ঘষা কাঁচের দেয়াল পর্ব-৪+৫+৬

0
208

#ঘষা কাঁচের দেয়াল
#পর্ব ৪
ছোটো থেকে নিস্তরঙ্গ মফস্বলে কাটানো অপর্ণার কাছে কলকাতা এক ভয়ঙ্কর জায়গা, হাওড়া স্টেশনে নামার পর থেকেই বিরক্ত লাগছিলো ওর। ভিড়, ট্রাফিক জ্যাম, ক্রমাগত গাড়ির হর্নের আওয়াজ কাটিয়ে যখন ওরা মামার বাড়িতে পৌঁছালো ততোক্ষনে দুপুর গড়িয়ে গেছে। মামার বাড়িতে মামীমা বাণী এবং ছোটো একটা ভাই আছে অপর্ণার, সে ছোটো থেকেই দিদির খুব ন্যাওটা।

কদিন আগেই অপর্ণা মাকে নিয়ে টানা প্রায় মাস তিনেক মামার বাড়িতে ছিলো, মোটামুটি মামার অফিস থাকায় মা আর মামীমাই যাতায়াত করতো হাসপাতালে, অপর্ণা ভাই কে নিয়ে বাড়িতে থাকতো, দুই ভাই বোনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। দরজায় বেলের আওয়াজে অপর্ণার মামী দৌড়ে এলো, ট্রেন জার্নিতে ক্লান্ত অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

ইসস! কি চেহারা হয়েছে! বলেছিলাম তোর মামাকে, একদিন আগে নিয়ে আসতে! দিনের দিন কেউ এতদূরে মেয়ে আনে! তোর মামা কখনো আমার কথা শোনে না! যা, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে, খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়, ওদের আসতে এখনও খানিক দেরি আছে, চেহারাটা একটু ঠিক হবে ঘুমালে!

অপর্ণা ম্লান হাসলো,

আমি ঠিক আছি মাইমা, তুমি অতো চিন্তা কোরো না! একটু শুয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে!

একটু শুতে শুতেই বিকেল হয়ে এলো, বাণী যখন চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো, তখন অপর্ণা জানলায় মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলো। বাণী তাকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো,

কিরে! একটুও ঘুমোস নি! চোখের তলায় তো কালি পড়ে গেছে!

অপর্ণা ম্লান হাসলো,

তার জন্যে কি ছেলে পক্ষ আমাকে পছন্দ করবে না? তাহলে সে এক রকম ভালোই হবে!

বাণী অপর্ণার পাশে বসে পড়লো, মাথায় হাত রেখে বললো,

তোর একটুও ইচ্ছে নেই, তাই না? বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থাটা! কিন্তু দিদির দিকটাও একটু ভেবে দ্যাখ! বেচারা চারিদিক থেকে এতো চাপে আছে যে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না!

অপর্ণা চাদরের ওপরে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললো,

জানি সব, তাই তো রাজি হয়েছি! কিন্তু মা আমাকে সমরের কথা ওদের কাছে লুকিয়ে রাখতে বলছে, আমার মন সেটাতে সায় দিচ্ছে না মাইমা! একটা সম্পর্কের শুরুই কি মিথ্যে দিয়ে হবে! পরে যদি কখনো জানতে পারে ওরা, তখন তো আরো বেশি খারাপ হবে তাই না? একটা মিথ্যে ঢাকতে গিয়ে আরো কতো মিথ্যে হয়তো বলতে হবে তখন!

বাণী চিন্তিত হলো,

এই কথাগুলো আমিও বলেছিলাম তোর মামাকে, আগের দু টো পাত্রের বাড়িতে বলেছিলো তোর মামা, কিন্তু ওরা শুনেই পিছিয়ে যাচ্ছে! সবাই সত্যি শুনতে পছন্দ করে না রে, সত্যি বললে আরো অবিশ্বাস করে! আর এটা তো দিদি ঠিকই বলেছে সমর তো আর বেঁচে নেই, তাই ওর সঙ্গে তোর কি সম্পর্ক ছিলো সেটা অন্য কে বলাটা কি খুব জরুরি বল!

অপর্ণা মুখ নিচু করে জলভরা চোখে বললো,

কিন্তু যদি পরে ওরা জানতে পারে তাহলে? আমাদের ওখানে তো সবাই সব কিছু জানে!

বাণী একটু ভাবলো,

আচ্ছা, ঠিক আছে, বাড়িতে বলার দরকার নেই তবে ছেলে তো তোর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবেই, তখন সেরকম হলে তুই নাহয় ছেলেকে বুঝিয়ে বলিস! তবে দিদি কে এসব কিছু বলার দরকার নেই, মিছিমিছি টেনশন করবে!

ওদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যেই অপর্ণার মামা ঘরে ঢুকলো, মামাকে দেখেই অপর্ণা খাটের পাশে হাত দেখালো,

মামা, বসো এখানে! আমার কিছু কথা আছে!

মামা বসতে বসতে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ভাগ্নির দিকে তাকালেন, অপর্ণা হাসলো,

ভয় নেই তোমার, বিয়ে না করার কথা বলবো না, অন্য কথা বলবো বলে তোমাকে বসতে বললাম! আমি কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ করবো না, এই কথাটুকু তোমাকে বলে নিতে হবে কিন্তু!

মামা মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে! দেখছি সেটা। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে নেবো।

না মামা, দেখছি নয়! আমি কিন্ত ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হবো, সে মা যতোই বলুক!

জোরের সঙ্গে বললো অপর্ণা, মামার ভঙ্গি দেখে সে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছিলো না।

আরে বাবা, বললাম তো ঠিক আছে! শিক্ষিত ছেলে, সবে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে, সেকি নিজেই চাইবে না তার বউ পড়াশুনা করুক! তুই অতো ভাবিস না তো! আগে পছন্দ হোক, কথা বার্তা এগোক, তারপরে তো এসব কথা!

মামার এই কথার পরে অপর্ণা আর কথা বাড়ালো না, মনে মনে ভেবে রাখলো যদি মামা পিছিয়ে যায় ও নিজেই বলবে কথাগুলো। একটু সন্ধ্যের দিকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এলো অপর্ণা কে, ছেলের বাবা, মা, দিদি এবং ছেলে। মামীমার পরিয়ে দেওয়া শাড়ি পরে প্রায় কাঠের পুতুলের মতো ছেলের বাবা, মাকে প্রণাম করে গিয়ে বসলো অপর্ণা, আড়চোখে লক্ষ্য করলো বাবা,মা দিদি সবার মুখেই বড্ড বেশি গাম্ভীর্যের ছাপ!

ছেলের বাবা উপস্থিত সবার সঙ্গে পরিচয়
করানোর পরে ছেলের দিকে ইশারা করলেন,

এই যে আমার ছোটো ছেলে, সৌমিক!

ছেলেটি এতক্ষনে মাথা তুলে একবার তাকিয়েই আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে অনেক্ষন ধরেই একমনে মাথা নিচু করে মোবাইল দেখতে ব্যস্ত ছিলো, আশেপাশে এতো মানুষজনের কথাবার্তাও তার মোবাইল দেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারছিলো না একটুও! ভদ্রলোকের কথা থেকে জানা গেলো ছেলের দাদা আছে বিবাহিত, কিন্তু সে বা তার বউ না আসায়, বাণী একটু কৌতুহলী হল, ছেলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনার বড়ো ছেলে, বৌমা কেউ এলো না?

