চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-৬+৭

0
387

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৬
_____________

জোহান এগিয়ে এলো মিতুলের কাছে। প্রায় এক হাতের মতো দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“এখানে কী করছো? একটু পর রাত নামবে, এখানে কী কাজ তোমার?”

মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে চাওয়া ছিল বড়োসড়ো একটা বোকামি। এখন এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কী করতো ও? নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে সারা রাত জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতো! বোকা মেয়ে! দিনের বেলায় ঢুকতে চাইলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু এই রাত্রি নামার ক্ষণে…
মিতুল চোখ তুলে জোহানের দিকে তাকালো। একটু আগে জোহানকে খানিক ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না। তবুও কেন যেন একটু ভয় লাগছে অবশ্য। জোহানের মুখে রাগের প্রলেপ নেই কোনো। গাম্ভীর্যের ছায়া দেখা যাচ্ছে একটু।
মিতুল মুহূর্তেই একটা কথা বানিয়ে বলে দিলো,
“আমি বনের ভিতরের গাছ গুলো দেখছিলাম। আর কিছুই নয়।”

“গাছ কেন দেখছিলে? যেকোনো একটা গাছ চূজ করে তার সাথে প্রেম করতে চাইছিলে বুঝি?” কথাটা বলে গাম্ভীর্য মুখে ফিচেল হাসি ফোঁটায় জোহান।

মিতুল খানিক রেগে বললো,
“কীসব বলছো? গাছের সাথে আবার প্রেম করে কীভাবে?”

জোহান হাসি থামিয়ে মিতুলের আরেকটু নিকটে এসে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে ছোট্ট(খাটো) মিতুলের সমানা হওয়ার চেষ্টা করে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“শোনো বেঙ্গলি মেয়ে! এই জঙ্গলে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। যাদের দেহ লোম দ্বারা আবৃত। যাদের আছে ধারালো বড়ো বড়ো দাঁত, বড়ো বড়ো নখ। যারা এক থাবায় তোমার বুক থেকে তোমার হৃদপিণ্ড বের করে আনতে পারে। বুঝেছো? তোমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকেছে আমার কথাগুলো?”

মিতুলের আত্মা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। হিংস্র প্রাণীতে ওর ভয় লাগছে কি না জানে না, তবে জোহান যেভাবে বললো, তাতে ভয়ের তীব্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে ছিল। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। জোহানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জোহানকে এড়িয়ে দ্রুত পদে এগোতে লাগলো ঘরের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্যও নিজের গতি থামালো না।
এতটা দ্রুতই নিজের রুমে দিকে ছুটছিল যে, প্যাসেজ ওয়েতে বেখেয়ালে জায়িনের সাথে ধাক্কা লাগলো।
জায়িনের হাতে কিছু ফাইল পত্র ছিল, যা পড়ে যায় ফ্লোরে। মিতুল তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।
জায়িন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হয়তো এত দ্রুত পদে ওর ছোটার কারণ ভাবছে সে। মিতুল জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত ফ্লোর থেকে ফাইলগুলো উঠিয়ে দিলো। স্যরি বললো জায়িনকে।

জায়িন কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে, নিজের ফাইল নিয়ে নিচে নেমে গেল।
মিতুল পিছন থেকে মুখ বাঁকালো। ইশ, এমন একটা ভাব করে যেন, রাজার ছেলে রাজপুত্র এসে গেছে। মিতুল আবারও একবার ভেংচি কেটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

_____________

রাত নামার কিছুক্ষণ পরেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। উড়ে উড়ে পড়ছে শত সহস্র কুচি কুচি বরফদানা। কৃত্রিম আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করা এই রাত এবং শান্ত, ধীর গতিতে উড়ে উড়ে পড়া তুষারপাত, দুই মিলে পরিবেশ করছে এক অনন্য রাজ্য।
বসন্তের তুষারপাত উপভোগ করতে মানুষ এখন নিজেদের ঘর ছেড়ে বাইরে পদার্পন করেছে। গায়ে জড়িয়েছে পুরু উষ্ণ কাপড়।
রাস্তায় কিছু বাচ্চা ছেলে, মেয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। রাস্তায় অল্প অল্প করে জমতে থাকা বরফে বাচ্চাগুলো পা আটকে পড়ে যাবে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা হয় না। তারা দিব্যি দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে।
মিতুল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মন হারাচ্ছে অজানা, অচেনা মুগ্ধতায়। জীবনে এই প্রথম কাছ থেকে স্নো ফল দেখা। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে তুষার ছুঁয়ে দেখছে নীরবে। তুষারের ঠান্ডা পরশে একটু আধটু শিহরণ আঁকছে মনে।

