কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
1083

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#শেষ পর্ব

জুলিনা জুম্মন আলীর নাম দিয়েছে বেক্কল আলী। এই নাম সবার পছন্দ হয়েছে। আড়ালে সবাই জুম্মন আলীকে এই নামেই ডাকে। জুম্মন আলীর সঙ্গে জুলিনার বিয়ে হয়েছে সাদামাটা ভাবে। জুম্মন আলীর ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ রাজী ছিলেন, আবার কেউ কেউ ছিলেন। তাতে অবশ্য জুলিনার মাথা ব্যথা নেই। তার মাথা ব্যথার কারণ বিচ্ছু বাচ্চা দুটো। জুলিনার বিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় জয়ীতার বাবা, মা আদনান তিনজনেই খুশি। অবিরাম কথা বলা ছাড়া জুম্মন আলী ভালো মানুষ ই। তবে সকলের ধারণা এই কথা বলা রোগ জুলিনার বদৌলতে কমবে।

আদনান খুব খুশি হয়েছে এই বিয়েতে। নিজেকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান, বিবেকবান ভাবলেও কখনো এরকম বিষয় মাথায় আসে নি। জয়ীতা ঠিক কী বুঝেছে জানে না তবে আদনান জুলিনার মধ্যে সংসার করার যে আকুলতা দেখেছে তাতে ওর নিজের ই খারাপ লেগেছে। এই মানুষ’টার হয়তো গুছিয়ে সংসার করার খুব লোভ ছিলো। কিন্তু কেউ উদ্যোগ নেয় নি বলে করতে পারে নি। দ্বিধা সংকোচের কারণে কাউকে বলতেও পারে নি।

আদনান আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছে। জয়ীতা অনেক কিছুই বুঝে যায়। মন খারাপ, ভালো লাগা সবকিছু। সেটা শুধু ওর ক্ষেত্রে না। তাসিন নওশিনের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার। আদনানের খুব ভালো লাগে এই বিষয় টা। জীবনের কাছে ও অনেক কিছু চায় নি, তবুও পেয়েছে। এই পাওয়া নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আদনান চায় সারাটা জীবন ই এমন থাকুক। প্রতিটি দিন বৈচিত্র্যময় হোক। অনেক বছর পর যখন স্মৃতির পাতা উল্টাবে তখন যেন আফসোস না হয় আগের দিনগুলো নিয়ে। যেন এমন টা মনে না হয়, আগের দিন ই ভালো ছিলো। সবসময় যেন একই রকম কাটে।

***
আজকের সকাল টা অন্যদিনের মতোই। গাছগুলো গত রাতের টুপটাপ ঝরে পড়া শিশিরে ভেজা। পাতার ফাঁক গলে সকালের মিষ্টি রোদ উঁকি দিচ্ছে। এখন বসন্তকাল। জয়ীতার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বসন্ত এবছর থেকে শুরু হয়েছে। তারমধ্যে আজকের দিন টা আরও বেশী সুন্দর। হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা মসলা দেয়া চা। আজকের চা’টা জয়ীতা বানিয়েছে। রোজ আদনান বানায় কিন্তু আজকের টা ওর বানানো।

বিয়ের পর জয়ীতা একটু একটু করে অনেক টা বদলে গেছে। এটা একটা বড় রহস্য। কেন বদলে গেল ও নিজেও জানেনা। ছন্নছাড়া একটা জীবন চেয়েছিল। কিন্তু এখন এই চার দেয়ালের মায়ার জীবন টুকুও ভালো লাগছে। ভাবী ভাবী করে সারা ঘর মাতিয়ে রাখা দুই ননদ বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যাবে সেটা ভাবতে গেলেও চোখে পানি এসে যায়। জয়ীতা আদনান কে বলে দিয়েছে তাসিন, নওশিন দের বিয়ে দিয়ে দূরে পাঠানো চলবে না। ওরা এখানেই থাকবে। ঘরজামাই থাকতে রাজী হবে এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। আদনান হেসে উড়িয়ে দিলেও জয়ীতা ব্যাপার টা নিয়ে ভীষণ ই সিরিয়াস।

