চিরকুট পর্ব-০৬

0
94

#চিরকুট ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১১>
তবে এরপরের দিন সমীরণ বাবু আর অনন্যা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছিল নিজের বাড়ি। গৌরবের খারাপ লাগছিল সেই সময়। কিন্তু সৃজার কথা ভেবে এই আলাদা থাকার ডিসিশনটা নিতেই হলো ওকে। কিন্তু এসবের পরেও সৃজার মানসিক অবস্থা ঠিক হয়নি! বরং মেয়েটা অস্বাভাবিক ভাবে চুপ হয়ে গেছিল হঠাৎ! কথা বলতো না, ঠিকভাবে খেত না, চুল বাঁধতো না, অফিস যেত না দিনের পর দিন। সব সময় একা ঘরে বসে থাকতো স্থির হয়ে। গৌরব এই সময়ে ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে! বার বার বলেছে একটাই কথা,
——-” আমরা দুজনে দুজনের জন্য যথেষ্ট। আর কারোর আসার দরকার নেই আমাদের মধ্যে। প্লিজ তুমি বাচ্চার ব্যাপারে ভাবা বন্ধ করো। আমাদের দুজনের ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে ঠিক জীবনটা কেটে যাবে! ”
কথাগুলো সব সময় খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করতো গৌরব। সৃজা কে এটা বোঝানোর চেষ্টা করতো যে মা না হলে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে না! জীবনে ভাবার মতন আরো অনেক কিছু আছে। কিন্তু এইসব কথার শেষে সৃজা প্রত্যেকবার ডুকরে কেঁদে উঠতো ভীষণ। তারপর এলোমেলো হয়ে শুধু একটাই কথা বলতো,
———” আমি মা হতে চাই শুধু। আর আমার কিছুর দরকার নেই গৌরব! আর কিছু চাই না আমি। ”
কথাগুলো খুব অসহায় হয়ে বলতো সৃজা। গৌরব এসব শুনে নিজেও আর চোখের জলটা আটকাতে পারতো না! নিঃশব্দে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো সৃজাকে।
তবে সৃজার মা এসে সেদিন থমকে গেছিল কেমন। অগোছালো চেহারা, শুকনো মুখ, আর এক রাশ নিঃস্তব্ধতার মাঝে নিজের মেয়েকে দেখে কেমন শেষ হয়ে গেছিল যেন আনন্দি ভিতরে ভিতরে। কিন্তু আর দেরি না করে আনন্দি এবার গৌরবকে সরাসরি বলেছিল,
———” তুমি একজন ভালো সাইকোলজিস্ট এর সাথে কনসাল্ট করো। সৃজার অবস্থা আমার ভালো লাগছে না! ও সিভিয়ার ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ”
কথাগুলো শুনে গৌরব কি বলবে ঠিক বুঝতে পারেনি! আসলে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর এই সময়ে। সৃজার সাথে দিনগুলো ওর কি সুন্দরই না কাটছিল এক মাস আগে পর্যন্তও! কিন্তু এই একটা এক্সিডেন্ট, সব কিছু বদলে দিল যেন কেমন। পুরো জীবনটাই ছন্নছাড়া হয়ে গেল হঠাৎ দুজনের।

