চিলেকোঠার প্রেম পর্ব-২১+২২

0
828

#চিলেকোঠার_প্রেম

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব_২১

রাহাতের এরকম আচরণে অবাক হয় সায়েন। নেশার ঘোরে এসব করছে কি??সায়েন দুহাতে রাহাতকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেছে। কিন্তু রাহাত ছাড়ছে না। সায়েন চিৎকার করে বলল,’কি করছেন ছাড়ুন আমার মা’কে?? এতটা নিচে নেমে গেছেন যে কাউকে মারতেও হাত কাঁপছে না আপনার?? ছাড়ুন মা’কে??’

রাহাতের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সায়েনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দুহাতে চেপে ধরল জয়নব বেগমের গলা। চোখ উল্টে আসছে জয়নব বেগমের। শ্বাসকষ্ট ও শুরু হয়ে গেছে। মা’কে এমতাবস্থায় দেখে সায়েনের মাথা ঘুরে গেল। চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল। আশেপাশের মানুষ আসতে আসতে হয়তো জয়নব বেগম মরেও যেতে পারে। এসব চিন্তা করে সায়েন দৌড়ে রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে এলো। ভাবলো ভয় দেখিয়ে রাহাতকে সরাবে। সায়েন রাহাতের হাত টানতে টানতে বলল, ‘ছাড়ুন নাহলে কিন্তু আমি ছুরি চালিয়ে দেব??মায়ের জন্য আপনাকে আঘাত করতে আমার এতটুকুও হাত কাঁপবে না।’

রাহাত এতে আরও রেগে গেল। একহাত দিয়ে সায়েনের গলাও চেপে ধরল। গর্জে উঠে বলল,’আমাকে মারবি তুই?এতো সাহস তোর?? আজকে মা মেয়ে দু’টোকেই শেষ করে দেব।’
সায়েনের শক্তি লোপ পেয়ে গেল। এখন সে নিজেকে বাঁচাবে নাকি মা’কে বাঁচাবে??এসব ভাবতে ভাবতে হাত নাড়াতে লাগলো সে। হাতাহাতির এক পর্যায়ে সায়েন ছুরি চালিয়ে দিলো রাহাতের গলায়। ধারালো ছুরি পুরোই গেথে গেছে রাহাতের গলায়। ঝর্ণার মতো রক্ত পড়তে লাগলো রাহাতের গলা দিয়ে। শরীরের সব ভর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল রাহাত। জয়নব বেগমও ততক্ষণে মেঝেতে পড়ে গেছে।
হাত-পা ছুড়াছুড়ি করতেছে রাহাত। ছুরি হাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে সায়েন। আকাশি রঙের শার্ট টা মুহূর্তেই রক্তলাল হয়ে গেল। সায়েন পারছে না নড়তে। পাদুটো জমে গেছে যেন। জয়নব বেগমের স্থির দেহের দিকে এক পলক তাকিয়ে সায়েন ও মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। খুন খারাবি রক্ত সে দেখতেই পারে না। তারউপর নিজেই খুন করে ফেলেছে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠে সায়েনের তাই সে জ্ঞান হারায়।

যখন সায়েনের জ্ঞান ফিরলো নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো। পাশে শাফিনকে বসা দেখে উঠে বসেই জাপটে ধরে শাফিন কে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সায়েন। শাফিনের চোখেও পানি। সায়েন বলল,’ভাইয়া আমি খুন করে ফেলেছি। ওই খারাপ লোকটাকে মেরে ফেলেছি আমি। বিশ্বাস কর ইচ্ছে করে মারিনি। ও তো মা’কে,,,,,’

মায়ের কথা মনে পড়তেই সায়েন সোজা হয়ে বসলো বলল,’ভাইয়া মা কোথায়??মা ঠিক আছে তো??’
শাফিন চুপ করে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শাফিনের। সায়েন শাফিনকে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে কিন্তু শাফিন উওর দিচ্ছে না। সায়েন অস্থির হয়ে হয়ে গেল। উঠে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার আগেই শাফিন ওকে টেনে ধরল বলল,’কোথায় যাচ্ছিস??’

‘আমি মায়ের কাছে যাব।’

শাফিন ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,’মাকে পোস্টমর্টেম এর জন্য নিয়ে গেছে সায়েন।’

সায়েন ঢলে পড়ল শাফিনের গায়ে কিন্তু জ্ঞান হারালো না। শাফিনের শার্ট আঁকড়ে ধরলো সায়েন। মায়ের মৃত্যু টা মানতে পারলো না সে।শাফিন বলল,’হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম মা’কে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেছে।’

