চন্দ্রমল্লিকা পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
623

#চন্দ্রমল্লিকা
#লেখিকা : আরোহী
#অন্তিম পর্ব

বিয়ের আমেজে পূর্ণ সবাই। সকাল থেকে বিভিন্ন কাজে বেশ ব্যস্ততায় কাটছে দিনটা।নিহিতের খালাতো ভাই সজীব ভাইয়ের বিয়ে।তাই আমরা সবাই দিনাজপুর এসেছি।আজ হলুদের অনুষ্ঠান হবে। বাসার ছাদে বেশ বড় ভাবেই আয়োজন করা হয়েছে।

আমি রুমে এসেছি রেডি হতে। শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করছিলাম এমন সময় ঘরে ঢুকলো নিহিত।গায়ে হালকা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।ঘরে এসে ঢুকতেই নিহিত ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো তুমি আমার অধিকার হরণ করছো কেন। আমি ওনার কথা শুনে হা করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে শাড়ির কুচিগুলো ধরে ঠিক করতে করতে বললেন স্ত্রীর শাড়ির কুচি ঠিক করা স্বামীদের জন্মগত অধিকার। আর তুমি আমার থেকে সেই অধিকার কেড়ে নিচ্ছেলে।

আমি ওনার কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।শাড়ি পড়া শেষ করে আমি বললাম ঠিক বলেছেন স্ত্রীর শাড়ির কুচি ঠিক করা স্বামীদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু স্ত্রীদেরও তো কিছু অধিকার আছে তাই না।আমি কথাগুলো বলতে বলতে ওনার দিকে আগাচ্ছিলাম।উনি আমার এগোনো দেখে বললেন বাহ্ আজ বেশ রোমান্টিক মুডে আছে দেখি আমার বউ। আমি ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওনার পাঞ্জাবির বোতাম টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো এটা কি হলো। তুমি বোতামটা ছিড়লে কেন।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম এটা আমার অধিকার তাই। নিহিত বোকা বোকা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো এটা কেমন অধিকার। আমি বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম আপনি সিনেমা দেখেন না।আনরোমান্টিক লোক একটা। উনি আমার কথা না বুঝে বললেন মানে।আমি এবারও বেশ বিরক্ত নিয়ে বললাম আরে সিনেমায় দেখেন নি স্বামীর জামার বোতাম ছিঁড়ে গেলে স্ত্রী কত যত্ন নিয়ে বোতাম লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আপনার কোন জামার বোতাম তো ছিঁড়ে যায় নি।তাই আমিই ছিঁড়ে ফেললাম। এবার আপনি দাঁড়ান আমি এক্ষুনি গিয়ে সুঁই সুতো নিয়ে আসছি।এই বলে আমি দৌড়ে খালামনি অর্থাৎ আমার খালা শাশুড়ির ঘরে গিয়ে সুঁই সুতো নিয়ে আসলাম।ঘরে এসে দেখি নিহিত ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি তা দেখে হেসে বললাম বাহ্ আপনি তো বউয়ের কথা বেশ ভালোভাবেই পালন করেন। উনি হেসে আমার কোমর ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বললো বউয়ের কথা অমান্য করবো যে আমার ঘাড়ে কটা মাথা। আমি শান্ত শিষ্ট বউ পাগল মানুষ। আমি ওনার কথা শুনে বললাম আপনি দিন দিন অনেক অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন। উনি আমার কথা শুনে চোখ টিপে বললো বিয়ে করলে একটু অসভ্য হতেই হয়। ওনার কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেছে। কোন কথা না বলে চুপচাপ ওনার পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দিলাম। ওনার থেকে সরে আসতে নিলে উনি আমার মুখটা উঁচু করে কপালে চুমু দিয়ে বলল রেডি হয়ে নাও আমি আসছি।বলেই উনি চলে গেলেন।

আমি আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিয়ে নিলাম।আর ভাবতে লাগলাম তিন মাস আগের কথা। সেদিন যখন আমারা সবাই টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখি সামনে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ছিল নিহিতের ইউনিফর্ম।তা দেখেই নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম কঠিন এক সত্যের মুখোমুখি হতে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠল মি:নিহিতের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওনার অবস্থা বেশ গুরুতর।আইসিইউতে আছেন। অফিসারের কথা শুনে আমি নয়না আর মাকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলাম। হসপিটালে গিয়ে নিহিতের অবস্থা জানতে চাইলে ডাক্তার বললেন ওনার অবস্থা ভালো না বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না।

