চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-১৮+১৯

0
340

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৮
____________

বোর্ডেন্স পার্ক। এই পার্কটি এডমন্টন সিটি এক্সিবিশন সেন্টারের সামনে অবস্থিত। পার্কের আরেক পাশে রয়েছে নর্থল্যান্ড ফার্ম। যেখানে গ্রীষ্ম কালে বিভিন্ন ধরণের সবজির চাষ করা হয়। পার্কের ভিতরে নানা ধরণের ভাস্কর্য রয়েছে। যার কারণে অন্যান্য পার্ক থেকে এটা আলাদা। পুরো পার্কটি সবুজের চাদরে ঢাকা। ভিতরে হাঁটার জন্য আলাদা ওয়াকওয়ে রয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা প্লে-গ্রাউন্ড। মর্নিং বা ইভিনিং ওয়াক করতে করতে মানুষজন ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার বেঞ্চির অভাব নেই। এই পার্কে সারি সারি পাইন গাছ এবং ঝাউ গাছ লক্ষ্যনীয়। মিতুলের খুব একটা ভালো লাগেনি পার্কটি। আর ভাস্কর্য দেখতে তো ওর কোনো কালেই ভালো লাগে না। তবে কার্ল সাথে থাকায় ভালো না লাগলেও, অধিক ভালো এই পার্কটি ওর কাছে।
কার্ল এবং ও ওয়াকওয়েতে হাঁটছে। এখন বিকেল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ পাইন গাছ অতিক্রম করে মুখমন্ডলে এসে পড়েছে। কালকে ওরা ভ্যাংকুভার চলে যাচ্ছে বলে, আজকে বিকেলে রেস্টুরেন্টে কার্লের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তখন কার্ল ছুটি নিয়ে বাইরে ঘুরতে এলো ওকে নিয়ে।
মিতুল কার্লকে যতই দেখছে, ততই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কী ভালো ছেলেটা! ভীষণ মিশুক। কথাও বলে খুব সুন্দর করে। মিতুলের ইচ্ছা করে কার্লের কথা রেকর্ড করে নেয় মোবাইলে। যেমনি ছবি তুলে নিয়েছিল গোপনে, তেমনি করে কথাও রেকর্ড নিতে ইচ্ছা করছে। চাইলেই পারে রেকর্ড করতে। কিন্তু কেন যেন করছে না।
মিতুল কার্লকে দেখতে দেখতে হেঁটে চলছে। কার্ল ওকে এই পার্কটি সম্পর্কে বলছে অনেক কিছু। কিন্তু সেসব শোনায় ওর মনোযোগ নেই। ও কার্লকে দেখার মনোযোগে হারাচ্ছে।
হঠাৎই কার্লের দৃষ্টি ওর উপর পড়লো। একদম চোখে চোখ। মিতুল থমকে যায়। চোখ সরিয়ে নেয় কার্লের থেকে। লজ্জা লাগছে ভীষণ। বেহায়া মেয়ের মতো কীভাবে দেখছিল কার্লকে, ইশ! মিতুলের নিজের কাছেই কেমন যেন লাগলো।

কার্লের মোবাইলে রিং হতে, মিতুল আবার তাকালো কার্লের দিকে। কার্ল হেসে কল রিসিভ করেছে। মোবাইলটা কানের সাথে ধরেই বললো,
“হাই!”

ওপাশের কলার কিছু একটা বলার পর কার্ল বললো,
“নো, আমি রেস্টুরেন্টে নেই। পার্কে আছি। এক ফরেইনার ফ্রেন্ডকে পার্ক ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। শি ইজ ফ্রম ব্যাংলাডেশ।”

ওপাশের কলার কিছু একটা বললো। কার্ল বললো,
“ও কে ও কে আই উইল কাম। জাস্ট পনেরো মিনিট লাগবে আমার।
হ্যাঁ, আসছি আমি। ও কে বাই!”

কার্ল কল কেটে দিলো। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আই অ্যাম সো স্যরি রাবা! আমাকে এখন চলে যেতে হবে। আমার খুব স্পেশাল একজন মানুষ আমার সাথে মিট করার জন্য ডাকছে। সুতরাং আমাকে যেতে হচ্ছে। আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি যে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারছি না।”

কার্লকে এভাবে বলতে দেখে মিতুলের খারাপ লাগলো। মিতুল বললো,
“ইট’স ও কে। তোমার যেতে হলে তুমি যাও। এখানে এমন করে বলার কিছু নেই। আমি আরও কিছুটা সময় ঘুরে বাসায় চলে যাব।”

কার্লকে কিছুটা প্রফুল্ল হয়ে বলতে দেখা গেল,
“যার সাথে আমি দেখা করতে যাচ্ছি, তার সাথে তোমাকেও একদিন মিট করাবো। আশা করছি তুমি তাকে ভীষণ পছন্দ করবে।”

কার্ল একটু মিষ্টি করে হেসে চলে গেল। কতদূর গিয়ে আবার পিছন ফিরে বললো,
“বাই রাবা! শীঘ্রই দেখা হবে তোমার সাথে।”

মিতুল একটু হাসলো। কত বিনয়ী ছেলে কার্ল। প্রয়োজনীয় কাজ আছে বলে চলে যেতে হবে, সে জন্যও কত সুন্দর করে বোঝালো ওকে।
আর ওদিকে জায়িন, জোহানকে দেখো। ওই দুই ভাইয়ের তো অহংকারেই মাটিতে পা পড়ে না। চলে যাওয়ার সময় সূক্ষ্ম একটু বিদায়ও জানাতো না ওরা। মিতুল মনে মনে দুই ভাইয়ের প্রতি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করলো।
তারপর আবার কার্লের কথা ভাবলো। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কার্ল? কে সেই স্পেশাল মানুষ? খুবই ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু না কি?

______________

ভ্যাঙ্কুভার।
কিছুক্ষণ হলো মিতুলরা ভ্যাঙ্কুভার ল্যান্ড করেছে। নতুন শহরের নতুন বাতাসই যেন মিতুলের মনে উদ্দীপনার ঢেউ তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েছে বেশি সময় হয়নি। মাত্রই ট্যাক্সিতে উঠেছে। ওর দু চোখ ছুটছে বাইরের পরিবেশ দেখতে।
ওর পাশে রেশমী আন্টি বসা। রেশমী আন্টির পাশে জায়িন। সাদাত আঙ্কল সামনে বসেছেন। ট্যাক্সি থ্রি-স্টার হোটেল রেডিসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ দিনের জন্য ভ্যাঙ্কুভার আছে ওরা। ওর স্বপ্নের ভ্যাঙ্কুভার!

