চিরবন্ধু পর্ব-০৬

0
63

#চিরবন্ধু
#পর্বঃ০৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ফিজার অবাক চাহনি, মিনির আহ্লাদী স্বর, আর গোফরান সিদ্দিকীর মুখ গোঁজ করে বসে থাকা সবটাই তাসনিয়াকে যতটা না অবাক করেছে, ততটাই অবাক করেছে আগন্তুকের আচরণ দেখে। তার পরিচয় জানার জন্য কারো মুখ কিছু শোনার প্রয়োজন হয়নি তার। মিনি আর গোফরান সিদ্দিকীর সাথে তার কথার ধরন দেখে সবটা বুঝতে পেরেছে সে। এটাও বুঝতে পেরেছে সে কোনো বিপদে পড়ে এখানে এসেছে তাই যত সম্ভব নিজেকে সামলে রান্নাঘরে চায়ের পানি দিল চুলোয়। ফিজা এসে উঁকি দিয়ে চাইলো। তাকে দেখে ঘাড় ফিরাতেই ফিজা আমতাআমতা করে বলল, “ছোট ভাবি ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।
– যাচ্ছি।
তাসনিয়া ঘরে যেতেই দেখলো গোফরান অবিরত পায়চারি করছে। তাকে দেখামাত্রই থামলো।
কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে জানতে চাইলো,
– শনিবার পর্যন্ত কি থাকা যায় না?
তাসনিয়া বলল,
– না যায় না। ইতোমধ্যে অনেক কামাই হয়ে গেছে। ফিজা থাকছে। রান্না-বান্নার কোনো অসুবিধে হবে না।
– বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করলে কি বলবে?
– একই কথায় বলব।
গোফরান চুপ থাকলো। অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখা তাসনিয়ার মুখে চোখ রেখে কপালে আঙুল বুলিয়ে বলল,
– রোহিনী সরকার আসাতে নিশ্চয়ই তোমার কোনো আপত্তি নেই? কারণ তোমার জানা আছে ওর সাথে মিনি কিংবা আমার..
– আমি যাকে চিনিনা তাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে পছন্দ করিনা।
গোফরানও এটাই জানতো। তানজিম যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তার কাছ থেকে অহেতুক প্রতিক্রিয়া সে পাবেনা রোহিনী সরকারের আগমনে। যেহেতু সে বিপদে পড়ে এসেছে সেহেতু তাকে যতটা সম্ভব একটা ফয়সালা করে তাকে বিদেয় করা উচিত। মিনির মা হয়ে উঠা সংযমী তাসনিয়া তানজিম বিষয়টা হজম করতে পারলেও গত কয়েকমাসের ব্যবধানে গড়ে উঠা প্রেমিকা স্বত্বা নিশ্চয়ই তা সহ্য করতে পারবে না? অতএব, ঝামেলা থেকে দূরে থাকায় বাঞ্ছনীয়।

