ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-১+২+৩

0
476

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১
রায়দার মেয়ের খবর শুনেছ মনার মা, কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার গো, সব ওই মেয়ের কপালের দোষে! আগেই বলেছিলুম মেয়েদের এতো তেজ ভালো নয়! কতো করে তো অপর্ণার মাকেও বলেছিলুম, একটু দেখে রাখো মেয়েকে! তা সেও কি আর কথা কানে নেয়! সেদিন যদি একটু শুনতো তাহলে আজ আর এতো বড়ো দিন দেখতে হতো না গো!

দুপুরের রোদে পিঠ দিয়ে বারান্দায় পাতা শতরঞ্জি তে বসতে বসতে বললো মলয়া যাকে এখানে সবাই রাজার মা বলেই চেনে। মনার মা মাথা নাড়লো,

শুনবো না কেনো গো! একি আজকের কথা! যবে থেকে ওই প্রেম ট্রেমের ভুত মাথায় চেপেছে তবে থেকেই জানি একটা কিছু বাড়াবাড়ি হবে তবে ও ভুত মাথা থেকে নামবে!

বাড়াবাড়ি বলে বাড়াবাড়ি! কি কান্ড বলো দিকিনি! একটা শক্ত পোক্ত জোয়ান ছেলে কিরম হুট করে মরে গেলো গো!

গালে হাত দিয়ে বললো মলয়া, পাশ থেকে বারীন মুখুজ্জের বউ সাবিত্রী মাথা নাড়লো,

না গো রাজার মা, হুট করে নয়! আমার ছেলে কাল বলছিলো এ তো হবারই ছিলো! ওই মেয়ের ওপরে নাকি স্বপনের নজর পড়েছে, সে যা ছেলে অন্য কাউকে আর ধারেপাশে আসতে দেবে তার! তাছাড়া পকেটে তো পয়সাও কম ছিলো না শুনলুম, পুলিশ নাকি বলছিলো!

মনার মা সহমত হলো,

হ্যাঁ! আমিও সেরোম কিছুই শুনছিলাম! যাদের খবর তাদের মুখ থেকে তো আর কিছু বেরোবে না, ওই লোকমুখেই ভরসা!

ক্রমশ বিভিন্ন বক্তব্যে জমে উঠছিলো নিত্যদিনের দুপুরের গল্পের আসর, সারাদিনের কাজের শেষে এটুকুই জীবনের আনন্দ! মায়েরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের বা স্বামীদের নামেই পরিচিত এখানে, তাঁরা নিজেরাই এখন নিজেদের নাম আর মনে করতে পারেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে।

যেমন যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা সেই মনার মায়েরও কিন্তু সুন্দর একটা নাম আছে, সীমা! কিন্তু বাপ মা চলে যাওয়ার পরে আর তাকে কেউ সে নামে ডেকেছে কিনা তার মনে পড়েনা, এমনকি স্বামীও তাকে ওগো শুনছো বলে ডেকেই এই জন্মটা চালিয়ে দেবেন বোঝাই যায়। তবে সেই নিয়ে কারোর কোনো বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই, তাঁরাও নিজেদের ছেলে মেয়ের বা স্বামীর নামে পরিচিত হতেই ভালোবাসেন। আসলে স্বামী, সন্তান, সংসার আর অবসর বিনোদন বলতে দুপুরে পাটি পেতে কারোর কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে গল্প, সন্ধ্যেবেলায় টিভিতে সিরিয়াল, এবং আরও বেশি করে বলতে গেলে পরনিন্দা পরচর্চা এইটুকুই, তাই খুব বেশি ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া তাঁদের নেই, এবং না পাওয়ার জন্যে কোনো আক্ষেপও নেই।

এই সময়ে দাঁড়িয়েও কলকাতা থেকে বেশ অনেকটা দূরের এই আধা শহরের মানুষজন এখনও খুব বেশি অন্তর্জালের দুনিয়ায় মগ্ন হয়ে ওঠেনি। একদম অল্পবয়সী ছেলে মেয়েদের যদিও অল্পসল্প সামাজিক মাধ্যমগুলোয় যোগাযোগ আছে তবে তাদের অভিভাবকরা এসব থেকে দূরেই থাকেন। ছোটো এই আধা শহরটার এক প্রান্তে ছোট্ট একটা রেল স্টেশন, নাম রসুলপুর, স্টেশনের নামেই পরিচিতি শহরের, সারাদিনে শুধু মাত্র লোকাল ট্রেন দাঁড়ায়, এক্সপ্রেস ট্রেনের ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া দেখতেই অভ্যস্ত এখানকার বাসিন্দারা। সেই স্টেশন কে ঘিরে ছোটো একটা রেল কলোনি, বাসিন্দারা সবাই মোটামুটি রেলেরই বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। এই রেলের অঞ্চল টুকু পেরিয়ে গেলে বেশ খানিকটা দূরে ছোটো একটা গঞ্জ, তাকে শহর বলা উচিত কিনা বোঝা মুস্কিল, আগে তো বাজার আর মুদির দোকান বাদে সেরকম কিছু ছিলো না, এখন অল্পবয়সীদের চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকটা নতুন জামা কাপড়ের দোকান হয়েছে। সেই গঞ্জের মধ্যে দিয়েই বাস রাস্তা, তবে সেখান দিয়ে কাছাকাছি যাতায়াতের বাসই পাওয়া যায়, কলকাতার মতো অনেক দূরের শহরে যেতে গেলে ট্রেনই একমাত্র ভরসা, তাও দুবার বদল করে তবেই পৌঁছানো যায়!

