গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-০৮

0
3957

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৮|

অক্টোবর মাস শেষ দিকে।কিন্তু এখনো শীতের দেখা নেই।যেখানে গতবছর অক্টোবর মাসে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা না থাকলেও শীত পড়ে গিয়েছিলো।সকাল বেলায় কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ঘাসের উপর শিশির বিন্দু জমা হতো।বেলা হলে কুয়াশা ভেদ করে এক ফালি রোদ এসে পড়তো।সেখানে এই বছর এখনো গরমের তীব্রতা রয়েছে।ভাপ্সা গরম পড়েছে।রাতে ঠিকমতো কারেন্ট ছিলোনা।
রীতির ঘুম হয়নি ঠিকমতো।সকাল সকাল উঠে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে।আশেপাশটা ধোয়াশা লাগছে।

রীতির কৌতুহলী মন বলে উঠলো,
“তবে কি শীত পড়তে শুরু করেছে?ঘাসের উপর কি শিশির বিন্দু জমা হয়েছে?”
রীতি কৌতুহল নিয়ে মেইনগেট খোলে নিচে যাওয়ার জন্য।বাড়ির সবাই ঘুম কেউ এখনো উঠেনি।রীতি কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে গেলো।
বাগানে গিয়ে দাড়ালো।ঘাসের উপর শিশির বিন্দু জড়ো হয়েছে।রোদ উঠলেই মুক্তোর মতো জ্বলে উঠবে।
রীতি পায়ের জুতা খোলে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাটছে।তারপর চোখ গেলো সাদিবের ফুলের গাছের দিকে।গাছের নিচে কয়েকটা ফুল পড়ে আছে।রীতির লোভ জাগলো কয়েকটা ফুল ছুয়ে দেখার।রীতি গাছের কাছে গিয়ে ফুলে হাত দিবে তখনই গম্ভীর কন্ঠস্বর বললো,
—-“একদম ছুবেনা।”

কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে রীতি ঘাবড়ে গিয়ে ঘুরে দাড়ালো।
সাদিব দাড়িয়ে আছে।
রীতি সাদিবকে দেখে আরো ঘাবড়ে গেলো।
“এভাবে ধমকানোর কি আছে?আমি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি?ফুল ছিড়তাম আমি হুহ?আমি তো শুধু ছুয়ে দিতে চেয়েছি।”
রীতির ইচ্ছে করছে সাদিবকে দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু মনের কথা মনে রেখে দিলো।

সাদিব ভ্রু কুচকে বললো,
—–“কি হচ্ছে এখানে?আমার শখের বাগান এটা।ফুলে হাত দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।একদম ছুবেনা।যাও এখান থেকে।”

রীতি অপমান হজম করে নিলো।তারপর জুতা পায়ে দিতেই সাদিব বললো,
—-“খালি পায়ে কি করছো?”

রীতি সাদিবের কথার উত্তর দিলো,
—-“খালি পায়ে নাচ করছিলাম।আপনার সমস্যা?অদ্ভুত!”

রীতি জুতা পায়ে হনহন করে হেটে চলে গেলো।
সাদিব হাসছে আর মনে মনে বলছে,
“তারছিড়া মেয়ে”

.

বইয়ের লাইব্রেরিতে প্রচুর ভীড়।তিল পরিমাণ জায়গায় নেই দাড়ানোর।রীতি দূরে এক জায়গায় দাড়িয়ে ভীড় কমার অপেক্ষা করছে।ওর কিছু প্রয়োজনীয় বই কেনা দরকার।তাই লাইব্রেরীতে এসেছে কিন্তু এখানে তো প্রচুর ভীড়।যেনো আজই সবার বইয়ের প্রয়োজন পড়ে গেছে।
মাগরিবের আজান পড়ে গেছে।রীতির কানে আজানের শব্দ পৌছাতেই রীতির টনক নড়লো।এখানে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না।ভেবেছিলো ভীড় কমার পর ধীরেসুস্থে বই কিনবে কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে তা সম্ভব না।রীতি ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরদাম করে বই কিনে নিয়ে এলো।
এখন বিপত্তি বেধেছে রিক্সা পাওয়ায়।একটা রিক্সাও নেই।রাত হয়ে গেছে আর বর্তমান পরিস্থিতিতে রাতের বেলা বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
রীতি রাস্তায় দাড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে।রিকশা খোজছে।তখনই ওর চোখ আটকে গেলো একজনের দিকে।রীতি ভালো করে দেখলো।ভুল দেখছে না তো।
“এটা কি করে হতে পারে?মেয়েটা কে রিজভীর সাথে?যেমন বিহেভ করছে মনে হচ্ছে বিয়ে করা বউ।গার্লফ্রেন্ড নয়তো?কিন্তু সাবিহা? রিজভী কি সাবিহাকে ঠকাচ্ছে?”
রীতি ফোন বের করে এক পিক তোলার জন্য কিন্তু তার আগেই মেয়েটাকে ওর বাইকে বসায়।রীতি আর পিকচার নিতে পারেনি।মেয়েটা রিজভীকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে রিজভী বাইক স্টার্ট দিলো।
রীতি কিছু মেলাতে পারছেনা।ওরা দুজন একসাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো।মেয়েটার মুখে তৃপ্তির হাসি ছিলো।কথার ফাকে একে অপরেকে বারবার ছুয়ে নিচ্ছে।ওদের বিহেভিয়ার ওদের সম্পর্কের কথা জানান দেয়।