উপস্থিত ছেলের বাড়ির সদস্যদের মুখে একটু অস্বস্তির ছায়া পড়লো, ছেলের দিদি তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,

আসলে ওরা দুজনেই চাকরি করে তো, তাই আসা সম্ভব হয়নি! বিয়ে ঠিক হলে তখন একবার আসবে নিশ্চয়ই!

সাধারণ কিছু কথাবার্তা হলো, বেশিরভাগটাই ছেলের মা এবং দিদি বলল, তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে এটুকু বোঝা গেলো যে অপর্ণা কে তাঁদের পছন্দ হয়েছে! স্ত্রী এবং মেয়ে কথা শেষ করার পরে ভদ্রলোক মুখ খুললেন,

দেখুন আমাদের শুধু একটাই কথা, আমরা বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে চাই! সম্ভব হলে সামনের মাসেই! তবে মেয়ের মা, বাবা তো আসেন নি, তাই সেটা সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছি না! ওটা জানতে পারলে আমাদের সুবিধা হতো!

অপর্ণার মামা তাড়াতাড়ি হাত জোড় করলেন,

আপনাকে তো আমার জামাইবাবুর কথা বলেছিলাম, দিদি ওনাকে একা ছেড়ে আসতে পারে নি, তাই আমিই ওকে নিয়ে এলাম। তবে আমি দু একদিনের মধ্যেই দিদির সঙ্গে কথা বলে আপনাদের সবটা জানাবো, আশাকরি খুব বেশি অসুবিধা হবে না। তবে ওর তো সামনেই পরীক্ষা, ওই টুকু সময় যদি দিতেন!

ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন,

সময় দিতে পারবো না কিন্তু, ওইটুকুই আমাদের শর্ত, সেটা আপনারা ভেবে দেখুন! ঠিক আছে! আমরা এখন উঠি তাহলে!

অপর্ণা অবাক হয়ে মামার দিকে তাকালো, দেখলো মামীমাও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, স্ত্রীর ইশারায় এবার মামা সামনে এগিয়ে একটু নিচু গলায় বললেন,

একটা অনুরোধ ছিলো, আমার ভাগ্নি কিন্তু পড়াশোনায় ভালো বরাবরই, কিন্তু জামাই বাবুর শরীরের জন্যে দিদি আর দেরি করতে চাইছে না! ও কিন্তু পড়াশোনাটা নিয়ে আরো এগোতে চায় এই আর কি! এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত জানতে পারলে একটু সুবিধা হতো!

ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী তড়িঘড়ি কথা বললেন,

হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়াশুনা করুক না, ভালোই তো! বিয়ের পরে পড়াশুনাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই! পরীক্ষা ইচ্ছে হলে ও বিয়ের পরেও তো দিতেই পারে!

অপর্ণার মামা হাত জোড় করলেন,

যাক! নিশ্চিন্ত! আসলে আমার ভাগ্নি পড়তে খুব ভালোবাসে, কিন্তু এমন সমস্যা এলো, যে কোনো উপায় থাকলো না! তা ওরা একটু নিজেরা কথা বলবে তো?

ভদ্রমহিলা হটাৎ উঠে দাঁড়ালেন, দেখাদেখি তাঁর স্বামীও,

একসঙ্গেই তো কাটাবে সারাজীবন, তখন অনেক কথা হবে! এই মুহূর্তে আর আলাদা করে কি কথা বলবে!

অপর্ণার মামা একটু থতমত খেলেন, তাঁকে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবার বাণী নিজেই এগিয়ে এলো,

একটা কথা বলার ছিলো, প্লিজ কিছু মনে করবেন না! ছেলে তো একটাও কথা বললো না, ওর মতামতটাও জানতে পারলে ভালো লাগতো একটু! আপনাদের আপত্তি না থাকলে ওরা একটু নিজেরা কথা বলে নিলে ভালো হতো! যতোই বিয়ের পরে কথা বলার সুযোগ থাকুক, তবুও আজকালকার ছেলে মেয়ে, ওদেরও তো নিজস্ব মতামত থাকে কিছু!

আমার ভাই একটু লাজুক ধরনের, ও বোধহয় একা কথা বলতে চাইবে না! বললেও আমাকে সঙ্গে থাকতে হবে! শুধু ও নয় ওরা দুই ভাইই তাই! এই যে দেখুন না কতো করে বললাম, তাও আমাদের সঙ্গে আমার বড়ো ভাই এখানে এলো না!

বাবা, মা কিছু বলার আগেই তাড়াতাড়ি ছেলের দিদি বলে উঠলো, অপর্ণা লক্ষ্য করলো ওখানে বসে থাকা ছেলের বাবা মায়ের মুখে যেনো স্বস্তির ছাপ পড়লো। অপর্ণা মামিমার মুখের দিকে তাকালো, ও ভেবেছিলো আর কাউকে না হোক সমরের কথাটা ছেলেটাকে জানাবে, কোনো মিথ্যে দিয়ে ও নতুন জীবন শুরু করতে চায়না! কিন্তু ছেলেটা যদি আলাদা কথা বলতেই না চায় তাহলে কি করবে ও! অপর্ণার অন্য মনস্ক ভাবনার মধ্যেই সবাইকে চমকে দিয়ে ছেলেটা হটাৎ উঠে দাঁড়ালো, মামার দিকে তাকিয়ে বললো,

চলুন! কোথায় গিয়ে কথা বলা যাবে?

পলকে ওখানে উপস্থিত ছেলের বাড়ির লোকেদের মুখে কেমন যেনো ভয়ের ছায়া পড়লো, ছেলের দিদি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো, মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে বললো,

ওমা! তুই কথা বলতে রাজি আছিস! যাক, নিশ্চিন্ত হলাম, ওনারা ভাবছিলেন আমরা তোকে কথা বলতে দিতে চাই না! চল, আমি সঙ্গে যাচ্ছি!

অপর্ণা ওর মামা এবং মামীমা সবাই একটু অবাক হলো, উনিও সঙ্গে যাবেন! তাহলে আর আলাদা কথা বলার মানে কি! বাণী বরাবরের স্পষ্টবাদী, সে ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছেলের গম্ভীর গলা শোনা গেলো, সে দিদিকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,

তুই বোধহয় বুঝতে পারলি না উনি ঠিক কি বলেছেন! উনি আমাকে ওনার ভাগ্নির সঙ্গে কথা বলার জন্যে ডেকেছেন, তোকে নয়!

দিদি অপমানিত মুখে চেয়ারে বসে পড়লো, ছেলেটি সবাই কে উপেক্ষা করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে মামার দিকে তাকালো,

চলুন, কোথায় যেতে হবে?

মামার ইশারায় অপর্ণা শাড়ি সামলে ছেলেটির পেছন পেছন পাশের ঘরে উপস্থিত হলো, দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে মামা দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে চলে যাবার পরে ছেলেটি অপর্ণার দিকে সরাসরি তাকালো,

আমার কোনো কিছু জানার নেই, বলারও নেই! আপনার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন!