তবে সাইকোলজিস্ট সৃজার সাথে কথা বলে এটা বুঝেছিল যে ও যেভাবেই হোক মা হতে চায়! এই মিসক্যারেজটা ও মেনে নিতে পারছে না কোনভাবেই। আর এই ঘটনার জন্য সৃজা অবচেতন মনে নিজেকেই রেসপনসিবেল ভাবে। সেই অপরাধবোধটা থেকে ও বেরোতে পারছে না আসলে। কথাগুলো সাইকোলজিস্ট রিমা বসু গৌরব কে আলাদা ডেকে বলেছিল। গৌরব এইসব শুনে কিরকম নিশ্চুপ হয়ে গেছিল যেন। বুঝতে পারছিল এই ভাবনাটা ওর মনে মা বাবাই ঢুকিয়েছে। সেদিন হসপিটাল থেকে ফেরার পর সৃজাকে যদি ওইসব কথা না বলতো ওরা, তাহলে হয়তো মেয়েটার মধ্যে এরকম অপরাধ বোধ জাগতো না এতটা তীব্রভাবে! এইসবই ভাবছিল সেদিন গৌরব চুপ করে। তখনই সাইকোলজিস্ট রিমা বসু বলে উঠলো,
——–” হোয়াই ডোন্ট ইউ এডপ্ট আ চাইল্ড? এটা হলে সৃজার জীবনে যে শূন্যতাটা তৈরি হয়েছে, সেটা আর থাকবে না। আমি শিওর একটা বাচ্চা ওর জীবনে এলে সৃজা এই ট্রমাটা কাটিয়ে উঠবে। ও আবার নতুন করে বাঁচতে চাইবে। ”
কথাটা শুনে গৌরব স্থির হয়ে গেল যেন কিছুক্ষণ! আসলে একটা অন্যের সন্তানকে নিজের ভেবে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে, এই ভাবনাটা ওর মধ্যে আসেনি কখনো। আর সত্যি বলতে, এইভাবে ভাবতেও চায়নি কোনদিন। হ্যাঁ, গৌরব বাবা হতে চেয়েছিল। তাই যেদিন সৃজার প্রেগনেন্সির খবরটা শুনেছিল, ভীষণ খুশি হয়েছিল মন থেকে। কারণ যে আসছিল সে ওর আর সৃজার একটা অংশ ছিল। তবে এই ফিলিংস গুলো কোন অচেনা বাচ্চার প্রতি আসবে না গৌরবের। ও সত্যি পারবে না একটা এডপটেড চাইল্ডকে নিজের সন্তান হিসেবে বাড়ি নিয়ে আসতে, তাকে বাবার ভালোবাসা দিতে সারা জীবন! কথাগুলো কয়েক সেকেন্ডে মনে এসে ভিড় করলো। গৌরব তাই এবার কিছুটা কঠিন হয়েই বললো,
———” আমি এডপশন চাই না। আপনি কাউন্সিলিং শুরু করুন সৃজার। আমিও সমস্ত রকম ভাবে পাশে থাকবো, চেষ্টা করবো সৃজাকে এই কষ্টটা ভুলিয়ে দিতে। ”
কথাগুলো শুনে রিমা বসু আর কোন কথা বাড়ায়নি। আসলে সত্যিই অন্যের সন্তানকে নিজের ভেবে বড় করার জন্য অনেক বড় মন মানসিকতার প্রয়োজন হয়। আর সেই চিন্তাধারা সবার মধ্যে থাকে না। আর এখানে তো জোর করারও কিছু নেই! তাই গৌরবকে কোনভাবে কনভেনশ করানোর চেষ্টা করেননি উনি।
তবে এরপর কদিন বাদে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যেটা গৌরবকে সব কিছু নতুন করে ভাবতে বাধ্য করিয়েছিল। সৃজা সেদিন বাড়িতে একাই ছিল। গৌরবের একটা মিটিং ছিল বলে ও বেরিয়ে গেছিল সকাল সকাল। তবে এই একা ফ্ল্যাটের নিঃস্তব্ধতা যেন দম বন্ধ করে দিচ্ছিল সৃজার হঠাৎ! শুধু মনে হচ্ছিল সেদিন যদি অফিস না যেত, সেদিন যদি সিড়ির রেলিংটা ধরে আরো বেশি সাবধানে নামতো নিচে, তাহলে হয়তো আজ ওর বাচ্চাটা বেঁচে থাকতো! ওর শরীরে বড় হতো আরো কদিন, ধীরে ধীরে! এইভাবে জীবনটাকে না দেখেই মৃত্যুর কাছে চলে যেতে হতো না ওইটুকু প্রাণকে! কথাগুলো ভেবেই মনে হচ্ছিল তাহলে গৌরবের মা বাবা ঠিকই বলেছে। ও ই দ্বায়ী এই সমস্ত কিছুর জন্য। ও ই শেষ করেছে নিজের সন্তানকে। আর এই পাপটাকে নিয়েই সারা জীবন বেঁচে থাকতে হবে এরপর! এমনকি