.

রিক্সা এসে গেটের সামনে থেমেছে।ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে।লাইটের আলোর কারণে সময়টা বুঝা যাচ্ছেনা।কিন্তু রাত হয়ে গেছে অনেক রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতে করতে।রীতি তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
বাগানটা নীরব নিস্তব্ধ।কেউ নেই আর না আছে কোনো শব্দ।রীতি তাড়াতাড়ি বাগান পাড় করে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে।
সাদিব বাইরে যাচ্ছে কোনো কাজে।এক সিড়ি পার করতেই রীতিকে দেখলো।এর আগে পিছে কেউ নেই যার মানে ও একা আছে।
সাদিব রীতিকে দেখে বললো,
—-“এই দাড়াও,তুমি এই সময় কোথায় থেকে আসলে?”

রীতির মাথায় তখনও রিজভীর ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।সাদিবকে খেয়ালই করে নি।
রীতি সাদিবের কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
তারপর বললো,
—-“লাইব্রেরি থেকে।”

—–“লাইব্রেরি?কার সাথে গিয়েছিলে?”

—-“একাই গিয়েছিলাম।”

সাদিব অবাক হয়ে বললো,
—–“এই রাতে তুমি একা একা বাইরে থাকছো?একা কেনো গিয়েছিলে?কাউকে নিয়ে যেতে পারোনি?আংকেল,আন্টি কিংবা রিমনকে নিয়ে যেতে পারতে।”

—–“সবাই ব্যস্ত ছিলো তাই একাই গিয়েছিলাম।আর তাছাড়া বুঝতে পারিনি এতো দেরি হবে।”

সাদিব রাগ দেখিয়ে বললো,
—–“বুঝতে পারোনি মানে?কি বুঝতে পারোনি?দেশের যে পরিস্থিতি তাতে তোমাদের টনক নড়ে না?একা একা ঢ্যাং ঢ্যাং করে রাতের বেলায় ঘুরে বেড়াও?”

রীতি সাদিবের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না।কি বলছে,কেনো বলছে?এত চিন্তিত ভাব কেনো দেখাচ্ছে?
—-“আশ্চর্য আপনি আমাকে কথা শুনাচ্ছেন কেনো?প্রয়োজন ছিলো তাই গিয়েছি।আমি ঘুরতে যাইনি।আপনার সমস্যাটা কই?”

রীতির কথা শুনে সাদিবের গায়ে যেনো ফোস্কা পড়ে গেলো।সাদিব ধমক দিয়ে বললো,
—-“এই মেয়ে কি বললে আমার সমস্যা কোথায়?আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে বলেছি।এই বিল্ডিংয়ে বসবাসরত সবার নিরাপত্তার কথা আমি ভাবি আর সেই ভাবনা থেকে বলেছি।যাও এখন।বেশী স্পর্ধা দেখাতে এসোনা।”

সাদিবের ধমক খেয়ে রীতি চুপসে গেলো।তাই আর কিছু না বলাই ব্যাটার মনে করছে।রীতি তাড়াতাড়ি সিড়ি পার করছে।
সাদিব রীতির দিকে ঘুরে বললো,
—-“শুনো।”

রীতি থেমে গেলো।সাদিব কয়েক সিড়ি উপরে উঠে রীতির সামনে দাড়ালো।রীতির হার্টবিট ফার্স্ট হচ্ছে সাদিবকে এতো সামনে দেখে।
সাদিব রীতির দিকে মায়াভরা দৃষ্টি দিয়ে নরম সুরে বললো,
—-“সন্ধ্যা বেলায় আর একা বের হবেনা।
দিনকাল ভালো না।প্রয়োজনীয় কাজ দিনের বেলায় সেড়ে নিবে।আর খুব প্রয়োজন হলে কাউকে নিয়ে বের হবে।কাউকে না পেলে আমাকে বলবে।”

রীতি মাথা নাড়িয়ে হু বললো।আসলে রীতি কি বলছে,সাদিব ওকে কি বলছে সেটা ভালো করে ওর মাথায় ঢুকছেনা।তাই হু বলছে।

—-“যাও।”
সাদিবের শীতল কণ্ঠে রীতির টনক নড়ে।রীতি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে উপরে যায়।সাদিবও কয়েক সিড়ি উপরে যায়।
তারপর আবার নিচে নেমে নিজের কাজে যায়।

.

