চিলেকোঠার প্রেম পর্ব-২৩+২৪

0
891

#চিলেকোঠার_প্রেম

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব_২৩

রুমের মধ্যে অনেকক্ষণ যাবত ধরে বসে আছে সায়েন। বিছানার উপর বসে হাত দিয়ে আঁকিবুঁকি করতেছে। কিন্তু মনটা বারবার বাইরে টানছে সায়েনের। কি কথা বলছে আরাদ ওর বাবার সাথে?? ভেতরটা উসখুস করছে। তখন সায়েন যেতেই ওকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে শফিকুল ইসলাম। বেশ গম্ভীর গলায় বলেছেন শফিকুল ইসলাম তাই সায়েন আর না করতে পারলো না। নিজের রুমে চলে এসেছে সে। কিছুক্ষণ বাদেই শাফিন ওর রুমে আসলো সায়েন চটজলদি জিজ্ঞেস করলো,’কি হয়েছে ভাইয়া??কি বলল??’

‘ওসব বাদ দে তো!!তোর কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। মানে তুই কেমন আছিস??ছাড়া পেলি কবে এখন পড়াশোনা করবি কি করবি না এইসব।’

শাফিনের কথা বিশ্বাস হলো না সায়েনের। আরাদ যে আগে থেকেই জানতো যে সায়েন ছাড়া পাবে তা একশভাগ নিশ্চিত সায়েন।আর আরাদ যে এসব বলতে আসেনি তাও বেশ বুঝেছে। কিন্তু তাও সায়েন পাল্টা প্রশ্ন করলো না শাফিনকে। এমন ভাব দেখালো যে সে বিশ্বাস করে নিয়েছে। সায়েন রুম থেকে বের হয়ে বাবার কাছে গেল। সোজাসাপ্টা ভাবেই বলল,’আব্বু ভাইয়া আর ভাবির বিয়ের ব্যবস্থা করো। খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা হলে ভালো হয়। তোমার না হ্যা আমি শুনব না।’

শফিকুল ইসলাম মুচকি হাসলেন সায়েনের কথা শুনে। তিনি বললেন,’আমিও সেটাই ভাবছি। আমি রুহির বাবা মায়ের সাথে কথা বলব।’

সায়েনের পিছন থেকে শাফিন বলল,’একটু সাবধানে আব্বু। আমার মনে হয় না যে রুহির বাবা মা তোমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।’

‘বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মেয়েটা আমাদের জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছে। আমি নাহয় এটুকু সহ্য করলাম।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আর তুমি যাব। সায়ুর যাওয়ার দরকার নেই। তুই বাসায় থাকবি। দরজা বন্ধ করে বসে থাকবি। আমরা আসব তারপর দরজা খুলবি ওকে??’

সায়েন মাথা নাড়লো। ব্রেকফাস্ট সেরে শাফিন অফিসে চলে গেছে। শফিকুল ইসলাম নিজের রুমে। সায়েন ঘুরে ঘুরে পুরো ফ্ল্যাট দেখতেছে। নিজেকে একা একা লাগছে খুব।তাই এটা ওটা গোছাচ্ছে। বিশেষ করে শাফিনের রুম। রুমটা একেবারে মাছ বাজার করে রেখেছে। রুম গুছিয়ে সায়েন রান্নাঘরে গেল। কিন্তু সে কোন রান্নাই তো পারে না। শুধু ঘুরে দেখলো রান্নাঘরটা। একটু পরেই কাজের মহিলাটা আসলো। রান্নাবান্না করে দিয়ে আবার সে চলে গেল। দুপুরের খাবারটা সে বাবার সাথে করে নিলো। তারপর আবার রুম। এটা তো সেই জেলখানা মনে হচ্ছে সায়েনের। কিন্তু একটা কথা সায়েনকে ভাবাচ্ছে যে আরাদ তখন কি বলতে এসেছিল?? বিকেলে রুম থেকে বের হলো সায়েন। বাবার রুমে উকি দিয়ে দেখলো তিনি এখনও ঘুমে। সায়েন তাই বাসা থেকে বের হলো। মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে নিলো। রাস্তায় গিয়ে বড় শ্বাস ফেলল সায়েন। অনেক তো রুম বন্দী হয়ে থেকেছে। রাস্তাটা বড্ড টানছে সায়েনকে। সায়েন ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। খেয়াল করলো ফুটপাতে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কাগজ কুঁড়াতে ব্যস্ত তাঁরা। একপাশে আবার কতগুলো মধ্যবিও ঘরের ছেলেমেয়েরা ঘাসের উপর খেলা করছে। সাথে ওদের বাবা মাও আছে। কি অদ্ভুত তাই না!! ওদের বয়স একই কিন্তু জীবনটা আলাদা। এক ধ্যানেই সেদিকে তাকিয়ে আছে সায়েন।

‘সবার জীবন এক হয় না।’
পিছন ফিরে তাকালো সায়েন। আরাদ দাঁড়িয়ে আছে। সাদা রঙের শার্ট পরা। প্যান্টের রং ও সাদা। সাদা রং টা বেশ মানায় আরাদকে। তাছাড়া প্রথম যেদিন সায়েনের সাথে আরাদের দেখা হয়েছিল সেদিনও সাদা শার্ট পরা ছিল আরাদ। সায়েনকে চুপ থাকতে দেখে আরাদ বলল,’সবার জীবন সুখের হয় না সায়েন। তার প্রমাণ তোমার সামনে। সুখ দুঃখ সবার জীবনে স্থির নয়। আবার কারো কারো জীবনে স্থির। কিন্তু তোমার জীবনে দুটোই বহমান। পারবে না পেছনের সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে??’