মাত্র বারো, তেরো মিনিটের মধ্যে হোটেলের সামনে এসে ট্যাক্সি থামলো। এখানে আরও অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা। সব কিছু শৃঙ্খল। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখেই মিতুলের মুগ্ধতার শেষ রইল না। অনেক বড়ো হোটেল। আকাশের নীলের বুকে পেজা তুলোর মতো সাদা রঙের মেঘের ভেলা যেন হোটেলের গায়ে জড়িয়ে আছে। হোটেলটা গ্লাসে আবৃত। গ্লাসে আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুঁটে রয়েছে। হোটেলটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে, আকাশের নীল সাদা আবির মেখেই বাইরের দিকটা তৈরি করা হয়েছে। মিতুল মুগ্ধতার বশে নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,
“ওয়াও!”

বাইরের মুগ্ধতা শেষ হলে এবার ভিতরের মুগ্ধতায় ডোবার সময়।
এই হোটেলে দুটো রুম বুক করেছে ওরা। রুমে দুটো করে বেড। এক রুমে থাকবে ও এবং রেশমী আন্টি। অপর রুমে থাকবে সাদাত আঙ্কল এবং জায়িন।
মিতুল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখছে। রুম বেশ ভালোই বড়ো। বেড দুটোও বড়ো আছে। একেকটা বেডে দুইটা বালিশ। দুই বেডের পাশে দুটো ল্যাম্পশেড নিয়ে, মোট চারটি ল্যাম্পশেড আছে রুমে। রুমের এক সাইডে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা একটা ওয়ার্ডোব। ওয়ার্ডোবের উপরের দেয়ালে একটা টিভি।
একটা কাউচও আছে। রয়েছে তিনটা ফুলদানিও। দেয়ালে আছে কয়েকটা পেইন্টিং টানানো। রুমের সাথেই ওয়াশরুম। মিতুল ওয়াশরুমটাও দেখে নিলো। ওয়াশরুমটাও পছন্দ হয়েছে ওর।
রুমের দেয়াল জুড়ে আছে বিশাল আকৃতির গ্লাস উইন্ডো। ঠিক যেমন করে রেশমী আন্টিদের বাড়িতেও আছে। উইন্ডোর সামনে একটা আর্মচেয়ারও রাখা।
মিতুল উইন্ডোর দিকে এগিয়ে গেল। উৎসুক দৃষ্টি রাখলো উইন্ডোর বাইরে। দুপুরের রোদে বাইরের পরিবেশটা ঝকঝকে পরিষ্কার।
এখন ফ্রেশ হবে। ফ্রেশ হয়ে হোটেলটা ঘুরে দেখবে। শুনেছে এই হোটেলে ইনডোর পুলও আছে।

লাঞ্চের পর রেস্ট নিয়ে সবাই মিলে কুইন এলিজাবেথ পার্কে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। এমন কথা হয়েছিল বাড়িতে বসেই, যে যেদিন ভ্যাংকুভার যাবে, সেদিন বিকেলে কুইন এলিজাবেথ পার্কে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু লাঞ্চ করার সময় রেশমী আন্টি বললেন, তার এবং সাদাত আঙ্কলের রিচমন্ডে এক বন্ধুর বাসায় কী একটা কাজ আছে। তারা যেতে পারবে না পার্কে। জায়িনের সাথে একা যেতে বললো ওকে। মিতুলের একা একা জায়িনের সাথে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বসন্তের ভ্যাঙ্কুভারের অপরূপ সৌন্দর্যে মাতোয়ারা রাশি রাশি চেরি ব্লসমে পরিপূর্ণ রাজ্য দেখার জন্য, ওর দু চোখ পিপাসার্ত হয়ে আছে। গোলাপি এবং সাদা চেরি ব্লসমের মধ্যে, সাদা চেরি ব্লসম বেশি প্রিয় ওর। এখানে অনেক সাদা চেরি আছে।

মিতুল একটু আগে ভাগেই জায়িনের সাথে বেরিয়ে পড়লো। এখান থেকে এলিজাবেথ পার্ক মাত্র সতেরো আঠারো মিনিটের পথ। ট্যাক্সিতে যাচ্ছে বলে কম সময়। বাসে গেলে এর থেকে একটু বেশি সময় লাগতো। আর হেঁটে গেলে আড়াই ঘণ্টার মতো।
ট্যাক্সি নিজ গতিতে এগিয়ে চলছে পার্কের উদ্দেশ্যে। মিতুল উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর দু চোখ বিমোহিত, মুগ্ধ! চেরি ব্লসম! ওর প্রিয় চেরি ব্লসমের রাজ্য এই ভ্যাঙ্কুভার।
এডমন্টনে যে চেরি ব্লসম দেখেছিল, ভ্যাঙ্কুভারের চেরি ব্লসমের কাছে তা কিছুই নয়।
রাস্তার দুই পাশেই সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেরি ব্লসম ট্রি। প্রত্যেকটা গাছ ফুলে ভরপুর। পাপড়ি ঝরে পড়ে আছে নিচে। এখানে রোদ দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার দুপাশের ফুলে ভরপুর চেরি গাছগুলো উপর থেকে মিলে ছাউনির মতো হয়ে, রাস্তাকে রোদ থেকে আড়াল করে রেখেছে একেবারে। কী অপরূপ এই দৃশ্য! দুই চোখ জুড়িয়ে যায় মুগ্ধতার কলকাতানে!
মিতুলের হঠাৎই কেন যেন জোহানের কথা মনে পড়ে গেল। জোহানকে মনে পড়ার রহস্যটা ও নিজেও বুঝতে পারছে না। জোহানের কনসার্ট রাতে। একটা আমেরিকান ব্যান্ডের সাথে। মিতুল ভাবছে, কেমন পারফর্ম করবে জোহান? ভালোই করবে নিশ্চয়ই। মিতুলের এই প্রথম মনে হলো, জোহান সাথে আসলে ভালো হতো।
জোহানের চিন্তা এখানেই থামিয়ে দিলো মিতুল। কুইন এলিজাবেথ পার্কে এসে গেছে ওরা।
ব্রিটেনের রানি কুইন এলিজাবেথকে সম্মাননা দেওয়ার জন্যই এই পার্কের নাম কুইন এলিজাবেথ পার্ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই পার্কটি লিটল মাউন্টেন নামের একটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। পার্কটির আয়তন প্রায় ১৩০ একর।