যার কপালের দোষ নিয়ে এই উত্তেজিত আলোচনা, সেই অপর্ণা বরাবরই একটু অন্য রকম, তাই তাকে ঘিরে উৎসাহও সব সময়েই বেশি। ছোটো মফস্বল শহরটার নিস্তরঙ্গ জীবনে গত দুদিন ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলো যতটা না আসল ঘটনার জন্যে আলোড়ন ফেলেছে, তার চেয়েও বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যাকে ঘিরে এই ঘটনা সেই অপর্ণা কে নিয়ে।

অপর্ণার বাবা রমেন রায় এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, অসম্ভব সরল সিধে, বরাবরের নির্বিরোধী মানুষ, শুধু দোষের মধ্যে একটাই, মেয়েকে ছোটো থেকেই স্বাধীনচেতা তৈরি করতে চেয়েছেন। সেই নিয়ে বাড়িতেও কম অশান্তি হয়না, তাঁর ভাষায় যেটা স্বাধীনচেতা, তাঁর স্ত্রী সুপর্ণা অর্থাৎ অপর্ণার মায়ের কাছে সেটাই অসম্ভব প্রশ্রয়। আসলে সেদিক থেকে ভেবে দেখতে গেলে দোষ তাঁকেও দেওয়া যায়না, ওই গল্পের আসরে তো তাঁকে গিয়েও বসতে হয়! সেখানে কাঁহাতক আর নিজের মেয়ের নামে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা শুনতে ভালো লাগে! অবশ্য তাঁর সেই রাগ কে বাবা মেয়ে খুব বেশি ধর্তব্যের মধ্যে আনেনা কখনোই, তারা নিজেদের মতোই চলে।

তবে এবারের ঘটনা সত্যিই অন্য রকম, অপর্ণার প্রেমিক সমর খুন হয়ে গেছে! অপর্ণা যে প্রেম করে এই খবর রটার পরেও বেশ কিছুদিন দুপুরের চর্চার বিষয় ছিলো সেই, বাবার অতি প্রশ্রয়ের ফলাফলই যে এই প্রেম সে নিয়ে সবাই মোটামুটি একমত ছিলো। এবার তার খুন হয়ে যাওয়ার খবরে উত্তেজনা আরও বেশি, গত কাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়েই এই আলোচনাই চলছিলো। এর মধ্যেই আজকে সকালে আরও বড়ো ঘটনা ঘটলো, সমরের মৃতদেহ দেখে অপর্ণার বাবা রমেন রায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

অপর্ণা সেই অঞ্চলে মোটামুটি সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী বলে পরিচিত ছিলো, দুটো স্টেশন পরের কলেজে যাওয়ার জন্যে যখন সে বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেন ধরতো, তখন পাড়ার আরও বেশ কয়েকজন ছেলে তাকে ট্রেনে করেই কলেজ পর্যন্ত এগোতে যেতো। অপর্ণা সবই বুঝতো কিন্তু মুখে কোনো কথা বলতো না, অন্যান্য অল্প বয়সী তরুণী মেয়েদের মতোই তার কাছে ব্যাপারগুলো ভালোই লাগতো। এর পরেই হটাৎ করে স্বপনের আগমন হলো, সে ছিলো গুন্ডা প্রকৃতির, ওই ছোটো শহরটায় তার বেশ পরিচিতি ছিলো। আশে পাশের দোকানগুলো থেকে সে তোলা আদায় করতো, এবং একটা ছোটো খাটো দলও তার ছিলো। এহেন স্বপন যবে থেকে অপর্ণার প্রেমে পড়লো, তবে থেকেই অন্য ছেলেদের ট্রেনে ওঠা বন্ধ হয়ে গেলো। তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অপর্ণার প্রেমে পড়ার সাহস অন্যদের ছিলো না, ব্যতিক্রম সমর।

অপর্ণার প্রেমিক সমর যদিও পাড়ার ছেলে ছিলো না, তার জামা কাপড়ের ব্যবসা ছিলো, সে ওই গঞ্জের দোকানগুলোতে নতুন ডিজাইনের জামা কাপড় দিতে আসতো। ট্রেন থেকে নেমে অপর্ণা দের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই যে ছাদে দাঁড়ানো অপর্ণা কে দেখলো সমর, তার আর অন্য মেয়েকে মনেই ধরলো না। প্রথম প্রথম চোখাচোখি, তারপরে দু একটা কথা বলতে বলতেই কখন যে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেললো, ওরা নিজেরাই বোঝে নি কখনো!

বাবা কে টিফিন ক্যারিয়ারে করে স্টেশনে খাবার দিতে যাওয়ার পথে, কখনো বা ট্রেনে কলেজে যাওয়ার সময়, সমরের সঙ্গে অপর্ণার দেখা হতো, সেই দেখা সাক্ষাৎ কখন প্রেমে বদলে ছিলো সেখবর রমেন রায়ের কানে পৌঁছায়নি। অপর্ণা বরাবরের সতর্ক, সে নিজের কলেজে আসা যাওয়ার পথে সমরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছে, রমেন রায় কেনো, আশেপাশের মহিলা মহলও কিছু জানতে পারে নি। ঘটনা শুধু সে আর তার প্রাণের বন্ধু সৃজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, সেটা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব হতো না যদি না স্বপন এর মধ্যে ঢুকে পড়তো।

স্বপন যখন তার সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগ খুঁজছিলো, তখন তার চোখে সমর ধরা পড়লো। ট্রেন থেকে ওঠা নামার সময় ইচ্ছাকৃত ভাবে হ্যান্ডেলে অপর্ণার হাতের ওপরে হাত রাখা, অনেকটা দূরের সিটে বসে থেকেও চোখে চোখে কথা, এই সমস্ত লক্ষ্য করে একদিন সে অপর্ণার অনুপস্থিতিতে সমর কে রাস্তায় ধরলো, সমর তখন দোকানে মালপত্র দিয়ে টাকা নিয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবার জন্যে স্টেশনে ফিরছিলো।

ওই! এদিকে শোন! খুব বেড়েছিস তাই না! পাড়ার মেয়েদের দিকে নজর দিচ্ছিস! বেশি করলে এখানে ব্যবসা বন্ধ করে দেবো বুঝলি! আর তোর পকেটে কি? কতো টাকা রেখেছিস? পকেট ওরকম ফুলে আছে কেনো?

সমর বুদ্ধিমান, কোনো উত্তর না দিয়েই পকেট শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে রেখে চলে গিয়েছিলো তবে প্রেম বন্ধ করেনি। দুজনকেই এরপরেও যথারীতি আড়ালে আবডালে একসঙ্গে দেখা যেতে লাগলো। স্বপন কিছুদিন লক্ষ্য রেখে এরপরের পদক্ষেপ হিসেবে সরাসরি অপর্ণা কে কলেজের গেটে একদিন হাতে গোলাপ নিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু প্রেম নিবেদন করার আগেই অপর্ণা আর সৃজা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে এমন খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো যে স্বপন থতমত খেলো, নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বললো,

এতো হাসির কি আছে? নিজেকে কি বিশাল সুন্দরী ভাবো নাকি? ওরকম সুন্দরী হাজার হাজার আছে!

অপর্ণা সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে খানিকটা তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিলো,

সুন্দরী বলেই তো এসেছো নাকি? হাজার হাজার আছে যখন তখন তাদের কাছে যাচ্ছো না কেনো!