‘আপনি পারবেন পারবেন আমাকে ভুলে যেতে। আমার থেকে দূরে সরে যেতে??’

‘ভুলতে পারব না তবে দূরে সরে যেতে অবশ্যই পারব। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমার চাই না তোমার ভালোবাসা। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই অনেক। ভালোবাসতে তো পেরেছি!!’

সায়েনের গলা ধরে এসেছে। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,’আপনাকে দেখলে আমার পিছনের কথা মনে পড়ে যায়। প্লিজ আমার সামনে আসবেন না। আমি আমার জীবনের ভয়াবহ অতীতকে মনে করতে চাই না?? আপনি চলে যান প্লিজ!!!’

আরাদ থেমে গেল। এখন ওর চলে যাওয়াটাই বেটার। চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে তাকালো আরাদ বলল,’আমি আমার শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়েছি সায়েন। আর তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষকে ক্ষমা করতে পারবেনা?? শুধু একবার ভেবে দেখো যে আমার দোষ ঠিক কতটুকু ছিল??’

বলেই হাঁটা ধরলো আরাদ। যতক্ষনে আরাদ গাড়ি পর্যন্ত গেল সায়েন অবাক হয়ে দেখল। ভাবল কি বলে গেল আরাদ??ওর দোষের পরিমাপ করতে বলে গেল। আরাদ গাড়ি নিয়ে এক ছুটে চলে গেল। সায়েন কিছুক্ষণ ধরে গাড়ি চলে যাওয়াটা দেখল। তারপর গুটিগুটি পায়ে বাড়িতে ফিরে গেল। বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ান এর সাথে কথা বলছে শফিকুল ইসলাম। সায়েন সেদিকে যেতেই তিনি অস্থির হয়ে বললেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি?? আমার কত চিন্তা হচ্ছিল!!’

‘একটু সামনে হাঁটতে গিয়েছিলাম। রুমে একা একা ভালো লাগছিল না।’

‘এরপর থেকে বের হলে আমাকে বলবে আমি নিয়ে যাব।’

সায়েন মাথা নাড়িয়ে বাবার সাথে রুমে এলো। হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে আসলো। আর কিছু না পারুক অন্তত চা ভালো বানাতে পারে সায়েন। তাই চা বানিয়ে বাবাকে দিলো আর নিজে এক কাপ নিলো।
চা নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসলো সায়েন। আরাদের বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগলো। সত্যি তো আরাদের দোষ কতটুকু?? ভালোবাসার জন্য তো সে মিথ্যা বলেছিল আরাদ। এর থেকে তো কোন খারাপ উদ্দেশ্য আরাদের ছিল না। তাহলে তো নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে ওর এতটুকু সময় লাগতো না। কিন্তু আরাদ তা কখনোই করেনি। সম্মান করেছে সায়েনকে। যদি খারাপ উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে দিনের পর দিন ওই নোংরা চিলেকোঠার ঘরে পরে থাকতো না আরাদ। ও তো চায়নি সায়েনকে সবার সামনে খারাপ বানাতে। সবটাই তো ওর ভাগ্যে লেখা ছিল। ওসব বিষয়ে তো আরাদের কোন হাত ছিল না। কিন্তু তবুও কেন সায়েনের মন মানছে না। সবকিছুতে আরাদকে সামনে পাচ্ছে সায়েন। সবসময় এটাই মনে হচ্ছে যদি আরাদ সেদিন ওর জীবনে না আসতো তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না।
এসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো সায়েন। সাথে সাথে কপাল কুঁচকে ফেলে সে। চা পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে। তারমানে এতক্ষণ ধরে ভাবছে সায়েন যে চা ঠান্ডা হয়ে গেল!! বিরক্ত হয়ে চায়ের কাপটা রেখে দিলো সায়েন। মনে মনে আরাদকে বকছে সে। লোকটার কথা ভাবলে একটা না একটা গন্ডগোল হবেই।

সন্ধ্যার পরেই শাফিন ফিরলো। আজকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি এসেছে সে। কারণ আজকে রুহির বাড়িতে যাবে ওরা। সায়েনকে বাড়িতে রেখে চলে গেল ওরা। দরজায় খিল এঁটে নিজের রুমে বসে আছে সায়েন। লোকসম্মুখে সায়েনকে নিয়ে যেতে চায় না শাফিন। কারণ তারা সায়েনকে কটু কথা শোনাতে ছাড় দেবে না। তাছাড়া এমনিতেই রুহির পরিবার ওদের উপর অসন্তুষ্ট। তারপর যদি সায়েন যায় তাহলে তো তারা কিছু না কিছু বলবেই বলবে।
তাই সায়েন বাড়িতেই রয়ে গেল। বারান্দা থেকে রুম জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো সে। সে গভীর ভাবনায় মগ্ন। কলিং বেলের শব্দে ঈষৎ চমকালো সায়েন। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তো ওদের আসার কথা না। সায়েন ভাবছে দরজা খুলবে কি খুলবে না!! ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সায়েন। দরজার হোল দিয়ে তাকালো। আকাশের মুখটা জ্বলজ্বল করছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়েন এবং দরজা খুলে দিল। আকাশ মুচকি হেসে তাকালো সায়েনের দিকে। তারপর হাতের বইগুলো এগিয়ে দিলো সায়েনের দিকে। সায়েন বইগুলো হাতে নিতেই আকাশ বলে উঠলো,’এই বইগুলো ফেলে এসেছিলে। তাই দিতে আসলাম।’

সায়েন ছোট্ট করে বলল,’ওহ!!’

