#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_১৭
গাড়ির স্প্রীড বাড়িয়ে দিচ্ছে আরাদ। এই মুহূর্তে মথা কাজ করছে না আরাদের। পেছনের সিটে যে ওর দুই বোন বসা তারও কোন খেয়াল নেই। গুলির বেগে আরাদের গাড়ি ছুটে চলছে। আরশি আর তনয়া কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। গাড়ি এসে পুলিশ স্টেশনে থামলো। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলো আরাদ। আকাশের কেবিনে গিয়ে সে বড় করে শ্বাস ফেলেলো।
‘আকাশ আমি সায়েনের সাথে কথা বলতে চাই,রাইট নাউ।’
একটা ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিল আকাশ। আরাদের কন্ঠস্বর শুনে চমকে সেদিকে তাকালো। আরাদকে হাঁপাতে দেখে অবাক হয়ে গেল আকাশ। আরাদ হঠাৎ এই সময় এখানে!!বিষ্মিত কন্ঠে আকাশ বলল,’তুই এখানে??কোন সমস্যা??’
‘আমি সায়েনের সাথে কথা বলতে এসেছি। কোথায় ও??প্লিজ!!’
আকুতি ভরা কন্ঠে বলল আরাদ। আকাশ ওর কথার মানে বুঝতে পারছে না। বলল,’কিন্তু কেন??আর সায়েনকে তুই চিনিস কিভাবে??’
আরাদ নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলে,’সব পরে বলব আগে আমাকে সায়েনের কাছে নিয়ে চল!!’
এরই মধ্যে জোনায়েদ এসে কেবিনে ঢুকলো। ওর পিছু পিছু তনয়া আরশি। গাড়িতে থাকতেই আরশি জোনায়েদ কে ফোন করে সব বলে এবং সাথে সাথে জোনায়েদ ও চলে আসে। আরাদকে জিজ্ঞেস করে,’এ্যানি প্রবলেম আরাদ??’
আরাদ ঘাড় ঘুরিয়ে জোনায়েদের দিকে তাকালো। জোনায়েদ এগিয়ে আসতেই আরাদ বলল,’সায়েন এখানে আছে জোনায়েদ। আমি ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।’ বলেই আরাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,’প্লিজ আকাশ!!দেরি করিস না।’
সায়েনের নাম শুনে জোনায়েদ চমকে গেল সাথে তনয়া আর আরশিও। আকাশ কিছু না বুঝেও আরাদকে সায়েনের সাথে দেখা করতে নিয়ে গেলো। কয়েদখানার বেশ ভেতরে গেল সবাই। সায়েনকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে গিয়ে সবাই দাঁড়াল। লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট সায়েনের চেহারা দেখতে পাচ্ছে আরাদ। পা ভাঁজ করে বসে আছে সায়েন। বই হাতে নিয়ে তাতে কিছু একটা দেখছে আর প্রশ্নপত্রের দিকে তাকাচ্ছে। মাঝেমাঝে প্রশ্নপত্রের উপর কলম চালাচ্ছে। বেশ ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে সায়েনকে। আরাদ এক হাতে লোহার দরজার উপর হাত রাখলো। আকাশ উচ্চস্বরে বলে উঠলো,’সায়েন!! তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।’
মাথা তুলে তাকালো সায়েন। আরাদকে দেখেও দৃষ্টি স্থির তার। শান্ত চোখে সবাইকে দেখে নিলো সে। সায়েনের শান্ত দৃষ্টি আরাদের কাছে বিষাদময় লাগছে। এর থেকে যদি কেউ ওর বুকে একশো টাও তীর মারে তাতেও সে এতটুকু ব্যথা পাবে বলে মনে হয় না। সায়েনের এই চাহনি পুরো ভষ্ম করে দিচ্ছে আরাদের হৃদয়কে। শুকনো ঢোক গিলে আরাদ নড়েচড়ে দাঁড়ালো। সায়েন আবার তার দৃষ্টি বইয়ের দিকে দিলো। আরাদ আসবে এটা যেন সে আগে থেকে জানতো। চোখের কোণে পানি জমে গেছে আরাদের। জোনায়েদ আকাশে নিয়ে বের হয়ে আসলো। আরাদকে একা ছেড়ে দিলো।
আরাদ ধরা গলায় সায়েনকে ডাকল, ‘সায়েন!!’
তাকালো না সায়েন তার মনোযোগ বইয়ের দিকে। আরাদ আর ডাকলো না ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। এতদিন পর সে সায়েনকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছে। এতদিনের ছটফটানি কমাচ্ছে আরাদ। এভাবে যে সায়েনকে পাবে তা ভাবতেও পারেনি। আরাদ যাচ্ছে না দেখে সায়েন দ্বিতীয় বারের মতো তাকালো আরাদের দিকে। এবার সায়েনকে ভালো করে পরখ করলো আরাদ। ফর্সা মুখটা মলিন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। আগের থেকে বেশ শুকিয়ে গেছে। চোখেমুখ আগের মতো হাসিখুশি নেই। আগের সায়েন আর এখনকার সায়েনের মধ্যে হাজার গুণ তফাৎ। সায়েন এবার বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো আরাদের দিকে। মুখোমুখি দাঁড়ালো আরাদের। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সায়েন বলল,’কি দেখতে এসেছেন??আমি কেমন আছি?? আমি খুব ভালো আছি। এখানে আমি খুব ভালো আছি।’
হাসির মাঝে চোখ ভরে গেছে সায়েনের। আরাদ অকপটে জবাব দিলো,’তুমি ভালো আছো কি না তা আমি তোমাকে দেখেই বুঝে গেছি সায়েন। সে ক্ষমতা অন্তত আমার আছে।’
সায়েন চুপ করে তাকিয়ে রইল আরাদের দিকে। গাল বেয়ে পানি পড়ছে সায়েনের। সায়েন জানতো একদিন না একদিন আরাদের মুখোমুখি সে হবেই হবে। তাই আজকে আরাদকে দেখে সে অবাক হলো না।
লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে দিলো আরাদ। হাতটা সায়েনের মুখের কাছে নিতেই পিছিয়ে যায় সায়েন। কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে, ‘আমাকে ছোঁবেন না!!! আপনার ছোঁয়া আমার শরীরে বিষ যন্ত্রনার মতো লাগে। আমার খুব যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু পেতে ইচ্ছে করে তখন। প্লিজ আমাকে ছোঁবেন না।’
হাত থেমে গেল আরাদের। সায়েনর কাছ থেকে এর থেকে বেশী কিছু এক্সেপ্ট করা যায় না। কিন্তু সায়েন কিভাবে এখানে??ওর অবর্তমানে ঠিক কি কি ঘটেছিল??
‘ঠিক আছে আমি তোমাকে টাচ করব না। তবে, তুমি এখানে কিভাবে এসেছো??আর তোমার মা কিভাবে মারা গেছে সায়েন??’
মায়ের কথা শুনে সায়েন বসে পড়লো নোংরা মেঝেতে। সাদা রঙের কামিজটা মুহূর্তেই ময়লায় পরিণত হলো তার। হাঁটু ভাঁজ করে তাতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো সায়েন। সে এবার শব্দ করেই কাঁদছে। আরাদের এবার অস্থির লাগছে। সায়েনের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে সে। আরাদ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে বলল দরজা খুলতে কিন্তু সে রাজি হলোনা। আকাশের অনুমতি ছাড়া সে দরজা খুলবে না। আরাদের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। কলার চেপে ধরলো পুলিশের। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আকাশ আর জোনায়েদ দৌড়ে এলো। আরাদকে ধরে টেনে সরালো আকাশ। বলল,’কি করছিস তুই আরাদ। থাম একটু,আমি দেখছি।’
আকাশ দুজন মহিলা পুলিশকে ডেকে দরজা খুলল। মহিলা পুলিশ দুজন ভেতরে ঢুকে সায়েনকে সামলাতে লাগলো কিন্তু সায়েন কেঁদেই যাচ্ছে। আরাদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দৌড়ে ভেতরে ঢুকে সায়েনকে দুহাতে আগলে নিলো। হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েছে সায়েন। আরাদের শার্ট খামচে ধরে সে কাঁদছে আর বলছে,’আমি আমার মা’কে মেরে ফেলেছি। সব দোষ আমার। আমি সত্যি খুব খারাপ। আমার কোন ক্ষমা হয় না। মরতে চাই আমি। বাঁচতে চাই না আমি।’
সায়েনের চিৎকারে আরাদ শক্ত করে সায়েনের মাথা ওর বুকে চেপে ধরে। সায়েন দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে আরাদকে। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে গেছে সায়েন। যখন সে শান্ত হলো চোখ তুলে তাকালো। নিজেকে আরাদের বাহুডোরে দেখে ছিটকে সরে গেল সায়েন। চিৎকার করে বলল,’সবাই চলে যাও!! আমার কাউকে লাগবে না, কাউকে না। চলে যাও সবাই।’
আরাদ আসতে চাইলো না। জোনায়েদ টেনে নিয়ে এলো আরাদকে। সবকিছু সামলিয়ে নিজের কেবিনে এলো আকাশ। জোনায়েদ ও আরাদ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। আকাশ নিজের চেয়ারে বসে আরাদের দিকে তাকালো। আরাদ যখন সায়েনের সাথে কথা বলছিল তখন জোনায়েদ সবটাই বলেছে আকাশকে। সব শুনে আকাশ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ভাগ্য ওদের কোথায় নিয়ে এসেছে?? দুই বন্ধু এক জনের প্রতি দুর্বল। আকাশ বড় নিঃশ্বাস ফেলে সামনে থাকা খয়েরী মলাটের ফাইলখানা হাতে নিলো। আরাদ সরাসরি আকাশকে প্রশ্ন করলো,’কাকে খুন করেছে সায়েন?? সত্যি কি সায়েন ওর মা’কে মেরে ফেলেছে??’
আকাশ মাথা নেড়ে ফাইল খুলে তাতে চোখ বুলায়। তিন বছরের আগের ঘটনা তো পুরোপুরি মনে থাকে না তাই ঘটনাটা আবার পড়লো সে। তারপর বলল,’সায়েন নিজের মা’কে খুন করেনি। তবে মা’কে খুন করার দায় পড়েছিল ওর ঘাড়ে। এবং পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়।’
আরাদ অবাক হয়ে বলল,’তাহলে সায়েন কেন জেলে??’
‘রিলাক্স আরাদ,সব বলব আমি। যেটুকু জানি ঠিক সেটুকুই বলতে পারব। বাকিটা সায়েন ও তার পরিবার জানে। মা’কে সে খুন করেনি। কিন্তু হাজবেন্ড কে খুন করার অপরাধে চার বছরের জেল হয়েছে সায়েনের।’
আরাদ শরীরের সব ভর ছেড়ে দিলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে থম মেরে বসে রইল। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিৎ তা আরাদ বুঝতে পারছে না। সায়েনের বিয়ে হয়ে গেছে!!তাও তিন বছর আগে!!আর কি কি ঘটেছে ওই মেয়েটার জীবনে?? কতকিছু ফেস করতে হয়েছে সায়েনকে?? এসব ভেবে মাথাটা ধরে গেছে আরাদের। চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই আঙ্গুল দ্বারা কপালে স্লাইড করতেছে সে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলাচ্ছে আরাদ। আকাশ ফাইলটা বন্ধ করে বলতে লাগলো, ‘তুই ঠিকই শুনছিস আরাদ। তিন বছর আগে সায়েনের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না বিধায় বিয়ের সাত দিনের মাথায় সায়েন ওর পরিবারের কাছে ফিরে আসে। ওর হাজব্যান্ড নাকি খারাপ ছিল। বাজে নেশা আর খারাপ কাজ করতো। সায়েন তা জানতে পেরে চলে যায় ওর মায়ের কাছে। এবং মা’কে সব জানায়। সায়েনের মা নাকি প্রতিবাদ করেছে এবিষয়ে। সায়েনও ওর মায়ের সাথে প্রতিবাদ করেছিল।’
বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো আকাশ। আরাদ এখনও আগের ন্যায় বসে আছে। আকাশ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে দিল। তারপর আবার বলতে লাগলো,’সেদিন সায়েনের হাজবেন্ড ওকে নিতে এসেছিল। সায়েনের বাবা ভাই বাড়িতে ছিল না বিধায় সায়েনকে যেতে দিচ্ছিল না ওর মা। ছেলেটা নেশা করে এসেছিল সেদিন। সায়েনের মা’কে উপেক্ষা করে সে সায়েনের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলো। এক পর্যায়ে তিনজনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। নেশা করার জন্য ছেলেটার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। শক্ত হাতে চেপে ধরে সায়েনের মায়ের গলা। এমতাবস্থায় কি করা উচিৎ ছিল সায়েনের?? প্রতিবাদী সায়েন তখন মা’কে বাঁচানোর জন্য রান্নাঘরে ছুটে যায়। ধারালো ছুরি এনে আঘাত করে নিজের স্বামীকে। একটা মেয়ে কোন পর্যায়ে গেলে তার স্বামীকে আঘাত করতে পারে??সায়েন সেই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু মা’কে বাঁচাতে পারেনি। শ্বাসকষ্টের রোগী ছিল সায়েনের মা। তাই শক্ত হাতের চাপ তিনি নিতে পারেননি। সাত মিনিটের মতো চেপে ধরেছিল গলা তাই তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। হসপিটালে নিয়ে যাওয়াও হয়েছিল। ডক্টর তাকে মৃত ঘোষণা করেছিল। তারপর সায়েনের হাজবেন্ডের পরিবার কেস ফাইল করে সায়েনের নামে। ওরা চেয়েছিল দুটো খুনই সায়েনের উপর চাপিয়ে দিতে। কিন্তু পারেনি। সব সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার সায়েনকে সাজা দেওয়া হয়। খুনটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। যেহেতু মার্ডার দন্ডণীয় অপরাধ তাই চারবছরের সাজা হয় সায়েনের। সায়েন রংপুর থানায় ছিল একবছর। দু’বছর ধরে ওকে ঢাকা থানায় ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাই পড়াশোনা এখানে থেকেই করছে সে।’
আরাদ এখনও আগের ন্যায় বসে আছে।নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ শোনা যাচ্ছে। জোনায়েদ ও নির্বাক হয়ে বসে আছে। আরশি তনয়াকে সে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আকাশ ওদের দিকে ঘুরে তাকালো বলল,’আমি এটুকুই জানি তবে সবচাইতে বেশি জানে সায়েন। কিন্তু ও এখন পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা কারো কাছে শেয়ার করেনি। মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে ও। এর থেকে বেশী আমি জানি না তবে আমার মনে হয় আরো অনেক কাহিনী চাপা পড়ে আছে যা একমাত্র সায়েন জানে।’
বলতে বলতে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে আকাশ। আরাদের দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে বলল,’জেলে থাকার জন্য বোধহয় সায়েনকে খুঁজে পেতে তোর কষ্ট হয়েছে। তাছাড়া ওরা সপরিবারে রংপুর ছিলো। ওখানেই সায়েনের বিয়ে হয়।’
আরাদ এবার মুখ খুলল,’কি হয়েছে না হয়েছে তা আমি শুনতে চাই না। সায়েনকে বের করার ব্যবস্থা কর। যত দ্রুত সম্ভব।’
আকাশ বিষ্মিত কন্ঠে বলল,’এটা কিভাবে পসিবল?? আইনের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে আরাদ।’
‘জানি!! সবচেয়ে বড় লয়ার হায়ার করবো। বাকি একবছরের সাজা মওকুফ করাবো। যত টাকা লাগে আমি দেবো।’
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো আকাশ তারপর বলল, ‘তোর তো আবার অনেক টাকা পয়সা। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। দেখ পারিস কি না??আমি সব রকমের সাহায্য করব তোকে।’
________________
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সায়েন। গুটিসুটি মেরে ছোট্ট চৌকিতে শুয়ে আছে সে। তখন অনেক কষ্টে সবটা সামলিয়েছে আকাশ। মাঝেমাঝে এরকম করে সায়েন। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে আর মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকে। তখন আকাশসহ বাকি মহিলা পুলিশরাও সায়েনকে সামলায়। জয়নব বেগমের ইচ্ছে মতোই সাইকোলজি নিয়ে পড়ছে সে। মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছে সায়েন।
প্রায় অনেকক্ষণ ঘুমালো সায়েন। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছে রাত অনেকটাই হয়ে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে বসল। চোখ ডলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। সামনে তাকাতেই অবাক সায়েন। কারণ লোহার দরজায় হেলান দিয়ে এক পা ভাঁজ করে আরেক পা মেলে দিয়ে বসে আছে আরাদ। তারমানে আরাদ এখনও যায়নি?? কিন্তু কেন?? কিন্তু আরাদের সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছা নেই সায়েনের। কক্ষের এক কোণে মাটির কলস ভর্তি পানি রাখা সায়েন সেদিকে এগিয়ে গেলো। স্টিলের গ্লাসটিতে পানি ঢেলে মুখে ছিটালো। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পিছনে ফিরে তাকালো আরাদ। সায়েন ঘুম থেকে উঠে গেছে দেখে নড়েচড়ে বসল সে। ঘুমিয়ে ছিল বিধায় কোন শব্দ করেনি আরাদ। জোনায়েদ ওকে বাড়ি ফেরার জন্য বলেছিল কিন্তু আরাদ ফেরেনি। জোর করেও কোন লাভ হবে না তাই জোনায়েদ চলে গেছে। একটু আগেই আকাশের ডিউটি টাইম শেষ হওয়াতে সেও চলে গেছে। রয়ে গেছে আরাদ।
সে সায়েনকে ভালো করে দেখছে। কক্ষের মধ্যে সাদা বাতি জ্বলছে। যার আলো পুরো কক্ষকে সম্পূর্ণ আলোকিত করতে পারেনি। ওড়নায় মুখ মুছে সায়েন বই নিয়ে বসে। কালকে পরীক্ষা নেই। তবুও সে তাড়াতাড়ি পড়তে বসলো। আরাদ এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। সায়েনকে শান্তশিষ্ট দেখে মানতে পারছে না আরাদ। ও চাইছে সায়েন ওকে খুব করে বকুক কথা শোনাক এমনকি চার পাঁচটা থাপ্পর মারুক। এতে ওর শান্তি হবে। কিন্তু সায়েন তা করছে না। নিরব ঘাতক সে। কিছু না বলেই আরাদকে শাস্তি দিচ্ছে। এভাবেও শাস্তি দেওয়া যায়। যখন কেউ কারো কাছ থেকে অবহেলা, খারাপ ব্যবহার আশা করে তখন সে যদি এসব কিছু না করেই চুপ থাকে তাহলে এই শাস্তির থেকে বড় শাস্তি হয় না। কারণ রাগ, অভিমান, অবহেলা করার জন্য একটা অধিকারের প্রয়োজন। সায়েন হয়তো সেই অধিকার আরাদের থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্য এরকম করছে। আরাদ ওকে সেই অধিকার দিলেও সায়েন তা নিচ্ছে না।
সায়েনের দিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেলল আরাদ।
#চলবে,,,,,,,,
#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_১৮
মৃদু বাতাস বইছে, কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে। কিন্তু এই বাতাস যেন আজ বিষাদে ভরা। সেজন্য বোধহয় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আকাশের। বাড়িতে যায়নি সে, জিপটা ব্রিজের পাশে দাঁড় করিয়ে সে নেমে পড়েছে। ব্রিজের বর্ডার ঘেষে দাঁড়িয়েছে আকাশ। নদীতে নৌকা ট্রলার চলাচল দেখছে। আরাদের সামনে স্বাভাবিক থাকতে পারলে এখন সে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। কষ্টগুলো কেমন যেন দলা পাকিয়ে আসছে। সায়েনের জন্য আরাদের করা পাগলামি গুলো সহ্য হচ্ছে না আকাশের।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখছে আকাশ। জোনায়েদের থেকে সব জেনেছে সে। আরাদ কিভাবে সায়েনকে দেখেছে,এমনকি ওদের চিলেকোঠায় থাকা সব বলেছে। আরাদ যে ওর আগে থেকেই সায়েনকে ভালোবাসে। এটাও মানতে কষ্ট হচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে তার অনুভূতি মাপছে। সায়েনের প্রতি তৈরি হওয়া সুপ্ত অনুভূতি কি আরাদের থেকে কোন অংশে কম??নাকি তার ভালোবাসা কম। আচ্ছা সায়েন কাকে চায়?? নিশ্চয়ই আরাদকে চাইবে। যদিও সে প্রকাশ করে না। মনে এক অদম্য রাগ অভিমান সায়েনকে আটকে দিয়েছে। তবে একদিন না একদিন ঠিকই আরাদের কাছে ফিরে যাবে। তাহলে ওর ভালোবাসা কি একতরফা??তাই হবে। সায়েন তো কখনোই ওর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনি। কোন অনুভূতি ও দেখেনি আকাশ।
পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায় সে। ধোঁয়া আকাশের ছেড়ে দিয়ে ভাবতে থাকে যে সামনে ওদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে।
আরাদ সায়েনের দিকে ফিরে দু’পা ভাজ করে বসে আছে। একহাত তার গালে। সায়েন খাচ্ছে,একটু আগেই ওর খাবার দিয়ে যাওয়া হয়েছে। রুটি আর ভাজি। কি ভাজি তা দেখেও বুঝতে পারেনি আরাদ। আরাদকেও খাবার দিয়ে গিয়েছিল। তবে সায়েনের খাবার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আরাদের। সায়েনের সামনে সে এসব কিভাবে খাবে??তাই ফিরিয়ে দিয়েছে সে। সায়েন একেরপর এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরছে। দেখে মনে হচ্ছে খেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে সে। কিন্তু আসলে যে খাবারটা বাজে খেতে। খেতে খেতে সায়েন আরাদের দিকে তাকালো। আরাদকে এভাবে তাকিয়ে থেকে বিরক্তিবোধ করলো সায়েন। আরাদ একটু নড়েচড়ে বসে বলল,’আমার উপর তোমার রাগ হচ্ছে না সায়েন??দু চারটে বাজে কথাও তো বলতে পারো?? থাপ্পর মারতেও পারো। এমনকি খাওয়া শেষে প্লেটটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারতেও পারো। অথবা ওই মাটির কলসিটা আমার মাথায় ভাঙতেও পারো??’
