চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা পর্ব-১৬+১৭

0
357

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৬
____________

জঙ্গলটা আজকে এত পরিষ্কার মনে হচ্ছে কেন? কোথায় সেই চির ক্ষয়িষ্ণু কালো অন্ধকার? কোথায়? আগে যে অন্ধকার দেখা যেত জঙ্গলের ভিতর, দেখে যে মনে হতো ওখানে কোনো দিন কোনো আলোর প্রবেশ ঘটেনি, সেটা আজকে আর মনে হচ্ছে না কেন? তবে কি ভয়, কৌতূহলে অত বেশি অন্ধকার দেখতে পেত? সেটাই কি? উহ, কাল রাত থেকে এসব ভাবতে ভাবতে মাথায় যন্ত্রণা ধরে যাচ্ছে। মিতুল এসব ভাবনাকে অতলে তলিয়ে দিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার পথ ধরলো। সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে। আশেপাশে তাকালে দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো গাছ। মিতুল জানে এখন আর এই জঙ্গলে ভয়ের কিছু নেই। তবুও কেন যেন গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। কালকে রাতে ভালো করে কিছুই দেখা হয়নি। দূরে যে ওই আলো দেখতে পেয়েছিল, সেটা কী ছিল? এই জঙ্গলের ভিতর আলো এলো কোত্থেকে? আজকে জোহানকে এ ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করবে ।

রাতে মিতুলের ভালো ঘুম হয়নি। বলতে গেলে ঘুমই হয়নি। কালকে রাতের কথা মনে পড়ছিল বার বার। জোহানকে কেন মেরেছিল ওই ছেলেগুলো? জোহানের সাথে তাদের সম্পর্ক কী? জোহানের মুখে যে আগেও মারের দাগ দেখেছিল, তাও কি ওই ছেলেগুলোর থেকে পাওয়া আঘাতের কারণে ছিল? না কি আবার অন্য কেউ মেরেছিল? মারলো কেন ওকে? এর সব উত্তর জোহানের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে। মিতুলের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, যে জঙ্গল নিয়ে ওর এত ভয়, দুশ্চিন্তা ছিল, সেই জঙ্গলে কি না ভয়ের কিছুই নেই! ভাবা যায়?

মিতুল দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছন ফিরে তাকালো। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। গার্ডেন দেখা যাচ্ছে এখনও। মিতুলের মনে হলো জঙ্গলের প্রথম দিকে গাছ যেন বেশি ঘন। এখানে বেশি সূর্যের আলো নেই। গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে অল্প অল্প সূর্যের আলো এসে জমিন ছুঁয়ে দিচ্ছে। মিতুল হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে নিবিড় চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সব। গাছ পাতলা হয়ে এসেছে। এখানে অনেক রং বেরঙের বুনো ফুলের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলোর খেলা এখন জঙ্গল জুড়ে। সব যেন চকচকে আলোয় স্বচ্ছ পরিষ্কার। আর কয়েক পা হাঁটলে দেখা যাবে গাছই নেই প্রায়। যে জঙ্গলকে অন্ধকার রাজ্য মনে করতো, সেই জঙ্গলের এখানে এখন রাশি রাশি আলো। হঠাৎ মনে হলো, জঙ্গলটা ওর ভালোই লাগছে। যারা কেবল বাইরে থেকে দেখেছে জঙ্গলটা, তারা এর ভিতরে না ঢুকলে বুঝতেই পারবে না এই জঙ্গলের ভিতর কত আলো! ও নিজেও তো বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল জঙ্গলটা বোধহয় একটা অন্ধকার রাজ্য।
মিতুল বামে বাঁক নিলো। ওই তো জোহানের ঘরটা দেখা যাচ্ছে। মিতুল কালকে আলো দেখা জায়গাটায় তাকালো। চোখ সরু হয়ে এলো। ওখানেও কি ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে না কি? হুম তাইতো। এই জঙ্গল থেকে বাইরের দৃশ্যও দেখা যায় তাহলে? কালকে কি তবে ওইসব বাড়িতে জ্বালানো লাইটের আলোই দেখেছিল? হ্যাঁ, তা-ই হয়ে থাকবে।
মিতুল দূরের বাড়িগুলো দেখতে দেখতে জোহানের ঘরের সামনে এসে গেছে।
আচ্ছা, জোহান থাকে কী করে এখানে? ভয় করে না ওর? হোক এটা তেমন গাছপালা ঘেরা ঘন জঙ্গল নয়, তারপরও…
মিতুলের জোহানের কথা মনে পড়লো। জোহান ঘুম থেকে উঠেছে? মিতুল তিন ধাপ ওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। দরজা দিয়ে উঁকিঝুকি মারার চেষ্টা করছে। কিন্তু উঁকিঝুকি মেরে কী দেখছে সেটা নিজেও জানে না। মিতুলের উঁকিঝুকি মারার এক পর্যায়ে বন্ধ দরজাটা চোখের পলকে হঠাৎ খুলে গেল। মিতুল দেখতে পেল এক জোড়া বাদামি চোখ ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। জোহানকে দেখে মিতুল অপ্রস্তুত হাসলো।

“গুড মর্নিং, জোহান!”

“তুমি এখানে?”

“দেখতে এলাম তোমাকে। তোমার ব্যথা কি সেরে গেছে? দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে!”

মিতুল এখানে একটু মিথ্যা বললো। জোহানকে দেখতে আসা ওর প্রধান উদ্দেশ্য নয়। রাতে এই জঙ্গল এবং জোহানের এই টাইম হাউজ কিছুই ভালো করে দেখতে পারেনি। সেটাই এখন দেখতে এসেছে।

“দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন? ভিতরে ঢুকতে দেবে না?”

জোহান দরজার কাছ থেকে সরে বললো,
“এসো।”

মিতুল প্রবেশ করলো। প্রথমেই চোখ চলে গেল ফ্রিসিয়াস ফুলগুলোর উপর। ঘরকে মিষ্টি সুবাসে ভরিয়ে রেখেছে এরা। ফুলের উপর রোদ এসে পড়েছে।
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললো,
“কালকে তো বলছিলে তুমি খুব দুর্বল! কাউচ ছেড়ে নামার শক্তিটুকুও নেই তোমার। তাহলে আজকে এত টনটনা ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছ কী করে?”

“আমাকে কি তোমাদের মতো নিষ্কর্মা মনে হয়? যে একটু মার খেয়েই এক মাস বিছানায় পড়ে থাকবো? আই অ্যাম অ্যা একটিভ বয়।”
বলতে বলতে কাউচের উপর বসলো জোহান।

মিতুলের এতক্ষণে জোহানের পোশাকের দিকে খেয়াল হলো। পোশাকও পাল্টে ফেলেছে দেখছে। শার্ট, জিন্স রেখে ধূসর রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং বেগুনি রঙের টি শার্ট পরেছে। অথচ কাল বললো ও কাউচ ছেড়েই নামতে পারবে না, এতটাই দুর্বল!

“এমন করে কী দেখছো?” মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো জোহান।

“তোমার দিকে একটু তাকালেই কি এরকম আর সেরকম করে দেখা হয়ে যায়? কী হবে তোমাকে একটু দেখলে? তোমার রূপ নগরী ধ্বংস হয়ে যাবে?”

“হতে কতক্ষণ? বলা তো যায় না, নজর তো লেগেও যেতে পারে। তোমাদের মেয়ে জাতির উপর কোনো বিশ্বাস নেই। তোমরা চাইলে সবই পারো।”

মিতুল মুখ বাঁকালো।

জোহান বললো,
“ঠিক আছে, এ নিয়ে আর কথা না বাড়াই। এক কাজ করো। কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে আনো আমার জন্য।”

“কী? কী করবো আমি?”

“কফি বানিয়ে আনতে বললাম তোমায়…
ওহ বুঝতে পেরেছি। আমার একার জন্য কফি বানাতে বললাম বলে রাগ করেছো? ঠিক আছে, আমার একার জন্য নয়। তোমার জন্যও এক মগ বানিয়ো।”

জোহান যে অপমান করে কথা বলছে, সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না মিতুলের। মিতুল তেজি গলায় বললো,
“আমাকে কি নিজের দাসী মনে করো? তুমি যা বলবে তাই করতে হবে আমার? কালকে তোমার ট্রিটমেন্ট করে দিয়েছি, সেটাই ছিল মাত্রাতিরিক্ত! বুঝেছো? মাত্রাতিরিক্ত। জীবনেও যেই কাজ করিনি আমি, তোমার জন্য সেটা করতে হয়েছে আমার। কালকে করে দিয়েছি বলে কি, আজকেও হুকুম নিয়ে বসেছো? তোমার হুকুম তুমি নিজেই শোনো এবং পালন করো। তোমার হুকুম পালন করতে এই মিতুল দিলরাবা বসে নেই।”

“এখানে দাসী, ট্রিটমেন্ট এত এত কথা উঠলো কেন? কে বললো যে আমি তোমাকে হুকুম করছি? দেখতে পাচ্ছ না আমি আহত একজন রোগী? একজন আহত রোগীর পক্ষে কি কফি বানিয়ে খাওয়া সম্ভব?” মিতুলকে প্রশ্ন করে আবার নিজেই বললো,
“না, সম্ভব নয়। একজন আহত রোগী কিছুতেই কফি বানিয়ে খাওয়ার অবস্থায় থাকে না। এটা অবশ্যই অন্য কারো বানিয়ে খাওয়ানো উচিত। বুঝতে পে…”
জোহান কথার মাঝেই হঠাৎ পেট চেপে ধরে ব্যথা পাওয়ার মতো শব্দ করলো। পেট চেপে ধরেই আস্তে আস্তে একদিকে কাত হয়ে কাউচের সাথে মিশে গেল একেবারে।
মিতুলের চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ও পেল ভীষণ। উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো তোমার?”

জোহান সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, মিতুলের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
“একজন রোগীকে কী করে তুমি উত্তেজিত করে তুলতে পারো? জানো না, রোগীর সাথে এমন আচরণ করা বেআইনি? কেউ শেখায়নি তোমায়?”

মিতুল কিছু বলতে পারলো না। শুধু অপরাধী চোখে নিরাশ তাকিয়ে রইল।
জোহান আরও কিছুক্ষণ ওভাবে কাউচের সাথে থেকে, সোজা হয়ে বসলো। নিজের পেটের আহত জায়গায় হালকা ম্যাসাজ করতে করতে বললো,
“তুমি এখনও এভাবে স্থির দাঁড়িয়ে আছো কেন? একজন রোগীকে দুর অবস্থায় ফেলে দিয়েও কি অনুশোচনা হচ্ছে না তোমার? যাও কফি বানিয়ে আনো আমার জন্য।”

মিতুল বাধ্য মেয়ের মতো বললো,
“যাচ্ছি।”

মিতুল কিচেনে ঢুকতে যাবে এমন সময় জোহান পিছন থেকে বলে উঠলো,
“এই দাঁড়াও।”

মিতুল পিছন ফিরে বললো,
“কী?”