আর আদনান হলো জয়ীতার কাছে এক অন্য রকম মানুষ। যাকে কোনো কিছু বলতে হয় না। আপনাআপনিই সব বুঝে যায়।

জয়ীতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। অন্যমনস্ক থাকায় টের ই পায় নি আদনান পেছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে। আদনান আরেকটু কাছে এসে জয়ীতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। জয়ীতা প্রথমে চমকে গেলেও পরে সামলে নিলো নিজেকে। এক নজর আদনান কে দেখে হাসলো। আদনান জয়ীতার কানের পাশের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কী একটু নার্ভাস। ”

জয়ীতা জবাব দিতে এক সেকেন্ড সময়ও নিলো না। বলল,

“না।”

“সত্যি?”

“হু।”

“অনেকক্ষন ধরে তোমাকে নোটিশ করছিলাম। দেখে মনে হলো একটু নার্ভাস। ”

জয়ীতা আদনানের হাতের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বুক ভরে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা নিলো। আদনান জয়ীতার কানের পাশে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,

“ডোন্ট ওরি, আমি সবসময় ই তোমার পাশে থাকব।”

***
আজকের পার্টিটা মূলত দুটো কারণে দেয়া হয়েছে। প্রথম কারণ টা হলো জুলিনা আর জুম্মন আলীর জন্য। এই বয়সে এসে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে বিয়ে করতে কেউই আগ্রহী ছিলো না। তাই জয়ীতার প্রবল আপত্তি থাকা সত্যেও সাদামাটা ভাবে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছে। তাই আজ এই পার্টির আয়োজন। আজকের পার্টিতে জুলিনা ভালোমতো সাজগোজ করেছে। একদম সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো সাজগোজের কারণে দেখতেও চমৎকার লাগছে। আজকের পার্টিতে জুলিনা গুলশানের ভাবী, মিরপুরের ভাবী সবাই কে ডেকেছে। যারা সবসময় ও’কে দেখিয়ে দেখিয়ে স্বামীদের সঙ্গে বুড়ো বয়সেও আহ্লাদী করতো। আবার রসিয়ে রসিয়ে স্বামী সোহাগের গল্প করতো। আজ সবাই আসুক, দেখুক জুলিনারও একটা স্বামী আছে। এরপর থেকে স্বামীর গল্প সেও করতে পারবে।

আলম সাহেব আর তার পরিবার কে এই পার্টিতে ইনভাইট করা হয় নি। জুলিনা বিয়ের পর জুম্মন আলীকে নিয়ে একদিন আলম সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল। গিয়ে আলম সাহেবের স্ত্রীকে বলেছিল,

“বড়বোন আসছে। কদমবুচি কর। ”

জুলিনার উদ্দেশ্য ছিলো ওদের বিব্রত করা। সেই উদ্দেশ্য সফল করে চলে আসছে।

***
জয়ীতা আজ পরেছে গাঢ় গোলাপি রঙের জামদানী শাড়ি। সঙ্গে হিরের ছোট গয়না। চুলগুলো স্ট্রেইট করেছে। যদিও স্ট্রেইট চুল দেখে আদনান বলেছে জয়ীতাকে বড় বড় লাগছে। কার্লি চুলে নাকি দুষ্ট লাগে। জয়ীতা সিদ্ধান্ত নিলো আবারও চুল কার্লি করাবে।

আজকের পার্টিতে প্রথম ও শেষবারের মতো ওর আত্মীয় স্বজনরা আসবে। সবাই কে নিজে ফোন করে ইনভাইট করেছে সেই সঙ্গে কার্ড পাঠিয়েছে। এমনকি সাইমুন কেও ইনভাইট করেছে। আদনানের কথা শুনে ও সত্যিই সাইমুন কে ফেস করতে চায়। তাছাড়া জয়ীতা এখন খুব ভালো আছে। এই ভালো থাকার মধ্যে নেগেটিভ বিষয়গুলো ভেবে খারাপ থাকতে চায় না। ভুল বোঝাবুঝি, মান অভিমান ব্যাপার টা ও নিজেও মিটিয়ে নিতে চায়।