মিনি বহুদিন পর মাম্মামকে পেয়েছে। তার দেয়া অনাদর, অবহেলা গুলো ছোট্ট মনটা মনে রেখে দিতে পারেনি। তার মায়ের কষ্ট দেখে সেও বিচলিত হয়ে পড়েছে। কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে কি হয়েছে, এতদিন কোথায় ছিল, কেন তাকে ছেড়ে গেল, কেন বাবাকে ছেড়ে গেল, তাকে কি মনে পড়েনা এই সমস্ত প্রশ্ন একনাগাড়ে করে গেল তার জন্মদাত্রীকে। ফিজা অনেকবার হাত বাড়িয়ে তার কোলে ডেকেছে কিন্তু সে এল না।
ফিজা ভীষণ রাগান্বিত হয়ে বলল,
– সরি রোহিনী সরকার, তুমি কি অন্য কোথাও যেতে পারতে না? কেন এখানেই আসতে হলো তোমাকে?
রোহিনী নিরুপায় হয়ে বলল,
– আমি গোফরানের অনুমতি নিয়েই এসেছি। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করো।
– রাতের বেলায় একটা মেয়েমানুষ তার কাছে সাহায্য চাইলে বিশেষ করে তার মেয়ের মা, তখন সে কি ফিরিয়ে দিতে পারবে? তুমি সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছ। তোমার চাইতে বেশি তো ভাইয়াকে কেউ চেনে না। তুমি জানতে ভাইয়া কখনো এতটা কঠোর হতে পারবে না তোমার সাথে তাই তুমি সবটা ভেবে এখানে এসেছ। তুমি কি জানো না এখানে ভাইয়ার সদ্য বিবাহিত বউ আছে।
রোহিনী সরকারের মুখটা তখন দেখার মতো হয়েছিলো। সে কেন গোফরানের অনেক দূরের আত্মীয়-স্বজনরাও এখনো জানেনা মিনির একটা মা এসেছে। বিয়েতেও সাত আটজন উপস্থিত ছিল। রোহিনী সরকার চুপ করে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ আগে মিনির সমবয়সী যে ছেলে বাচ্চাটাকে দেখেছিলো সে কে তাহলে?
– মিনি আসো। খাবে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। চলো।
মিনি তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইলো মুখ গোমড়া করে। মায়ের মুখের দিকে একপলক তাকালোও। ফিজা বলল,
– তুমি নিশ্চয়ই তোমার মেয়েকে অতটাও ভালোবাসো না? প্লিজ ওকে নামিয়ে দাও।
রোহিনী তার কথার জোরাজুরিতে নামাতে চাইলেও মিনি নামলো না। রেগেমেগে ফিজাকে বলল,
– আমি মাম্মামের সাথে খাব। তুমি পঁচা।
ফিজা তাকে রোহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইলে রোহিনীকে শক্ত করে ধরে রেখে কেঁদে উঠলো মিনি। রোহিনী বলল,
– থাক। আমি তো চলেই যাব। থাকুক না কিছুক্ষণ।
– যাবে কিন্তু এখন তো যাচ্ছ না। ওকে বুঝিয়ে কোল থেকে নামিয়ে দাও প্লিজ। আমি তোমার উপস্থিতি যতটা সহ্য করতে পারছিনা তার চাইতে বেশি অসহ্য লাগছে মিনিকে কোলে নিয়েছ বলে।
ফিজার কথার আঘাতে রোহিনী মিনিকে বুঝালো কিন্তু মিনি নামবে না। আর ঠিক তখনই দরজার পাশ দিয়ে ঘরের গিন্নিকে যেতে দেখলো রোহিনী। আরেকটু দেখতে ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু ফিজা সামনে থাকায় সেই ইচ্ছেটুকুকে দমিয়ে রাখলো। কিন্তু এই অল্প দেখায় তার অনেককিছু মনে হয়েছে।
গোফরান এসে বলল,
– মিনি তোমার মায়ের কাছে যাও। ফিজা ওকে নিয়ে যাহ। ওর সাথে জরুরি কথা আছে।
ফিজা বলল,
– ও আসছেনা কিছুতেই।
গোফরান হাত বাড়িয়ে বলল,
– মিনি এসো।
মিনি কেঁদে উঠলো মাকে ধরে রেখে। তার অবুঝ মন কিছুতেই বুঝতে চায় না এই মা-ই একদিন তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো।
ফিজা রেগে চলে গেল সেখান থেকে।

