চিলেকোঠার প্রেম পর্ব-৪৪ এবং শেষ পর্ব

0
1051

#চিলেকোঠার_প্রেম

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব_৪৪ (অন্তিম পর্ব)

সবাই যখন আরশিকে বিদায় দিতে ব্যস্ত তনয়া তখন ইফতিকে খুঁজতে ব্যস্ত। কিন্তু কোথাও ইফতিকে সে খুঁজে পাচ্ছে না। এতো মানুষের ভিড়ে কি আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে?তনয়া ছুটতে ছুটতে বাইরে চলে গেল তবুও পাচ্ছে না। অবশেষে ফোন করলো ইফতিকে।ফোন রিসিভ করতেই তনয়া বলে উঠলো, ‘কোথায় তুমি??’
কিন্তু ইফতি জবাব দিলো না। তনয়া ধমকে উঠলো বলল,’মুখে কুলুপ এঁটেছো কেন? কোথায় তুমি??’

‘পেছনে তাকাও!!!’
ফোন কানে নিয়েই পিছন ফিরে তাকালো তনয়া। ইফতি ফোন কানে ধরে তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তনয়া ফোন রেখে ইফতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে ও। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে বলল,’কোথায় যাচ্ছো??’

ইফতি কথা বলে না। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তনয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। তনয়া রেগে সজোরে ধাক্কা মারে ইফতির বুকে তারপর বলে,’একটু আগেও তো কত বকবক করছিলে এখন কথা বলছো না কেন??’

‘আগের থেকে চেন্জ হয়ে গেছি তো তাই।’

‘চেন্জ হওয়া লাগবে না আমার সেই আগের ইফতিকেই চাই। শুধু ওই বাজে নেশা করা ছাড়তে হবে।’

হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ইফতি বলে উঠলো, ‘হঠাৎ মত ঘুরলো কেন তোমার? আমার কথায় এতো ইমোশনাল হয়ে গেলে!!আমি তো জানতাম ই না তুমি এতো ইমোশনাল??’

‘কি বলতে চাইছো তুমি??’

ইফতি কথা ঘুরিয়ে বলল,’ভালোবাসো??’

চোখ কুঁচকে তাকালো তনয়া বলল,’আমি নিজে তোমাকে প্রপোজ করেছি এরপরও জিজ্ঞেস করছো ভালোবাসি কি না??’

‘তাহলে কি প্রপোজটা আমার করা উচিৎ ছিল??’

ইফতির এরকম বিহেভে অবাক না হয়ে পারছে না তনয়া। একটু আগেই কত সুন্দর কথা বলছিল ইফতি। এখন হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো??সে বলল,’কি বলতে চাইছো তুমি? আমার ফিরে আসাটা কি তুমি নিতে পারছো না??’

‘পারছি!! কিন্তু তুমি পারবে বাড়ির সবার সামনে আমার কথা বলতে?পারবে বলতে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো??’

‘এসব বলার মানে কি ইফতি??আমি বুঝতে পারছি না যে তুমি এরকম করছ কেন? ওকে ফাইন আমি যদি না বলতে পারি তাহলে কি করবে তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে??’

‘নাহ, তোমাকে তুলে নিয়ে যাব।’
ইফতি তনয়ার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,’তোমাকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না অন্তত এরপর তো নয়ই। কিন্তু তোমার ওই পুলিশ ভাইয়ার জন্য সেটা সম্ভব হবে না। সে তোমার ভাইয়াকে সব বলে দেবে তনয়া। তখন তোমার ভাইয়া তোমার আর আমার সম্পর্কটা মেনে নেবে না তনয়া।’

তনয়া ওপর হাত ইফতির হাতের উপর রেখে বলল,’ভয় পাচ্ছো আমাকে হারানোর??’