কোনদিন আর মা হতে পারবে না সৃজা। কথাগুলো ভেবেই আজ প্রথম মনে হলো এই জীবনটা রেখে আর কোন লাভ নেই! এইভাবে বাঁচতে পারবে না সৃজা। রোজ বুকের মধ্যে যেই অসহ্য যন্ত্রণাটা হয় দিন রাত, সেটা সহ্য করতে পারবে না আর! এর থেকে ভালো নিজেকে শেষ করে দেয়া। কথাটা ভেবেই সেদিন সৃজা ড্রয়ার হাতড়ে একটা ব্লেড বার করেছিল। তারপর কিছু না ভেবেই সেটা চালিয়ে দিয়েছিল নিজের হাতের শিরার ওপর। তবে একবার ব্লেডটা চালালেও খুব গভীর ভাবে কাটেনি সৃজার হাত! রক্ত পড়তে শুরু করলেও সেই ক্ষততে মৃত্যু হবে না; এই ভেবেই তাই আরেকবার ব্লেডটা নিয়ে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করতে চেষ্টা করেছিল সৃজা। কিন্তু সেই মুহূর্তেই গৌরব এসে হঠাৎ টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ব্লেডটা, তারপর খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল ওকে। সেই সময় গৌরব প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠেছিল,
——–” কি করছিলে তুমি এটা! ভাগ্যিস আমার কাছে একটা ডুবলিকেট চাবি ছিল ফ্ল্যাটের, আর আমি ঠিক সময়ে চলে এলাম অফিস থেকে! নইলে তো সব শেষ হয়ে যেত! কেন করছিলে তুমি এইসব? একবারও আমার কথাটা মনে হলো না সৃজা? আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। ”
কথাগুলো বলে ও প্রচণ্ড ভালোবেসে জড়িয়ে ধরলো সৃজা কে। কিন্তু সৃজা এই মুহূর্তে জলভর্তি চোখে শুধু একটা কথাই বললো,
——–” আমি মা হতে চাই গৌরব! আমি এইভাবে বাঁচতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি শুধু আমার বেবিটাকে ফিরে পেতে চাই। ব্যাস। ”
কথাগুলো কেমন নিঃস্ব হয়ে বললো সৃজা। কিন্তু গৌরব এবার চুপ না থেকে সৃজাকে আশ্বস্ত করে বললো,
———” তুমি মা হবে। আমরা বাচ্চা এডপ্ট করবো। ঠিক আছে? সব কিছু নতুন করে শুরু করবো আবার। ”
কথাগুলো সৃজার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো গৌরব। কিন্তু সৃজা এইসব শুনে যেন অনেকদিন বাদে একটা আশার আলো খুঁজে পেল জীবনে! ও খুব স্থির হয়ে বলে উঠলো, ——–” সত্যি! সত্যি বলছো তুমি? আমরা বাচ্চা এডপ্ট করবো? আমি মা হবো? বাকি সবার মতন আমারও সন্তান হবে নিজের?”
প্রশ্ন গুলো শুনে গৌরব ঘাড় নাড়লো এবার। তারপর সৃজাকে আরেকবার নিজের মধ্যে আঁকড়ে ধরলো ভীষণভাবে। না, গৌরব কখনোই এই এডপশন চায়নি। তবে সৃজার জীবনের কাছে নিজের চাওয়া না চাওয়ার হিসেবগুলো ভীষণ ছোট, মূল্যহীন! ও মন থেকে অন্য একটা বাচ্চাকে নিজের জীবনে একসেপ্ট করতে না পারলেও সৃজার জন্য এই কম্প্রোমাইজটা করতেই হবে জীবনে। আর গৌরব সেটা করবেও। সৃজাকে একটা সুস্থ্য সুন্দর জীবন দেয়ার জন্য ও সব করবে। কালই অরফানেজ গুলোতে খোঁজ নেবে। সমস্ত ফর্মালিটিজগুলো জানবে।
( চলবে)