স্বপন রাগে একদলা থুথু মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে গোলাপ মাড়িয়ে চলে গিয়েছিলো আর প্রতিশোধ হিসেবে রমেন রায়ের কানে মেয়ের প্রেমের কথা তুলে দিয়েছিলো। তাতে রমেন বাবু একটু দুঃখিত হলেও মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী সুপর্ণা ছাড়েন নি, কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে বাড়িতে ফেরার পরে বেধড়ক পিটিয়ে ছিলেন। সেই পেটানোর আওয়াজ গায়ে গায়ে লাগোয়া অন্য কোয়ার্টার থেকে শুনতে পাওয়া খুব বেশি অসুবিধের ছিলো না, সেই মতো পরের দিন দুপুরের আলোচনার বিষয় বস্তু অপর্ণাই হয়েছিলো।

কিন্তু স্বপনের এতো প্রচেষ্টাও সেই প্রেম থামাতে পারলো না। আশে পাশের লোকজনের জেনে যাওয়া, মায়ের মার সব কিছুর পরেও অপর্ণা তার প্রেম পর্ব বহাল তবিয়তেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, বাধ সাধলো পাড়া প্রতিবেশী। তারা বড্ড উৎসাহী হয়ে পড়লো, ক্রমাগত আলোচনা সমালোচনা চলার পরে এমন হলো যে পাড়া পড়শী রমেন বাবু কে মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় মামার বাড়িতে রেখে আসার পরামর্শ দিতে লাগলো। এমনকি সুপর্ণাও সারাদিন অশান্তি করতে লাগলেন, এবং তলে তলে মেয়েকে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন।

কিন্তু রমেন বাবু মেয়ের ইচ্ছে কে সম্মান করতেন, মেয়েকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলকাতায় মামার কাছে পাঠিয়ে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁর ছিলো না, তিনি একদিন অপর্ণা কে দিয়ে সমর কে স্ত্রীর অজান্তে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন। স্ত্রী জানতে পারলে বাগড়া দেবেন এই ভয়ে নিজে সামনে না এসে সমর কে চুপিচুপি সব ব্যবস্থা এগোতে বললেন, বিয়ে একবার হয়ে গেলে তারপরে তিনি অনুষ্ঠান করবেন বলেই ঠিক করলেন। সেই মতো অপর্ণা তার সমস্ত কাগজপত্র সমরের হাতে তুলে দিলো, কথা হলো রেজিষ্ট্রির দিন রমেন বাবু মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় যাবেন ও বিয়ের কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করবেন, তারপরে অপর্ণা কে নিয়েই আবার ফিরে আসবেন। অপর্ণার কলেজে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি ছিলো, সেটুকু সময় মুখ বন্ধ রাখতে পারলেই বিয়ের পরে সে কলকাতায় গিয়ে বাকি পড়াশুনা করবে।

সমরের বাবা মা ছিলো না, মেদেনীপুরের গ্রামের পৈতৃক বাড়ি তালা বন্ধ রেখে কলকাতায় মেসে থাকতো, তাই অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। মেয়ে জামাইয়ের ঘর সাজানোর জন্যে খাট, আলমারি এবং মেয়ের গয়নার জন্যে বেশ কিছু টাকাও তিনি সমরের হাতে তুলে দিলেন। সব কিছু ঠিক মতোই চলছিলো, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বিয়ের নোটিস দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো এমন সময় বিয়ের মাত্র কিছুদিন আগেই সমর আচমকা খুন হয়ে গেলো।

প্রথমে কারোর কিছু নজরে পড়েনি, একমাত্র অপর্ণা দুদিন ধরে সমরের মোবাইলে ফোন করলে ফোন হচ্ছিলো না। এমনিতেই তাদের অঞ্চলে নেটওয়ার্ক প্রায় থাকে না বললেই চলে তাই খুব বেশি চিন্তা অপর্ণারও হয়নি সেই ভাবে। প্রায় দিন দুয়েক পরে স্টেশনের পাশের জঙ্গল থেকে একদল কুকুর মুখে করে একটা বস্তা টেনে বার করলো, সেই দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার ছেলেরাই সেটা খুললো এবং সেখান থেকে টুকরো টুকরো কাটা ক্ষত বিক্ষত শরীরে জড়িয়ে থাকা জামা কাপড়, হাতের ঘড়ি দেখে সবাই সেটাকে সমর বলে শনাক্ত করলো। স্টেশন মাস্টার রমেন রায় সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আচমকা সেই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন, তাঁকে ধরাধরি করে পাশেই কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হলো। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বোঝা গেলো তাঁর শরীরের ডান দিক সম্ভবত খানিকটা অসাড় হয়ে গিয়েছে।

বাবা এবং সমর, একসঙ্গে দু দুটো আঘাতে অপর্ণা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো আর রমেন বাবু কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তাই সমরের খুন হওয়ায় কেনো রমেন বাবু অসুস্থ হলেন এ প্রশ্ন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লেও উত্তর পাওয়ার কোনো উপায় এই মুহূর্তে ছিলো না।

কিন্তু পাড়া পড়শীদের মধ্যে রসিয়ে রসিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো, এবং একটা বিষয়ে সবাই সহমত হলো যে রমেন বাবুর অত্যধিক প্রশ্রয়েই আজ তাঁর মেয়ের এই অবস্থা! মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা কখনোই দেওয়া উচিত নয়, তাহলে এরকমই কোনো একটা দিন তাদের জীবনে আসবেই!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২
নিস্তরঙ্গ মফস্বলে মোটামুটি একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হলো, আশে পাশে বড়ো হাসপাতাল বা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা না থাকায় রেল কর্মীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় ফোনাফুনি করে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন কে ওখানে দাঁড় করিয়ে রমেন বাবু কে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, সঙ্গে সুপর্ণা এবং অপর্ণা। তারা চলে যাবার পরে নিকটবর্তী পুলিশ ফাঁড়ি তে ফোনে খবর দেওয়া হলো, যেটা নিকটবর্তী হলেও দূরত্ব প্রায় ঘন্টা দুয়েক।