মিতুল লক্ষ্য করলো অনেক অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা। এমনিতেই বসন্ত চলছে, তার উপর আজকে আবার ছুটির দিন। পার্কে যেন ভিড় একটু বেশিই। অনেককেই দেখা যাচ্ছে পার্কে ঘোরাঘুরি করতে। গাড়ি পার্ক করে রাখা রাস্তার পাশে আরও একটি সরু রাস্তা রয়েছে। মিতুল জায়িনের পিছন পিছন সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। একটু হাঁটতেই বাম সাইডে দেখলো চার পাঁচটা মতোন চেরি ব্লসম গাছ। গাছের নিচ ছায়া সুনিবিড়। জায়িন রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সবুজ ঘাসে মোড়ানো জমিনে পা রাখলো। মিতুলও জায়িনের পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। ।হাঁটতে হাঁটতে চেরি ব্লসম ট্রির নিচে এসে গেল ওরা। অনেক মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছে। হাসাহাসি করছে। ছবি তুলছে।
মিতুল দেখতে পেল গাছের তলাতে অনেক চেরি পাপড়ি পড়ে আছে। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে চাইছিল মিতুল। কিন্তু জায়িন থামলো না। মিতুল জায়িনের সাথে সাথেই হাঁটতে লাগলো। কয়েক পা হেঁটে এসে দেখতে পেল এখানে একটা রাস্তা। গাড়ি চলছে। মানুষ জনও হাঁটছে। রাস্তার ওপাশেই আরও অনেকগুলো চেরি ব্লসম গাছ। মিতুল লক্ষ্য করলো পার্কটার এখানে সেখানে অনেক চেরি ব্লসম গাছ আছে। যেগুলো পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে তুলনামূলক ভাবে বেশি। মিতুল মোবাইল বের করে দ্রুত কয়েকটা ছবি তুলে নিলো চেরি ব্লসমের। সেলফিও তুললো।
জায়িন মিতুলের ছবি তোলার ব্যাপারটি লক্ষ্য করলো।
জায়িন একটা ব্যাপারে ভেবে পাচ্ছে না যে, ও গাইডের খাতায় নাম লেখালো কবে? আর গাইড হিসেবে এত উন্নতিও বা করলো কবে? মমের কি সেরা গাইড হিসেবে ওকেই চোখে পড়ে? মম কেন বার বার মিতুলকে একা ওর সাথে ঘুরতে পাঠিয়ে দিচ্ছে? কাউকে এখানে ওখানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো খুব বেশি বিরক্ত লাগে ওর। আর মিতুলের সাথে তো ও ঠিক ফ্রি হয়েই চলতে পারে না। উহ, আজকেই ড্যাড, মমের কেন ড্যাডের ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হলো? আজকে সবাই মিলে একসাথে ঘোরাঘুরি করলে হতো না?

নিরিবিলি রাস্তা ধরে কিছুটা দূর হেঁটে আসতেই যেন পার্কের চেহারা বদলে গেল। রাস্তার পাশে পাশেই দেখা যাচ্ছে এখন রং বেরঙের ফুল। টিউলিপ ফুল এর মাঝে বিশেষ। যতই হাঁটছে, ততই পার্কের গভীরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে মিতুলের।

পার্কটা ঘুরে দেখতে দেখতে মিতুলের যা মনে হলো তা হলো, একে একটি পাহাড়ি ফুলের বাগান বললে মন্দ হবে না। কারণ, পুরো পার্কটিতে প্রায় শতাধিক রকমের ফুলের গাছ আছে। ফুলের গাছ ছাড়াও এখানে অনেক প্রকার বৃক্ষ আছে। বৃক্ষের অভাব নেই এই পার্কে। নিজ নিজ সৌন্দর্য নিয়ে একেকটা বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। হাইকিং করতে করতে হাঁপিয়ে গেলে বসার বেঞ্চির কোনো অভাব নেই। এখানে সেখানে বসার জন্য অনেক বেঞ্চি আছে। চাইলে গাছের ছায়ার নিচে বসেও বিশ্রাম করা যাবে।
এখানে ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডসদের নিয়ে পিকনিকও করা যাবে। কারণ, পার্কের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো ওপেন স্পেস রয়েছে, যা সবুজের চাদরে মোড়ানো। পাহাড়ি এই পার্কটির একদম ওপরে একটি গম্বুজ আকৃতির কাঁচের তৈরি ভবন দেখা যায়। এটি মূলত একটি কন্সারভেটরি। যেখানে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ এনে সংরক্ষণ করা হয়। এটা অনেকটা গ্রিন হাউজের মতো। যাতে এখানকার তীব্র শীতকালীন আবহাওয়াতে গাছগুলো বেঁচে থাকতে পারে। যেখানে এই কন্সারভেটরির অবস্থান, তার অপর পাশ থেকে পুরো উত্তর ভ্যাংকুভার শহর দেখা যায়।
পাহাড়ি এই পার্কটির নিচে একটি রোজ গার্ডেনও রয়েছে। যেখানে গ্রীষ্মকালে নানান রঙের ফুটন্ত গোলাপ দেখা যায়। এই রোজ গার্ডেনের পাশেই রয়েছে একটি গলফ কোর্স, কয়েকটি পিকনিক স্পট এবং বাচ্চাদের জন্য একটি প্লে গ্রাউন্ড।

পার্কে ঘুরতে ঘুরতে রাত নেমে এসেছে। পুরো পার্কটি দেখে মিতুলের মনে হলো কুইন এলিজাবেথ পার্ক সৌন্দর্যে অনন্য একটি জায়গা। পার্কের ভিতরের ঝর্ণাটা মিতুলের সেই রকমের পছন্দ হয়েছে।

____________

রেডিসন হোটেলকে দিনের বেলা যতটা না সুন্দর লেগেছিল, তার থেকে অনেক গুণ বেশি সুন্দর লাগছে রাতে। চারিপাশে কেবল আলোর ছড়াছড়ি।
মিতুল কিছুক্ষণ লবিতে ঘোরাঘুরি করে রুমে চলে এলো।
রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল এখনও হোটেলে ফেরেননি।
মিতুল মোবাইলে জোহানের পারফর্ম দেখলো এইমাত্র। ভিডিয়োটা জোহানই পাঠিয়েছে। পারফর্ম কেমন হয়েছে জানাতে বলেছে।
মিতুল প্রথমে কিছুই লিখতে চায়নি। কিন্তু পরে ভাবলো, জোহানকে একটু উৎসাহ দেওয়া দরকার। যদিও জোহানের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই-ই বোধহয় ওকে উৎসাহ দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে। কনসার্টের ভিডিয়ো ছাড়াও আরও একটা ভিডিয়ো পাঠিয়েছে জোহান। যে ভিডিয়োটা ওর ফ্রেন্ডসদের সাথে। যাতে দেখা গেল ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের বেশির ভাগই ওর সাথে উইনিপেগ গিয়েছে। ভিডিয়ো টাতে মিতুলকে সবাই হাই, হ্যালো জানিয়েছে। মিতুলের মনে হলো ওদের বন্ধুত্ব খুব বেশি গাঢ়।
মিতুল জোহানের প্রশংসা করে লিখলো,
‘সুন্দর পারফর্ম ছিল। আশা করি ভবিষ্যতে আরও বেশি ভালো করবে। এবং নিজের স্বপ্নটাও পূরণ করে ফেলবে দ্রুত।’

ম্যাসেজটা পাঠানোর একটু সময় পরই জোহান কল করলো। মিতুল বিরক্ত হলো। জোহানের সাথে ফোনে কথা বলার একদমই ইচ্ছা নেই ওর। তাছাড়া আগে কখনো ফোনে কথা বলেনি জোহানের সাথে। প্রথম ফোনে কথা বলতে ওর অস্বস্তি হবে। মিতুল কলটি কেটে দিতে চাইছিল। কিন্তু কী ভেবেই আবার রিসিভ করলো।
“হ্যালো!”

