খেলাঘর পর্ব-০৯

0
4200

#খেলাঘর
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ০৯
ফারাজ গাড়ি থেকে নেমে লাজের দরজা খুলে দিলো। লাজ নেমে অনেকটা অবাক হয়ে গেল কারন ফারাজ তাকে তার বাবা মায়ের কবর স্থানে নিয়ে এসেছে। লাজ ফারাজের দিকে তাকালে ফারাজ লাজের মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে ইশারা করলো কবরের কাছে যেতে।
লাজ কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ থেকে একফোঁটা পানি পরলো। ফারাজ তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,”এখানে তোমাকে কান্না করার জন্য আনেনি, এখানে এনেছি তুমি তোমার বাবা-র জন্য দোয়া করতে আর নিজের মনটাকে ভালো করতে।”
লাজ ফারাজের দিকে তাকালে ফারাজ একটা হাসি দেয় তারপর দোয়া করার জন্য দুহাত উঠিয়ে দেয়।
লাজ দোয়া করার সময় মনে মনে বলল,”আমি তোমাদের খুনীকে খুঁজে বের করবো, আর তাদের এমন শাস্তি দিবো যাতে করে আর কারো কোনোদিন হত্যা করতে না পারে। আর আমি খুব তারাতাড়ি ফারাজকে তার বাবার সব সত্য সামনে নিয়ে আসবো। তার আগে শিউর হতে হবে সত্যি ই কি ফারাজ এগুলো সম্পর্কে কিছু জানে না!”
দোয়া শেষ করে লাজ নিজের চোখের পানি মুছে বলল,” আমাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও!”
-“কিন্তু এসময় তোমাকে আমার একা ছারতে মন করছে না।”
-“আর আমিও তোমাকে আমার সাথে নিতে ছারছি না। কেন বোঝতে পারছে না আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আর করবোই কি করে তোমাদের প্রতিটা কাজই আমার কাছে বিশ্বাসের অযোগ্য লাগে। সো প্লিজ লিভ মি এলন!”
লাজ কথাটা বলে চোখ রাঙ্গিয়ে চলে গেল, ফারাজ বোঝতে পারলো না লাজের হঠাৎ করে কি হলো? সে এমন ব্যবহার করলো? তাহলে কি লাজ এখনো ফারাজ কে ভুল চোখে দেখছে?

লাজ নিজের বাড়িতে আসলো। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই মনে পরতে লাগলো তাদের সেই সোনালী দিন গুলোর কথা। বাবা মায়ের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। তার কাছে মনে হলো তাদের বাবা মা তাকে ডাকছে কিন্তু ধরতে গেলেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। লাজ কান্না করতে করতে ফ্লোরে বসে পরলো, তখনই ওর হাঁটুতে কি একটা যেন অনুভব হলো। হাত দিয়ে দেখে একটা আংটি পরে আছে,কিন্তু এই আংটি টা সে চিনে না। লাজ একা একা বলতে লাগলো,”এটা কার আংটি? দেখে তো মনে হচ্ছে পুরুষের আংটি কিন্তু বাবা তো এসব আংটি পরতো না। তাহলে এটা কার?”
বলে সাইডে ফিরতেই দেখতে পেল রক্তে মাখা ফ্লোর, সে বোঝতে পারলো এখানেই তার বাবা মাকে মারা হয়েছিল। লাজ বলল,” তারমানে এটা ঐ খুনী’র আংটি! এই আংটি কি আমাকে খুনী পর্যন্ত পৌঁছে দিবে কিন্তু এই একটা আংটিতে আমি কি করে খুনী কে খুঁজে বের করবো। আমি কি করবো?ফারাজ কে এটা দেখাবো? নাহ, আমি এতটা বোকা কি করে হলাম,ওকে বিশ্বাস করতে যাচ্ছি। যা করতে হবে আমাকেই করতে হবে।”

