চিরবন্ধু পর্ব-০৭

0
71

#চিরবন্ধু
#পর্বঃ৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

মায়ের কোল পেয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিল মিনি। হৃষ্টপুষ্ট শরীরটা শুকিয়ে গেছে অনেকটা। ছোট থেকেই ওর নিউমোনিয়ার সমস্যা আছে। বুকে শুকনো কফ লেগে যায়। দুবছর বয়সে একবার টাইফয়েড হয়েছিলো। সেই থেকে সবাই তার জ্বর হলে ভয় পায়। তাসনিয়াকে ফিরতে দেখে সবাই খুশি হয়েছে। কিন্তু বড় ভাবি মুখ বেজার করে বলেই বসলো,
– তোমাদের মধ্যে যাইহোক বাচ্চাগুলোকে সমস্যায় ফেলো না। ওদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও। তোমার কাছ থেকে এটা তো আশা করিনি ছোট বউ। বাপের উপর রেগে মেয়ের উপর রাগ দেখালে? মেয়েছেলে কি এখনো ভাগাভাগি করে পালছো নাকি? নইলে তার মেয়ে আমার ছেলে ভাগাভাগি আসছে কেন?
তিক্ত হলেও এটাই সত্যি যে, তাসনিয়া ভাগাভাগিই করেছে। রাগ করে চলে আসার পর তার উপলব্ধি হয়েছে মিনি অনেক অবুঝ। তার অবুঝপনায় কষ্ট পেয়ে এভাবে ছেড়ে চলে আসা উচিত হয়নি। সে খুব যত্নবান মা হতে গিয়ে হেরে গেল, অপরদিকে শুরু থেকেই পুরোপুরি নির্বিকার থাকার পরও গোফরান সিদ্দিকী জুবরানের বাবা হয়ে উঠেছে। এতে কোনো খাদ নেই।
সে নিজেও ফিরে আসার কথা ভেবেছে কিন্তু তারপরেই রোহিনী সরকার আর শওকতের সম্পর্কের কথাটা জানতে পারার পর, বাবাও যখন বললো গোফরান সিদ্দিকী আগে থেকেই তাকে চিনতো বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো। সবকিছু শুনে আত্মস্থ হতে তার সময় লেগেছিল। উনার কাছে অপশন ছিল মিনিকে তার কাছে নিয়ে আসার কিন্তু তিনি নিয়ে আসেননি। শওকত হোসেন আর রোহিনী সরকারের বিষয়টা জেনেও তাকে কেন জানায়নি প্রশ্নটা করার পরও উনি কোনো উত্তর দেয়নি এটাও তাসনিয়ার রাগের একটি কারণ। উনার মতে, সেসব জেনে কোনো লাভ নেই। উনার মনে হয়েছে উনার মতোও একজন ঠকে গিয়েছে যার পাশে উনার থাকা উচিত, সাথে মিনিরও এমন একটা মা দরকার যার কাছে সন্তানের প্রায়োরিটি সবার আগে। সব জানাশোনার পর তিনি বিয়ের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিছু মানুষের সাথে ঘর করেও চেনা হয়ে উঠেনা আবার কিছু কিছু মানুষের চলাফেরা আচার-ব্যবহার দেখে বুঝে ফেলা যায় অদূর ভবিষ্যতেও মানুষটা ঠিক একই থাকবে। তাসনিয়াকে তার এমনই মনে হয়েছে। তাদের দুজনের সম্পর্কের পরিণতি কেমন হবে তা নিয়ে সে ভাবেনি এটা সত্য, তবে তাসনিয়া তানজিম মিনির মা হয়ে উঠতে পারবে এটুকু বিশ্বাস তার মধ্যে ছিল। এটাও ঠিক সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মিনির মা হয়ে উঠার জন্য। কোনো হেলাফেলা ছিলনা এতে। তার মাতৃত্বের অধিকার ভাগাভাগি হচ্ছে দেখে প্রচন্ড অভিমানে দূরে চলে গিয়েছে।
তবে এটা তার ভুল তা সে অকপটে স্বীকার করে। তার উচিত ছিল দুজনকেই ফেলে আসা নয়ত দুজনকেই সাথে করে নিয়ে আসা।

মিনিকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা ভাবছিলো তাসনিয়া। ওকে সে সারিয়ে তুলবে। ফিজা জানিয়েছে সে দিনের ভেতর অনেকবার যখন ইচ্ছে তখন বাথরুমে গোসল নিয়েছে গরমের কারণে। বাবা বাড়িতে নেই, মা নেই সেই সুযোগে নিজের মর্জিমতো চলেছে। বাড়ির কাউকেই সে তোয়াক্কা করে না। সবাই কাজে ব্যস্ত থাকলে, ফিজা তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কোনো এক ফাঁকে চট করে সে বাথরুমে ঢুকে বালতিতে মগ ডুবিয়ে গায়ের উপর পানি ঢেলে দেয়। জ্বরটা মূলত এই কারনেই বাঁধিয়েছে সে। সে দুরন্তপনায় পটু তাসনিয়া তা জানতো কিন্তু এতটা তার জানা ছিল না। মাল্টার রস খাওয়ানোর পর যখন পুরোপুরি জাগলো তখন তাসনিয়া জানতে চাইলো,
– দিনে কয়বার গোসল করেছ?
মিনি শুধু হাসলো। আবারও মাথা ফেলে বুকে পড়ে রইলো। সন্ধ্যার দিকে তাসনিয়া তাকে বেড থেকে নামিয়ে দিয়েছে একটু হাঁটার জন্য। ফিজার সাথে তখন জুবরান এসেছে। জুবরানকে দেখামাত্রই সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
– জুবরান ইউ মিসড মি?
জুবরান হাসলো। বলল,
– তুই মাকে আর কষ্ট দিবি?
মিনি দু’পাশে মাথা নাড়লো। জিজ্ঞেস করলো,
– মা তোর সাথেও রাগ করে?

মিনিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে তাসনিয়া। ওকে এমনিতেই সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়ে আসা হতো। তাসনিয়াকে ফিরতে দেখে তার শ্বাশুড়ি খুশি হলো কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তামগ্ন হয়ে বলল,
– মেয়েটাকে অসুস্থ দেখে গেল, আর একটা খোঁজখবরও নিল না ও। ফিজা বললো ও নাকি ফোন তুলছেনা।
তাসনিয়া হাসপাতালে এজন্যই তাড়াহুড়ো করছিলো। যাতে সে মিনিকে বাড়ি নিয়ে এসে গোফরানের খোঁজে লেগে যেতে পারে। দু’দিন ধরে কোন ফোন নেই এটা অস্বাভাবিক। কখনো এমন হয়নি। তাদের মধ্যে রাগারাগি থাকলেও তিনি আগে ফোন দিতেন, দরকার পড়লে কথা বলতেন না। কিন্তু ফোন ঠিকই দিতেন। আর সে অপেক্ষায় থাকতো। কিন্তু এবার কি এমন হলো? সে প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগছিলো কথাটা শোনার পর থেকে। ভাগ্যিস ফিজাকে ফোন দিয়েছিলো নইলে কেউ তাকে কিচ্ছু জানাতো না।
পুরো রাতভর সে ফোন করে গেল কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। উদ্বেগের মাত্রা আরও তরতরিয়ে বাড়লো তার। মধ্যরাতে ঘর আলো করে বসে রইলো সে। কিছুতেই ঘুম এল না। হাঁটতে হাঁটতে মিনি আর জুবরানকে দেখে এল। মিনির কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করলো। স্বস্তি পেল এই ভেবে ওর গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে। কিন্তু গোফরানের জন্য উদ্বেগের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলো। হঠাৎ করে মনটা কেমন আকুপাকু করছিলো।
বাবা সেদিন তাকে বলেছে, একটা সম্পর্কের টানাপোড়েনের সময় যে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে তার কাছে সম্পর্কটার মূল্য অনেক বেশি। একটা সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে ইগো থেকে। এই ইগো ধীরেধীরে সব শেষ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। যে তার সমস্ত ইগোকে দূরে সরিয়ে আগবাড়িয়ে কথা বলছে তার কাছে সম্পর্ক আর মানুষ দুটোই খুব মূল্যবান। জীবনে এই প্রথমবার কেউ তোকে মূল্যায়ন