চন্দ্রমল্লিকা পর্ব-০৪

0
406

#চন্দ্রমল্লিকা
#লেখিকা: আরোহী
#পর্ব:৪

মানুষের জীবনের ভালো সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়। কখন কিভাবে সময় গুলো ফাঁকি দিয়ে চলে যায় বোঝা যায় না।ঠিক তেমনি নিহিত আর আমি পার করে ফেললাম বিবাহিত জীবনের এগারোটা মাস। ভালোবাসা,মান,অভিমান, ঝগড়া,খনশুটি সব মিলিয়ে ভালোই আছি বলা যায়।

সামনের মাসে আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। আমি বেশ এক্সাইটেড দিনটা নিয়ে। নিহিতকে বার বার ফোন করে জিজ্ঞেস করছি ছুটি পেল কি না। গত সপ্তাহ থেকে চেষ্টা করেও নিহিত এখনো ছুটি পেল না।

রাত ১১:৫৩ আধ শোয়া হয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। নিস্তব্ধতাকে ভেঙে বিকট আওয়াজে ফোনটা বেজে উঠলো। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার দরুন ফোনের শব্দে বেশ বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই সমস্ত বিরক্ততা যেন জানলা দিয়ে পালালো। ফোনের মধ্যে নিহিত নামটা জ্বল জ্বল করছে।যার ফোনের আশায় সারাটা দিন চাতক পাখির মতো বসে থাকি।বইটা রেখে ফোনটা ধরার আগেই কেটে গেল। হতাশ হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই আবার স্বশব্দে বেজে উঠল। বিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল ফোন ধরতে এতো সময় লাগে।আমি নিচু স্বরে বললাম না ফোন ধরার আগেই কেটে গেছিলো আরকি। নিহিত কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠল খেয়েছো।আমি বললাম হ্যাঁ, আপনি? নিহিত বললো না তোমার সাথে কথা বলে খেতে যাবো।আমি বললাম তাহলে যান খেয়ে আসুন।

নিহিত একটু রাগী গলায় বললো কেনো আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমি বিচলিত হয়ে বললাম না না এমন কিছু না। আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন। কিছু হয়েছে। নিহিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো না কি হবে। আচ্ছা শোন আমার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। সোমবার আসছি।আমি খুব খুশি হয়ে বললাম সত্যি। নিহিত একটু চাপা স্বরে বলে উঠল না হলে কি আমি তোমায় মিথ্যে বলেছি। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিহিত এখন রাখছি পরে কথা হবে বলে ফোনটা কেটে দিলো।

তিন দিন হলো নিহিত বাড়ি এসেছে। কিন্তু আসার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন মন মরা হয়ে গেছে।কারো সাথে ঠিক মতো কথা বলে না। আমাকেও কেমন যেন এড়িয়ে চলে। সারাক্ষণ ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে।
রাতের খাওয়ার পর ঘরে এসে দেখি নিহিত ঘরে নেই।বেলকুনি তে উঁকি দিয়ে দেখি নিহিত এক ধ্যানে আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই আমার হাত ছাড়িয়ে বললো এখন ভালো লাগছে না নূর। গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। আমি ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম আপনি ঘুমোবেন না। নিহিত বললো তুমি যাও আমি একটু পর আসছি।আমি ওনার কথা না শুনে ওনার হাত শক্ত করে ধরে বললাম কি হয়েছে আপনার। এসেছেন থেকে দেখছি কেমন যেন হয়ে গেছেন। কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছেন। বলুন আমাকে। নিহিত হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তুমি নিজের,মা আর নয়নার খেয়াল রাখবে নূর। আমি ওনার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠি কি হবে আপনার। কোথায় যাবেন।কি হয়েছে বলুন। নিহিত আমাকে ছেড়ে চলে যেতে নিচ্ছিল আমি ওনার হাত ধরে বলি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে কোথাও যেতে দেব না আপনাকে। নিহিত রাগ নিয়ে বললো কি হবে কিছু হয়নি। তুমি বেশি বুঝছো।সব বিষয়ে তোমার না জানলেও চলবে। নিহিত এর আগে কখনো এভাবে আমার সাথে কথা বলে নি। আমি এগিয়ে নিহিতের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম আপনার সম্পর্কে কিছু জানার অধিকার কি আমার নেই। নিহিত কিছু না বলে ঘুরে গেল।আমি ওনাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম কি হলো বলুন।আমি তো আপনার স্ত্রী। আমার থেকেও লুকোবেন।