জোহান মিতুলকে এতক্ষণ একেবারেই খেয়াল করে দেখেনি। জোহান মিতুলকে ভালো করে দেখতে লাগলো। মিতুলের পরনে খয়েরি রঙের জর্জেটের থ্রি পিস। মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে। গায়ে জড়িয়ে রেখেছে একটা খয়েরি রঙের শাল। জোহান মিতুলকে এমন সাজে কখনো দেখেনি। বললো,
“হঠাৎ করে তোমার লুক চেঞ্জ হয়ে গেল কেন?”

“মানে?”

“আমি তোমার ড্রেস আপের কথা বলছি।”

ড্রেস আপ? মিতুল নিজের ড্রেসের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটু। জোহানকে প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে আমার ড্রেসের?”

“কিছুই হয়নি। তোমাকে জাস্ট ভালো লাগছে না দেখতে। কখনো এই ড্রেস পরবে না আর।
আর হ্যাঁ, ওই…” জোহান মিতুলের গায়ের শালটার দিকে ইঙ্গিত করলো।
“ওটা দেখে মনে হচ্ছে একটা বস্তা জড়িয়ে আছো গায়ে।”

মিতুলের মুখ অপমানে রক্তিম হয়ে উঠলো। ওকে দেখতে খারাপ লাগে? এটাই বললো জোহান? মিতুল প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“এখন আমি কি পরবো সেটাও তুমি ডিসাইড করে দেবে? একশ বার এই ড্রেস পরবো আমি। কী করবে তুমি? একটানা দশ দিন এই ড্রেস পরে তোমার সামনে সামনে ঘুরবো আমি। কী করবে তুমি?”
বলে ঝড়ের গতিতে কিচেনে ঢুকে গেল।

জোহান কিচেনের শূন্য দরজাটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
“তোমাকে রাগলে খুব ভালোই লাগে নাক ফুলো তুলতুল। তুমি একটানা দশ দিন এই ড্রেস পরে আমার সামনে ঘুরলে, আমি মনে করবো, এটা আমার আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া একটি চোখ জুড়ানো উপহার। কারণ তুমি এই ড্রেসে দেখতে অত্যাধিক সুন্দর।”

মিতুলের ইচ্ছা করছে জোহানকে কফির বদলে বিষ বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু বিষ বানানোর প্রক্রিয়া তো ও জানে না। কী কী লাগে এই বিষ বানাতে? কিছু বিষাক্ত গাছের নির্যাস একসাথে মিক্সড করলে পারফেক্ট বিষ হবে? মিতুল এসব ভাবতে ভাবতেই কফি তৈরির সব উপকরণ খুঁজতে লাগলো। মিতুল জীবনেও কফি তৈরি করে খাওয়াতো না জোহানকে। কিন্তু নানির কথার মনে পড়ছে ওর। নানি বলতেন অসুস্থ মানুষের দেখভাল করতে হয়, সাহায্য করতে হয়। জোহান তো এখন অসুস্থ। মিতুল ভাববে ও জোহানের জন্য নয়, একজন অসুস্থ মানুষের জন্য কফি তৈরি করছে।

মিতুল কফি তৈরির মেশিন ব্যবহার করে কফি তৈরি করতে জানে না। কী ভাবে ইউজ করে এটা? মিতুল চেয়েছিল একটু ট্রাই করে দেখবে। কিন্তু সাহস পেল না। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে? বাই চান্স যদি মেশিনটাই নষ্ট হয়ে যায়? না না দরকার নেই। পরের জিনিস নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। এসব ইচ্ছা থাকলে ওই জোহান বদমাইশটার থাকতে পারে। মিতুল চুলোতে কফি তৈরি করলো।
এক মগ কফি নিয়ে ফিরলো লিভিং রুমে। এই কফি জোহানকে খেতে দিতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে জোহানের মুখে ছুড়ে মেরে ওর মুখটা পুড়িয়ে দেয়।
একটা মগ দেখে জোহান বললো,
“একি, শুধু আমার জন্য কফি তৈরি করলে কেন? নিজের জন্যও করতে।”

মিতুল কঠিন মুখে জবাব দিলো,
“তোমার এখানে কফি খেতে আসিনি আমি। তোমার এখানে বসে কফি খাওয়ার থেকে তো বিষ পান করাও বেটার।”

জোহান মগে চুমুক দিয়ে বললো,
“কিন্তু বিষ পান করলে তো তুমি মারা যাবে।”

“মরলে আমি মরবো। তোমাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। নিজের জীবন নিয়ে নিজে ভাবো।”
বলে মিতুল টাইম হাউজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরলো। কয়েক পা হেঁটে আবার থেমে গেল। জোহানের কাছে যা জানার ছিল তা তো জানা হয়নি ওর। মিতুল ভাবছে ওর এখন কী করা উচিত? রাগ দেখিয়ে এখনই এই ঘর ত্যাগ করা উচিত? না কি কথা গুলো জেনে তারপর যাওয়া উচিত?

মিতুল জোহানের দিকে তাকালো পিছন ফিরে। মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে। মিতুল শেষমেষ জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“আচ্ছা, ওই ছেলেগুলো কারা ছিল? কী সম্পর্ক তোমার ওদের সাথে? মারলো কেন তোমাকে?”

জোহান স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দিলো,
“ওরা আমার শত্রু।”

মিতুলের কপাল কুঁচকে গেল।
“শত্রু? আমি তো জানতাম ফেমাস লোকদের বেশি শত্রু থেকে থাকে।”

“তো আমাকে কি তোমার ফেমাস মনে হয় না? অবশ্যই আমি একজন ফেমাস ব্যক্তি। যার পিছনে হাজার হাজার মেয়ে ঘোরে, তাকে ফেমাস ছাড়া আর কী ভাববে তুমি?”

