য মোটিভেট করছে। কিন্তু তার মনটা বেশ অস্থির লাগছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে দেবকে সে যত ধরতে চাইছে ততই দূরে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। না সে হার মানবে না। তখনই অনুরাগ বাবু আসেন তার ঘরে। মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,
– মিনী মা কি করছো?
– কিছু না বাবা, সূর্যাস্ত দেখছিলাম।
– কফি খাবে?
– খাওয়া যায়।
– তোমার কি মন খারাপ?
– কেনো বলতো বাবা?
– আজ কফি খেতে চাইছো। তুমি তো কফি খাও না।
– তেমন কিছু না বাবা। পরিবর্তন ই তো জীবন বলো।
– হ্যা সে ঠিক আছে। আচ্ছা আজ কলেজ গেলে না যে!
সৌদামিনী কিছু বললো না, কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। দেবব্রত নেই বলে কলেজে যায় নি, শুনলে বাবা কিছু হয়তো বলবেন না। কিন্তু ভালোভাবেও নিবে না। অনুরাগ বাবু নীরবতা ভাঙ্গতে বলে উঠলেন,
– তুমি কি জানো আই এম প্রাউড অফ ইউ।
– কেনো বাবা? কি তীরটা মারলাম আমি?
– কজন পারে নিজের ভালোবাসাকে এভাবে বিলিয়ে দিতে। তুমি ঠিক করেছো মা, দেবব্রতকে দোটানা থেকে মুক্তি দিয়ে। বিয়ের বোঝাটা ও কখনোই তোমার সাপোর্ট ব্যাতীত পালন করতে পারতো না। তুমি তাকে মুক্তি দিয়েছো বলেই ছেলেটা ওই মেয়েটাকে তার সঠিক অধিকারটা দিতে পারছে। আসলে তো দোষ তো ওদের কারোর নয়। বরং দোষটা সময়ের, নিয়তির। আই এম প্রাউড অফ ইউ৷ ওই বাচ্চা মেয়েটার সাথে হিংসে না করে তার জন্য তুমি নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়েছো তাই।
বাবার কথাগুলো চুপ করে শুনলো দামিনী। নিজের চোখেই নিজে ছোট হয়ে গেছে। সে যে হিংসে করে মেয়েটাকে। খুব হিংসে করে। ভয় হয় তার যদি দেবের মনে মেয়েটা নিজের নামের জায়গা করে ফেলে_______
১৩.
খাওয়া শেষে উঠোনে প্রদীপ জ্বেলে আড্ডারত কৃষ্ণা এবং তার বান্ধবীরা। গ্রামের এই এক মজা, অল্প রাতেও মনে হয় অনেক রাত। আর শীত কাল হলে তো কথাই নেই। সবাই প্রায় ঘুমে। তখন এই ৬-৭ জন কিশোরী চাঁদর সোয়েটার জড়িয়ে বসে আছে উঠোনে। ফিসফিস করে গল্প করছে। গল্পের যেনো অন্ত নেই। আগামীকাল তাদের সখী চলে যাবে। তাই তারা আজ যেনো সব কথা বলে নিবে। আবার কবে না কবে আসা হয় কৃষ্ণার। আড্ডার এক পর্যায়ে শিপ্রা কৃষ্ণাকে মজার ছলেই বললো,
– এবার আমাদের তোর কথা বল। জামাইবাবু তোকে কতটা ভালোবাসে? ফুলসজ্জা রাতে তোকে তিনি কি দিলেন?