অপর্ণা মুখ তুলে তাকালো, নিচু গলায় বললো,

আমার কিছু বলার আছে! আমি একটি ছেলেকে ভালবাসতাম, সে এখন আর পৃথিবীতে নেই! বাবা যদি অসুস্থ না হতেন তাহলে আমি এই মুহূর্তে বিয়েতে রাজি হতাম না, আমার কিছু সময় দরকার নিজেকে সামলানোর জন্যে! বিয়ের পরে আমাকে একটু সময় দেবেন প্লিজ!

ছেলেটা কেমন যেনো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালো, খুব সাধারণ গলায় বললো,

ও আচ্ছা! ঠিক আছে, আর কিছু?

অপর্ণা অবাক হয়ে মাথা নাড়লো,

নাহ!

দুজনে মিলে যখন বসার ঘরে ফিরে এলো, তখন অপর্ণা লক্ষ্য করলো, ছেলের বাড়ির লোকজন উদগ্রীব হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, সবার মুখেই কেমন যেনো একটা অস্বস্তির ছায়া। ওদের ঢুকতে দেখেই দিদি উঠে দাঁড়ালো, ভাইয়ের খানিকক্ষন আগের করা অপমান সম্পূর্ন ভুলে গিয়ে বললো,

কি রে কথা বার্তা ঠিক মতো হলো তো? দুজনেই রাজি তো?

ছেলেটি দিদির কথার উত্তর না দিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে অপর্ণার মামার দিকে তাকালো,

আমার কোনো আপত্তি নেই, ওনার মতামত পরে জেনে নেবেন!

ছেলের বাড়ির লোকজন চলে গেলো, সব কিছু এতো সহজে মিটে গেলো যে অপর্ণার অবাক লাগছিলো। ছেলেটা ঠিক কি রকম! খারাপ না ভালো! হবু বউ অন্য কাউকে ভালোবাসতো, সময় চাইছে জেনেও মুখের কোনো পরিবর্তন হয়না যার সে কেমন মানুষ! ওরা কেনো চাইছিলো না ছেলে আলাদা কথা বলুক! অপর্ণা বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবছিলো! এমন তো নয় যে ছেলেটার কোনো মতামত নেই, নিজের মতামত তো স্পষ্ট করেই বলতে পারে! তাহলে? অপর্ণা না চাইলে তো কথাও বলতো না হয়ত! ওকে অন্য মনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে মামীমা এগিয়ে এলো, ওর পাশে বসে বললো,

কি এতো ভাবছিস! আমার তো বেশ লেগেছে ছেলেটা কে! বেশ মতামত দিতে পারে কিন্তু! আমার বরং প্রথমে ওকে কেমন যেনো লাগছিলো, মাথা নিচু করে বসে মোবাইল দেখছিলো যেনো ওর সঙ্গে এই বিয়ের কোনো সম্পর্কই নেই! তারপরে হটাৎ করেই বেশ স্পষ্ট করে কথা বলতে শুরু করলো, আমার এরকম মানুষ খুব পছন্দ! দিদি টাকে কিরকম দিলো দেখলি! আর ওই মহিলাই বা কিরকম যেনো! দুজন কথা বলবে তার মধ্যে তোর কি কাজ রে বাবা!

অপর্ণা অন্য মনস্ক হয়ে মাথা নাড়লো,

আমার ওদের বাড়ির সবাই কেই কেমন যেনো অদ্ভুত লাগলো মাইমা! সমরের কথা শুনেও ছেলেটার কোনো এক্সপ্রেশন হলো না জানো!

মামিমা ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

কিন্তু তোর মামা তো খবর নিয়েছে মোটামুটি, ছেলের ব্যাংকেও খবর নিয়েছে! কেউ খুব খারাপ কিছু ছেলের সম্বন্ধে বলে নি রে! তবে এটা ঠিক বড়ো ছেলে, বউয়ের সঙ্গে মনে হয় খুব বেশি সদ্ভাব নেই, কেমন প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলো দেখলি না!

ওরা আমাকে সত্যি পড়তে দেবে তো মাইমা?

বাণী হাসলো,

দূর বোকা! একবার কথা দিয়ে দিয়েছে, আর দেবে না তাই হয়! এতো সহজ নাকি!

কিন্তু ওরা তো পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছে না মাইমা! আমার খুব টেনশন হচ্ছে! মাত্র কদিন পরেই পরীক্ষা, বাবার জন্যে কতদিন নষ্ট হলো, আবার বিয়ের জন্যে হবে! মা একবারও আমার রেজাল্টের কথা ভাবছে না!

বাণী অপর্ণার পাশে এসে বসলো, ভাগ্নির মাথায় হাত রেখে বললো,

মায়ের দিকটা একটু ভেবে দ্যাখ বাবু, সেই বা কি করে! তোদের জায়গাটা তো কলকাতা নয় রে, দিদি কে সারাদিন কতো কথা শুনতে হচ্ছে! বাড়িতে অসুস্থ জামাইবাবু, পাড়ার লোকদের সমালোচনা, তারমধ্যে ওই বদমাইশ ছেলেটা! যদি তোর কোনো ক্ষতি করে দেয়! এইসব ভেবেই তো দিদি উঠে পড়ে লেগেছে বিয়ের জন্যে! তবে আমি জানি তুই খুব পরিশ্রমী, ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবি সবটা! রেজাল্ট ঠিক ভালো হবে তোর!

অপর্ণা মুখ ঢাকলো দুই হাতের চেটোতে,

জানিনা! আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না! আমার কি দোষ বলোতো! সব কিছু তো ঠিকঠাকই চলছিলো হটাৎ করে একসঙ্গে সব বদলে গেলো কি করে!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৫
ছেলে বা তার পরিবার সম্বন্ধে যেহেতু খারাপ কিছু জানতে পারা গেলো না এবং অপর্ণা দের সব কথাই তারা মোটামুটি মেনে নিলো তাই এই বিয়ে ঠিক হতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না। স্বামী খুব বেশি সুস্থ না হলেও পাছে ভালো ছেলে হাতছাড়া হয়ে যায় তাই একটু অসুবিধা সত্বেও সুপর্ণা পরের মাসেই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

ছেলের বাড়ি থেকে অতো দূরে গিয়ে বিয়ে দিতে আপত্তি থাকায় কলকাতায় মামার বাড়ি থেকে অপর্ণার বিয়ে দেওয়ার কথা স্থির হলো। সেদিক থেকে বলতে গেলে এই প্রস্তাবে সুপর্ণারও খুব বেশি আপত্তি ছিলো না কারণ পাড়া পড়শী দের থেকে তিনিও বরপক্ষ কে দূরেই রাখতে চাইছিলেন, পাছে কোনো ভাবে তাদের মুখ থেকে অপর্ণার অতীতের কাহিনী প্রকাশ্যে আসে!

অপর্ণা মায়ের সাথে রসূলপুর ফিরে এলো, সুপর্ণা বিয়ে প্রসঙ্গে প্রথম দিকে পাড়া পড়শীর সামনে একটাও কথা ভুলেও উচ্চারণ করলেন না, বিয়েতে কলকাতা চলে যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে দুপুরের গল্পের আসরে মেয়ের বিয়ের খবর দিলেন। হটাৎ করে এরকম খবরে সবাই অবাক হয়ে গেলো, সীমা বললেন,

সেকি গো অপর্ণার মা একেবারে শেষ সময়ে জানালে যে গো! যাকগে কি আর করা জানতে যে পারলাম সেই অনেক, বিয়ে দিয়ে এসে যে বলো নি তাই না কতো!