ওপাশে জোহানের আহ্লাদী কণ্ঠ শোনা গেল,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?”

“শুয়ে আছি।” মিতুলের মোটেই জানতে ইচ্ছা করছিল না, জোহান কী করছে। তবুও জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী করছো?”

“আমি? আমি ক্লাবে আছি। শব্দ শুনে বুঝতে পারছো না?”

“তো ক্লাবে বসে মজা করো। আমাকে কেন ফোন করেছো?”

জোহান মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। উল্টো নিজেই প্রশ্ন করে বসলো,
“আজকে সারাদিন তুমি আমাকে খুব মিস করেছো নিশ্চয়ই, তাই না?”

জোহানের এমন প্রশ্নে মিতুল হকচকিয়ে গেল। একটু একটু মনে পড়ছিল জোহানকে। কিন্তু অতটা না। মিতুল বললো,
“তোমাকে কেন মিস করবো? তোমাকে আবার মিস করার কী আছে?”

“মিস করার কিছু নেই বলছো?”

“হ্যাঁ, কিছুই নেই।”

“ঠিক আছে। মিস করার কিছু আছে কি নেই সেটা পরে দেখবো। কোন হোটেলে উঠছো তোমরা?”

“কেন তুমি জানো না? হোটেল তো আগে থেকেই বুকিং করা ছিল।”

“জানলে কি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করতাম?যেখানে আমি যাব না, সেখানকার খবর রাখার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“তাহলে এখন আবার জিজ্ঞেস করছো কেন কোন হোটেলে আছি? তুমি এসব জেনে কী করবে?”

“জেনে কী করবো মানে? আমার মম, ড্যাড, ব্রাদার সবাই ওখানে আছে। এখন সেটা জানাও কি দোষ আমার? বললে কী হবে? আমি কি ভ্যানকুভার গিয়ে তোমাকে কিডন্যাপ করে উইনিপেগ নিয়ে আসবো?”

“কে জানে তুমি কী করো।”

“কোন হোটেলে আছো?”

“রেডিসন।”

“রেডিসন? এয়ারপোর্টের কাছাকাছি? তোমরা একটা থ্রি-স্টার হোটেলে গিয়ে উঠেছো? কেন ফাইভ-স্টার, ফোর-স্টার হোটেলের কি অভাব পড়েছিল?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মেজাজ খারাপ হলো। বললো,
“হ্যাঁ, এখানে হোটেলের অভাব পড়েছে। বসন্ত চলছে তো এখন, সব দর্শনার্থীদের ভিড় এখানে। উইনিপেগে তো নিশ্চয়ই এত ভিড় নেই। তা তুমি কত বড়ো হোটেলে আছো? টেন-স্টার হোটেলে আছো না কি?”

“টেন স্টার হোটেল থাকলে সেখানেই উঠতাম। ছাড়ো সেসব। জানো তো মিতুল, এখানে এসেছি প্রায় বিশ মিনিট হলো। সেই থেকে লক্ষ্য করছি একটা মেয়ে নানা ভাবে আমার আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি কিন্তু মেয়েটাকে দেখছি চুপি চুপি। ভালোই লাগছে মেয়েটাকে। মেয়েটা সেই রকম সুন্দর। লম্বাও অনেকখানি। আমার মতোই। মেয়েটা যে কী সুন্দর তোমাকে বোঝাতে পারব না। যদিও এরকম মেয়ের চলাচল আমার আশেপাশে অহরহ। দিনে ষাট, সত্তর সুন্দরী মেয়ের প্রপোজ আসে আমার কাছে। তবুও এই মেয়েটাকে কেন যেন একটু আলাদা মনে হচ্ছে সবার থেকে। তোমার কী মনে হয়? মেয়েটাকে কি বুঝতে দেওয়া উচিত, যে আমি ওর উপর আকৃষ্ট?”

“তুমি আমার কাছে জিজ্ঞেস করছো কেন এসব? তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো। আজকেই মেয়েটার সাথে সকল কথাবার্তা ফাইনাল করে, কালকেই ডেটে চলে যাও। তোমাকে তো আর কেউ এই বিষয়ে বাধা দেবে না। তুমি তো নিজের ইচ্ছা স্বাধীন ভাবে চলো। এ বিষয়ে তো তুমি মুক্ত স্বাধীন। তোমার যা ইচ্ছা তাই…”

মিতুল পুরো কথা শেষ করলো না। তার আগেই ফোন কেটে দিলো। কারণ, জোহানের সাথে কথা বলার মাঝেই কার্লের কল এসেছে। মিতুলের চোখে ব্যাপারটা পড়তেই টুপ করে জোহানের ফোন কেটে দিলো। কার্লের কল আসার পরও জোহানের সাথে কথা বলে কে?
মিতুল কার্লের কাছে কল ব্যাক করলো।

____________

ব্রেকফাস্ট টাইম।
হোটেলের রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বসেছে ওরা। রেশমী আন্টি এখনও উপস্থিত হননি। মিতুল সাদাত আঙ্কল এবং জায়িনের সাথে বসে আছে। এখানে আরও অনেকে ব্রেকফাস্ট করছে। মিতুলদের অর্ডার দেওয়া শেষ। খাবার এসে পৌঁছয়নি এখনও।
মিতুল নীরব বসে আছে। একটা চামচ নাড়াচাড়া করছে। জায়িন বসে বসে মোবাইল ঘাটছে। সাদত আঙ্কলও তাই। মিতুলের কাছে মোবাইল থাকলে মিতুলও এখন তাই করতো। কিন্তু বোকার মতো মোবাইলটা রুমে ফেলে এসেছে। ধ্যাত ভালো লাগছে না।
মিতুল যখন নিজের বিরক্তিকর প্রহরগুলো গুনছিল, ঠিক তখনই শুনতে পেল দূর থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ ডেকে উঠেছে ওকে। মিতুল থমকে গেল। বাতাসের বুক চিরে দুটো শব্দ ওর কানকে নাড়িয়ে দিলো।
আর সেই শব্দ দুটি হলো,
“হেই তুলতুল…”

মিতুল চকিতে শব্দ অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টের প্রবেশ দরজায় তাকালো। যা দেখলো, তা ছিল ওর জন্য বিস্ময়কর। দেখতে পেল দরজায় জোহান দাঁড়ানো। জোহানের গায়ে কালো রঙের হুডি। হুডির ভিতর থেকে সাদা রঙের গেঞ্জি উঁকি দিচ্ছে। মাথায় হুডি টানা, পরনে কালো জিন্স। হাতে লাগেজ ধরা। মিতুলের ধারণা ও নির্ঘাত ভুল দেখছে। যে জোহান উইনিপেগ, সেই জোহানকে কী করে ও এই ভ্যাঙ্কুভার দেখতে পারে? এ অবশ্যই চোখের ভ্ৰম!

