গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-০৯

0
3658

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৯|

বিয়ে বাড়িতে মানুষ গমগম করছে।বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে শতাধিক অপরিচিত মানুষের আনাগোনা।সবাই কত ব্যস্ত।
রীতি লাল শাড়ি,লাল চুড়ি,ম্যাচিং অর্নামেন্ট পড়ে,চুলে ফুল গুজে লাল পরী সেজে নিজের রুমে চুপ করে বসে আছে।আর ওর মা ঘ্যানঘ্যান করছে।

—-“রীতি আর কতক্ষণ বসে থাকবি?কিছুক্ষণ পরেই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।”

রীতি অসহায় ফেস করে বললো,
—-“মা আমি যাবোনা।প্লিজ।”

রীতির মা কটাক্ষ দেখিয়ে বললো,
—-“যাবিনা মানে?তাহলে শাড়ী পড়লি কেনো?আর এতো সাজগোজ কেনো করেছিস?”

—-“মা আমার লজ্জা লাগছে।আমি কখনো এমন করে সেজেছি?”

রীতির মা হালকা হেসে আদুরী কন্ঠে বললো,
—-“বোকা মেয়ে প্রতিদিন কি মানুষ সাজগোজ করে? বিশেষ অনুষ্ঠানেই করে।সবাই আজ ডিফারেন্ট সেজেছে।চল আমার সাথে।কিচ্ছু হবেনা।কেউ কিছু ভাববে না।”

রীতি অন্য দিকে মুখ করে বললো,
—-“মা তুমি যাও।আমি যাবোনা।এখুনি চেঞ্জ করে নিবো।”

রীতির মা মেয়ের কাছে হেরে গিয়ে রীতির বাবাকে পাঠালো।এখন যদি বাবার কথা শুনে মেয়েটা।

রীতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে দেখছে।কত মেহমান আসছে।বেশিরভাগ মেয়ে শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়া।
রীতি ভাবছে,
“এত মানুষের সামনে যাবো এই সাজে?ইম্পসিবল।”

রীতি রুমে আসতেই ওর বাবা ওর রুমে ঢুকে মেয়েকে দেখে চমকে গেলো।
পেছনে ওর মাও এসেছে।
“আরে আমার মেয়েকে তো আজ রাজকন্যা লাগছে।বাহ!আমার মেয়ে কত বড় হয়ে গেছে।”
রীতি বাবার কথায় আরো লজ্জা পেলো।
—-“বাবা!”
রীতি অন্য দিকে ঘুরে দাড়ালো।

—-“থাক থাক আর লজ্জা পেতে হবেনা।সবাই হলুদে কত মজা করছে।”

রীতি দ্রুত বললো,
—-“আমি যাবোনা।প্লিজ বাবা প্লিজ।”

—-“কেনো যাবি না? আমার লক্ষী মা চল।ভালো লাগবে।সবাই যাচ্ছে।দিয়া আছে।”

দিয়া হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে কাউকে তোয়াক্কা না করে বললো,
—-“রীতি আপু!! তুমি কি করছো বলো তো?আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।চলো।”

রীতির বাবা দিয়াকে বললো,
—-“তোমার রীতি আপু নাকি যাবেনা।ওকে নিয়ে যাও তো।”

—-“কি যাবেনা?রীতি আপু এখন আমি ছোট বড় মানবোনা আর না আংকেল আন্টিকে।আমি তোমাকে মার লাগাবো যদি এখুনি না যাও।”

দিয়া রীতিকে কিছু বলতে যাবে তখনই দিয়া রীতির পার্স হাতে নিয়ে রীতিকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো।রীতি হাজারো বাধা দিয়ে থামাতে পারলোনা।

.

সাদিব আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নিচ্ছে।পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করে নিয়ে সুগন্ধি মেখে নিলো।তারপর আরেকবার নিজেকে দেখে নিলো।
মৃদু হেসে ছাদের দিকে রওনা দিলো।বেচেরা নিজেকে দেখে নিজেই ক্রাশ খাচ্ছে মেয়েদের কথা ভেবে মুচকি হাসছে।

রীতি আর দিয়া জুইদের ফ্ল্যাটে গেলো।দিয়া জুইয়ের সাজানো দেখছে।রীতি সাবিহার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু সাবিহা বরাবরই এভয়েড করছে।রীতি সাবিহার এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারছেনা।সেই দিনের পর থেকেই সাবিহা রীতিকে এক প্রকার এভয়েড করে যাচ্ছে।
রীতির খুব কষ্ট হচ্ছে।সাবিহা ওর সাথে এমন কেনো করছে।ও যা দেখেছিলো তাই বলেছে এক বিন্দু মিথ্যা বলে নি আর না কিছু বানিয়ে বলেছে।তাহলে এমন কেনো করছে?
রীতির নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।ও বারবার যেচে কথা বলতে যাচ্ছে কিন্তু সাবিহা এভয়েড করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রীতির কান্না পাচ্ছে।রীতি দিয়ার কাছে গিয়ে দিয়াকে টেনে এক পাশে নিয়ে গেলো।