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি করে সীমার হাত ধরে নিলেন,

একা মানুষ বুঝতেই পারছো, সব দিক দেখতে গিয়ে আর খবর দেওয়া হয়নি তোমাদের! আর আমরা তো পরীক্ষার পরে দিতে চেয়েছিলাম, ছেলের বাড়ি বড্ড তাড়াহুড়ো করলো!

মলয়া ফুট কাটলেন,

যাকগে! হয়ে গিয়েছে সে এক রকম ভালোই হয়েছে! বেশি দেরি হলে আর ও মেয়েকে তুমি বিয়ে দিতে পারতে না অপর্ণার মা! বেশি লোক জানাজানি হবার আগেই যে পার করতে পারছো সেই শান্তি! তবে ছেলের বাড়িতে সব জানিয়েছ তো, নাহলে কিন্তু পরে ঝামেলায় পড়বে!

সুপর্ণা মাথা নাড়লেন,

জানানোর মতো কি আছে বলতো মনার মা? মেয়ে আমার কোন অপরাধ টা করেছে?

মনার মা উত্তেজিত হলো,

কি বলো অপর্ণার মা, তোমার মেয়ের খুঁত বলেই তো অতো বড়ো একটা জোয়ান ছেলে চলে গেলো! সেগুলো একটু বলে নিতে হবেনা, যদি তাদের ছেলের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তখন তোমাকে ছাড়বে তারা? কুষ্টি ভালো করে মিলিয়ে দেখেছো তো আগে, মিল রাজযোটক তো?

সুপর্ণা আর বিতর্কে গেলেন না, কথাটা শোনা ইস্তক তাঁর নিজের মনের মধ্যেও খচখচ করতে লাগলো, অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করলেন,

হ্যাঁ, মিলিয়ে দেখেছি, সব ঠিক আছে!

এতো কিছুর মধ্যেও সবার মনে একটা দুঃখ থেকেই গেলো, কেউ সশরীরে সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবে না! সবচেয়ে পাশের বাড়ির জ্যেঠিমা, মানে দিগন্তের মা শেষ পর্যন্ত আর চেপে রাখতে পারলেন না, সুপর্ণা কে উদ্দেশ্য করে গল্পের আসরে বসে বললেন,

এ তোমাদের কেমন ধারা বিচার অপর্ণার মা! নিজেদের বাড়ি থাকতে কেউ ভাইয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের বিয়ে দেয়! আমরা ভাবলুম মেয়ের বিয়েতে কতো আনন্দ করবো, তা সে তো আর ভাগ্যে নেই বুঝতেই পারছি! দিগন্ত কাল বলছিলো অপর্ণার বিয়ের খাওয়া আমাদের মিস হয়ে গেলো।

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন,

না গো দিদি, তাই কখনো হয়! তোমরা আমার আপনজন, তোমরা না থাকলে কি আজ উনি বেঁচে থাকতেন? তোমাদের না খাইয়ে বাদ দিই কি করে! তবে কি জানো ওনার শরীর তো ভালো নয়, আর কলকাতার ছেলে তারা এতদূরে আসতে রাজি নয় তাই এই ব্যবস্থা! তবে মেয়ে যখন অষ্টমঙ্গলায় আসবে তখন অবশ্যই তোমাদের সবাইকে ডেকে নতুন জামাই দেখাবো আর খাওয়াবো!

অপর্ণা ফিরে এসে আবার কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো, বিয়ের সময় হতে চলা ক্ষতি যতটা মেরামত আগাম করে রাখা যায় সে চেষ্টায় সে যে কদিন হাতে আছে সেই দিনগুলো একদিনের জন্যেও কলেজ কামাই করতে চাইছিলো না। প্রথম কদিন ঠিকঠাকই হলো, কিন্তু পাড়ার সবাই জানার পরে সুপর্ণা আপত্তি জানালেন,

খবরদার! এখন সবাই জেনে গেছে আর এক পাও বাড়ির বাইরে দিবি না বলে দিলাম! গোটা পাড়া তোর বিয়ের খবর জানে, আর ওই বদমাশ স্বপন কিছু জানে না ভাবিস নাকি! ওর মাথায় কি চলছে কে জানে! আগে ভালোয় ভালোয় কাজ মিটে যাক, তার পরে ফিরে এসে যত খুশি কলেজে যাস!

অপর্ণা রাগে বই পত্র ফেলে রেখে ছাদে উঠে গেলো, মায়ের আপত্তি যে খুব বেশি অমূলক নয় সে তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে! মনে মনে স্বপন কে সেও যথেষ্টই ভয় পায়, কিন্তু জেদটা তার বরাবরই বেশি তাই নিজের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে জেনেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারে না! কিছুক্ষন পরে সুপর্ণা ধীরে ধীরে পাশে এসে দাঁড়ালেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

রাগটা একটু কমাও! ওটা শ্বশুরবাড়ি ওখানে অতো রাগ কেউ সহ্য করবে না বুঝলে! যা পারছো মায়ের ওপর দিয়ে করে নাও এখন, আমি তো তোমার খারাপই চাই সব সময়!

অপর্ণা বিরক্ত হলো, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

তোমার তো সব কিছুতেই ভয়! স্বপন কে ভয়, পাড়ার লোক কে ভয়! এই ভয় ভয় করেই তো ওদের বাড়িতে সমরের কথাটা লুকিয়ে গেলে তুমি! কতো আর ভয় পাবে মা, কতো সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে রাখবে সব কিছু?

সুপর্ণা ঘাড় নাড়লেন, খানিকটা হতাশ গলায় বললেন,

কি করে বোঝাবো তোকে! তুই তো নিজেও সব বুঝিস! যার একটা শক্ত সমর্থ পাশে দাঁড়ানোর লোক নেই, সে কি করবে একা বল! সবাই শুধু সমালোচনা করতেই আছে, বিপদে পড়লে পাশে কজন এসে দাঁড়ায়? কোথাকার কোন ছেলে খুন হলো, দোষ পড়লো তোর ঘাড়ে এসে, তুই নাকি খারাপ মেয়ে! দোষ নাকি তোর কুষ্টির! এই তো চারদিকের লোকজন ওই মুখে শুধু লোক দেখানো ভাব, আসলে কেউ কারো ভালো চায় না!

বিয়ের দিন দশেক আগে রমেন রায় তাঁর পরিবার নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, যেহেতু তাঁর শরীর খারাপ এবং বিয়ে উপলক্ষ্যে মালপত্র অনেকটাই বেশি তাই পাড়ার দু একজন সঙ্গে করে কলকাতা পর্যন্ত যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সুপর্ণা রাজি হলেন না! মনে মনেই তাঁর বিশ্বাস ছিলো যে পাড়ার লোকজন মেয়ের বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করতে পারে!