___

সে গোফরান সিদ্দিকীর জীবনে দ্বিতীয় মানুষ, আর গোফরান সিদ্দিকী তার জীবনে দ্বিতীয় মানুষ। এই সত্যটুকু সে মনেপ্রাণে স্বীকার করে গোফরান সিদ্দিকীর সাথে যতটা না সে জড়িয়ে পড়েছিল তার চাইতে বেশি জড়িয়ে পড়েছিল মা পাগল মেয়েটার সাথে। গোফরান সিদ্দিকীর আদর্শ স্ত্রী হওয়ার কোনো তাড়া না থাকলেও মিনির মা হয়ে উঠা তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জের মতো ছিল। শুরু থেকেই এই চ্যালেঞ্জে নিজেকে জয়ী মনে হলেও নিজের মাকে পেয়ে মিনির আনন্দ, আহ্লাদ, আবার মাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কান্নার ঝংকার সবটা তাসনিয়াকে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে চাইলেই মা হওয়া যায় না।
নিজেকে বারংবার বুঝ দিয়ে যাওয়া ভেতরস্বত্বার কাছ থেকে সংযমী মন এবার কোনো আশা পায়নি, কোনো সান্ত্বনা পায়নি । গোফরান সিদ্দিকীর জীবনে সে-ই এখন বর্তমান, সে-ই ভবিষ্যৎ এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেও মিনির মা হিসেবে তার জায়গাটা নিছকই একটা প্রয়োজন ছিল তা সে ভালো করেই বুঝেছে । একজন স্ত্রী, কিংবা প্রেমে পড়া প্রেমিকার মন নয় একজন মায়ের মনটা তখন ভীষণ রকম হিংসা আর ঈর্ষায় জ্বলছিলো ভেতরে ভেতরে। মিনির আদুরে কন্ঠস্বর যতই কানে আসছিলো, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকা মিনির সেই দৃশ্যটুকু যতবার চোখে ভাসছিলো ততবারই তাসনিয়ার চোখ জলে ভাসছিলো। আর মনে পড়ছিলো বিগত দিনগুলির কথা। ওই বয়সী একটা বাচ্চা তারও আছে বলেই হয়ত মা ছাড়া মিনির কষ্টগুলো সে অনুধাবন করতে পেরেছিলো খুব সহজেই। একজন বাবা-হীন সন্তানের চাইতে মা-হীন সন্তানের বেড়ে উঠা আরও ভয়ংকর কষ্টের। সেই ভয়ানক কষ্ট আর আঘাতে জর্জরিত, মায়ের অনাদর অবহেলায় পতিত মেয়েকে তার আপন করতে তাই দেরী হয়নি। অথচ আজ মনে হচ্ছে সব বৃথা চেষ্টা ছিল। একজন স্ত্রী কিংবা প্রেমিকার হিংসাত্মক মন যতটা না হিংস্র, মায়ের হিংস্র রূপটা তার চাইতেও বেশি ভয়ংকর তা স্বচক্ষে দেখেছিলো ফিজা আর গোফরান।
এতদিনের চেনাজানার দরুন তাসনিয়া তানজিমের কান্নাচাপা মুখটা বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিলো গোফরানের। সেই কান্নাচাপা মুখটাকে স্বাভাবিক রেখে সরাসরি রোহিনী সরকারের কোল থেকে মিনিকে নিজের কাছে ডাকলো, ডাকার পরও মিনি আসতে না চাইলে গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে রোহিনীর কোল থেকে তাকে কেড়ে নিয়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ দিয়েছিলো সে। ফিজা বেশ খুশি হয়েছিলো। আর গোফরান শুধু চেয়ে রইলো।
স্ত্রী আর প্রেমিকার কাছে তার নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত না হলেও মা হিসেবে তাসনিয়া তানজিম যে তার চাইতেও এগিয়ে তা আরও একবার স্বচক্ষে দেখার পর বড়সড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
– ওকে ওভাবে মারলো! আর তুমি বসে বসে দেখলে?
গোফরানের উত্তর,
– মেয়ে আমার একার নয়।
রোহিনী সরকার পরপর ঘটনাগুলোর দরুন নিজের জায়গা এবং আসন্ন বিপদের কথা ভুলেই বসেছিলো। যেন সে এখনো সত্যিই মিনির মা, এখনো গোফরান সিদ্দিকী স্ত্রী! নিজের প্রতিক্রিয়া দেখে বারংবার অবাকই হচ্ছিলো সে। এমন ঘরকুনো জীবনযাপনে সে কখনোই খুশি ছিল না। বাচ্চা পালা, ঘর সংসার, স্বামী সেবা এইসব কখনোই তার জীবনের লক্ষ্য ছিল না। অথচ আজ মনে হচ্ছে একজন নারীর জীবনের অস্তিত্ব স্বামী, সংসার আর সন্তান।
মিনি ভীষণ কাঁদছিলো। মায়ের কাছ থেকে কেড়ে আনার দুঃখে নয় তার সামনে বসে অনবরত কেঁদে যাওয়া তার নতুন মাকে দেখে। নিজে মেরে আবার নিজেই কাঁদছে কেন?

___

বিন্দির বিয়ে ঠিক হওয়ায় সে কাজে আসতে পারবেনা জানিয়েছিলো রোহিনীকে। বিন্দি গত দু’বছর যাবত কাজ করছে তার বাড়িতে।
শহরের সুপরিচিত বিউটিশিয়ান এক্সপার্ট এন্ড ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে রোহিনী সরকারের মতো ব্যস্ত মানুষ বিন্দির মুখ থেকে কথাটা শুনে বিরক্ত হয়ে চড়াও হয়েছিলো ভীষণ। চিৎকার চেঁচামেচি করার পর বিন্দিকে মাসের অর্ধেক টাকার বিষয়টা অস্বীকার করেছিলো। পরে বিন্দির কান্না, অনুরোধের পর সন্ধ্যায় বাসায় আসতে বলেছিল। সে তখন টাকা দিয়ে দেবে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর সে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন তার মনেই ছিল না যে বিন্দির আসার কথা ছিল। রাত দুটোর দিকে তার বেড়ালটা হঠাৎ ভীষণ শঙ্কিত হয়ে ডাকা শুরু করলে সে আওয়াজ অনুসরণ করে গেস্টহাউজে যেতেই দেখলো বিন্দির লাশ পড়ে আছে সেখানে।
কেউ হয়ত ছুরিকাঘাতে মেরেছে। এইসব দেখার পর রোহিনী আগাপাশতলা না ভেবেই বাসা ছেড়ে পালিয়েছে তার মায়ের বাসায়। সে জানে দোষটা তার উপরেই আসবে।
মা বললো এই মুহূর্তে তাকে গোফরানই সাহায্য করতে পারে। সেখানে বসে গোফরানকে ফোন করলে সে জানালো সে রাঙামাটিতে। আর কোনো উপান্তর না দেখে রাঙামাটিতে ছুটে আসতে হয়েছে তাকে। প্রাক্তন স্ত্রী নয় মিনির মা হিসেবে অনুরোধ করায় গোফরান সিদ্দিকী সেই অনুরোধ ঠেলে দিতে পারেনি। তাকে অনুমতি দেয়ার সময় তার ঘর করা মেয়েটির কথাও তখন মনে পড়েনি কারণ সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তানজিমের মধ্যে কোনো ছেলেমানুষী নেই। এতদিনে সে আর যাইহোক তানজিমের বিশ্বাসটুকু ভালোই অর্জন করেছে।