সায়েন আর টু শব্দটি করতে পারলো না। গলায় যেন কেউ পাথর বসিয়েছে। তাই সায়েন কথা বলতে পারছে না শুধু চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে। সায়েনকে সামলিয়ে বাইরে নিয়ে আসে শাফিন। পুলিশ এসেছে বাড়িতে। ঘাবড়ালো না সায়েন কারণ সে জানতো যে এমনটাই হবে। আশেপাশে তাকিয়ে সে বাবাকে খুঁজলো কিন্তু পেল না। শাফিনের থেকে জানতে পারল যে শফিকুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি হসপিটালে ভর্তি। এতবছর একসাথে থেকে নিজের স্ত্রীর মৃত্যু তিনিও মেনে নিতে পারেননি।
পুলিশ নিয়ে যায় সায়েনকে। যাওয়ার আগে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে শাফিনের দিকে তাকিয়ে ছিল শুধু।
মায়ের লাশ দেখাতে আনা হয় সায়েনকে। সেদিন সায়েন কাঁদেনি অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল সেদিন। দুচোখ ভরে মা’কে সেদিন শেষ দেখা দেখেছিল সায়েন। সেই মুখটা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সায়েনের। এখনও নিজের শরীরে মায়ের গন্ধ পায় সে।
কোর্টে দু’পক্ষের লড়াই হয়। খুনের দায়ে চার বছরের জেল দেওয়া হয় সায়েনকে। খুনটা ইচ্ছাকৃত হয়নি তবুও খুন তো হয়েছে তাই সায়েন একজন দোষী। সেজন্য শাস্তি হয় সায়েনের। রাহাতও দোষী সাব্যস্ত হয়। কিন্তু সে তো আর বেঁচে নেই। তার শাস্তি এমনিতেও পেয়ে গেছে সে। সায়েনের বাবা উকিলের সাথে কথা বলে জেলে থেকেই পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেন। কারণ চারবছর পর তার মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে??এই দায় তো আদালতকেই নিতে হবে। তাই উপর থেকে অনুমতি নিয়েই সায়েন পড়াশোনা শুরু করে। প্রথমে সায়েন অমত করলেও মায়ের ইচ্ছার কথা ভেবে পড়াশোনা শুরু করে সায়েন।

একবছর পর সায়েনকে রংপুর থানা থেকে ঢাকা থানায় ট্রান্সফার করা হয় এবং সেখানে আবার পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়। সায়েন কে ঢাকা আনাতে শাফিনও বাবাকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেয়। কিন্তু নিজের বাড়িতে ফেরেনি। বাসা ভাড়া নিয়েছে সে। আগের বাড়িতে তো মা’কে নিয়েই থাকত। মা ছাড়া এখন থাকবে কিভাবে?? বাবাকে নিয়ে সে একাই থাকে। সাথে নতুন চাকরি ও পেয়েছে সে। এই ভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেল আরো দু’বছর।

_________________

টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সায়েন। ওর সামনেই চেয়ারে আকাশ বসে আছে। এতক্ষণ সে পুরো ঘটনাটা শুনেছে সায়েনের থেকে। যদিও অনেকবার জানার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তবে আজকে হয়েছে। সায়েনের পরীক্ষা শেষ হতেই আকাশ সায়েনের থেকে সবটা জানার চেষ্টা করতে থাকে। ফলস্বরূপ আজকে সব বলেছে সায়েন। আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,’তো তুমি এসব কিছুর জন্য আরাদকে দায়ী করছো তাই তো??’

মাথা তুলে তাকালো সায়েন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সায়েন এতক্ষণ কষ্টের কথা বলেছে। চোখের পানিও পড়ছে না সায়েনের। মৃদু হেসে সায়েন বলল,’নাহ,সব দোষ আমার ভাগ্যের। ভাগ্যে লেখা ছিল এসব তাই হয়েছে।’

আকাশ এবার সরাসরি প্রশ্ন করে,’ভালোবাসো আরাদকে??’

‘ভালোবাসতাম, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোবাসা চলে গেছে। এখন শুধু ওই লোকটার প্রতি একরাশ ঘৃণা আছে।’

আকাশ পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। তারপর সায়েনের সামনে রেখে বলল,’সেদিন যেই লোকটা আরাদের নামে বাজে কথা বলেছিল এটা কি সে??’
ফোনের স্ক্রিনে চোখ দিলো সায়েন। দেখা মাত্রই ফাহিমকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। মাথা নাড়ল সায়েন,মানে এটাই সে। আকাশ ফোনটা আবার পকেটে রেখে বলল, ‘তুমি জানো এই লোকটা কে??ফাহিম,যার সাথে আরাদের কঠিন শত্রুতা। তুমি না জেনেই আরাদকে ভুল বুঝেছো।’

সায়েন হাসলো বলল,’মানলাম ওনার শত্রু। কিন্তু স্মৃতি হারানোর নাটকটা কি মিথ্যা??’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আকাশ বলল,’নাহ,আরাদ তোমাকে ভালোবাসে বলেই এই নাটকটা করেছে। এর মধ্যে ওর কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। তোমারা ভুল করেছিলে। সেদিন যদি আরাদের থেকে সবটা জানতে তাহলে এসব হতো না।’

সায়েন কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে কাঠের টেবিলটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্লাস টপারদের মধ্যে জনম জনমের শত্রুতা থাকে এটা কি জানেন??’
ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো আকাশের। কি কথা হচ্ছে আর সায়েন কি বলছে??