শেষ পর্যন্ত অপর্ণার মামা সরোজ কলকাতা থেকে এসে অপর্ণাদের কলকাতায় নিয়ে গেলেন। স্বামী কে মেয়ের তত্বাবধানে রেখে সুপর্ণা ভাই, ভাই বউয়ের সঙ্গে বিয়ের জোগাড় যন্ত্রে মনোযোগ দিলেন। সব কিছু ঠিকঠাক এগিয়ে চললেও বিয়ের দুদিন আগে থেকে হটাৎ করেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। অগ্রহায়ণ মাসের বিয়েতে কেউই বর্ষণের আশা করেনি তাই দু পক্ষকেই বাঁধা ম্যারাপ খুলে, আবার নতুন করে সব কিছু বাঁধতে হলো, তাতে দুপক্ষরই বেশ খানিকটা খরচা বাড়লো।

অপর্ণার বিয়েতে যেনো দুর্যোগ পিছু ধাওয়া করলো, এমন বর্ষণ কলকাতা শহর অনেকদিন দেখেনি! বিয়ের দিন সকালে মোটামুটি গোটা কলকাতা জলের তলায় চলে গেলো, রাস্তা ঘাটে গাড়ি ঘোড়ার দেখা নেই, দু বাড়িতেই অর্ধেক নিমন্ত্রিত আসতে পারলেন না। প্রচুর খাওয়ার নষ্ট হবে দু বাড়িতেই, অপর্ণার মা এবং মামা হা হুতাশ করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত বর এবং বরযাত্রী কিভাবে পৌঁছাবে এই চিন্তায় মেয়ের বাড়ির লোকদের ঘুম উড়ে গেলো, একমাত্র ব্যতিক্রম অপর্ণা। এসব ঘটনা তাকে স্পর্শও করছিলো না, সে খাটে বসে জানলার গ্রিলে মাথা রেখে কালো দুর্যোগে ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলো।

অবিরাম বর্ষণ সঙ্গে ঠান্ডা জলো হাওয়ার মধ্যেও সে রসুলপুরের পুরনো দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছিলো, যেখানে সমর তার জীবনে জড়িয়ে ছিলো। আর আজকের দিনটা, এর পরে সে কি সমর কে নিয়ে ভাবনার সময় আর পাবে কখনো! আজ পর্যন্ত তো তবু সেই স্বাধীনতা টুকু তার আছে যেখানে সমর ছাড়া আর কারো জায়গা নেই! কিন্তু কালকের পর থেকে কোনো এক সদ্য চেনা ছেলেকে তাকে সমরের জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে সারাজীবনের মতো! এতো সহজ সব কিছু! বাইরে থাকা আসা বৃষ্টির জলের সঙ্গে চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা জল মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিলো অপর্ণার। একটা ছবিও ও সমরের কখনো রাখেনি মায়ের জেনে যাওয়ার ভয়ে, মনের মধ্যের আঁকা ছবিটাও কি মুছে যাবে এর পরে! চোখ বন্ধ করে সমরের মুখটা মনের মধ্যে বসিয়ে নিচ্ছিল অপর্ণা, এখান থেকে কেউ কখনো জোর করেও মুছে দিতে পারবে না সমর কে!

কি করছিস! এই ঠান্ডায়, বৃষ্টির মধ্যে কেউ জানলা খুলে বসে থাকে! ছি ছি! তুই কি কখনো একটু শান্তি দিবিনা আমাকে! তোর আর কি! অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তো আমাকেই কথা শুনতে হবে তোর স্বশুর বাড়িতে!

নিজের চিন্তার জাল কাটিয়ে কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো অপর্ণা, মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে থতমত খেলো, কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই মামীমা অন্য দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো, হাত বাড়িয়ে জানলা বন্ধ করতে করতে বললো,

সত্যি খুব ঠাণ্ডা রে! দিদি ঠিকই বলেছেন, যা মাথা, মুখটা মুছে নে ভালো করে নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বি! আর শোন শাড়িটা বদলে নে, একটু পরেই হলুদের তত্ব নিয়ে আসবে ছেলের বাড়ির থেকে, পুরোহিত মশাইও এসে পড়েছেন।

সুপর্ণা ভাই বউয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন,

পুরোহিত মশাই তো এসে গেলেন, কিন্তু ছেলের বাড়ির লোকের কি হবে বাণী? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে!

বাণী মাথা নাড়লো,

ওতো চিন্তা কোরো না দিদি, তোমার ভাই দেখছে তো! আর তাছাড়া ওদেরও তো দায়িত্ব আছে নাকি? ঠিক এসে পড়বে সময় মতো।

বেশ খানিকটা বেলার দিকে জল কিছুটা কমলে অপর্ণার শ্বশুর বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে শ্বশুর মশাই, মাসি শাশুড়ি এবং ছেলের দিদি এলো, তাদের দেখে সুপর্ণা হাঁফ ছাড়লেন।

বাবা! কি দুর্যোগ! কি দুর্যোগ! কলকাতায় তো কম দিন বাস করছি নে, এরম বৃষ্টি তো বাপের জন্মে দেখিনি বাপু! মেয়ের বর্ষা লগ্নে জন্ম নাকি?

বলতে বলতে এগিয়ে দেওয়া মিষ্টির প্লেট হাতে চেয়ারে বসলেন মাসি শাশুড়ি, পাশে শ্বশুর মশাই গম্ভীর মুখে বসে থাকলেও, ছেলের দিদি মুচকি হাসলো।

সুপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লেন, তাড়াতাড়ি জোর করে মুখে হাসি টেনে বললেন,

না না, বেয়ান, মেয়ে তো আমার বৈশাখে জন্মেছে! সে তখন ভরা গরম!

ছেলের দিদি রসগোল্লা মুখে তুলে বললো,

যাক তাও ভালো! আমি তো ভাবলাম এবার থেকে প্রতিবছর এই সময়ে বৃষ্টি হবে! এই সময়ে বৃষ্টি তো পাওয়া যায়না খুব একটা!

বাণী সামনে এগিয়ে এলো, দিদির হাত থেকে খালি প্লেট হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

তুমি খুব ভালো কথা বলোতো! এই দ্যাখো, এই নিয়ে তুমি দুবার আমাদের বাড়ি এলে তোমার নামটাই জানা হয়নি এখনও!

রত্না!

বাণী হাসলো,

বাহ বাহ বেশ নাম! তুমি সৌমিকের দিদি সেটা আমি জানি কিন্তু তোমার নামটা জানা ছিলো না! তা রত্না সৌমিকের জন্মের সময় বৃষ্টি হয়নি তো? তাহলেও কিন্তু এই সময় এবার থেকে প্রতিবছর বৃষ্টি হতে পারে!

উপস্থিত ছেলের বাড়ির লোকেরা একটু থতমত খেলো, সুপর্ণা আর তাঁর ভাইয়ের মধ্যে চোখাচোখি হলো, বাণীর এই কথাকে তাঁরা দুজনেই বেশ ভয় পান। বউ কে চুপ করাতে সরোজ তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এলো, ভাগ্নির হবু শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললো,

বেয়াই মশাই, এদিকে আসুন, জামাইবাবু এই ঘরে আছেন!

উনি উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুপর্ণা ভাই বউয়ের দিকে তাকালেন,

বাণী দেখো অপর্ণা তৈরি হয়েছে কিনা! ওর আশীর্বাদের ব্যবস্থা করো!