আকাশ ইতস্তত করছে হয়তো কিছু বলতে চায়। সায়েন সেটা উপলব্ধি করতে পারলো। কিন্তু আকাশকে সে রুমের নিতে পারবে না। শাফিনের কড়া নির্দেশ ছিল দরজা যেনো না খুলে। সায়েন বলল,’সরি আপনাকে এই মুহূর্তে ভেতরে নিতে পারছি না। আসলে বাসায় কেউ নেই। এমনিতেই অনেক দাগ রয়েছে আমার শরীরে। নতুন করে কোন দাগ লাগাতে চাই না আমি। তবে অন্য একদিন আসবেন। দাওয়াত রইল।’

আকাশ মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। সায়েন দরজা আটকিয়ে রুমে গিয়ে বই গুলো গোছাতে লাগলো। আকাশ বাইকে উঠে বসলো। সায়েনের ফ্ল্যাটের দিকে তাকালো। সায়েনের রুমে বাতি জ্বলছে তাহলে কি সায়েন নিজের রুমে??সায়েন কোনদিনও আকাশের সাথে যেচে কথা বলেনি। আকাশই বলেছে নানা বাহানায়। অনেকবার আকাশ সায়েনের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু সায়েনের দৃষ্টি সবসময় মেঝেতে নিবদ্ধ ছিল। আকাশের সাথে তো কোন প্রকার মনমালিন্য ছিল না সায়েনের। কিন্তু আরাদকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও সায়েন আরাদের চোখে চোখ রেখেই সবসময় কথা বলে। যেটা আকাশের ভালো লাগে না। কিন্তু ওর কিছু করার ও নেই। ভালোবাসা জোর করে হয় না।হয়তো সায়েন জানেই না যে আকাশের মনে ওর জন্য আলাদা স্থান রয়েছে। বড় একটা শ্বাস ফেলে আকাশ চলে গেল।

সায়েন একটা বই নিয়ে বসেছে। বইয়ের শেষ পাতার মলাটের সাথে কিছু লেখা। লেখাগুলো খুব ঘনঘন যা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে সায়েন তা বুঝতে পারছে। কারণ লেখাগুলো সায়েন নিজেই লিখেছিল। আই হেইট ইউ আরাদ। এই লেখাগুলো হিজিবিজি করে লেখা। যা সায়েন ব্যতীত অন্য কেউ বোঝার কোন উপায় নেই। সায়েন লেখাগুলোয় হাত বুলায়। যখন আরাদের কথা মনে পড়ত সায়েন এসব লিখে রাখতো বইয়ের মলাটে।

বইটা হাতে নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সায়েন তা ও নিজেও জানে না। কলিং বেলের শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সায়েন। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। শাফিন আর ওর বাবা এসেছেন। শাফিন বিরক্ত হয়ে রুমে চলে গেল। শফিকুল ইসলাম ও নিজের রুমে চলে গেলেন। সায়েন বুঝলো না যে কি হয়েছে। পরে ভাবলো হয়তো রুহির বাবা মায়ের সাথে কিছু হয়েছে!!সায়েন গুটিগুটি পায়ে শাফিনের রুমে গেল বলল,’ভাইয়া ওরা এই বিয়েতে রাজি হয়নি??’

শাফিন হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘রাজি হয়েছে!!বিয়ের ডেট ও ফাইনাল।’

‘তাহলে তোমরা মুখটা এরকম করে রেখেছো কেন??’

শাফিনের বিরক্তিভাবটা আরেকটু বাড়লো বলল,’রুহির বাবা মা বড্ড সেকেলে। ওনারা এখনই মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায়। ওনাদের মেয়েকে স্বর্ণে মুড়িয়ে দিতে হবে। শুধু তাই নয় কাবিননামায় টাকার এমাউন্ট ওনারাই ঠিক করবেন বলেছে।’

সায়েন আগ্রহী হয়ে বলল,’তারপর তুমি কি বললে??’

‘বলেছি সব আমার ইচ্ছা মতোই হবে। আমি আমার বউ কে কি দেব না দেব সেটা আমার ব্যাপার। যদি তারা এসব মানে তাহলে বিয়েটা হবে না মানলেও হবে। উসখুস করতে করতে রাজি হয়েছেন ওনারা।’

‘যাক বাবা বিয়েটা হচ্ছে এটাই ভালো।’

সায়েন চলে আসতে নিলে শাফিন ওর হাতে একটাও বক্স ধরিয়ে দেয়। ওখানে বসেই বক্সটা খুলল সে। নতুন ফোন দেখে সায়েন হাসল বলল,’খুব সুন্দর হয়েছে।’

‘আমি দেইনি রুহি দিয়েছে।’

সায়েন অবাক হলো সাথে রাগ ও করল বলল, ‘তুমি আনলে কেন??’

‘আমি কি নিতে চেয়েছি??জোর করেই দিয়েছে।বলেছে হবু ভাবি হিসেবে গিফট করেছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের তো শপিং করতে হবে। বিয়ের কত কাজ। মামা মামি খালামণিদের বলবি না??’