***
আজ সবাই সেজেগুজে এসেছে। শুধু লিজা আসতে পারে নি। লিজার মেয়ে বাবু হয়েছে। মেয়ের ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে সাবধানতা অবলম্বন করছে খুব। সে কারণে এই পার্টিতেও আজ মিসিং। তবে জয়ীর ভাই খুব ই এক্সাইটেড। এতদিন কাজিন গ্রুপে আদনান জয়ীতার আপডেট গুলো দিয়ে সবার মনে আগুন জ্বালাতো। আজ সামনাসামনি জ্বালাবে।

জুম্মন আলী ভদ্রলোক হেলথকেয়ার সিস্টেম নিয়ে ছোট খাট আসর শুরু করলেন একপাশে কয়েকজন কে নিয়ে। জুলিনা রাগে গজগজ করছে। তাও আবার মিরপুরের রোকসানা ভাবীর হাজবেন্ডের সঙ্গে। জুলিনা নওশিন কে দেখে বলল,

“এই যাহ! বেক্কল আলীকে ধরে নিয়ে আয়। ”

নওশিন ইতস্তত করে বলল,

“আন্টি আঙ্কেল তো কথা বলছে। ব্যাপার টা ঠিক হবে।”

জুলিনা রাগী গলায় বলল,

“আমাকে ব্যাপার শিখাতে আসিস না। যা তাড়াতাড়ি। ”

নওশিন গিয়ে জুম্মন আলী কে বলল,

“আঙ্কেল, মামী আপনাকে না দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যান।”

জুম্মন আলীর যক্ষ্মারোগ শুরু হলো। প্রথমে শুকনো কাশি দিয়ে শুরু হলেও পরে ভয়ংকর রুপ নিলো।

****
জয়ীতা ভেবেছিল যাদের ইনভাইট করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই আসবে না। হাসিমুখে হু হা করলেও আসবে না। জয়ীতার সঙ্গেও এমন অনেক হয়েছে। ওর মেজ খালামনির মেয়ে চৈতীর বিয়ের সময় খালামনি যেতে বললেও ও যায় নি। অথচ যত বার ফোন করেছে ততো বারই এমন ভাব করেছে যে জান প্রাণ এক করে হলেও ও যাবেই যাবে।

চৈতী, রিতি, জিসান, পায়েল আতিক সবাই ই এসেছে। সেজেগুজে এসেছে। জয়ীতা খুশি হতে চেয়েও পারলো না। নিজের কর্মকান্ডে নিজেই হতাশ হলো। আদনান অনেক করে বুঝিয়েছে নরমাল থাকতে। সকালে উঠে নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে নরমাল থাকবে। কিন্তু পারছে না। সবাই ও’কে দেখে এমন ভাব করছে যেন ও’র সঙ্গে এতোদিন দেখা না হওয়ায় সবাই মরে যাচ্ছিলো। তবে খানিক বাদেই শুরু হলো খোঁচা দেয়া। রিতি আপদামস্তক দেখে বলল,

“কী ব্যাপার রে জয়ী, কোনো গেট টুগেদারে এটেন্ড করিস না, তারপর আমাদের ফেসবুকে রাখিস না। মানলাম তুই এতো বড় ক্রিকেটারের বউ। আমরা তো আর রাস্তা থেকে উঠে আসা কেউ না। ”

জয়ী মনোযোগ দিয়ে রিতি কে দেখলো। সেই একই রকম আছে। কথার আঘাতে যে সামনের মানুষ টা ক্ষত বিক্ষত হতে পারে তাতে কোনো হেলদোল নেই।

জয়ীতা প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিসান বলল,

“বাদ দে এসব। এই টপিকে পরে কথা বললেও হবে। আগে আমাদের জেন্টলম্যানের সঙ্গে আলাপ করা। ”