জোহান দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুটা দূরত্বে। সেলফি, ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। একটা ছেলে জোহানকে ছবি তুলতে সাহায্য করছে।
মিতুল অবশ্য এ কাজটা আগেই শেষ করেছে।

জায়িন বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবার ভাব মূর্তি লক্ষ্য করছে সে। কিন্তু তার দিকে কারো বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।

রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে গিয়েছেন। আর একটু হেঁটে বামে বাঁক নিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবেন দুজনে।

সবাই যখন নিজ নিজ ভাবে ব্যস্ত, তখন মিতুল মনে মনে একজনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে। চোখের পর্দায় আলতো করে ভেসে উঠছে এক জোড়া ধূসর চোখ। যে চোখের গভীরতায় সাঁতার কেটে বেড়াতে ইচ্ছা করে মিতুলের। মিতুল কল্পনা করছে, ও এবং ওর প্রিয় ধূসর চোখের মানুষটি একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে। পাড়ি দিচ্ছে তুষার জমা পথ। আশপাশ জনমানবহীন। কেবল ওদের অনুভূতির সাক্ষী হয়ে ঝরছে মিহিদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কণিকা।

তুষার মানব তৈরি করার কাজে হাত লাগিয়েছে জোহান। ওকে ছবি তুলতে সাহায্য করা ছেলেটাও তুষার মানব তৈরিতে সহায়তা করছে।
বড়ো আকারের একটা গোলাকৃতির তুষারখন্ড এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে জোহান। বড়ো খন্ডটার উপর আরেকটা ছোট গোলাকৃতির খন্ড বসাতে হবে এরপর। সেটা তৈরিতে এখন জোরদার কাজ চালাচ্ছে। একের পর এক বরফ কণিকার আস্তরণ উল্টে-পাল্টে মেখে ছোট খন্ডটি তৈরি করে ফেললো। তারপর সেটাকে বড়ো খন্ডটির উপরে বসিয়ে দিলো।
ছোট খাটো একটা তুষার মানব তৈরি হয়েছে। সাফল্যের হাসি হাসলো জোহান। এরই মধ্যে ওর চোখ গেল কল্পনা বিমোহিত অন্যমনস্ক মিতুলের উপর। মিতুলকে দেখে জোহানের মনে দুষ্টুমির ভাবনা উদয় হলো। দুই হাতে রাস্তা থেকে কিছু তুষার তুলে নিলো, এবং তা ছুঁড়ে মারলো মিতুলের মুখ বরাবর।
আকস্মিক এমন ঘটনায় মিতুল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। বেরিয়ে আসলো ওর কল্পনা জয়ী রাজ্য থেকে।
মিতুলের অবস্থা দেখে জোহান হাসতে হাসতে শেষ। পারলে এই বরফ জমা রাস্তাতেই লুটোপুটি খায় অবস্থা। এমন ভাবে হাসছে যেন এরকম মজা সে আগে কখনো পায়নি।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের প্রতিটা শিরা উপশিরায় রাগের তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজন থাকায় মিতুল মুখে কিছু বললো না। মনে মনে হাজারও কথা শুনিয়ে নিজের তুষ্টি মেটালো।
জোহান রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতুলের রাগে ফুলো নাকটা লক্ষ্য করলো। যা দেখে ওর হাসি আরও বেড়ে গেল।

জোহানের উপর কিছুটা রাগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জায়িনের মাঝে।
মিতুলের মুখে জোহানের তুষার ছুঁড়ে মারাটা একদমই ভালো লাগেনি জায়িনের। কেন এত খারাপ লাগলো ঠিক জানে না! কিন্তু এতটাই খারাপ লেগেছে যে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে ও। জায়িন সত্যি সত্যি আর এখানে দাঁড়ালো না। তুষার জমা রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যেতে লাগলো। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে এখন। ফ্রেডি অনেক আগেই ফোন করে ডেকেছিল ওকে। ‘এখনই আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়েও কেন যেন তখনই নিজের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি জায়িন। কিছুক্ষণ বাড়ির সামনেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছিল।