দিয়া রীতির চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেলো।রীতির চেহেরাটা কেমন লাগছে।
দিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
—-“রীতি আপু কি হয়েছে? ”

রীতি দিয়াকে সব খোলে বললো।সেদিনের ঘটনা আর সেদিনের পর থেকে সাবিহার ব্যবহার সবটা বললো।
দিয়া সবটা শুনে কিছুটা শংকিত হলো।
তারপর রীতিকে শান্তনা দিয়ে বললো,
—-“আপু মন খারাপ করোনা।আমি ওর সাথে কথা বলবো।প্লিজ মন খারাপ করোনা।”

—-“দিয়া তুমি এসব বলোনা ওকে।তাহলে ও বলবে আমি ওর প্রেমিকের বদনাম সবার কাছে করে বেড়িয়েছি।”

—-“আরে না এসব বলবোনা।শুধু বলবো তোমার সাথে ঠিক করে কথা কেনো বলছেনা।তারপর যদি ও নিজ থেকে বলে তো ঠিক আছে।”

—-“আচ্ছা। ”

—-“এখন চলো।সব রেডি আমরা জিনিসপত্র নিয়ে ছাদে যাই।”
দিয়া রীতিকে টেনে নিয়ে হাতে কেক ধরিয়ে দিলো।
—-“আপু তুমি এটা নেও আমি হলুদের বাটি নিয়ে যাচ্ছি।বাকিটা ওরা আনবে।চলো,চলো।”

দিয়া আগে আগে যাচ্ছে রীতি ওর পেছনে।ছাদে মানুষে ভর্তি।রীতি পা রাখার জায়গা পাচ্ছেনা।জোরে মিউজিক বাজছে।মানুষের চিতকার চেচামেচিতে রীতির কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা।সবাই এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।সবাই নানার সাজে নিজেকে সজ্জিত করেছে।
রীতি সবাইকে দেখছে আর লজ্জায় নিজে কুকড়ে যাচ্ছে।নিজেকে সবার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।আর তখনই চোখ পড়লো সাদিবের দিকে।রীতির এখন আরো লজ্জা লাগছে।সাদিব যদি ওকে দেখে তাহলে কি ভাববে?এসব ভেবেই রীতির চোখে মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ছে।রীতি অতি সাবধানে হাতের কেকটা নিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছে।সাদিবকে এভয়েড করা সম্ভব না।কেননা সাদিব স্টেজের কাছেই।রীতিকে হুট করে কেউ জোরেশোরে ধাক্কা দিলো।রীতি তাল সামলাতে না পেরে একটা মেয়ের উপর পড়ে গেলো।মেয়েটি ওকে ধরে ফেললো।রীতি নিচে পড়া থেকে বাচলেও রীতির হাতের কেকটা নিচে পড়ে গেলো।রীতি দ্রুত সেই মানুষটির দিকে তাকালো।একটা ছেলে কালো পাঞ্জাবী পড়া।দ্রুত সরে গেলো।রীতি মেয়েটিকে সরি বললো।কিন্তু
কেকটা তো পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।রীতির কান্না পাচ্ছে প্রচুর কান্না পাচ্ছে।এমন একটা দিনে এমন একটা ঘটনা ও মেনে নিতে পারছেনা।এখন কি বলবে সবাইকে?সবাই ওকে কি বলবে?নিশ্চয়ই বকাবকি করবে।করবেই তো কেক ছাড়া হলুদের অনুষ্ঠান কিভাবে হবে?

সব গুছানো শেষ হতেই সাদিব কেকের খোজ করছে।আর তখনই দিয়া বললো,
—-“রীতি আপু কেক নিয়ে আসছে।”
দিয়া গিয়ে বসে পড়লো।সাদিবের চোখ পড়লো রীতির দিকে।রীতি জড়োসড়ো হয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।সাদিব রীতিকে অপলক দেখছে।মনে হচ্ছে একটা লাল পরী দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু ওর চোখ মুখ এমন কেনো?ওকে এতো বিষন্ন লাগছে কেনো?ওর মুখে হাসি নেই কেনো?

সাদিব রীতির কাছে গিয়ে দাড়ালো।তারপর বললো,
—-“কি হয়েছে তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?কোনো সমস্যা?”

রীতি সাদিবের কথা শুনে ঢোক গিলছে।সাদিবকে কি বলবে?ভয়ে ওর হাত-পা জমে যাচ্ছে।যদি সাদিব বলে ফেলে দেওয়া তোমার হেবিট।তোমার পুষ্টির অভাব।হাতে কি শক্তি নেই।যখনই দেখছি তখনই ফেলছো?
রীতি মাথা উচু করে জড়তা নিয়ে বললো,
—-“কেকটা পড়ে গেছে।কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি।কেউ আমাকে ধাক্কা মেরেছে।আর ইচ্ছে করেই ধাক্কা মেরেছে।আমি ব্যালেন্স রাখতে পারিনি তাই….