– পুলিশ আমাকে জানালো আপনার প্রাক্তন স্ত্রী এখানেই আছে। তার খোঁজখবর পেলে যেন জানাতে ভুল না করি। তুমি ভাবতে পারছ এখন আমি চুপ করে থাকলে বিষয়টা কিভাবে দাঁড়াবে? সবাই মনে করবে আমি তোমাকে সাপোর্ট দিচ্ছি।

– কে কি মনে করবে তা তুমি কেয়ার করো?

– এটি যখনই আইনের প্রশ্ন হয় তখন হ্যা আমি করি। ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি, সেখানে একজনকে খুন করে তুমি পালিয়ে এসে ভেবেছ আমি তোমাকে আশ্রয় দেব তাও তুমি আমার প্রাক্তন স্ত্রী বলে? এটা ভাবলে কি করে?

– আমি আবারও বলছি আমি খুনী হলে তোমার কাছে আসতাম না। আমি নির্দোষ তাই এসেছি। আমার মনে হয়েছে এমতাবস্থায় আমার কথা কেউ শুনবে না। শুধু তুমি শুনবে। আর তোমার কথা পুলিশ শুনতে বাধ্য।

গোফরানের শক্তপোক্ত জবাব,
– সারাজীবন আমি তোমার প্রয়োজন ছিলাম, এখনো আছি। সেটা আজকেও তুমি প্রমাণ করে দিয়েছ। যদি বলি আমি তোমাকে কোনোপ্রকার সাহায্য করতে পারব না তাহলে তুমি কি বলবে?

– কিছু বলব না। কারণ আমি প্রয়োজন থেকে আর প্রিয়জন হতে পারব না। তুমি নিজেই সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছ। তুমি এটা পারলে? তাও একটা বাচ্চার মাকে।

– তাকে নিয়ে কোনো কথা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই না। আর যদি বলতেই হয় দরজা খোলা আছে। বেরিয়ে যাও। ইতোমধ্যে তুমি আমার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছ। কি চাও আর?

– মিনির বাবার কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নেই। একজন আইনের রক্ষক হিসেবে চাইছি তুমি প্লিজ পুলিশকে জানাও যে খুনটা আমি করিনি। বিন্দি আমার বাড়িতে কাজ করছে দু’বছর যাবত। ও ভীষণ ভালো মেয়ে। কথা কম বলতো। চুপচাপ কাজ করতো, পারলে প্রয়োজনের চাইতে বেশি করতো। ওইরকম একটা মেয়ের সাথে আমার কিসের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে যার কারণে আমি ওকে খুন করব?

– সেটা তুমিই জানো। তুমি পরশু ওকে বেরিয়ে যেতে দেখেছ তোমার বাড়ি থেকে? যখন ও টাকা চাচ্ছিলো।
-হ্যা সোজা চলে গিয়েছিলো।
– তোমার বাসার চাবি আর কারো কাছে ছিল?
– না।
– তাহলে কিভাবে বলছো খুনটা অন্য কেউ করেছে?
– কারণ কয়েকদিন আগে শওকত আমাকে হুমকি দিয়েছিল। বলেছিল আমার এমন অবস্থা করবে যাতে আমি আমার মুখ জনসমাজে না দেখাতে পারি।
– শওকত এখন কোথায়?
– জানিনা। ওর দেখাসাক্ষাৎ আমি পাইনি। ফোনেও পাইনি। ও কোথায় আমি জানিনা। পুলিশ আমাকে তাড়া করছে। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা এই মুহূর্তে।
– কোনো অপরাধ না করে এভাবে পালানো উচিত হয়নি তোমার। তুমি নিজেই তোমার দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়েছ। এখন আমি কি করতে পারি? আমার মুখের কথা কেনই বা তারা বিশ্বাস করবে? তুমি ফিরে যাও। আমি তারপর দেখছি কি করা যায়।
– আমি ফিরতে পারব না। সব প্রমাণ আমার বিরুদ্ধে যাবে। আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি।
– পুলিশ যদি এখানে চলে আসে তাহলে তোমাকে তাদের সাথে যেতেই হবে। কেসটা কোর্টে উঠলে লয়ার হায়ার করার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তুমি সব সত্যি সত্যি বলবে। তুমি যদি নির্দোষ হও তাহলে তুমি ছাড়া পাবে এটা আমি মেক সিউর করছি।
রোহিনী দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল,
– তুমি এখনো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না।
– তুমি সেই জায়গাটা রাখোনি। আজকের রাতটা ফিজার সাথে কাটিয়ে দাও। রাতের খাবার গেলে খেয়ে নিও।
গোফরান উঠে চলে গেল।
গিয়ে দেখলো ফিজা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাসনিয়াকে ডাকাডাকি করছে। তাকে দেখে ফিজা রাগ করে চলে গেল। সে কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পর তাসনিয়া দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। গোফরান দেখলো মিনি ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতেই মিনি জেগে উঠলো। কেঁদে উঠতেই
গোফরান তাকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে বলল,
– তুমি মাকে কষ্ট দিয়েছ?
– না।
– কষ্ট না দিলে তোমার মা কেঁদেছে কেন?
– মা আমাকে মেরেছে।
গোফরান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– কি করে বুঝাই?