‘বুঝতে পারলেন না তাই তো?? যখন পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশ মিনিট সময় থাকে তখন পুরো হলের কেউ শেষের প্রশ্নের উত্তর করতে পারে না। সবাই শুধু এদিকে ওদিকে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়। তখন যে যা বলে তাই খাতায় লেখা শুরু করে সবাই। সত্যতা যাচাই করার সময় তখন কারো থাকে না। এমনকি ক্লাস টপাররাও একে অপরের বন্ধু হয়ে ওঠে তখন। তখন কেউ এটা দেখে না যে আদৌ উওর গুলো কি সঠিক??এরকমই একটা পরিস্থিতি তখন হলের ভেতরে তৈরি হয়। সেরকমই মানুষের জীবনেও এরকম একটা পরিস্থিতি আসে,তখন শত্রুর বলা কথাগুলো ও সত্যি মনে হয়। আমাদের ও সেরকম হয়েছিল। ওই পরিস্থিতিতে কোনটা সঠিক কোনটা ভুল তা বোঝাই মুশকিল ছিল। সত্যি জেনেই বা কি হতো?? আমার গায়ে লাগা কলঙ্কের দাগটা তো উঠতো না।’

আকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে সায়েনের কথাগুলো শুনলো। ঠিকই বলেছে সায়েন। মানুষ মাঝেমাঝে এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। তখন সত্য মিথ্যা যাচাই করার মন মানসিকতা থাকে না। তখন শত্রুদের কেও মিত্র মনে হয়। ওইসব পরিস্থিতিতে খুব কম মানুষই বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে। সবার মধ্যে এই ধৈর্য টা থাকে না।

আকাশ আবারো বলল,’হুম বুঝলাম। কিন্তু তুমি এতে আরাদকে কেন দোষী ভাবছো??’

‘দোষী তো বলিনি আমি!!আমি শুধু বলেছি আমি তাকে ঘৃণা করি। কারণ জানতে চাইবেন না। এটা আমি বলতে পারছি না। আমার ব্যক্তিগত বিষয় এটা।’

‘তোমার কথাগুলো এটাই বলছে সায়েন। তুমি আরাদকে দোষী ভাবছো। হ্যা এটা ঠিক যে আরাদের কারণে তোমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। যদি তুমি আরেকটা দিন অপেক্ষা করতে তাহলে কিছুটা হলেও ঠিক হতো। কিন্তু সেটা হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমার পরিবার না জেনে শুনে ওইরকম একটা খারাপ ছেলের হাতে তোমাকে কিভাবে তুলে দিলো?? তাদের একবার দেখা উচিত ছিল।’

‘ভালো করে দেখেনি বলে এই না যে আমার পরিবার আমার ভালো চায় না!!তারা আমার ভালো চায়। সব পরিবারই তাদের মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সবাই কি পারে??শত দেখার পরও এক প্রতারকের খপ্পরে ঠিকই পড়ে যায়। আশেপাশে তাকালে এরকম অনেক মেয়েকেই দেখবেন। মেয়ের নামে ঠিকই সঠিক তথ্য নেবে কিন্তু ছেলের বিষয়ে সম্পূর্ণ জানাবে না। কেউ যদি নিজের সম্পর্কে জানাতে না চায় তাহলে তার থেকে কি আদৌ সবকিছু জানা সম্ভব??আপনার মনে কি আছে তা কি আমি জানি??’

আকাশের বুকটা ধক করে উঠল। সত্যি তো ওর মনে যে সায়েনের প্রতি ভালোবাসা আছে তা কি সায়েন জানে??সবাই সবার মনের কথা পড়তে পারে না। তাইতো আকাশের মনের বদ্ধ অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারেনি। সব কথা বদ্ধই থেকে গেছে। আকাশ নিজেকে সামলিয়ে বলল,’তাহলে তুমি মানছো যে এতে সম্পূর্ণ দোষ আরাদের নয়।’

সায়েন এবার বেশ রেগে গেল। বারবার আরাদের নামটা শুনতে ওর ভালো লাগছে না। বেশ রেগেই সায়েন বলল,’বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?আমি তো বলছি যে ওই লোকটাকে আমি ঘৃণা করি। তারপরও এতো কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন??আমি আর কিছু বলতে ইচ্ছুক নই।’

আকাশ বুঝলো যে সায়েন এর থেকে বেশী কিছু বলবে না। তাই সে বেরিয়ে আসলো। সায়েনকে নিজের কক্ষে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের কেবিনে এসে বসলো আকাশ। সামনের চেয়ারে আরাদ বসা। এতক্ষণ মাইক্রোফোনে সবটাই শুনেছে। ওর প্রতি সায়েনের এতটা ঘৃণা তা জেনে অবাক হয়নি আরাদ। এটা তো হওয়ার ছিল। কিন্তু সায়েনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যে ভোলার নয়। সায়েন কিভাবে এসব ভুলবে??মনের মধ্যে যে আঠার মতো লেগে আছে। বারবার পুরোনো স্মৃতির মধ্যে বিচরণ করছে সায়েন। আকাশের কথায় ধ্যান ভাঙল আরাদের।