_______________

মিতুল বেড রুমের বিশাল আকৃতির উইন্ডোটি মেলে দিলো। উইন্ডোর গ্লাসে কুচি কুচি বরফ জমে আছে। বাইরে এখন নীরব পরিবেশ। স্নো ফল থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মোবাইলে মায়ের মিসড কল উঠে আছে। মিতুলের কল ব্যাক করতে ইচ্ছা করছে না। মিতুল কল ব্যাক করলো না। পরে মা ফোন দিলে, ফোন ধরতে না পারার কোনো একটা কারণ দাঁড় করিয়ে দেবে। মিতুল গায়ের জ্যাকেটটা খুলে রেখে বিছানার নরম তুলতুলে কোলে গা ভাসালো।
মিতুলের মনে একটা জেদ চাপলো। কালকে যে করেই হোক সেই রেস্টুরেন্টে যাবে ও। না, রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। খাওয়ার ছুতো দিয়ে সেই ধূসর চোখ জোড়াকে একবার দেখতে যাবে। একা যাওয়া যায়। কিন্তু একা গেলে ব্যাপারটা কেমন হবে? না, একা যাবে না। রেশমী আন্টির সাথে…না রেশমী আন্টির সাথে যাবে না। জোহানের সাথে যাবে। ওর সাথেই তো গিয়েছিল আগের বার। ওর সাথে আরেক বার ওখানে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না ও। জোহান অহংকারী, বদমাইশ হলেও, তার পাশাপাশি একটু আহাম্মকও আছে।
হ্যাঁ, কালকে জোহানের সাথেই যাবে সেই রেস্টুরেন্টে।
মিতুলের হঠাৎ খুশি খুশি লাগছে। লজ্জাও লাগছে একটু। প্রথম কাউকে মনে ধরেছে ওর। আর এমন একজনকে মনে ধরেছে যাকে চেনেই না। সামান্য নামটা পর্যন্তও জানা নেই। ইশ, কে ভেবেছিল যে এমন করে কারো প্রেমে পড়বে! মিতুল লজ্জায় নিজের মুখ লুকালো দু হাতে। শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভেবে গেল কেবল ধূসর চোখ জোড়াকে।
এরপর উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগছে। মিতুলের মনে হচ্ছে, ও আগের চেয়ে একটু সুন্দর হয়েছে। আসলেই কি সুন্দর হয়েছে? না কি মনে তৈরি হওয়া সদ্য রঙিন অনুভূতির জন্য সবকিছু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছে? কোনটা?
মিতুল কাঁধ বেয়ে একটু নিচ ছুঁয়ে যাওয়া অদীর্ঘ চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। শুকনো ঠোঁট লিপ জেলে ভেজালো। কণ্ঠে তুললো গুনগুন করে বাংলা গানের সুর। বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খুলে চুলগুলো বেঁধে নিলো সযতনে। তারপর দরজা টেনে রুম থেকে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আপন মনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সিঁড়ির প্রান্তে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে জোহানের কক্ষ থেকে মিষ্টি গিটারের সুর ওর চলন থামিয়ে দিলো। গিটারের সুর বরাবরই ভালো লাগে ওর। মিতুলের মনে পড়লো কালকে রাতের কথা। কালকে রাতে জোহানকে গার্ডেনে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাতে দেখেছিল।
জোহান যে গিটার বাজানোয় দক্ষ, সেটা বুঝতে পেরেছে মিতুল। আচ্ছা, জোহান কি গান টান করে না কি?
জোহানের রুমের দরজা একটুখানি ফাঁকা। মিতুল উঁকি দিলো। রুমের ভিতর সোনালী আলোক রশ্মিতে জোহানকে দেখা যাচ্ছে। একমনে অনবরত গিটার বাজাচ্ছে ও। খুবই শান্ত একটি সুর বাজছে ওর গিটারে। একটুখানি ফাঁকা জায়গা দিয়ে মিতুল তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।

জোহানের গিটারে চালিত হাত দুটো হঠাৎ থেমে যায়। কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে,
“লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গিটার বাজানো দেখছো কেন?”