তাসনিয়া জুবরানকে খাইয়ে-দাইয়ে ফিজাকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লো। ফিজা রোহিনীকে খাবার দিয়ে এসে গোফরানের কাছে যেতেই দেখলো মিনি আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোলে। ফিজা বলল,
– এখানে এনে দেব?
– জুবরান কোথায়?
– ওর মা ওকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
গোফরান মিনির কপালে আদর করে বলল,
– ও ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবে না বোধহয়। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।
ফিজা বলল
– তুমিও খাবে না?
– খিদে নেই।
ঘরে গিয়ে মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পড়লো সে। মিনিকে তাসনিয়ার পাশে শুইয়ে দিয়েছে। কিন্তু অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর যখন দেখলো তাসনিয়া মিনিকে বুকে টেনে নেয়নি তখন তার কাছে নিয়ে এসেছে। মিনির মায়ের রাগ মিনিকেই ভাঙাতে হবে।

তার পরের দিন তাসনিয়া চলে গেল জুবরানকে নিয়ে। রোহিনী থাকায় তাসনিয়ার সাথে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি গোফরান। তাদের সম্পর্কের মধ্যেকার জটিলতা সে কাউকে জানতে দিতে চায় না। মা চলে যাওয়ার পর মিনি চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। রোহিনী ডাকলে কাছে গেলেও কোনো কথা বললো না। বাবা রাতে তাকে বুঝিয়েছে কে আসল মা! মাম্মাম এসেছে কিন্তু তার জন্য নয়। আবারও চলে যাবে। কিন্তু মা কখনো যাবে না। কিন্তু জুবরানকে নিয়ে মা এভাবে চলে যাবে এটা তার কল্পনাতীত ছিল। ভেবেছিলো ফুপী মজা করে বলেছে মা তার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যখন দেখতে পেল গাড়ি চলে যাচ্ছে মা আর জুবরানকে নিয়ে তখন পেছন পেছন অনেকদূর ছুটেছিল সে। কিন্তু গাড়িটা আর থামেনি। তারপর কি ভীষণ একা লাগছিলো তার। বন্ধু নেই, মা নেই। অথচ আগের মা আছে কিন্তু তারপরও আনন্দ নেই কোথাও।

রোহিনীর কেসটা আদালতে উঠেছে। তাকে গ্রেফতার করার পর লয়ার হায়ার করেছিলো গোফরান। আর তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসে শওকত হোসেনের আসল রূপ।
শওকতের সাথে রোহিনী বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড়বছর আগে। গোফরান সিদ্দিকীর স্ত্রী থাকাকালীন শওকত হোসেনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলো সে। ডিভোর্সের পরপরই বিয়ে হয়। আর সেই শওকতের লোকই বিন্দিকে মেরেছিলো। শওকতের কাছে চাবি ছিল রোহিনীর ফ্ল্যাটের। আর সেটা কাজে লাগিয়ে তার লোকজন ফ্ল্যাটে ঢুকে অবস্থান করছিলো রোহিনীকে মারার জন্য। কিন্তু ভুলবশত বিন্দি ঢুকে এসেছিলো। তাদের সবাইকে দেখা ফেলায় ভয়ে চিৎকার দেয়ার আগেই বিন্দিকে মেরে ফেলা হয়। লোক গুলোকে শওকত পাঠিয়েছিলো মূলত রোহিনীর প্রাণবধ করার জন্য।
কেসের সমস্ত ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর রোহিনীকে যখন ছাড়া হলো গোফরানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখদুটো চকচক করছিলো। তার সমস্ত ভুলগুলো গোফরান সিদ্দিকী আঙুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সেদিন। আর এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে গোফরান সিদ্দিকীই তার জীবনে সঠিক মানুষ ছিলো। নিজ হাতে, নিজ দোষে নিজের সবটা সে হারিয়ে ফেলেছে। স্বামী, সংসার, সন্তান। গোফরানের স্পষ্ট জবাব,
– আশা করছি আর কখনো তুমি আমার পিছু নেবে না। না মিনির। একটা কথা মনে রেখো মিনির একটা মা আছে। তাই মিনির তোমাকে কোনো প্রয়োজন নেই।
– আর তোমার?
গোফরান সগর্বে বলল,
– সে শওকত হোসেনের বিপরীত। শওকত হোসেন তোমার জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছে। আর সে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। বুঝতেই পারছো এবার।
রোহিনী ঝরঝর করে কেঁদে উঠে বলল,
– আমাকে ক্ষমা করো।
– ছলনাময়ীদের ক্ষমা করা যায় না। তোমাকে সাহায্য করেছি এই কারণে, কারণ তুমি মিনির গর্ভধারিণী। ও যাতে কখনো বলতে না পারে আমার কারণে তার মা জেলে পঁচে মরেছে। আমার দয়াকে অন্য কিছু ভেবো না। যে গোফরান সিদ্দিকী তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো সে সেদিনই মরে গিয়েছে যেদিন তুমি ডিভোর্স লেটার হাতে পেয়েছ। আসি। তোমার সাথে আর কখনো দেখা না হোক।
তার পথ আটকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রোহিনী বলল,
– তোমার অভিশাপ লেগে গেছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।