ওনার অপারেশন সাকসেসফুল কিন্তু বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে ওনার জ্ঞান না ফিরলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। আপনারা শুধু উপরওয়ালাকে ডাকুন। উনিই এখন একমাত্র ভরসা।মা তো ডাক্তারের কথা শোনার পরই জ্ঞান হারায়। মায়ের জ্ঞান ফেরানোর পর নয়নার সাথে মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। হসপিটালে আমি আর বাবা সারারাত ছিলাম।সকালে অনেক বুঝিয়ে বাবাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছে না। কোন অনূভুতিই কাজ করছে না।ডাক্তারের দেওয়া বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে আটষট্টি ঘন্টা কেটে গেছে কিন্তু নিহিতের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।ডাক্তাররাও প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মাকে কোনভাবেই বাসায় রাখা যায়নি উনি হসপিটালে চলে এসেছে।মা আর নয়না মিলে ডাক্তারের কাছে অনেক অনুরোধ করেছে নিহিতের সাথে দেখা করতে দেওয়ার জন্য। শেষে ডাক্তার সাহেব রাজি হলেন বললেন যে কোন একজন ভেতরে নিহিতের সাথে দেখা করতে পারবেন।মা এসে আমার হাত ধরে বললো যা মা তুই যা আমার ছেলেটাকে দেখে আয়। মায়ের কথায় আমি নিঃশব্দে উঠে নিহিতের কাছে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ওর অক্সিজেন চলছে। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম নিহিত উঠুন আর কতো এভাবে শুয়ে থাকবেন। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি নিজের,মা, নয়নার সবার খেয়াল রেখেছি। এবার আপনার পালা নিজের কথা রাখুন নিহিত উঠুন। আমার ভালোবাসাকে এভাবে হেরে যেতে দেবেন না।প্লিজ নিহিত উঠুন।আমি নিহিতের হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলাম।নার্স এসে বললো আপনার সময় শেষ এখন আপনাকে বাইরে যেতে হবে। আমি কিছুতেই নিহিতকে রেখে আসতে চাইছিলাম না।নার্স জোর করে বের করে দিলেন।

আরও দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল কিন্তু কোন রেসপন্স করছে না নিহিত।ডাক্তার এসে আমাদের বললেন রোগীর জ্ঞান আর হয়তো ফিরবে না। আপনারা গিয়ে শেষ বারের মত দেখে আসুন। ঠিক তখন আইসিইউ থেকে নার্স তারাহুরো করে এসে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বললেন স্যার রোগীর তো জ্ঞান ফিরেছে। নার্সের কথা শুনে ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে গেলেন।আধ ঘন্টা পর বেরিয়ে এসে ডাক্তার বললেন রোগী এখন আউট অফ ডেইন্জার। রাতে ওনাকে কেবিনে শিফ্ট করা হবে।আমি ডাক্তারকে বললাম এখন কি ওর সাথে দেখা করা যাবে।ডাক্তার বললেন কেবিনে দেওয়ার পর দেখা করা যাবে। রাতে নিহিতকে কেবিনে দেওয়া হলো।এখন একটু সুস্থ তবে আরও কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে।মা নিহিতের সাথে কথা বলছেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছিলেন। আমি কেবিনের কোনায় দাঁড়িয়ে মা ছেলের অভুতপূর্ব মিলনের সাক্ষী হয়ে ছিলাম।মা আমার হাত নিহিতের খাবারের থালাটা দিয়ে ওকে খাওয়াতে বলে চলে গেলেন।আমি নিঃশব্দে বসে নিহিতকে খাওয়াতে লাগলাম। নিহিত আমার হাত ধরে বললো কি হলো কথা বলছো না কেন। আমি তাও কোনো কথা না বলে খাবারটা মুখের সামনে ধরে বললাম খেয়ে নিন। নিহিত তাও খেলো না।বললো আগে তুমি ভালোভাবে আমার সাথে কথা বলো তারপর আমি খাবো।আমি অনেক কষ্টে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছিলাম।আর না পেরে নিহিতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলাম। নিহিত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো আরে কাঁদছো কেন আমি ঠিক আছি তো।দেখ আমার কিছু হয়নি। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম আপনার কিছু হলে আমার কি হতো বলুন তো। জানেন আমি কতো ভয় পেয়েছিলাম। নিহিত আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বললো এতো ভালোবাসো আমাকে।

হঠাৎ চুল টান পরতে আয়নায় তাকালাম দেখি নিহিত আমার খোঁপায় দুটো সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুল গুঁজে দিয়েছে।আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখের কোন থেকে কাজল নিয়ে ঘাড়ে লাগিয়ে বললো এবার একদম পারফেক্ট লাগছে। আমি নিহিতকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে বললাম “ভালোবাসি নিহিত”। একটু বেশিই ভালোবাসি। আমার কথায় নিহিতের ঠোঁটের
কোনে ফুটে উঠলো এক দূর্ভেদ্য সূক্ষ্ম হাসির রেখা।

সমাপ্ত