রীতি বিছানায় বসে আছে।সাদিবের সাথে ওর কথোপকথন রিপিট করছে।সাদিব কি বলেছে।
তারপর রীতি হুট করে বলে,
“কাউকে না পেলে আমাকে বলবে।”
রীতি লাফিয়ে উঠলো।তারপর ঘরজুড়ে পাইচারি করছে।
আর ভাবছে এর মানে কি?সাদিব কেনো এটা বললো?হুট করে এতো কেয়ার কেনো দেখাচ্ছে?

.

জুইয়ের বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে।পুরো বাড়ি লাইটিং করা হচ্ছে।বিয়ের অনুষ্ঠান ক্লাবে হলেও হলুদ ছাদে হবে।ছাদে স্ট্রেজ বানানো হচ্ছে।পুরো বিল্ডিংয়ের সবাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বিয়ে উপলক্ষে।রীতির ব্যাপারটা ভালো লাগছে।সবাই একসাথে কত সুন্দর মিলেমিশে থাকে।এই বিল্ডিংয়ের মানুষগুলো ইউনিক।অনেকে তো পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের খোজ নেয়না কিন্তু এরা সত্যিই আলাদা।
রীতি পড়াশোনার ব্যস্ততার মাঝেও ছাদে এসেছে।ছাদ কেমন সাজানো হয়েছে সেটা দেখতে আসা ওর বাহানা মাত্র।ও এখানে সাবিহার সাথে কথা বলতে এসেছে রিজভীর ব্যাপারে।

রীতি বিভিন্ন কথার ফাকে সাবিহাকে বললো,
—-“সাবিহা আমি গতকাল রিজভীকে দেখেছি।”

সাবিহা রিজভীর কথা শুনতেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
—-“তাই নাকি আপু?”

—-“হ্যা,লাইব্রেরীর পাশে দেখেছি।”

—-“কথা বলেছো?অবশ্যই বলোনি।বললে রিজভী আমাকে বলতো।ও আমাকে সব বলে।”

—-“তাহলে এটাও বলেছে ও গতকাল সন্ধ্যায় কার সাথে ওখানে গিয়েছিলো?কে ছিলো ওই মেয়েটা?”

সাবিহা চমকে গিয়ে বললো,
—-“মেয়ে!! কোন মেয়ে?কি বলছো আপু?”

—–“আমি একটা মেয়ের সঙ্গে ওকে দেখেছি।”

সাবিহা হেসে বললো,
—-“হবে হয়তো কেউ।কোনো ফ্রেন্ড বা কাজিন।”

—–“আমার তা মনে হয়নি।”

—-“মানে কি আপু?”

—-“ওদের বিহেভিয়ার অন্য রকম লাগছিলো।মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অন্য কিছু।”

সাবিহার রীতির কথাটা পছন্দ হলোনা।মুখের উজ্জ্বল আভা মিলিয়ে গেলো।
—-“আপু আমি রিজভীকে অনেক ভালোবাসি।আর রিজভীও আমাকে অনেক ভালোবাসে।আমি ওকে ট্রাস্ট করি।তুমি ভুল ভাবছো।ও আমার বিএফ তাই বলে তো এমন নয় যে ওর কোনো ফ্রেন্ড কিংবা কাজিন থাকতে পারবেনা বা ওদের সাথে মিশবেনা।”
সাবিহা কথা শেষ করে রীতিকে কিছু বলতে না দিয়ে অন্যত্র চলে গেলো।

রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—-“অন্ধপ্রেম হলে যা হয় আর কি।এই মেয়ে কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা।এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক?বিশ্বসের মূল্য কি সবাই পায়?সাবিহা কি পাবে?ঠকবে না তো?”

সাদিব দূর থেকে সবটা খেয়াল করলো।এ যেহেতু ছাদেই ছিলো।সব কাজ দেখাশোনা করছিলো।সাবিহার সাথে কি হলো সেটা জানার অদম্য ইচ্ছে সাদিব চেপে রাখতে পারলো না।তাই রীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে।
তার আগেই রীতির মা চলে এলো।তাই সাদিব আর কথা বলতে পারলো না। কিছুক্ষন পর রীতি মায়ের সঙ্গে নিচে চলে গেলো।

চলবে….🌸