সায়েন খাওয়া বাদ দিয়ে কিছু পল আরাদকে দেখলো। শব্দ করে প্লেটটা মেঝেতে রেখে পানি খেয়ে নিল। গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আপনার গায়ে হাত দেওয়ার কোন রাইট নেই আমার। সব অধিকার ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। আর আপনাকে মেরে আমার কি লাভ। আমি কি আমার মা’কে ফিরে পাবো?? পেছনে ফেলে আসা জীবনটা কি ফিরে পাবো?? মারধর করে যদি সবকিছু ফিরে পাওয়া যেতো তাহলে এই পৃথিবীটা কবরস্থানে পরিণত হতো। সবকিছু ফিরে পাওয়ার জন্য যে যাকে পেতো মারধর করে সবকিছু উসুল করে নিতো।’
মুচকি হাসলো আরাদ বলল,’সেদিন ছাদ থেকে তোমার থেকে উওর না শুনে চলে এসেছিলাম সায়েন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে উওরটা না শুনে আমি অনেক বড় ভুল করেছি। যার জন্য তিন বছরের বেশি সময় আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তোমাকে এভাবে দেখব সেটা কখনোই ভাবিনি আমি সায়েন। সবটা আগের মতো কখনোই করতে পারব না। তবে তোমাকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব আমি।’
সায়েনের মুখে হাসি দেখা দিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি,’আমি কি অস্বাভাবিক জীবনে আছি??উহু একদম না। আর না আপনার কোন সাহায্য আমার চাই। আপনি আমার সামনে থেকে চলে গেল আমি বেশি খুশি হবো। অন্তত আমার এই খুশিটুকুর জন্য চলে যান আপনি।’
নিরব থেকেই অপমান করছে আরাদকে। তা আরাদ বেশ বুঝতেই পারছে। মাথা নিচু করে আরাদ বলে উঠলো,’তিনবছর তো খুশি ছিলে না তুমি। তাহলে আজকে আমার চলে যাওয়াতে আর কতটুকু খুশি হবে তুমি??’
বাঁকা হাসলো সায়েন বলল,’ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার খুশি বা খারাপ লাগাতে আপনার কিছু যায় আসেনা। সরি, এসব বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
চাদরটা টেনে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো সায়েন। আরাদ আগের ভঙ্গিতেই বসে রইল।
সকাল সকাল শাফিন আর শফিকুল ইসলাম এসেছেন সায়েনের সাথে দেখা করতে। ওনারা আরাদকে মেঝেতে বসে ঘুমাতে দেখে অবাক হয়ে গেল। সায়েন জেগে ছিল বিধায় বাবা আর ভাইয়াকে ইশারায় চুপ করতে বলল। শফিকুল ইসলাম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের পানি ফেলল। তবে কোন কথা বলল না। প্রতিবারই এসে সায়েনের সাথে তিনি কথা বলেন না। গলায় কথা আটকিয়ে যায় তার। কোন বাবা চায় সন্তানকে এভাবে দেখতে?? মেয়েকে এভাবে হাজতবাস করতে দেখে তিনি মোটেও ভালো নন। পরপর দুটো ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর মেয়ের এই অবস্থা মেনে নিতে ভিশন কষ্ট হচ্ছে। শফিকুল ইসলাম চলে গেলেন। এবার শাফিন এগিয়ে গেল সায়েনের দিকে। সায়েন অলরেডি কেঁদে দিয়েছে। শাফিন ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘কাদিস না!! তোকে এভাবে দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সায়ু।’
‘ভাইয়া মা’কে মনে পড়ছে খুব। মা’কে বল না যে তুই ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিয়েছিস আর আমিও সাইকোলজি নিয়ে পড়ছি। মা কিছুতেই রাগ করে থাকতে পারবে না চলে আসবে। ভাইয়া আমার এখানে থাকতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না রে। আমার শুধু মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।
সায়েনের হাত দুটো ধরে শাফিন বলল,’ওই নোংরা ছেলেটার হাতে তুলে দেওয়াটাই আমাদের ভুল হয়েছিল। সেদিন সবকিছু জেনে শুনে সিদ্ধান্ত নিলে এসব কিছুই হতো না।’
শাফিন থামলো,একপলক আরাদের দিকে তাকিয়ে আবার সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’ও এখানে কি করছে??জানলো কিভাবে তুই এখানে আছিস??’
