গোপন কথা পর্ব-০৬

0
412

#গোপন_কথা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



বারংবার ওসব নোংরামো চোখে পড়লে কার বা সহ্য হয়! তিশা কতো বার দেখেছে ওদের!
ওর সামনেই একে অপরের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যাওয়া। চুপিচুপি কানে এটা ওটা বলা।হুট করে দৌড়ে ছাদে উঠা।রাত বিরাত নেই এক ঘরে শুয়ে বসে গল্প আর গল্প।ও- মা! এদের আচরণ এমন যেন এরা বারো-তেরো বছরের সদ্য কিশোর- কিশোরী। বারো -তেরো বছর বয়সের ছেলে মেয়েরা অনেকটা এমন হয়। ছটফটে।বুনো পাখির মতো। উড়নচন্ডী।এরা কে কী বলবে বা ভাববে এসবের ধার ধারে না।অথবা ওরা জানেই না যে ওদের নিয়ে কোন আলোচনা হতে পারে! আলোচনা হইয়ো না।বড়োরা জানে এই বয়সটা এমনই।ওই বয়সে ছেলে মেয়েদের ভেতর সদ্য কামনা জেগে উঠে। কানাকানি ফিস ফিস করে এটা ওটা বলে ওরা।তাই বলে ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া বিবাহিত দুটো ছেলে মেয়েও এমন করবে?
ওরা ভেবেছে টা কী!নাটক সিনেমার শুটিং করছে নাকি? নাকি ভেবেছে, এ বাড়ির আর সকল মানুষ বোকা সোকা। শুধু তারা দুজন কপোত- কপোতীই জ্ঞানী। একেবারে এরিস্টটল!না না তার উস্তাদের উস্তাদ সক্রেটিস?
কথাগুলো ভাবলো তিশা। এই কথাগুলো ভাবার কারণ আছে।আজ দুপুর সাড়ে এগারোটা কী বারোটা। তখন তিশা ডাইনিং পেরিযে নোরার কাছে যাচ্ছিল। তখনই দেখলো,দীপা ঘরের ভেতর থেকে ফাহাদের হাত ধরে টেনে ওকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।দীপার তিন বছর বয়সী ছেলেটা তখন ঘরে।ফ্লোরে বসে মায়ের ট্যাব নিয়ে কী যেন একটা দেখছে। কার্টুন ফার্টুন হবে সম্ভবত।
কী ভয়াবহ লজ্জার কথা! ছেলেটার সামনে এসব!
কিন্তু ওরা এইসব লজ্জা শরম কবেই খেয়ে বসে আছে!
ওরা ডাকাতের মতো।দস্যুর মতো। এদের কাছে দিন এবং রাতের কোন তফাৎ নাই।তফাৎ নাই পাপ কিংবা পূণ্যেরও।

তিশাকে দেখেও ওরা দমে গেল না।তিশাও দাঁড়িয়ে রইল না।তার মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হয়ে আছে।আজ সে বড়ো সড়ো একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে বলে মনস্থির করলো!
সে ধপধপ করে হেঁটে নোরার ঘরে এলো। তারপর বললো,’খবর কী আছে তোমার?’
নোরা মৃদু হেসে বললো,’কিসের খবর?’
‘চোখ কী অন্ধ নাকি তোমার?’
‘কেন কী হয়েছে আবার?’
‘দেখে এসো গিয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে! এদের যদি লজ্জা শরম বলতে থাকতো কিছু!দরজাটা খোলা রেখেই! ছিঃ!তাও ছেলেটার সামনে।আরে ওসবের এতো নেশা থাকলে তুই বস্তিতে যা। ওখানে ঘর বেঁধে ফেল। ঢাকায় থেকে চাকরি বাকরি করে কী লাভ? ওখানে গেলে তো এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারছিস।টাকা আর শখ দুটোই পূরণ হচ্ছে! তোকে কেউ বাঁধা টাধাও দিচ্ছে না!মন যতো চায় ততো ফূর্তি কর।’
তিশা রাগে ফুঁস ফুঁস করছে। অতটুকু বয়সে এর আগে সে কখনও এমন রাগেনি!
নোরা বললো,’আসলেই ওর পতিলালয়ে যাওয়া উচিৎ।ও এর একদম যোগ্য।যে মেয়ে তার নিজের ছেলেটার সামনে এসব করে বেড়ায় এরচেয়ে নোংরা মহিলা আর কে আছে!’
তিশা বললো,’ইচ্ছে করছে এদের কুপিয়ে মারি! ‘
নোরা বললো,’কুপিয়ে মারলে তো এরা একেবারেই মরে যাবে। আবার ওদের খুনের দায়ে তোর জেল ফাঁস হবে। দেশের আইনটাও হাতে তোলে নেয়া হবে! এরচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে একটা কিছু করতে হবে।যাতে করে এদের রোজ রোজ মৃত্যু হবে।ধর, এমন একটা কিছু করলাম যার পর ওরা সারা জীবন ভুগবে। ভুগবে আর ভুগবে!আর দীপার শেষ ঠিকানা টা হবে পতিতালয়।তোর ভাইটার কোথায় ঠিকানা হয় জানি না!
কিন্তু আমার না ওর ছেলেটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। ছেলেটার জীবনটা খুব কষ্টে যাবে রে!’
তিশা বললো,’ছেলেটার জীবন আবার সুখেই বা যাবে কবে?যখন বড় হয়ে সে বুঝতে শিখবে।যখন সে জানবে তার মা তার চোখের সামনে পর পুরুষের সাথে যা করতো তা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত পাপ। তখন? এরচেয়ে কী এটা ভালো না যে ছেলেটাকে তার বাবার হাতে তুলে দেয়া? তার বাবা তাকে উপযুক্ত পরিবেশে বড় করে তুলবে। এমন কাল নাগিনীর বিষের ছোঁয়া তবে তার গায়ে আর লাগবে না!তার বাবা তাকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে!’
নোরা বললো,’কথা তো মন্দ বলিসনি। কিন্তু আমার জীবনটা কী হবে বল দেখি তো?আমি তো কলঙ্কিনী হয়ে যাবো রে তিশা!’
তিশার রাগ লাগছে খুব!সে রাগের গলায় বললো,’অশিক্ষিত আর কুসংস্কার পূর্ণ মেয়েদের মতো কথা বলা রাখো তো তুমি। তুমি কী এখনও ভাবছো ভাইয়ার সংসার করবে?’
‘হ্যা ভাবছি।ওর চরিত্র বদলে গেলে করবো।’
তিশা বললো,’তুমি আমার চেয়ে হয়তোবা বয়সে বড় কিন্তু তুমি অনেক গাধা আছো। তুমি যেভাবে মানুষ নিয়ে ভাবো মানুষ আসলে তেমন না।’
‘মানুষ তবে কেমন?’
‘মানুষ ফেরেশতার চেয়েও উত্তম আবার শয়তানের চেয়েও অধম। খারাপ মানুষ হুট করে ভালো হয়ে গেলে তাকে বিশ্বাস করা বোকার কাজ। তুমি রিস্ক নিয়ে যদি ওকে বিশ্বাস করে থেকে যাও তবে দেখবে নতুন করে তোমায় সে ঠকাচ্ছে। তখন? তখন কী উপায় হবে তোমার?
আমি তো ডিসিশন নিয়েছি কখনো বিয়েটাই করবো না। বিয়ে করে অত কষ্ট সহ্য করতে পারবো না! এরচেয়ে একা থাকাই ভালো।’
নোরা ভাবতে পারছে না আর কিছু।কারণ সে জানে একবার ডিভোর্স হয়ে গেলে তারপরের জীবনটা একটা নারীর জন্য কী কষ্টের! তবুও সে সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে ডিভোর্সি মহিলা হয়ে সারা জীবন একা থাকা ভালো।সে জানে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টের একটি হলো স্বামীর অন্য মেয়ের সাথে পরকিয়ার সম্পর্ক।এটা মেনে নেয়া যায় না। কিছুতেই না।
সে মনে মনে ঠিক করে নিলো, এই নোংরা লোকটির সাথে কিছুতেই সে সংসার করবে না। কিছুতেই না।