‘তুই চিন্তা করিস না আরাদ। আমার বিশ্বাস সায়েন তোকে এখনও ভালোবাসে। ওর ঘৃণা তোর ভালোবাসা দিয়ে মুছে ফেল আরাদ। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। শুধুমাত্র তুই পারবি ওর কষ্টগুলো ধুলিসাৎ করতে।’

আরাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,’আমার উকিলের সাথে কথা হয়েছে। কোর্টে খুব শিগগিরই কেস উঠবে। তবে আমি যে এসব করেছি সেটা যেন সায়েন ও তার পরিবারের কেউ জানতে না পারে। সেদিকে খেয়াল রাখিস। আই হোপ খুব তাড়াতাড়ি সায়েন ছাড়া পাবে। আমি আসছি।’

আরাদ উঠে দাড়াতেই আকাশ বলে উঠলো, ‘এরপর কি করবি??মানে ফাহিম,,,,,’

মুখে লাল আভা ফুটিয়ে আরাদ বলল,’জ্যান্ত পুঁতে ফেলব ওকে। ও হাত বাড়িয়েছে কার দিকে সেটা একবার ওর ভেবে দেখা উচিৎ ছিল ওর।’

আকাশ চুপ করে গেল। আরাদ অনেকটাই জেদি তা ভালো করেই জানে সে। এজন্য আকাশ প্রায়ই বলত তার জায়গায় আরাদ পুলিশ হলে ভালো হতো। একদিনেই ক্রিমিনালদের পিটিয়ে দফা রফা করে দিতো। যদিও মারামারি আরাদের পছন্দ নয়। এর আগেও অনেকবার ফাহিমকে ছেড়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু এবার আর ছাড়বে না। বিজনেস নিয়ে কোন সমস্যা করলে কিছুই বলতো না আরাদ। কিন্তু সায়েনের সঙ্গে ও যা করছে তার শাস্তি সে ফাহিমকে দেবেই। কেবিন থেকে বের হওয়ার আগে পেছনে না ঘুরেই আরাদ বলল,’সায়েন আমার কাছে ফিরে আসুক এটা আমি খুব করে চাই। কিন্তু আমি জানি এটা কখনো হবে না। আমি সায়েনকে হ্যাপি দেখতে চাই। এমন একটা মানুষের সাথে দেখতে চাই যে সে সায়েনকে একদম আমার মতো করে আগলে রাখবে। ভালোবাসবে আমার থেকে বেশি। আর সেই মানুষটি তুই।’

বলতে বলতে আরাদ কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। আকাশ মৃদু হাসলো। কলেজ লাইফ থেকেই বন্ধুদের জন্য নিজেকে উগ্রে দিতো আরাদ। শার্ট থেকে খাতা কলম সবকিছু শেয়ার করতো আরাদ। বিশেষ করে রাফিন, যার সবসময় আরাদের সানগ্লাস পছন্দ হতো। যখনই আরাদ নতুন কোন সানগ্লাস কিনেছে তো রাফিনের পছন্দ হয়ে গেছে। সেটা ওর চাই ই চাই। আরাদ হাসিমুখে দিয়ে দিত। কিন্তু আকাশ ওরকম ছিলো না। এমন নয় যে সে আরাদের জিনিসপত্র পছন্দ হতো না। পছন্দ হতো তবে ও হুবুহু সেরকম একটা কিনে নিতো। শুধু আকাশ নয় সব বন্ধু্রাই একই ড্রেস পড়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রেও যে দুজনে এক হয়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি আকাশ। কিন্তু অবাকের বিষয় যে এবারও নিজের অদম্য ইচ্ছা কে কোরবানি করে দিয়েছে। আকাশ নিজে নিজেই বলে উঠলো,’সায়েনকে মানাবি কিভাবে তুই??ও যে এখনও তোকে ভালোবাসে। ওর চোখের ঘৃণার আড়ালে থাকা ভালোবাসা যে স্পষ্ট দেখেছি আমি।’

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়েই আরাদ ফোন দিলো জোনায়েদকে। ফাহিমের ব্যাপারে সব খোঁজ লাগাতে বলল আরাদ। জোনায়েদ সব আগে থেকেই জানতো। তাই ও সব জায়গায় খোঁজ পাঠিয়ে দিলো। আরাদ কড়া গলায় বলল,’চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ফাহিমকে আমার গোডাউনে চাই। ওকে বোঝাব যে ভালোবাসলে মানুষ যেমন দূর্বল হয়ে যায় তেমনি কঠোর ও হতে পারে। আরাদের হিংস্রতা ওকে আজ ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দেব আমি।’