সাদিব অবাক হয়ে বললো,
—-“তোমাকে কে ধাক্কা দিবে?তাও ইচ্ছে করে? ”

রীতি কিছুটা কনফিউশন নিয়ে বললো,
—-“আমি ঠিক জানি না।একটা ছেলে কালো পাঞ্জাবী পড়া ছিলো।”

একটা ছেলে ধাক্কা মেরেছে এটা শুনে সাদিবের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো।
কিন্তু রীতিকে বুঝতে দিলোনা।

রীতি বললো,
—-“এখন কি হবে?কেক ছাড়া হলুদের অনুষ্ঠান হবে?”
সাদিব রীতির দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো,
—-“আমার সাথে এসো।”
রীতি সাদিবের কথা মতো সাদিবের সাথে গেলো।
সাদিব রীতিকে সামনের সারিতে ভালো জায়গায় বসিয়ে দিলো।তারপর বললো,
—-“এখানেই বসে থাকবে।এদিক সেদিক যাবেনা।”

রীতি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।তারপর বললো,
—-“কেকের কি হবে?”

—-“ডোন্ট ওরি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”(আশ্বস্ত করে)

তারপর সাদিব কাউকে ফোন করলো কেকের ব্যবস্থা করার জন্য।তারপর সেই কালো পাঞ্জাবী পড়া লোককে খোজতে চলে গেলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ।সবাই একে একে ছাদ ত্যাগ করছে।রীতি দিয়ার সাথে গল্প করছে।সাদিব রীতিকে ডেকে নিলো।রীতি একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে তাই সাদিবের সব কথা মেনে নিচ্ছে।
রীতি সাদিবের সামনে গিয়ে ভদ্রভাবে বললো,
—-“হ্যা বলুন।”

সাদিব ফোন বের করতে করতে বললো,
—-“এখানে এসে সোজা হয়ে দাড়াও।”

রীতি সাদিবের কথা মতো সাদিবের বলা জায়গায় সোজা হয়ে দাড়ালো।
সাদিব ফোন বের করে ক্যামেরা অন করে সেল্ফি নেওয়ার জন্য ফোন উচু করতেই রীতি হতবাক।কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিক তোলা শেষ।
রীতি সাদিবকে বললো,
—-“এটা কি হলো?আমার পিকচার তুললেন কেনো?”

সাদিব ফোন পকেটে রেখে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
—-“তোমার নামে মামলা হবে।আর মামলা আমি করবো। তাই তোমার পিকচার তুলে নিলাম।পুলিশকে দেবো,যাতে পুলিশ সহজেই তোমাকে খোজে পায়।”

রীতি সাদিবের কথা মাথা মন্ডু কিছুই বুঝতে পারছেনা।
তাই চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

সাদিব রীতির চাহুনি দেখে বললো,
—-“সবার সাথে পিকচার নেওয়া হয়েছে।তুমি বাকি ছিলে।তাই নিয়ে নিলাম।সুন্দর কিছু মোমেন্ট ক্যাপচার করে নিলাম।বুঝেছো?”

রীতি কিছুই বুঝেনি তাই কোনো উত্তর দিলোনা।
সাদিব সেটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
—-“বাসায় যাও।এখানে আর থেকো না।”

.

রীতি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।নিচে দুই-এক জন মানুষ দেখা যাচ্ছে।রীতি ভাবছে সাদিবের কথা।সাদিব ওর সাথে পিকচার তুলেছে।কেক ফেলে দেওয়ার পরেও কিছু বলে নি।ম্যানেজ করে এনেছে।ওর বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।সাদিব ওকে আজকাল একটু বেশীই কেয়ার করছে।সেটা ভেবেই রীতির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো।

রীতির ফোন বেজে উঠলো।এই রাতে কে ফোন দিবে?
রীতি ফোন হাতে নিয়ে দেখে সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।রীতি ফোন রিসিভ করে ঝাড়ি দিয়ে বললো,
—-“আপনি এই রাতের বেলায় কি চান?কেনো নিষেধ করার পরেও আমাকে বারবার ফোন করেন?”

—-“তোমার কন্ঠস্বর শুনতে।আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছিলো একদম পরীর মতো।কিন্তু বলতে পারিনি।”

রীতি চমকে গেলো।
তারপর কাপা কাপা গলায় বললো,
—-“আপনি এখানে কেনো এসেছিলেন?”

—-“কেনো আসতে মানা নাকি?”

রীতি কোনো জবাব খোজে পাচ্ছেনা।
—-“আপনার নাম কি?”

—-“কিছু একটা ভেবে নেও।”

রীতির ভাবাভাবির সময় নেই।তাই বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে বন্ধ করে রাখলো।
রীতি ভাবছে,
“কে হতে পারে? এখানে আজ এসেছিলো? সেই কালো পাঞ্জাবী পড়া লোক নয়তো?”
রীতি সিদ্ধান্ত নিলো এই সিম আর অন করবেনা।নিউ একটা সিম নিবে।

চলবে….