চিরকুট পর্ব-০৫

0
87

#চিরকুট ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
সেদিন এরপর যখন সৃজার জ্ঞান ফিরেছিল তখন সন্ধ্যে নেমেছে শহরে। সূর্যের আলো শেষ হয়ে অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারিদিক। তার মধ্যেই নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে কেমন নিস্তেজ শরীরে চোখ খুলেছিল সৃজা। পেটে তখনও কিছুটা যন্ত্রণা ছিল। তবে জ্ঞান ফিরতে প্রথম ও সামনে দেখেছিল গৌরবকে। সৃজার হাত ধরে স্থির ভাবে বসে আছে ছেলেটা। কিছু যেন একটা ভাবছিল! তখনই সৃজা ওর নাম ধরে ডেকে উঠলো সেই মুহূর্তে, আর ওর গলার আওয়াজে স্তম্ভিত ফিরলো ছেলেটার। গৌরব তখনই বেশ ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
——” ঠিক আছো তুমি? কষ্ট হচ্ছে কিছু? ডাক্তার কে ডাকবো? ”
এতগুলো প্রশ্ন শুনে সৃজা শুধু একটা কথাই বলে উঠলো এবার,
——–” আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো গৌরব? ওর কিছু হয়নি তো? ”
কথাটায় গৌরব যেন স্তব্দ হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। কি বলবে, কি উত্তর দেবে, কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না! সৃজা তখন ওর হাতটা ঝাঁকিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে,
——–” কি হলো? কিছু বলছো না কেন! ঠিক আছে তো আমার বাচ্চা? ”
এই প্রশ্নে গৌরব এবার নিজের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে ভীষণ আস্তে গলায় বললো,
———” বাচ্চাটা আর নেই। নষ্ট হয়ে গেছে। ”
কথাটা শুনে সৃজা এবার পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গেল হঠাৎ! গৌরব কে আঁকড়ে ধরা হাতটা আলগা হয়ে এলো ওর; কিছু বলার মতন শক্তি যেন হারিয়ে ফেললো সেই সময়! শুধু চোখ থেকে অঝোরে জল পড়তে শুরু করলো নিঃশব্দে, আর সৃজা বেঁচে থেকেও মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করলো আজ। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা।
এরপর কদিন ধরে গৌরব ওকে অনেক কথা বলানোর চেষ্টা করেছে। অনেক রকমভাবে বুঝিয়েছে। ভালোবেসে, কেঁদে সৃজাকে আঁকড়ে ধরেছে বার বার। কিন্তু মেয়েটা কোন কিছুতেই সাড়া দেয়নি। আসলে সৃজা কেমন শেষ হয়ে গেছিল যেন ভেতরে ভেতরে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল শরীরের মধ্যে যেই প্রাণটা ছিল, সেটা আর নেই! ওর সন্তান আর নেই। যে একদিন বড় হতো, পৃথিবীর আলো দেখতো, ওকে মা বলে ডাকতো, সেই ছোট্ট প্রাণটা আর কোথাও নেই! কথাটা যতবার মনে হচ্ছে সৃজার মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কষ্টে। বুকের মধ্যে অদ্ভুৎ একটা যন্ত্রণা চেপে ধরছে ওকে। কিছুতেই যেন সেই বুক ভাঙা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সৃজা! আর এই যন্ত্রণার ভিড়ে কোন কথা আসছে না আর ওর। শব্দ গুলো কেমন হারিয়ে যাচ্ছে আসলে! কি বলবে; কিভাবে আবার নতুন করে সব শুরু করবে, কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না। শুধু নিঃশব্দে চোখে জল এসে জমছে। আর সৃজা শেষ হয়ে যাচ্ছে রোজ নিজের মধ্যে।
তবে এরপর তিনদিন বাদে নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়েছিল সৃজা। যদিও মনের সাথে শরীরটাও ভীষণ ক্লান্ত ছিল! মিসক্যারেজ এর কষ্টটা আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ছিল ওকে। এর মধ্যেই গৌরবের হাত ধরে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসেছিল ও। কিন্তু অনন্যা দরজা খুলে আজ ভীষণ কঠিন মুখে দাঁড়িয়েছিল সৃজার সামনে। সমীরণ বাবুও চুপ করে বসেছিল সোফায়। তার মধ্যেই গৌরব সৃজাকে ধরে ধরে ড্রইং রুমে এনেছিল। এই সময় সৃজার বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। তাই ও কারোর সাথে কোন কথা না বাড়িয়ে ই সৃজা কে নিয়ে ভিতরে বেড রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখনই অনন্যা বলে উঠলো ভীষণ কঠিন স্বরে,
——–” বলেছিলাম আমি, চাকরিটা ছেড়ে দিতে। শুনলে না। এত টাকার লোভ তোমার! শেষে নিজের বাচ্চাকে নিজেই মেরে ফেললে! ”
কথাগুলো ভীষণ বিষ মেশানো গলায় বলেছিল অনন্যা। সৃজা কথাটা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিল এক জায়গায়। কিন্তু গৌরব চিৎকার করে বলে উঠেছিল,
——–” মা! কি বলছো তুমি! এসব কথা কিভাবে বলছো তুমি? মেয়েটা এই বাড়ি ফিরলো, আর তুমি! ”
না, ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই সমীরণ বাবু এবার বললো ভীষণ উত্তেজিত হয়ে,
——-” থাম তুই বাবু। নিজের মায়ের ওপর চিৎকার না করে যদি ঠিক সময়ে নিজের বউকে আটকাতিস চাকরি করতে যেতে; তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের! সত্যি বৌমা, বাচ্চাটাকে তুমি মেরেই ফেললে এইভাবে?”
