কে পর্ব-০৯

0
1230

#কে!!
#৯ম_পর্ব

নীতি যখন সাগরের উত্তাল দেখতে ব্যাস্ত তখন অনুভূত হলো কেউ তার চোখ পেছন থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা-মা এই কাজটা করবে না। লোকটির স্পর্শ চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। তখন লোকটি তার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– বলোতো আমি কে?

কন্ঠটা নীতির খুব পরিচিত। মনের অজান্তেই কন্ঠটা শুনে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। চোখে হাতের বাধন খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
– আপনি এখানে? জানলেন কিভাবে আমি এখানে আসবো?

লোকটা আর কেউ নয় স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধকে দেখে বেশ অবাক হয় নীতি। তাকে এখানে দেখবে কল্পনা করে নি নীতি। কিন্তু ভালোও লাগছে, লোকটাকে দেখতে আজকাল খুব ভালো লাগে নীতির। মনের গহীনে অজান্তেই লোকটাকে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। সেটা হয়তো নিজেও বুঝে নি। কেনো, কখন, কবে এই লোকটা তার অন্তরালকে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলেছে এটার উত্তর খোজাটা নীতির পক্ষে অসম্ভন। অবাক নয়নে আবারো স্নিগ্ধকে জিজ্ঞেস করে,
– বললেন না যে আপনি এখানে কি করছেন?
– ট্যুরে এসেছি। বন্ধুদের সাথে প্লান হলো তাই চলে এসেছি। তোমাকে এখানে দেখবো এটা যেনো সোনায় সোহাগা আমার জন্য।
– তাই বুঝি?
– হুম। এই দেখো না নীল সাগরের পাশে নীলাঞ্জনাকে কাছে পাওয়াটা সোনায় সোহাগা নয় কি?
– ফ্লার্ট করছেন?
– উহু, আমি ফ্লার্ট করতে পারি না। তোমার মনে হয় এগুণটা থাকলে আমার আজ সিংগেল থাকতে হতো?

স্নিগ্ধ এর কথাটা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নীতি। এই লোকটার সাথে থাকলে নীতির মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। হাসি থামিয়ে নীতি বললো,
– আপনার কখনোই কোনো গার্লফ্রেন্ড হয় নি এটা আমাকে মানতে হবে?
– মানা না মানা একান্ত তোমার ব্যাপার৷ এটা ভুল হবে বললে যে তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। এর আগেও আমি প্রেমে পড়েছি। তবে রিলেশনে যাওয়াটা হয় নি। আমি তো ফ্লার্ট করতে পারি নি। আমি যখনই কাউকে নিজের অন্তঃসত্তাকে উজার করে দেখাতে চাই তখন সে আমাকে একা ফেলে চলে যায়। খোলশ পরিহিত মানুষকে মানুষ খুব ভালোবাসে। কেউ ভেতরের মানুষটাকে ভালোবাসে না। আচ্ছা নীতি আমার কি ভুল যে আমি ছলনা করতে পারি না!!

নীতি চুপ করে স্নিগ্ধ এর সব কথা শুনছিলো। তার চোখের দিকে তাকাতেই কেনো জানে শুন্যতা অনুভূত হলো। যে চোখ তাকে সর্বদা মাতাল করতে ব্যাস্ত আজ সেই চোখে শুন্যতার হাহাকার অনুভূত হচ্ছে। স্নিগ্ধ এর শুন্যতা কোথাও না কোথাও তার হৃদয়েও বিধছে। মলিন হাসি হেসে বললো,
– অনেকেই আছে যারা খোলশকে নয় ভেতরের মানুষকে ভালোবাসে। আপনি হয়তো তেমন মানুষ খুজে পান নি।
– নীতি মুখে বলাটা অনেক কঠিন কিন্তু কাজে করাটা কিন্তু অনেক কঠিন। তুমি আমার সত্যিটা জেনে কখনোই আমাকে ভালোবাসবে না। বরং তোমার যে ভালোলাগাটুকু ছিলো সেটাও নষ্ট হয়ে যাবে।

কথাটা বলে সাগরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলো স্নিগ্ধ। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার। চোখের শুন্যতার হাহাকার সাগরের উত্তালতায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নীতি এক মনে তাকে দেখে যাচ্ছে। কোথাও না কোথাও তার শুন্যতার সাথে স্নিগ্ধ এর শুন্যতা মিলে যাচ্ছে। আজ এতোদিনের ভালোথাকার খোলশটা কেনো যেনো খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সব থেকেও কি আদৌ সব আছে তার!!

সকাল ১১টা,
বাবা-মার দরজার বাহিরে চিৎকার শুনছে নীতি। ভেতরে অকথ্য ভাষার কিছু কথা কানে আসছে নীতির। আদনান সাহেবের কলার টেনে ফারহানা বেগম বলছেন,
– ওই ****টার সাথে এখনো ফস্টি নস্টি করতে তোমার লজ্জা লাগে না। মেয়ে বড় হয়েছে, কোথায় এখানে মেয়েকে আমরা সঙ্গ দিবো তা না তুমি রয়েছো নিজের রঙ্গলীলা নিয়ে।
– মুখ সামলিয়ে কথা বলো ফারহানা।
– কি মুখ সামলাবো, অস্বীকার করতে পারবে,, ওই রেশমি এখানে আসে নি।
– আজিব তো রেশমি তার পরিবারের সাথে এসেছে। এখানে আমার কি সম্পর্ক?
– আসলেই তোমার কোনো সম্পর্ক নেই? তাহলে এই ছবিটার কি অর্থ বলো?
– তোমার আসলেই মাথায় সমস্যা আছে। একটা মানুষ কি একটা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না।
– ওহহ তাহলে বলছো তুমি তার সাথে শুধু কথাই বলছিলে, আমাকে ভূগোল বুঝাচ্ছো?
– বেশ হ্যা আমি ওর সাথে আমার মনের শখ মিটাতে কথা বলছিলাম। আমি এখন ও ওকেই ভালোবাসি। তোমার তাতে কোনো সমস্যা আছে? তোমার তো আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার নেই। ভুলে যেও না আমাদের স্বামী- স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র নীতির জন্য আমাদের এক সাথে থাকা। ডিভোর্স না হলেও আমি তোমাকে বরদাস্ত করছি শুধু নীতির জন্য।