‘জানি না। ড্রামা করা শেষ হয়নি। তাই আবার নতুন ড্রামা করার জন্য হাজির হয়েছে। ভাইয়া তুমি চলে যাও। তোমাদের দেখলে আবার নতুন ড্রামা শুরু করে দেবে। পারলে ওকে এখান থেকে সরানোর চেষ্টা করো।’
শাফিন হতাশার শ্বাস ত্যাগ করে বলে,’এটা পুলিশ স্টেশন সায়ু। আমার কথায় কে কি বলবে?? তবুও আমি চেষ্টা করবো। আসি হুম?? কালকে আবার আসবো।’
শাফিন চলে গেল। আরাদ ঘুমে এতোই বিভোর ছিল যে ওদের কথাবার্তা কিছুই শুনতে পায়নি। আকাশ এসে আরাদকে এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে টেনে তোলে। বলে,’তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস??বাসায় যাবি না?তোর বাবা মা আমাকে ফোন করে শেষ করে দিয়েছে। কাল সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। শুধু ফোন রিসিভ করেই গিয়েছি।’
আরাদ উঠে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে সায়েনের দিকে তাকালো একবার। সায়েন বই হাতে বসে আছে। আরাদ পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকলো আরাদ। ডান হাত ঘাড়ে রেখে মাসাজ করছে সে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানোর ফলে ঘাড়টা ব্যথা হয়ে গেছে আরাদের। নিজের রুমে গিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেল সে। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হলো। নিজেকে পরিপাটি করে খাবার টেবিলে এসে বসলো আরাদ। উপস্থিত সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আরাদের দিকে। কেউ কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কিছু বললে না জানি আবার খাবার টেবিল উল্টে ফেলে দেয়। হাসি বেগম কিছু বলতেন কিন্তু টেবিলটার কথা ভেবে কিছু বলেননি। অনেক কষ্টে তিনি এই টেবিলটা খুঁজে এনেছে। টাকা পয়সা বড় কথা নয়।শখটাই বড় কথা। আরাদ যদি ভেঙ্গে ফেলে??এই ভেবে সেও চুপ করে আছে। আরাদ নিজের খাওয়া শেষ করে মাথা তুলে তাকালো। সোজাসুজি আরশির দিকে তাকিয়ে বলল,’দাঁড়া তুই??’
ঝটপট দাঁড়িয়ে পড়লো আরশি। শেষমেষ ওকেই পেলো আরাদ?? শুকনো ঢোক গিলে সে মেকি হাসি দিলো। আরাদ সোজা হয়ে বসে বলল,’আমি এতক্ষণ কিভাবে খেলাম তার বর্ণনা দে??’
আরশি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এটা কোন ধরনের প্রশ্ন??সে আমতা আমতা করে বলল, ‘জ্বী ভাইয়া??’
আরাদ ধমকে বলল,’এতক্ষন কিভাবে খেয়েছি বর্ণনা দে??’
আরশির এবার কান্না পেয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তামিম আর তনয়া মুখের ভেতর খাবার পুরছে। নাকমুখ দিয়ে খাচ্ছে ওরা। হাসি বেগম ইমান সাহেবের পাতে ডাল দিচ্ছেন তো দিচ্ছেন। প্লেট ভরে উপচে পড়ছে কিন্তু তিনি থামছে না। ইমান সাহেব হাসি বেগমের থেকে ডালের বাটিটা কেড়ে নিয়ে বলল,’এতেও আমার হবে না। তুমি বরং রান্নাঘর থেকে ডালের কড়াইটা নিয়ে আসো।সব ডাল আমিই খাবো।’
হাসি বেগম মাথা নেড়ে চলে গেল। তনয়া মা বাবার কান্ড দেখে ঠোঁট চেপে হাসছে। আরাদ উঠে নিজের রুমে চলে গেল। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। নিলিমা বেগম চেয়ারে বসে পড়লেন। কালকে আরশি সবাইকে সব বলে দিয়েছে সায়েনের ব্যাপারে। সায়েনকে না চিনলেও আরশি জানতো যে সায়েন খুনি এবং নিজের হাজবেন্ড কে খুন করেছে। নিলিমা বেগম প্রলাপ করতে করতে বললেন, ‘এখন কি হবে??ওই খুনি মেয়েটাকে আরাদ বাড়িতে তুলবে??এটা কখনোই হতে দেব না আমি??’
হাসি বেগম ও তাল মিলিয়ে বলল,’হুম ভাবি। সবচেয়ে বড় কথা হলো মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। তার উপর নিজের স্বামীকে খুন করেছে। তিনবছর জেলে থেকেছে। এমন একটা মেয়ে আরাদের বউ হবে জানলে লোকে কি বলবে??’