মাথা নাড়লো ইফতি। তনয়া আবার বলল, ‘তুমি ভাইয়া আর ভাবির লাভ স্টোরি শোননি?কত ঝড় ঝাপটা কাটিয়ে দু’জনে আবার এক হয়েছে। ভাবি মার্ডার কেসের আসামি তার উপর বিয়ে হয়েছিল। যা সমাজ খারাপ চোখে দেখে। ভাইয়া সেই সবকিছু পায়ের নিচে ঠেলে দিয়ে ভাবিকে আবার নিজের করে নিয়েছে। কিসের জোরে?? ভালোবাসার জোরে। ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তাহলে এই সব সিম্পল ইস্যু কে গুরুত্ব না দিয়ে ভালোবাসাটাকে সবার উপরে রাখতে হবে। তাহলেই সব কিছু মানিয়ে নেওয়া যাবে। আমার বিশ্বাস ভাইয়া অমত করবে না। ভাবি আর আরশি আমার সাথে আছে।’

ইফতি তনয়াকে জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। বুক ভরে প্রশান্তির শ্বাস নিলো। আরশি যখন আকাশের সাথে ইফতি আর তনয়ার বিষয়টা আলোচনা করলো তখন আকাশ অবাক হয়েছিল। আরশি নিজেই ওকে সত্যটা বলেছিল। তারপর আকাশ নিজে গিয়েছিল ইফতির বাড়িতে। শাসিয়ে এসেছিল ইফতিকে যেন ও কখনো তনয়ার পিছনে না ঘোরে। তাহলে ও সবটা আরাদকে বলতে বাধ্য হবে। আরাদ যদি একবার সব জেনে যায় তাহলে তনয়াকে কিছুতেই ইফতির কাছে ঘেঁষতে দেবে না। তনয়া আরাদের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সেজন্য ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ইফতি। কিন্তু তনয়ার কথা গুলো ওর ভয়টা কিছু হলেও দূর করতে পেরেছে।

__________

নতুন পরিবেশে পা রেখেছে আরশি। আকাশের সেই ফ্ল্যাটেই এসেছে। মা আর বোন নিয়েই আকাশের পরিবার। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে উপলক্ষে সেও এসেছে। আত্মীয় স্বজন খুবই কম। বাড়িতে এসে সব নিয়ম কানুন মেনে ঘরে তোলা হয়েছে আরশিকে। ভারি গয়না মেকআপ রেখে সুতি শাড়ি পড়ানো হলো আরশিকে। অতঃপর ফুলে ফুলে সাজানো রুমটায় বসিয়ে দিলো। সারা রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো আরশি। এই ফ্ল্যাটে যখন প্রথম এসেছিলো এই রুমটাতে ঢুকেনি সে। কেমন জড়তা কাজ করছিল কিন্তু আজ এই রুমটা ওর নিজেরই। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে এলো আরশি। আকাশ কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ফোন স্ক্রোল করতে লাগল সে। আকাশ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে এসে দেখলো আরশি ফোন হাতে নিয়ে কিছু দেখছে। হাতের তোয়ালে রেখে আকাশ বলে উঠলো,’কিছু শেখোনি দেখছি!!বাসর রাতে কেউ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে?’

আকাশের কথায় চোখ তুলে তাকালো আরশি। মুখের ভাবভঙ্গি তার স্বাভাবিক। ফোন রেখে সে বলল,’তো আমার এখন কিছু করা উচিৎ? আপনার সাথে রোমান্স করা?হাউ ফানি!! আপনার থেকে তো এটা একদমই আশা করা যায় না। আপনার কি মনে আছে সেদিনের কথা??’

আকাশ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,’আমার মনে থাকলেও তোমার নেই বোধহয়।’

‘আমার সবটাই মনে আছে। আপনি আপনার কথাগুলো বাস্তবায়ন করতে টাইম নেবেন তাই আমি ও টাইম দিচ্ছি আপনাকে।’

হতাশাগ্রস্থ হলো আকাশ। এই মেয়েটা দিনদিন বেশি কথা বলছে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে আরশির পাশে শুয়ে পড়লো। হাঁটু মুড়ে বসে আকাশের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করছে আরশি। ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে আকাশ। আরশি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আকাশ ঘুমিয়েছে কি না??আরেকটু ঝুকতেই আকাশ ঘুরে তাকালো। তাল সামলাতে না পেরে আরশির পতন হলো আকাশের বুকের উপর। ঝটপট উঠে বসলো আরশি। আকাশ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কি হয়েছে?’

‘না মানে আপনি কি সারারাত ঘুমিয়ে থাকবেন??’