__________________

তাসনিয়া সেদিন স্কুল থেকে ফিরছিলো। ফার্মেসী থেকে বাবার জন্য ওরস্যালাইন আর পাশের দোকান থেকে জুবরানের জন্য কিছু চিপস চকোলেট নিল। ঘরের জন্য দুধ চিনি কফির প্যাকেট আর রাস্তার পাশের সবজি দোকান থেকে কয়েক পদের সবজি কিনে নিল। ফোনটা অনবরত বাজছিলো। কেনা শেষে ফোনটা তুলে দেখলো, বাবা ফোন করেছে। কোথায় আছিস জিজ্ঞেস করছিলেন উনি। তাড়াতাড়ি ফিরছে আশ্বাস দিয়ে যেই রিকশায় বসতে যাবে ঠিক তখনি একটা লোক তাকে ডাকলো। ডাকটা পুরোনো তবে পরিচিত। তাসনিয়া ঘাড় ফেরাতেই দেখলো শওকত হোসেন। কড়া মেজাজে বলল,
– তোমার বাবা তুশিবের সাথে দেখা করতে দেয়নি। আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে চাই।
তাসনিয়া চুপ করে চেয়ে রইলো। রিকশায় বসে বলল- মামা চলুন।
শওকত রিকশাটাকে হ্যাঁচকা টান মেরে আটকে রেখে বলল,
– উত্তর দাও।
– কোনো খুনীর সাথে আমি আমার ছেলেকে দেখা করাতে চাই না।
– খবরদার খুনী বলবে না।
– একশোবার বলব। তুমি যাবে নাকি পুলিশকে ফোন করব? ওরা আমার কাছে নাম্বার দিয়ে গেছে। তোমাকে পেলেই যেন ফোন করি।
– ভয় দেখাচ্ছিস আমাকে?
– দেখাচ্ছি। ভালোই ভালোই বলছি পথ ছাড়ো।
– আমি একবার তুশিবের সাথে দেখা করতে চাই।
তাসনিয়া রিকশা ছেড়ে হাঁটা ধরলো। শওকত তার পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
– তুমি রোহিনী সরকারের পক্ষ নিচ্ছ?
– হ্যা নিচ্ছি।
– তুমি জানো না ও কত ডেঞ্জারাস মহিলা। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ও সব পারে। ও আমাকে ব্যবহার করেছে। তারপর প্রয়োজন শেষে ছুঁড়ে ফেলেছে।
তাসনিয়া থেমে কর্কশ গলায় বলল,
– ওই ডেঞ্জারাস মেয়েটার জন্য তুমি আমাকে ফেলে চলে গেছ। আমার অবুঝ বাচ্চাটার মন ভেঙেছ। আমার সব শেষ করে দিয়েছ। আমার পথ ছাড়ো। নয়ত আমি এখনি গোফরান সিদ্দিকীকে ফোন দেব।
শওকত গোফরানের নামটা শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– তুমি ওই লোককে কিভাবে চেনো? ও তো শুনেছি রোহিনীর এক্স হাসবেন্ড।
তাসনিয়া দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল
– আমার পথ ছাড়ো। নয়ত আমি চিৎকার করব।
ডিভোর্সের পরেও তাসনিয়াকে একই গেটআপে চলাফেরা করতে দেখেছে শওকত। ওকে দেখে কখনো মনে হয়নি ও অবিবাহিত কিংবা ডিভোর্সী। তাই হয়ত ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সে ধরতে পারেনি। আর তাছাড়া এতগুলো মাস সে কলকাতায় ছিল। বাংলাদেশে এসেছেও জরুরি কাজে। আবারও পালিয়ে যাবে। কিন্তু একবার তুশিবের মুখটা দেখে যেতে ইচ্ছে হলো। তাসনিয়াকে সে বরাবরই নরম গোছের মানুষ হিসেবে জেনে এসেছে। তুশিবের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে সে আবারও ভাববে। আত্মসমর্পণ করবে পুলিশের কাছে। হয়ত কয়েক বছর জেল খাটতে হবে কিন্তু সে আবারও ফিরে আসবে তুশিবের কাছে, তাসনিয়ার কাছে।
রাস্তায় প্রচুর ঝামেলা বাঁধিয়ে দিচ্ছিলো শওকত। তাসনিয়া তাই তাকে একবার তুশিবের সাথে দেখা করানোর কথা ভেবেছে। শওকতের গাড়িতে করে বাড়িতে যখন এল তখন বাবা এগিয়ে এসে বলল,
