খেলাঘর পর্ব-০৮

0
3369

#খেলাঘর
পর্বঃ০৮
লেখকঃ শাওন
কারখানার ভিতরের চেহারা পুরো পাল্টে গেল।যেখানে বড় বড় ড্রাম রাখা ছিলো এখানে এখন বড় বড় বইয়ের থাক। এদিকে কতগুলো মেয়ে পরছে অন্যদিকে কতগুলো মধ্য বয়সী নারী হস্তশিল্প বানাচ্ছে। লাজ অবাক হয়ে বলল,”এটা কি করে সম্ভব? আমি তো কালকেই এখানে অন্যকিছু দেখে গিয়েছিলাম তাহলে আজকেই কি করে এত পরিবর্তন হলো?”
এটা বলার সাথে সাথেই পিছন থেকে ফারিদ তাকদিয়ার বলে,”আরে ফারাজ বাবা,তুই এখানে?”
ফারাজ বলল,” এইতো লাজ নিয়ে আসলো কিন্তু তুমি এখানে কি করছো?”
-“তোকে বলেছিলাম না,আমি নতুন একটা কাজ করছি।এটাই হলো সেই নতুন কাজ,এখানে মেয়ে আর মহিলাদের পড়ালেখা শিখানোর পাশাপাশি হস্তশিল্প ও বানানো শিখায়,যাতে করে ওদের সংসার খুব ভালো করে চলে।”
-“ওহহ বাবা,গ্রেট! কিন্তু লাজ তুমি কি করে জানলে আমাদের নতুন কাজ এখানে শুরু হয়েছে?”
ফারাজ লাজের দিকে তাকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো।লাজ ফারাজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ফারিদ তাকদিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি অনেককিছু জানি যা তুমি হয়তো জানো না। তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি তোমাকে কেন নিয়ে এসেছিলাম? তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম কারণ তোমাকে তোমার বাবা-র কালো ব্যবসার সম্পর্কে জানাতে,তিনি কতটা নিচ তা প্রমান করতে।”
-“মুখ সামলে কথা বলো,ওনি আমার বাবা হয়।আর তুমি জানো আমি আমার বাবা-র জন্য ঠিক কি করতে পারি।”
-” বিশ্বাস করো ফারাজ,তুমি এখানে যা দেখছো সব সাজানো আমি কালকে এখানে এসেছিলাম। এখানে এসব কিছু ছিলো না,ছিলো শুধু নেশা করার জিনিস আর এইদিকটাই মেয়েদের বেঁধে রাখা হয়েছিল পাচার করার জন্য। আচ্ছা বিশ্বাস হচ্ছে না তো তাহলে ওয়েট।”
লাজ এই কথাটা বলে এক কোনায় পরে থাকা ফোনের ভাঙা অংশ দেখিয়ে বলল,”এই দেখো, আমি ওনার সব কুকর্ম ভিডিও করেছিলাম বলে ওনি আমার ফোন ভেঙে দেয়।”
ফারিদ তাকদিয়ার বলল,”তুমি কি বললে?কালকে তুমি এখানে এসেছিলে আর এসব কিছু দেখতে পাও নি,ওয়েট! এই মেয়েরা তোমরা এখানে কতদিন ধরে কাজ করছো?”
মেয়েরা উত্তর দিলো,”পাঁচ দিন!”
-“আর এই মোবাইল টা কার ছিলো আর কি করে ভাঙ্গলো?”
একটা মেয়ে বলল,”মোবাইল টা আমার ছিলো,অসাবধানতায় দৌড় দেওয়ার ফোনটা ভেঙে যায়। ”
উত্তর টা পেয়ে লাজ চমকে উঠলো তারমানে ফারিদ তাকদিয়ার সবকিছু তার প্লান মতো করছে, আর ফারাজ এসবের কিচ্ছু জানে না!কিন্তু ফারাজের কাছে সবকিছু বললেও এসব কেন বলেনা?লাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারাজ চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,” তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম আমার বাবা-র নামে তুমি অযথা মিথ্যা কথা বলবে না,কিন্তু তুমি তাও শুনো নি।তোমার এত কিসের শত্রুতা আমার বাবা-র সাথে বলবে আমাকে?”
-“বিশ্বাস করো ফারাজ,আমি মিথ্যা বলছি না!”
-“চুপ,আর একটা কথাও বলবে না তুমি!”