‘তো রাতের বেলা কে জেগে থাকে? পুলিশের চাকরিতে বহুরাত নির্ঘুমে কাটিয়েছি আজকে সুযোগ পেয়েছি তাই এই সুবর্ণ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না।’

আরশি বিড়বিড় করে বলল,’তামিম ভাইয়া তাহলে ঠিকই বলেছিল এর থেকে রিকশাওয়ালা বেটার ছিল। অন্তত আমাকে সময় তো দিতো।’

আরশিকে বিড়বিড় করতে দেখে আকাশ বলল,’কি বিড়বিড় করছো??’
আরশি মাথা নেড়ে না বলল। আকাশ ওপাশে ফিরতে নিলে আরশি আবার বলে উঠলো, ‘শুনুন??’

‘হুম বলো!!’

আরশি খানিকটা লজ্জামিশ্রিত সংকোচ নিয়ে বলল,’আপনার বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমাবো।’

ভ্রু কুচকালো আকাশ,নির্দিধায় যে আরশি কথাটা বলে ফেলবে তা মোটেও ভাবেনি আকাশ। তবে মেয়েটা যে ওর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করছে তা বেশ বুঝতে পারছে। কথা না বলে আরশি দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। মুহূর্তেই আরশির মুখে হাসি ফুটে উঠল। ফোনটা বালিশের পাশে রেখে আকাশের হাতে হাত রাখলো সে। মাথাটা এলিয়ে দিলো আকাশের চওড়া বুকের উপর। আরশির পাগলামো দেখে মুচকি হাসলো আকাশ। দুহাতে আকাশকে জড়িয়ে ধরে আরশি বলে,’আমি কিন্তু জড়িয়ে ধরেই ঘুমাবো। তনয়াকেও এভাবেই জড়িয়ে ধরেই ঘুমাতাম। আপনার সমস্যা হবে কি??’

‘সমস্যা হলেও মানিয়ে নিতে হবে। আমি তোমাকে আগেই বলেছি তোমাকে আমি সবসময় খুশি রাখবো।’

‘আমার একমাত্র খুশির কারণ আপনার ভালোবাসা। ওতেই হবে আর কিছু চাই না আমার।’

আকাশ আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে রইল আরশি। এভাবেই সে তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে।

সময় বহমান,তাকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। কেউ যদি ভালোবাসার চাদরে এই সময়কে ঢেকেও রাখে তবুও সময় সেই চাদরের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে যায়। এই সময়ের সাথে সাথে কিছু মানুষ জড়িয়ে পরে অনৈতিক কাজে আর কিছু মানুষ ভালোর পথে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। সৃষ্টিকর্তা তার পথে চলা মানুষদের পরীক্ষা করতে খুব ভালোবাসে। তাই তাদের কষ্ট দেন। কিন্তু কিছু কিছু পাপিদেরকে ইহকালে শাস্তি দেন নিজেকে শোধরানোর জন্য। অনেকে শোধরাতে পারে আবার অনেকে পারে না। সামিউক্তাকে সেই সুযগটা তিনি দিয়েছিলেন কিন্তু সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি বিধায় আবার শাস্তি পেয়েছে। কঠোর দন্ডে দন্ডিত হয়েছে সামিউক্তা ও তার ভাই। পাপের শাস্তি ইহকালেই সৃষ্টিকর্তা ওদের পাইয়ে দিয়েছে। এবার যদি ওরা নিজেকে শোধরায় তবে ভালো।

_____________

কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সায়েন। ছুটি হয়ে গেছে কিন্তু আরোভিকে সে দেখছে না। এতক্ষণ লাগার কথা না তো? নিশ্চয়ই কারো সাথে মারামারি শুরু করে দিয়েছে!!মেয়েকে নিয়ে আর পারেনা সায়েন। প্রতিদিন একটা না একটা অভিযোগ সে শুনবেই মেয়ের নামে। এজন্য সে আরাদকে মনে মনে শখানেক বকা অলরেডি দিয়ে ফেলেছে। হন্তদন্ত হয়ে সে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করলো। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলো। গাছের নিচে শান বাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছে আরোভি। ওর আশেপাশে চার পাঁচ জন বসা। সায়েন ভাবলো আজকে কি আবার ভাষন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে নাকি ওর মেয়ে??শব্দ না করেই সেদিকে এগোলো সায়েন। গাছের আড়ালে লুকিয়ে শুনতে লাগলো ওদের কথা। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে হতাশ হয়ে বলে উঠলো,’আমার বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না। আম্মু আব্বু শুধু ঝগড়া করে। আম্মু রাগ করে কালকে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছে। আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হেল্প করেনি তাই তো টিচারের কাছে আজকে বকা খেলাম।’

আরোভি মাথা নেড়ে বলল,’কিন্তু আমার মাম্মাম পাপার সাথে একটুও ঝগড়া করে না। সবসময় মাম্মামকে ভালোবাসে। মাম্মাম আর পাপার ভালোবাসা হচ্ছে ‘চিলেকোঠার প্রেম’।

সব বাচ্চারাই অবাক হয়ে গেল আরোভির কথা শুনে। সায়েন তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এতো পাকা পাকা কথা কোথা থেকে শিখলো পিচ্চি মেয়েটা। অপর বাচ্চাটা বিষ্মিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘চিলেকোঠার প্রেম সেটা কি আরু??’