ফুলসজ্জাতে বরেরা স্ত্রীকে একটি উপহার দেয়। কিন্তু অবুঝ কৃষ্ণার সেটা একেবারেই জানা ছিলো না। সত্যি বলতে তার ফুলসজ্জাই তো হয় নি। তার সেই রাতটা কি ভোলা যায়। মাঝ রাত থেকে বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে। আর ভোর বেলায় উপহার স্বরুপ যে অপমানটা ভাগ্যে জুটেছে তা শুধু তার গোপাল আর সেই জানে। শিপ্রার প্রশ্নে কৃষ্ণা যেনো একেবারেই চুপ মেরে যায়। কি বলবে! ভালোবাসা নয় দয়া পেয়েছে সে তার মাষ্টারমশাই এর কাছ থেকে। আর তার ভালোবাসা তো অন্য কেউ। কলেজের ফাঁকে যখনই মাষ্টারমশাই এর রুমের সামনে থেকে পাশ কাটায়, খেয়াল করলেই দেখতে পায় দিদিমনি বসে রয়েছে। তাদের মধ্যের কথোপকথন ই যেনো অন্যরকম। এমন ভাবে কখনোই মাষ্টারমশাই তার সাথে কথা বলে না। ঠোঁটের কোনায় ম্লান হাসি টেনে কৃষ্ণা বলে,
– ভালোবাসে কি না জানি না, তবে সে আমাকে অনেক স্নেহ করেন। আমার জন্য তাকে কতো ত্যাগ স্বীকার যেতে হয়েছে। আর উপহার, দিয়েছেন তো। আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাকে বড় এক কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। এর থেকে বড় উপহার হয়! তিনি চান আমি তার যোগ্য হয়ে গড়ে উঠি।
– তোর সাথে হিংসে করতে ইচ্ছে হয় জানিস। কি কার্তিক ঠাকুরের মতো বর পেয়েছিস! আহা নজর না লাগে, আঁচলে গিট্টু দিয়ে রাখিস। যদি কেউ কেড়ে নেয়।
– আস্তো মানুষটাকে কিভাবে কেড়ে নিবে রে!
– আরে বলদ, এই কেড়ে নেওয়া সেই কেড়ে নেওয়া নয়। তোকে নিয়ে সত্যি ভয় হয়৷ তুই শহরে থেকেও লাভ হয় নি।
শিপ্রার কথা শুনে কৃষ্ণা কোনো কথা বলে না শুধু খিলখিল করে হাসে। সত্যি তার মনটা এখনো সেই গ্রামের সরল কৃষ্ণার মন। তাই তো সব দেখেও কিছুই বলে না। তার ধারণা একটা সময় তার মাষ্টারমশাই ঠিক তার ই হবে। সময় লাগবে কিন্তু হবেই, হতেই হবে। নয়তো তার করা কষ্ট যে সব জলে যাবে। মানুষটার যোগ্য হয়ে উঠার জন্যই তো এতো কিছু। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণার সকল কথোপকথন শুনতে পেলো দেবব্রত। মেয়েটা ছোট হলেও বুদ্ধিমান। এতো অপমানিত হবার পরও কাউকে কোনো অভিযোগ করে নি। বরং শ্বশুরবাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেবব্রত মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে তার বউকে। মেয়েটা এই তিনদিন যেনো আরোও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ভট্টাচার্য মঞ্জিলের কৃষ্ণাবতী সাহা আর এই কৃষ্ণার মধ্যে রাত আর দিন তফাৎ। মাথাটা তার ব্যাথা করছে। হয়তো জ্বর আসবে। শিশিরে শুধু চাঁদর গায়ে হাটার ফল। ঔষধের জন্য কৃষ্ণাকে ডাকতে আসা। কিন্তু বান্ধবীদের সাথে এতো মনখুলে হাসতে দেখে আর বিরক্ত করলো না। পরশু থেকে তো আবার সেই ইটপাথরের জীবন। নিঃশব্দে চলে গেলো বিছানায় সে। কম্বলখানা জড়িয়ে শুয়ে পড়লো দেবব্রত। রাতটা কেটে গেলেই হয়তো জ্বর নেমে যাবে। তখন কানে এলো,
“তোমায় গান শোনাবো
তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া
তোমায় গান শোনাবো
চমক দিয়ে তাই তো ডাকো
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকো
ওগো দুখজাগানিয়া
তোমায় গান শোনাবো
ওগো দুখজাগানিয়া
তোমায় গান শোনাবো
এলো আঁধার ঘিরে
পাখি এলো নীড়ে
তরী এলো তীরে
এলো আঁধার ঘিরে
পাখি এলো নীড়ে
তরী এলো তীরে
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুখজাগানিয়া