লাজ ছদ্মবেশ নিলো, ঘাগড়া পরে ঘোমটা দিয়ে নিলো। তারপর ফারিদ তাকদিয়ারের কালো কারখানার ভিতর ঢুকলো। ঢুকে দেখে ফারাজ সেখানে চেয়ারে বসে আছে। ফারিদ তাকদিয়ারের সাথে কথা বলছে, লাজ দৌড়ে গিয়ে ফারিদ তাকদিয়ারের পায়ে পরলো। তারপর কান্না করতে করতে বলল,”স্যার,আই এক গরীব মানুষ, জামাই আইয়ের মরে গেছি। দুই পুলা মাইয়া লইয়া পথে পথে ঘুড়ি। দয়া করে আপনার মিলে কাজ দেইন।!”
ফারিদ তাকদিয়ার রাগ হলেও ফারাজের সামনে তা প্রকাশ করলো না। রাগ সহ্য করে বলল,” দেখো এখানে তোমাদের জন্য কোনো কাজ নেই আর তাছাড়া যতজন নেবার ছিলো আমাদের লোক নিয়েছে। তুমি অন্য কোথাও দেখো।”
লাজ আরেকটু বেশী কান্নার অভিনয় করে শক্ত করে পা জড়িয়ে বলল,” বাবু স্যার, এমন কইরেন না। আমি তাইলে মইরা যামু সাথে আমার পোলা মাইয়া গুলা। আমনে চাইলে সব পারেন দয়া করে একটা কাম দেন আমারে।”
ফারিদ তাকদিয়ার কিছু বলতে নিবে তার আগেই ফারাজ বলল,”তুমি ঐ মহিলাদের সাথে গিয়ে কাজ করো, আমি বাবা-র সাথে কথা বলছি। আর হ্যা,তোমার কোনো টেনশন করতে হবে না। তুমি এখানে আজকে থেকে কাজ করবে।”
-“শুকরিয়া সাহেব!”
লাজ এই বলে ঘোমটার নিচে শয়তানি হাসি দিয়ে কাজ করতে বসে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ফারাজ বার বার বাসায় কল করে খবর নিচ্ছে লাজ বাসায় ফিরেছে কিন্তু না বাসায় যায়নি। ফারাজের টেনশন হচ্ছে লাজের জন্য, ওর একটা ফোনও নেয় যে সে কল দিবে।
এদিকে লাজ কাজের এখান থেকে সুযোগ মতো সরে পরলো। তারপর পুরো টা কারখানা আবার ঘুরে দেখতে লাগলো কোথাও কোনো কিছু পাওয়া যায় কি না।কিন্তু না,কোথাও কিছু পেল না হটাৎ করে তার চোখ গেল সেদিনের সেই রুম টার দিকে। কি অদ্ভুত প্রতিটারুমের দরজা খোলা কিন্তু এই একটা মাত্র রুমেই তালা দেওয়া। কি এমন আছে এই রুমে যার জন্য তালা দিয়ে রাখতে হবে বর তাছাড়া সেদিন কারো আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল লাজ। তারমানে কি এর ভিতরে এমন কিছু লুকানো আছে যা ফারিদ তাকদিয়ার লুকিয়ে রাখতে চায়। লাজ নিজের ঘোমটা টা দিয়ে ঐরুমের দিকে যেতে নিবে তখনই পিছন থেকে বলে,” হেই,তুমি এখানে কি করছো?”
লাজ হতমত খেয়ে গেল সে বলল,” আব স্যার,আসলে একটু হিসু দিতে জায়গা খুজছিলাম।”
ফারাজ একটু লজ্জায় পরে গেল সে বলল,” ওয়াশরুম এদিকে না, বাম দিকের রাস্তা দিয়ে সোজা যাবে তাহলেই পাবে।”
-“শুকরিয়া!”
ফারাজ চলে গেল, লাজ একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঐরুমের সামনে চলে এলো। কিন্তু রুমে তো তালা লাগানো ভিতরে যাবে কি করে? লাজ টানাটানি করেও কোনো লাভ হয়নি, মাথা চুলকিয়ে ভাবতে লাগলো কি করবে? তখনই হাত গেল তার ক্লিপে আর তার একটা বুদ্ধি চলে আসলো। সে ক্লিপটা নিয়ে তালা খুলার চেষ্টা করে। অনেকবার চেষ্টা করে যখন ফেল হয়ে আশা ছিড়ে দিলো তখন সে কারো আসার শব্দ পেল। সে ভয় পেয়ে ক্লিপটা নিয়ে কোনো মতো ভাঙা চুড়া জিনিসের পিছনে লুকিয়ে পরে।
ফারিদ তাকদিয়ার এক প্লেট খাবার নিয়ে এদিকে আসছে। রুমের সামনে এসে খাবারটা টেবিলের উপর রেখে রুমের তালা খুলল। তারপর খাবারটা নিয়ে ভিতরে চলে গেল। লাজও দৌড়ে রুমের সামনে চলে আসলো কিন্তু ভেতরে অন্ধকার বেশী হওয়ায় কিছু দেখতে পেল না।তাই সে চুপি চুপি ভিতরে ঢুকে গেল। রুমের ভিতরে বড় বড় ড্রামের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলে ফারিদ তাকদিয়ার কি করে? লাজ তার পিছন পিছন যেতে লাগলো।
ফারিদ তাকদিয়ার একটা চেয়ারে খাবার টা রেখে টেবিলের মোমবাতি টা জ্বালিয়ে দিলো। আলো জ্বালানোর ফলে লাজের চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সে যা দেখলো তা সে মোটেও কল্পনা করতে পারেনি।