জয়ীতা আদনান কে ডাকলো। আদনান ওর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল। জয়ীতার কাছে পঙ্গপাল যে অলরেডি এসে গেছে সেটা এতক্ষন খেয়াল করে নি। জয়ীতা তাসিন, নওশিন কেও ডাকলো। জয়ীতার কাজিন রা ওদের তেমন পাত্তা না দিলেও আদনান কে খুব পাত্তা দিলো। আদনানের সঙ্গে সেলফি তুলে চেক ইন দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। আদনান হাসিমুখে সেলফিতে যোগ দিলো। প্রতিটি সেলফিতে জয়ীতাকে হাসিমুখে পোজ দিতে হলো। আদনান সবার সঙ্গে পরিচিত হলো। সাইমুন এখনো আসে নি, অথচ জয়ীতার মুখের রঙ এরই মধ্যে পাল্টে গেছে।

প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর রিতি আদনান কে উদ্দেশ্য করে জয়ীতাকে বলল,

“জয়ী শোন, ছোট খালামনি, আম্মু, বড় খালামনি এরা সবাই ই কিন্তু নানুমনির আপন মেয়ে। তোর বিয়েতে সেই হিসেবে আমরাও ইনভাইট পাই কিন্তু। কবে কখন কী হয়েছে না হয়েছে তারজন্য এভাবে আমাদের ইগ্নোর করবি! আমাদেরও তো সোসাইটিতে চলতে হয়। ”

জয়ীতা জবাব দেবার আগে আদনান বলল,

“আসলে আমাদের বিয়েতে আমিই একটু প্রাইভেসি চেয়েছিলাম। কারণ আমি প্রাইভেট পার্সন। জয়ীতা কে বলা হয়েছিল, খুব কাছের লোকজন ছাড়া কাউকে যেন না বলা হয়। ”

রিতি জবাব দেবার কিছু খুঁজে পেল না। বাকীরা কেউ কিছু বলছে না। রিতিকে দেখে মনে হচ্ছে জ্বলে, পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আদনান ওখান থেকে সরে আসার আগে জয়ীতাকে নিয়ে এলো। নিচু গলায় বলল,

“বি নরমাল জয়ীতা। ”

জয়ীতা এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“নরমাল হতে চেয়েও তো পারছি না। মনে হচ্ছে আমিও জুলিনা হয়ে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে একেকটাকে দিয়ে ফুটবল খেলি।”

“ক্রিকেটারের বউ হয়ে ফুটবল খেললে ব্যাপার টা লোকের ভালো লাগবে না। ক্রিকেট ই খেলো। ”

জয়ীতা হেসে ফেলল। আদনানও হেসে ফেলল।

জয়ীতার কাজিন রা কেউই ব্যাপার টা মেনে নিতে পারছে না। প্রথমে বিয়ের খবর শুনে রীতিমতো শকড ছিলো। জয়ীতার মতো এভারেজ মেয়ে আদনান ফয়সালের মতো একজন মানুষের ওয়াইফ। কিন্তু আজ এভারেজ জয়ীতাকে দেখে প্রথমে চিনতে সবারই কষ্ট হলো।

জয়ীতা কাউকে পাত্তাই দিচ্ছে না, এটাও সবার জ্বলুনির আরেকটা কারণ।

***
সাইমুন ও পরিবারসমেত এলো। আদনানের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর জয়ীতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কী অবস্থা জয়ীতা? কেমন আছ? ”

জয়ীতার ভালো বলতেও যেন অনেক কষ্ট হলো। জয়ীতা ভালো করে সাইমুন কে খেয়াল করলো। চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে, ওভার স্মার্ট বউ নিয়ে দিব্যি ভালোই আছে হয়তো। এমন ভাবে কথা বলছে যে কোনোকালেই কিছু হয় নি। আদনান জয়ীতার হাত ধরে আছে। জয়ীতার এখন আর খারাপ বা অস্বস্তি লাগছে না। আজকের দিন টা’র জন্য ও অপেক্ষা করেছে এতদিন। অবশেষে সেই দিন টা এলো।

