শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০১

0
888

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি
#সূচনা_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রাক্তন স্বামী সাইমনকে নিজের একমাত্র ননদের স্বামীর স্থানে দেখে থমকে যায় মুহুর্তেই আদিবা। পা জোড়া যেনো আর সামনে এগুচ্ছেনা আদিবার। সিঁড়ির কাছেই এসে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিবা কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার শক্তি যেনো সে হারিয়ে ফেলেছে। শরীরটা কাঁপছে, কপাল ঘামছে। এই মানুষটাকে জীবনে দ্বিতীয় বার দেখার আশা রাখেনি আদিবা কখনো। পাশেই অবাক করা দৃষ্টিতে আদিবার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহান। আজ মাত্র চারদিন হলো আদিবা আর আহানের বিয়ের। সাইমন কিছু কাজে দেশের বাহিরে ছিলো বলে বিয়েতে সে ছিলোনা, আজ সকাল ৬টাই সে দেশের মাটিতে পা রেখেছে।
আহান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আদিবার দুই কাঁধে নিজের দুই হাত রেখে বলে “কি হয়েছে সামনে এগুচ্ছো না কেনো?”
আহানের কথায় চমকে উঠে আদিবা, এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি যে আহান ওর সাথেই আছে। আহানকে কি বলবে বুঝতে পারছেনা আদিবা। খানিকটা চিন্তা করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আদিবা বলে “শুনছেন আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা, আপনি দেখা করে আসুন উনার সাথে। আমি একটু রুমে যাচ্ছি।” কথাটা বলে আর এক মুহুর্তও দেরি না করে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে নিজের রুমে চলে যায় আদিবা। আদিবার এমন কান্ডে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহান। হঠাৎ কি হয়েছে আদিবার চিন্তায় পরে গেছে আহান। আহান আদিবার পেঁছন পেঁছন রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওর একমাত্র ছোট বোন সানিয়া ওকে ভাইয়া বলে ডাক দেয়। সানিয়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়েই খেয়াল করে আহানকে। আহান আর রুমে যেতে পারলোনা। নিচে গিয়ে সবার সাথে বসে কথা বলছে সে কিন্তু মনের কোণে আদিবাকে নিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। আদিবার হঠাৎ করে এভাবে রুমে ছুটে যাওয়ার কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছেনা ইফাদ। কেমন জানি ঘোলাটে লাগছে ব্যাপারটা ওর কাছে। আদিবা মেয়েটা কেমন জানি অদ্ভুত টাইপের, মনের কথাগুলো কখনো শেয়ার করেনা কারো সাথে, গম্ভীর হয়ে থাকে সবসময়ই। আদিবার সবটা প্রচুর ভাবাচ্ছে আহানকে। প্রথম স্বামীর প্রতারণার আঘাত থেকে মেয়েটা এখনো বের হতে পারেনি এটাই ধারণা আহানের, হুম আহান সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছে কিন্তু আদিবার প্রাক্তন স্বামীকে সে চিনেনা এখনো।

“ভাবি কোথায় ভাইয়া? দেখছিনা যে ভাবিকে কোথাও।”

সাইমনের কথা কর্ণকুহর হতেই আহান ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। মুখে হালকা হাঁসির রেখা টেনে সে বলে “তুমি বসো, আমি দেখি তোমাদের ভাবি কি করছে” এটা বলেই আহান নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আহানের মা খালেদা খাতুন ছেলের যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ বাঁকিয়ে বলেন “এই মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই, যেনো প্রথমবার বিয়ে করেছে বউ সেজে সারাক্ষণ ঘরের কোণায় বসে থাকা লাগে তার।”
মায়ের কথায় সানিয়া চুপ থাকতে পারলোনা আর। প্রতিবাদি সুরে সানিয়া গটগট করে বললো “দেখো মা তুমি মেনে না নিলেও ভাবি এখন এই বাড়ির বউ। আচ্ছা মা তুমি ভাবিকে যে নজরে দেখছো সেই নজরে তো সাইমনকে কখনো দেখোনি, কারণ কি বলোতো? আমি যখন বারবার এই বিয়েতে অমত করছিলাম তখন তো তুমিই আমাকে বারংবার এটা সেটা বুঝিয়েছো। জোর করে আমাকে সাইমনের সাথে বিয়ে দিয়েছো, সাইমনও তো ডিভোর্সি। সাইমনও তো আগে অন্যকারো সাথে সংসার করেছে। সাইমনের সাথে তো বেশ ভালো তোমার সম্পর্ক তবে ভাবিকে মেনে নিতে কিসের সমস্যা তোমার?”