করছে। তার কয়েকটা কথায় তুই রাগ করে জেদ দেখিয়ে একগুঁয়ের মতো চলে এসেছিস। সেই কষ্টে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থেকে চোখের জল ফেললে কিচ্ছু সমাধান হবে না। তারচাইতে বরঞ্চ ওর সাথে কথা বল। রাগ থাকলে ঝেড়ে ফেল। সব অভিযোগ শুনিয়ে দে। দেখবি নিজেকে হালকা লাগছে। কিন্তু এভাবে এড়িয়ে চলিস না। আমরা যাকে মূল্যায়ন করি তার অন্যসবকিছু মেনে নিতে পারলেও এড়িয়ে চলাটা সহ্য করতে পারিনা। গোফরান সিদ্দিকী মানুষটাই আগাগোড়া ইগোস্টিক । সেখানে সে তার ইগো ধরে রাখেনি। বরঞ্চ তোর সমস্ত অভিযোগ চুপচাপ শুনেছে। এই মানুষটাকে তুই অন্তত এমন হেলায় ফেলে রাখিস না। জীবন তোকে প্রতিটা পদে পদে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এবার ভালো কদর করতে শিখ। নিজের ভালোমন্দ নিয়ে ভাব। তুই ভালো থাকলে তবে তোর ছেলেমেয়েরা ভালো থাকবে। তোর কাছ থেকে কতকিছু শেখার আছে ওদের। তুই কি অস্বীকার করতে পারিস গোফরান তোর জীবনের অন্ধকার কাটিয়ে দেয়নি? অস্বীকার করতে পারবি তোকে আর তোর ছেলেকে একটা সুস্থ জীবন দেয়নি? যদি স্বীকার করে থাকিস তাহলে সব ভুলে তার কাছে যাহ। নিজে ভালো থাক, সবাইকে ভালো রাখ। মানুষ বাঁচেই বা ক’দিন। জীবনটাকে উপভোগ কর। অনেকের জীবনে দ্বিতীয় সুযোগটাও আসেনা। তোর জীবনে এসেছে কারণ এটা উপরওয়ালার ইচ্ছে ছিল। উনি তোকে সুযোগ দিয়েছেন। এই সুযোগটাকে হাতছাড়া করিস না।
কথাগুলো গভীরভাবে উপলব্ধির পর তাসনিয়ার মনে হয়েছিলো তাই তো! যদি গোফরান সিদ্দিকী মানুষটাও অমন দুশ্চরিত্র হতো কিংবা জুবরানকে ভালো না বাসতো! পরস্ত্রী হিসেবে তাকে ট্রিট করতো তখন? বিয়ের আগে তো গোফরান সিদ্দিকীকে সে একফোঁটাও চেনেনি। সেই মানুষটা এমন হবে, কোনো একসময় সেই মানুষটাকে ঘিরে তার সংসার হবে এটা ভেবে তো সে বিয়ের পিড়িতে বসেনি অথচ সময় তাকে কত মূল্যবান জিনিস উপহার দিয়ে দিল। একটা মেয়েকে আগাগোড়া বুঝে তার প্রতি যত্নবান হওয়া পুরুষ মানুষ ক’জনের ভাগ্যে জোটে? জুটলেও ক’জন তা মূল্যায়ন করতে পারে? প্রায় আরও দুটো রাত নির্ঘুম কাটলো তার। ফিজা জানালো ভাইয়ার কোনো বিপদ আপদ হলে হসপিটাল থেকে ফোন আসে। এবার তা আসেনি। তারমানে ভাইয়া নিজেই চাইছেনা যোগাযোগ করতে।
কেন চাইছেনা তার কারণটাই বুঝে পাচ্ছে না তাসনিয়া। এত বুঝদার মানুষের পক্ষে এমন ছেলেমানুষী মানায় না। উনি এমন কাজ করতে পারে তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। মনের মধ্যে একটা বিদঘুটে আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছিলো বারংবার। আগে এটা কখনো মাথায়ই আসেনি যে তিনি জীবন-মৃত্যুর মধ্যিখানে দোদুল্যমান জীবন যাপন করেন। তা ভেবে তার পুরো শরীর ঘামছিল, হাত পা ভীষণ অসার লাগছিলো তারপর থেকে। কেন বিপদ তার পিছু ছাড়েনা। জীবনটা বোধহয় এভাবেই চলতে থাকবে। শঙ্কাহীন, সংকটহীন জীবনই তো সে চেয়েছিলো।

তিনদিনের মাথায় রাতের প্রায় শেষাংশে যখন তার চোখ লেগে এল তখন ফোনের কম্পিত স্বরে সেও কেঁপে উঠলো। বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো।
এমন সময় কে ফোন দিতে পারে?
