চাদর জড়ানো চিরকুট পর্ব-০৩

0
252

#চাদর_জড়ানো_চিরকুট।
#পর্বঃ- ০৩

লতার বাম হাতের বাহুতে গু/লি লেগেছে। মিজান ঠিকমতো নিশানা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই লতার তেমন কিছু হয়নি। সামান্য মাংস ছিড়ে বুলেট বের হয়ে গেছে কিন্তু র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে তার হাত।

পুলিশের গাড়িতে করেই তাকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জরুরি বিভাগে ডাক্তার তার হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছে আর বাহিরে বসে বসে অপেক্ষা করছে সাজু।

রবিউলের চাদর আর চিঠি সাজুর হাতেই। চিঠিটা আরও কয়েকবার পড়লো সাজু ভাই, কিন্তু যেসব প্রশ্ন আছে সেগুলো লতা ছাড়া পাওয়া যাবে না। লতার স্বাভাবিক হবার জন্য অপেক্ষা করে আছে সাজু।

হাসপাতালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাজুর দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিউল ইসলাম ওরফে রাফসান মাহমুদ। সাজুর হাতে রাফসান নিজের লেখা চিঠি আর চাদরটা দেখে অবাক হয়ে রইল। তারমানে সাজু ভাই মোটামুটি অনেক কিছু জেনে গেছে। রবিউল বুঝতে পারলো এই সাজুর জন্য তাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে।

কোতোয়ালি থানার এসআই নিজাম উদ্দিন সাজুর কাছে এসে বললো,
– আপনি তো সবার আগে লাশের ছবি তুলেছেন তাই না?

– জি।

– আমি এসআই নিজাম উদ্দিন।

– আমি রিহানুল ইসলাম সাজু, সাজু নামেই বেশি ডাকে সবাই।

এসআই নিজামের সঙ্গে সাজু সচক্ষে দেখা সব ঘটনা বর্ননা করলেন। শুধু চিঠি আর চাদরের বিষয় এড়িয়ে গেল সাজু। সাজুর পাশে বসে বসে রামিশাও সবকিছু শুনছিল।

সাজু বললো,
– মেয়েটা সুস্থ হলে আমি তাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করতে চাই। খুনি ভদ্রলোক এই মেয়ের স্বামী।

– আচ্ছা ঠিক আছে আমার সঙ্গে গিয়ে আপনি যা যা জানতে চান জিজ্ঞেস করবেন।

– না, আমি একাই তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

নিজাম উদ্দিন সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়ে আবার চিপ করে থাকলো কিছু সময়। তারপর বললো,

– আচ্ছা সমস্যা নেই।

★★

কেবিনে আধশোয়া অবস্থায় আছে লতা চৌধুরী। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। সাজু প্রায় দশ মিনিট ধরে তার সামনে বসে আছে, সাজুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রামিশা।

সাজু বললো,
– আমি আপনার সিটের উপর চিঠি আর চাদরটা পেয়েছি। এই পর্যন্ত অন্তত ২০ বার পড়েছি আমি। আমি জানি আপনার স্বামীর খুনির সম্পর্কে সব আপনি জানেন।

লতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ছেলেটার নাম রাফসান মাহমুদ।

– সেটা তো চিঠির শেষে লেখা আছে, কিন্তু আমার ধারণা এটা তার আসল নাম নয়।

লতার চোখ ছোট হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাজুর দিকে। তাকে তাকাতে দেখে সাজু ভাই বললেন,

– ওর নাম রবিউল ইসলাম, আমি আমার একটা মামলার মধ্যে ওকে পেয়েছিলাম। সবমিলিয়ে সেই সময়ে রবিউল ৭/৮ খুন করেছে, তবে যাদের সে খুন করেছে তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিল নিরপরাধ।

– তাহলে তখন তাকে ধরলেন না কেন?

– চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। রবিউল অনেক দক্ষ একজন কিলার, বেশ পরিকল্পনা করে সে কাজ করে।

– ওকে আমি কোনদিনই ক্ষমা করবো না। দরকার হলে ওর চেয়ে বড় খুনি ভাড়া করবো তবুও ওকে আমি খুঁজে বের করে আমার স্বামী হত্যার দায় শাস্তি দেবো।

– আপনার সঙ্গে আমি আপনার স্বামীর বিষয় জানতে চাই। আপনার স্বামীর পরিচয়, সে কোথায় কি করতো, তার আত্মীয় স্বজন কে কে।

– ওর নাম ছিল ফিরোজ। একটা বায়িং হাউজে চাকরি করতো। চট্টগ্রাম থেকে আমি ঢাকা যাবার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কথাবার্তা আর ব্যবহার এতটা মনোমুগ্ধকর ছিল যেটা তার প্রতি আমাকে দুর্বল করে দেয়। যদিও সেবার আমরা শুধু মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান করেছিলাম। তারপর থেকে কথা হতো আমাদের, আস্তে আস্তে ভালো লাগা তারপর ভালোবাসা।

যেহেতু দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক তাই আমরা দুজন মিলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিয়ের জন্য তার আগ্রহ বেশি ছিল। আমি ভাবলাম আজ বা কাল আমরা বিয়ে তো করবো ই তাহলে কদিন আগে করলে ক্ষতি কি। কোটিপতি বাবার সন্তান হয়েও আমার বিয়ে হলো কাজি অফিসে। বাবার অবাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলাম।

– আপনার মা?

– মা এগারো বছর আগে মারা গেছে।

– তারপর?

– বিয়ে করার পরও আমরা একসঙ্গে বাসায় উঠলাম না। আমি আমার বাসাতেই থাকতাম। ফিরোজ বলতো যে কিছুদিন পরে আমরা একটা ফ্ল্যাটে উঠবো। তাই কিছুদিন আলাদা থাকতে সমস্যা নেই।
আমি বললাম তাহলে বিয়ে করে লাভ কি?
সে বলে যে তোমাকে নিজের করে রাখলাম যেন হারিয়ে না যাও। তোমাকে হারানোর ভয়।

– আপনার চিঠিতে বর্ননা অনুযায়ী আপনার স্বামী নাকি খুব খারাপ মানুষ। আপনি কখনো তাকে অপরাধ করতে দেখেছেন?

– না, আমাদের মাসের মধ্যে দুই তিনবার দেখা হতো আর বাকি সময় ফোনেই কথা হতো।

– আপনার গর্ভে সন্তান?

– হ্যাঁ। অফিসের একটা কাজে আমি রংপুরে গেছিলাম তখন ফিরোজ সঙ্গে ছিল। কারণ সেই সময় আমার জন্মদিন ছিল।

– এটা কতদিন আগের ঘটনা?

– দুইমাস আগের।

– তাহলে আপনার গর্ভে সন্তানের বয়সও একই?

– জি।

– চিঠিতে লেখা আছে সেই অজ্ঞাত রাফসান বা রবিউল সে নাকি ১৭ দিনের মধ্যে আপনার আপন তিনজনকে শত্রু মনে করে। আপনার নিজের কি কখনো এরকম কাউকে সন্দেহ হয়েছে?

– কোই না তো।

সাজুর মোবাইল বেজে উঠলো। সাজু একটু ব্রেক নিয়ে মোবাইল রিসিভ করলো, যদিও অপরিচিত নাম্বার ছিল।

– কেমন আছেন সাজু ভাই?

– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন আর কে বলছেন প্লিজ?

– আমি রবিউল ইসলাম, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আমার বোনের অবস্থা ভালো না তাই একটু পরেই আমি ঢাকা চলে যাবো। আমি যাবার আগে আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।

– ঠিক আছে মোবাইলে বলেন।

– না সাজু ভাই, সরাসরি বলতে হবে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ডানদিকে সামান্য হাঁটলে দেখবেন একটা রেস্টুরেন্ট। আমি সেখানেই আছি, তবে আশা করি আপনি একা আসবেন।

– আপনি ফিরোজ সাহেবকে খুন করেছেন কেন?

