চন্দ্রমল্লিকা পর্ব-০৩

0
441

#চন্দ্রমল্লিকা
#লেখিকা: আরোহী
#পর্ব :৩

শরতের আকাশে কালো মেঘ জমেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে শিক্ত হয়েছে ধরনী। অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস সবসময় খারাপ কিছু বয়ে আনে না। কখনো কখনো জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হয়ে যায়। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিও তেমন নিহিত। নিহিত অর্থ সৃষ্টিকর্তার উপহার।সত্যিই নিহিত সৃষ্টিকর্তার উপহার স্বরূপ আমার জীবনে এসেছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে জুড়ে গেছে আমাদের জীবন।আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই হয়েছে আমাদের মনের মিলন। নিহিতের সাথে আমার সম্পর্কটা এখন বাকি দশটা স্বামী স্ত্রীর মত। প্রতিদিন যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি তাকে। হঠাৎ পেছন থেকে নিহিত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেয়ে বললো কি হয়েছে মন খারাপ।

আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম না গেলে হয় না। নিহিত আমাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল দেখ আমি আর্মি জয়েন্ট করেছিলাম আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে।এখন আমার কাজ আমার দেশকে রক্ষা করা।আর আমাকে আমার কাজ করতে হবে। আমাকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে। আমার চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিহিত চোখের জল মুছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো কাঁদছো কেন আমি কি সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি।আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসব।চোখে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে নিহিত বললো আমি আসার পর কিন্তু তোমাকে আর রুমের বাইরে যেতে দেব না।এখন যত পার মা আর নয়নার সাথে সময় কাটিয়ে নাও।

আমি নিহিতের বুক কিল মেরে বললাম অসভ্য লোক। সবসময় আপনার খালি বাজে কথা না। নিহিত হাসতে হাসতে বলল বাজে কথা কখন বললাম যা বলেছি একদম সত্যি।আমি নিহিতের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম যান তো আপনি আমার অনেক কাজ আছে। আপনার বাজে কথা শোনার সময় নেই। নিহিত মেকি রাগ নিয়ে বললো একটু আগে যাওয়ার কথা শুনে কেঁদে ভাসাচ্ছিলে আর এখন তাড়িয়ে দিচ্ছ। বেশ ভালো নারী মন বোঝা বড় দায়।বলতে বলতে নিহিত মায়ের রুমে চলে গেল।

সময় তার নিজের নিয়মে চলে।সময়কে আটকে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। ঠিক সেই নিয়মে নিহিত চলে যাওয়ার পর কেটে গেল পনেরো দিন। নিহিতের সাথে কথা হয় খুব কম।ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। আমার সময়ও খুব খারাপ কাটছে না। ভার্সিটি যাওয়া, বাড়ি এসে মা, নয়নার সাথে গল্প করে কেটে যাচ্ছে দিন।এবাড়িতে এসে মনেই হয় না আমি শ্বশুর বাড়িতে আছি।মা কোন কাজ করতে দেয় না। জোর করে করতে গেলে ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।

আজকে মনটা খুব ভালো।কাল রাতে নিহিতের সাথে কথা হয়েছে।বলেছে পরশু দিন আসবে।মাকে আর নয়নাকে বলতে বারন করেছে। ওদের সারপ্রাইজ দিবে তাই।আমি শুধু দিন গুনছি কবে নিহিত আসবে।

সময় যেন শেষই হচ্ছে না।বার বার শুধু ঘড়ি দেখছি কখন নিহিত আসবে।মা আমাকে ছটফট করতে দেখ বললো কি হয়েছে নূর এত ছটফট করতো কেন।শরীর খারাপ লাগছে।আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম না মা তেমন কিছু না আসলে নয়না স্কুলে গেছে, তুমি কাজ করছো আমার একা একা ভালো লাগছে না।মা বললো ও তাহলে টিভি দেখ গিয়ে।আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম মা আজকে আমি রান্না করি।আমি সব রান্না পারি।মা কিছু একটা ভেবে বললো আচ্ছা করো। কিন্তু আমি তোমাকে হাতে হাতে সাহায্য তো করতেই পারি তাইনা। মায়ের কথায় হেসে বললাম আচ্ছা ঠিক আছে।