– ওই নিমকহারাম বাড়িতে এসেছিলো। কিছুতেই আমার নানুভাইয়ের সাথে দেখা করতে দিবিনা ওই শয়তানের সাথে। বাচ্চা তোর একার নয় এইকথা মনে রাখবি।
তাসনিয়ার পেছন পেছন শওকতকে দেখে বাবার মুখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
– ও শুধু একবার দেখা করতে চাই বাবা।
মেয়ের উপর বিরক্ত হয়ে মাথা দুলাতে দুলাতে চলে গেলেন উনি। মা ফিরেছে শুনে জুবরান ছুটে এসেছিলো মায়ের কাছে। কিন্তু এসে যাকে দেখলো তাতে তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। শওকত এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্টে। গালে, কপালে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলল,
– আ’এম সরি তুশিব। বাবাকে ক্ষমা করো। আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।
জুবরান হা করে চেয়ে রইলো। শওকতের পরিণতি দেখে তাসনিয়া নিজের চোখের জল আটকাতে পারলো না অথচ জুবরান কি ভীষণ শক্ত হয়ে একদৃষ্টে বাবাকে চেয়ে রইলো। একটুও নড়লো না, কাঁদলো না, তার শুকনো চোখের কোথাও একটুও জল দেখা দিল না। ও যে সেই তুশিব নয়। ও জুবরান। ও সবার সামনে কাঁদেনা।
– আমি তোমার কাছে আবারও ফিরে আসবো তুশিব। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?
তুশিব চুপচাপ চেয়ে রইলো। বাবা তার সাথে এত পাগলামি শুরু করেছে তাতে সে একটা শব্দও করলো না। তাসনিয়া কাঁদলো এই ভেবে তার ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়ে এমন শক্ত হয়ে গিয়েছে। যে বাবা বলতে পাগল ছিল সেই ছেলে বাবার এমন কাকুতিমিনতিতে একটুও টলছেনা!
তাসনিয়ার বাবা পুলিশকে শওকতের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো ফোনে। খবর পেয়ে একের পর এক পুলিশের গাড়ি এসে থামলো তাসনিয়াদের বাড়ির সামনে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই সারাবাড়ি ঘিরে ফেললো পুলিশ। শওকত আত্নরক্ষার জন্য পিস্তল বের করে তুশিবের মাথায় ঠেকিয়ে বলল
– কেউ এগোলে শেষ করে দেব সব। নিজেও মরবো। সবাইকে শেষ করব। সর সবাই।
তাসনিয়ার পায়ের মাটি সরে গেল তখন। এ কেমন বাবা? তুশিব অবাক চোখে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। কোনো বাবা আত্মরক্ষার জন্য ছেলের মাথায় গুলি ঠেকাতে পারে? তাসনিয়া কেঁদে বলল,
– আমার ছেলেকে ছাড়ো। তোমাকে বিশ্বাস করাটা আমার ভুল হয়েছে। ছেড়ে দাও।
শওকত তুশিবকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তাসনিয়া চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। দোহাই লাগে ওকে ছেড়ে দাও। আর কত আঘাত করবে ছেলেটাকে? শওকত তারপরও কথা শুনলো না। সে তার বাচ্চাকে মারতে পারেনা কিন্তু তাকে পালাতে হবে যেকরেই হোক।
তুশিবকে নিয়ে যেই দরজার বাইরে পা রাখতে যাবে ঠিক তখনি শক্ত একটা মুষ্ঠ্যাঘাতে ছিটকে পড়ে গেল শওকত। জুবরান গিয়ে তার সুপারম্যানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে।
শওকত যখন প্রথমবার তুশিবের সাথে দেখা করতে এসেছে তখনি গোফরানকে ফোনকলে শওকতের কথা জানিয়ে দিয়েছিল তাসনিয়ার বাবা। আর খোঁজ পেয়ে সে ছুটে এসেছে। তার জীবদ্দশায় আর কেউই জুবরানের বাবা হয়ে উঠতে পারবে না।