শেষ কথাটা উনি সৃজার দিকে তাকিয়ে বললেন ভীষণ তাচ্ছিল্যের স্বরে। সৃজা এবার কোনভাবেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না যেন! প্রচণ্ড ভাবে কেঁদে উঠলো সবার সামনে। তবে এবার গৌরব সৃজাকে শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
——-” শাট আপ বাবা। জাস্ট শাট আপ। আর কিভাবে পারো তোমরা একজনকে এই পরিস্থিতিতে এইরকম কথা শোনাতে? আর তোমরা কি ভুলে যাচ্ছো, কদিন আগে এই মেয়েটাই তোমাদের বিপদে কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? ”
এই প্রশ্নে অনন্যা এবার সাথে সাথেই বলে উঠলো,
——–” তার জন্য তো ওর এত বড় অন্যায়টাকে ক্ষমা করা যায় না! আর ওর সাথে তো তোর জীবনটাও জড়িয়ে! এই মেয়েটা তো কোনদিন আর মা হতে পারবে না। ডাক্তার বলেই দিয়েছে। এই এক্সিডেন্টএ ওর ইউট্রাসটা এমন ভাবে ড্যামেজ হয়েছে যে ওর আর বাচ্চা ধরে রাখার কোন ক্ষমতাই নেই! ওর একটা ভুল ডিসিশনের জন্য তুই সারাটা জীবন নিঃসন্তান হয়ে থাকবি। আর এরপরেও বলছিস আমাদের চুপ থাকতে? সেদিন যদি সৃজা আমার কথা শুনে চাকরিটা ছেড়ে দিতো, তাহলে আজ এত বড় দাম দিতে হতো না আমাদের! ”
কথাটা শুনে সৃজার যেন ধাক্কা লাগলো একটা! ও আর কোনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। মাথাটা ঘুরে গেল কেমন। গৌরব সেটা দেখে সৃজা কে আরো শক্ত করে নিজের কাছে ধরলো, তখনই সৃজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
——–” কি বলছে মা এইসব! এটা কি সত্যি? আমি কি সত্যিই আর কোনদিন! ”
কথাগুলোকে আর শেষ করতে পারলো না সৃজা। তার আগেই খেয়াল করলো গৌরবের চোখ দুটো নিচে নেমে গেছে এই মুহূর্তে। কোন উত্তর ঠিক দিতে পারছে না ছেলেটা ওকে। এই নিঃস্তব্ধতার মানে বুঝতে আর কোন অসুবিধা হলো না সৃজার! তার মানে এটাই সত্যি। সৃজা আর কোনদিন মা হতে পারবে না! ওর কোল সারা জীবন শূণ্যই থাকবে। কেউ আর নিজের ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরবে না! কারোর কাছ থেকে ‘মা’ ডাকটা শুনতে পারবে না সৃজা। এটা মনে হতেই হঠাৎ চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে এলো ওর। গৌরব, ওর মা বাবাকে ভীষণ আবছা মনে হলো চোখের সামনে, তারপর কয়েক সেকেন্ডের ভিড়ে সবটা অন্ধকার হয়ে এলো কেমন। সৃজা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গৌরবের বুকে ঢলে পড়লো। গৌরব সৃজাকে এইভাবে সেন্সলেস দেখে ঘাবড়ে গেল ভীষণ! ও সৃজা সৃজা বলে ডেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো ওকে। তারপর কোন রকমে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শোয়ালো।
সেদিন এরপর প্রায় আধ ঘন্টা বাদে ডাক্তার এসে সৃজাকে দেখে বলেছিল,
———” নার্ভে খুব চাপ পড়ে এরকম হয়েছে। ও এমনিতেই ভীষণ শক এ আছে এই মিসক্যারেজের জন্য। এরপর আর কোন রকম মেন্টাল প্রেশার আসলে নিতে পারছে না সৃজা। ”
কথাটা শুনে গৌরব থমকে গেছিল কেমন। আসলে বাড়ি আসার পর মা বাবা যেইভাবে সৃজার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো, তাতে নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব। ওর মা বাবার জন্য আজ মেয়েটা এইভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে! তবে আর না। সৃজাকে আর কোন রকম কষ্ট দেয়ার সুযোগ দেবে না গৌরব ওর মা বাবাকে; অনেক হয়েছে।
<১০>