কাঁপা-কাঁপা হাতে ফোনটা তোলার পর ওপাশ হতে গম্ভীর গলায় একজন বলল,
– মিসেস কর্নেল বলছেন?
– জ্বি। আপনি কে?
– আমি কমবাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল থেকে বলছি। কর্নেল সিদ্দিকীর একটা মেজর অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। আপনারা তার সাথে দেখা করতে আসতে পারেন। অবশ্যই কম লোকজন নিয়ে আসবেন।
– কি হয়েছে উনার?
– বিএসএফের গুলিতে আহত হয়েছেন। অপারেশন সাকসেস না হওয়া অব্ধি পরিবারের কাছে খবর দেয়া হয় না। তাই জানাতে দেরী হয়েছে। কাল আসুন। ধন্যবাদ।
আরিবের সাথে কাল সকালেই রামু সেনানিবাসে রওনা দিত সে । কিন্তু এটা শোনার পর আরিবের জন্য আর অপেক্ষা করেনি সে। একা একাই পাড়ি দিয়েছে মিলিটারি হসপিটালের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো গুলিটা সেদিনই লেগেছে যেদিন তার কাছে শেষবার ফোন এসেছিল। আর অপারেশনও তারপরের দিন হয়েছিল। কর্নেল চাননি বলে বাড়িতে জানানো হয়নি। শারিরীক উন্নতি একটা পর্যায়ে না আসার আগ অব্ধি উনি চাননি উনার এই দুরাবস্থার কথা কেউ জানুক। বাড়িতে তার বৃদ্ধ মা, ছোট্ট বাচ্চা আর একজন কোমলমতি প্রেমিকা আছে। সে তাদের সামনে পরাজিত যোদ্ধার ন্যায় মুখোমুখি হতে চাইনা। জুবরান যাতে কখনো মনে না করে তার বাবাকে শত্রুরা আঘাত করেছে। যে বাবা তার আইডল সেই বাবার ইমেজ তার সামনে সবসময় স্ট্রং এবং বোল্ড থাকুক। মিনি তো বরাবরই জানে তার বাবা ফাইটার। আর তাসনিয়া তানজিম যাতে কখনো তার পেশা নিয়ে অসন্তুষ্টিতে না ভোগে তাই সে কাউকে জানায়নি। একটু সুস্থ বোধ হলে হসপিটালের বেড ছাড়লো সে। তারপর বাড়িতে জানানোর অনুমতি দিল। কিন্তু তানজিম সোজা হাসপাতাল থেকে শুরু করে ক্যাম্প অব্ধি চলে আসবে একথা কে জানতো!