ফোন কেটে গাড়ি স্টার্ট দিলো আরাদ। সোজা বাড়িতে গেলো। রাগ হচ্ছে ওর খুব। কোনমতে নিজেকে সামলিয়ে নিজের রুমে গেল। কিন্তু রুমে গিয়ে ওর রাগটা চড়ে গেল। কারণ সামিউক্তা ওর খাটের উপর বসে বসে ফোন চালাচ্ছে। যেখানে আরাদ নিজের রুমে ওর বোনদের ও এলাও করে না সেখানে সামিউক্তা!!শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে তেড়ে গেল আরাদ।

#চলবে,,,,,,,,,,

#চিলেকোঠার_প্রেম

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব_২২

আরাদকে তেড়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো সামিউক্তা। আরাদকে রেগে থাকতে দেখে ঘাবড়ালো সামিউক্তা।‌ কারণ নিলিমা বেগম আর হাসি বেগম অনেক বার বারণ করেছিল সামিউক্তাকে। সে যেন আরাদের রুমে না যায়। কিন্তু সামিউক্তা তা শোনেনি। জোর করেই সে আরাদের রুমে এসে বসেছে। আরাদ সামিউক্তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,’গেট লস্ট।’

সামিউক্তা নিজের ভয়টা প্রকাশ করলো না। আরাদের নরমাল বিহেভ দেখে ভাবলো যে আরাদ বোধহয় রাগ করবে না। তাই সে বলল,’এইতো এলাম। আর তাছাড়া এই রুমটা তো কিছুদিন পর আমাদের হতে চলেছে। তাই আমি তো আসতেই পারি।’

আরাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’না পারেন না। আর রইল আপনার কথা। এই রুম কখনোই আপনার হবে না। আমি আর কোন কথা বলতে চাই না। আপনি কি বের হবেন নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব??’

কথাটা আত্মসম্মানে লাগলো সামিউক্তার। যেখানো সে নিজেই কতজনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আর আরাদ কি না?? মুহূর্তেই মুখটা লাল হয়ে গেছে সামিউক্তার। সে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কোনরকমে নিজেকে সামলালো আরাদ কারণ এখন রাগলে হবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তাই সে ওয়াশরুমে চলে গেল।

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আছে আরাদ। সায়েনের বলা প্রতিটা কথা মনে গেঁথে আছে। যা সরানো কষ্টকর। মেয়েটা এতগুলো দিন অনেক কষ্টে কাটিয়েছে। যে মেয়েটার মুখে সবসময় হাসি থাকতো আজ সেই মেয়েটার মুখ থেকে হাসি বিলিন হয়ে গেছে। যেভাবেই হোক সায়েনকে আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। পুরোপুরি পারবে না তা আরাদ জানে কিন্তু তবুও সে চেষ্টা করবে। আর সেজন্য একটা বিশ্বাসী হাত দরকার। যে হাত সবসময় আগলে রাখবে। নিঃসন্দেহে সেই দায়িত্ব আকাশকে দেওয়া যায়। কিন্তু আরাদ তাহলে কিভাবে থাকবে?? কষ্ট হবে খুব। সায়েনকে অন্যের হতে দেখা আরাদের পক্ষে অসম্ভব। সায়েনকে আকাশের হাতে তুলে দিয়ে আবার আমেরিকা ফিরে যাবে বলে মন স্থির করলো আরাদ। বাথরুম থেকে বের হয়ে খাটে শুয়ে পড়লো আরাদ। ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। আরাদ উঠে বসে ফোনটা হাতে নিলো। জোনায়েদের কল। আরাদ ফোন রিসিভ করতেই জোনায়েদ বলে উঠলো,’কাজ হয়ে গেছে।’

উওর না দিয়ে আরাদ ফোন কেটে দিল। রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাবার্ড থেকে শার্ট বের করে পরে নিলো। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে আরাদ। নিলিমা বেগম সোফাতে বসে আছেন। আরাদকে দেখে তিনি ভয়ে শুকনো ঢোক গিললেন। যদি আরাদ কিছু বলে?? মানে সামিউক্তাকে নিয়ে। কিন্তু আরাদ কিছু না বলেই চলে গেছে। নিলিমা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ছেলের যাওয়ার পানে।

__________________

হকিস্টিক হাতে দাঁড়িয়ে আছে জোনায়েদ। সামনের চেয়ারে ফাহিমকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখে হাতে তার মারের দাগ স্পষ্ট। জোনায়েদ ব্যতীত আর কেউ নেই গোডাউনে। ঠিক তখনই আরাদ এলো। ফাহিমের সামনে চেয়ার টেনে বসলো সে। ফাহিম আরাদের চোখে চোখ রেখে হাসলো। রুক্ষ সেই কাটা ঠোঁটের হাসি। আরাদের শান্ত দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে। সেই আগুনে ভষ্ম করে দেবে ফাহিমকে। কিন্তু ফাহিমের কোন হেলদোল নেই। মরলেও যেন ওর কিছু যায় আসে না।

‘তোকে বলেছিলাম না যে আমাকে হিংস্র হতে বাধ্য করিস না আর তুই সেটাই করলি। এখন তোকে কি করা উচিত বলতো??’