কনস্টেবলরা শওকতকে গ্রেফতার করলো আর বাকিরা প্যারা স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স মিলিটারি অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে দেখামাত্রই একসাথে স্যালুট জানিয়ে ধীরেধীরে বেরিয়ে গেল। তাসনিয়া গোফরানের কোলে জুবরানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মানুষটার প্রতি আবারও ঋণী হয়ে পড়লো সে। শওকত যেতে যেতে চিৎকার করে বলল,
– আমি আবার ফিরবো তুশিব। আমি তখন ভালো বাবা হবো। আবার ফিরবো আমি।
পুলিশ তাকে ঠেলতে ঠেলতে গাড়িতে তুললো। আর ফাঁকফোকর দিয়ে সে দেখলো তুশিব ওই লোকটার কাঁধে মাথা ফেলে কেঁদে যাচ্ছে। পেছনে তাসনিয়া দাঁড়িয়ে ছেলের চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। পড়নে ইউনিফর্ম না থাকায় গোফরান সিদ্দিকীকে সে ঠাওর করে উঠতে পারেনি। সে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
– ওই লোকটা কে? ওই লোকটা? আমার ছেলেকে যে কোলে নিয়েছে?
– কর্নেল গোফরান সিদ্দিকী। তোর বউ বাচ্চা এখন তার। তুই জেলে পঁচে মর শালা।

____

বিয়ের আগে হোক কিংবা পরে শওকতের সেই প্রেমিকার কথা শুনলেও কখনো নামধাম শোনেনি তাসনিয়া। গোফরান সিদ্দিকীর সাথে জড়িয়ে পড়ার পরও না। কেসটা আদালতে না উঠলে সে জানতেই পারতো না শওকত হোসেনের প্রেমিকাই রোহিনী সরকার। সে অমন শিক্ষিত সুন্দরী আধুনিকা নারীর প্রেমে পড়বেই না বা কেন? শওকত হোসেন বরাবরই তাসনিয়াকে ওভাবেই চাইতো।
গোফরান সিদ্দিকী সেদিন খালিহাতে ফিরে গিয়ে ছিলো তার কাছ থেকে সবটা আড়াল করার কারণে। শওকতের গ্রেফতারের দিন জুবরান নিজেও বাবার সাথে চলে যেতে ইচ্ছুক হয়েছিল কিন্তু মায়ের কারণে যেতে পারেনি। বাবা যেবার দুমাস পর বাড়ি ফিরেছিলো, সেবার মা আর বাবাকে সে একসাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে দেখেছিল। তারপর আর কখনো দেখেনি। তার ছোট্ট মন এটুকু বুঝে নিয়েছিলো মা আর বাবার মধ্যে একটা অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব লেগে আছে। যার কারণে বাবা মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে পারছেনা, মাও বাবাকে ফেস করতে চাইছে না।
তারউপর মিনিও একটা কারণ।
সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গোফরানের ফোনকল পেয়েছিল তাসনিয়া। ফোন রিসিভ করার পরও কেউ কোনো কথা বললো না শুরুতেই। অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তাসনিয়া ইচ্ছে করে ফোনটা কেটে দিল।
তারপর আর ফোন আসেনি। ফিজাকে একদিন ফোন করার পর জানতে পারলো মিনি হসপিটালাইজড অনেকদিন ধরে। ওর প্রচন্ড জ্বর। ভাইয়া জানাতে বারণ করেছিলো তাই তাকে তারা জানায়নি এতদিন। গোফরান সিদ্দিকীকে কয়েকটা কড়া কথা শোনানোর জন্য বারংবার ফোনে ট্রাই করার পরেও ফোনে পাওয়া যায়নি তাকে। ফিজাকে ফোন করার পর ফিজা জানালো তারাও পাচ্ছেনা ফোনে। কোনো বিপদআপদ হলো কিনা তাও জানা যায়নি।
এক আকাশসম রাগ দুঃখ অভিমান নিয়ে তাসনিয়া সব ছেড়েছুড়ে হাসপাতালে ছুটলো। হাসপাতালের বেডে ছোট্ট শরীরটাকে পড়ে থাকতে দেখে তার মায়ের মন কেঁদে উঠেছিলো প্রবলভাবে। মাকে বহুদিন পর দেখে পিটপিট করে তাকিয়েছিলো মিনি। চোখের কোণা বেয়ে কানের কাছে অশ্রু গলে গলে পড়ছিলো যা বলে দিচ্ছিলো, ” মিনি সরি মা। ”

চলমান…..