সেখান থেকে পুলিশ যখন এলো তখন প্রায় সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে, যেহেতু সমরের কোনো নিকট আত্মীয়ের খবর ওখানের কারোর কাছেই ছিলো না, তাই তারা খুনি খুঁজে বার করতে সেরকম উৎসাহ দেখালো না। যেসব দোকানে সে মাল দিতো সেখানে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করে তার কলকাতার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে পুলিশ ফেরত গেলো, দোকানদারদের কথা থেকে তারা জেনে গিয়েছিলো যে সমরের কাছে মালের আগাম হিসেবে বেশ অনেকগুলো টাকা ছিলো সেদিন। তাই খুনের কারণ বার করার আর কোনো চেষ্টা না করেই স্টেশনে বসে বসে টাকা হাপিশ হওয়াকেই একমাত্র কারণ বলে জানিয়ে দিয়ে বডি নিয়ে তারা ফেরত চলে গেলো। দু একজনের যদিও ইচ্ছে ছিলো স্বপন সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার কিন্তু বাকিদের চোখের ইশারায় তারা শেষ পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করলো।

এরপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, নিস্তরঙ্গ রসুলপুর যখন প্রায় একঘেয়ে হয়ে উঠেছে, গল্পের কোনো নতুন বিষয় পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সময় প্রায় মাস তিনেক পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাবা কে নিয়ে অপর্ণা বাড়ি ফিরলো। রমেন বাবু এখন জড়িয়ে জড়িয়ে হলেও বোঝার মতো কথা বলতে পারেন, টুকটাক ঘরের মধ্যে হাঁটা চলাও করতে পারেন কিন্তু স্টেশন মাস্টারের দায়িত্ব সামলানোর ক্ষমতা এই মুহূর্তে রমেন বাবুর ছিলো না। তাই ফিরে এসেই সুপর্ণা স্বামীর অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছুটি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন, ব্যবস্থা চলতে লাগলো, সঙ্গে নতুন করে পুরনো হয়ে যাওয়া সমরের প্রসঙ্গও উঠতে লাগলো। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সুপর্ণা আবার তাঁর দুপুরের আড্ডায় যোগ দিতে শুরু করলেন, সেখানেও টুকটাক কিছু কথা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হতে লাগলো। সবচেয়ে মুখরা মলয়া তাঁকে ছাড়লেন না, সহানুভূতির আড়ালে তাঁর গলায় কৌতূহলের সুর ছিলো,

রায় দার যে কি হলো কিছুই তো বুঝলাম না অপর্ণার মা! কোথাকার কোন অজানা অচেনা একটা ছেলে, তার মরার খবরে কিনা রায়দা মূচ্ছ গেলো! একটা সুস্থ লোক কি করে যে এমন হলো কে জানে!

সুপর্ণা মাথা নাড়লেন, হতাশ গলায় বললেন,

জানিনা গো রাজার মা! আমি নিজেই তো এই কথাই ভাবছি সেই থেকে! লোকটার হলো কি! তা সে মানুষ কি আর বলার মতো অবস্থায় আছে গো, যে কিছু জানতে চাইবো!

মনার মা পাশ থেকে উৎসুক হলেন,

তা বটে! কি হাসিখুশি লোক ছিলো গো, তার এই অবস্থা চোখে দেখা যায় না! তবে একটা কথা বলি অপর্ণার মা, তুমি তোমার মেয়ে কে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো দেখি! সেই তো মেলামেশা বেশি করেছে ওই ছেলের সঙ্গে, সে জানলেও কিছু জানতে পারে!

মেয়ের দুঃখে বাপ মুচ্ছ যাবে! এরকম হয় নাকি আবার! তাও যদি জামাই হতো তাহলে না হয় একখান কথা ছিলো। হ্যাঁ গো তোমার মেয়ে আবার তার সঙ্গে কিছু ঘটিয়ে বসে নি তো? আজকালকার মেয়ে তো! তাকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখোতো, হয়ত রায় দা কিছু জেনেছিল! তার তো বাপের সঙ্গেই ভাব ছিলো বেশি!

মলয়ার কথায় সুপর্ণা চমকে তাকালেন, হে ভগবান! সত্যিই কি এরকম কিছু ঘটলো নাকি! তাঁর মায়ের চোখ কে কি বাপ বেটিতে ফাঁকি দিয়ে গেছে! গল্পের সমস্ত উৎসাহ তাঁর চলে গেলো, তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন,

বিকেল হয়ে এলো, মানুষটা কে চা করে দিতে হবে, আসি গো রাজার মা!

অপর্ণা বাবার মাথার কাছে চুপ করে বসেছিলো, সমরের জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার চলতে থাকলেও মুখে প্রকাশ করার উপায় তার ছিলো না। হটাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেনো তাকে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিণত করে দিয়েছিলো, সেই হাসিখুশি উচ্ছল অপর্ণার সঙ্গে আজকের অপর্ণার কোনোই মিল ছিলো না! রমেন বাবু ভালো করে কথা বলতে পারেন না এখনও, ধীরে ধীরে সুস্থ হবেন বলে ডাক্তার জানিয়েছেন, সেই আশাতেই বুক বেঁধে আছে মা মেয়ে। মেয়ের মলিন মুখ তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিলো, তাঁর চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। বাবার চোখে জল দেখে অপর্ণার চোখও জলে ভরে এলো,

বাবা! আজ তোমার যা হয়েছে তার জন্যে আমিই দায়ী! আমি কখনো ভাবিনি এরকম কিছু হতে পারে!

রমেন বাবু সজোরে মাথা নাড়লেন, জড়ানো গলায় বললেন,

না রে মা! তোর মতো ক্ষতি আর কার হলো! তুই এই যন্ত্রণা থেকে কবে মুক্তি পাবি কে জানে!

বাবা মেয়ের কথোপকথনের মধ্যেই সুপর্ণা প্রায় দৌড়ে ঢুকলেন, মেয়ের দিকে আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন,

হতভাগী মেয়ে! আর কতো জ্বালাবি তুই আমাকে? কি ঘটিয়েছিস ওই ছেলেটার সঙ্গে বল? পাড়ায় তো তোর জন্যে আর মুখ দেখানো যাচ্ছে না, কেনো তোর বাবা ওরকম অসুস্থ হয়ে পড়লো?

অপর্ণা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো, ব্যথিত গলায় বললো,

কি বলছো মা এসব! কি ঘটাব আমি?

সুপর্ণা সজোরে মেয়ের গালে এক চড় মেরে আরো জোরে চিৎকার করলেন,

যেখানে যাই সেখানেই এক কথা! অচেনা ছেলের খুনের খবরে রায় দা কেনো অসুস্থ হলো! আরে বাবা, আমি কি জেনে বুঝে লুকিয়ে রেখেছি! কি উত্তর দিই এসবের! এমনকি সেদিন ভাইও একই কথা বললো! কেনো সবাই একই কথা বলছে বলতো? তোরা দুজনেই সব জানিস!