“ঠিক আছে ধরলাম তুমি ফেমাস…”

“ধরছো মানে? আমি যে ফেমাস, সে বিষয়ে তোমার সন্দেহ আছে?”

মিতুলের বলতে ইচ্ছা হলো,
“আরে ব্যাটা, তুই ফেমাস না কি ফেমাস না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ করার কোনো দরকার নেই। আমি একশো পার্সেন্ট শিওর তুই ফেমাস না।”

কিন্তু মুখে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না, সন্দেহ নেই।”
এমন কথা বললো কারণ, মিতুল ভালোয় ভালোয় সত্যিটা জানতে চায়। তা না হলে জোহানের এই মিথ্যা ফেমাসের গল্প এক কিক মেরে চুরমার করে দিতো।
“কিন্তু ওরা তোমার শত্রু হলো কীভাবে?”

“হিংসায়। ওদের অধিক হিংসার কারণেই ওরা আমার শত্রুতে পরিণত হয়েছে।”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“হিংসা? কী নিয়ে হিংসা করে ওরা?”

“এই যে আমি এত সুদর্শন! আমার সৌন্দর্য নিয়ে হিংসা করে ওরা। সব মেয়েরা আমার পিছন পিছন ঘোরে বলে ওদের সহ্য হয় না একেবারে। হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় ওরা। আর এই হিংসা থেকেই ওরা আমার উপর অ্যাট‍্যাক করে। যাতে ওদের মারের ফলে আমার চেহারার বারোটা বেজে যায়। আমার মুখ মন্ডল যেন কুৎসিত হয়ে যায়। কিন্তু ওরা তো জানে না। ওদের ওই ঠুনকো মারে আমার কিছুই হবে না। যে সুন্দর, সে সব সময়ই সুন্দর। আমি আমার ত্বকের প্রতি ভীষণ যত্নশীল। আমার এই যত্নশীলতার সাথে সাথে ওদের দেওয়া আঘাতের এসব দাগ সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। আর দাগ থেকে গেলেও সমস্যা নেই। আমার দিকে দেখো। কী? খারাপ লাগছে আমাকে? এখন এই মারের দাগ নিয়েও সুদর্শন নই আমি?”

মিতুল তাজ্জব বনে গেল। জোহানের মুখ থেকে এতক্ষণ কী শুনলো এসব? এসব লজিকও কি মানার মতো? মিতুল বললো,
“সত্যি সত্যিই তুমি সুদর্শন বলে, ওরা হিংসা করে মেরেছে তোমাকে?”

জোহান বেশ দাপটের সাথে বললো,
“তা নয় তো কী? তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি আমি?”

মিতুলের মেজাজটা আবার প্রচণ্ড রকমের খারাপ হয়ে গেল। কীভাবে কথা বলছে দেখো বদমাইশটা! একটা পাগলও কি এসব বিশ্বাস করবে? মিতুল কোনো কথা বাড়াতে চাইলো না। রাগটা সামলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল জোহানের ঘর থেকে। কিন্তু পা বাড়াতেই জোহান ডাকলো আবার,
“শোনো…”

মিতুল দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়াতে চায়নি। কিন্তু পা দুটো কেন যেন থেমে গেল। মিতুল গাম্ভীর্য মুখ নিয়ে পিছন ফিরে তাকালো।
জোহান হাতের মগটা উপরে উঠিয়ে ওকে দেখিয়ে বললো,
“কফি বানিয়ে খাওয়াতে বলাটা কিন্তু আমার অর্ডার ছিল না। কিন্তু এখন একটা অর্ডার দিচ্ছি তোমায়। যদি অর্ডার হিসেবে না মানো, তবে অনুরোধ হিসেবেই মেনে নিয়ো। এই মগটা ধুয়ে রেখে যাও।
আর হ্যাঁ, জীবনেও আর কাউকে কোনো দিন কফি বানিয়ে খাওয়াতে যেয়ো না। ইট’স ভেরি ব্যাড!”

জোহানের অপমানিত বাক্যতে মিতুলের মস্তিষ্কের কিছু একটা ব্লাস্ট হলো যেন। মিতুল এগিয়ে এলো জোহানের কাছে। জোহানের হাত থেকে মগটা নিয়ে, শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলো। শান্ত অথচ ধারালো কণ্ঠে বাংলাতে বললো,
“তোমাকে মাঝে মধ্যে কী ইচ্ছা হয় আমার জানো তো? ইচ্ছা হয়, আমার দাদা বাড়ির পিছনের বিশাল পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে চুবিয়ে মারি তোমায়!”

মিতুলের বাংলা জোহানের মাথাতে সব ধরলো না।
“দাদা বারি…পু-কুর…চু-চু…হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে?”