‘আব্বুকে জিজ্ঞেস কর।’

সায়েন ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। বাবার সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করলো সে।বিয়ের আট দিন বাকি তাই সবকিছু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। দু’দিন পরেই সায়েনের মামারা আর খালারা চলে আসেলো। তারা জানতোই না যে সায়েন ছাড়া পেয়েছে। সায়েনকে দেখেই সবাই অবাক। লিলি খালাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদল সায়েন। কারণ মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে। মামা মামিও সায়েনের জন্য চোখের পানি ফেললেন।
লিমাও এসেছে ওর কোলে ছোট্ট প্রিন্সেস। সায়েন বাবুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলো। তারপর সবাই মিলে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিল। সবার সাথে থেকে বেশ আনন্দ পাচ্ছে সায়েন। কিন্তু এতসব কিছুর মধ্যে সে আরাদকে একটি বারের জন্য ও দেখলো না। এতে সায়েন খুশি হলো না আবার খারাপ লাগলোও না। ও নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছে।

বাড়ির ছাদে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। বেশ ছোটো করেই সব আয়োজন করা হয়েছে। আকাশ কে ও ইনভাইট করেছে শাফিন। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে শাড়ি পরেছে সায়েন। কতদিন পর সে শাড়ির পরেছে তা ও নিজেও জানে না। ওর খালা আর মামি কাজের ফাঁকে ফাঁকে সায়েনকে দেখে রাখছেন। সায়েন মন খারাপ করলেই তারা সামলাচ্ছেন।
বিয়ের দিন সকলেই রুহির বাড়িতে চলে গেল। আজকে সায়েন ও গিয়েছে সাথে। একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা ওকে তো যেতেই হবে। কিন্তু সায়েন কি জানত ওখানে গিয়ে আবার অপমানের সম্মুখীন হতে হবে??কম বেশি সবাই সায়েনকে চিনে ফেলল। তাছাড়া রুহির মা’ই সবাইকে বলেছে। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সায়েন খেয়াল করলো সবাই কেমন দৃষ্টিতে যেন সায়েনকে দেখছে। শুধু তাই নয় কানাঘুষা ও চলছে। কেউ কেউ তো রুহির মায়ের কাছে গিয়ে এটা ওটা বলছে। রুহির মা ও একেকটা বলছে। মানুষের কান ভাঙাতে তো আর বেশি সময় লাগে না। ঠিক সেটাই হলো।
বিয়ে পড়ানোর সময়ই বাধ সাধলেন রুহির মা বললেন,’এই বিয়ে করতে হলে আমার কিছু শর্ত মানতে হবে নাহলে বিয়ে হবে না।’

শফিকুল ইসলাম অবাক হয়ে বললেন,’এসব আপনি কি বলছেন??বিয়ের দিন এবং কথা বলার মানে কি??’

রুহির মা জোর গলায় বললেন,’মানে আছে। আপনার মেয়ে একটা খুনি। নিজের স্বামীকে খুন করেছে। এরপর যে এরকম কাজ আর করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে??’

‘দেখুন আমার মেয়ে ওরকম কাজ করবে না। আর এই খুনটাও সে ইচ্ছে করে করেনি। এটা একটা এক্সিডেন্ট। সবটাই তো জানেন আপনারা।’

‘হুম জানি। কিন্তু এই এক্সিডেন্ট যদি আমার মেয়ের সাথে হয়??আমি আমার মেয়েকে হারাতে চাই না। কথায় আছে না চুরি করার জন্য একবার হাত চলে গেলে সেই হাত বারবার চুরি করতে চায়। আপনার মেয়ে একবার খুন করেছে। দ্বিতীয় বার একই কাজ আবার করতেও পারে। আমি এমন ঘরে মেয়ে কিভাবে দেব??’

শফিকুল ইসলাম শান্ত হলেন বললেন,’তো আপনার শর্ত কি??’

‘আমার শর্ত হচ্ছে বিয়ের পর আপনার মেয়েকে কোন আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। এই মেয়েকে তো এমনিতেই কেউ বিয়ে করবে না। তাই বলছি কোন আত্মীর বাড়িতে মেয়েকে রেখে আসবেন। তাহলে আমি নিশ্চিত হব যে আমার মেয়ে সুরক্ষিত আছে।’

সায়েন একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। সবসময় ওকেই কেন সবাই দোষী ভাবে?? সত্যি কি ও দোষী??ওর ভাগ্যে তো এসব লেখা ছিল। ইচ্ছে করে তো খুনটা করেনি তাহলে সবাই কেন ওকে দোষী ভাবে?? চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না সায়েনের। লিলি খালা সায়েনকে আগলে ধরলেন। সায়েন বলল,’ঠিক আছে আমি বরং খালামনির কাছেই থাকব। তারপর নাহয়,,,’

খালা সায়েনের হাত চেপে ধরে বললেন, ‘তারপর নাহয় কি??তুই আমার কাছেই থাকবি।’
শাফিন আর সহ্য করলো না তেড়ে উঠলো বলল,’আমার বোন আমার কাছেই থাকবে। এতে যদি আপনারা রুহির সাথে আমার বিয়ে না দেন তো করব না এই বিয়ে। আপনার কাছে আপনার মেয়ে যেমন সবার আগে আমার কাছে তেমনি আমার বোন ও আগে। আমার বোন আমার কাছেই থাকবে ব্যাস। বিয়ে না হলে আমরা চলে যাই।’