অপর্ণা চিৎকার করে উঠলো,

মা! বিশ্বাস করো বাবাকে ছোটো করার মতো কোনো কাজ আমি করিনি! তুমি মিছিমিছি ওদের কথায় আমার গায়ে হাত তুলছ!

মেয়ের চিৎকারে সুপর্ণার মাথা আরও গরম হয়ে গেলো, তিনি আবার চড় মারতে যাচ্ছিলেন তার আগেই স্বামীর জড়ানো গলা শুনে থমকে গেলেন,

ও কিছু করেনি, সব দোষ আমার! তুমি জোর করে ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে বিয়ে দিতে চাইছিলে তাই আমি সমর কে ডেকে ওকে রেজিষ্ট্রি করে নেওয়ার জন্যে বলেছিলাম! বিয়ের খরচের জন্যে কিছু টাকাও দিয়েছিলাম!

সুপর্ণা চমকে উঠে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন,

কি বললে! রেজিষ্ট্রি করে নিতে বলেছিলে! টাকাও দিয়েছো তুমি! হে ভগবান! এ তুমি আমার কি করলে! রেজিষ্ট্রি হয়ে গেছে মানে তো বিয়েই হয়ে গেছে! তার মানে ও তো বিধবা! লোকজন জানলে কি হবে! আমি তো কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবো না!

সুপর্ণা বিলাপ করতে লাগলেন, মাকে মাটিতে বসে কপাল চাপড়াতে দেখে এবার অপর্ণা এগিয়ে এলো, কান্না জড়ানো গলায় বললো,

মা! বাবা কি বলেছে তুমি বোধহয় ঠিক করে বোঝনি! রেজিষ্ট্রির কথা হয়েছিলো, হয়নি! আমি যা ছিলাম তাই আছি! কিন্তু কথা সেটা নয় মা! একটা জলজ্যান্ত মানুষ খুন হয়ে গেলো কেনো, কেউ সেটা জানতে চাইছে না! উল্টে বাবা কেনো অজ্ঞান হয়ে গেলো সেটা নিয়ে আলোচনা করছে!

সুপর্ণার এতক্ষনে বিষয়বস্তু বোধগম্য হলো, তিনি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে মেয়ের দিকে তেড়ে এলেন,

চুপ কর! যত বড়ো মুখ নয় ততো বড়ো কথা! বিয়ে নাহয় হয়নি কিন্তু বেশ কিছু টাকা তো গেছে, তাই বা কম কি! আর প্রতিদিন কতো লোক চারদিকে খুন হচ্ছে তার ঠিক নেই, আর ওই চালচুলোহীন ছেলেটা কেনো খুন হলো লোকে মাথা ঘামাতে যাবে! পকেটে তো শুনলাম অনেক টাকা ছিলো সেসব নাকি কিছু পাওয়া যায়নি!

অপর্ণার গলা কান্নায় বুজে এলো,

ওরকম করে বোলো না মা! ওর কেউ নেই বলে খুনের কোনো বিচার হবে না! ওর ঠিকানা আছে আমার কাছে, আমি থানায় যাবো, বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বিচার চাইবো! আমি জানি এসব স্বপনের কাজ, ও অনেক বার ওকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে হুমকি দিয়েছে, পকেটে কতো টাকা আছে জিজ্ঞেস করেছে! সমর আমাকে সব বলতো!

সুপর্ণা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন,

শোনো তোমার মেয়ের কথা! বাবার এতো বড়ো অসুখের পরেও ওর শিক্ষা হয়নি, উনি এখন থানায় চললেন খুনের বিচার চাইতে! আমি এই শেষ কথা বলে দিলাম মেয়েকে বুঝিয়ে দিও! তোমার কাজ সব শেষের পথে, ছুটি বাড়লেই আমরা কলকাতায় গিয়ে ওর বিয়ে দেবো, ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে! এই কদিন যেনো ও ঘরের বাইরে পা না দেয়! যদি দেয় তাহলে তোমরা আমার মরা মুখ দেখবে বলে দিলাম!

সুপর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে অপর্ণা জলভরা চোখে বাবার দিকে তাকালো,

বাবা! প্লিজ! মাকে বোঝাও! আমি এখন অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না! সমর কে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া কি সম্ভব, তুমিই বলো? আর আমার সামনেই পরীক্ষা, তারপরে আমি এম এ তে ভর্তি হবো, সব ঠিক হয়ে আছে!

কি বললি? বিয়ে করতে পারবি না! তুই করবি না তোর ঘাড় করবে!

সুপর্ণা আবার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন, অপর্ণা চমকে তাকালো, মা যে বাইরে থেকে সব শুনেছে বুঝেই এবার মরিয়া হয়ে বললো,

না, করবো না! জোর করে দেবে নাকি! আমার এখন বিয়ে করার মতো মনের অবস্থা নেই! কেনো বুঝতে চাইছো না তুমি!

মনের অবস্থা নেই কেনো? ওই হাভাতে ছেলেটার জন্যে তো? আর কলেজের কথা বলছিস, যখন ওই ছেলেটার সঙ্গে রেজিষ্ট্রি করতে যাচ্ছিলিস, তখন পড়াশুনার কথা মনে ছিলো না?

সুপর্ণা চিৎকার করে উঠলেন, অপর্ণাও গলা চড়াল,

রেজিষ্ট্রি করছিলাম, বিয়ে করে চলে যেতাম না! পড়াশুনা করে চাকরির চেষ্টাই করতাম!

সুপর্ণা মেয়ের চিৎকারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,

এক থাপ্পড় মারবো! এতো কিছুর পরেও আবার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় কোন সাহসে? চাকরির চেষ্টা করবো তো কর না! বিয়ের পরে যত খুশি পড়, চাকরি কর! আমি কিছু বলতে যাবো না! আমার ঘাড়ে বসে কেনো?

রমেন বাবু জড়ানো গলায় স্ত্রী কে থামাতে চেষ্টা করলেন,

ঘাড়ে বসে বলছো কেনো? ও আমার মেয়ে, ওর পড়াশুনা করার দায়িত্ব তো আমারই! থাক না! ওর ইচ্ছে যখন পড়ুক আরো, বিয়ে পরে দেবো!