মিতুল চমকে গেল। কী করে বুঝলো যে এখানে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে? মিতুল প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“কী করে বুঝলে যে আমি এখানে আছি?”

জোহান গিটার রেখে উঠে আসে। একটুখানি ফাঁকা থাকা দরজাটা খুলে ফেলে সম্পূর্ণ।
গাম্ভীর্যের সাথে বললো,
“চুপিচুপি আমাকে লক্ষ্য করা ব্যাপারটা আমি খুব অপছন্দ করি। কখনো করবে না আর।”
বলে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

মিতুল তাড়াতাড়ি পিছন থেকে বললো,
“একটা কথা ছিল তোমার সাথে।”
আর মনে মনে বললো,
“এই অহংকারী ছেলে, নিজেকে কি রাজপুত্র ভাবো তুমি? চুপি চুপি না হয় একটু তাকিয়ে থেকে তোমার গিটার বাজানোই দেখছিলাম। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে?”

জোহান বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার সাথে? কী কথা আমার সাথে?”

মিতুল ভাবছে কালকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথাটা এখনই বলে দেবে।
মিতুল খানিক ইতস্তত করে বললো,
“কালকে আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে?”

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৭
_____________

সকাল সকাল বাড়িতে এক অপরিচিত মুখের আগমন ঘটেছে। অচেনা মুখের ব্যক্তিটির নাম ফ্রেডি। জায়িনের বন্ধু হয়। ছেলেটাকে খুব একটা ভালো লাগেনি মিতুলের। কেমন যেন ছেলেটা! ঠিক কেমন সেটা বোঝাতে পারবে না। ছেলেটা নিজ থেকে পরিচিত হতে এসেছে মিতুলের সাথে। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে মিতুলের দিকে।
মিতুলের হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখানে হ্যান্ডশেক না করাটা হয়তো অভদ্রতার সহিত দেখা হয়। মিতুল যখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য কেবল হাত উঠাতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে কোত্থেকে যেন উদয় হলো জোহান। ঝড়ের গতিতে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য ফ্রেডির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করলো জোহান। ফ্রেডিকে বুকে টেনে নিয়ে, পিঠে জোরে কয়েকটা চাপড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“হেই ব্রো, হোয়াট’স আপ?”

জোহানের এমন আগমনে অবাক ফ্রেডি, অবাক মিতুলও।
জোহান এত শক্ত করে ফ্রেডিকে ধরে রেখেছে যে, ফ্রেডি ব্যথা অনুভব করছে। তাছাড়া জোহানের চাপড়গুলোও ছিল আক্রমণাত্মক। ফ্রেডি দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জোহানের থেকে। মুখে এক টুকরো বাধ্য হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“এইতো ভালো। তোমার কী খবর?”

জোহানের মুখ থেকে চঞ্চল বুলি ফুঁটলো,
“আমি তো একটি শান্তিপ্রিয় ছেলে। সব সময় ভালোই থাকি।”

“তা যদি ভালোই থাকো, তাহলে মুখের ওই দাগগুলো কীসের?”

মিতুল জোহানের মুখের দিকে তাকালো। জোহানের মুখে এখনও মারের দাগ আছে। সেদিনের মতো গাঢ় নেই, হালকা হয়ে গেছে। জোহানকে মারলো কে, সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না ও। কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছে না। কথাটা কে কীভাবে নেবে ও জানে না।

জোহান নিজের ঠোঁটের কোণে ক্ষত স্থানটা স্পর্শ করে বললো,
“আরে ব্রো, জানোই তো এগুলো স্বাভাবিক আমার সাথে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে গিয়ে বসবে চলো।”
জোহান এক হাত দিয়ে ফ্রেডিকে টেনে নিয়ে যাওয়া দিলে, ফ্রেডি হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,
“জায়িনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে ওর সাথে। এই ফাইলটা নেওয়ার ছিল শুধু, পেয়ে গেছি এটা। সুতরাং বসবো না। আমার ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। যেতে হবে আমার। আসছি আমি। পরে দেখা হবে আবার।”
মিতুলকে লক্ষ্য করে বললো,
“আশা করছি তোমার সাথেও দেখা হবে আবার।”

জোহান এবং মিতুল দুজনের দিকে তাকিয়ে দু বার ‘বাই’ জানালো ফ্রেডি। তারপর দ্রুত পায়ে একরকম পালিয়ে যাওয়ার মতো করে চলে গেল।

মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফ্রেডির চলে যাওয়ার দিকে। এমন করে চলে গেল কেন ফ্রেডি? জোহানকে নিশ্চয়ই পছন্দ করে না? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। এই জোহান এমন যে, মানুষ এড়িয়ে চলে ওকে?

মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোহান বললো,
“হোয়াট? এমন করে দেখছো কেন?”

“কেন, তোমাকে দেখলেও এত সমস্যা?” কথাটা বলে ঘরের দিকে হাঁটা দিলো মিতুল।

_______________

জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে। গাড়ির ভিতর ভীষণ নীরবতা। ড্রাইভিং সিটে বসে রোবটের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছে জোহান। আজকে গান-টানও ছাড়েনি।
কিন্তু মিতুলের এই সময় গানের খুব প্রয়োজন ছিল। জোহানকে এখনও সেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি মিতুল। ঠিক কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। অনেক ভেবে টেবে বলার একটা রাস্তা বের করলো। জোহানকে প্রথমে সহজ গলায় বললো,
“আমরা কি একটা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি?”

জোহান অবাক হয়ে একবার মিতুলের দিকে তাকালো। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“কেন? রেস্টুরেন্টে কী কাজ আমাদের?”

“আমি ক্ষুধার্ত। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি আমার। যখন ব্রেকফাস্ট করতে যাব, ঠিক তখনই দেখলাম তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ। তাই ব্রেকফাস্ট না করেই তোমার সাথে দৌঁড় দিতে হলো আমার।”
মিথ্যা বলেছে মিতুল। ব্রেকফাস্ট করেছে ও। রেশমী আন্টি নিজের সাথে বসিয়ে রেখে ব্রেকফাস্ট করিয়েছে ওকে। কিন্তু এখন মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। যে করেই হোক আজকে সেই রেস্টুরেন্টে যেতেই হবে।

জোহানকে কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বলতে শোনা গেল,
“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা দেখছি আসলেই কোনো কাজের না। ঠিক আছে, তোমাকে এডমন্টনের সেরা একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করাবো আজ। বলো কোন রেস্টুরেন্টে যাবে? আমার মনে হয়, আমাদের লা রোনডে’তে যাওয়া উচিত। ওখানের খাবার বেশ ইয়াম্মি হয়।”

মিতুল বাগড়া দিয়ে বললো,
“কেন? আমাদের সেখানে যেতে হবে কেন? আমরা তো সেদিন যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, সেখানেও যেতে পারি। সেটাও তো একটা সেরা রেস্টুরেন্ট।”

জোহান ভ্রু কুঁচকে সন্দ্বিগ্ন চোখে তাকালো।
“হঠাৎ করে সেখানে যেতে চাইছো কেন? কাহিনী কী?”

জোহানের চাহনি দেখে মিতুলের মনে হলো জোহান ওর মনের কথা সব পড়ে ফেলবে। এই জোহানকে যতটা আহাম্মক মনে করেছিল, আসলে ততটা আহাম্মক নয় সে। কিন্তু মিতুলও কম চালাক নয়। মুহূর্তেই একটা মিথ্যা বুঝ দিয়ে দিলো,
“আসলে সেই রেস্টুরেন্টের পিরি পিরি প্রন্সটা সুস্বাদু ছিল খুব। সেই খাবারের স্বাদটা আরেকবার নিতে চাইছি আমি। এর আগে যত খেয়েছি, ওই রেস্টুরেন্টের মতো এত টেস্ট ছিল না তাতে।”

মিতুলের কথা ঠিক বিশ্বাস হলো না জোহানের। তবুও মিতুলের কথা মেনে নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টের পথ ধরলো।
মিতুলের বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খেয়াল হলো জোহানের। জোহান অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“এটা কি হেয়ার রাবার না? হেয়ার রাবার হাতে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন তুমি?”