তাসনিয়া যখন হাসপাতালে এল তখন সেখানকার প্রবীণ ডাক্তার জানালো কর্নেলকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে তাঁর হেলথ স্টেটাস এবং ধারাবাহিক ট্রিটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে। উনি মেক সিউর করেছেন প্রপার ট্রিটমেন্ট উনি নেবেন, এবং অতি দ্রুতই তিনি বাড়ি ফিরছেন। সবগুলো কন্ডিশন মানার পর উনাকে ডিসচার্জ দেয়া হয়েছে। বাড়ি এখনো ফেরেনি বলতেই তিনি জানালেন তাহলে উনি রাঙামাটি সেনা ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। আরিবের সাহায্যে সেনা ক্যাম্প অব্দি পৌঁছাতে তাসনিয়ার পরিশ্রম হয়েছে কিন্তু কষ্ট হয়নি। আর কর্নেলের মুখোমুখি হওয়ার পর তার সব কষ্ট সার্থক। ক্যাম্পের কড়া নিয়মাবলি অনুযায়ী কোনো অপরিচিত কেউ ক্যাম্পের নির্দিষ্ট জায়গা অব্দি এলে তাকে জবাবদিহিতা করতে হয়। সামরিক ইউনিফর্ম পরিহিত বন্দুক হাতে দাঁড়ানো সেনা কর্মকর্তাদের কাছে জবাবদিহিতা শেষে তাকে যখন একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এসে নিয়ে গেলেন স্ব-সম্মানে তখন ভয় অনেকটা কমে গিয়েছিলো তার। আর সারি সারি করে শৃঙ্খলা রক্ষা করে দাঁড়ানো, উচ্চস্বরে ভেসে লেফট রাইট লেফট, সাথে ঝপঝপ শব্দ, একই তালে হাঁটা, সুশৃঙ্খল বাহিনীটাকে দেখে এই প্রথম স্বামীর পেশা নিয়ে গর্বিত অনুভব করেছে তাসনিয়া। ঠোঁটের কোণায় আকস্মিকভাবে হাসির ঢেউ দেখা দিয়েছিল তখন।
গোফরান সিদ্দিকী ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতে নয়। জেনারেলের সাথে ভিজিটে এসেছে। এখান থেকে বাড়ি ফেরার কথা। উনার সহকর্মী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে জরুরি আলাপে ব্যস্ত থাকাকালীন মেজর জিয়া যখন এসে হেসে বলল,
– ইনি কে কর্নেল সাহেব। চিনতে পারছেন কিনা দেখুন তো।
তখনি ঘাড় ফিরিয়ে তাসনিয়াকে দেখামাত্রই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোফরান। তার অবাকদৃষ্টি দেখে সহকর্মীরা হেসে সেখান থেকে প্রস্থান নিল। জাম রঙের একটা শাড়ি, কালো রঙের একটা ফুলতোলা চাদর মাথায় জড়িয়ে ছুটে এসেছিলো তাসনিয়া। একদম পাক্কা গিন্নি গিন্নি ভাব।
তার শরীরে জুড়ে থাকা পট্টি গুলো একেকটা ভীষণ সুনিপুণ দৃষ্টিতে দেখার পর সে যখন বললো,
– আপনি এই শরীরে বাড়ি না গিয়ে এখানে এসেছেন কেন?
তখন তার উত্তর ছিল,
– মিনির মা ফিরে এসেছে জানতাম না। ফেরার তো কারণ দরকার।
তাসনিয়া নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে রাখছিলো। কঠিন মুখটা যখন এমন শান্ত জলের মতো কথা বলে, তখন তার কিচ্ছু বলার থাকে না।
অনেকক্ষণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো সে।
গোফরানও নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ততক্ষণ। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর তাসনিয়া জিজ্ঞেস করলো,
– আমার উপর রাগ করে বাড়ি ফেরেননি।
গোফরানের জবাব,
– হয়ত তাই।
– আপনি যা করেছেন তা কি ভালো করেছেন? আমিই না হয় অবুঝ। কিন্তু আপনি? আপনি তো অনেক বুঝদার একটা মানুষ।
– তুমি সত্যিই অবুঝ। নইলে এত কষ্ট করে এমন দুর্গম সেনা ক্যাম্পে কে আসে?