সুপর্ণা স্বামীর দিকে ঘুরলেন, আঙুল তুলে বললেন,

চুপ করো! ওই মেয়ের জন্যে আজ আমাদের এরকম অবস্থা! সবাই সেই কথাই বলছে, তোমার লাই পেয়ে পেয়েই ও এই রকম মাথায় চড়ে বসেছে! দাও আরো স্বাধীনতা! অনেক সহ্য করেছি আমি আর নয়! তোমার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? তোমরা বাপ বেটি তো কারো সঙ্গে কথা বলো না, তোমাদের আর কি? আমাকে পাড়ায় বেরোতে হয়, আমি আর সহ্য করতে পারছি না! অনেক জ্বালিয়েছে ওই মেয়ে আমাকে, আর একটা কথাও তুমি বলবে না, আর বললেও আমি শুনবো না!

অপর্ণা গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,

যদি জোর করে আমাকে বিয়ে দাও, তাহলে আমি বিষ খাবো!

সুপর্ণা পর্দা তুলে বেরিয়ে যেতে যেতে মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকালেন,

ওসব হুমকি ভুলেও আমাকে দিতে আসিস না, আমি তোর বাবা নই যে তোর ওই হুমকি তে ভয় পাবো! কোনোদিনও ভেবেছিস ওই স্বপন যদি তোকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়, তাহলে এমনিতেই আমাদের সবাইকেই বিষ খেয়েই মরতে হবে কিনা! তার চেয়ে ভালো আগেই মর তুই! মরলে আমারও হাড় জুড়ায়! সারাদিন আর দুনিয়ার লোকের কথার খোঁটা সহ্য হচ্ছে না!

মা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই অপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেলো, বাবা তাকে থামানোর চেষ্টা করলেও সে দাঁড়ালো না! সে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে সুপর্ণা স্বামীর জন্যে চা করে ঘরে এসে ঢুকলেন, তাঁকে দেখেই রমেন বাবু উত্তেজিত হয়ে জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠলেন,

আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও তুমি! চা চাইনা আমার! খাবো না তোমার হাতের চা! মেয়েটা এতো কষ্ট পাচ্ছে, মা হয়ে তুমি বুঝতে পারছো না? জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? পারবে ও আর একটা ছেলে কে সমরের জায়গায় বসাতে? মানুষের মন বলে একটা বস্তু হয় জানো সেটা? তুমি জানবে কি করে, মেয়ের কষ্টটা তো কখনো ওর মতো করে ভাবো নি আজ পর্যন্ত!

সুপর্ণা দাঁত দিয়ে তলার ঠোঁট কামড়ে ধরলেন, অপমানে তাঁর চোখেও জল আসছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে কাপ হাতে বেরিয়ে যেতে যেতেও ঘুরে তাকালেন স্বামীর দিকে,

আমি জানবো কি করে, আমি তো ওর নিজের মা নই! যতো ভালোবাসা তো তোমারই আছে, তাই তো দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো একটা অজানা অচেনা ছেলের সঙ্গে আমাকে লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিলে! এই তোমার বাস্তব বুদ্ধি! এই নিয়ে তুমি চাকরি করো! এতো বড়ো বড়ো কথা যে বলছো তা কিসের ভরসায়? এক কাপ চাও তো ভালো করে হাতে ধরে খেতে পারোনা এখনও! ওই গুন্ডা টা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেলে আটকাতে পারবে তো? আমি না হয় খুব খারাপ মা, তোমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলে তোমরা বাপ বেটিতে শান্তি পাওয়া জানি, কিন্তু সরে গেলে কে যোগাবে তোমাদের মুখের সামনে খাবার? এই তো দুদিন আগেও বিছানায় উঠে বসতে গেলেও ধরতে হচ্ছিলো, তখন তো কই বলোনি যে তুমি দূর হয়ে যাও, আমি একাই পারবো! এখন আমার দরকার ফুরিয়েছে তাই না? ভালো কথা, থাকো তোমরা দুজনে নিজেদের মতো, আমি চলে গেলে তোমাদের সুবিধাই হবে! শুধু দেখো মেয়েটা কে আমার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে স্বপনের হাতে মরতে হয়না যেনো! আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে কিন্তু আমিও তোমাকে ছাড়বো না! মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩
রসুলপুরে ফিরেও প্রায় দিন সাতেক ধরে ঘরেই বসেছিলো অপর্ণা, নতুন করে কলেজে যাওয়া, পড়তে বসা কোনো কিছুতেই কেনো উৎসাহ পাচ্ছিলো না। একে সমরের জন্যে মন খারাপ তার ওপরে ওকে নিয়ে বাবা, মায়ের মধ্যে অশান্তি সব কিছু মিলিয়ে বড্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিলো মনটা। খানিকটা সেসব থেকে জোর করে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় আজ প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে কলেজে বেরোলো অপর্ণা।

ওদের বাড়ির ঠিক তিনটে কোয়ার্টার পরেই সৃজার বাড়ি, ওর বাবাও রেলে চাকরি করেন। ওদের বাড়ির সামনে এসে সবে সৃজা কে ডাকতে যাচ্ছিলো তার আগেই সৃজা জানলা দিয়ে ভীত মুখে উঁকি দিলো, চাপা গলায় বললো,

দাঁড়া, আসছি!

সৃজা ব্যাগ কাঁধে দৌড়ে বেরিয়ে এলো, পেছন পেছন ওর মা, অপর্ণা কে দেখতেই তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেলো, গম্ভীর গলায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

সোজা কলেজে যাবি আর বাড়ি ফিরবি, কোথাও একটুও দেরি হয় না যেনো,এই বলে দিলাম!

অপর্ণা অস্বস্তিতে পড়লো, তাকে দেখেই যে কাকিমা বিরক্ত হয়েছেন সেটা বুঝতে তার একটুও অসুবিধা হচ্ছিলো না। সৃজা ঘাড় নেড়ে হাঁটতে শুরু করলো, পেছন পেছন অপর্ণা। কিছুটা যাবার পরে রাস্তাটা যেখানে স্টেশনের দিকে ঘুরেছে সেখানে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো সৃজা, মা কে আর দেখা যাচ্ছে না দেখে সে মুখ খুললো,

তুই সমরের সঙ্গে রেজিষ্ট্রি করে ফেলেছিলি নাকি? আমাকেও বলিস নি তো?

অপর্ণা চমকে তাকালো,

না তো! তোকে এসব উল্টোপাল্টা কথা কে বললো?

সৃজা ঘাড় নাড়লো,

তাই বল! আমি ভাবলাম এত বড় কথাটা আমি জানতে পারলাম না! দত্ত জ্যেঠুর বউ এমন অদ্ভুত না! গোটা পাড়ায় বলছে এসব! কদিন আগে নাকি বিকেলে কাকিমা তোকে মারছিলেন এসব বলে? কি বলতে কি শোনে কে জানে!