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৯
____________

জোহান ড্যাড, ব্রাদার এবং মিতুলের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তোমরা সবাই ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?”

মিতুল ফ্যাল ফ্যাল করে জোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না জোহান ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেবলই চোখের ভুল। কিন্তু জায়িনের কণ্ঠ ওর ভুলকে সত্য করে দিলো। জায়িনকে বলতে শুনলো,
“তুই এখানে মানে? কীভাবে কী?”

মিতুল জায়িনের দিকে তাকালো। এটা কেবলই ওর চোখের ভুল হলে তো জায়িন জোহানকে দেখতে পেত না। তবে কি জোহান সত্যিই এসেছে? কিন্তু জোহান তো উইনিপেগ ছিল। কালকে রাতেও জোহানের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। তখন ও উইনিপেগ ছিল। তাহলে আজ এই সকালে কী করে ও ভ্যাঙ্কুভার থাকতে পারে? মিতুল নিজের বিস্ময়গ্রস্ত চোখ জোড়া আবারও জোহানের উপর নিক্ষেপ করলো।

সাদাত আঙ্কল বললেন,
“আমি নয়, দশ মিনিট আগেও তো তোমাকে কল করেছিলাম। তোমার সাথে কথা হলো তো আমার। কই? তখন তো তুমি বললে না যে তুমি ভ্যাঙ্কুভার এসেছো!”

জোহান প্রশস্ত হেসে বললো,
“সারপ্রাইজ ড্যাড!”

মিতুল নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,
“সাংঘাতিক সারপ্রাইজ দাও তুমি।”

জোহান মিতুলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
তারপর খালি চেয়ারটায় নিজের আসন করে বললো,
“তোমরা তিনজন কেন? হোয়্যার ইজ মাই মম?”

জোহানের প্রশ্নের উত্তর দিলো না কেউ। সাদাত আঙ্কল জিজ্ঞেস করলেন,
“কয় টার ফ্লাইটে এসেছো?”

“ড্যাড, উইনিপেগ থেকে ভ্যাংকুভার এত সকালে তো একটা ফ্লাইটই আছে। সকাল সাড়ে ছয়টার ফ্লাইটে এসেছি।”

খাবার এসে গেছে টেবিলে। জোহান মাথার হুডি ফেলে দিলো। ব্রাউন হেয়ার গুলো মুক্ত শ্বাস নিচ্ছে এখন। জোহান চামচ দিয়ে এক টুকরো অমলেট মুখে পুরে নিলো।

মিতুলের কেমন বিব্রত বোধ হচ্ছে। সত্যি সত্যি জোহান এসেছে? হ্যাঁ, আসলে আসুক। ওর তো কিছু না তাতে। কিন্তু এসে প্রথমে ওকেই কেন ডাকতে হলো? তাও আবার আসল নাম ধরে না। নামকে ব্যঙ্গ করে তুলতুল বলে ডাকলো। সবার সামনে বসে কীভাবে এরকম ভাবে ব্যঙ্গ করতে পারলো ওকে? কমনসেন্স নেই কোনো ওর? বদমাইশ একটা!

রেশমী রেস্টুরেন্টে এসেই থমকে গেলেন। এই ভ্যাঙ্কুভারের রেস্টুরেন্টে ওদের সাথে জোহানকে বসা দেখবে, এ তো সে কল্পনাও করতে পারেননি। রেশমী দ্রুত এগিয়ে এলেন।
“তুমি এখানে কী করে এলে জোহান?”

জোহানের মুখ ভর্তি খাবার। মমের দিকে তাকিয়েই হেসে দিলো ও। মুখের খাবার টুকু শেষ করে বললো,
“হাই মম!”

“তুমি তো উইনিপেগ কনসার্ট করতে গিয়েছিলে, তাহলে এখানে কেন তুমি?”

“অবুঝের মতো প্রশ্ন কেন করছো মম? আমি উইনিপেগ কনসার্ট করতে গেলে, এখানে আসতে পারি না? আমি এসেছি উইনিপেগ থেকে। আমার কনসার্ট তো কালকেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি তোমাদেরকে খুব মিস করছিলাম। কালকে রাত থেকেই তোমাদের ভীষণ মনে পড়ছিল আমার। তাই ভাবলাম চলে আসি তোমাদের কাছে। তাই একেবারে সকালের ফার্স্ট ফ্লাইটটা ধরে চলে আসলাম। তোমাদের যে খুব মিস করছিলাম, থাকতাম কী করে তোমাদের ছাড়া?”

জোহান আবার খাবারের দিকে মনোনিবেশ করলো। কেউ খেতে পারছে না ওর এমন আকস্মিক আগমনের জন্য। সবার বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। অথচ ওকে দেখো, ও একেবারে স্বাভাবিক।

জায়িনের কাছে জোহানের কথা একেবারে পানসে লাগলো। ওদের মিস করছিল বলে চলে এসেছে? এ তো অসম্ভব! জায়িনের কেন যেন মিতুলের দিকে চোখ চলে গেল। তারপর আবার জোহানের উপর। জায়িন বললো,
“সিরিয়াসলি? মিস করছিলি বলে চলে এসেছিস? এত দ্রুত গতিতে? হঠাৎ করে এত মিস করার কারণ কী? যে মিস এতগুলো বছরের মাঝে একটা বছরও করলি না, সেই মিস হঠাৎ এ বছর কেন করলি? হঠাৎ করে আমাদের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেল কবে তোর?”

জায়িনের কথা শুনে জোহানের খাওয়া থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকলো ও। তারপর দ্রুত মুখের খাবার টুকু গিলে বললো,
“ব্রাদার, মানুষের মন হলো মোমের মতো। এটা কখন জ্বলবে, কখন গলবে, কে বলতে পারে সেটা? হঠাৎ করে আমার মন তোমাদের জন্য গলে উঠলো। ব্যস, চলে আসলাম আমি।”

জোহান মমের দিকে তাকালো। চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বললো,
“মম, প্লিজ সিট ডাউন। নতুন করে আবার খাবার অর্ডার করে নিয়ো। যেহেতু এই খাবারটা আমি এটো করে ফেলেছি!”
জোহান ড্যাডের দিকে তাকালো। বললো,
“ড্যাড, আমাদের রুম নাম্বার কত?”