নিহিত আমার হাত ধরে বললো আমায় কাল যেতে হবে নূর।ক্যান্টনমেন্ট থেকে খবর এসেছে।বর্ডার এলাকায় আপরেশন হবে। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে যেতেই হবে।ফিরে আসতে পারবো কি না জানিনা।হয়তো নাও ফিরতে পারি। আমি ওনার কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে বলে উঠলাম কোথাও যাবেন না আপনি। আমি আপনাকে কোথাও যেতে দেব না। নিহিত আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো আমাকে যেতেই হবে। আমার দেশকে রক্ষা করতেই হবে। তুমি শুধু কথা দাও নিজের আর, পরিবারের খেয়াল রাখবে।

তোমার হাতে আমি আমার পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে শান্তিতে মরতে পাড়ব।আমি ছাড়া ওদের যে কেউ নেই নূর।আমি জোরে কেঁদে বলে উঠলাম কিছু হবে না আপনার। আমার ভালোবাসা, পরিবারের সবার ভালোবাসা আপনাকে ফিরিয়ে আনবে। নিহিত ঘোলা চোখে বললো এই কাজটা এতটা সহজ না।এর আগেও আমি অনেক অপারেশনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু এবারের টা অনেক রিস্কি। আমার ফেরার আশা মাত্র ১০%। আমি ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম ১০% হোক বা ১% আপনাকে ফিরতেই হবে।

পরেরদিন সকালে নিহিত চলে গেল।ওকে আটকে রাখার চেষ্টা করিনি।ওকে আটকে রাখলে সেটা দেশের প্রতি অবিচার হতো। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস নিহিত ঠিক ফিরে আসবে। ওনাকে ফিরতেই হবে।

নিহিত যাওয়ার পর কেটে গেল দুদিন। এই দুদিন অনেক চেষ্টা করেও নিহিতের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি।মা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে।কোন ভাবেই নিহিতের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খবরের চ্যানেল গুলোতে বার বার বলছে বর্ডার এলাকায় প্রচন্ড গণ্ডগোল হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না।

পাঁচ দিন হয়ে গেল নিহিতের কোন খোঁজ নেই।খবরে বলছে দুষ্কৃতকারীদের কাবু করতে দেশিয় সেনারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কয়েক জন সেনা শহীদও হয়েছে।এসব খবর শুনে বাসার সবাই বেশ ভেঙে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত কোন খোঁজ না পেয়ে ক্যান্টনমেন্টে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারাও কোন খোঁজ দেয়নি।

প্রচন্ড চিন্তায় আরও এক দিন কেটে গেল।বর্ডার এলাকার অবস্থা এখন কিছুটা স্বাভাবিক। দুষ্কৃতকারীরা আটক হয়েছে। কিন্তু অনেক সেনার খোঁজ পাওয়া যায়নি।এর মধ্যে নিহিতের নামও আছে। কিছু সেনার ডেড বডি পাঠানো হয়েছে তাদের আপনজনের কাছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে।

আমাদের সবার অবস্থা খারাপ।কখন কি খবর আসে বলা যায় না।আমরা সবাই কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।মাকে জোর করেও কিছু খাওয়ানো যাচ্ছেনা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে নিহিত ঠিক ফিরবে।ওকে ফিরতেই হবে। আমার ভালোবাসা ওকে ঠিক ফিরিয়ে আনবে।সবার দোয়া আছে ওর সাথে।

মাকে অনেক কষ্টে হালকা কিছু খাইয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে এসেছি।এখন ঘুমোচ্ছে।নয়নাকেও খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি।ঘরে এসে ঢুকতেই বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো।মনে হলো কি যেন নেই।খানি খালি লাগছে। খুব কান্না পাচ্ছে।সবার সামনে শক্ত থাকলেও এখন আর পারছি না। টেবিলের উপর থেকে নিহিতের ছবিটা নিয়ে বুকে চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম আপনাকে ফিরতেই হবে নিহিত।প্লিজ ফিরে আসুন। আমি আর পারছি না।একা একা সবাইকে সামলাতে পারছিনা। আমি ক্লান্ত নিহিত।প্লিজ ফিরে আসুন।

কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেকক্ষণ ধরে কেউ কলিং বেল বাজাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে মা দেখি তাতে আপনা আপনি চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে………

#চলবে