মিতুল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওহ! এটা? আসলে কী বলো তো, মাঝে মাঝে আমি না খুব গরম অনুভব করি। আর গরমে আমি একদমই খোলা চুলে থাকতে পারি না। সে জন্যই এটা সাথে নিয়েছি। যখন তখন গরম লাগলে যেন নিজের চুল বেঁধে ফেলতে পারি।”
মিতুলের মনে হলো ও বানিয়ে বানিয়ে ভালোই কথা বলতে পারে। মনে মনে ফিচেল হাসলো মিতুল।

রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেছে। মিতুলের মনে উত্তেজনা, উদ্দীপনার ঝড় বইছে। রেস্টুরেন্টে পদার্পণ করেই মিতুলের আঁখি সেই ধূসর চোখ জোড়াকে দেখার পিপাসায় মরিয়া হয়ে উঠলো। এদিক থেকে ওদিক খুঁজে চোখ জোড়া অবশেষে শান্ত হলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। ওইতো সে…
একটা টেবিলে খাবার সার্ফ করছে ধূসর চোখের মানুষটি। মিতুলের মনে আনন্দঘন মেঘের আনাগোনা চলছে। শরতের আকাশে থাকা সাদা পেজা তুলোর মতো গাঢ়, ঘনত্ব সেই মেঘ। ছেলেটিকে লক্ষ্য করতে করতেই জোহানকে অনুসরণ করে মধ্যম সারির একটা চেয়ারে জায়গা করে নিলো মিতুল। এখনও ধূসর চোখাকে দেখে চলেছে চুপি চুপি। সেদিনের মতো একজন ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য এগিয়ে এলো।
জোহানের এখন খাওয়ার মুড নেই, তাই শুধু চিজ কেক অর্ডার করলো। অর্ডার করে মিতুলের দিকে তাকাতে দেখতে পেল, মিতুলের ধ্যান-জ্ঞান কিছুই এখন এই টেবিলে নেই। ওর ধ্যান-জ্ঞান সব কিছু এখন ওই দূরে কোথাও নিবেদিত। জোহান মিতুলের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। রেস্টুরেন্টের একটা স্টাফের উপর চোখ আটকে গেল ওর। ছেলেটা একজন কাস্টমারের সাথে হেসে হেসে কিছু বলছে। জোহান মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের চোখে মুগ্ধতার গভীর নলকূপ।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে জোহান ভীষণ চমকালো। ও একবার মিতুলকে দেখছে আর একবার ওই ছেলেটিকে। জোহানের বুঝতে বাকি রইল না মিতুলের এখানে আসার আসল কারণ কী! জোহানকে একই সাথে বিরক্তি এবং রাগে চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত বোধ হচ্ছে ওর। এই নাকফুলো মেয়েটা সত্যিই…
জোহান নিজের বিরক্তি, রাগকে সামাল দিয়ে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই মিতুল!”

জোহানের ডাকে ধূসর চোখাকে দেখার অশান্ত তৃষ্ণার্ত মনকে জোহানের দিকে স্থির করতে হলো মিতুলের।
“হ্যাঁ, কী হয়েছে?”

জোহান জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“পিরি পিরি প্রন্সের স্বাদ নিতে এসে, এখানে আবার কোন মধুর স্বাদে হারিয়ে গেলে? অর্ডার করবে না কিছু?”

“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ…” মিতুল অযথা একবার মেনু কার্ড হাতে তুলে নিয়ে এক ঝলক দেখে বললো,
“আমি পিরি পিরি প্রন্স এবং কোল্ড ড্রিঙ্কস চাই।”

ওয়েটার হালকা মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
মিতুলের মন এখন আর এই টেবিল অথবা জোহানকে ঘিরে থাকতে চাইছে না। ওর মন এখন ধূসর চোখার দিকে। ওর চোখও বার বার চলে যাচ্ছে তার উপর।
জোহান কিছু বলছে না, বিরক্ত মনে শুধু মিতুলকে দেখছে। এই মেয়েটা এত পাগল সেটা আগে জানা ছিল না ওর।

খাবার চলে আসে। মিতুল খাচ্ছে সেটা ঠিক, কিন্তু ওর মন পড়ে আছে ধূসর চোখের পিছনে। খাওয়ার পাশাপাশি শুধু চুপিসারে তাকেই দেখে গেল। এত ভালো লাগে কেন তাকে?
কখনো সেই ধূসর চোখের মানুষটা সদৃশ্যমান হচ্ছে চোখের সামনে, আবার কখনো বা হারিয়ে যাচ্ছে।