আশীর্বাদ পর্ব শেষে ছেলের বাড়ির লোকজন চলে গেলো, অপর্ণার গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হলো, আস্তে আস্তে বেলার দিকে জল অল্প অল্প করে নামতে শুরু করলো। রাতে যখন বিয়ে করতে ছেলে এবং তার বাড়ির লোকজন এসে পৌঁছালো তখন রাস্তার অবস্থা মোটামুটি ভালোই, ধীরে ধীরে সবাই না হলেও নিমন্ত্রিত লোকজনও কিছু কিছু করে পৌঁছাতে লাগলো।

একটু বেশি রাতের দিকে বিয়ে মিটে গেলে, বরযাত্রীরাও মোটামুটি বিদায় নিলো, থেকে গেলো শুধু সৌমিকের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রবি। কনে পক্ষের দিকেও বাসর জাগার মতো কেউ না থাকায় কিছুক্ষন পরেই অপর্ণা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেই চোখ বন্ধ করলো। সৌমিক তার বন্ধুর সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে লাগলো, অপর্ণার সঙ্গে বন্ধু কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো সভ্যতাও সে করলো না!

সকাল থেকে উপোস করে থাকা শরীর ক্রমশ ক্লান্ত লাগছিলো, এক সময়ে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো অপর্ণা বুঝতেও পারে নি। হটাৎ করেই মাঝ রাতে বেজে ওঠা সৌমিকের মোবাইলে চটকা ভেঙে তাকালো, ওদিকের কথা শুনতে না পেলেও এদিক থেকে সৌমিকের উত্তেজিত গলা কানে এলো,

সেকি! কখন? কিভাবে হলো? ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি আসছি!

অপর্ণা সোজা হয়ে উঠে বসলো, সৌমিক কি কোথাও চলে যাচ্ছে! আজকের রাতে ওকে একা ফেলে চলে যাবে!

অপর্ণার ভাবনার মধ্যেই সৌমিক নিজের গায়ে জড়ানো জোড় খুলে অপর্ণার পাশে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলো, কিছুক্ষন পরেই মামার চিন্তিত গলা কানে এলো,

সর্বনাশ! ঠিক আছে তোমরা বেরিয়ে পড় তাহলে! আমি ড্রাইভার কে ডাকছি, ও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে!

কথপোকথনের মধ্যেই মা ঢুকে এলো, হতবাক অপর্ণার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

যতো বিপদ কি তোরই হয় মা রে! শিগগির ওঠ! তোর শ্বশুর বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় পা পিছলে পড়ে গেছেন, মাথা ফেটে গেছে! সৌমিক এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে চাইছে, যে ভাবে আছিস সেভাবেই চলে যেতে বলছে তোকে!

অপর্ণা থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালো, বুকের মধ্যে ভয় চেপে বসছে, শ্বশুর মশাই সুস্থ হয়ে যাবেন তো! কোনো রকমে বিদায় পর্ব শেষ করে গাড়িতে বসলো অপর্ণা, অসুস্থ, ঘুমন্ত বাবার সঙ্গে যাওয়ার আগে দেখাও হলো না আর! গাড়িটা যখন গলির শেষে বড়ো রাস্তায় এসে পড়লো, দু চোখ ভরে জল এলো অপর্ণার, পাশে বসা যুবকটি তখন নির্বিকার মুখে উল্টোদিকের জানলার দিকে তাকিয়ে!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৬
দিদি আসেন, বরণটা করে নেন একটু, নিয়মটুকু তো মানতে লাগে নাকি?

ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসা মহিলার কথায় মাথায় লাল চেলি, লাল বেনারসিতে সজ্জিত অপর্ণা কোনো রকমে চেয়ার ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে এতক্ষন ধরে কোলে নিয়ে বসে থাকা জোড়ের সাদা কাপড় আর গায়ের শাল নিচে পড়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। মহিলার কথা শুনে রত্না বেরিয়ে এসেছিল কাপড় মাটিতে পড়তে দেখে মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক আওয়াজ করে বললো,

কি যে করো! এতবড়ো মেয়ে কাপড়টা একটু ঠিক করে ধরতে পারো না! একে দেখছো বাড়ির এই পরিস্থিতি এখন আবার তোমার পেছনে কে ঘুরবে?

অপর্ণার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, কিন্তু ওই বা কি করে, ইচ্ছা করে তো কিছু করে নি! সৌমিক বাড়িতে ঢুকেই ওকে নামিয়ে দিয়ে সেই গাড়িতেই তো বাবাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো, যাবার সময় গায়ের থেকে ওটা খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। তারপরে সেই থেকে সবাই ব্যস্ত, কারোর ওকে বরণ করার কথা মাথায় ছিলো না, ও শেষ পর্যন্ত ডেকোরেটরের রাখা চেয়ারগুলোর একটা টেনে নিয়ে বসেছিলো। এখন নিজের নাম শুনে উঠে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে এই অবস্থা!

অপর্ণার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই পিসি শাশুড়ি বরণ ডালা হাতে বেরিয়ে এলেন, এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

ঋজু কই, ডাকো তাকে। সে নাহলে বরণ করবো কি করে? দুজনকেই তো লাগবে!

রত্না কোনো উত্তর দিলোনা, পিসি শাশুড়ি নিজেই গলা তুললেন,

ঋজু! কোথায় গেলি?

অপর্ণা মনে মনেই একটু অবাক হচ্ছিলো, সৌমিক যখন বাবা কে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো, তখন পিসি শাশুড়ি ওখানে না থাকলেও রত্না এবং ওর শাশুড়ি ওখানে ছিলো, কিন্তু রত্না কে দেখে মনেই হচ্ছে না যে ও কিছু জানে! এতক্ষন চুপ করে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণা এবার মৃদু গলায় রত্নার উদ্দেশ্যে বললো,

দিদি! উনি তো বাবা কে নিয়ে হসপিটালে গেলেন তোমার সামনেই, তোমার মনে নেই?

ওমা! সেকি! ঋজু এই অবস্থায় হসপিটালে গেলো, কেনো ঋষি কি করছিলো? ও তো বাড়িতেই ছিলো, যেতে পারলো না! অদ্ভুত তো! আমি তো দোতলা থেকে নামতে নামতেই ওরা চলে গিয়েছে, যদি জানতাম আগে তাহলে কিছুতেই ঋজু কে আজকের দিনে যেতে দিতাম না!

রত্না একটু থতমত খেলো, পিসি শাশুড়ির চিৎকারের মধ্যেই চোখের জল মুছতে মুছতে শাশুড়ি বেরিয়ে এলেন, ননদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

মাঝ রাতে এতো হইচই কিসের, আমি ঋজু কে যেতে বলেছি তাই ও গেছে! তুমি তো জানো আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভরসা করতে পারি না!

পিসি শাশুড়ি কিছু বলার আগেই অন্য মহিলা বলে উঠলেন,

আসলে দিদি বরণ টুকু মিটে গেলে সমস্যা হতো না, ঋজু না আসা পর্যন্ত তো তাহলে ও ঘরেই ঢুকতে পারবে না!

অপর্ণার শাশুড়ি অপর্ণার দিকে তাকালেন, তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

ডালা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, যা পিসির হাত থেকে নিয়ে ঠাকুর ঘরে রেখে আয়! এসে ভাই কে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস কর ওর আর কতো সময় লাগবে!