মা আর আমি মিলে সব রান্না মোটামুটি শেষ করেছি। কিন্তু নিহিত এখনো আসেনি। কয়েক বার ফোন করেছি তাও ধরেনি। এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে কিছু হলো না তো।এর মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠল।আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি নয়না এসেছে।নয়না আমাকে দেখে বললো কি হলো ভাবি মুখটা এমন করে রেখেছ কেন।এখন আমাকে আশা করোনি,অন্য কারো আসার কথা ছিল বুঝি।নয়না কথা বিপরীতে বললাম না এখন আবার কে আসবে তুমি ভেতরে এসো।

এই বলে আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম তখন পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠল সত্যিই কারো আসার কথা ছিল না।আমি ঘুরে দেখে নিহিত বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে চোখে মুখে দুষ্টু হাসি।আমি মুখ গোমড়া করে বললাম এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো। সেই কখন আসার কথা ছিল। ফোনও ধরছিলেন না। আমার বুঝি চিন্তা হয় না। নিহিত ব্যাগ নিয়ে নয়নাকে বললো আজকে বোধহয় আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।নিহিতের কথা শুনে আমি দরজার সামনে থেকে সরে এলাম। ভেতরে এসে নিহিত মায়ের সালাম করে বললো মা আমি এসেছি তুমি একটুও অবাক হওনি।

মা হেসে বললেন আমি তো জানতাম তুই আসবি। নিহিত মুখ গোমড়া করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো তুমি মাকে বলে দিয়েছিলে।মা বলল না নূর কিছু বলেনি। নিহিত কৌতুহল নিয়ে বললো তাহলে তুমি জানলে কি করে।মা মুচকি হেসে বলল তোর বৌয়ের তোড়জোড় দেখে। সকাল থেকে তোর সব পছন্দের রান্না নিজের হাতে করেছে।আর বার বার শুধু ঘড়ি দেখছিল।ওর উচাটন দেখেই বুঝেছি আজ নিশ্চই আমার ছেলে আসবে।আমি লজ্জায় রান্না ঘরে চলে এলাম।

একটু পরে মা আমাকে ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।আমি আসতে না চাইলে বললেন এখন আমার ছেলে এসেছে তুমি শুধু ওকে সময় দাও। তোমার কিছু করতে হবে না।আমি ঘরে এসে দেখি নিহিত মুখ গোমড়া করে চুল মুছছে।আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আমাকে না দেখার ভান করে বিছানায় গিয়ে বসে ফোন চাপতে লাগলেন।এমন ভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন ফোন ঘাটা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি আর ঘরে যেন উনি ছাড়া আর কেউ নেই।আমি ওনার পাশে গিয়ে বসতেই উঠে চলে যেতে নিচ্ছিল।

আমি ওনার হাত ধরে বললাম কি হলো এমন কেন করছেন। উনি কিছু না বলে চলে গেল। ওনার পেছন পেছন গিয়ে দেখি খেতে বসেছে।মা আমাকেও খেতে বসতে বলল।সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। কাজ সেরে ঘরে এসে দেখি উনি শুয়ে আছে। আমাকে দেখেই অন্য দিকে ঘুরে গেল।আমি কাছে গিয়ে বললাম কাল হয়েছে কথা বলবেন না আমার সাথে। উনি কিছু বললেন না।

আমি একটু কাছে ঘেষে জড়িয়ে ধরতেই উনি বলে উঠলেন আমার কাছে কেন এসেছ যাও রান্না ঘরে গিয়ে বসে থাকো। তোমার তো আবার অনেক কাজ আছে।আমি ওনার রাগ বুঝতে পেরে বললাম সবসময় যদি আপনার কাছে বসে থাকি তাহলে লোকে কি ভাববে বলুন তো। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো আমার বৌ আমার কাছে থাকবে তাতে কার কি। আমার বৌকে আমি সারাদিন নিজের সামনে বসিয়ে রাখব কে কি বলে দেখি। ওনার কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।

সন্ধ্যায় আমি আর নয়না মিলে প্লান করে নিলাম কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো।মা বলছিলেন এবার হানিমুনে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভার্সিটিতে জরুরী ক্লাস থাকায় আর যাওয়া হবেনা।তাই ভাবলাম সবাই মিলে শহরের মধ্যে ঘোরা যাক……
#চলবে