দত্ত জ্যেঠিমা! অপর্ণার খুব খারাপ লাগছিলো। ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টের যতীন দত্ত ঠিক অপর্ণাদের লাগোয়া কোয়ার্টারে থাকেন, বাড়িতে মা না থাকলে, অপর্ণা ওনার কাছ থেকেই ঘরের চাবি নেয়! রান্না করতে গিয়ে তেল মসলা কম পড়লে, চা পাতা, চিনির দরকার হলে দু বাড়ির গিন্নীই নিজেদের রান্না ঘর থেকেই জিনিস চেয়ে পাশের বাড়ির গিন্নীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করেন। সেই মানুষ কিনা অপর্ণার নামে এসব কথা বলছেন! অপর্ণা বুঝতে পারছিলো সেদিনের বিকেলের ওদের বাড়ির অশান্তি তার মানে অনেকটাই জ্যেঠিমার কানে এসেছিলো, সেটাকেই উনি নিজের মতো করে পাড়ায় ভাসিয়ে দিয়েছেন!

অপর্ণা কে অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটতে দেখে সৃজা তাকালো,

শোন না! একটা কথা বলবো, রাগ করবি না তো?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! বল!

কাল থেকে না তুই সরাসরি স্টেশনে চলে আসিস, আমি ট্রেনে উঠে তোর সঙ্গে কথা বলবো! মা আসলে খুব রাগারাগি করছে, বলছে তোর সঙ্গে কম মেলামেশা করতে! আমাকে বাড়ির সামনে ডাকতে আসিস না!

সেদিন বিকেলে বলা মায়ের কথা গুলো মনে পড়ছিলো অপর্ণার, সত্যি ও জানতেই পারে নি কতো কিছু ঘটে গেছে ওর অগোচরে! মা বেচারা আর কতই বা সহ্য করবে! অপর্ণা চোখের কোনায় জমে ওঠা জল চেপে রেখে নিজেকে শক্ত করে বললো,

আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম, হতে পারে ট্রেনেও কেউ আমাদের এক সঙ্গে দেখে ফেললো! তখন তুই মিছিমিছি কাকিমার কাছে বকুনি খাবি! তার চেয়ে এবার থেকে আমরা আলাদাই যাবো, কোনো দরকার পড়লে তুই আমাকে না হয় ফোন করে নিস!

অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজা কে সামনের কামরা টা দেখিয়ে ইশারা করলো অপর্ণা,

তুই এটাতে ওঠ, আমি পরেরটায় উঠছি!

বেলা প্রায় দুটোর দিকে লাস্ট ক্লাসটা শেষ হওয়ার পরে আজ ইচ্ছাকৃতভাবেই সৃজার জন্যে অপেক্ষা না করে একাই বেরিয়ে পড়লো অপর্ণা। মাথা নিচু করে অন্য মনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে যখন সে প্রায় স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার ডাক ভেসে এলো,

অপর্ণা!

গলার স্বরে অপর্ণার বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠলো, স্বপন! অপর্ণা কোনো কথা না বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো, স্বপন দ্রুত পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো,

তোমার বাবা ভালো আছে?

অপর্ণা শক্ত মুখে ঘাড় নাড়লো,

হুঁ!

সমরের খবর শুনে খারাপ লাগলো, কিন্তু যা হয়েছে সবটাই ওর নিজের দোষেই! এর আগেও ওকে অনেকবার বলেছিলাম অতো টাকা পকেটে নিয়ে না ঘুরতে, কিন্তু ও কানে তোলেনি! যাইহোক, কি আর করা যাবে, যার কপালে যা লেখা থাকে!

স্বপনের কথায় অপর্ণা চোয়াল শক্ত করলো,

তুমি জানলে কি করে ওর পকেটে টাকা থাকতো? কপাল বলে কিছু হয়না, এটুকু মনে রেখো, আজ না হয় কাল খুনি ধরা পড়বেই! পুলিশ যদি নাও ধরতে চায় তাও আমি ধরাবোই!

যে যাওয়ার সে গেছে, মিছিমিছি ওসবের পেছনে সময় নষ্ট না করে নিজের কথা ভাবো! আজ তোমার সঙ্গে বন্ধু নেই কেনো? শুনলাম তোমাদের কলোনীতে নাকি তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে? কারা করছে এসব? নামগুলো একটু বোলো তো আমাকে!

অপর্ণা স্বপনের দিকে কড়া চোখে তাকালো,

আমি নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারি, অন্য কারোর সাহায্য আমার প্রয়োজন হয়না!

স্বপন অপর্ণা কে পেছনে ফেলে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেলো, যেতে যেতে পেছন ফিরে বললো,

আমি কিন্তু তোমার যেকোনো দরকারে আছি! আজ না হয় কাল দরকার নিশ্চয়ই হবে, তখন ডেকো আমাকে! কলেজে একা একা যাও, আমার নম্বরটা রাখো।

অপর্ণা জোর পায়ে স্টেশনের দিকে পা চালালো,

নম্বর লাগবে না, আমি ছোটো বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাবো!

স্বপন অশ্লীল হেসে অপর্ণার আপাদমস্তক তাকালো,

বাচ্চা নয় বলেই তো বললাম, এই ফিগার নিয়ে একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করো, কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল!

বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এসে অপর্ণা দেখলো ওর মামা এসেছেন, ওকে দেখেই বললেন,

কালকের দিনটা আর কলেজ যাস না মা, কাল তোকে কলকাতা নিয়ে যাবো, ওখানে তোকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে।

অপর্ণা বাবার দিকে তাকালো, মা সঙ্গে সঙ্গে সামনে এগিয়ে এলো,

একদম বাবার দিকে তাকাবি না! বাবার কোনো কথাও আমি শুনবো না আর! ছেলে ভালো, পরিবার ভালো আর কোনো কিছু ভাববো না আমি!