জোহানের কথায় মিতুল কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। হাতের মগটা তীব্র রাগের সাথে মেঝেতে ফেলে দিয়ে, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল জোহানের টাইম হাউজ থেকে।

জোহানের মাথায় কিছুতেই ধরছে না মিতুল কীসব বলে গেল।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৭
____________

ভ্যাঙ্কুভার যাওয়ার সকল ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন। চেরি ব্লসমের মায়ায় হারিয়ে যেতে চাওয়া প্রিয় ভ্যাঙ্কুভার মিতুলের। এই বসন্তে ভ্যাঙ্কুভার ঘুরতে যাবে না, এটা তো বেমানান। নেক্সট উইকেন্ডে সবাই মিলে ভ্যাঙ্কুভার যাচ্ছে ওরা। উহু, সবাই না। একজন বাদে। জোহান যাবে না। শুনেছে ফ্যামিলির সবাই প্রত্যেক বছর বসন্তে ভ্যাঙ্কুভার সময় কাটাতে যায় কিছুদিনের জন্য। কিন্তু জোহান না কি ভ্যাঙ্কুভার যেতে চায় না একবারও। এমনকি যায়ও না। এবারও তাই। তবে এবার যেতে না চাওয়ার একটা কারণও আছে। সেটা হলো, ওর গানের কনসার্ট আছে উইনিপেগে। কালকেই রওনা হবে উইনিপেগের উদ্দেশ্যে। আর তারপরের দিন ওরা সবাই রওনা হবে ভ্যাঙ্কুভারের উদ্দেশ্যে।
জোহান ভ্যাঙ্কুভার না যাওয়াতে খুশি মিতুল। জোহান সাথে গেলে ওর আনন্দের সময়গুলো মাটি করে দিতো। জোহানকে এখন দুই চোক্ষের বিষ মনে হয় ওর কাছে। সেদিন কী অপমানটাই না করেছিল জোহান! একবার খারাপ দেখতে লাগে বলে অপমান করেছে, আরেক বার কফি বানানো নিয়ে। সবই মনে আছে মিতুলের। তবে মিতুল জোহানকে শাস্তি দিচ্ছে। জোহান বলেছিল থ্রি পিস আর না পরতে, থ্রি পিসে ওকে খারাপ লাগে দেখতে। এই খারাপ লাগা ড্রেসই পরছে ও সেদিন থেকে। আজ তিন দিন হলো এই নিয়ে। এবার বুঝুক জোহান!

মিতুল বারান্দায় পায়চারি করছে। এখন রাত। বারান্দায় লাইট জ্বলছে। ওর পরনে ভারী কাজের লাল রঙের থ্রি পিস। শীত নেই আজকে তেমন। তাই শাল জড়ায়নি। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। হাতে কার্লের দেওয়া সেই হেয়ার রাবার। ভ্যাঙ্কুভার গেলে কার্লকে খুব মিস করবে। ভ্যাঙ্কুভারে যদি কার্লও থাকতো সাথে, তাহলে খুব খুব ভালো হতো। দুজনে এক সাথে পুষ্পবৃষ্টিতে ভিজতে পারতো। দুজনে এক সাথে ঘুরতো চেরির রাজ্যে। খুবই ভালো হতো।

“মিতুল!”

কারো ডাকে পিছন ফিরতে হলো মিতুলের। রাবার্তা দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলকে ফিরতে দেখে সে বললো,
“ডাইনিং রুমে এসো, রাতের খাবারের জন্য।”

কথাটা বলেই রাবার্তা চলে গেল। রাবার্তার মাঝে কোনো আন্তরিকতা নেই। তাকে গম্ভীর স্বভাবের মনে হয় মিতুলের। ক্যামিলার মতো মিশুক নয়। মিতুলের মনে হলো, এই রাবার্তাকেই এ বাড়ির উপযুক্ত মেইড হিসেবে মানিয়েছে। এ বাড়ির মানুষের মাঝেও যেমন আন্তরিকতা নেই, তেমন এই রাবার্তার মাঝেও নেই। ক্যামিলা এদের থেকে ভিন্ন। ক্যামিলাকে যায় না এদের সাথে।

ডাইনিং রুমে এসে সাদাত আঙ্কলকে দেখতে পেল। সাদাত আঙ্কলকে খুব একটা দেখাই যায় না। কাজ টাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আজকে তাকে এভাবে ডাইনিং রুমে দেখতে পাবে ভাবেনি। মিতুল দরজায় এসে থেমে গিয়েছিল সাদাত আঙ্কলকে দেখে। সাদাত আঙ্কলের দৃষ্টি ওর উপর পড়তেই একটু হকচকিয়ে গেল। হেসে ফেললো অপ্রস্তুত। সাদাত আঙ্কলও একটু হাসি উপহার দিলেন।
মিতুল রুমে ঢুকলো। সাদাত আঙ্কলের বিপরীত পাশের একটা চেয়ার টেনে বসলো।
ক্যামিলা খাবার সার্ফ করছে। দেশি, বিদেশি দুই ধরণের খাবারই আছে। পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর গোশের কালা ভুনা, ফিশ ফ্রাই, চাইনিজ সবজি কারি, অ্যাপল টার্ট, থাই চপ স্যুয়ে, ভেজিটেবলস সালাদ এবং ভাত। মিতুল এ বাসায় আগে একসাথে এত আইটেম তৈরি করতে দেখেনি। আজকে হঠাৎ এত খাবার তৈরির মানে কী?