সাদাত রুম নাম্বার জানিয়ে, চাবি দিলেন ছেলেকে। জোহান আবার মাথায় হুডি টেনে দিয়ে, লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

জোহান বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, জায়িন কেন যেন আবার তাকালো মিতুলের দিকে।
___________

মিতুল করিডোর দিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটছে। পুরো খাবার শেষ না করেই চলে এসেছে ও। খেতে পারছিল না। জোহান সবার মাঝে বসে ওকেই কেন প্রথম ডেকে উঠলো, সেটাই ওর মাথা ব্যথার কারণ। এটা কেমন ব্যাপার হলো সেটাই বুঝতে পারছে না। সবাই এটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও, ও নিতে পারছে না। আর তাই খেতেও পারলো না শান্তি মতো। এই জোহান ওর শান্তি বিনষ্ট করে দিতে এসে গেছে। কাল মনে হয়েছিল জোহান এখানে আসলে ভালো হতো। কিন্তু এখন মনে হয় না যে ভালো হয়েছে। মনে হয় না যে আর শান্তিতে থাকতে পারবে এখানে।
মিতুল আরও কয়েক পা হাঁটতেই দেখলো জোহান দাঁড়িয়ে আছে রুমের সামনে। সাদাত আঙ্কল এবং জায়িন যে রুমে থাকে, সেই রুম পেরিয়ে ওপাশে ওদের রুম। জোহানের এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটি ভালো লাগলো না মিতুলের। মনে হচ্ছে যেন ওর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল জোহানকে অতিক্রম করে যাওয়া দিলেই, জোহান এক হাত সামনে বাড়িয়ে বাধা দিয়ে বললো,
“দাঁড়াও।”

মিতুল থেমে গেল।

জোহান বললো,
“তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস করছো কীভাবে? এত সাহস তুমি দিনকে দিন পাচ্ছ কোত্থেকে? তুমি আমার সাথে নিজের সাহসিকতা দেখাতে চাইছো বার বার? কেন? আমাকে কি তোমার সাহসিকতা প্রমাণের পরীক্ষা কেন্দ্র মনে হয়?”

জোহানের এমন করে কথা বলা অসহ্যকর মনে হলো মিতুলের। মিতুল সহজ ভাবে জানতে চাইলো,
“কী বলতে চাও?”

জোহান বলার জন্য মুখ খোলা দিয়েও, আবার থামলো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি যা বলতে চাইছি তার জন্য এরকম পরিবেশ মানানসই নয়। আমার সাথে এসো।”

জোহান মিতুলের হাত ধরে টেনে ইনডোর পুল গ্রাউন্ডে নিয়ে এলো। এখানে এখন তেমন মানুষজন নেই। ব্রেকফাস্ট টাইম সে জন্য হয়তো। পুলে কয়েক জনকে সাঁতার কাটতে দেখা যাচ্ছে। কাউকে বা দাঁড়িয়ে গল্প করতে। জোহান মিতুলকে নিরিবিলি একটা সাইডে নিয়ে এলো। জোহান থামতেই মিতুল নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। মেজাজ দেখিয়ে বললো,
“এটা কোন ধরণের অসভ্যতামি? কথায় কথায় হাত ধরে টেনে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে আসা, তোমার কোন ধরণের ভদ্রতার কাতারে পড়ে, সেটা জানতে চাইছি আমি। কে অধিকার দিয়েছে তোমায়? কে অধিকার দিয়েছে কথায় কথায় আমার হাত ধরে এভাবে টেনে আনার? কে দিয়েছে?”

“ওহ, আমি একটু হাত ধরে টেনে আনলে দোষ, সেটা আমার অসভ্যতামি করা হয়। তাহলে বাইরের একটা ছেলের সাথে যখন হ্যান্ডশেক করো, তখন? তখন সেটা দোষের হয় না? আমি ঘরের ছেলে হয়ে হাত ধরলে সেটা ভীষণ দোষের। আর বাইরের একটা ছেলের হাত ধরলে সেটা খুব পূণ্যের হয়, তাই না?”

“কীসের সাথে কী মেলাচ্ছ তুমি? হাত ধরে টেনে আনা, আর হ্যান্ডশেক করা কি এক বিষয়?”

“এক বিষয় নয়? হ্যাঁ, হতেই পারে দুটো দুই বিষয়। সেসব নিয়ে এখন আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি যার জন্য ডেকে এনেছি তোমাকে সেটা শোনো। কালকে রাতে তুমি আমার ফোন কেটে দিয়েছো কেন? আমার কল কেটে দিয়ে অন্য কার সাথে কথা বলায় বিজি ছিলে তুমি? কে সেই স্পেশাল মানুষ? কার্ল জোনাস না কি?” শেষে কার্লের কথা শ্লেষাত্মক গলায় বললো জোহান।

কার্লের কথা বলতেই অবাক হলো মিতুল। জোহান কীভাবে জানলো ও কার্লের সাথে কথা বলছিল? মিতুল ঘাবড়ালেও দ্রুত উত্তর দিলো,
“না, মোটেই না। একদম না। আমি তো আমার মায়ের সাথে কথা বলছিলাম।”

“মা?”

“ইয়াহ।” মিতুল বেশ জোর দিলো কণ্ঠে।

মিতুল যে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে, সেটা বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না জোহানের। ও তো শিওর কার্লই ছিল। তারপরও মিতুলকে বোঝাতে চাইলো ও মেনে নিয়েছে মিতুলের কথা। জোহান মুখে একটু হাসি ফুঁটিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো। মিতুলের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা ঝুঁকে মোবাইলটা মিতুলের সামনে ধরলো। একটা মেয়ের সাথে নিজের ছবি এনে বললো,
“কালকে রাতে তোমাকে যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম, এই সেই মেয়ে। খুব বিউটিফুল না?”

মিতুল দেখলো ছবিতে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে দুজনে সেলফি তুলেছে। মিতুল লক্ষ্য করলো, মেয়েটা আসলেই সুন্দরী। মিতুল বললো,
“হ্যাঁ, বিউটিফুল।”

জোহান মোবাইল স্কিনে ইঙ্গিত করে বলতে লাগলো,
“দেখো, মেয়েটা কী সুন্দর! নাক দেখো, চোখ দেখো, ঠোঁটও দেখো। সে আসলেই খুব সুন্দর, তাই না? ঠিক যেন একটা পরী। পৃথিবীর যেকোনো মেয়েকে তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে…”

নিজে একটা মেয়ে হয়ে, অন্য একটা মেয়ের এমন গুণকীর্তন শুনতে হয়তো অনেক মেয়েরই ভালো লাগবে না। মিতুলের বেলায়ও তাই হলো। ওর-ও ভালো লাগলো না মেয়েটার এত এত প্রশংসা শুনতে। কেন যেন সহ্যই হচ্ছে না ওর। মিতুল জোহানের মুখের দিকে তাকালো।
জোহান হাসি খুশি মুখে মেয়েটার গুণকীর্তন গেয়ে যাচ্ছে তো, যাচ্ছেই। যাক গেয়ে। ও তো আর শোনার জন্য বাধ্য নয়। মিতুল টুপ করে কেটে পড়লো জোহানের পাশ থেকে। দ্রুতগামী এগিয়ে যেতে লাগলো বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে। জোহান পিছন থেকে বললো,
“আরে, আমার কথা তো শেষ হয়নি। মেইন পয়েন্টেই তো আসতে পারলাম না। মেয়েটার সাথে আমি আনুষ্ঠানিক ডেটে যাব, কি যাব না, সে বিষয়ে আলাপ করবো তোমার সাথে। তুমি চলে যাচ্ছ কেন?”