ফাহিম আবারো হাসলো। আরাদ এবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের দিকে তারপর আবারো বলতে লাগলো,’সায়েনকে আমার থেকে দূরে পাঠিয়ে ক্ষান্ত হসনি তুই। আমার জন্য ওর জীবনটা নষ্ট না করলেও পারতি তুই??’
জোনায়েদ অবাক হয়ে তাকালো আরাদের দিকে বলল,’সায়েনের জীবন ও নষ্ট করলো কিভাবে??’
আরাদ এক পলক জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে আবার ফাহিমের দিকে তাকালো বলল,’সায়েনের শাস্তি আরো কম হতো কিন্তু ফাহিম নিজে লয়ারের সাথে কথা বলে টাকা দিয়ছিল। আর সবচেয়ে বড় লয়ার হায়ার করেছিল যাতে সায়েনের সাজা বাড়াতে পারে। সেটাই হয়েছে। পর্দার আড়াল থেকে সব করে গেছে ও।’

জোনায়েদ রাগে ফুসে ওঠে। এগিয়ে গিয়ে এক লাথি দিয়ে চেয়ারসুদ্ধ ফাহিমকে ফেলে দিলো। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’কু*র বাচ্চা,একে তো বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে। আজকেই তোর শেষ দিন।’

আরাদ জোনায়েদেকে থামিয়ে দিল। টেন ওঠালো ফাহিমকে। ঠিকঠাক করে বসিয়ে দিয়ে বলল,’তুই এতকিছু করে আমার থেকে সায়েনকে দূরে সরাতে পেরেছিস। তোর প্ল্যান মাফিক সবই হয়েছে কিন্তু আমার ভালোবাসা কি কমাতেও পেরেছিস??’

ফাহিম বাঁকা হেসে বলে,’কিন্তু সায়েনের ভালোবাসা তো কমাতে পেরেছি।’

‘ভুল!!সায়েনের ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। শুধু অভিমান নায়ক পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে। সেই পর্দা ছিঁড়তে কতক্ষন?? ভালোবাসা কখনো শেষ হয়না। শুধু এর ধরন পরিবর্তন হয়। হাসি কান্না রাগ অভিমানের মাধ্যমেও ভালোবাসা প্রকাশ করে মানুষ। তবে এসবের আড়ালে থাকা ভালোবাসা দেখার জন্য চোখ থাকতে হয় যা তোর মতো পিচাশের নেই।’

ফাহিম নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে আরাদের দিকে। জোনায়েদ রেগে গিয়ে বলে, ‘এত কথা বলার দরকার কি?এটাকে এখানেই
মেরে পুঁতে দেই। এটাই ওর সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে।’

আরাদ ফাহিমের বাঁধন খুলে দিলো। জোনায়েদ বাঁধা দিয়ে বলল,’ওর বাঁধন খুলছিস কেন??’

‘ওকে ছেড়ে দেব।’

বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে জোনায়েদ বলে,’কি! পাগল হয়ে গেছিস তুই??ও তোর শত্রু। ওকে শাস্তি দিবি না??’

‘শাস্তিই তো দিচ্ছি।’

‘হুম!!এই তোর শাস্তি??’

আরাদ মুচকি হেসে বলল,’শত্রুর সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো ওকে ছেড়ে দেওয়া,ক্ষমা করে দেওয়া। কেন জানিস??ফাহিম আমার থেকে ক্ষমা এক্সেপ্ট করতে পারবে না। আমার দয়ায় ও নিজের প্রাণ ফিরে পেল যা ওর সারাজীবন মনে থাকবে। এইটা ওকে কষ্ট দেবে। কেন ও শত্রুর দয়ায় বেঁচে আছে??আর আমি সেটাই চাই। একজন মানুষ তার শত্রুর থেকে আঘাত চায় ক্ষমা বা সহানুভূতি নয়। সেখানে যদি আমি ওকে ক্ষমা করে দেই সেটা ওর পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।’

‘তবুও এটা করিস না আরাদ পরে ও আবার তোর ক্ষতি করবে।’

আরাদ ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল,’ও যতবার আমাকে আঘাত করবে ততবারই হতাশ হবে। কারণ পাল্টা আঘাত ও পাবে না। একসময় ও ঠিকই থেমে যাবে।’

ফাহিমের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। হয়তো সে অনুতপ্ত হয়েছে। কারণ ও অনেক ক্ষতি করেছে আরাদের কিন্তু আরাদ ওকে বারবার ছেড়ে দিয়েছে। আরাদ হিংস্র হলেও ফাহিমকে সে একটা আঁচড়ও দেয়নি। ফাহিমকে ছেড়ে দিয়ে আরাদ সোজা থানায় চলে গেল। আকাশের সাথে কথা বলে সে সায়েনকে দেখতে গেল। সায়েন তখন ঘুমাচ্ছিল। কয়েকমুহূর্ত সায়েনকে দেখে আবার চলে আসলো আরাদ।