আরোভি গর্বের সহিত বলল,’পাপা বলেছে আমাকে,মাম্মামের সাথে নাকি চিলেকোঠার ঘরে থেকে প্রেম করেছে তাই ওদের প্রেম চিলেকোঠার প্রেম!! আমার পাপা বেস্ট পাপা। আমাকে অনেক আদর করে আর মাম্মামকেও। তাই আমি ভাবছি পাপার মতো আমিও চিলেকোঠার প্রেম করব। আমাদের চিলেকোঠার ঘরটা পাপা মাম্মামের জন্য বানিয়েছে। কিন্তু এখন তো মাম্মাম ওখানে থাকে না খালি পরে থাকে রুমটা। তাই আমি ওই চিলেকোঠার ঘরে থেকে প্রেম করব।’

বলেই হাসতে লাগলো আরোভি। পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠলো,’খুব ইন্টারেস্টিং তো! এই আমিও চিলেকোঠার প্রেম করব।’

আরোভি শার্টের কলার টেনে ভাব নিয়ে বলল,’ওকে তাহলে নেক্সট ফ্রাইডেতে সবাই আমার বাড়িতে আসবি। পাপার থেকে সবটা জেনে নেব তারপর নাহয় প্রেম শুরু করলাম।’

মাথা ঘুরছে সায়েনের। সাত বছরের মেয়ে এতো হাইপার হয়ে গেছে!!এসব কিছুর জন্য একমাত্র আরাদ দায়ী। প্রতিদিন এই গল্প শোনাবে আরোভিকে।বাচ্চারা সেটাই শেখে যা বড়রা তাদের শেখায়। এইসব কিছুই আরাদ শিখিয়েছে আরোভিকে। মেয়েকে লাই দিতে দিতে মাথায় তুলেছে। সায়েন রেগে গিয়ে কান টেনে ধরলো আরোভির সাথে সাথে সব বাচ্চারা দৌড়ে পালালো। সায়েন রাগি মুখে বলল,’খুব বার বেরেছো তুমি!!চলো বাড়িতে তোমার পাকা কথা বের করছি আমি।’

আরোভির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গাড়িতে বসলো। গাড়িতে বসে আরোভি বলল,’তুমি তো দেখছি নানুর মতো। নানু যেমন পাপাকে দেখে রাগ করেছিল তুমিও সেরকম,,,’

সায়েন আর বলতে দিলো না ধমকের সুরে বলল,’চুপ একটা কথাও বলবে না তুমি। এতো পাকা কথা শিখেছো কোথা থেকে? সবসময় পাপার কাছ থেকে এটা ওটা শিখে আমাকে জ্বালাও কেন?? আজকে আসুক তোমার পাপা তার একদিন কি আমার একদিন।’

আরোভি মুখ চেপে হেসে বলল,’সেগুড়ো বালি পাপা তোমাকে হাগ করলেই তোমার সব রাগ চলে যায় আমি দেখেছি।’

সায়েন কপাল চাপড়ে বলল,’আল্লাহ এ কেমন মেয়ে দিয়েছো আমাকে??’

সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরলো আরাদ। আরোভি ড্রয়িং রুমে বসে বসে হোমওয়ার্ক করছে। পাশেই নিলিমা বেগম আর হাসি বেগম বসে আছেন। আরাদকে দেখামাত্র ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো আরোভি। সাথে সাথে ক্যাচ নিলো আরাদ। মুচকি হেসে সে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে চলে এলো। আরোভির পাশে বসে দেখতে লাগল ওর হোমওয়ার্ক। এমন সময় সায়েন এলো হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। নিলামা আর হাসি বেগমকে চা দিয়ে কড়া চোখে আরাদের দিকে তাকিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেলো। আরাদ চোখের ইশারায় মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে। আরোভি মুখ ফুলিয়ে মা’কে নকল করে দেখালো। মানে সায়েন রাগ করেছে। আরাদ মাথা নেড়ে আস্তে করে বলল,’আমি গিয়ে দেখে আসি??’