তামিমের এবার রাগ হলো খুব। সে উঠে দাড়িয়ে বলল,’লোকে কি বলবে সেটা দিয়ে আমরা কি করব??আর ভাইয়া কিন্তু এখনো বিয়েটা করেনি।’
ফুঁসে উঠলেন হাসি বেগম বললেন,’সবসময় শুধু ভাইয়া ভাইয়া করিস কেন?? কোথায় আরাদকে একটু বোঝাবি তা না??উল্টে আরাদের সঙ্গ দিচ্ছিস।’
‘আমি কারো সঙ্গ দিচ্ছি না। যেটা ভালো সেটাই করবে ভাইয়া। সায়েন নামের মেয়েটার সাথে কি হয়েছে সেটা একবারও জানতে চেয়েছো তোমরা?? কেন সে আজকে এই অবস্থায় তা জানতে চেয়েছো?? শুধু নিজের ছেলের কথাই ভাবছো। ওই মেয়েটা ছিলো বলেই সেদিন তোমার ছেলে বেঁচে ছিল। নাহলে ওরা সেদিন যদি ওই প্রজেক্ট টা চুরি করে নিয়ে যেতো আর তোমার ছেলেকে মেরে ফেলতো তখন এত নাম ডাক কিছুই হতো না।তোমরা পারোও। এনিওয়ে আমি আসি কাজ আছে আমার।’
তামিম চলে গেল। হাসি বেগম এবং নিলিমা বেগম দু’জনেই রাগে ফুঁসছেন। ইমান সাহেব উঠে চলে গেলেন। নিলিমা বেগম তার স্বামীকে বললেন,’তুমি কিছু বলবে না?? তোমার ছেলে একটা ভুল করতে যাচ্ছে!!’
‘আমি জানি না কোনটা ভুল কোনটা ঠিক। আগে ভালো করে সবটা জেনে নেই তারপর নাহয় বিচার করব!!’
বলে তিনিও চলে গেলেন। নিলিমা বেগম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেল। তনয়া আরশিকে বলল,’তুই কেন আগ বাড়িয়ে সব বলতে গেলি??যা বলার সব ভাইয়াই বলতো। এখন পরিবারে নতুন করে অনর্থের সৃষ্টি হবে।’
‘আমি কি জানতাম নাকি যে মা এরকম করবে??’
‘তো কি জানতি তুই??ভাইয়া যদি জানে তুই সবটা বলেছিস তাহলে তোর অবস্থা টাইট করে দেবে।’
হতাশ হলো আরশি। কি হতে কি হয়ে গেল। তনয়া কিছু একটা ভেবে বলল,’কি অদ্ভুত না??ভাইয়া ভাবিকে ভালোবাসে,আকাশ ভাইয়াও ভাবিকে ভালোবাসে। তুই আকাশ ভাইয়াকে ভালোবাসিস। তোদের চারজনের মধ্যেই সব প্যাচ সীমাবদ্ধ।’
আরশিও তাই ভেবে দেখলো সত্যি তো। সে বলল,’এরপর কি হবে তনু??’
‘জানি না। সবটাই উপরওয়ালার হাতে। তবে আকাশ ভাইয়াকে পাওয়ার চান্স তোর আছে। যদি ভাবি ভাইয়াকে মেনে নেয় তবে তোর রাস্তা ক্লিয়ার কি বলিস??’
‘তুই আবার মজা শুরু করেছিস ধ্যাত।’
আরশি উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। তনয়া ও পিছু পিছু ছুটলো। আরাদ স্যুট বুট পড়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি বের হয়েছে। ফোন কানে নিয়ে সে জোনায়েদের সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত। মূলত সায়েনের ব্যাপারে কথা বলছে আরাদ। কিভাবে বাকি সাজা মওকুফ করা যায় এসব নিয়ে?? অফিসে গিয়ে নিজের কেবিনে বসলো আরাদ। তখনই কাঁচের দরজা ঠেলে একজন নারী ঢুকলো। পড়নে তার গাঢ় লাল রঙের শাড়ি। দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি পড়েছে। যার ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে হাত নাড়ানোর জন্য। চুলগুলো তার খোলা। এই মুহূর্তে সে যেকোনো পুরুষের মন সহজেই কেড়ে নিতে সক্ষম। কিন্তু মেয়েটাকে আরাদ দেখেই বিরক্ত হয়ে গেল। প্রথমত নক না করে ভেতরে ঢোকার জন্য আর দ্বিতীয়ত এরকম সাজে আসার জন্য। এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি যে এভাবে সেজেগুজে আসতে হবে?আরাদ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,’হু আর ইউ??আর নক না করে ভেতরে কেন এসেছেন??’
মেয়েটা বিনা বাক্যে চেয়ার টেনে আরাদের মুখোমুখি হয়ে বসলো। দুহাত টেবিলের উপর রেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,’সামিউক্তা, আপনার মনে হয় চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। হবেই তো আমার দিকে তো ঠিক মতো তাকাননি কখনো!!কেন বলুনতো??’
আরাদ সোজাসাপ্টা ভাবে বলল,’তাকানোর প্রয়োজন বোধ করিনি কখনো।’
সামিউক্তা তার হাসিটা প্রস্বস্ত করে বলল,’আই লাইক ইউর এটিটিউড। ইউ লুকিং সো হট।’
মেয়েটার এরকম কথাবার্তা শুনে রাগ হলো আরাদের তবে প্রকাশ করলো না। ঘাড় কাত করে সামিউক্তার দিকে তাকিয়ে বলল,’এসব কথা ছেলেদের মুখে মানায় মিস সামিউক্তা। কোন নারীর মুখে নয়।’
হাসলো সামিউক্তা বলল,’কেন?? ছেলেদের কি শুধু এসব বলার অধিকার আছে মেয়েদের নেই।’
‘সবসময় ছেলেদের সাথে মেয়েদের তুলনা করবেন না। ছেলেরা যা পারে তা কখনোই মেয়েরা পারে না।’
‘ওহ আচ্ছা,তো শুনি কি পারেন আপনি??’