***
খাবার দাবারের আগে জয়ীতা ঘোষণা দিলো যে সে একটা সারপ্রাইজ দিবে। সবাই নড়েচড়ে বসলো। জয়ীতা স্টেজে উঠলো। উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে এবার আদনানের দিকে তাকালো। আদনান মৃদু হেসে জয়ীতাকে আশ্বস্ত করলো। জয়ীতা বলতে শুরু করলো।

“আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন। এই দিন টার জন্য আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ জানেন যে ফিল্ম বানানোর জন্য আমি স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম। ফাইনালি সেই স্ক্রিপ্ট শেষ হয়েছে। কাস্ট, ক্রু সবকিছু ফাইনাল। নতুন বছরের শুরুতে শ্যুটিং শুরু হবে।”

সবাই হাততালি দিলো। কেউ কেউ ঠোঁটও উল্টালো। জুলিনা বিড়বিড় করে বলল,

“প্রফেসর বাপের মাইয়া ভালোই বক্তৃতা দিতে শিখছি। ”

জয়ীতা আবারও বলল,

“গল্পটা ভীষণ ই সাদামাটা। একটা এভারেজ মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। এভাবেই শুরু…… সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো সেই গল্পের প্রতিটি চরিত্র আজ এখানে উপস্থিত আছে। তবে গল্পের প্রয়োজনে আমি সত্যির সঙ্গে কিছু মিথ্যেও যোগ করেছি যেন চরিত্রগুলো রিলেটেবল হয়।…..

সাইমুন এবার নড়েচড়ে বসলো। মাই গড! জয়ীতা কী করতে যাচ্ছে! জয়ীতা এখন পাব্লিক ফিগার। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্ট্রিমিং হলে সর্বনাশ।

জয়ীতা আরও জানালো যে চরিত্রদের নাম সত্যিকারের নামগুলোই ব্যবহার করা হবে। তখনই কিছু লোকের মুখোশ খসে পড়বে।

সাইমুন বিচলিত হলো। ক্যারিয়ারের শীর্ষে অবস্থান করলেও ও আদনান ফয়সালের সমকক্ষ কোনোভাবেই না। জয়ীতা যেভাবে বলছে সেভাবে যদি হয় তাহলে ওর ফ্যামিলি, কলিগ সবাই ই তো জানবে। এমনকি ওর মেয়েও! সাইমুন ভাবতে পারছে না…. হাত, পা কাঁপছে।

রিতি নার্ভাস গলায় বলল,

“সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে…..

কথা শেষ করতে পারলো না। জিসান বলল,

“সামান্য বলিস না প্লিজ, ওই সময়ে ওর উপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। সেটা জেনেও সামান্য বলে নিজেদের দোষ আড়াল করিস না। সেদিন তোদের দিন ছিলো, আজ ওর দিন এসেছে। সময় আসলে কাউকে ছাড় দেয় না।”

জুলিনার ভারী ভালো লাগলো। পা ব্যবহার না করেও কী সুন্দর সবাইকে লাত্থি মারার ব্যবস্থা করলো মেয়েটা। নাহ জুলিনার চয়েজ অত্যন্ত ভালো। জয়ীতা তো ওর পছন্দের ই।

জয়ীতার কথা বলা শেষ হতেই আদনান এসে পাশে দাঁড়ালো। বলল,

“আমি সবসময়ই তোমার পাশে আছি।

পরিশিষ্টঃ

জুলিনা এয়ারপোর্টে তাসিনের সাথের ছেলেটাকে দেখে জয়ীতাকে জিজ্ঞেস করলো,

“ছেলেটার নাম কী?’