একটা মধ্যবয়সী মহিলা’কে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মহিলাটির শরীর ঠিক কতটা দুর্বল হয়ে আছে। চুলগুলো রুমের ধুলোয় সাদা হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালো কালো দাগ। হাত বাঁধা থাকতে থাকতে একদম দাগ হয়ে গেছে। মহিলাটি বসে বসে ঘুমাচ্ছিল ফারিদ তাকদিয়ার এক গ্লাস পানি নিয়ে ওনার মুখে ছুড়ে মারলো। ওনি ছটফটিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল, ফারিদ তাকদিয়ার কে দেখে ভয় পেল ওনি ছুটার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না৷ফারিদ তাকদিয়ার অট্ট হাসি দিতে লাগলো, হাসি নিয়েই বলল,”কেন অযথা চেষ্টা করছো বলো তো? গত ১৯ বছর ধরে তো তাই করে আসলে কিন্তু কোনো লাভ হলো? হলো নাতো!তাহলে কেন করছো এমন।যেদিন আমার ছাড়তে ইচ্ছে হয় সেদিন তো ছাড়ি মাত্র পাঁচ সাত মিনিটের জন্য।”
বলেই খপ করে চুলের মুঠি ধরে ফেলল, মহিলাটি কুকড়িয়ে উঠলো লাজ সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।ফারিদ তাকদিয়ার চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,”চুপ চাপ ভালোই ভালোই হা করো, দেখেছো তোমার প্রতি আমার এখনো কতটা মায়া? আর যদি এই মায়াতে ভালোই ভালোই না খাও তাহলে কি ব্যবস্থা আমি করতে পারি তাও তুমি ভালো করে জানো।”
কথাগুলো সামনের চেয়ারে বসে লোকমা মুখের সামনে তুলে দিলো। মহিলাটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হা করলো। কয়েক লোকমা খাইয়ে দেবার পর ফারিদ তাকদিয়ার ফোনে কল আসে। ফোনটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ছিল তাই সে খাবারগুলো এভাবে রেখেই চলে যায়। রুম থেকে বেরিয়ে দরজায় তালাও দিয়ে দেয়।
লাজ দৌড়ে দরজার কাছে গেল, কয়েকবার টানলেও দরজা খুলতে পারেনি। সে ভয়ে আর টেনশনে ঘামতে শুরু করলো। এখন যদি সে ধরা পরে তাহলে তাকে আর আস্ত রাখবে ফারিদ তাকদিয়ার। সে কি করবে কিছুই বোঝতে পারছে না।তখনি ঐ মহিলাটা কাশতে শুরু করলো,হয়তো বিষম খেয়েছে।লাজ বোঝতে পারছে না কি করবে, মহিলাটির সামনে যাবে কি যাবে না।পরক্ষণেই তার বিবেক বলল,”যা হয় হোক, আমার সামনে একটা মানুষ কে এবাবে কষ্ট পেতে আমি দেখতে পারবো।”
লাজ মহিলাটির কাছে গেল,তারপর এক গ্লাস পানি ওনার মুখের সামনে ধরতেই ওনি গপগপ করে পান করে নিলো। মহিলাটি বোঝতে পারলো না পানিটা হটাৎ দিলো কে?উপরে তাকাতেই সে দেখতে পায় এক হাসি মাখা পদ্মমুখ। লাজ ওনার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো।মহিলাটি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কে?কে তুমি?”
-“আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি কোনো এক হতভাগী।”
-“এখানে কেন এসেছো?কি চাও তুমি?”
-“আমি কিচ্ছু চায়না, শুধুমাত্র এই বন্ধ রুমের ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আপনি কে? আপনাকে এভাবে কেন বেঁধে রাখা হয়েছে?”
-“আমার বাঁধন গুলো একটু খুলে দিবে, ওরা আমাকে এখানে রাখতে রাখতে মেরে ফেলবে। তোমার পায়ে পরি দয়া করে আমাকে একটু খুলে দাও।”
মহিলাটি কান্না শুরু করে দিল,লাজের বড্ড মায়া হলো মহিলাটি কে দেখে। তার মনে পরে গেল তার মায়ের কথা হয়তো তারাও এভাবেই বাঁচার জন্য মিনতি করেছিল কিন্তু ওরা মানে নি। লাজের চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো, সে তা মুছে মহিলাটির বাধন খুলে দিলো। মহিলাটি কিছু না বলেই লাজকে জড়িয়ে দরলো, লাজ কিছু বোঝতে পারলো না। লাজ কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার আগেই দরজার তালা খুলার শব্দ হতে লাগলো। লাজ আর ঐ মহিলা ভয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।কি হবে এবার তাদের? তারা কি তাহলে দুজন একসাথে ধরা খাবে? ধরা খেলে কি হবে তাদের পরিনাম?

#চলবে!