মিতুল কতদূর গিয়ে থামলো। পিছন ফিরে বললো,
“মেয়েটা তো পরীর মতো সুন্দর। তো ওই সুন্দরী পরীর পাখায় ভর করে আকাশে উড়ে বেড়াও তুমি। আমার সাথে সে বিষয়ে কী আলাপ করবে?”

মিতুল আবারও হাঁটা শুরু করলো। আর থামলো না। জোহানও ডেকে বললো না কিছু। শুধু পিছনে দাঁড়িয়ে হাসলো।

___________

স্ট্যানলি পার্ক।
অনেক ঘুরে দেখা হলো এই পার্কটি। তবুও সম্পূর্ণ দেখে ওঠা গেল না। ওদিকে সূর্য জানান দিচ্ছে তারা শেষের পথে আছে। পাঁচটার সময়ই পার্ক থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সকাল দশটা থেকে এখন পর্যন্ত এই পার্কে আছে ওরা। এখন চারটা বাজে। আরও এক ঘণ্টার মতো ঘুরবে এখানে। লাঞ্চের পর ঘোড়ার গাড়ির রাইড নিয়েছে। এখনও ঘোড়ার গাড়িতেই আছে। ঘোড়ার গাড়ির এই রাইডে পার্ক ঘুরে দেখানো হয় এবং পার্কের বিভিন্ন উল্লেখ যোগ্য স্থানে থামানো হয়। সামনে আসছে চেরি ব্লসম স্পট। যেখানে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি সাদা চেরি ব্লসম ট্রি আছে। এখানে তো গাড়ি না থামালেই নয় একেবারে। গাড়ি থামলো। সবাই নামলো গাড়ি থেকে। নামলো না শুধু জোহান। সবার প্রথমেই নামলো মিতুল। দৌঁড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল ও। মিতুলের পরনে সাদা গাউন, পায়ে উঁচু হিল। হিল থাকার কারণে ওর দৌঁড়টা কেমন যেন হলো। যেটা ভালো লাগলো জোহানের, আবার হাসিও পেল একটু।

মিতুল হারিয়ে গেল ওর প্রিয় সাদা চেরি ব্লসমের মায়ায়। হারিয়ে গেল অবিরাম মুগ্ধতায়। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি চেরি ব্লসম ট্রি। উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় চেরি ব্লসমের ডালের ফাঁক থেকে বিকেলের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। এখানে চেরি ব্লসম খুব বেশি ঘন নয়। ফুল যেন খুব দ্রুতই ঝরে পড়ে গেছে। চেরি ব্লসমের এই রাস্তার দুই পাশেই গাড়ি পার্ক করে রাখা। আর রাস্তার মাঝখান দিয়ে দর্শনার্থীদের চলাচল। এখান থেকে দূরে চোখ পড়লে পার্কের লেক দেখা যায়। লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে অনেকে সাইক্লিং করছে, আবার অনেকে হাঁটাহাঁটি করছে। মিতুল লেকের থেকে চোখ এনে চেরি ব্লসমের দিকে আবার মনোনিবেশ করলো। মিতুলের ইচ্ছা করছে, এই রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর তৈরি করতে। যে কুঁড়েঘর থেকে তাকালেই দেখতে পাবে সাদা চেরির অপরূপ মোহনীয়তা। আর ঝরে পড়া পাপড়ি গুলোও সযতনে কুঁড়িয়ে এনে ওর সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে জমা করবে।

জোহান মিতুলকে দেখছে। কেন যেন, মিতুলের মুগ্ধ নয়নে চেরি ব্লসম দেখার ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লাগছে ওর। জোহানের নিজের চোখেও মুগ্ধতা জড়ো হলো। এ মুগ্ধতা চেরি ব্লসম দেখার জন্য নয়। মুগ্ধ হয়ে চেরি ব্লসম দেখতে থাকা একটি মেয়েকে ঘিরে ওর মুগ্ধতা। জোহানের কেন যেন মনে হলো, এই মেয়েটির মুগ্ধ হয়ে চেরি ব্লসম দেখার জন্যই বোধহয় এই চেরি ব্লসমের উৎপত্তি। জোহান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। আশেপাশে শুধু সাদা চেরি ব্লসমের মায়া। গাছ থেকে দুই একটা চেরি পাপড়ি উড়ে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে মুগ্ধমনা মেয়েটিকে। জোহান মুগ্ধমনা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মাই লিটল এঞ্জেল!”

____________

মিতুলের চোখে এখনও স্ট্যানলি পার্ক ঘোরার দৃশ্য ভেসে উঠছে। ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরে বেরিয়েছিল ওরা। একজন টুরিস্ট গাইড এই সম্পূর্ণ রাইডটি পরিচালনা করেছে এবং বিভিন্ন স্থানের ধারাবিবরণী দিয়েছে।
মিতুলের পার্কে উল্লেখযোগ্য দুটি লেক, লস্ট লাগুন এবং বিভার কথা মনে পড়ে গেল। বিভার লেকে অনেক ফুটন্ত পদ্মফুলের সাক্ষাৎ পেয়েছিল। এছাড়াও পার্কের উত্তর পাশে একটি সুদীর্ঘ কোরাল বিচ ছিল। কয়েকটি পাহাড়ি ট্রেইলও আছে পার্কে। যেখানে ট্র্যাকিং করা যায়। আর এর বাকি সবটুকু সবুজ চাদরে মোড়ানো। তাছাড়া পার্কে বিভিন্ন রকমের গাছপালাও আছে। সাইক্লিষ্টদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান বলে মনে হয়েছে মিতুলের। পুরো পার্কে সাইক্লিং এর জন্যে আলাদা একটি রাস্তা রয়েছে। ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঘুরবার জন্যও রাস্তায় আলাদা একটি লেন আছে। তবে পার্কের সবচাইতে সুন্দর স্থান ছিল উত্তর পাশের কোরাল বিচটি। এই বিচে অনেক কোরাল পাথর সারি সারি অবস্থানে অবস্থিত। এই বিচে কানাডিয়ান হাঁসেরা দলে দলে বিচরণ করে বেড়ায়। এই বিচ থেকে সাগরের ওপারে অবস্থিত উত্তর ভ্যানকুভার শহরের প্যানরামিক ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। দূর থেকে শহরের প্রধান ঝুলন্ত ‘লায়ন্স গেট’ ব্রিজকে দেখতে দারুণ লাগে। ব্রিজের কথা মনে হতেই মিতুলের মনে পড়লো কালকে ওরা সেই ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাবে। যদিও এতে ওর আগ্রহ নেই তেমন। ঝুলন্ত ব্রিজে উঠতে ওর ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি ঝুলন্ত ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়ে যাবে। ওর এই চিন্তা ভাবনার প্রথম উৎপত্তি হয় রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজে যাওয়ার পর। সেই ব্রিজে উঠে ভালো মুসিবতেই পড়েছিল। উঠে কয়েক পা হাঁটতেই মাথায় চক্কর দিয়ে বমি এসে গিয়েছিল। মিতুল কালকে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাবে কি না ভাবছে। হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে। ভ্যাঙ্কুভার এসেছে আর ওই ব্রিজটি ঘুরতে না গেলে কেমন হবে? ওই ব্রিজটি তো রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজের মতো নয়। অহরহ গাড়ি চলে সে ব্রিজ দিয়ে।

মিতুলের মোবাইলে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলো। মিতুল এখন রুমে। উইন্ডোর কাছের আর্মচেয়ারে বসে এতক্ষণ এসব ভাবছিল। স্ট্যানলি পার্ক থেকে এসেছে অনেক সময় হয়েছে। রাতের অন্ধকারে জ্বলে উঠেছে রেডিসনের সমস্ত আলোক বাতি।
মিতুল ম্যাসেজ সিন করলো।
‘কী করছো?’