“ইমন।”

“দেখছস! আমি বলছিলাম না যে ইমন কোনো মেয়ের নাম না। ছেলেরই নাম। ”

জয়ীতা চুপ করে রইলো। জুম্মন আলী কক্সবাজার ট্যুরের প্ল্যান করেছে। বাচ্চা দুটোও সঙ্গে যাচ্ছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারনে তাসিন, নওশিনও সাথে যাচ্ছে। অবাক করা বিষয় হলো এই দুই বোন জুম্মন আলী কে ভীষণ পছন্দ করে। এরা মাঝেমধ্যে আহ্লাদ করে বেক্কল মামাও ডাকে। জুলিনা রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায় এই ডাক শুনলে। নিজে বেক্কল ডাকবে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু ওরা কেন ডাকবে।

আদনানও জুম্মন আলীকে মামা ডাকতে শুরু করছে। এরাই বোধহয় পৃথিবীর আশ্চর্য তিন জীব, যারা মামার প্রাক্তন বউয়ের হাজবেন্ড কে মামা ডাকছে।

তাসিনের আবদারে ওর বিশেষ বন্ধুকেও কক্সবাজার প্ল্যানে নেয়া হচ্ছে। তার কাজ হচ্ছে ফটোগ্রাফারের দায়িত্ব পালন করা।

জুলিনা যাবার আগে জয়ীতার কানে কানে বলল,

“এসেই যেন ভালো, মন্দ খবর পাই। ”

জয়ীতা বলল,

“হাইব্রিড পদ্ধতি অবলম্বন করব?”

জুলিনা কটমট চোখে তাকালো।

***
জয়ীতা এয়ারপোর্ট থেকে এসে আদনানের জন্য অপেক্ষা করছে। আদনান প্র‍্যাকটিসে ছিলো। জয়ীতাকে দেখে বলল,

“আজ তুমি ড্রাইভ করছ নাকি?”

“হ্যাঁ। ”

“ভেরি গুড। কোথায় যাচ্ছি?”

“কোথাও না। শুধু ঘুরব। ”

“ওকে, ওকে।”

জয়ীতা প্রথমে গেল বিউটি পার্লারের সামনে। সেখানে গিয়ে বলল,

“এখানেই প্রথম জুলিনা আন্টির সঙ্গে দেখা। এই জায়গায় সেদিন না এলে আজ তোমার পাশে চিকন ঠ্যাংওয়ালা কোনো মেয়ে থাকতো। ”

আদনান হেসে ফেলল। বলল,

“আর তুমি নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে অনীশ কে মনেমনে গালাগালি দিতে। ”

জয়ীতাও এবার হেসে ফেলল। ঢাকা শহরের একটা অংশ চষে বেড়ানো পর গাড়ি যখন ঢাকার বাইরে এলো তখন আদনান জিজ্ঞেস করলো,

“আমরা কী তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি?”

“কী করে বুঝলে?”

“জানিনা। কীভাবে যেন তোমাকে বুঝে যাই। ”

জয়ীতা আদনানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।

আদনান বলল,

“আমার অবশ্য অন্য প্ল্যান ছিলো। ”

“কী প্ল্যান? ”

“আজ বাসায় ঢোকার সময় সিড়িতে তোমাকে কোলে তুলে নেব। বিয়ের দিনের ফিলিংস। এই ফিলিংস রিক্রিয়েট করতে চাই। কারণ সেদিন একটা ব্যাপার মিসিং ছিলো। ”

“কী ব্যাপার? ”

আদনান এক চোখ টিপে বলল,

“ফুলে ফুলে টোটাটুকি। ”

ঠিক সেই সময় জয়ীতা ব্রেক কষলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল,

“ধ্যাৎ!”

হঠাৎ গাড়ি থামানোয় পিছন থেকে অন্য গাড়ির হর্নের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

আদনান আফসোসের সুরে বলল,

“ইশ! আমার বউটা একটু বেশী সময় ধরে যে লজ্জা পাবে সেটাও পারছে না। ”

মাঝরাত, ব্যস্ত রাস্তা, গাড়ির শব্দ, তারমধ্যেই যেন জয়ীতা চোখ বন্ধ করে সাত রঙের রামধনু দেখছে।

….সমাপ্ত….