সেদিন কথাটা ভেবেই গৌরব এরপর ড্রইং রুমে এসেছিল। অনন্যা আর সমীরণ বাবু নির্বিকার মুখে এই সময় টিভি দেখে যাচ্ছে। একটা মেয়ে যে ওদের জন্য এইভাবে সেন্সলেস হয়ে শুয়ে আছে পাশের ঘরে, তাতে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। দৃশ্যটা দেখে গৌরবের নিজেরই লজ্জায় চোখটা নিচে নেমে গেল, আর কেমন অদ্ভুৎ একটা রাগ এসে জমা হলো মনে। গৌরব এবার তাই কোন ভনিতা না করে সোজাসুজিই বললো,
——-” তোমাদের সাথে কিছু কথা আছে আমার। বলতে পারো রিকুয়েস্ট। আমি সৃজাকে নিয়ে একা থাকতে চাই এবার। তোমরা আজ যেইভাবে মেয়েটাকে হার্ট করলে, কথা শোনালে; আমার সত্যিই এরপর আর কিছু বলার নেই। আর তোমরা যখন ওকে সহ্য করতে পারোই না, তখন একই ফ্ল্যাটে একসাথে থাকার আর কোন মানে নেই মনে হয়। আর তোমরা সৃজাকে সামনে দেখলেই এরকম বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করবে প্রত্যেকবার, আর সেটা আমি হতে দিতে পারি না। আজ তোমাদের জন্য মেয়েটা এরকম সেন্সলেস অবস্থায় পড়ে আছে! ”

কথাগুলো ভীষণ রেগে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল গৌরব। এটা শুনে অনন্যা আর সমীরণবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লো! অনন্যা তো আর চুপ না থেকে বেশ বড় বড় চোখ করেই বললো,
——–” তুই ওই মেয়েটার জন্য আমাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছিস! যেই মেয়েটা এতটা কেয়ারলেস, যে পেটে বাচ্চা থাকা সত্বেও কাজে বেরোয়, যেই মেয়েটার ভুলের জন্য তুই কোনদিন জীবনে বাবা হওয়ার সুখ পাবি না, তার জন্য তুই নিজের মা বাবার সাথে এরকম ব্যাবহার করছিস! আমরা কি না করেছি তোকে বড় করার জন্য! আর আজ সেইসবের এই দাম দিবি? ”
কথাটায় গৌরব এবার আরো কঠিন গলায় বললো,
——–” আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম কারণ সারাটা জীবন একসাথে থাকবো বলে। হ্যাঁ,বাচ্চা আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা না হলে ওকে আমি ছেড়ে দেব, বা ওর জন্য আমার ভালোবাসা কমে যাবে, এরকম শর্ত ছিল না কখনো! আর একটা মেয়ে যদি কনসিভ করে, তার মানে এই না যে সে তার কাজকর্ম সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে। আমি নিজেও এটা বিলিভ করি না। যেটা হয়েছে, সেটা একটা এক্সিডেন্ট। এর জন্য কারোর কোন দোষ নেই! যাইহোক, আমি জানি তোমাদের এইসব বলে কোন লাভ নেই। তোমাদের যেটা ভাবার সেটাই ভাববে। আর যখন আমাদের কোন চিন্তাধারা মেলেই না, তখন আলাদা থাকা ভালো। ”
কথাগুলো খুব স্পষ্ট ভাবে বলেছিল গৌরব। কিন্তু এইসব শুনে সমীরণ বাবু খুব তির্যক স্বরে বলেছিল,
———” চলে যাবো আমরা কালই। তুই বলেছিলিস বলেই থাকতে এসেছিলাম এই ফ্ল্যাটে! নইলে আমাদের কোন ইচ্ছে ছিল না। আর একটা কথা; এই মেয়েটাকে নিয়ে তোকে জীবনে আরো পস্তাতে হবে। সেদিন হয়তো আমাদের কথা মনে পড়বে! ”

কথাগুলো বলেই সমীরণ বাবু আর দাঁড়ায়নি। ড্রইং রুমটা ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেছিল সেই মুহূর্তে। অনন্যাও এরপর আর কিছু বলেনি। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেছিল। কিন্তু গৌরব ভীষণ কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আজ একা! মাত্র কদিন আগে সৃজা বাবার জন্য কত কি করলো! আজ যে বাবা বেঁচে আছে সুস্থ্য শরীরে, সেটা শুধুমাত্র সৃজার জন্য। আর এত তাড়াতাড়ি সেই সমস্ত কথা ভুলে গেল মা বাবা! একটা মিসক্যারেজের জন্য এইভাবে একদিন সৃজা ওদের কাছে এতটা খারাপ হয়ে গেল! কথাগুলো ভেবে সত্যিই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল ও।
( চলবে)