আরোভি মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘মাম্মাম বলেছে এইবার তুমি হাগ করলেও মাম্মামের রাগ ভাঙবে না।’

‘তাই নাকি??’

‘হুমমম!!’

‘সিরিয়াস কেস তো তাহলে। ওকে আমি গিয়ে চেষ্টা করে দেখি।’

আরাদ উঠে গিয়ে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হলো। সায়েন গাজরে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে অনবরত। চুলায় মেয়ের জন্য নুডুলস সিদ্ধ করতে দিয়েছে। এই কয় বছরে পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে সায়েন। আরাদ সায়েনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার আগেই সায়েন বলে উঠলো,’ডোন্ট টাচ মি!! আমাকে টাচ করলে গরম পানি ছুঁড়ে মারব।’

‘এতো রাগ কিসের জন্য জানতে পারি??’

সায়েন ছুরি উঁচিয়ে পেছন ফিরে তাকালো বলল,’জেনেও না জানার ভান করছেন কেন? আমার রাগের কারন সবসময় যে আপনার গুনবতি মেয়ে তা তো জানেনই। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন??’

আরাদ টান দিয়ে সায়েনের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো। ছুরিটা পাশে রেখে কাছে টানলো সায়েনকে। খোপা থেকে বেরিয়ে আসা এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে যত্নে গুজে দিয়ে বলল,’যেদিন আমার প্রিন্সেস প্রথম দুনিয়াতে এলো আমি অধির আগ্রহে হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। নার্স বাইরে এসে আমার কোলেই ওকে প্রথম তুলে দিলো। এর থেকে শান্তি পৃথিবীতে যেন আর কিছু নেই আমার কাছে।ওর কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলাম পৃথিবীর সব সুখ ওকে দেব আমি। একজন বাবার কাছে তার মেয়ের শত দুষ্টুমি অতি নগন্য। তাই আমি আমার প্রিন্সেসকে কিভাবে বকা দেই বলোতো??’

সায়েন কথা বাড়ালো না। ছুরিটা নিয়ে আবার গাজর কাটায় মন দিলো। যখনি সে আরাদকে বকবে তখনই এরকম কথা বলেই সায়েনের মনে আঘাত করে ওর সব রাগ গলিয়ে দেবে। মুহূর্তেই সায়েনের অতীতের সব মনে পড়ে গেল। সেদিনের পর থেকে সাতটা বছর পার হয়ে গেছে। আর সায়েন আরাদের সম্পর্কের প্রায় দশ বছর অতিক্রম করেছে। আরোভি গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় আরাদ আর ওর পরিবার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে। যার কারণে সায়েনের ভেলিভারি ভালোভাবেই হয়েছে। সবাই আরোভিকে পেয়ে খুশি। কারণ একটা বাচ্চাই একটা বাড়ি মাতিয়ে রাখতে সক্ষম। ইমজাদ ও ইমাম ওয়াহেদ নাতনি বলতে পাগল। ওনাদের দেখলেই গলায় ঝুলে পড়বে আরোভি। আর দাদিদের কাছ থেকে কতশত গল্প শোনা হয়ে গেছে তবুও তাদের গল্পের ঝুড়ি কখনো খালি হয় না। তামিম বলতেও পাগল আরোভি। মাঝে মাঝে তামিমের কাছে বায়না ধরে ঘুরতে যাওয়ার। অগত্যা তামিমকে তাই করতে হয়। আরোভি দেখতে একদম সায়েনের মতো হয়েছে কিন্তু স্বভাব আরাদের পেয়েছে। আরোভিকে দেখে কেউ না ভালোবেসে থাকতেই পারে না। পিছনের কথা ভেবে সায়েন চুপ করে গেল। আরাদ দেখলো যে বরফ কিছুটা হলেও গলেছে। তাই কফি চেয়ে ওখান থেকে চলে এলো আরোভির কাছে। বুরো আঙ্গুল উঁচিয়ে বোঝালো যে সব ঠিক আছে। বিনিময়ে আরোভি মুচকি হাসলো। তখনই আরাদের ফোন এলো। তনয়া আর আরশি গ্রুপে ভিডিও কল দিয়েছে। হাসি মুখে সে ফোন রিসিভ করতেই আরোভি টেনে নিলো। ফুপি বলতেও সে পাগল। ফোন করলে ওদেরকেও কথার ঝুড়ি শুনিয়ে দেয়।
আকাশের পোস্টিং হয়েছে সিলেটে। আরশি আর ওর মাকে নিয়ে সেখানেই থাকে এখন। আর তনয়াকে নিয়ে ইফতি আমেরিকায় সেটেল হয়েছে। আরশির বিয়ের ঠিক দুই বছর পর ইফতি আর তনয়ার বিয়ে হয়। আকাশ মানতে নারাজ ছিল কিন্তু আরশি আর সায়েন ওকে বুঝিয়েছে যাতে আরাদকে বিষয়টা না জানানো হয়। তাছাড়া ইফতির পরিবর্তন আকাশ লক্ষ্য করেই চুপ ছিল। তবে ইফতি যে এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলবে সেটা হয়তো কখনোই ভাবেনি। সবাই এখন দূর দূরান্তে। ইন্টারনেট যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই ভাব বিনিময় করে। আরশির চার বছরের একটা ছেলে আছে। ও ভেবেছিল আকাশ হয়তো পিছুটান ভুলতে পারবে না। কিন্তু আরশির ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো। আরিশর সাথে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে আকাশ। যে ভালবাসা আরশি আকাশের থেকে আশা করেছিল তার থেকে বেশি ভালোবাসা আকাশ দিয়েছে ওকে। এজন্য আরশি সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে।