মেয়ের কথা শুনে খালেদা খাতুনের চেহারা শুকনো হয়ে গিয়েছে। সাইমন খুব অপমানবোধ করতেছে নিজের স্ত্রীর মুখে এসব কথা শোনে। তবুও সাইমন আর খালেদা খাতুন চুপ হয়ে আছে কারণ এখন সানিয়াকে কিছু বললেই ও আরো বেশি চটে যাবে তাই। সানিয়া খুব জেদি মেয়ে। ওর মা ইমোশনাল ব্লেকমেইল করে ওকে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছে। তবে এখনো সানিয়া খোঁটা দেওয়ার বেলায় স্বামী কিংবা মা কাউকেই ছাড় দেন না। খালেদা খাতুন মেয়েকে কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেননি বরং টাকাকে বিয়ে দিয়েছেন। টাকা দেখে ভেবেছিলো খালেদা খাতুন সানিয়া সাইমনের সাথে খুব সুখী হবে কিন্তু উনি এখনো জানতে পারেননি যে তার মেয়ে বিয়ের চার বছর পার হয়ে গেলেও এখনো সংসার করেনি। লোক দেখানো কথা বার্তা বললেও সবার সামনে বন্ধ কক্ষে স্বামীর দিকে দৃষ্টিও রাখেনা সানিয়া যদিও এতে সাইমনের ভীষণ খারাপ লাগে। সাইমন মাঝে মাঝে খুব মিস করে আদিবাকে। সানিয়াকে পাওয়ার লোভেই সাইমন আদিবাকে ছেড়েছিলো। এর পেঁছনে যদিও অন্য আরেকজনেরও হাত ছিলো। সানিয়া আর এক মুহুর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।

*
আদিবা দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে একাধারে। মনে পরে যায় সমস্ত অতীত। কোনো দোষ না থাকা সত্বেও স্বামীর অবহেলার স্বীকার হতে হয়েছিলো রোজ আদিবাকে। আদিবার একটাই দূর্বলতা ছিলো তা হলো সে গরিব বাবার মেয়ে যার কারণে প্রাক্তন স্বামী বিয়ের ছয়মাস পর থেকেই ওকে অবহেলা করা শুরু করেছিলো। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করছে খুব আদিবার। সাইমনের সামনে যাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছে নেই আদিবার, সাইমনকে দেখতেই আদিবার কষ্ট যেনো বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
আহান এসে দরজায় নক করতেই কেঁপে উঠে আদিবা। আদিবার একটুও ইচ্ছে করছে না দরজা খুলতে তবুও খুলতে হবে নয়তো যে আহান কষ্ট পাবে। মানুষটা যে ওকে ভীষণ ভালোবাসে। মানুষটাই তো তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। যাই হয়ে যাক এই মানুষটাকে কখনোই কষ্ট পেতে দিবেনা আদিবা। আদিবা চোখের জল মুছে কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই আহান প্রশ্ন করা শুরু করে আদিবাকে। আদিবা প্রশ্নগুলো এড়িয়ে বলে “আসলে সিয়াকে খুব মনে পরতেছে আমার, খুব মিস করতেছি মেয়েটাকে।”
আদিবার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় আহান। আহান আদিবার পাশে বসে ওর এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে “তুমি অনুমতি দিলে এখনই সিয়াকে আমি নিয়ে আসবো এই বাসায়, তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো সিয়াকে খুব ভালোবাসি আমি। সিয়াকে ছাড়া থাকতে পারবোনা বলেই তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম যাতে সিয়াকে নিজের কাছে রাখতে পারি কিন্তু তুমি কেনো যে হঠাৎ এমন করছো বুঝতেছিনা। বাচ্চা মেয়েটা আমাকে আর তোমাকে না ফেলে খুব অস্থির হয়ে পরবে।”