বহমান সময় আরো দুমাস এগিয়ে গেল। এই দুই মাসে সায়েনকে বের করার সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে আরাদ। কিন্তু সেটা এখনও সায়েন জানে না। শাফিন আর ওর বাবাও জানে না। শুধু আকাশ জোনায়েদ কে জানানো হয়েছে। সায়েন জানে না যে আর কিছুদিনের মধ্যে সে এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। ঠিক সেরকমটাই হলো। হঠাৎ করে একদিন আকাশ লোহার দরজা খুলে দিল। সায়েন ভাবলো হয়তো কোন কারণে তাকে ডাকা হয়েছে কিন্তু বাইরে এসে সে দেখলো শাফিন আর ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুচকালো সায়েন। শফিকুল ইসলাম অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর সায়েনের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। সায়েন তো আরো অবাক। শাফিন সায়েনের হাত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,’আজ থেকে তুই মুক্ত সায়েন। তোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি সাজা মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে।’

সায়েন অবাক চোখে তাকালো শাফিনের দিকে। তারপর চারপাশে চোখ বুলায়। জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিলো সায়েন। দীর্ঘ তিন বছর পর সে বাইরে এসেছে। পরিবেশটায় যেন সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। এর আগেও সায়েন বাইরে এসেছিল কিন্তু তখন তো এরকম সুগন্ধ পায়নি। তাহলে এটা কি স্বাধীনতার সুবাস?? তাই হবে। স্বাধীন মানুষের চলাফেরা করার মজাই আলাদা। এতদিন সে বদ্ধ কুঠুরিতে আটকে ছিল। এতদিন পর মুক্তি পেয়ে খুব খুশি। রাস্তার এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলো সায়েন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো সায়েনের। আজ সে বুঝতে পারছে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বোধহয় মানুষ এরকম খুশি হয়েছিল বা তার থেকেও বেশি। সায়েনের এসব চিন্তা ভাবনার মধ্যেই শাফিন এসে ওর হাত ধরলো। একটা সিএনজি ডেকে উঠে চলে গেল। থানার সামনেই গাড়িতে বসা ছিল। সায়েনের মুখের এই হাসিটুকুই ওর কাছে বেশি। পাখির মতো উড়তে পছন্দ করে সায়েন। আর আজ থেকে সে বন্দি খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে। হয়তো আগের মতো উড়তে ইচ্ছে করবে না। তবুও যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু সময়টাতেই যেন ওই আকাশ জুড়ে মনের বিচরণ করে সায়েন এটাই আরাদের চাওয়া।
আরাদ ওদের পিছু নিলো না। আজকের দিনটা সায়েনকে ছেড়ে দিলো।

দশতলা বিল্ডিং এর সামনে নামলো সায়েন। শাফিন বের হয়ে ইশারায় ভেতরে আসতে বলল। সায়েন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। শাফিন বলল,’কি হয়েছে আয়?? তিনতলার ফ্ল্যাট আমাদের।’

‘আমাদের বাড়ি???’

শফিকুল ইসলাম মেয়ের হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,’ওসব পরে হবে আগে ভেতরে এসো।’

তিনতলার ফ্ল্যাটে সায়েনের জন্য রাখা রুমটাতে নিয়ে গেল সায়েনকে। সায়েন পুরো রুমে চোখে বুলায়। এই ফ্ল্যাটের সবকিছুই নতুন। নতুনত্বের গন্ধ পাচ্ছে সায়েন। ওর জন্যই সব কিছু নতুন কেনা হয়েছে। সায়েন বারান্দায় গেল। এখান থেকে রাস্তার সবকিছুই দেখা যায়। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে সায়েনের। বোধহয় ও ঘুমাচ্ছে,ঘুম ভাঙলেই দেখবে ও আবার সেই কারাগারে বন্দি। তাই বারবার চোখের পলক ফেলে সায়েন সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছে।

‘সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে তাই না??’
শাফিনের কন্ঠস্বর শুনে চকিতে তাকালো সায়েন। মুচকি হেসে বলল,’এটা বোধহয় স্বপ্নই হবে।’

‘তোকে কিছু জানাইনি সায়েন। এমনকি আমারাও কালকে জেনেছি। জানিস তখন আমি আর বাবা কত খুশি হয়েছি!!যাক গে বাদ দে সব। আলমারি তে তোর জামাকাপড় রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে আয়। বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।’

শাফিন চলে আসতে নিলে সায়েন বলল,’ভাবি কোথায়??’