তোমায় গান শোনাবো
ওগো দুখজাগানিয়া
তোমায় গান শোনাবো”
কৃষ্ণা গান গাইছে। এই সুমধুর কন্ঠটাই যথেষ্ট দেবব্রত ক্লান্তি দূর করতে। মনের মাঝে যেনো একরকম প্রশান্তি বয়ে গেলো। চোখ বুঝে এলো দেবব্রতের৷ ঠোঁটে শান্ত হাসি_______
ঘরে যখন কৃষ্ণা পৌছালো তখন অনেক রাত। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে এলো সে। মাষ্টারমশাইকে জাগানো যাবে না। হারিকেনটা জ্বলছে। দেবব্রত তখন কম্বল মুড়ি দিয়ে অপরপাশে ফিরে ঘুমিয়ে রয়েছে। কৃষ্ণা ভেবেছিলো মাষ্টারমশাই হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছেন। সারাদিনের এই ঘুমের সময়টা তার খুব ভালো লাগে। মাষ্টারমশাই এর কাছাকাছি থাকতে পারে। একটু নির্লজ্জ বললে ভুল হবে না তবে মাষ্টারমশাই এর কাছ থেকে একটা মাতালকরা গন্ধ পায় কৃষ্ণা। এটা মাষ্টারমশাই এর গায়ের গন্ধ। এটা একরকম মাতাল করে তুলে কৃষ্ণাকে। কৃষ্ণার ধারণা দেবব্রতের শরীরে এলকোহল তৈরি হয়। নয়তো তার নেশা নেশা লাগার কারণটা কি! সে তো জানে না এই নেশা তো যে সে নেশা নয়, এই নেশা ভালোবাসার নেশা। শোবার সময় খেয়াল করলো দেবব্রত রীতিমতো কাঁপছে। কপালে হাত দিতেই শিউরে উঠলো কৃষ্ণা। ভীম জ্বর দেবব্রতের। সে রীতিমতো কুহাচ্ছে। এই রাতে মামাকে তোলা ঠিক হবে না। কিন্তু কি করবে তাও বুঝে উঠছে না। কাঁপা স্বরে বললো,
– মাষ্টারমশাই আপনার কি খারাপ লাগছে! মাষ্টারমশাই?
– হু,হু
দেবব্রত আর কিছু বললো না। শুধু কুহিয়ে যাচ্ছিলো। ছুটে গিয়ে কৃষ্ণা কলতলা থেকে পানি দিয়ে এলো। হাতের কাছে থার্মোমিটার নেই তবুও বলা যায় জ্বর ১০০ ছাড়ানো। মাথায় পানি দিলে জ্বরটা হয়তো কমবে সেই ভরসায় পানিটুকু নিয়ে এলো। শিপ্রাকে বলে ঔষধ আনালো। শিপ্রার কাছে প্যারাসিটামল ছিলো। কোনো মনে এই ভারী লোকটাকে সরালো। পানি ঢাললো মাথায়, জলপট্টি দিলো। কোনো মতে উঠিয়ে ঔষধ খাওয়ালো কৃষ্ণা। বাচ্চা মেয়েটার অবস্থা যেনো নাজেহাল। দেবব্রত তখন জ্বরে বেহুস বলা যায়। জ্বরটা খানিকটা কমলো শেষরাতে। সব কিছু গুছিয়ে ক্লান্ত কৃষ্ণা দেবব্রতকে ঠিকমত শুইয়ে দিলো। তখন দেবব্রত যেনো চোখ মেললো। কৃষ্ণা মৃদু কন্ঠে বললো,
– এখন কেমন লাগছে, ব্যাথা করছে?
– উহু, ভালো লাগছে।
– তাহলে ঘুমোন। গা খানিকটা ঘাম দিবে। কিন্তু জ্বর নেমে যাবে।
বলেই উঠে যখন যেতে যাবে তখনই হাতটা টেনে ধরলো দেবব্রত। এক হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো কৃষ্ণাকে তার। কৃষ্ণা কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে খেয়াল করলো তার অবস্থান এখন মাষ্টারমশাই এর বুকে। দেবব্রত জাপটে ধরে আছে থাকে। কৃষ্ণার যেনো দম বন্ধ লাগছে। এ যেনো অন্য এক অনুভুতি। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। দেবব্রত যেনো ঘোরের মাঝে আছে। নেশাগ্রস্ত চোখে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে কৃষ্ণার মুখখানা আদলে নিয়ে উঁচু করলো সে। কৃষ্ণার মুখের সবথেকে আকর্ষণীয় তার গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোঁড়া। দেবব্রত কি করছে নিজের ও জানা নেই। কৃষ্ণার বুক রীতিমতো ঢোল বাজাচ্ছে। কি করবে বুঝছে না। সে বুঝতে পারছে দেবব্রত তার মাঝে নেই। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের অধরে দেবব্রতের উষ্ণ ঠোঁটজোড়ার পরশ পেলো কৃষ্ণা। তৃষ্ণার্ত দেবব্রত তখন…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি