চিরকুট পর্ব-০৩

0
116

#চিরকুট ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
যাইহোক, এইসব টুকরো কিছু দিন পেরিয়ে অবশেষে সৃজা আর গৌরবের বিয়েটা হয়েই গেল এরপর। দিনটা ছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহের চার তারিখ। রেজিস্ট্রির পর ওরা এসে উঠেছিল এই নতুন ফ্ল্যাটে। সঙ্গে সমীরণবাবু আর অনন্যাও ছিল। তবে ওরা আশা করেনি সৃজা প্রথম দর্শনেই ওদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে হাসি মুখে ঘরে নিয়ে আসবে। খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলবে! যদিও ওনারা ভীষণ গম্ভীর ছিলেন প্রথম থেকেই।
যাইহোক, সেদিন রাতে গৌরব নিজেই কিছু কুচো ফুল এনে ছড়িয়ে দিয়েছিল খাটে। ওদের জন্য তো এই দিনটাকে কেউ সাজালো না! মা বাবা তো এমন মুখ করে রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বাড়ি এসেছে যেন বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ছেলের জীবনে! তাই গৌরবই চেষ্টা করছে নিজের মতন করে যত টুকু সম্ভব দিনটাকে স্পেশ্যাল করার। তবে সৃজা ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসে খুব অবাক হয়ে গেছিল এইসব দেখে! তার মানে ফুলসজ্জা হবে ওদের। যদিও যাকজমক নেই। তবে গৌরবের ছড়ানো এই ফুলের কুচিই সৃজার মুখে হাসি এনে দিল। সৃজা এরপর গৌরবের খুব কাছে গিয়ে বলেছিল,
——–” আজ আমি সত্যি ভীষণ খুশি। আমি আসলে কখনো ভাবিনি, কারোর কাছে আমি এতটা দামী হবো! এন্ড ইউ মেক মি ফিল স্পেশ্যাল অল দ্যা টাইম..”
এই কথায় গৌরব সৃজা কে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
——-” বিকজ ইউ আর স্পেশ্যাল.. তুমি নিজেও জানো না যে তুমি ঠিক কতটা ভালো মানুষ! এন্ড আই এম রিয়ালি লাকি টু হ্যাভ ইউ ইন মাই লাইফ.. ”
কথাটা শেষ করে ও আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরেছিল সৃজাকে নিজের মধ্যে। তবে এরপর হঠাৎ গৌরব খুব আনমনা হয়ে বলে উঠেছিল,
———” কিন্তু আমার খুব টেনশন হচ্ছে। বাবা মা যেরকম গম্ভীর মুখ করে আছে! ওরা তো তোমার সাথে ঠিকভাবে কথা অব্দি বলছে না! সত্যি এইসব দেখে এত বাজে লাগছে আমার! আর একই বাড়িতে থেকে যদি এরপর অশান্তি বাড়ে! ওরা যদি খারাপ ভাবে বিহেভ করে তোমার সাথে! তাহলে কি হবে? ”
এই কথায় সৃজা একটু সময় নিয়ে গৌরব কে শান্ত করে বলেছিল,
———-” এত ভেবো না তুমি। এতটা টেনশনেরও কিছু নেই। আসলে আমি ওদের দিকটাও বুঝি। ছোট থেকে মানুষ করেছে তোমাকে। এরপর নিজের ছেলের বউ এর জন্য কিছু এক্সপেকটেশন তো থাকতেই পারে ওদের! সেখানে তুমি নিজের মতন একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে। এতে ওদের খারাপ লেগেছে। আর যদি সেই জন্য কিছু রিয়্যাক্ট করেও ফেলে আমার ওপর, আমি খারাপ ভাববো না। আর সব কিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দাও। সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়। ”
শেষ কথাগুলো আলতো হেসে বলেছিল সৃজা। কিন্তু গৌরব এবার হঠাৎ খুব থমকে বলেছিল ওকে,
——-” একটা প্রমিজ করো আমাকে আজ প্লিজ, যে তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না? যা ই পরিস্থিতি আসুক! আসলে আমি পারবো না আর তোমাকে ছাড়া থাকতে! সত্যি পারবো না। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবের চোখটা ভিজে এসেছিল কেমন নিজে থেকে। এটা দেখে সৃজা খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল ওকে, ঠিক একটা ছোট্ট বাচ্চার মতন। তারপর খুব স্থির গলায় বলেছিল, ——–” আমি কোথাও যাবো না। কক্ষনো যাবো না। আই প্রমিজ..”
কথাটা বলে সেই মুহূর্তে ভীষণ ভালোবেসেছিল সৃজা গৌরবকে। আজকের রাতে দুজনে সমস্ত দূরত্ব কাটিয়ে এক হয়ে গিয়েছিল নিঃশব্দে।
তবে বিয়ের পরেরদিন সকাল সকাল যখন অনন্যা চা বানাতে গেছিল রান্নাঘরে, তখন অবাক চোখে দেখেছিল সৃজার চা বানানো হয়ে গেছে। মেয়েটা ওনাকে দেখে বেশ ব্যাস্ত হয়েই বলে উঠলো,
——-” মা, আপনি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসুন, আমি চা দিচ্ছি। ”
এই কথায় অনন্যা কোন উত্তর না করেই বেরিয়ে এসেছিল রান্নাঘর থেকে। তবে উনি আর সমীরণ বাবু এরপর সৃজার হাতের আদা আর এলাচ দেয়া চা খেয়ে সত্যি ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিল। যদিও মুখে কিছু প্রকাশ করেনি। তবে গৌরব বলে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে,
——-” এ তো দারুণ চা হয়েছে! সত্যি। ”
সেদিনের পর সৃজা তবে অনেক সময়ই অফিস থেকে ফিরে রাতের রান্না করতো। কখনো লুচি আলুর দম, কখনো মাংস, কখনো ছানার ডালনা। আর সব সময় খেয়াল রাখতো অনন্যার কোন ব্রত ষষ্ঠী কিছু আছে কি না! আসলে বিয়ের আগেই গৌরবের কাছে শুনেছিল ওর মা খুব ঠাকুর ভক্ত। আঁশ নিরামিষ ভীষণ ভাবে মেনে চলে। সৃজা তাই সেই মতনই রান্না করতো সব সময়। যদিও সকালটা কাজের লোক রান্না করে দিত। এই রান্নার মাসিকেও সৃজাই ঠিক করেছে। ও চায় না গৌরবের মা এই বয়সে গরমের মধ্যে রান্নাঘরে ঘাম ঝরাক!
কথাটা যখন ছেলের মুখে প্রথম শুনেছিল অনন্যা, কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়েছিল বৈকি। আসলে যেই কথাটা এতদিন বর বা ছেলে কেউই ঠিক ওর জন্য ভাবেনি, সেই কথাটা ওই দুদিনের মেয়ে এসে ভাবলো এত সহজেই! তাই সৃজার জন্য মনটা বদলাতে শুরু করেছিল অনন্যার।
<৬>
কিন্তু এরপর কটা দিন পার করে একটা ঘটনা ঘটলো। গৌরব সেই সময় অফিসের কাজে দিল্লী গেছিল। ফ্ল্যাটে সৃজা অনন্যা আর সমীরণ বাবুই ছিল। যাইহোক, সেদিন রাতে রোজের মতন ডিনার করে সবাই ওই এগারোটার দিকেই শুয়ে পরেছিল। সৃজাও কিছুক্ষণ গৌরবের সাথে ভিডিও চ্যাট করার পর গভীর ঘুমে চলে গেছিল। আসলে আজ ব্যাঙ্কে ভালোই খাটাখাটনি হয়েছে। তাই শরীরটাও ক্লান্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎই রাত দুটোর সময় ওর ঘরের দরজায় আওয়াজ। অনন্যা প্রায় আর্তনাদ করে ডাকছে সৃজা কে। সেই মুহূর্তে সৃজা তো প্রায় ধড়ফড় করে উঠেছিল ঘুম থেকে! তারপর বেশ ঘাবড়েই দরজা খুলে দেখেছিল গৌরবের মায়ের এলোমেলো চেহারা। উনি যেন কেমন উদভ্রান্তের মতন ছুটে এসেছে এখানে। কিন্তু সৃজার কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনন্যা বলে উঠেছিল,
——–” ওর বাবার বুকে খুব যন্ত্রণা করছে হঠাৎ! ঘুমের মধ্যে কেমন ছটফট করে উঠলো! আমি বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। তুমি চলো একবার।”

কথাগুলো ভীষণ অসহায় গলায় বললো অনন্যা। কিন্তু সৃজা অনন্যা কে শান্ত করে বলে উঠলো,
——–” চিন্তা কোরো না তুমি। আমি যাচ্ছি বাবার কাছে। আর কিছু হবে না বাবার! আমি এম্বুলেন্সে কল করছি। এইভাবে সারা রাত ফেলে রাখাটা ঠিক না। ”
কথাটা বলেই সৃজা এম্বুলেন্স বুক করলো একটা। সাথে একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে বেডও বুক করলো নিজের ফ্যামিলি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে। তারপর প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই সমীরণ বাবুকে নিয়ে এসে এডমিট করলো ‘ সঞ্জীবনী ‘ নার্সিং হোমে। যদিও অনন্যা এর মধ্যে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করেছিল। এদিকে গৌরব কে কল করেও কেউ পায়নি। ওর ফোনটা সুইচ অফ ছিল সারাক্ষণ। তবে সমীরণ বাবুকে ডাক্তার দেখে বলেছিল মাইল্ড এটাক হয়েছে একটা। স্ট্রেন বসাতে হবে দুটো। তাই অপারেশনের পর আই.সি.ইউ তে রাখতে হবে ওনাকে। সব মিলিয়ে খরচ পড়বে প্রায় আশি হাজারের কাছাকাছি। আর এখনই হাফ টাকা জমা দিতে হবে নার্সিং হোমে। কথাটা শুনে অনন্যা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল করিডোরের বেঞ্চটায়! এতগুলো টাকা এখন ও কোথা থেকে দেবে! এইসব ব্যাঙ্কের কাজ তো সব সময় সমীরণ বাবুই করতো। কোথায় কোন একাউন্টে কি টাকা আছে, এসব তো কিছুই জানা নেই অনন্যার! এদিকে গৌরব কেও পাচ্ছে না ফোনে! এখন এত তাড়াতাড়ি এতগুলো টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবে ও! এই কথাগুলোই ভাবছিল কেমন অস্থির হয়ে, তখনই কানে এলো সৃজার কথা। মেয়েটা ডাক্তারকে খুব দৃর গলায় বললো,
——-” আপনি টাকা নিয়ে একদম ভাববেন না। আমি এক্ষুনি পে করে দিচ্ছি। কিন্তু প্লিজ, আপনার যা ট্রিটমেন্ট করার করুন। প্লিজ ওনাকে সুস্থ্য করে দিন যেভাবেই হোক। ”
সৃজার কথাটা শুনে অনন্যা যেন থমকে গেছিল সেই মুহূর্তে। এই বিপদের দিনে মেয়েটা ওদের এইভাবে সাহায্য করলো! অনন্যা আর সমীরণ বাবু তো কোনদিন একটু হাসি মুখে অব্দি কথা বলেনি সৃজার সাথে। কথাটা ভেবেই কেমন লজ্জায় চোখ নেমে গেল ওর আপনাআপনি। কিন্তু সেদিন এই থমকে থাকা মনেই ও খেয়াল করলো সৃজা কিরকম দৌড়াদৌড়ি করে কখনো ব্লাড জোগাড় করা, কখনো ওষুধ ইঞ্জেকশন নিয়ে আসা, নার্সিং হোমের ফর্মালিটিজ সব একা হাতে সামলাচ্ছিল। তারপর অপারেশন হয়ে যখন সমীরণ বাবুকে বেডে দিল অবশেষে, তখন ভোর হয়ে গেছে এই শহরে। তবে ডাক্তার এসে এই মুহূর্তে ওদের বলেছিল সমীরণ বাবু আউট অফ ডেঞ্জার.. আর কোন ভয়ের কারণ নেই।
সেদিন এই নতুন সকালে অনন্যা ভেজা চোখে সৃজার হাত দুটো ধরে বলেছিল,
——–” তুমি আজ যেটা করলে মা, আমি কোনদিন ভুলবো না! তোমার জন্যই ও ঠিক আছে আজ। শুধু তোমার জন্য। ”
এই কথায় সৃজা খুব অবাক হয়ে বলেছিল,
——–” মা, এইসব কেন বলছো! আমরা তো একটা ফ্যামিলি। আর ফ্যামিলি তে কোন ক্রাইসিস হলে তো শক্ত হয়েই সব সামলাতে হয়। আর আমি সত্যি এমন কিছু করিনি বাবার জন্য। যা করেছে, ডাক্তাররা করেছে। যাইহোক, এখন একটু শান্ত হও। সারা রাত অনেক টেনশন করেছো। ”
কথাগুলো আলতো হেসে বলেছিল সৃজা। তারপর অনন্যাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে কফি খাইয়েছিল জোর করে। কিন্তু সেদিন সমীরণ বাবুর জ্ঞান ফেরার পর অনন্যার মুখে সব শুনে নিজেও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল হঠাৎ! আসলে এই মেয়েটাকে প্রথম থেকে খুব ছোট চোখে দেখেছিলেন উনি। অনাথ, রক্তের ঠিক নেই, জাতহীন এইসব ভেবেছিলেন সব সময়। কিন্তু মানুষ হিসেবে কখনো বিচার করেননি সৃজার চরিত্র। তবে আজ সত্যি মনে হলো, মেয়েটা মানুষ হিসেবে এই সমস্ত কিছুর ওপরে। ভীষণ ভালো একটা মনের মেয়ে। নইলে এইভাবে এই বিপদের সময়ে পাশে থাকতো না ওদের! মনে হয়েছিল, আজ যেই নতুন জীবনটা পেয়েছেন উনি, সেটা শুধুমাত্র সৃজার জন্য।

তবে সেদিন ওই সকাল আটটার দিকে গৌরব ফোন করেছিল অনন্যাকে। আসলে কাল রাতে ফোনে চার্জ ছিল না বলে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গেছিল হঠাৎ। তারপর মোবাইলটা চার্জে রেখে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্লান্ত শরীরে। এমনিতেও ফ্লাইট জার্নি করেছিল কাল! কিন্তু আজ সকালে ফোন খুলে বাড়ি থেকে সবার এতগুলো মিস কল দেখে তো গৌরব ভীষণ ঘাবড়ে গেছিল! তাই খুব চিন্তা নিয়েই ফোন করেছিল মা কে। তবে অনন্যা ফোন ধরে আজ ভেজা স্বরে বলেছিল,
———” কাল তোর বাবার একটা হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল রাতে! আমি তো দিশেহারা হয়ে গেছিলাম ওকে ওইভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে! কিন্তু সৃজা এরপর সবটা সামলেছে একা হাতে। এম্বুলেন্স বুক করা থেকে বেড এরেঞ্জ, তোর বাবার অপারেশনের জন্য টাকা জমা দেয়া, ওষুধ ইঞ্জেকশন কেনা, রক্ত জোগাড় করা, সব কিছু করেছে ও সারা রাত জেগে! সত্যি রে বাবু, সৃজাকে একটা সময় কত ভুল বুঝেছিলাম আমরা! কখনো ভালো মুখে কথা অব্দি বলিনি। কিন্তু মেয়েটা আমাদের জন্য কাল থেকে এত করলো! সারা জীবন ঋণী করে দিল আমাদের। ”
কথাগুলো খুব স্তব্ধ গলায় বলেছিল অনন্যা। কিন্তু গৌরবও এই সময় কেমন শব্দহীন হয়ে গেছিল যেন। বাবার হার্ট এটাক হয়েছিল কাল! কথাটা ভেবেই বুকটা কেঁপে উঠছিল কেমন। তবে সৃজার কথাও মনে হচ্ছিল খুব। বাবার জন্য মেয়েটা এত কিছু করলো! সেই মানুষটার জন্য; যে একদিনও সৃজাকে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেনি। ভালো মুখে কথা বলেনি! তবে আজ মার কথাগুলো শুনে মনে হলো এতদিনে যেন ওরা বুঝেছে মেয়েটার মূল্য। বুঝেছে, গৌরব কোন ভুল করেনি সৃজাকে বিয়ে করে! সৃজা কে ভালোবেসে।
( চলবে।