ফারাজ ধমক দিয়ে কথাটা বলে চলে গেল। আজকে লাজের খারাপ লাগছে,সে মিথ্যা না বলেও মিথ্যাবাদী সাজতে হলো!ফারিদ তাকদিয়ার অট্ট হাসি দিয়ে বলল,” আমার পিছনল লাগতে নিষেধ করেছিলাম,কিন্তু তুই কথা শুনিস নি।এখন তো টের পাবি এই ফারিদ তাকদিয়ার কি কি করতে পারে। এই কারখানা কে আমাকে উল্টা পাল্টা করতে একরাতের ও প্রয়োজন হয় না।”
-“আর আপনিও জেনে রাখুন এক মাঘে যেমন শীত চায় না ঠিক তেমন সত্য কে হাজার চেষ্টা করলেও চাপা দেয়া যায় না,একদিন না একদিন ঠিকই সবার সামনে চলে আসে।”
এম পি সাহেব চলে যেতে নিলে লাজ পিছন থেকে এই কথাটা বলে।এমপি সাহেব পিছন ফিরে বলে,” যা হবে দেখা যাবে কিন্তু আমার সাথে লাগতে আসার ফল মোটেও কিন্তু ভালো হবে না!”
ফারিদ তাকদিয়ার কথাটা বলে চলে গেলেন। লাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুরো কারখানা দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।তারপর বের হতে যাবে তখনই একটা রুম থেকে কারো কান্নার আওয়াজ আসে।লাজ থমকে দাঁড়ায় সে বোঝতে চেষ্টা করে ঠিক কোন জায়গা থেকে আসছে এই কান্নার আওয়াজ? আওয়াজ ফলো করে আসতে আসতে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়, রুমটা বাহির থেকে খিল দেয়া। লাজ খিলটা খুলতে নিবে তার আগেই কেউ একজন ওর হাত ধরে ফেলে। তাকিয়ে দেখে ফারাজ,
-“তারাতাড়ি চলো,এখুনি হসপিটালে যেতে হবে।”
লাজ’কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো। লাজ ঐ রুমটার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু।
অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আয়েরা,লাজ আর ফারাজ। একটু আগেই লাজের বাবা মাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। দুজনেরই অবস্থা খুবই খারাপ।লাজের অবস্থা কান্না করতে করতে অবস্থা খারাপ, আয়েরা ফারাজের দিকে ফারাজ চোখ রাঙ্গিয়ে কিছু একটা ইশারা করে না বলে। অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বেড়িয়ে আসলো।লাজ দৌড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে ওদের? ওরা এখন কেমন আছে?কিছু হয়নি তে ওদের?”
ডক্টর কোনো জবাব দিলো না, মাস্কটা খুলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,” সরি, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু গুলি গুলো একদম হার্টে গিয়ে লেগেছে।তাই আমরা শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলাম না!”
এই কথা শুনে লাজ মাথা চক্কর দিয়ে পরে যেতে নিলে ফারাজ ধরে ফেলে। লাজ বোঝতে পারছে না,ওদের গুলি কি করে লাগলো? কে ই বা ওদের গুলি করবে? তার বাবা মায়ের তেমন কোনো খারাপ শত্রু নেই,তাহলে কে?”
আয়েরা কান্না করতে করতে বলল,”লাজ নিজেকে সামলা, এভাবে কেমন ভেঙে পরছিস?”
লাজ বলল,” আমি কি করবো বল, আমি ওদের কে সত্যি টাও বলতে পারলাম না,আমাকে এতটুকু সময় না দিয়েই ওরা চলে গেল।”
আয়েরা বলল,” শক্ত হো,তোকে জানতেই হবে কে আর কেন আঙ্কেল আন্টিকে মেরেছে। আর তাদেরকে শাস্তি দিতেই হবে!”
লাজ নিজের চোখের পানি মুছে বলল,” হুম, আমি আমার বাবা মা’র খুনি কে খুঁজে বের করবোই আর তাকে শাস্তি আমি দিবো।”
-“আর এতে আমি নিজে তোমার পাশে থাকবো,তোমাকে সাহায্য করবো।”
ফারাজের কথাটা শুনে লাজ কান্নারত ছলছল চোখে ওর দিকে তাকালো,ফারাজ লাজের চোখের পানি মুছে দিলো। আয়েরা ফারাজ কে এসব করতে দেখে অনেকটা অবাক হলো।
দুদিন চলে গেল, এই দুদিন লাজ নিজের রুম থেকে একটাবারের জন্য বের হয়নি। খাওয়া দাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে ফারাজ বিষয়টা লক্ষ্য করলো কিন্তু লাজের মনের অবস্থা টা বোঝতে পেরে কিছু বলল না৷ লাজ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিল তখন পিছন থেকে ফারাজ বলল,” এসব কি শুরু করছো? এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে তো মরে যাবে!”