খাওয়া শেষ হয়ে গেল। এবার যেতে হবে। মিতুলের যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এখানে পার্মানেন্ট থাকার তো কোনো উপায় নেই! মিতুল ব্যথিত মন নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্য জোহানের পিছু পিছু দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে গেলে কেউ একজন পিছন থেকে ডেকে উঠলো। কণ্ঠটা পরিচিত লাগলো মিতুলের। মিতুল তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল।
মিতুলের সামনে হাঁটতে থাকা জোহানও থেমে যায়।
মিতুল পিছনে ফিরে যা দেখলো তা আশা করেনি। দেখলো ওর প্রথম প্রেম, মানে সেই ধূসর চোখা ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
মিতুল অগাধ বিস্ময় এবং সেই সাথে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। ভালোবাসার কিছু রঙিন প্রজাপতি মিতুলের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
ছেলেটা একেবারে মিতুলের সামনে এসেই থামলো। মিতুলকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“তুমি সেই মেয়ে না? যাকে হেয়ার রাবার দিয়ে সাহায্য করেছিলাম আমি?”

ছেলেটার কণ্ঠ মিতুলের মনে শিহরণ বইয়ে দিলো। যে মানুষটাকে এতক্ষণ চুপি চুপি দূর থেকে দেখছিল, সেই মানুষটা এখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে! খুব কাছ থেকেই দেখছে তাকে। মিতুল মনে মনে বললো,
“আহ, আমার প্রথম প্রেম!”

জোহানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। মিতুলের চুলের দিকে চাইলো ও। মিতুল খাওয়ার আগে নিজের চুল বেঁধে নিয়েছিল হাতের সেই রাবার দিয়ে। তাহলে এই রাবার এই ছেলে দিয়েছে? আর সে জন্যই তাহলে এটা হাতে পরে রাখা!

ছেলেটা আবার বললো,
“সেদিন তোমার সাথে পরিচিত হওয়া হয়নি। ভেবে রেখেছিলাম এরপর তোমার সাথে আবার দেখা হলে পরিচয় পর্বটা সেরে নেবো। আমি কার্ল জোনাস।”

মিতুল যেন বসন্তের হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে এখন। আহা! আজকের দিনটা এত সুন্দর কেন? ধূসর চোখার নাম শুনেও মিতুলের অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। নামটা যে খুব বেশি সুন্দর তা নয়। কিন্তু এই নাম মিতুলের আজ পর্যন্ত শোনা সব নামের থেকে শ্রেষ্ঠ এখন। মিতুল মিষ্টি হেসে, মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি মিতুল দিলরাবা।”

“মি…মি…হোয়াট?” কার্ল মিতুলের নাম উচ্চারণ করতে পারলো না মোটেই।

মিতুল আবার কার্লের বোধগম্যতার জন্য বললো,
“মি…তুল দিল…রা…বা।”

“রা…রাবা?” কার্ল কোনো রকম উচ্চারণ করলো। তারপর নামটাকে কয়েকবার মনে মনে আওড়িয়ে বললো,
“তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি কি তোমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারি?”

মিতুল ভাবতে লাগলো, কেন ওকে সবাই মিতুল বলে ডাকে? এই রাবা নামটা কেউ কখনো বের করতে পারলো না কেন? এই রাবা ডাকটা কী সুন্দর! ওর নাম মিতুল দিলরাবা না হয়ে শুধু রাবা হলে কত ভালো হতো! এই ডাক এত মিষ্টি কেন? মিতুল প্রশস্ত হেসে বললো,
“অবশ্যই তুমি আমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

কার্লও একটু হাসলো।

জোহান এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সব সহ্য করছিল। কিন্তু কেন যেন আর পারলো না। মিতুলকে টেনে পিছনে এনে, নিজে কার্লের সামনে এসে দাড়ালো। চওড়া হেসে কার্লের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো,
“হাই ব্রো, আই অ্যাম জোহান।”

কার্ল উজ্জ্বল হেসে বললো,
“ওহ, নাইস টু মিট ইউ।”

জোহান একটু মাথা দোলালো। তারপর বললো,
“আসলে আমরা ব্যস্ত মানুষ। এত ডিটেইলসে পরিচিত হওয়ার সময় আমাদের নেই। আসছি আমরা। তুলতুল লেট’স গো।”