– সেটা বলার জন্য আপনাকে আসতে বলছি। কারণ আপনার সঙ্গে দেখা করে রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ ঠান্ডা কফি খাবার কোনো সখ নেই।

– ঠিক আছে আমি আসছি, দাঁড়ান আপনি।

– আবারও বলছি পুলিশকে জানাবেন না, এখানে তাহলে অনেক খুনাখুনি হবে। আমাকে গ্রেফতার করার চেয়ে এই মুহূর্তে আপনার লতাকে রক্ষা করা জরুরি। আমি যদি চট্টগ্রাম থেকে এখন চলে না যেতাম তাহলে তাকে ঠিকই নিরাপত্তা দিতাম।

– আপনি নিরাপত্তা দিবেন? যার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা স্বামীকে আপনি খুন করেছেন তাকেই আপনি খুন করেছেন। আবার বলছেন তাকে নিরাপত্তা দিবেন আপনি।

– তর্ক করতে চাই না, পৃথিবীতে আমাদের প্রতিটি মানুষের হিসাব আলাদা। লতার স্বামীর অপরাধ ছিল তাই তার হিসাব আলাদা হয়েছে। লতা খুব ভালো এবং অসহায় একটা মেয়ে তাই তাকে আমি সাহায্য করতে চাই।

– ওকে আমি যাচ্ছি ওখানে, আমার সঙ্গে রামিশা থাকলে কোনো সমস্যা আছে?

– না নেই, আপনি আসেন। মনে হয় এখনো লাঞ্চ করেননি, একসঙ্গে লাঞ্চ করতে করতে কথা হবে আমাদের।

কল কেটে দিয়ে সাজু লতাকে বললেন,

– আপনি একটু থাকেন আমি একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

– ওই খুনির সঙ্গে?

– হ্যাঁ, সে আমাকে কিছু বলতে চায়।

– আপনি পুলিশ নিয়ে যান, তাহলে তো তাকে ধরতে পারবেন।

– তাহলে সে আর সামনে আসবে না। আমি আগে জানতে চাই আপনার স্বামীর প্রতি তার কেন এই প্রতিশোধ। রবিউলের সেই কথিত ছোটবোনের করুন অবস্থার জন্য আপনার স্বামী কীভাবে দায়ী? সবকিছু তার কাছে জানতে চাই। আমি তাকে যতটুকু চিনি তাতে করে সে নিরপরাধ কাউকে খুন করে না।

– আপনি ওই খুনির বিষয় বেশ পজিটিভ।

– না, অপরাধ তো অপরাধই। আমি শুধু আমার মনের প্রশ্ন গুলোর উত্তর চাই।

– আমার হাসবেন্ডের লাশ কোথায়?

– চট্টগ্রাম মেডিকেলে, পোস্টমর্টেম করা হবে।

– আমি ওর লাশ নিয়ে ঢাকায় ফিরবো।

– আচ্ছা।

★★

রবিউল হাসপাতালেই ছিল। সাজুকে হাসপাতাল থেকে বের করার জন্য সে এই মিথ্যা কৌশলটুকু প্রয়োগ করেছে। সাজু হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাবার সময় রবিউল তাকিয়ে রইল।

সাজু বের হবার সঙ্গে সঙ্গে লতার নাম্বারে কল দিল রবিউল। যদিও তার ধারণা ছিল লতার সঙ্গে নিজের মোবাইল না ও থাকতে পারে। কিন্তু একটু আগে লতা ঢাকায় তার বাবার সঙ্গে কথা বলেছে তাই মোবাইল তার হাতেই ছিল।

লতা বললো,
– হ্যালো কে বলছেন?