মিতুল উত্তর দেবে না, দেবে না করেও লিখলো,
‘কী করবো আর? বসে আছি।’

‘ঘুরতে যাবে?’

জোহানের ম্যাসেজ দেখে মিতুলের একটু থমকে যেতে হলো। জোহান তো ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার পাত্র নয়। মজা করছে?
মিতুলের উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে জোহান নিজেই আবার লিখলো,
‘রাতের ভ্যাংকুভার দেখাতে নিয়ে যাব তোমায়। যাবে? যদি যেতে চাও, তবে এখনই হোটেল থেকে বের হও। রাস্তাতেই দেখতে পাবে আমাকে।’

জোহান সত্যিই ওকে শহর দেখাতে নিয়ে যাবে? বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।
মিতুল রেশমী আন্টির দিকে তাকালো। রেশমী আন্টি ঘুমে এখন। তিনি আসার পরপরই ঘুমের পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমানোর আগে বলেছেন, ডিনার করবেন না। ওকে সাদাত আঙ্কেলদের সাথে ডিনার করতে বলেছে। তিনি যে ঘুমাচ্ছেন, সেটাও জানিয়ে দিতে বলেছেন। মিতুল কয়েক মিনিট নীরব তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো রেশমী আন্টির থেকে। ভাবতে লাগলো। ওর কি যাওয়া উচিত? মিতুলের মনে হচ্ছে যাওয়া উচিত হবে না। আবার মনে হচ্ছে রাতে ঘুরতে বের হওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিত নয়। মিতুল এক জোড়া কেডস পরে, গায়ে লং কোট চাপিয়ে বের হলো রুম থেকে।
মিতুলের ধারণা ছিল বাইরে শীত থাকবে। কিন্তু বাইরে তেমন শীত নেই। হোটেল থেকে বের হয়ে দেখতে পেল জোহান রাস্তায় দাঁড়ানো। জোহানের গায়ে টি শার্ট। জোহানের গায়ে শুধু একটা টি শার্ট দেখে মনে হলো, সত্যিই আজকে শীত নেই। জোহান মিতুলকে দেখে বললো,
“এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার?”

মিতুল কোনো উত্তর দিলো না।

জোহান সাইকেলে উঠে বললো,
“ওঠো তাড়াতাড়ি।”

মিতুল এতক্ষণ সাইকেলটা লক্ষ্য করেনি। জোহানকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সাইকেল পেলে কোথায়?”

“ধার নিয়েছি।”

“কার কাছ থেকে?”

“সেটা জানা কি খুব জরুরি?”

মিতুল না বোধক মাথা নাড়লো।

“তাহলে ওঠো এখন।” জোহান তাড়া দিলো।

মিতুল সাইকেলের পিছনে উঠে বসলো।

জোহান মিতুলকে সাবধান করলো,
“শক্ত করে ধরে বসো আমাকে। খুব দ্রুত চালাবো আমি। পিছন থেকে পড়ে যেতে পারো তুমি।”

মিতুল জোহানকে ধরে বসলো না। জেদ ধরে বললো,
“পড়বো না। চালাও তুমি।”

জোহান মিতুলের একঘেয়েমি পনা দেখে, নিজেই পিছন থেকে মিতুলের এক হাত এনে নিজেকে আঁকড়ে দিলো। তারপর বললো,
“শক্ত করে ধরো কিন্তু।”

বলেই সাইকেল চালানো স্টার্ট করলো জোহান। মিতুল ভেবেছিল জোহানকে শক্ত করে ধরবে না, কিন্তু জোহান সত্যিই এত জোরে চালাচ্ছে যে, জোহানকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতেই হলো। মিতুল শক্ত করে আকড়ে ধরেছে জোহানকে।
জোহান মিতুলের অগোচরে হাসলো। বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে মিতুলের মাথা কখন যেন জোহানের পিঠের সাথে হেলে পড়েছে। মাথা লেগে আছে জোহানের পিঠের সাথে। মিতুলের দু চোখে রাশি রাশি মুগ্ধতার আনাগোনা। নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে জোহানের সাইকেল এগিয়ে চলছে। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। খুবই মায়াবী লাগলো মিতুলের কাছে সেই আলো। অনেক পথ পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। কতটা পথ ফেলে এসেছে? মিতুল পিছনে ঘুরে দেখলো একবার। ওদিকে ঝাপসা অন্ধকার দেখাচ্ছে। যদিও ওদিকে ল্যাম্পপোস্টের আলো ছিল। তবুও ঝাপসা অন্ধকার দেখাচ্ছে।

রাস্তার পাশেই জংলার মতো উঁচু জায়গায় ফুল ফুঁটে আছে। জোহান দূরে থাকতেই দেখতে পেল। কাছাকাছি আসতেই জোহান হাত বাড়িয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে নিলো।
সাইকেলটা থামিয়ে পিছন ফিরে টুপ করে মিতুলের চুলে গুঁজে দিলো ফুলটা। জোহানের সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো মিতুলের। জোহান বেশিক্ষণ তাকালো না মিতুলের চোখে, দ্রুত চোখ সরিয়ে এনে আবার সাইকেল চালানো শুরু করলো।
মিতুল থমকে গেছে। কী করলো জোহান? মিতুল হাত বাড়িয়ে জোহানের গুঁজে দেওয়া ফুলটা ছুঁয়ে দেখলো। হৃদস্পন্দনের গতি যেন বেড়ে যাচ্ছে ওর। শব্দটা নিজের কানে এসে লাগছে মিতুলের। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দের সাথেই সামনে থেকে জোহানের শান্ত মৃদু কণ্ঠও ভেসে এলো,
“শত সহস্র ফুল তোমার জন্য প্রিয়তমা। তুমি ফুল লুটে নাও, আর সেই সাথে লুটে নাও আমার হৃদয়। আমি হৃদয় খুলে বসে আছি। তুমি খুব সংগোপনে এসে কড়া নাড়ো এই হৃদয়ের। তুমি কেবল আমারই লিটল এঞ্জেল!”

(চলবে)