কথাটা শেষ করে জোহান মিতুলের একহাত শক্ত করে চেপে ধরলো। কাউকে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে না দিয়ে, মিতুলকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে এলো।

________________

“তুমি এটা কেন করলে?” ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে ক্ষুব্ধ গলায় প্রশ্ন করলো মিতুল। রাগে ফুঁসছে ও। রেস্টুরেন্ট থেকে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। জোহানের এমন বেয়াদবি মিতুলকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারছে না।

“কী করেছি আমি?” নির্বিকার ভাবে জানতে চাইলো জোহান।

মিতুল গর্জে উঠলো,
“আমাকে কী মনে হয় তোমার? আমি কি তোমার পোষা প্রাণী? একটা পাবলিক প্লেস থেকে তুমি আমার হাত ধরে টেনে আনলে কেন ওভাবে? আমাকে কি তোমার হ্যান্ডব্যাগ মনে হয়? কী মনে করো কী তুমি নিজেকে? রাজপুত্র? না কি স্বয়ং রাজাই ভাবো নিজেকে? কী মনে করো, এটা তোমার রাজ্য? আর আমি তোমার রাজ্যের অসহায় একজন প্রজা? যার উপর উঠতে বসতে শাসন চালাবে তুমি?
শুনে রাখো একটা কথা, যদি তুমি নিজেকে রাজাই ভেবে থাকো, তাহলে তোমার ওই চিন্তা চেতনাকে রাজার দাস বানাতেও সময় লাগবে না আমার। অহংকারী বদমাইশ কোথাকার!
আর হ্যাঁ, কার্লের সাথে এমন বাজে বিহেভ কেন করলে তুমি? হ্যাঁ? কেন করলে?” চাপা গর্জন করে উঠলো মিতুল।

রাগে দপদপ করা শিরা এবার সত্যিই জ্বলে উঠলো জোহানের। রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেগে ব্রেক কষলো। সিট বেল্ট বাঁধা থাকা সত্ত্বেও বড়ো সড়ো রকমেরই একটা ধাক্কা অনুভব হলো।
জোহানের এহেন কারবারে মিতুল অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলো।
জোহান সামনে স্থির দৃষ্টি রেখে, চোয়াল শক্ত করে বললো,
“বেরিয়ে যাও।”

“কী?”

“সহজ কথা বুঝতে পারছো না? গেট আউট অফ মাই কার!”

জোহান মিতুলের দিকে একটু ঝুঁকে এক হাত দিয়ে মিতুলের পাশের দরজাটা খুলে দিলো। রাগে জোহানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে।

দু চোখে জ্বালা, বুক ভর্তি ঘৃণা আর রাগ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল মিতুল। তারপর নিজের আত্মসম্মান নিজের কাছেই গুটিয়ে রেখে, রাগ এবং জেদকে প্রধান্য দিয়ে ফট করে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
মিতুল বেরিয়ে যেতেই জোহান দরজাটা টেনে বন্ধ করে নিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল বহুদূর।

মিতুল অদৃশ্যপ্রায় গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অপমান, রাগে শরীর থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। এই জোহান এত খারাপ, এত খারাপ, এত খারাপ যে তার প্রমাণ আজ ভালো করে পেল। এই কদিনে মনে হয়েছিল জোহান একটু ভালো হয়েছে। কিন্তু না, ভালো তো দূরের থাক বরং আরও বেশি পাজি শয়তান হয়েছে।
রেস্টুরেন্টে কার্লকে ইনসাল্ট করে, ওকে টেনে নিয়ে আসলো! কার্লের সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে দিলো না! এখন আবার মাঝপথে এত বড়ো অপমান করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো!
আজকে জোহানের সাথে বাইরে বের হওয়া ছিল জীবনের আরও একটা সবথেকে বড়ো ভুল। একারই বের হওয়া উচিত ছিল।
মিতুল এই মুহূর্তে একটা শপথ নিলো, যে কদিন এই কানাডায় আছে তার মধ্যে একদিনও ওই অহংকারী ফ্যামিলির কারোর সাথে বাইরে বের হতে চাইবে না। বিশেষ করে ওই জোহানের সাথে। বয়কট করলো আজ থেকে জোহানকে! বয়কট জোহান!

(চলবে)