কয়েক মিনিট পরই জায়িনকে ডাইনিং রুমে ঢুকতে দেখা গেল। জায়িন সাদাত আঙ্কলের থেকে একটা চেয়ার রেখে তারপর বসলো। এরই মধ্যে রেশমী আন্টিকেও দেখা গেল। উনি এসে স্বামী এবং ছেলের মাঝখানের চেয়ারটাতে বসলেন। যে চেয়ারটা মিতুলের সোজাসুজি। মিতুল ভাবছে, কী হচ্ছে আজকে? আজকে কি কোনো স্পেশাল ডে? এখানে আসার যতদিন হলো, তত দিনে এদের সবাইকে এক সাথে বসে খেতে দেখেনি ও। আজকে হঠাৎ সবাই একসাথে খেতে বসেছে, কাহিনী কী?
জোহান না আসায় ফ্যামিলিটা অপরিপূর্ণ ছিল। হুট করে সেও এসে গেল। টপাস করে বসে পড়লো মিতুলের পাশের চেয়ারটিতে। জোহানকে নিজের পাশে বসতে দেখে মিতুল এই চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে, এর পাশের চেয়ারটায় সরে বসতে চাইছিল। কিন্তু সবাই এখানে উপস্থিত থাকার কারণে পারলো না। এমন করলে তারা কী ভাববে? মিতুল চুপচাপ বসে রইল। তবে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে ওর। জোহানের কেন ওর পাশে এসেই বসতে হলো? আরও তো চেয়ার ছিল।

রেশমী আন্টির কথা শুনে, তার দিকে তাকালো মিতুল। রেশমী আন্টি বলছেন,
“মাসে তিন, চার বার আমরা সবাই এক সাথে বসে ডিনার করি। কাজ বাজে সবাই ব্যস্ত থাকার কারণে সব সময় একসাথে বসে খাওয়া হয় না। আর তাছাড়াও আমাদের খাওয়া দাওয়ার ধরা বাধা নিয়ম নেই। যার যখন খিদে পায়, সে তখন খায়। তোমার সাদাত আঙ্কেলই মাঝে মাঝে সবার সাথে একসাথে বসে খাওয়ার তাগাদা দেয়।”

রেশমী আন্টির কথা শুনে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো মিতুলের। মাসে মাত্র তিন, চার বার একসাথে বসে ডিনার করে সবাই? মজার তো ব্যাপারটা!

সবাই স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে। কিন্তু মিতুল খেতে পারছে না। ওর অস্বস্তি হচ্ছে। এত লোকের মাঝে বসে খাওয়া যায়? পোলাও আর এক পিস রোস্ট নিয়ে সেই থেকে বসে আছে। প্লেট যেন একটুও খালি হচ্ছে না। এ কেমন জ্বালা?

জোহান নিজের মমকে লক্ষ্য করছে। ব্রাদারকে খুব সযত্নে এটা ওটা বেড়ে দিচ্ছে মম! এই যে ব্রাদার ফিস ফ্রাই নিতে চাইলো না, কিন্তু মম তারপরও জোর করেই দিলো। দৃশ্যটা তো খুব নয়নাভিরাম! মা তার ছেলেকে যত্ন করছে। জোহান মনে মনে হাসলো একটু। তারপর মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“জানো তো মিতুল, মম তার বড়ো ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসে। কী, তোমারও কি মনে হচ্ছে না যে মম আমার ব্রাদারকে খুব বেশিই ভালোবাসে?”

মিতুল এমনিতেই খেতে পারছিল না। তার উপর সবার মাঝে বসে জোহানের এমন একটা প্রশ্ন করে ওঠায়, একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সবার মধ্যে বসে এ কীরকম প্রশ্ন করলো জোহান ওকে? মিতুল দ্রুত রেশমী আন্টির দিকে তাকালো। জোহানের কথা শুনে সবার খাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। সবার মুখেই লেগে আছে একটা অপ্রত্যাশিত ছায়া।
রেশমী আন্টি নিজের মুখের সেই ছায়াকে এক চিলতে হাসিতে ঢেকে দিয়ে বললেন,
“এই দুষ্ট ছেলে, এটা কেমন কথা? আমি কেবল তোমার বড়ো ভাইকেই ভালোবাসি? তোমাকে বুঝি বেশি ভালোবাসি না?”

জোহান মমের মুখের হাসিটা খুব গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখলো। এতটাই গভীর ভাবে দেখলো যে, ওই হাসিতে ভালোবাসা আছে কি না সেটাও বুঝে যায় নিমেষে! জোহানের নিজের মুখেও একটু হাসি ফোঁটে নীরব। বুকের মাঝে চাপা পড়ে রয় কিছু একটা খুব দুঃখ, অভিমানে!

______________

ঘর অন্ধকার। শুধু ড্রিম লাইট জ্বলছে একটা। মিতুল কম্বলটা কোমর পর্যন্ত টেনে রেখেছে। হাতে মোবাইল। মোবাইলের স্কিনে কার্ল। কার্ল মানে, কার্লের ছবি। সেদিন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খুব গোপনে কার্লের ছবি তুলেছিল ও। মোট পাঁচটা ছবি তুলেছিল। এর মাঝে তিনটার অবস্থাই বেগতিক। এই তিনটা ছবি দেখে তো মিতুলের সন্দেহ হচ্ছে, এ কাকে তুলেছে ও ক্যামেরায়? কার্লকে? না কি কার্লের প্রেতাত্মাকে?
ইশ, ছেলেটা কাজের জন্য এত ছোটাছুটি করে যে, ওর বদলে ওর প্রেতাত্মা উঠে গেছে মোবাইলে!
বাকি যে দুইটার অবস্থা একটু ভালো, সে দুইটা মেহরিনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেহরিন তো দেখে খুবই প্রশংসা করেছে। অবশ্য প্রশংসা করবেই বা না কেন? প্রশংসা পাওয়ারই তো যোগ্য সে। কী সুন্দর চেহারা, কী সুন্দর নাক, কী সুন্দর ধূসর চোখ, কী সুন্দর ঠোঁট, যেন একেবারে সুদর্শন রাজপুত্র! যদিও এই সুদর্শন রাজপুত্রের সুদর্শন নাক, কান, চোখ, ঠোঁট কিছুই দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। দূরে বসে তার চলার উপর ছবি তুললে কতটুকুই বা স্পষ্ট হবে আর? এরকম যে উঠেছে সেটাই তো কপাল! চাইলে কার্লের পারমিশন নিয়ে, ভালো করেই ছবি তোলা যেত। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন হতো? সে জন্য মিতুল এভাবেই ছবি তুলেছে। এরকম ভাবে যা উঠেছে তাতেই শান্তি ওর।
মিতুল কার্লের মুখটা জুম করে দেখছে। এই তো ওর প্রথম প্রেম। মিতুল মোবাইল স্কিনে কার্লের ছবিতে চুমু খাবে বলে, মোবাইলটা ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসছিল। এর মাঝেই মোবাইলটা হঠাৎ বিকট শব্দে বেজে উঠে, হাত ফসকে ঠাস করে ওর মুখের উপর পড়লো।