রত্না ঠাকুর ঘরে চলে গেলো, এবার তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে ঘুরলেন,

তোমাকে কতো বার বলেছি মিনতি বাড়ির সব কথায় কথা বলবে না! বার বার তবু ভুলে যাও তুমি! তোমাকে যে কাজের জন্যে এখানে রাখা হয়েছে শুধু সেটুকুই ঠিক ভাবে করো!

মিনতির মুখ অপমানে কালো হয়ে গেলো, অপর্ণা এতক্ষনে খানিকটা ধারণা করলো মহিলা সম্ভবত এই বাড়িতে কাজ করেন। ইতিমধ্যে নিচের কথোপকথনের আওয়াজ ওপরেও শোনা যাচ্ছিলো, সেই আওয়াজে উপস্থিত নিমন্ত্রিত যাঁরা রাতে বাড়িতে ছিলেন, দু একজন নিচে নেমে এলেন, তাদের মধ্যেই মাসি শাশুড়ি সামনে এগিয়ে এলেন,

ঋজু এখনও ফেরেনি?

অপর্ণার শাশুড়ির তাকে দেখেই মুখে হাসি ফুটলো,

নারে মেজদি, ফেরেনি এখনও! ওই তো রত্নাকে ফোন করতে বললাম একবার! ওনার খবরও তো পাইনি এখনও, খুব চিন্তা হচ্ছে!

ভদ্রমহিলা বোনের দিকে তাকালেন,

এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো তুই রীনা, তোর শরীরও তো ভালো নয় তেমন। যা ঘরে যা ঋজু আসার আগে তো কিছু করার নেই এখন! ঋষির বউ কোথায় গেলো? একটু চা বসালে পারতো তো!

রত্না ততোক্ষনে ফিরে এসেছিলো, মাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,

কে চা বসাবে, ঋষির বউ? তাহলেই হয়েছে! পড়ে পড়ে ঘুম দিচ্ছে দেখো গিয়ে! বাবা যাওয়ার সময় নেমেছিলো সেই না কতো!

মহিলা ঘাড় নাড়লেন,

তা বটে! দেখি তাহলে আমিই বসাই গিয়ে নাহয়! হ্যাঁরে রীনা, তোর বড়ো ছেলে ছোটো ছেলের বউ কে দিলো কি, দুদিন ধরেই জিজ্ঞেস করবো ভাবছি, সে আর মনেই থাকছে না!

অপর্ণা মনে মনে একটু অবাক হলো, এই রকম পরিস্থিতির মধ্যে যে মাঝ রাতে উনি এসব আলোচনা শুরু করবেন সেটা ও একটুও ভাবতে পারে নি! মা কিছু বলার আগেই রত্না বিরক্ত মুখে ঘাড় নাড়লো,

আর মাসি! কি যে বলো তুমি! ভাইয়ের দেওয়ার মন থাকলে কি হবে, বউয়েরও তো থাকতে হবে নাকি! নিজের বেলায় এদিকে সব বোঝে, বাপের বাড়িতে তো নেমন্তন্নও করতে দিলো না, তাই মায়ের পয়সা আর খরচ করতে হলো না!

অপর্ণার মাসি শাশুড়ি গালে হাত দিলেন,

আসলে হাভাতে ঘরের মেয়ে তো, কি দেখে যে তোরা এনেছিলি কে জানে! কোনো কিছু দিতে হাত সরে না একদম!

রত্না হাত তুললো,

যা বলেছো! ছাড়ো এখন এসব! আমি বরং ভাইকে একটা ফোন করি, দেখি তার কদ্দুর কি হলো!

রত্না সৌমিক কে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, এতো কিছু কথার পরেও প্রশ্নের উত্তর কিন্তু জানা গেলো না! উল্টোদিকে সৌমিকের গম্ভীর গলা পাওয়া গেলো,

বাবা কে ভর্তি করেছি, আমি আর আমার বন্ধু আছি, ফিরতে দেরি হবে! ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যাবো, ডাক্তার অপেক্ষা করতে বলেছেন!

কিন্তু ভাই, তোদের তো বরণ হয়নি এখনও! অপর্ণা বাইরে বসে আছে, ঘরে ঢুকতে পারছে না!

সৌমিক কর্কশ গলায় জবাব দিলো,

তাহলে রজত দা কে বা দাদা কে পাঠিয়ে দে! কেউ না এলে তো আমি যেতে পারবো না!

রত্না ফোন কেটে দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো,

মা ভাই তো আসতে পারবে না! তাহলে অপর্ণা এখন এখানেই থাকুক, আর কি করা যাবে! রজত তো ঘুমাচ্ছে, ওকে ডাকা কি ঠিক হবে!

অপর্ণার শাশুড়ি মাথা নাড়লেন,

থাকুক! আর কি করবো! সব আমার কপালের দোষ, আজকের দিনেই এসব ঘটতে হলো! রজত ঘুমাক, ওকে ডাকতে হবে না! নিজের ছেলে থাকতে তো আর পরের ছেলে কে তার শ্বশুরের সেবায় পাঠাতে পারিনা! ঋজু এলেই সব হবে না হয়!

এক এক করে সবাই ভেতরে চলে যাওয়ার পরে অপর্ণা আবার চেয়ারে বসে পড়লো, নির্জন ঠান্ডার রাতে কাদায় মাখামাখি কাপড় নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করতে লাগলো সৌমিকের আসার। বরণ না হওয়া পর্যন্ত যে ওকে এখানে এই ভাবেই বসে থাকতে হবে বুঝতে পারছিলো ও। কিছুক্ষন বসে থাকার পরেই শীতে হাত, পা যেনো ঠান্ডা হয়ে আসছে, বুকের ভেতরে কাঁপুনি হচ্ছে, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে অপর্ণা কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না, এমন সময় ঘর থেকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে বেরিয়ে এলো।

মেয়েটি বয়সে অপর্ণার থেকে বছর চার পাঁচেকের বড়ো হবে, বিবাহিতা, এসেই অপর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড়ো কফি মগে করে এক কাপ গরম ধোঁয়া ওঠা কফি আর গায়ের একটা চাদর ওর দিকে এগিয়ে ধরলো,

গায়ে দাও এটা, তোমার শাল তো কাদায় নষ্ট হয়ে গেছে! আর কফিটা খাও দেখো ভালো লাগবে ঠান্ডায়!

অপর্ণা তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে চাদর টা টেনে নিয়ে মাথা, গা মুড়িয়ে ফেললো, দু হাতে মগ টা ধরে হাত দুটো কে গরম করতে করতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো,

সত্যি আরাম লাগছে! তুমি কে গো? তোমাকে কি বলে ডাকবো?

মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো,

আমি অনিন্দিতা, সৌমিক আমার দেওর! তুমি আমাকে দিদিভাই বলে ডাকতে পারো!

অপর্ণা এক মুহুর্ত চমকালো, এই তাহলে ওর জা, এর কথাই এতক্ষন ধরে আলোচনা হচ্ছিলো তাহলে! ওকে চমকে তাকাতে দেখে অনিন্দিতা হাসলো,

অবাক হলে, তাই না? আসলে আজ পর্যন্ত তো আমাদের দেখা হয়নি, তাই আলাপ করাও হয়নি! একই বাড়িতে থাকবো যখন আবার পরে কথা হবে নিশ্চয়ই! তুমি খাও আমি এখন আসি!