-“সেটা তো তোমার আর তোমার বাবা-র জন্য ভালোই হবে, তোমাদের পথের কাটা দূর হয়ে যাবে।”
-“জাস্ট শাট আপ, আর একটা কথা না বলে চুপ চাপ এখানে বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
-“আমি কিছু খাবো না, আর এসব কিছু করতে হবে না আমার জন্য। দরকার নেই কারো দয়ার এসব দয়া আমি বিশ্বাস করে অনেক বড় ভুল করে ছিলাম।আজকের এইদিনগুলোর জন্য আমি শুধু মাত্র তোমাকে আর তোমার বাবা’কে দায়ী করি। তুমি যদি আমার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার নাটক না করতে আর তোমার বাবা কালো ব্যবসা না করতো তাহলে কখনো তোমাকে বিয়ে করতাম না আর বাবা মাকে ছেড়ে আসতাম না।আমি না আসলে ওরা হয়তো আজকে বেঁচে যেত!”
বলে লাজ আবার কান্না করতে লাগলো,ফারাজ লাজকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর লাজের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,”আচ্ছা মানলাম এসব আমাদের জন্যই হয়েছে আর তা শোধরাবার জন্য তোমার পাশে থাকবো। তোমার বাবা মা’র খুনী কে আমি খুঁজে বের করবো।খুব বেশি দিন হয়তো লাগবে না। আর তাই বলছি তুমি এভাবে ভেঙে পরো না শক্ত হতে হবে আরো, খাবারগুলো খেয়ে নাও!”
ফারাজ এখন ইচ্ছে করেই লাজের কথাগুলো মেনে নিলো কারন সে জানে লাজ এখন কতটা ভেঙে পরেছে এজন্য সে আর কিছু না বলে চুপচাপ মেনে নিয়েছে।কথাগুলো বলে ফারাজ লাজের সামনে লোকমা তুলে ধরলো, লাজ ওর দিকে তাকালে ইশারা করে হা করতে বলল।লাজকে ফারাজ নিজ হাতে খাইয়ে দিলো।
ফারাজ তার বাবা-র রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন শুনতে পেল ফারিদ তাকদিয়ার কারো সাথে ফোনে কথা বলছে…..
-“তোদের কে বলেছিলাম একটু ভয় দেখাতি যাতে করে ঐ আপত টা একটু ভয় পায় কিন্তু তোরা তো ওদের কে….”
ফারিদ তাকদিয়ার কথাগুলো বলে পিছনে ঘুরতেই ফারাজ কে দেখে চমকে উঠে,ফোনটা রেখে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কিরে তুই এখানে!কোনো দরকার?”
-“নাহ এমনি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?কাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলে?”
-“আর বলিস না,একটা লোক আমাদের কারখানায় এসে ঝামেলা করছিল তাকেই ভয় দেখানোর কথা বলছিলাম।”
-“ওহহ, লোকটার নাম বলো আমিই দেখে আসছি।”
-” নানা,তোর এসব ঝামেলা যাওয়ার দরকার নেই। দরকার হলে আমিই বলবো।”
-“আচ্ছা, তাহলে আমি একটু লাজ কে নিয়ে বাহির থেকে আসছি!”
-“ওয়েট, তোর কি মনে হয় না তুই এখন ঐ লাজের জন্য একটু বেশীই করছিস? আমার মনে হয় তুই হয়তো আমার অপমানের কথা ভুলে যাচ্ছিস!”
-” আমি কিছু ভুলিনি, কিন্তু এখন লাজের পাশে থাকা দরকার। ওর বাবা মা এই মৃত্যু সে মেনে নিতে পারছে এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ডিপ্রেশনে চলে যাবে।তারপর একদিন আত্মহত্যা করে ফেলবে!”
-“তো করতে দে।”
-“বাবা,তুমি কি বলছো এসব? তুমি এগুলো কি করে বলতে পারো? সে আমাদের বিরোধিতা করেছে বলে আমরা ওকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না। আর আমি ওর পাশে থাকবো।ওর বাবা মার মৃত্যুর খুনিকে আমি খুঁজে বের করবো।”
এই বলে ফারাজ ঐরুম থেকে বেড়িয়ে গেল। নিচে এসে দেখে লাজ সাধারণ ভাবে রেডী হয়ে আছে। ফারাজ লাজের সামনে গিয়ে বলল,” চলো তাহলে যাওয়া যাক!”
-“হুম!”
লাজ গাড়িতে উঠে বসতেই ফারাজ গাড়িয়ে স্টার্ট দিলো।
#চলবে