“আ-আহ্…”

মোবাইলটা মুখের উপর পড়ে, আবার বিছানায় পতিত হয়েছে। মোবাইলটা হঠাৎ করে পড়ায় নাকে লেগেছে একটু। মিতুল মোবাইলটা বিছানা থেকে হাতে তুলে নিলো। মোবাইল স্কিনে চোখ দিয়ে মিতুলের চোখে বিস্ফোরণ ঘটলো। ভেবেছিল মা, অথবা ভাইয়েরা কল করেছে। কিন্তু জোহানের নামটা দেখে ওর সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল অগ্নিতাপে। জোহানের কলটি কেটে গেল রিং হয়ে। এই জোহান সব সময় ওর ভালো ভালো সময়গুলোতে এসে ডিস্টার্ব করে। রোমান্টিক মুহূর্তে এসেও নিজের বাম হাত ঢুকিয়ে দিলো এখন।
আবার কল এলো জোহানের। এই কল ও ধরবে, এটা ভেবে যদি বসে থাকে জোহান, তাহলে ভুল সেটা। মিতুল ওর কলটা এক চাপে কেটে দিলো। তারপর আবারও নিজের কার্লকে দেখায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু এই মনোযোগ কী আর জোহান রাখতে দেয়! জোহান ম্যাসেজ পাঠালো,
‘তোমার সাহস দেখছি ইদানীং খুব বেশি বেড়ে যাচ্ছে! আমার কল কেটে দেওয়ার দুঃসাহস হয় কীভাবে তোমার?’

ম্যাসেজটা দেখে মিতুলের মেজাজ চরমে উঠলো। ও কতগুলো ঘুষির ইমোজি পাঠিয়ে দিলো জোহানকে। তারপর আবার ব্যাক করলো নিজের গ্যালারিতে।
সঙ্গে সঙ্গেই জোহানের ম্যাসেজ এলো আবার।
‘আমি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি তোমার সাথে। আর তুমি কতগুলো অহেতুক ইমোজি পাঠাচ্ছ আমায়? তোমার দেখছি আসলেই সাহস বেড়ে যাচ্ছে!’

জোহানের ম্যাসেজটা দেখে মিতুল শ্লেষপূর্ন গলায় বললো,
“আরে আহাম্মক, তোকে অহেতুক ইমোজি পাঠাচ্ছি না আমি। সামনাসামনি তোকে মারতে পারব না বলে, এভাবে ঘুষি মারছি তোকে। তুই এতটাই বেকুব যে এটাও বুঝতে পারছিস না?”

ঘটাঘট আবারও জোহানের ম্যাসেজ এলো,
‘কী হলো? কোনো রেসপন্স করছো না কেন? আমার কথাবার্তা কি তোমার কাছে গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে? আমাকে গুরুত্বহীন বানাতে চাইছো তুমি?’
জোহানের ম্যাসেজ দেখে মিতুলের এখন ক্লান্ত লাগছে। ও আর কিছু বললো না জোহানকে। না কিছু লিখে পাঠালো, আর না কোনো ঘুষির ইমোজি পাঠালো। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখে চোখ বুঝলো ও।

_____________

“তোমার ফ্লাইট তো দুপুর বারোটায়। এখনই সব কিছু তাড়াহুড়ো করে গোছগাছ করছো কেন?”
জোহানের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিলা।

পর্দা সরিয়ে রাখা জানালা অতিক্রম করে সকালের স্নিগ্ধ রোদ্দুর এসে পড়েছে জোহানের মুখে। জোহান সাদা রঙের একটা শার্ট লাগেজে রাখতে রাখতে বললো,
“আগে তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে রাখছি কারণ, চাই না পরে তাড়াহুড়ো করে গোছাতে গিয়ে কিছু একটা ভুলে যাই।”

“তাই বলে এত সকাল সকাল?”

“হ্যাঁ। পরে যেটা করতেই হবে, সেটা আগে করে রাখাই ভালো না?”

“হ্যাঁ, সে ভালো। কিন্তু আমাকে কেন ডাকলে? নিজের লাগেজ তো তুমি নিজেই গোছাও সবসময়।”

“লাগেজ গোছাতে ডাকিনি তোমায়। তোমায় তো অন্য কারণে ডেকেছি আমি। লুক অ্যাট মি…” জোহান নিজের ঠোঁটের কোণে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো,
“এই জায়গাটা দেখে কি মনে হবে যে আমি মার খেয়েছি? ক্ষতটা তো হালকা হয়ে গেছে। এটা দেখে কি এখনও বোঝার উপায় আছে আমাকে কেউ মেরেছে? মানে মুখের অন্য দাগ গুলো তো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাও কানের পাশটায় একটু আছে, সেটা কনসিলার দিয়ে ঢেকে দেবো। কিন্তু এই জায়গাটা নিয়েই তো সমস্যা। এটা দেখে কি বোঝা যায় আমি মার খেয়েছি?”