শফিকুল ইসলাম শাফিনকে শান্ত হতে বললেন। তিনি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। সবাই বুঝলেও রুহির মা নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তিনি কিছুতেই সায়েন আর রুহিকে একসাথে রাখবেন না। আকাশ এতক্ষণ পরিস্থিতি দেখছিল। সে এবার মুখ খুলল,’দেখুন আমি কিন্তু আইনের লোক। আমি ইচ্ছে করলে আপনাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে পারি কিন্তু তা আমি করব না। যেহেতু ব্যাপারটা সায়েনকে নিয়ে হচ্ছে তাই আমি একটা কথা বলতে চাই।’

কথাটা আকাশ রুহির মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে। রুহির মা কিছু বলল না আকাশ আবার বলল,’কে বলেছে যে সায়েনকে কেউ বিয়ে করবে না। আপনি কি জানেন??আর সবাইকে কি নিজের মতোই মনে করেন আপনি??’
ফুঁসে উঠল রুহির মা বলল,’কি বললে??’

‘বললাম সায়েনকে কেউ বিয়ে করবে না এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা আপনার।’

‘তাহলে কে বিয়ে করবে শুনি। তুমি?? জেলখানায় বসে বসে এসব করেছো নাকি?’

আকাশ এবার রেগে গেল খুব। এই মহিলার মুখের ভাষা খারাপ। যা নয় তা বলেই যাচ্ছে তখন থেকে। এর মুখটা যেকরেই হোক বন্ধ করতে হবে। তাই আকাশ বলল,’আজ এই মুহূর্তে যদি সায়েনের বিয়ে আমি দিতে পারি তাহলে কি করবেন আপনি???’

#চলবে,,,,,,,,,,,,

#চিলেকোঠার_প্রেম

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব_২৪

পিনপতন নীরবতা পালন করছে সবাই। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। অথচ প্রায় দশ পনের জন মানুষের উপস্থিতি সেখানে। সোফার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে জাম রঙের শাড়ি পরিহিতা রমনি। চুলের খোঁপা টা এলোমেলো হয়ে আছে। খোঁপায় গোঁজা গোলাপের পাপড়ি গুলো খসে পড়েছে তবে কিছু কিছু পাপড়ি এখনও বিদ্যমান। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ সে কেঁদেছিলো। চোখ ফুলে আছে তার,গাল আর নাকের ডগা অসম্ভব লাল হয়ে আছে। তবে এখন সে আর কাঁদছে না। হয়ত সেই শক্তি সে হারিয়েছে। কোমল দেহটা কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে তার। সোফার অপর পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে নিলিমা বেগম। হাসি বেগমও পাশে বসা। ওনাদের মুখে একটু নয় অনেক বেশি চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে। দুজনের দৃষ্টি সায়েনের দিকে। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে কোলের উপর নিয়ে চেপে ধরে বসে আছে সায়েন। ওর দৃষ্টি নিজের পায়ের দিকে। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না সায়েনের। নিলিমা বেগম চোখ সরিয়ে নিজের রুমের দিকে তাকালো। দরজাটা সেই কখন থেকে বন্ধ হয়ে আছে এখনও কেউ খুলছে না কেন? ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতে। কিন্তু আরাদের যা রাগ!! আবার কি না কি করে বসে কে জানে??এই কারণেই সবাই চুপ করে আছে। সায়েনকে এভাবে দেখে আরশি খানিকটা বিরক্ত। যবে থেকে শুনেছে যে আকাশ সায়েনকে ভালোবাসে তবে থেকেই সায়েনকে ভালো লাগে না ওর। আর তনয়া অবাক হয়ে সায়েনকে দেখছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সেদিন কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আরশির জন্য পারেনি। তাই আজকে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কথা ও বলেই ছাড়বে শুধু আরাদের অপেক্ষা।

কিছুক্ষণ আগেই সায়েনকে নিয়ে নিজের বাড়িতে হাজির হয় আরাদ। ওর সাথে আকাশ,রাফিন,নিয়াজ এবং জোনায়েদ ও। তবে সায়েনকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। নিলিমা বেগম তো যারপরনাই বিরক্ত হয়ে গেছে সায়েনকে দেখে। তবে ছেলের মুখের উপর কোন কথাই বলেননি তিনি। আরাদ কাউকে কিছু না বলেই বাবা আর কাকাকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছে তাও রুমের দরজা আটকে। তাই সবাই ওনাদের অপেক্ষা করছে। সায়েনকে কেন এখানে আনা হয়েছে তা এখনও সবার অজানা। আরাদ না বলা পর্যন্ত সবাই চুপ করে বসে থাকবে। কিন্তু জোনায়েদ রাফিন আর নিয়াজের কোন ভাবান্তর নেই ওরা বসে বসে ফোন চালাতে ব্যস্ত। দেখে মনে হচ্ছে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ওরা। কে কার আগে ফোনের চার্জ শেষ করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। কিন্তু আকাশের মুখটা বেশ থমথমে। সে চুপ করেই বসে রয়েছে। আরশি বারবার আকাশের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু সে ব্যর্থ হচ্ছে।
এমন সময় দরজা খোলার শব্দ আসতেই সবাই চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। আরাদের বন্ধুরা চট জলদি ফোন পকেটে পুরে ফেলল। আরাদ এগিয়ে আসলো সাথে ওর বাবা ও কাকা। আরাদ দাঁড়িয়ে রইল আর ওনারা দুজনে সোফায় গিয়ে বসল। ইমজাদ ওয়াহেদ সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’এখানে থাকতে তোমার যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে বলতে পারো!!!আমরা তোমাকে জোর করব না।’
ইমাজদ ওয়াহেদের কথা শুনে নিলিমা বেগম বড়বড় চোখে তাকালেন। এখানে থাকতে সমস্যা মানে??সায়েন কি এখানে থাকবে নাকি?? সায়েন উওর দিলো না ডান হাতের উল্টো পিঠে শুধু চোখ মুছলো। আকাশ বলে উঠলো,’ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। ও এখানে থাকবে। সব সিদ্ধান্ত আরাদ নেবে।’
ইমান ওয়াহেদ বললেন,’কিন্তু সায়েনের ও তো একটা মতামত আছে??’

আরাদ বলে,’ওর চুপ থাকাটাই হ্যা বলেই ধরেছি আমি। আর কোন কথা নয়। সায়েন চলো??’
বলতে বলতে আরাদ সায়েনের দিকে এগিয়ে যেতেই হাসি বেগম বলে উঠলো,’থাম আরাদ, এভাবে সবটা লুকাচ্ছিস কেন??এই মেয়েটা এখানে থাকবে কেন??ও তো এই বাড়ির কেউ নয়। তাছাড়া ওর তো বাবা আছে ভাই আছে সেখানে তো থাকতে পারে??’
এবার জোনায়েদ উওর দিলো বলল,’হুম সায়েনের পরিবার আছে কিন্তু একটা সমস্যা হওয়ার কারণে ওকে এখানে আনা হয়েছে।’

জোনায়েদের কথায় বিরক্ত হলো হাসি বেগম বলল,’কি সমস্যা যে এখানে ওকে রাখতে হবে।’

‘সায়েনের ভাইয়ের বিয়েতে সমস্যা হয়েছে। ওর ভাইয়ের শ্বাশুড়ি চায় না সায়েন ওদের সাথে থাকুক তাই আরাদ ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।’

নিলিমা বেগম এবার রেগে গেলেন। এটা কোন কারণ হলো?? তিনি বললেন,’তাহলে আমরা কি করবো। ওর পরিবার সেটা বুঝবে। এরকম একটা মেয়ে আমাদের বাড়িতে থাকলে লোকে কি বলবে??’

‘লোকে কি বলবে সেটা নিয়ে আমি কোনদিন ভাবিনি আর ভাববোও না। তোমরা মানো আর না মানো সায়েন আজ থেকে এখানেই থাকবে ব্যাস।’

আরাদের কঠোর কন্ঠে সবাই চুপ করে গেল। ইমজাদ ওয়াহেদ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,’আরাদ যখন চাইছে তখন সায়েন এবাড়িতে থাকবে। আরশি গেস্ট রুমটা খুলে দাও।’

ইমজাদ ওয়াহেদ নিজের রুমে চলে গেলেন। সাথে তার ভাইও। আরাদ আরশির দিকে তাকিয়ে বলল,’তোকে গেস্ট রুম খুলতে হবে না।’
আরশি মাথা নাড়ল। আরাদ গিয়ে সায়েনের হাত ধরে দাঁড় করালো। তারপর একপ্রকার টেনেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যেতে লাগলো। সবার দৃষ্টি এখন ওদের দিকে। একহাতে শাড়ির আঁচলটা ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে সায়েন। আরাদের সাথে এতো তাড়াতাড়ি সে পারছেও না। তবুও আরাদের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে সে। আরাদ আর সায়েনের চলে যাওয়ার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না আকাশ। সাথে সাথে সে বেরিয়ে গেল। যা আরশির দৃষ্টি এড়ালো না।
আরাদ সায়েনকে নিয়ে ছাদে উঠতে লাগলো। সায়েন বুঝলো না যে আরাদ ওকে নিয়ে ছাদে যাচ্ছে কেন??ছাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই ডানদিক বরাবর একটা ঘর। ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। আরাদ দরজা খুলে সায়েনকে নিয়ে সেঘরে প্রবেশ করলো। লাইট জ্বালাতেই সায়েন অবাক হয়ে গেল। বেশ বড়সড় রুমটা। রুমের ভেতরে খাট, ড্রেসিং টেবিল,কাবার্ড,সোফা এবং প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। রুমটার ছাদটা পুরো সমান্তরাল নয়। একপাশে হেলানো দেখলে মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পরবে। ছাদের হেলান অংশে সাদা কাঁচ লাগানো যা দিয়ে আকাশটা দেখা যায়। সায়েন চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। আরাদ সায়েনের হাত টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। তবুও সায়েন চোখ তুলে তাকালো না। আরাদ বলল,’আমার দিকে তাকাও??’

সায়েন তাকালো। আরাদ নিজের হাত দ্বারা সায়েনের গাল আবদ্ধ করে বলল,’থাপ্পড়টা কি খুব জোরে লেগেছিল??’
সায়েন এতক্ষণ আরাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর কথা শুনে গাল ফুলিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। আরাদ একহাত সরিয়ে সায়েনের গাল দেখলো। লাল হয়ে আছে এখনও। আরাদ আলতো করে সায়েনের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’সরি!!মাথা ঠিক ছিল না তখন। আর তার উপর তোমার কথাগুলো মাথাটা আরো গরম করে দিয়েছিল তাই!! আচ্ছা বাদ দাও ওসব। আগে তোমাকে এই রুমটা দেখাই।’

আরাদ সায়েনের হাত ধরে টেনে নিয়ে সব দেখালো বলল,’তোমার চিলেকোঠার ঘরে আমি থেকেছি এবার তোমার পালা। আমার চিলেকোঠার ঘরে আজ থেকে তুমি থাকবে। তোমার চিলেকোঠার ঘর আর আমার চিলেকোঠার ঘর সম্পূর্ণ আলাদা। কেন জানো?? তোমার চিলেকোঠার ঘর তুমি আমার জন্য বানাওনি। কারণ তুমি আমার আগমনের খবর জানতে না। কিন্তু আমি এই চিলেকোঠার ঘর শুধু তোমার জন্য বানিয়েছি। কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে সত্যি সত্যি তুমি আসবে। ভেবেছিলাম অন্তত একবার হলেও তোমাকে এই ঘরটা দেখাব। আর দেখ তাই হলো।’

সায়েন কিছু বলল না। আরাদের চড়টা এখনও হজম করতে পারেনি ও। এক ঘর মানুষের সামনে চড় মারাটা সায়েন মানতে পারছে না। তবে সায়েনের দোষেই ওকে চড় মেরেছে আরাদ। কিন্তু নিজের দোষ স্বীকার করতে সে নারাজ। আরাদ আবার বলল, ‘আমাদের শুরুটা হয়েছিল চিলেকোঠার ঘর দিয়ে। কিন্তু প্রেমটা হয়নি। এবার হতে বাধা কোথায়?? আচ্ছা আমি আসি। জাস্ট ওয়েট।’

আরাদ বেরিয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেল সায়েনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,’রুমে এটাচ বাথরুম আছে। আমার মতো উপর নিচ দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না তোমায়।’
বলেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে বের হয়ে যায় আরাদ। সায়েন খাটের উপর বসে পড়লো। কি হতে কি হয়ে গেল এসব ভাবছে সায়েন। জীবনটা ওর আবার নতুন মোড় নিয়েছে। না জানি এবার ওর জন্য আর কি কি অপেক্ষা করছে??এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় নক করল কেউ। সায়েন নড়েচড়ে বসতেই দরজা খুলে দুটো মেয়ে রুমে প্রবেশ করলো। মেয়ে দুটোকে দেখেই চিনতে পারলো সায়েন। ভার্সিটিতে কয়েকবার দেখেছে সে। এই বাড়িতে এসে একবারও দেখেনি কারণ ও তো চোখ তুলে কারো দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। তনয়া ওর হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে চট করে সায়েনের পাশে বসে পড়লো। সায়েন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। তনয়া মুখে হাসি নিয়ে বলল, ‘তুমি আমাদের সেই ভাবি যার জন্য আমার ভাইয়া দিওয়ানা তাই তো!!’

দুষ্টু হাসি দিলো তনয়া। তনয়ার কথায় আরশি বিরক্ত হলো। তনয়া বলল,’আমি তনয়া,আর ও আরশি।’
কথাটা আরশিকে দেখিয়ে বলল তনয়া। আরো বলল,’আমি ভাইয়ার চাচাতো বোন আর আরশি নিজের বোন। উফফ আমি এতো কথা বলছি কেন??যে কাজে এসেছি সেটাই তো ভুলে গেছি।’
টেবিল থেকে ব্যাগটা এনে সায়েনের হাতে দিয়ে বলল,’এতে আমার থ্রিপিস আছে পড়ে নাও। তোমার সাথে অনেক কথা আছে সব পরে বলব। আমি তোমাকে হেল্প করব??’

সায়েন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মুখ দিয়ে কথা বলতে চেয়েও সে পারছে না যেন। তনয়া আবার বলল,’তোমার চুলের খোঁপা টা খুলে দেই??’
সায়েন মাথা নাড়ল শুধু। তনয়া খুব যত্নে সায়েনের খোপা খুলে দিয়ে চুলের জট ছাড়িয়ে দিলো। তনয়ার থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেল সায়েন। দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করলো সে। শাওয়ার শেষে মিষ্টি রঙের থ্রিপিস টা পরে নিলো। মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হতেই চমকালো সায়েন। কারণ আরশি আর তনয়া উধাও। টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে আরাদ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ওর ছাই রঙের টাউজার আর পাতলা কালো টিশার্ট। যা গরম পরেছে!! তাছাড়া রুমে এসি চলছে তার পরও গরম চেপে ধরেছে আরাদকে। ভেজা চুল বেয়ে এখনও পানি গড়িয়ে পড়ছে আরাদের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সবে শাওয়ার নিয়ে ফিরেছে আরাদ। আরাদকে এভাবে দেখে থমকে দাঁড়ায় সায়েন। তারপর ধীর পায়ে অন্যদিকে গিয়ে মাথা থেকে তোয়ালে খুলে চুল মুছে তোয়ালে টা চেয়ারে মেলে দিলো। আরাদ এখনও সায়েনের দিকে তাকিয়ে আছে। যা সায়েনকে অস্বস্তির মুখে ফেলছে। সায়েন পারছে না পিছনে ঘুরে তাকাতে।

আরাদ নিজেই সায়েনের কাছে এগিয়ে গেল। সায়েনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,’কথা বলবে না আমার সাথে?? এখন তো সেই সব অধিকার আছে তোমার। তাহলে চুপ করে আছো কেন??মারতেও পারো আমাকে নো প্রবলেম। এখন আমার মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা আছে।’
সায়েন তবুও চুপ করে আছে। আরাদ সায়েনকে আরেকটু কাছে টেনে আনলো। সায়েন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। ও জানে চাইলেও নিজেকে ছাড়ানো সম্ভব নয়। আরাদের দিকে চোখ তুলে তাকালো সায়েন বলল,’নরক থেকে মুক্তি দিতে আরেক নরকে এনে ফেললেন কেন আমাকে??’

কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো আরাদের বলল, ‘কেনো?? তোমার হঠাৎ এরকম মনে হওয়ায় কারণ??’

‘সেটা কি আপনাকে বলে দিতে হবে?? আপনি তো বাচ্চা নন। সবটাই বোঝেন। এটা বোঝেন না যে আপনার পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমার আসা মেনে নিতে পারছে না??আমি তো বলেছিলাম যে আমি অন্য কোথাও,,,’

মুখে আঙ্গুল দিয়ে সায়েনকে চুপ করিয়ে দিলো আরাদ। দুহাতের মুঠোয় সায়েনের দুহাত নিয়ে বলল,’আমার পরিবারকে তোমার থেকে আমি বেশি জানি। তাদের কিভাবে সব মানাতে হবে সেটাও আমি জানি। এখানে তোমার কোন কাজ নেই। তুমি শুধু আমাকে মানানোর চেষ্টা করবে তাহলেই হবে। আমি জানি তোমার এতে সময় প্রয়োজন। সময় তুমি পাবে। তবে আমার অপেক্ষা টা যেন সফল হয়। কিছু কিছু অপেক্ষা মিষ্টি হয় জানো??সেই মিষ্টি অপেক্ষা আমি উপভোগ করতে চাই সায়েন। এতকিছুর পরও আমাকে ফিরিয়ে দিও না। হয়তো আমাদের মিলটা এভাবেই লিখে রাখা ছিলো। জীবনে তো অনেক কিছু মেনে নিয়েছো তাহলে এটা কেন মানতে পারবে না??’

সায়েন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাদের কথা শেষ হওয়ার পর আর ওর চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না সায়েনের। চোখের পলক ফেলতেই পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। আরাদ আলতো হাতে সায়েনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

সায়েন হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো মেঝেতে। আবার কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসলো। কাঁদতে লাগলো সায়েন। ফোনের শব্দে হুঁশ ফিরলো সায়েনের। বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো সায়েন। শাফিন কল করেছে। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করলো সায়েন। শাফিন বলে উঠলো,’পৌছে গেছিস??’
সায়েন নিচু গলায় বলল,’হুম!! তোমরা বাড়িতে গিয়েছো??আব্বু কোথায়?কি করছে?’

শাফিন গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,’কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। তোকে নিয়ে আসব তখনই। আমার ইচ্ছা করছে না তোকে ওখানে রাখতে। কি করব তাও ভেবে পাচ্ছি না।’

‘আমার কথা ভাবিস না ভাইয়া। আমি ভালো থাকবো এখানে। তুই নতুন সংসার শুরু করেছিস। ভালো থাক। আমি অবশ্যই আসব তোকে আর ভাবিকে দেখতে। আর আব্বুকে বলবি আমি ভালো আছি। রাখছি এখন কালকে কথা হবে।’

ফোন রেখে উঠে বসলো সায়েন। চুপচাপ বসে রইল সে। আজকে মায়ের কথা বড্ড মনে পরছে ওর। মা’কে যে ও বাঁচাতে পারলো না। এজন্য সায়েন নিজেকে দোষী ভাবে। এসব ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে তনয়া এলো হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। সায়েনকে খাইয়ে তবেই সে গেল। আরাদের কড়া হুকুম, সায়েনকে যেন সে খাইয়ে ফেরে। তনয়া অনেক রিকোয়েস্ট করে খাইয়ে দিয়ে গেছে সায়েনকে।

দরজা আটকিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সায়েন। হাতের ডানপাশে ছাদের হেলানো অংশ। স্বচ্ছ কাঁচের মধ্যে দিয়ে তারাভরা আকাশটা দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর মিটিমিটি করে হাসছে তারাগুলো। মনে হয় ওদের খুশির শেষ নেই বলেই ওরা সবসময় হাসিখুশি থাকে। এই মুহূর্তে তারাগুলো দেখে হিংসা হচ্ছে সায়েনের। চাঁদ মামা আজকে আসেনি। নিশ্চিত তারাদের সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। ছোট বেলা থেকে এটাই ভেবে আসছে সায়েন। যেদিন আকাশে চাঁদ দেখা যেতো না সায়েন ভাবতো চাঁদ আর তারা মিলে ঝগড়া করেছে। আর যেদিন চাঁদ উঠতো সায়েন ভাবতো ওদের আবার ভাব হয়ে গেছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখটা বুজে এলো সায়েনের। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

সকালে ঘুম ভাঙলো দরজার ঠকঠক শব্দে। সায়েন উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো আরাদ দাঁড়িয়ে আছে হাতে ব্রাশ নিয়ে। আর মুখের মধ্যে নিজের ব্রাশ। একহাতে সায়েনের ব্রাশ ধরে আছে আরেকহাত দিয়ে নিজে ব্রাশ করছে। নাক কুঁচকে ফেলে সায়েন বলে, ‘খাচ্চর ওয়াক থু,ব্রাশ করতে করতে কেউ বের হয়??’
আরাদকে বলার সুযোগ দিল না সায়েন। নিজের ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

#চলবে,,,,,,,,,,