– আমি রাফসান মাহমুদ।

নাম শুনেই লতার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,

– তুই আমাকে কল দিয়েছিস কেন? তোর সাহস কতবড়!

– আমি জানতাম আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। ভেবেছিলাম আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে ঢাকায় ফেরত যাবো। কিন্তু আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন তাহলে তো কিছু করার নেই ম্যাডাম।

– তোকে করবো বিশ্বাস? তোর মনে কি একটুও দয়ামায়া নেই? তুই তো নিজের চোখে দেখলি আমি আমার স্বামীর ছবিটি দেখে কান্না করতাম। তাহলে তারপরও তুই কীভাবে পারলি তাকে খুন করতে।

– দেখুন তাকে না মারলে এতক্ষণে আপনি হয়তো মারা যেতেন। তাদের সব পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেছে শুধু আমি তাকে মেরেছি বলে।

– আমাকে বোকা মনে হয়? ফিরোজ তো মারা গেছে তাহলে আমাকে গুলি করেছে কে? আসলে তুই সবকিছুর আসল কালপ্রিট সেটা আমি ভালো করে বুঝতে পারছি। আমার স্বামীকে খুন করে এখন আমার সঙ্গে ভালো হবার অভিনয় তাই না? স্টেশনের বাইরে তুই আমাকে গুলি করেছিস আমি নিশ্চিত।

– আজব তো, কেন করবো এটা?

– কারণ তাহলে তোর চিঠির কথা অনুযায়ী আমি স্টেশনকে বিপজ্জনক মনে করবো। তারপর তোর উপর বিশ্বাস করে তোর সব কথা শুনবো তাই না?

– ধুর, উল্টাপাল্টা বুঝেন কেন? আচ্ছা বাদ দেন। আপনার স্বামীকে আমি খুন করা জরুরি ভেবেছি তাই খুন করেছি। আপনার ওই গোয়েন্দা সাজু আর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পারলে আমার কিছু করে দেখান।

– করবো তো ঠিকই, কিন্তু তুই আমার সন্তানের বাবাকে খুন করেছিস। পৃথিবীতে আসার আগেই ওকে পিতৃহারা করেছিস তোর ক্ষমা নেই।

– ক্ষমা করতে হবে না, আপাতত নিজেকে রক্ষা করে তারপর অন্য কাজ করেন। আপনিই যদি না বাঁচেন তাহলে আপনার সন্তান কীভাবে দুনিয়ায় আসবে?

– আচ্ছা তুই বলেছিলি আমার নাকি তিনজন শত্রু আছে। কে কে আছে নাম বল।

– আপনার বাবা।

– কিহহ…?

– অবাক হবার কিছু নেই। আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন উনি আপনার আসল বাবা নয়। আপনার আসল বাবা মৃত্যুর পরে তার খালাতো ভাই মানে এখন যাকে আপনি বাবা বলে ডাকেন তাকে আপনার মা বিয়ে করেন।

– এসব আপনি কীভাবে জানেন?

– দুঃখিত ম্যাডাম, কৈফিয়ত দিতে চাচ্ছি না। যে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারে না তার সঙ্গে কথা বলার রুচি নেই।

– আপনি কীভাবে জানেন সে আমাকে খুন করতে চায়? বলেন তো।

– কারণ আজ থেকে পাঁচ মাস আগে আপনাকে খুন করার জন্য আপনার বাবা আমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছিলেন। কিন্তু আমি উপযুক্ত কারণ ছাড়া কাউকে খুন করি না। তিনি আমাকে কোনো কারণ দেখাতে পারেননি তাই আমিও আপনাকে মারার কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করিনি।

– আপনি আবারও সাজিয়ে মিথ্যা বলছেন।

– মোটেই মিথ্যা কথা নয়, আপনার হাসবেন্ডকে দিয়ে আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছে আপনার বাবা নিজে। তিন কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে তাদের মধ্যে।

চলবে…

– I Love You 💙💙

– I Love You Too 💙💙💙💙

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।