জোহানের ঠোঁটের কোণে আঘাতের চিহ্নটা একটু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ক্যামিলা তা ধরা দিলো না। সে চোখ সরু করে দেখতে দেখতে বললো,
“দেখো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি এই বিষয়ে মিতুলের সাহায্য নিতে পারো। ওকে কি আমি..”

“নো সিস, ওর কথা উঠিয়ো না। ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে।”

“বেয়াদবি? কী বেয়াদবি করেছে তোমার সাথে?”

“কালকে আমি ওকে কল দিয়েছি। ও কল রিসিভ করেনি আমার। ম্যাসেজ পাঠিয়েছি, ও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। চরম বেয়াদবি করেছে ও আমার সাথে।”

“কল রিসিভ না করার কারণ ছিল নিশ্চয়ই।”

“বুঝ দিতে এসো না সিস, বুঝ দিতে এসো না আমাকে। তুমি চেনো না ওকে। ও সাংঘাতিক মেয়ে!”

“বুঝতে পেরেছি তুমি রেগে আছো ওর উপর। ঠিক আছে আমি এখন যাচ্ছি।”

ক্যামিলা জোহানের ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলো। জোহান ডেকে উঠলো,
“সিস…”

ক্যামিলা পিছন ফিরে বললো,
“হোয়াট?”

জোহান একটু দোনামনা করে বললো,
“পাঠিয়ে দাও মিতুলকে আমার রুমে।”

জোহানের কাণ্ডে ক্যামিলা হেসে ফেললো। কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
প্যাসেজ ওয়ে থেকে দেখতে পেল মিতুল কিচেনে ঢুকছে। ক্যামিলা কিচেনে চলে এলো।

মিতুল ক্যামিলাকে দেখে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“মিতুল, তুমি একটু সাহায্য করতে পারবে আমাকে?”

“কী সাহায্য?”

“জোহানকে একটু হেল্প করতে পারবে? ও আমাকে ডেকেছিল। কিন্তু আমাকে এখন ব্রেকফাস্ট রেডি করতে হবে। তো আমার হয়ে তুমি ওকে একটু সাহায্য করো।”

জোহানকে হেল্প করে দিতে নারাজ মিতুল। কিন্তু ক্যামিলার মুখের উপর সে কথা বলতে পারলো না। ক্যামিলার মুখের উপর না করে দেওয়া তো অভদ্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়।মিতুল বললো,
“ঠিক আছে, ওকে হেল্প করবো আমি। কিন্তু কী বিষয়ে হেল্প করতে হবে ওকে?”

“গিয়েই দেখো একটু, কী হেল্প লাগে।”

মিতুল জোহানের রুমের দরজায় নক করলো। সাহায্যের জন্য মানুষ ডেকে এখন আবার দরজা বন্ধ করে রেখেছে? কেমন বেয়াদব? মিতুল এবার জোরে আঘাত করলো। দরজা খুলে গেল। মিতুল কঠিন মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হেল্প লাগবে তোমার?”

“রুমে প্রবেশ করো।”

মিতুল রুমে ঢুকলো।

জোহান নিজের ঠোঁটের কোণে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো,
“এই জায়গাটা দেখলে কি বোঝা যায় যে আমি মার খেয়েছি?”

“হুম, বোঝা যায়। না বোঝার কী আছে? তুমি যে মার খেয়েছো, সেটা একটা পাগলও দেখলে বুঝে যাবে।”

মিতুল বাড়িয়ে বললো। জোহানের ক্ষত অতটাও গাঢ় নয়। হালকা হয়ে গেছে। আর একটু ক্ষত তো যে কোনো কারণে হতেই পারে। মার খেলেই যে কেবল ক্ষত হবে, এমনটা তো নয়।
মিতুল যে বাড়িয়ে বলছে সেটা জোহানও বুঝতে পারলো। আর তাই বললো,
“বাহ! বাংলাদেশি মেয়েরা তো হাত হলে, পা বানিয়ে ফেলতে পারে দেখছি। এসব প্রতিভা তো ওদের ভালোই আছে।
এখন তুমিই বলো, বাংলাদেশি মেয়েদের গুনগান আমি কীভাবে গাইতে পারি?
নাহ, বাংলাদেশি মেয়েদের এই জীবনে বিশ্বাস করা যাবে না।
আর হ্যাঁ, যাওয়ার সময় বাংলা বলার চেষ্টা করবে না একদম। আমি বাংলা পারি না বলে দুর্বল ভাববে না আমাকে। ওদিকে দেখো। তিন তিনটা বাংলা শেখার বই আছে আমার কাছে। খুব দ্রুত বাংলা শিখে তোমায় দেখিয়ে দেবো আমি।”

মিতুল এবার বাংলাতে গটগট করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, আমিও দেখতে চাই তোমার মতো অকর্মণ্য, বদমাইশের মুখে কী বাংলা ফোঁটে। পারবে তো শুধু ‘চু-চু’ করতে। ‘চুবিয়ে’ আর বলতে পারবে না।”

বলেই মিতুল বেরিয়ে গেল।

জোহান বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লো। দিশেহারা লাগছে ওর। মেয়েটা বাংলা বলে বলে পাগল বানিয়ে ফেলবে ওকে।
না, বাংলা না শিখে থাকা যাবে না আর। এই বেঙ্গলি লিটল গার্লটির জন্য হলেও ওকে বাংলা শিখতে হবে দ্রুত।

(চলবে)