অনিন্দিতা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ও চেয়ারে বসে পড়লো, নতুন চাদর, হাতের গরম কফি ততোক্ষনে অনেকটাই গরম করে ফেলেছে শরীর, ধীরে ধীরে সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো, ওখানে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো অপর্ণা।

পেশেন্টের কন্ডিশন কিন্তু এখনও স্টেবল নয়, হসপিটাল ছেড়ে যাবেন না!

ডাক্তারের এই কথার পরে সৌমিকের পক্ষে বাবা কে ফেলে রেখে চলে আসা সম্ভব ছিলো না, অগত্যা ধুতি, পাঞ্জাবির ওপরে শাল জড়িয়ে বিয়ের সাজেই সে বন্ধু রবি কে নিয়ে হাসপাতালের চেয়ারে কফির কাপ হাতে বসে পড়েছিলো। রবি একটু বিরক্ত হচ্ছিলো,

অদ্ভুত তো! তুই সারারাত এই ভাবে বসে থাকবি নাকি! তোর দাদা বা জামাই বাবু কে বল চলে আসতে!

সৌমিক মাথা নাড়লো, মুখে বিরক্তি সূচক আওয়াজ করে বললো,

বললাম তো ফোনে, শুনিস নি তুই! আসার হলে ঠিকই আসতো! কে আর যেচে পড়ে এই শীতের রাতে এখানে থাকতে আসবে বলতো! ছাড় ওসব, অন্য কথা বল! খারাপ লাগছে তোকেও আমার জন্যে এখন বসে থাকতে হচ্ছে! কফিটা খা, ঠান্ডা হয়ে যাবে।

কফির কাপ হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে রবি হাসলো,

আমার জন্যে ভাবিস না, এসব আমার অভ্যাস আছে! নাইট ডিউটি তে তো জেগেই বসে থাকি রাতের পর রাত! তবে এটা ঠিক আজ খুব বাজে হলো কিন্তু, বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই তোকে বউ নিয়ে চলে আসতে হলো, এটা ঠিক হলো না! তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি ভাবলো বলতো? বাড়িতে যদি আর কেউ না থাকতো তাহলে একটা অজুহাত হতো না হয়! লোকের তো অভাব ছিলো না!

সৌমিক কফির কাপে চুমুক দিয়ে ঠোঁট উল্টালো,

ভাবলে আর কি করা যাবে! অতো কিছু ভাবনার সময় নেই আমার! প্রয়োজন তো হতেই পারে, ইচ্ছে করে তো আর চলে আসিনি!

রবি একটু চুপ করে থেকে বললো,

তবে তোর বউ কে আমার ভালো লেগেছে, একটু চুপচাপ কিন্তু মনে হয়েছে বুদ্ধিমতি! আশাকরি তোর পরিস্থিতি টা বুঝবে!

সৌমিক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো,

বোঝা উচিত! তবে না বুঝলে বোঝানোর দায় নেই আমার! আমার কোনো কাজের জন্যে যে আমি কাউকে কৈফিয়ত দিই না সেটা তুই ভালোই জানিস!

হুম! সেটা আর আমার থেকে বেশি কে জানে, জেদ টা একটু কম হলে তোর খারাপ হতো না কিন্তু! জেদের বশেই তো এতো কিছু ঘটে গেলো!

বন্ধুর কথায় সৌমিক মুখ বিকৃত করলো,

আবার এক কথা! যা শেষ হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আর নতুন করে আলোচনা করতে চাই না! অনেক আলোচনা আগেও হয়েছে তো! জেদ শুধু আমারই ছিলো বলছিস?

রবি বন্ধুর দিকে তাকালো,

না দুজনেরই ছিলো, সেদিক থেকে বলতে গেলে মিতার ই বেশি হয়ত! ও তো একেবারে কলকাতা ছেড়েই চলে গেলো! আচ্ছা ওই প্রসঙ্গ থাক, তুই একটা কথা বল, এটা কিরকম কথা, বোঝানোর দায় নেই এটা শুনতে ভালো লাগলো না একদম! জানি তুই এতো তাড়াতাড়ি হয়ত সব কিছু ভুলতে পারিস নি, কিন্তু তাই বলে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হবে অন্য কাউকে এমন কিছু তো বাধ্যবাধকতা তোর ছিলো না! না হয় নাই করতিস বিয়ে সারাজীবন, তবে অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার তো তোর কোনো অধিকার ছিলো না! খানিকটা মিতা কে দেখানোর জন্যেই বিয়েটা করলি বোধহয়, তাই না?

সৌমিক রবির চোখের দিকে তাকালো,

যা জানিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না! কে বললো তোকে যে আমি কারো জীবন নষ্ট করছি? যার হয়ে তুই এতো কথা বলছিস সে তো নিজেও এই বিয়েটা প্রায় বাধ্য হয়েই করেছে, জানিস সেটা? তারও প্রেমে ব্যথা পাওয়ার গল্প আছে, তার বাবা অসুস্থ না হয়ে পড়লে সেও এই বিয়েতে রাজি হতো না, নিজেই বলেছে তার সময় চাই!

রবির মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়লো,

তাই নাকি! তাহলে তো আর কোনো কথা থাকতেই পারে না! তা তার প্রেম কাটলো কিভাবে? বাবা জোর করে দিয়ে দিলো নাকি? আর তুই কি বললি? নিজের কথাও কিছু বললি নাকি?

নাহ! আমার তো বলার মতো কিছু নেই! তার বলার ছিলো তাই বলেছে! বাবা জোর করেনি, ছেলেটি সম্ভবত বেঁচে নেই, কথা শুনে সেরকমই মনে হয়ে ছিলো! প্রথম প্রেম ভুলে যাওয়া সহজ নাকি! তাই সে তো নিজেই সময় চেয়ে নিয়েছে!

রবি ব্যাঙ্গের হাসি হাসলো,

তুইও তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলি তাহলে! তোকে তো ভালোই অভিনয় করতে হতো!

নাহ! অভিনয় কেনো করবো, সেটা করার দরকার আমার অন্তত পড়েনি কখনো, আর আমি সেটা পারিও না!

রাগের গলায় বললো সৌমিক, বন্ধুর কথায় রবি ঘাড় কাত করলো,

আচ্ছা, আচ্ছা বুঝলাম! তবে এটা ঠিক বলেছিস একদম, প্রথম প্রেম ভোলা সত্যিই সহজ নয়, সে তো তোকে দেখেই বুঝতে পারছি! মুখে যতই অস্বীকার করিস, তোর চোখ মুখ কিন্তু অন্য কথা বলে! আমি জানি তুই এখনও মিতা কে ভালবাসিস! এখনও ওর ডাক ফিরিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা তোর নেই!

সৌমিক চোয়াল শক্ত করলো,

একদম ভুল জানিস তুই! আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না! আমার দিক থেকে যতটা চেষ্টা করার ছিলো তার থেকেও বেশি করেছি আমি, কিন্তু ও যদি ভেবে থাকে আমি ওর সব অন্যায় দাবি মেনে নেবো তাহলে ও সত্যিই ভুল ভেবেছিলো। ও কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়ে আমার ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো, সেটা আমার জেদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে! ওর প্রতি আমার আর কোনো ফিলিংস নেই!
ক্রমশ