শেষ বিকেলে নোরা তিশাকে নিয়ে ছাদের উপর উঠলো। গোলাপ বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় হয়ে আসা সন্ধ্যায় তিশার সাথে একটা গোপন কথা বললো নোরা।নোরা বললো,’তোর একটা কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক করতে হবে।’
তিশা বলে,’তোমার জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।ভাবী, এমন কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে সারা জীবনভর থাকলেও তাদের আপন করে নেয়া যায় না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে এক পলক দেখেও আপন করে নেয়া যায়। আমার এক পলকে দেখেও আপন হওয়া মানুষটি তুমি। তোমার মঙ্গল হয় এমন যে কোন কাজ আমি করতে পারি!’
নোরা এবার কাজটির কথা বলে।বলে,’তুই দীপার সাথে গলায় গলায় ভাব করবি।’
তিশা কেঁপে উঠে।রাগে তার হাত পা টান টান হয়ে উঠে। মাথায় চক্কর দেয়।
সে বলে,’এটা কোন ধরনের কথা বললে তুমি!ওর মতো নোংরা মহিলার সাথে আমি গলায় গলায় ভাব করতে যাবো কেন?ওর মুখে তো আমার থুথু দিতে ইচ্ছে করে।এরচে বরং বলো ওর মুখে থুথু দিয়ে আসি। হুকুম করতে দেরি হবে কিন্তু কাজ সেরে আসতে দেরি হবে না!’
নোরা এবার বলে,’এই তোর আমার প্রতি ভালোবাসা? একটু আগেই না বললি তুই আমার জন্য সব করতে পারিস!আমি তোর আপন মানুষ। আমি যা বলবো তাই করতে প্রস্তুত তুই। কিন্তু এখন না বলছিস কেন?প্রশ্ন তুলছিস কেন?’
তিশা ভীষণ রকম অবাক হয়।সে বলে,’তাই বলে কী আমি তার সাথে গিয়ে ভাব করবো, গলায় গলায় মিশবো? জড়াজড়ি করবো ওর সাথে? যে কি না তোমার এবং আমার চোখের বালি।যে কি না এই পবিত্র বাড়িটিকে ওর পাপের কালিমায় অপবিত্র করে দিয়েছে। এটা আমি কীভাবে করবো বলো!’
নোরা হাসে। অদ্ভুত করে হাসে।ওর হাসির রেখায় মিলিয়ে যায় মেঘের ওপারে লাল দিবাকর। একদল পানকৌড়ি উড়ে যায় ডানা মেলে।আর গোলাপের ডালে এসে বসে পড়ে একটা ঘাস ফড়িং।
তিশা বুঝতে পারে না এ হাসির মর্ম।সে চেয়ে তাকে নোরার মুখের দিকে। বোকার মতো।নোরা কী তাকে দিয়ে কোন গেইম খেলতে চায়?
যদি খেলে তবে মন্দ হবে না।সে ভালো খেলবে বরং!
নোরা এবার তিশার নরম তুলতুলে হাত দুটো ধরে। তারপর সেই জোড়া হাত তার হাতের ভেতর নিয়ে মুষ্টি করে ধরে আদর করতে করতে বলে,’ওর সাথে এমন ভাবে মিশবি যেন ও ভাবে তুই——-

#চলবে