দু’দিন পর ওরা সবাই সিলেটের উদ্দেশ্য রওনা হলো। আকাশ অনেক বার বলার পর রাজি হয়েছে আরাদ। বাড়ির সকলে মিলে যাবে। আরোভি খুব এক্সাইটেড। তামিমের হাত ধরে সে গাড়িতে বসলো। সায়েন আরোভিকে ডেকে বলল,’চাচ্চুর পাশে বসেছো ভালো কথা। বমি করোনা যেনো??’

‘নো মাম্মাম আ’ম ওকে।’

সায়েন হেসে বলল,’ভাবছি সিলেট গিয়ে তোমার চাচ্চুর জন্য একটা কাকিমনি ধরে আনব কেমন হবে বলোতো??’

আরোভি গালে হাত দিয়ে বলল,’ওমা তারমানে চাচ্চু চিলেকোঠার প্রেম করা ছাড়াই কাকিমনি আনবে??’

সায়েনের মুখের ভঙ্গি বদলে গেল। মেয়েটা এসব ছাড়া কথাই বলতে পারে না। তামিম হেসে বলল,’না মামুনি আমি চিলেকোঠার প্রেম করেই তোমার কাকিমনি আনব হ্যাপি??’

আরোভি মাথা নাড়ল খুশিতে। সায়েন গিয়ে আরাদের পাশে বসে পড়লো। গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। সামনের ফ্রন্ট সিটে বসে আরোভি তামিম কথায় মগ্ন। সায়েন আরাদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় মগ্ন হয়ে গেছে। আরাদ সায়েনের হাত মুঠো করে ধরে আছে। সুন্দর মুহূর্ত গুলো যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়। যেমন করে ওদের বিয়ের প্রায় সাড়ে সাত বছরের বেশি পার হয়ে গেছে। সামনের সময়গুলো বোধহয় এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু এই সময়গুলো আরাদের সাথে যেন সে কাটাতে পারে এটাই ওর চাওয়া। জীবনে যত দুঃখ কষ্ট আসুক না কেন প্রিয় মানুষটির হাত শক্ত করে ধরতে হয়। তাহলে কষ্ট দুঃখ চলে গেলেও প্রিয় মানুষটা থেকে যায়। জীবনে অনেক মানুষ আসবে যাবে শত কষ্টও আসবে যাবে কিন্তু প্রিয় মানুষ জীবনে একবারই আসে। তাই প্রিয় মানুষের হাত কখনোই ছাড়া যাবে না। সেজন্যই হয়তো আরাদ আর সায়েনের ভালোবাসা টিকে আছে। দুজনে মিলে ছুটে চলছে নতুন গন্তব্যে। সেখানে হতে চলেছে ভালোবাসার নতুন সৃষ্টি।

________________সমাপ্ত_________________