– আপনি নিজেকে কি মনে করেন? আপনি সবার জন্য চিন্তা করেন আর কেউ করেনা?
– করে। ভুল করে একটা প্রেমিকা জুটিয়েছিলাম সে একটুআধটু করে। বাড়িতে মা, ভাইবোন, বাচ্চা আছে তারা করে। একটা দূরসম্পর্কের বউ আছে সেও করে। করেনা একথা বললে পাপ হবে।
– এই সময়েও আপনাকে মজা করতে হবে আমার সাথে?
– মজা কোথায় করলাম? সিরিয়াস প্রশ্নের সিরিয়াস উত্তর।
তাসনিয়া আবারও অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর চট করে ফিরে তার নিকটে ঘেঁষে বুক আর হাতের সাথে বাঁধা বড়সড় ব্যান্ডেজের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
– ডাক্তার বললো অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। ওখানে এখনো পেইন হচ্ছে?
– হচ্ছে।
তাসনিয়া বিচলিত হয়ে বলল,
– তাহলে আপনি এখানে কি করছেন? এটা নিশ্চয়ই মজার করার বিষয় নয়।
– মজা লাগছে এই ভেবে মিনির মা আমার খোঁজ নিতে সদূর মিলিটারি হসপিটাল অব্দি ঘুরে এসেছে।
– হ্যা এসেছি। কারণ আমার একটা দায়িত্ব আছে।
– হায়রে দায়িত্ব।
তাসনিয়া রাগে ফুঁসে ওঠে বলল,
– এখনো মজা করে যাচ্ছেন! বুঝতে পারছেন না আমি কত ভয়ে ভয়ে এখানে এসেছি।
– এত ভয় কিসের?
– কিসের মানে? একটা মানুষ গুলি খেয়েছে। আর আমার ভয় হবে না?
– গুলি খেয়ে মরে গেলেই বা কি?
তাসনিয়ার সব ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে গেল। গোফরান সিদ্দিকীও হয়ত এটাই চাচ্ছিলেন। নিজের হাতের বল দ্বারা জোরে ঠেলে দিয়ে, – তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করেছেন ” বলেই সে যখন কান্না চাপা দিতে ব্যর্থ হলো তখন কি আনন্দটাই না লেগেছিলো গোফরান সিদ্দিকীর। তাকে কাছে টেনে নীরব আলিঙ্গনটি, গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের বিষফোঁড়ার মতো ব্যথা নিরাময়ের কাজে লেগেছিলো।

সন্ধ্যাটুকু এখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করবে নাকি যাবে?
তাসনিয়া তাকে ধরে রাখা অবস্থায় মুখ তুলে চেয়ে বলল,
– এবার আর প্রেমে পড়ছিনা। এসব প্রেমালাপ সাজিয়ে কোনো লাভ নেই।
গোফরান অল্প হেসে বলল,
– প্রেমে তো অনেকেই পড়েছে। এবার কেউ মায়ায় পড়ুক।
তাসনিয়া অশ্রুচোখে মৃদু হাসলো। মাথা একপাশে এলিয়ে বলল,
– পড়লাম।
গোফরান মন উজাড় করে হাসলো।

সেই সন্ধ্যেটুকুতে নিজেকে কর্নেল গোফরান সিদ্দিকীর স্ত্রী হিসেবে আরও একটা নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিলো তাসনিয়া। কেটেছে দুর্দান্ত কিছু মুহূর্ত। ভর সন্ধ্যের মলয় বাতাসে অবিন্যস্ত শাড়ির আঁচল উড়িয়ে, কপালের উপর নেচে বেড়ানো চুলগুলোকে প্রশয় দিয়ে, আর পাহাড়ের গায়ে অযত্নে বেড়ে উঠা সদ্য ফোঁটা ফুলের গন্ধ শুঁকে বাড়ি ফিরলো তারা বাচ্চাগুলোর আনন্দ হয়ে।

চলমান…