শাফিন ফিরে তাকালো সায়েন আবার বলল, ‘জানি তোমরা এখনও বিয়ে করোনি। ভাবি অনেক সেক্রিফাইস করেছে ভাইয়া। এখন আমি চলে এসেছি তোমরা আর দেরি করো না। আমি খুশি থাকতে চাই ভাইয়া। পুরোনো কথা মনে করতে চাই না। বিয়েটা করে ফেল।’

প্রতুত্যরে কিছু বলল না শাফিন। মুচকি হেসে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হলো সায়েন। বাবার বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ বসে ছিল সায়েন। মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো সব উগ্রে দিলো সায়েন। তিনজনে এভাবেই রাত বানিয়ে দিলো। কলিং বেলের আওয়াজ আসতেই শাফিন গিয়ে হাসিমুখে দরজা খুলে দিল। রুহি এসেছে খাবার নিয়ে। টেবিলের উপর টিফিন বক্স রেখেই সে সায়েনের দিকে এগিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরলো সায়েনকে। চোখের কোণের পানি মুছে হাসিমুখে সায়েনের সাথে কথা বলতে লাগলো রুহি। মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে শাফিনকে পাওয়ার জন্য। পরিবার থেকে তো সেই কবে থেকেই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে কিন্তু রুহি সেসবের কথা কানেই নিচ্ছে না। একটার পর একটা সমন্ধ সে ভেঙেই গিয়েছে। একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করে রুহি। এতদিন শাফিনকে বিয়ের কথা বলেনি সায়েনের জন্য। কারণ সায়েন ছাড়া না পাওয়া পর্যন্ত শাফিন এবিষয়ে এগোবে না এটা রুহি ভালো করেই জানে। আর আজ মনে হয় ওর সব অপেক্ষার অবসান ঘটলো।
সবাই একসাথে ডিনার করে নিলো। রুহি চলে গেছে,শাফিন গিয়ে দিয়ে এসেছে। সায়েন নিজের রুমে গেল। কেন যেন ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না সায়েনের। তাই গুটিগুটি পায়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশে অন্যরকম সুবাস আসছে। মুক্ত হওয়ার সুবাস। চোখ বন্ধ করে প্রাকৃতিক সুগন্ধ টেনে নিতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সায়েন।
কিন্তু চোখ খুলেই সে অবাক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কালো রঙের গাড়ির দিকে চোখ আটকে গেছে সায়েনের। দুহাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরাদ। আরাদকে এসময় আশা করেনি সায়েন। তাই সে আর সেখানে দাঁড়ালো না। বারান্দা থেকে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। যদিও ঘুম আসছে না তবুও এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো সায়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিলো সায়েন। রুম থেকে বের হতে গিয়েও হলো না। কেন যেন বারান্দাটা ওকে বড্ড টানছে। তাই সায়েন বারান্দায় চলে গেল। গিয়েই বড়সড় ঝটকা খেল সায়েন। গাড়ির সামনের চাকার সাথে হেলান দিয়ে পা মেলে বসেছিল আরাদ।সায়েনকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো সে। মুখে হাসির রেখা টেনে একটু জোরেই বলল,’গুড মর্নিং।’
সায়েন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার মানে কি আরাদ সারারাত এখানেই ছিল। সে বলল,’আপনি এখনও বসায় যাননি??’

আরাদ কপাল কুঁচকে একটু জোরে বলল,’কি বলছো শুনতে পারছি না। একটু জোরে বলো।’
সায়েন দাঁতে দাঁত চেপে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘এখনও বাসায় যাননি কেন??কি বোঝাতে চান আপনি??’

দু পকেটে হাত গুজে দাঁড়ালো আরাদ বলল, ‘তেমন কিছু না। এই বিল্ডিং এ তো কোন চিলেকোঠার ঘর দেখছি না। এবার আমাকে কোথায় রাখবে??আমিও কোন জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। তাই এই রাস্তাটা বেটার মনে হলো।’

সায়েন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল আরাদের দিকে। আরাদের মতলবটা বোঝার চেষ্টা করছে সায়েন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সায়েন বলল,’আমি সেই আগের সায়েন নই। আর আপনি আমার থেকে দূরে থাকলে আমি খুশি হব।’

আরাদ দুকদম এগিয়ে এসে বলল,’চলে যাব বলেই তো এসেছি। যেক’দিন আছি অন্তত সেই ক’দিন আমি আসব। এরপর থেকে আর বিরক্ত করব না তোমাকে প্রমিস।’

আরাদের কথাগুলো মাথায় ঢুকলো না সায়েনের। মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করলো না। বারান্দা থেকে রুমে চলে এলো সায়েন। আরাদের কাছে নিজেকে আর দূর্বল করবে না সে কিছুতেই না।
আরাদকে ভুলে খুশি থাকতে চায় সায়েন। রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাইরে এলো সায়েন। বাইরে এসে আরো অবাক সায়েন। এখানেও আরাদ!!এটা কি ওর চোখের ভ্রম?? কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আরাদের দিকে তাকালো। নাহ এটা সত্যি সত্যি আরাদ। সোফায় বসে শাফিন আর শফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলতেছে আরাদ। ওদের কথা শোনার জন্য এগিয়ে গেলে সায়েন।

#চলবে,,,,,,,,,,,,,,

রিচেক করিনি। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।