ঠোঁটের কোণে হাঁসি নিয়ে আরাদ বলল,’আমি এই মুহূর্তে নিজের স্যুট শার্ট খুলে বাইরে যেতে পারব আপনি কি তা পারবেন??পারবেন শাড়িটা খুলে বাইরে যেতে??পারবেন না। আমি চাইলে তিনটা বিয়ে করে বউদের এক ছাদের নিচে রাখতে পারি। আপনি কি তিনজন ছেলেকে বিয়ে করে এক সাথে থাকতে পারবেন??উহু, পারবেন না। আর যেভাবে সেজে এসেছেন মনে হচ্ছে কোন বিয়ে বাড়িতে এসেছেন ছেলেদের নজর কাড়ার জন্য। এমনটা ভাবলে ভুল করছেন মিস সামিউক্তা। মেকআপ এর উপরের চেহারাটা সবাই পছন্দ করলেও ভেতরের চেহারাটা সবার ভালো না লাগতেও পারে। বাইরের চাকচিক্য সবাইকে না দেখিয়ে ভেতরের নমনিয়তা দেখানোর চেষ্টা করবেন। নয়তো আপনাকে দেখে কেউ বিউটিফুল বলবে না হট বলবে।’
আরাদের কড়া জবাবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো সামিউক্তার। আরাদ যে ওকে শান্তভাবে অপমান করে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠলো,’কি বলতে চাও তুমি??আমি সুন্দর নই?? শোনো আমি যথেষ্ট সুন্দর আর ম্যাচিউর। সো আমাকে রিজেক্ট করার কোন অপশন নেই তোমার।’
আরাদ এবার শব্দ করে হাসলো। চোখ তুলে সামিউক্তার দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি থেকে ডিরেক্ট তুমি!! আপনার সভ্যতা কোথায় গেল?? এতোটা রূপের বড়াই করেন তাহলে ওই রূপের জোরে আমাকে কেন বশ করতে পারলেন না??রূপ থাকা সত্ত্বেও এটা কি আপনার ব্যর্থতা??’
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে সামিউক্তার। যেচে অপমান হতে যে কেন এসেছে??চোখ নামিয়ে সে হাত কচলাচ্ছে। আরাদ সামিউক্তার অস্বস্তির কারণ বুঝতে পেরে বলল,’ইউর টাইম ইজ ওভার। নাউ গেট লস্ট।’
সামিউক্তা রেগেমেগে বের হয়ে গেল। আরাদের মা আর কাকিমার পরামর্শে সে এখানে সেজেগুজে এসেছিল যাতে আরাদ ওর প্রতি ঝুঁকে যায়। সেটা তো হলোই না উল্টে সে ঘোর অপমান হয়ে ফিরলো। এই মুহূর্তে সে হাসি আর নিলিমা বেগমকে মনে মনে বকছে। কিন্তু আরাদের প্রতি তার ঝোক বেড়েছে। যেকোন মূল্যে তার আরাদকে চাই।
সামিউক্তা বিড়বিড় করে বলল,’আমার এই রূপের কাছেই তোমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে আরাদ ওয়াহেদ। তোমাকে আমার হতেই হবে যেকোন মূল্যে!!’
সামিউক্তা গাড়িতে করে চলে গেল।
পরেরদিন পরীক্ষা আরশি আর তনয়ার। দু’জনে রেডি হয়ে বাইরে আসতেই অবাক। আরাদ গাড়ি নিয়ে ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে। কোন কথা না বলে দু’জনে গাড়িতে উঠলো। আরাদ গাড়ি নিয়ে ভার্সিটিতে এলো। আরশি তনয়া ভেতরে ঢুকলো আরাদ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সায়েনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। একটু পরেই আরাদের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। পুলিশের গাড়ি ঢুকেছে। হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিলো সায়েনের। বাইরে আসতেই সায়েনের সাথে সাথে দুজন মহিলা পুলিশ ঢুকলো। সায়েনকে নিজের আসনে বসিয়ে দিয়ে ওনারা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। আকাশ আরাদের দিকে এগিয়ে গেল। এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আরাদ আরশি আর তনয়ার কথা বলল। মুচকি হাসলো আকাশ। আরাদ যে সায়েনকে দেখার জন্য এসেছে তা সে বুঝেছে। কারণ কালকে আকাশ বারণ করেছে আরাদকে। শাফিন কম্প্লেইন জানিয়েছে আরাদের ব্যাপারে। তাই আরাদ ও যায়নি। আর সেজন্যই এখন এসেছে সায়েনকে দেখতে।
আরশি আর তনয়া নিজস্ব সিটে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে সায়েনকে। শুধু ওরা নয় ক্লাসের বাকি স্টুডেন্টরাও দেখছে সায়েনকে। অনেকে তো ভয় পাচ্ছে। তনয়া আস্তে করে বলল,’আরশি এখনও তো পরীক্ষা শুরু হয়নি। চল গিয়ে ভাবির সাথে কথা বলে আসি??’
‘পাগল হয়ে গেলি নাকি??আর ভাবি ভাবি করছিস কেন??এতো সহজেই কি ও আমাদের ভাবি হয়ে যাবে নাকি??”
#চলবে,,,,,,