অপর্ণা আর কোনো কথা না বলে ছাদে উঠে এলো। ছাদ টা ওর খুব প্রিয়, অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো সবুজ দেখতে ওর খুব ভালো লাগে, এখানে এলেই ইদানিং বড্ড সমরের কথা মনে পড়ে ওর। কতো কিছু ভেবেছিলো ও, সমর ওকে কতো স্বপ্ন দেখিয়েছিল, ছোট্ট একটা বাড়ি, একটা সাজানো সংসার, সব কেমন এক লহমায় ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো। ছেলেটার ওপরে একটা অদ্ভুত মায়া পড়ে গিয়েছিলো, যবে থেকে শুনেছিলো ওর বাবা মা ছোটো বয়সে মারা গিয়েছে তবে থেকেই ওর জন্যে একটা খারাপ লাগা তৈরি হয়েছিলো।

মাঝে মাঝেই বাবার জন্যে নিয়ে যাওয়া খাবারের সঙ্গে মাকে লুকিয়ে সমরের জন্যে খাবার নিতো অপর্ণা, চোখ বন্ধ করে যখন আঙুল চেটে চেটে খেত ও, অপর্ণার চোখে জল আসতো। খাওয়া শেষ করে সমর চোখ খুলে তাকাতো, হেসে বলতো,

বাড়ির খাবারের স্বাদই আলাদা! এতে হাতের ছোঁয়া লেগে থাকে! মেসের খাবারের স্বাদ কি আর কখনো একে টেক্কা দিতে পারে!

অপর্ণা জলভরা চোখে সমরের দিকে তাকাতো,

আর কদিন অপেক্ষা করো, আমি একটা চাকরি পেয়ে নিই তারপরে তোমাকে প্রতিদিন বাড়ির খাওয়ার খাওয়াবো!

সমর হাসতো,

তুমি চাকরি পেলে আমি ব্যবসা ছেড়ে দেবো, বড্ড খাটনির কাজ! কলকাতা থেকে দুটো ট্রেন পাল্টে আসতে খুব কষ্ট হয়!

অপর্ণার কষ্ট হতো,

কাছাকাছির মধ্যে কোথাও করতে পারো তো! এতদূরে আসো কেনো?

সমর অপর্ণার চোখের দিকে তাকাতো,

তোমার জন্যে! এখন আমার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেছে অপর্ণা, এখন এতো দূরে না এলেও চলে! কিন্তু তোমার জন্যে তো না এসে থাকতে পারিনা! তুমি যখন আমার কাছে চলে যাবে তখন আর এতো দূরে আসবো না!

একা এই ভর সন্ধ্যেবেলায় এলোচুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস! কতোবার তোকে বারণ করেছি! মায়ের একটা কথাও কি শুনতে নেই!

অপর্ণা চমকে উঠে ফিরে তাকালো, মা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ও খেয়াল করেনি। বিরক্ত মুখে ও উত্তর দিলো,

সন্ধ্যেবেলায় এলোচুল আবার কি! তোমার যত অদ্ভুত অদ্ভুত কথা! তুমি এতো উল্টোপাল্টা জিনিসে বিশ্বাস করো কেনো!

সুপর্ণা রেগে গেলেন, মেয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,

সব ব্যাপারেই তোকে তর্ক করতেই হবে তাই না! চুলটা খোঁপা কর এক্ষুনি, না হলে ছাদ থেকে নেমে যা!

অপর্ণা বিরক্ত মুখে চুলে খোঁপা করতে করতে নিচু গলায় বললো,

তুমি কি একটুও আস্তে কথা বলতে পারো না! এতো চিৎকার করো কেনো? নিজের মতো করে যা মনে হবে তাই বলবে আর তার পরে সেগুলো পাড়ায় ছড়াবে!

সুপর্ণা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন,

ওমা! আমি আবার নিজের মতো কি বললাম! কি যে বলিস তার মাথা মুন্ডু নেই কিছু!

হ্যাঁ, তোমার কথার সব মানে আছে আর আমার কথার নেই! ওই যে সারাদিন দত্ত দি, দত্ত দি করো, জানো তোমার ঐ সাধের দিদি কি করেছে? সেদিন তুমি চিৎকার করে বলছিলে আমি রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছি, সেই কথা সবাই কে রটিয়ে বেরিয়েছে!

রাগের গলায় বললো অপর্ণা, সুপর্ণা গালে হাত দিলেন,

কি বলিস! দিগন্তর মা টা তো খুব বদ! ইস! এই একটু আগেই দুধ ফুরিয়ে গেছে বলে চেয়ে নিয়ে গেলো, আর তলে তলে আমারই সব্বনাশ করে বেড়াচ্ছে গো! এই জন্যেই বলি মা, চারিদিকে সত্তুর! কেউ কারো ভালো চায় না আজকাল! রাগ করিস না মা রে, তোর বিয়ে কি আর সাধে দিয়ে দিতে চাই মা! একে বাবার এমন অবস্থা, কতদিনে পুরোপুরি সুস্থ হবেন কে জানে! তারপরে এরকম একটা বদনাম রটে গেলো! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ওই স্বপন নামের গুন্ডা টা! আমি একা মানুষ কোন দিকে দেখি বলতো!

অপর্ণা মায়ের দিকে তাকালো, এই মুহূর্তে ওর সত্যিই মায়ের জন্যে কষ্ট হচ্ছিলো। সকালের স্বপনের কথাগুলো মনে হচ্ছিলো, সত্যিই কি নিজের জেদে অটল থাকা ওর পক্ষে সম্ভব এই মুহূর্তে! স্বপন যদি সত্যি ওর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে কি ও তার মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে আদৌ! কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ও মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে নিচু গলায় বললো,

ঠিক আছে মা, তুমি যা চাও তাই হবে, আমি বিয়েতে রাজি আছি! শুধু একটা কথা তুমি কিন্তু ওদের কাছে সমরের কথা লুকিয়ে যেওনা প্লিজ! পরে কখনো জানাজানি হলে খুব সমস্যা হবে!

সুপর্ণা বিরক্ত মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় হাতের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন,

বেশি সৎ তুই! যে বেঁচেই নেই তার কথা আবার সবাই কে ফলাও করে বলারই বা কি আছে! একদম মুখ খুলবি না বলে দিলাম, পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলবো!

মা নিচে চলে যাবার পরে অপর্ণা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা টানাপোড়েন হচ্ছে, জেনেশুনে একটা ভদ্র ছেলে কে ঠকাবে ও! ও তো এই মুহূর্তে সমরের জায়গায় কাউকে বসাতে পারবে না, কি করে ও অন্য কাউকে ভালোবাসবে এই মুহূর্তে! জোর করে বিয়ে হতে পারে কিন্তু ভালোবাসা তো হয়না! অথচ সেই ছেলেটার দোষই বা কি! রাতের তারা ভরা নিস্তব্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলো অপর্ণা, কে জানে ওর কপালে কি লেখা আছে! অথচ অন্য সবার মতো ওর জীবনও তো সুন্দর হতে পারতো! পৃথিবীতে কতো মানুষ আছে, কিন্তু ওর সঙ্গেই এরকম হলো কেনো!
ক্রমশ