আদনান সাহেবের কথায় ফারহানা বেগম একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। আদনান সাহেব একটি কথাও ভুল বলেন নি। মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে খাটে বসে পড়েন ফারহানা বেগম। নীতি সব শুনছে, বুঝতে পারছে তারা আবারো ঝগড়া করছে। কিন্তু আজ তাদের ঝগড়াটা কিউট রোমান্টিক ঝগড়ার মতো মোটেই মনে হচ্ছে না নীতির কাছে। ভেবেছিলো ভ্যাকেশনে এসে হয়তো শান্তি পাবে সে। কিন্তু হলো কোথায়? এখানেও একই অশান্তি। ভেবেছিলো বাবা-মা হয়তো বদলে যাবে। আবার সেই আগের তিনজনের পরিবার হয়ে যাবে তারা। কিন্তু সব যেনো গোলমেলে হয়ে গেছে। হারিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। কেনো যেনো মিলিয়ে যেতে মন চাচ্ছে সেখানে কেউ তাকে খুজবে না। যেখানে কোনো কষ্ট থাকবে না। চোখ ভিজে এসেছে নীতির। না চাইতেও আবারো কাঁদছে সে। যাদের ইমপোর্টেন্স তার জীবনে এতোবেশি, তাদের জীবনেই কোথাও তার কোনো গুরুত্ব নেই। নিজেকে আজ যেনো নিঃস্ব মনে হচ্ছে। নিজের মাঝেও কোথাও না কোথাও শুন্যতার হাতছানি পাচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকাটা সম্ভব নয় নীতির পক্ষে। ছুটে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ছুটতে ছুটতে হোটেলের সীমানার বাহিরে চলে গিয়েছে সে। নিজের আবেগের তাড়নায় ছুটছে। ছুটতে ছুটতে একটা সময় আশেপাশে তাকালে দেখে, হোটেল থেকে অনেক দূরেই চলে এসেছে সে। চারিপাশের অচেনা মানুষের ভীড়ে নিজেকেই যেনো হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলো নীতি। সামনে নীল সাগরের উত্থাল ঢেউ এর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে মন চাচ্ছিলো। নিজের আনমনেই হাটতে হাটতে কখন যে সাগরের পানির কাছে চলে গিয়েছিলো নিজেরও খেয়াল নেই। একটা ঢেউ এর আছড়ে পানির গভীরে তলিয়ে গেলো নীতি। হয়তো চেষ্টা করলে উঠে যেতে আরে সে। কিন্তু একাকিত্বের প্রভাবে আবেগে হারিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটুকু ও শেষ হয়ে গেছে তার। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে নীতি। হঠাৎ একজোড়া হাত তাকে ঝাপটে ধরে সেখান থেকে উঠিয়ে আনলো।

দুপুর ২টা,
জাহাজ এসে তীরে নেমেছে। একটা ব্যাগ কাধে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমেছে নির্ভীক। গন্তব্য নীতির কাছে। নীতিকে নিজের কাছ থেকে হারাতে চায় না সে। এক অজানা ভয় তাকে খেয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেনো একটা খটকা কাজ করছে। হাবীবের ফোনে খটকাটা সন্দেহে পরিণত হয়েছে। কেউ নীতির ক্ষতি করতে চায়। তাকে খুব বাজে ভাবে খুনের দায়ে ফাসিয়ে দিয়েছিলো। এখন যদিও প্রমাণ স্পষ্ট যে, নীতি খুনটি করে নি। কিন্তু প্রমাণের পরিমাণটা অনেক স্ট্রং ছিলো। আফরার কাছ থেকে কথাগুলো শুনার পর নীতির সামনাসামনি হবার প্রবণতা যত বেশি ছিলো। হাবীবের সাথে কথা হবার পর আরো নীতিকে দেখতে চায় সে। নীতির বাবার কাছ থেকে এড্রেস নিয়ে তাদের হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছে সে। হোটেলের কাছাকাছি এসে দেখলো ঝটলা বেধে আছে। ফারহানা বেগম কাঁদছেন। আদনান সাহেব ছুটাছুটি করছেন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে নীতিকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ভীক যে ভয়টা পেয়েছিলো সেইটা ঠিক হলো। তবে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললো নীতিকে সে!! না না নীতিকে খুজে বের করতেই হবে। যেভাবে হোক______

রাত ১১টা,
পিটপিট করে চোখ খুলে নীতি। আশেপাশের পরিবেশটা বড্ড অচেনা। কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। মাথায় ব্যাথা হচ্ছে। অসম্ভব ব্যাথা। কোথায় আছে সে? মরে গিয়েছে? নাহ জাহান্নামে তো খাট থাকবে না তাহলে কোথায় আছে সে। হঠাৎ…..

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি