#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_২৭
এই মুহূর্তে কোন কবিতাই মনে পড়ছে না কবিতা নামের মেয়েটির। কিন্তু হাসি আর নিলিমা বেগম যেভাবে ওকে চেপে ধরেছে সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। আমতা আমতা করছে কবিতা। হাসি বেগম সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা থাক তোমাকে কবিতা বলতে হবে না। তবে একটা শর্ত আছে। সেটা মানতেই হবে তোমাকে।’
কবিতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের নামের চক্করে সব কবিতাই গুলিয়ে ফেলেছে সে। এমনকি ছোটদের চার লাইনের ছড়াও মনে পড়ছে না তার। হাসি বেগম আবার বললেন, ‘তোমাকে যেই মেয়েটাকে দেখাশোনা করার জন্য আনা হয়েছে তার সব খবর আমাদের চাই। আরাদ কখন ওই রুমে যাচ্ছে কতক্ষণ থাকছে কি করছে সব!!বুঝেছো??’
শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়লো কবিতা। কিন্তু আরাদ যে এর আগে হাজার খানেক কথা বুঝিয়েছে ওকে। এও বলেছে যে এবাড়ির কারো সাথে যেন তেমন কথা সে না বলে। ওর কাজ শুধু সায়েনের দেখভাল করা।
নিলিমা এব হাসি বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। কবিতা রান্না ঘরের সব দেখতে লাগল। কবিতাকে আরাদ এনেছে সায়েনের জন্য। মূলত সায়েনের সব খবরাখবর সে আরাদকে দেবে। আরাদ খুব ভালো করেই জানে যে এবাড়ির দুজন মানুষ সায়েনকে মানতে পারছে না। সেটা হলো ওর মা আর কাকিমা। ওনারা যে সায়েনকে কিছু বলেছে তা আরাদ বেশ বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ওর পক্ষে বাড়ি অফিস আর সায়েন এতকিছু সামাল দেওয়া তো সম্ভব নয়। আর তাছাড়া সায়েন আর ওর সম্পর্কের কথা তো সবাই জানে না। নিলিমা বেগম তো সামিউক্তাকে নিয়ে পড়ে আছে। এখন ও এটা নিয়ে ফিসফিসানি চলে তাদের মাঝে। আরাদ আগে সামিউক্তার ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে চায় তারপর নাহয় আস্তে আস্তে সবাইকে সব সত্যিটা বলা যাবে!! কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তো সায়েনকে ঠিক রাখতে হবে। আরাদ জানে যে সায়েনকে একা পেলে ওর মা আর কাকিমনি সায়েনের ব্রেন ওয়াশ করে ছাড়বে। তাই সায়েন যাতে একা না থাকে সেজন্য কবিতাকে এনেছে। এখন আরাদ নিশ্চিন্তে ওর কাজে মন দিতে পারবে।
নিলিমা বেগম ছেলেকে নিয়ে ভিশন চিন্তিত। সে কাতর কন্ঠে বলল,’কি করি বলতো??সবাই যদি জানতে পারে যে একটা খুনি মেয়েকে আরাদ বাড়িতে এনে তুলেছে তাহলে মান সম্মান কিছুই থাকবে না।’
হাসি বেগম তাল মিলিয়ে বলল,’হুম ভাবি। আমার বাপের বাড়ির লোকজন কি বলবে??জানোই তো আমার ভাইয়েরা সব কত বড় ব্যবসায়ী। সব বড়বড় লোকেদের সাথে ওঠাবসা। সবাই জানলে তো!!!’
‘তুই তো ওই মেয়েটাকে কি যেন বললি??তা কি বলেছিল মেয়েটা??’
‘ওই মেয়েটা আর কিই বা বলবে!! তাছাড়া তোমার ছেলে যেরকম এতো সহজে যেতে দেবে নাকি মেয়েটাকে??’
‘আমি তো ভাবতেই পারছি না এমন ছেলে পেটে ধরেছি আমি!!’
বিলাপ করতে লাগলেন নিলিমা বেগম। হাসি বেগম পুনরায় বললেন,’এর একটাই সমাধান আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সামিউক্তার সাথে আরাদের এংগেজমেন্টটা সেরে ফেল। অন্তত ওই মেয়েটার থেকে ফিরিয়ে তো আনা যাবে। পরে দেখবে সামিউক্তাই আরাদকে দিয়ে ওই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।’
নিলিমা বেগম যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন,’সেটাই বরং করি!!আমি আজই আরাদের বাবার সাথে কথা বলব। তারপর সামিউক্তার বাবার সাথে কথা বলে এক সপ্তাহের মধ্যে এংগেজমেন্টের ডেট ফাইনাল করব।’
ওনাদের দুজনের আলাপ আলোচনা সবই কবিতার কানে চলে গেছে। এবং সাথে সাথেই কবিতা কথাগুলো আরাদের কাছে পাচার করে দিয়েছে। সব শুনে আরাদ হতাশ হলো। তার মানে ওর কাকিমনি সায়েনকে কিছু বলেছে। এমনিতেই অনেক কিছু করার পর সায়েনকে নিজের করে পেয়েছে। আর এখন সে সায়েনকে আর হারাতে চায় না। আরাদের এখন কিছু করতেই হবে। ও ফোন হাতে আকাশকে কল করলো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোনটা কেটে দিলো সে।
চিলেকোঠার ঘর থেকে সায়েন একটুও বের হয় না। বের হবেই বা কি করে?? সাথে তো কাউকে লাগবেই। বাড়িটা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে করছে সায়েনের। আপাতত সেই ইচ্ছা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে ফোন বের করে শাফিনকে কল করলো। শাফিন রুহি আর ওর বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো সে। সময় যেন কিছুতেই কাটছ না ওর। তনয়া আর আরশির সাথে ভার্সিটি যেতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু আরাদের অনুমতি ছাড়া যাবেই বা কিভাবে??আরাদকে জিজ্ঞেস করবে ভাবলো সায়েন। তাই সে চুপচাপ বসে রইল। এমন সময় কবিতা এলো ওর রুমে। কবিতা ওর হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বোঝালো যে আরাদ ফোন করেছে। সায়েন ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই আরাদ বলল,’সকালের খাবার খেয়েছো??’
সায়েন ছোট্ট করে উওর দিলো,’হুম।’
‘আমি না আসা পর্যন্ত রুম থেকে বের হবে না। যদি খুব প্রয়োজন হয় তাহলে কবিতাকে নিয়ে বের হবে। আর কারো কথায় কান দেবে না ওকে??
সায়েনের জবাব ‘হুম’ হলো এবারো!!আরাদ বলল,’একটা সিক্রেট কথা শুনবে??’
কপালে ভাঁজ পড়লো সায়েনের। সে আস্তে করেই বলল,’কি??’
‘আই লাভ ইউ!!’
মুহূর্তেই সায়েন বড়বড় চোখে তাকালো কবিতার দিকে। ও কি রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে শব্দ করে হাসলো আরাদ। আবারও সেই সিক্রেট কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিলো সে। সায়েন ফোন এগিয়ে দিলো কবিতার দিকে। কবিতা ফোন নিয়ে বলল,’ম্যাম আপনার ফোন নাম্বারটা স্যারকে দিয়ে দিয়েন। তাহলে আমাকে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না।’
সায়েন মৃদু হেসে বলল,’তোমার স্যার তো ইচ্ছে করলে আমার ফোন নাম্বার নিতে পারে তাহলে কেন নিচ্ছে না??’
‘সেটাও কথা!!!তবে আমি এবিষয়ে স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারব না। আমাকে স্যার আগেই বলে দিয়েছে যে প্রশ্ন করা নিষেধ। আমি যাই!!’
কবিতা চলে গেল। সায়েন ভেবে পায়না যে সবাই এতো ভয় কেন??আরাদ কি বাঘ না ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবে?? কিন্তু সায়েন তো নিজেই এখন আরাদকে ভয় পায়।
সন্ধ্যার পর তনয়া এলো সায়েনের সাথে দেখা করতে। সায়েন যে রুমে থেকে বোর হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে তনয়া তাই সে সায়েনকে নিয়ে বের হয়। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখাবে বলে। এই সন্ধ্যা বেলায় সবাই এখন যার যার রুমে। সায়েনকে নিয়ে নিচে নেমে এলো তনয়া। নিচে ওর বাবা আর কাকার রুম। সায়েনকে বাইরে থেকেই দেখালো। তারপর রান্নাঘর দেখালো। এরপর তনয়া সায়েনকে নিয়ে নিজের রুমে গেল। আরশি এই সন্ধ্যায় ঘুমাচ্ছে দেখে মুচকি হাসলো সায়েন। তনয়া বলল,’আরশি আজকে একটু বেশি টায়ার্ড। বন্ধুদের সাথে আজকে অনেক সময় আড্ডা দিয়েছি তো। চলো তোমাকে আমার ভাইয়ার রুমে নিয়ে যাই।’
এরপর ওরা গেল তামিমের রুমে। ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে বসে আছে তামিম। পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট টিশার্ট। সায়েনকে দেখেই তামিম নড়েচড়ে বসলো। কানের ইয়ারফোন খুলে বলল,’আরে ভাবি তুমি???’
তনয়া মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল,’হিসসস,আস্তে বলো কেউ শুনতে পেলে খবর আছে।’
তামিম মাথা নাড়িয়ে বলল,’ওপপস সরি। আচ্ছা বসো তোমরা।’
সায়েন তনয়া দু’জনেই বসলো। তামিমের সাথে টুকটাক কথা বলে সায়েনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো তনয়া। বেশ ভালোই লাগছে সায়েনের। হাত পা ধরে এসেছিল অনেকটা মরিচা ধরার মতো। তামিমের রুম থেকে বের হয়ে একটু সামনে যেতেই একটা রুম চোখে পড়লো সায়েনের। সায়েন তনয়াকে বলল,’এই রুমটা কার??’
মিটমিট করে হাসলো তনয়া। সায়েন এই হাসির অর্থ বুঝতে পারলো না। তনয়া বলে, ‘ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবে চলো।’
সায়েন ছোট ছোট চোখে তাকালো তনয়ার দিকে। তনয়া এক গাল হেসে বলে,’তুমি গিয়ে রুমটা দেখে আসো ততক্ষণে আমি আমার ফোনটা নিয়ে আসি হ্যা??’
‘তুমি চলো তোমার সাথেই যাই।’
‘আমি তো যাবো। আগে ফোনটা আনি তারপর।’
একপ্রকার জোর করেই সায়েনকে ভেতরে পাঠিয়ে চলে গেল তনয়া। সায়েন ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ করে ফোনের কি এতো দরকার পড়লো তনয়ার। এসব ভাবতে ভাবতে পুরো রুমে চোখ বুলায় সায়েন। বিশাল বড় রুম, খাটটাও অনেক বড়। দেয়ালে নীল রং করা সাথে সাদা সাদা মেঘ ও আঁকা। বেশ ভালো লাগলো সায়েনের। বারান্দায় চোখ গেল সায়েনের সেদিকে এগিয়ে গেল। বারান্দাটাও বেশ বড় আর সুন্দর। বারান্দায় কিছু কিছু গাছ ও আছে। তবে একটাও ফুলের গাছ নয়। পাতাবাহার গাছ। যেগুলোতে শুধু পাতা ফুল হয় না। সায়েন গাছ গুলোয় হাত বুলালো। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়লো তনয়া তো এখনও এলো না। তাই সে তাড়াতাড়ি বের হতে নিলো। সায়েন দরজা খোলার আগেই দরজা খুলে গেল। তাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল সায়েন। এসময়ে আরাদকে দেখে হকচকিয়ে গেল সায়েন। আরাদ ও অবাক হয়ে গেছে সায়েনকে দেখে তবে ওর মুখে হাসি ফুটেছে। আরাদ বলল,’আমাকে মিস করছিলে বুঝি??’
আমতা আমতা করতে লাগলো সায়েন বলল, ‘ন না মানে তনয়া,,,,’
কথার মাঝেই অনেকটা কাছে চলে এসেছে আরাদ। সায়েনের কথা না শুনে সে বলল, ‘চুপচাপ বসো এখানে আমি আগে ফ্রেশ হই তারপর দেখছি।’
শার্ট টাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সায়েনকে আর পায় কে?? তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। এক দৌড়ে চিলেকোঠার ঘরে পৌঁছে গেল সে। তনয়া ইচ্ছে করেই এসব করেছে। ইচ্ছে করেই আরাদের ঘরে ওকে পাঠিয়েছে।
মাত্রি আরশির ঘুম ভাঙলো। মাথাটা এখনো ব্যথা করছে। কফি হলে ভালো হতো কিন্তু আশেপাশে তনয়াকে সে দেখতে পাচ্ছে না। থাকলে ওকে দিয়ে কফি আনতো। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো আরশিকে। ঘুমে সে ঢুলুঢুলু করে হাটছে। রুম থেকে বের হতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগলো আরশির। পড়তে গিয়েও পড়লো না। সামনে থাকা ব্যক্তিকে আঁকড়ে ধরলো বলল,’তনু এক কাপ কফি আন তো??মাথাটা খুব ধরেছে।’
‘সরি!!!’ পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকালো আরশি। চোখ খুলে তাকালো। আকাশকে দেখে ঝড়ের গতিতে ছেড়ে দিলো আকাশকে। আরশির এরকম কাজে ভড়কে গেল আকাশ। এতো রিয়্যাক্ট করার কি দরকার??আরশি বলল,’সরি আসলে দেখতে পাইনি। আমি ভেবেছিলাম তনয়া। এই বাড়িতে ধাক্কা লাগার মতো তনয়াই আছে যার সাথে দিনে তিনবার ধাক্কা না খেলে আমার ঘুমই হয় না।’
চোখ কুঁচকে তাকালো আকাশ। একসাথে কতগুলো কথা বলে দিলো আরশি। তবে আকাশ বেশি কিছু বলল না শুধু এটুকুই বলল,’ইটস্ ওকে।’
বলেই সে আরাদের রুমের দিকে চলে গেল। আরশ বুকে হাত দিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। বড়সড় হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে গেল যেন। তনয়ার কথায় সেদিন থেকে আকাশকে ভোলার চেষ্টা করছে আরশি কিন্তু কিছুতেই পারছে না। উল্টে বারবার আকাশের সামনেই এসে পড়ছে সে।
আকাশ সোজা আরাদের রুমে ঢুকলো। আরাদকে বাথরুমে দেখে খাটের উপর বসলো। কিছুক্ষণ পর আরাদ বের হলো। আকাশকে দেখে আরাদ বিষ্ময়ে বলে উঠলো, ‘তুই???’
‘কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলি বুঝি??’
‘উহু,সায়েন ছিলো এখানে!! কিন্তু গেল কোথায়??’
‘আমি তো এসে কাউকে দেখলাম না।’
আরাদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে বলল,’বোধহয় পালিয়েছে। বাদ দে,কি খবর বল??’
‘সবকিছু ঠিকঠাক এখন শুধু বোম ফাটানো বাকি!!’ বলেই হাসলো আকাশ। আরাদ ও হেসে বলে,’হুম,তবে বোমটা আমার মা আর কাকিমনির মাথায় ফাটাবো ভাবছি।’
আকাশ ফের হাসলো বলল,’বেশ হবে তাহলে। তোর ম মনে হয় এংগেজমেন্টের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে।’
আরাদ পকেটে হাত গুজে আকাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,’হুম,বাবাকেও বলেছি মায়ের কথামতো কাজ করতে পরে সব আমি ঠিক করে নেব। আর হ্যা ডিনার করে যাবি।’
‘সায়েনকে সবটা বলবি না??’
‘এখনো সময় আসেনি। সময় হলে সব বলব।’
নিজের রুমে বসে আছে সায়েন। একটু আগেই শাফিনের সাথে কথা হলো ওর। শাফিন বলছে কবে যাবে ওবাড়িতে। সায়েন কিছু একটা বলে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একথা তো আরাদকে কিভাবে জানাবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। কবিতা এসে ওকে খাইয়ে চলে গেছে। আর সকালে আসবে সে। সায়েন এপাশ ফিরে শুয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দে উঠে বসলো সায়েন। কিন্তু কে এসেছে তা সায়েন বুঝতে পারছে। ড্রিম লাইট ব্যততী আর কোন আলো নেই রুমে। এই আলোতেই সায়েনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরাদ। খাটের উপর সটান হয়ে শুয়ে পড়লো আরাদ। সায়েন ততক্ষণে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। হাঁটু মুড়ে বসে সে আরাদের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ বন্ধ করে আছে আরাদ। সায়েন আরাদের ভাবগতি বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। আরাদ সায়েনকে এক টানে নিজের পাশে শোয়ালো। একহাতে ভর দিয়ে সায়েনের দিকে ফিরে বলল,’তখন চলে আসার জন্য কি পানিশমেন্ট দেওয়া যায় তোমাকে বলো তো??’
‘আমি আর কখনোই আপনার রুমে যাব না। আমি জানতাম না যে ওটা আপনার রুম। তনয়া আমাকে,,,,’
আরাদ তার তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা সায়েনের ঠোঁটজোড়া আটকে দিলো। তারপর কন্ঠে কোমলতা এনে বলল,’ওটা তো তোমারও রুম।
সমস্যা কোথায় তাতে?? আমার কথা হলো তুমি আমার কথা অমান্য করে চলে এসেছো সেজন্য শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।’
সায়েন এবার ভয় পেলো। কি শাস্তি দেবে আরাদ??সায়েনকে এভাবে ভয় পেতে দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো আরাদ। বলল,’যতক্ষন পর্যন্ত আমার ঘুম না আসছে ততক্ষন পর্যন্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে তুমি এটাই তোমার শাস্তি। ইউর টাইম স্টার্ট নাউ।’
বলেই সায়েনের একহাত নিয়ে নিজের চুলে ডোবায় আরাদ। সায়েন ও বাধ্য মেয়ের মতো আরাদের চুল নিয়ে খেলতে লাগলো। একসময় সায়েন খেয়াল করলো যে আরাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। একহাত দিয়ে সায়েনের কোমড় আলতো করে জড়িয়ে রেখেছে। আরাদের হাত ছাড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ঘুমন্ত অবস্থায় আরাদকে একটা নিঃষ্পাপ শিশুর মতোই লাগছে। আসলে ঘুমালে প্রতিটা মানুষকেই নিঃষ্পাপ লাগে। কিন্তু আরাদকে একটু বেশি স্নিগ্ধ লাগছে সায়েনের কাছে। সে আরাদের কাছে এগোতে গিয়েও থেমে গেল। কেন যেন অদৃশ্য এক পিছুটান আটকে দেয় সায়েনকে। এভাবে যে কখন ঘুম পরীরা এসে সায়েনকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেল তা খেয়াল করলো না সায়েন। ঘুম থেকে উঠে আরাদকে দেখতে পেল না সায়েন। কখন উঠে চলে গেছে তা টের পায়নি। আড়মোড়া ভেঙে সায়েন ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
আরশ আর তনয়া বসে থাকতে থাকতে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। পঁচিশ মিনিট যাবত গাড়িতে বসে আছে দু’জন। ঘামে দু’জনেই অস্থির। ড্রাইভার তখন থেকে গাড়ি ঠিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পারছে না। হয়তো কঠিন কোন রোগ হয়েছে গাড়িটার। তনয়া গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলল,’চাচা আর দেখতে হবে না। গাড়িকে বড় কোন ডক্টর দেখান গিয়ে। আমি দেখছি কোন গাড়ি ম্যানেজ করা যায় কিনা!!’
আরশিও ততক্ষনে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। তখনই একটা বাইক এসে থামলো ওদের সামনে। বাইকের মালিক হেলমেট খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমরা এখানে??কোন সমস্যা??’
তনয়া হেসে বলল,’আসলে আকাশ ভাইয়া আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। একটু ড্রপ করে দেবে আমাদের??’
আকাশ দু’জনকে একবার পরখ করে দেখে বলল,’আচ্ছা চলো!!’
‘তুমি বরং আরশিকে নিয়ে যাও। দু’জন একসাথে বসলে সমস্যা হবে। আমি আমার এক বন্ধুকে আসতে বলেছি ও এখনই চলে আসবে।’
‘আচ্ছা তোমার বন্ধু আসুক তারপর নাহয় একসাথে যাব।’
তনয় পড়লো বিপদে। ও তো কোন বন্ধুকেই আসতে বলেনি। এখন কি হবে??আরশি তো অবাক হয়ে গেছে। কি হচ্ছে ওর মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ একটা বাইক আসতেই তনয় সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থামিয়ে দিলো বাইকটাকে। বাইকের মালিক কিছু বলার আগেই তনয়া বাইকে উঠে বসে আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল,’এইতো আমার বন্ধু এসে গেছে। তোমর যাও আমরাও যাচ্ছি। এই চল চল।’
বাইকের মালিক হেলমেট পরা তাই তনয়া ছেলেটাকে দেখতে পেল না। তনয়া ছেলেটাকে কিছু বলতে দিলো না। বারবার বাইক স্টার্ট দেওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলো। অগত্যা ছেলেটা বাইক স্টার্ট দিলো।
#চলবে,,,,,,,,
#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_২৮
প্রিয় মানুষটির কাছাকাছি আসার প্রথম অনুভূতি কতখানি ভালোলাগা কাজ করে তা বোঝানো সম্ভব নয়। এই অনুভূতি সে’ই বোঝে যে তার প্রিয় মানুষের কাছাকাছি প্রথম আসে। যা আজকে আরশি হারে হারে টের পাচ্ছে। আকাশের পেছনে বসে আছে সে। আর আকাশ বাইক চালাচ্ছে। আকাশের কাঁধে হাত রাখতে সংকোচবোধ করছিল আকাশ তা বুঝতে পেরে নিজেই আরশিকে বলেছে ওর কাঁধে হাত রাখতে যেন পড়ে না যায়। আরশি তখন খুশিতে চকচক করছিল। চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছিল। আকাশের কাঁধে হাত রেখে চুপচাপ সামনে থেকে আসা গাড়িগুলো দেখতেছে। কিছু কিছু খুশির মুহুর্ত গুলো ক্ষণিকের জন্য হয়। তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে চলে এলো ওরা। কিন্তু আরশি আরো সময় চাইছিল। পথটা যদি তাড়াতাড়ি না ফুরাতো কি এমন ক্ষতি হতো??মুখটা গোমড়া করেই সে বাইক থেকে নেমে পড়লো। আকাশ কোন কথা না বলেই চলে গেল। আরশি ভেবেছিল কিছু হয়তো বলবে আকাশ কিন্তু ওর আশায় এক বালতি পানি ঢেলে চলে গেল সে। আরশি ভাবছে কবে এই মানুষটা ওর মনের কথা বুঝবে?মনের কথা মনে চেপে রাখার যে কষ্ট যার হয় শুধুমাত্র সে’ই জানে।
আকাশ চলে যেতেই আরশি অপেক্ষা করতে লাগল তনয়ার জন্য। কার বাইকে চড়ে বসেছে কে জানে??একটু পরেই বাইকটা এসে থামলো আরশির সামনে। তনয়া বাইক থেকে নেমে মুচকি হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কস’
আরশিকে ইশারায় যেতে বলে নিজেও যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ওড়নায় টান পড়তেই পিছন ফিরে তাকালো। এবার সে ছেলেটার মুখটা দেখতে পাচ্ছে কারণ সে হেলমেট খুলে ফেলেছে। ছেলেটার এহেম কাজে ভারি অবাক হলো তনয়া। ছেলেটা ওড়না হাতে পেঁচিয়ে একটানে তনয়াকে কাছে টেনে নিলো। রেগে গেল তনয়া বলল,’কি অসভ্যতামি করছেন??ওড়না ধরছেন কেন??’
ছেলেটা হাত মুচড়ে ধরলো তনয়ার। ব্যথায় তনয়া ‘আহ্’ শব্দ করে উঠলো। ছেলেটা রাগি কন্ঠে বলল,’তোর সাহস কি করে হলো আমার বাইকে ওঠার?? আবার তখন অর্ডার করছিলি??’
আরশি আর তনয় অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।
‘আপনি তুই তুকারি করছেন কেন??ভদ্রতা সভ্যতা কি জানেন না?? মেয়েদের রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলতে শিখুন!!’
দমে গেল ছেলেটা তবে তা বুঝতে দিলো না। সে বলল,’রেসপেক্ট হাহ,শালার মেয়ে বলতেই ঝামেলা। কোন সাহসে আমার বাইকে বসলে??’
‘আপনি তখন বারন করতে পারলেন না?? এখন বলছেন??’
‘হুম!!তখন কিছু বলি আর ওই পুলিশ বেটা আমাকে ধরে নিয়ে যাক। ভালোই তো পেয়েছো তোমরা। তোমার জন্য আমার কাজের দেরি হয়ে গেছে। এখন টাকা বের করো।’
তনয়ার মাথা ঘুরছে কি বলছে ছেলেটা??টাকা বের করবে মানে কি??তনয়া রাগি গলায় বলে,’টাকা দেব কেন?? অসভ্য ছেলে কোথাকার!!আমি কোন টাকা দেব না। বাইকে করে নিয়ে এসেছেন বলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে নাকি??’
ছেলেটা কোন কথা না বলেই তনয়ার ব্যাগ টেনে নিয়ে চেক করতে লাগলো। তনয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়,কি করবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা ব্যাগ হাতরে পনেরশো টাকা পেলো। সে ব্যাগটা তনয়ার হাতে দিয়ে বলল,’ফকিন্নি, মাত্র পনেরশো টাকা নিয়ে ঘুরছো??তবে চলবে এতে। এরপর যদি আমার সামনে দেখি তো নাক ফাটিয়ে দেব।’
বলে সে বাইক স্টার্ট দেয়। ছেলেটা চলে যেতেই তনয়ার হুস ফিরলো। অনেকটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,’তোকে আরেকবার যদি সামনে পাই তাহলে খুন করে ফেলব বেয়াদব ছেলে।’
রাগে ফোস ফোস করছে তনয়া। আরশি ক্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল এবার সে মুখ খুলল,’দেখলি তো কি হলো??তুই যদি আকাশ ভাইয়ার সাথে আমাকে না পাঠাতি তাহলে এরকমটা হতো না। তুইও অপমান হতি না।’
তনয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে,’হুম!!যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর!!এরজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই। আর ওই ব্যাটাকে আরেকবার পাই বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।’
রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাসে চলে গেল তনয়া ওর পিছু পিছু আরশিও দৌড় দিলো।
ফুরফুরে মেজাজে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো ইফতি।ওর কয়েকজন ফ্রেন্ড আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। কঙ্খিত চেয়ারে বসে টেডি স্মাইল দিলো সে।
‘কি রে এরকম হাসছিস কেন??আজকে কাকে বোকা বানালি??’
টেবিলের উপর হাত রেখে ইফতি হেসে বলে উঠলো,’একটি মেয়েকে!! পনেরশো টাকা মেরে দিয়েছি। তবে এতে আমার আজকের দিনটাও চলবে না। দেখি কি করতে পারি। আম্মুর কাছ থেকে আনতে হবে। রাতের প্ল্যান কি?? আজকে আমার ডাবল ডোজ লাগবে কিন্তু??’
‘মামা,টাকা দিলে সব পাবে। দুনিয়া সে’ই রাজ করে যার টাকা বেশি।’
স্পিরিটের ক্যানে চুমুক দিয়ে হাসলো ইফতি।বড়লোক বাবার ছেলে সে। বড় ভাই ভাবি আর বাবা মায়ের সাথে থাকে সে। ভাইয়া বাবার বিজনেস দেখছে। আর ইফতি!!নাইট ক্লাব আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা ছাড়া কিছুই করে না সে। বাজে নেশাও করে। এরজন্য কয়েক বার থানায়ও গিয়েছে সে। আকাশের সাথে সে খুব ভালো ভাবেই পরিচিত। তাই তখন তনয়াকে কিছু বলেনি। হেলমেট পরা থাকায় আকাশ ও ইফতিকে চিনতে পারেনি। ছেলে উচ্ছন্নে উঠেছে দেখে ইফতির বাবা ওকে কোনরকম হাতখরচ দেয়না। এমনকি ইফতির ভাইও ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে যদি ইফতি ঠিক হয়। কিন্তু হচ্ছে উল্টো!!এতে ইফতি বিন্দুমাত্র বদলায়নি। নতুন ধান্দা শুরু করেছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা নেওয়ার ধান্দা। সেরকমই আজকে সে তনয়াকে পেয়েছে। তাই তনয়ার টাকা মেরে দিয়েছে সে। অবশ্য ইফতি ওর মায়ের থেকে টাকা নেয়। আর যে যাই করুক মা কখনো সন্তানের প্রতি কঠোর হতে পারে না। ইফতির মুখের দিকে তাকালেই তিনি পানির মতো গলে যায়। ছোট সন্তানকে তিনি আদরে আদরে বাঁদরে পরিণত করেছেন।
____________
গাড়ির জানালা দিয়ে সপ্তবর্নে আকাশ দেখে চলেছে সায়েন। বাসন্তি রঙের সুতি শাড়ি গায়ে জড়ানো তার। চুলগুলো খোপা করে রেখেছে। চুল খুলে রাখতে বলার কেউ যে নেই তার। যে সায়েনকে রাগি কন্ঠে বলবে তোমাকে খোলা চুলেই দারুন মানায়। অতঃপর সে আদুরে স্বরে বলবে চুলগুলো খুলে দিতে। আর সায়েন তার কথায় বাধ্য হবে খোপা খুলতে। কিন্তু একথা বলার কেউ নেই সায়েনের।এমনকি আরাদও নয়। সে কখনোই সায়েনের সাজগোজ নিয়ে কথা বলে না। সবসময় চুপচাপ থাকতেই দেখা যায় আরাদকে। আজকেও যখন বের হচ্ছিল সায়েন তখন আরাদের সামনে একবার পড়েছিল। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে আরাদ সায়েনকে যাওয়ার অনুমতি দেয়। নিজের পরিবারের সাথে দেখ করতে গিয়েছিল সায়েন। শাফিন রুহি আর ওর বাবার সাথে দেখা করে। শাফিন কিছুতেই সায়েনকে আসতে দিচ্ছিল না। অবশেষে ডিনার করেই আসতে দিলো সায়েনকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সায়েন আসতেই সে সায়েনকে নিয়ে গন্তব্যস্থলে রওনা হয়। আজকে বাবাকে দেখে খুব অবাক হয়েছে সায়েন। স্বাভাবিক ভাবেই আছেন তিনি। কিন্তু শাফিনকে অনেকটা উত্তেজিত হতে দেখেছে সায়েন। আরাদের সাথে কিছুতেই সে তার বোনকে মানতে পারছে না। মনের ভেতর ক্ষোভ জন্মেছে শাফিনের। কিন্তু শাফিন আর রুহিকে সুখি দেখে সায়েন মনে মনে খুশি হয়। তবে পরক্ষনেই সায়েনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ বিয়ের পর থেকে শাফিন ওর শ্বশুর বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করেছে। কিন্তু রুহিকে ওর বাড়ি যেতে অনুমতি দিয়েছে। রুহি যায়নি,নিজের পরিবারের এরকম কাজে রুহি নিজেই লজ্জিত। তাই সেও ওই পরিবারের কারো সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না। হয়তো পরে ঠিকই সবাই একদিন মিলে যাবে তবে সময়ের প্রয়োজন। সায়েন এবিষয়ে কোন কথাই বলেনি। ওদের ব্যাপার ওরাই ঠিক করুক।
গাড়ি থেমে গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু সায়েন এখনও অতীতের কিছু স্মৃতি বিচরণ করছে। ড্রাইভারের কথায় ধ্যান ভাঙল সায়েনের। শাড়ির আঁচল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো সে। দরজায় সে কবিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। কবিতা এখনও বাড়িতে যায়নি!!সায়েন বলল,’তুমি এখনও যাওনি??’
কবিতা মাথা নেড়ে বলল,’স্যার বলেছে আপনি না ফেরা পর্যন্ত থাকতে। চলুন আপনাকে রুমে দিয়ে আসি।’
কবিতার সাথে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে এলো সায়েন। তারপর সে কবিতাকে বলল,’আমরা প্রায় সমবয়সী। তুমি আমাকে তুমি করে ডেকো। আর নাম ধরেও ডেকো।’
সায়েনের কথায় আতংকিত দেখা গেল কবিতাকে। সায়েন কবিতার এরকম করার মানে বুঝলো। সে বলল,’তোমার স্যার কিছুই বলবে না। আমি ওনাকে বলে দেব।’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সায়েন চুড়িগুলো খুলতে লাগল। কিন্তু দুটো চুড়ি খুলেই সে থেমে গেল। ঘুরে কবিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমার ছেলের বয়স কতো??’
কবিতা মুচকি হেসে উওর দিলো,’দেড় বছর।’
‘আর তোমার হাজবেন্ড??’
‘গার্মেন্টসে চাকরি করেন উনি। আর আমার ছেলে শ্বাশুড়ির কাছে থাকেন।’
সায়েন ছোট্ট করে বলল,’ওহ’ তারপর সায়েন আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেল। কানের দুল খুলতে খুলতে সায়েন বলল,’আমি জানি তুমি তোমার হাজব্যান্ড কে খুব ভালোবাসো। আচ্ছা তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে কিরকম দেখতে পছন্দ করে??মানে কিরকম সাজে??শাড়ি না সালোয়ার, খোলা চুল নাকি খোপা,,,’
বলতে বলতেই সায়েনের চোখ যায় আয়নার দিকে। এতক্ষণ সে নিচের দিকে তাকিয়ে কানের দুল খুলছিল। হঠাৎ চোখ যায় আয়নার দিকে। থেমে যায় সায়েন। আয়নায় আরাদের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে পেছনে ঘুরে তাকালো সায়েন। উঁকি দিলো আরাদের পেছনে। সায়েনের দৃষ্টি অনুসরণ করে আরাদ একপলক পিছনে তাকিয়ে আবার সায়েনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসলো। আরাদ মৃদু হেসে বলল, ‘ভালোবাসার কোন সাজ হয়না সায়েন। ভালোবাসার ধরন হয়। সেই ধরন বোঝার ক্ষমতা সবার হয়না।’
সায়েন স্নিগ্ধ নয়নে তাকালো আরাদের দিকে। আরাদ আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো সায়েনের। একহাত দিয়ে সায়েনের খোঁপায় লাগানো ক্লিপ গুলো খুলতে খুলতে বলতে লাগলো,’তোমার সাজ নিয়ে কখনোই কোন অভিযোগ নেই আমার। কারণ সব সাজেই তোমাকে আমার কাছে মোহনীয় লাগে। নতুন নতুন সাজে তোমার মধ্যে নতুনত্বের স্বাদ পাই আমি। প্রতিদিন নতুন তুমিতে পরিচিত হতে আমার যে খুবই ভালো লাগে। এতে তোমার প্রেমে প্রতিদিন পড়ি আমি। এটা যে কতটা সুখানুভূতি সৃষ্টি করে তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না সায়েন!!আমি যে তোমার মধ্যে প্রতিদিন নতুন সায়েনকে খুঁজে চলি। কিন্তু সেই আগের সায়েনকে খুঁজে পাই না। সময়ের সাথে সাথে সেই সায়েন হারিয়ে গেছে। তবুও হাল ছাড়িনি আমি। আমি আমার আগের সায়েনকে চাই।’
আরাদের প্রতিটা কথার ভাজে কিছু অব্যক্ত অনুভূতি লুকিয়ে আছে যা ধরতে সায়েন অক্ষম। হয়তো ওর বোঝার ক্ষমতা নেই যেমনটা আরাদ বলেছিল। কিন্তু এই কথাগুলো যে সায়েনের বোঝা দরকার!! নাহলে আরাদের সাথে ওর দূরত্ব বাড়বে বৈ কমবে না। আরাদ ক্লিপগুলো নিয়ে পকেটে রেখে দিলো। সায়েন এতক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আরাদকে দেখলেও আরাদের শেষের কাজে কপাল কুঁচকে এলো সায়েনের। ক্লিপগুলো পকেটে রাখার কারণ কি হতে পারে??সায়েন তাই মুখ ফুটে প্রশ্ন করেই ফেলে,’ওগুলো পকেটে রাখলেন কেন??’
পকেটে হাত গুজে বাঁকা হয়ে দাড়িয়ে আরাদ বলল,’তোমার খোপা থেকে খসে পড়া গোলাপের পাপড়ি গুলো যত্নে রেখে দিয়েছি। তোমার খোলা চুলে আটকে থাকা কাঠগোলাপও সযত্নে ডায়রির ভাজে চাপা পড়ে আছে। এমনকি শুকনো বেশি ফুলের গাজরাটাও। তাহলে এগুলো নেওয়া নিছকই সারাধারন নয় কি??’
আরাদের প্রতিটা কথা সায়েনকে মুগ্ধ করে। এবারও তার বিপরীত হলো না। শান্ত দৃষ্টিতে সেই তাকিয়ে রইল আরাদের হাসিমাখা মুখটার দিকে। কেন সে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও পারছে না??কি এমন শক্তি আছে আরাদের??যা সায়েনকে এভাবে টানছে??নেশাক্ত সেই আকর্ষণ শক্তি। সায়েনের এরকম চাহনি দেখে হাসলো আরাদ। হালকা ঝুঁকে মাটিতে লুটিয়ে থাকা সায়েনের শাড়ির আঁচল উঠিয়ে বলল,’শাড়ির আঁচল এতো বড়ো রাখো কেন যদি সেই আঁচলে আমাকে বাঁধতেই না চাও??’
চমকে উঠলো সায়েন। আরাদের হাতের মুঠোয় থাকা শাড়ির আঁচলের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও আরাদের মুখের দিকে তাকালো। এতো মাদকতা কেন আরাদের কথায়?? পাগল করে দেয় সায়েনকে। মাঝেমধ্যে সায়েনের মনে হয় সুই সুতো দিয়ে আরাদের মুখটা সেলাই করে দিতে। যাতে এরকম নেশাক্ত গলায় কথা না বলতে পারে। সায়েন ঘোরের মধ্যে পড়ার আগেই কাবার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। ইচ্ছে করেই দেরি করে বের হয় সে। কিন্তু আরাদকে কোথাও দেখতে পায় না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয় সায়েনের। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।
পরেরদিন রেডি হয়ে বের হতেই নিলিমা বেগমের সাথে দেখা আরাদের। সবার সামনেই নিলিমা বেগম আরাদ আর সামিউক্তার এংগেজমেন্টের প্রস্তাব রাখেন। তবে আরাদের ভাবগতি কারো সুবিধার ঠেকলো না। আরাদ জবাব না দিয়েই বের হয়ে যায়। রাতে এসে ওর সিদ্ধান্ত জানাবে বলে যায় সে। সে আগ্রহেই ছেলের আসায় বসে থাকেন নিলিমা বেগম।
ভার্সিটির ক্লাস শেষে রেস্টুরেন্টে যায় আরশি তনয়া। দু’জনেই সামিউক্তাকে নিয়ে কথা বলছে। আরাদ এবার কি করবে তা নিয়ে আলোচনা করছে ওরা। সায়েনকে নিয়েও কথা বলছে দু’জনে। হঠাৎ কারো চিৎকারে সেদিকে তাকালো দুজে। রেস্টুরেন্টে বেশি মানুষ নেই। নেই বললেই চলে। তবে একটু পরেই মানুষের আনাগোনা বাড়বে। একটা ছেলে সার্ভেন্টের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধিয়েছে। কি নিয়ে ঝগড়া করছে তা জানার জন্য দু’জনেই ভালো করে মনোযোগ দিলো। তনয়া তো রিতিমত অবাক। এতো কালকের সেই বজ্জাত ছেলেটা। এখানেও ঝগড়া করছে দেখে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তনয়ার। ভাবলো আজকে ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিবে। তাই সে রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
#চলবে,,,,,,,,,