আদিবা কিছু বলেনা শুধু নিরবে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে আর মনে মনে বলে “কিভাবে বুঝাবো আপনাকে সিয়াকে ছাড়া যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এই মহলে। অনেক কষ্টের ফসল সিয়া আমার। সিয়ার জন্মের পর এই প্রথম ওকে ছাড়া তিন তিনটি রাত পার করলাম আমি। আমার বুকটা যে ছিঁড়ে যাচ্ছে, যন্ত্রণা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।”
আদিবাকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে আহান বলে “আর কোনো কথা শুনবোনা তোমার, আমি এখনই গিয়ে নিয়ে আসছি সিয়াকে।”
এটা বলেই আহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। সাথে সাথেই আদিবা বলে উঠে “না বলছিতো আমি, কেনো এতো ঝামেলা করছেন শুধু শুধু?”
কিছুটা উচ্চস্বরে বলে কথাটা আদিবা। আদিবাকে হঠাৎ এভাবে মেজাজ দেখাতে দেখে অবাক হয় আহান। কারণ আহান জানে আদিবা কোনো বড় কারণ ছাড়া এভাবে রেগেমেগে কথা বলেনা কখনো, খুব ঠান্ডা মেজাজের মেয়েটা। আহান খুব শান্তভাবেই আদিবার দুই বাহুতে আলতোভাবে হাত রেখে বলে “সত্যি করে বলো এই পরিবারের কে কি বলেছে তোমায়? সিয়াকে এই বাড়িতে আনতে কে নিষেধাজ্ঞা করেছে তোমায়?”
এবার আদিবা খুব চুপচাপ হয়ে গেলো। মাথা নুইয়ে অপরাধীর মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিবা। তখনই সানিয়া রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে “ভাবিকে জিজ্ঞেস না করে আমাকে করো কারণ হাজারবার রিকুয়েষ্ট করলেও ভাবি তোমায় সেই মানুষটার নাম বলবেনা।”
আহান কপাল ভাঁজ করে তাকায় সানিয়ার দিকে। সানিয়া নিজের রুমে যাওয়ার সময় হঠাৎ ভাই ভাবির কথার শব্দ শুনে দাঁড়িয়েছিলো সেখানে, আদিবারা দরজার কাছেই ছিলো বলে সব কথা বাহির থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো। আহানের পেঁছনে দাঁড়িয়ে আদিবা চোখ দিয়ে ইশারা করে যাচ্ছে সানিয়াকে যাতে সে আহানকে খালেদা খাতুন এর নামটা না বলে। আহান কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলে “শুধু একবার বল কার কথায় সিয়াকে এই বাড়িতে আনার অনুমতি দিচ্ছেনা আদিবা আমাকে।”
“আম্মুর কথায়।”
সানিয়ার মুখে নিজের মায়ের কথা শুনে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছেনা আহান কারণ সে তার মাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আহানের। সানিয়া ভাইয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে “ভাই একটা কথা বলি তোমায় আমার কথায় কিছু মনে করিওনা প্লিজ। মাকে এতোটাও বিশ্বাস করিওনা নয়তো আমার মতোই পস্থাতে হবে তোমাকেও। আর ভাবি তোমায় বলছি মায়ের কথায় চলিওনা, উনার কথা শুনলে পরে একসময় দেখা যাবে তোমার সংসারে আগুন জ্বলতেছে। শান্তিতে সংসার করতে দিবেনা আম্মু তোমাকে। এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। সাবধানে থেকো। আর ভাই তুমি আমার মতো মাকে অন্ধবিশ্বাস করে নিজের সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট হতে দিওনা। আমার জীবন তো শেষ করলোই ওই লোভী মা নামক মানুষটা।”

কথাগুলো বলতে বলতেই গলা ধরে আসছে সানিয়ার তাই সে কথাগুলো বলে আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে ছুটে চলে গেলো নিজের রুমে। বোনের কথাগুলো বারবার বাজতে থাকে ইফাদের কানে। নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। কি বলে গেলো সানিয়া এসব। মা কি করে পারে সন্তানের সুখ শান্তি কেঁড়ে নিতে? আদৌও কি সম্ভব এসব করা একটা মায়ের পক্ষে?
আহান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে আদিবাকে বলে “বিয়ের পর তো মেয়েদের বাপেরবাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হয় শুনেছি। চলো আজ ঘুরে আসি আমরা।”
আদিবা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে আহান আবারও বলে “মন খারাপ করার কি আছে এতে বুঝলাম না। আমি জানি মা বাবা ছাড়া আর কেউ নেই তোমার পরিবারে যে তোমাকে বিয়ের পরদিন দেখতে আসবে। এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মোটেও মন খারাপ করবেনা আর কখনো বলে দিলাম। যাও তৈরি হয়ে নাও, আমার কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে আসি আমি।”
আহান আদিবাকে তৈরি হয়ে নিতে বলে নিজে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। হনহনিয়ে মায়ের রুমের দিকে এগুচ্ছে আহাম। আহানের বাবা আফজাল খান এই সময় অফিসে আছেন তাই মায়ের সাথে কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ সময় আর হতে পারেনা। রাগে চোখমুখ লালা হয়ে গিয়েছে।

ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।