চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা পর্ব-১২+১৩

0
364

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১২
____________

আশেপাশে অসংখ্য কবর। সারি সারি কবরের অনেকটা দেখে পুরোনো মনে হচ্ছে। চার, পাঁচ বছরের মতো হবে বোধহয়। আশেপাশে কেবল বিশাল লম্বা লম্বা গাছ। গাছের বেড়াজালে আটকানো এই জঙ্গল থেকে বাইরে দৃষ্টি যাওয়া একেবারে অসম্ভব, দুষ্কর। শুধু দেখা যাচ্ছে কাক ভোরের ঝাপসা অন্ধকারের মতো ঘোলাটে কালো পরিবেশ এবং সারি সারি গাছ। আশেপাশেই অনেক পোকা মাকড় ডাকছে। কয়েকটা পাখিও ডাকছে। পাখির ডাক গুলো ভয়ংকর। শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। যেন মৃত্যুর বাণী শোনাচ্ছে কানে কানে। মৃত্যু! হ্যাঁ, মিতুলের মাথায় কেবল একটা শব্দই ঘুরছে এখন। সেটা হলো, ‘মৃত্যু’। এত দ্রুত মৃত্যুর নিকটে এসে পৌঁছে যাবে ভাবতে পারেনি ও। মিতুল বিশাল লম্বা, মোটা আকৃতির একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা। বসা বললে ভুল হবে। বসা নয়, বসতে বাধ্য! একটা মোটা দড়ি দিয়ে ওর শরীর গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। এই দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে এখান থেকে ছুটে পালানো একটা দুঃস্বপ্নের মতো।
মিতুলের গায়ের মেজেন্ডা কালারের টপসটা ধুলোয় মাখামাখি। স্কার্টেরও একই অবস্থা। মুখের অসংখ্য জায়গা লালবর্ণ ধারণ করেছে রক্তে। ঠোঁটের কোণের রক্ত বাঁধ না মেনে গড়িয়ে পড়েছে। একেকটা শ্বাস টেনে তুলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। শরীর অসহ্য যন্ত্রনায় অসাড় হওয়ার মতো। মাথাটা শূন্য, ভীষণ শূন্য! হিতাহিত কোনো চিন্তা এখন মাথায় ঘোরার মতো নয়। শুকনো পাতার উপর দিয়ে হেঁটে আসার মড়মড়ানি শব্দ মিতুলকে জানান দিলো এই পৃথিবীতে ওর সময় খুব অল্প। খুব খুব অল্প! মিতুলের চোখ থেকে উষ্ণ গরম অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাথা তুলে সামনে তাকালো।
সমাধি ক্ষেত্রের মাঝের ফাঁকা সমতল জমিন ধরে একজন এগিয়ে আসছে। গায়ের কালো পোশাকে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা। ফর্সা মুখটা দেখা যাচ্ছে শুধু। হাতে ধরে আছে ধারালো ছুরি। ছুরিটা দেখে মিতুলের হৃদয় কাঁপতে লাগলো। এটা যেই সেই কাঁপন নয়, মৃত্যুর কাঁপন!
মিতুল দুই চোখ বন্ধ করে ফেললো। ক্ষণিকের ভিতরেই খুললো আবার।
মানুষটি নিকটে এসে গেছে। মিতুলের সামনে দুই পায়ে ভর করে বসলো সে। মিতুলের ভীত, অসহায় মুখখানি দেখছে। মিতুলও তাকিয়ে রইল মানুষটির মুখের দিকে। বড্ড অচেনা এই মুখ, বড্ড! ও তো এই মুখ চেনে না। ও চিনতো এক হাস্যজ্জ্বল যুবক মুখ। কিন্তু কোথায় সেই মুখ? সেই মুখ তো দেখতে পাচ্ছে না এখন। এ যে বড্ড অপরিচিত মুখ। ভয়ংকর এক মুখ। দুই চোখ যেন প্রাণহীন। ওই চোখে কোনো মায়া নেই। আছে কেবল নির্মমতা। মিতুলের ভাবতে খুব কষ্ট হয় যে এই প্রাণহীন, নির্মমতা ঘেরা চোখ জোড়া জোহানের। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এটা ভাবতে। বুকটা ঘৃণায় ভরে যাচ্ছে। মিতুল খুব করে এই নির্মম বাদামি চোখ জোড়ার জোহানকে বলতে চাইছে,
‘প্লিজ জোহান। প্লিজ আমাকে মেরো না! আমি কানাডা ছেড়ে আজকেই চলে যাব। কারো কাছে কিচ্ছু বলবো না। আর কোনোদিন তোমাদের আশেপাশেও আসবো না। প্লিজ, ছেড়ে দাও আমায়। প্লিজ…’
কিন্তু মিতুলের মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ও কেবল অসহায়, ভয়ার্ত মুখ নিয়ে জোহানের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিতুলের এই রকম চেহারা দেখে জোহান হাসছে। কী ভয়ংকর সেই হাসি! রক্ত হিম হয়ে যায়। ওর ঠোঁট হাসছে ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ দুটো সেই প্রাণহীন। না এই হাসির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! মিতুল চোখ নামিয়ে ফেললো।

এর মাঝেই জোহানের শীতল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কী দরকার ছিল এই জঙ্গলের ব্যাপারে নাক গলানোর? কানাডা ঘুরতে এসেছো, কানাডা ঘুরেই চলে যেতে। আমার এই অন্ধকার রাজ্যের ব্যাপারে নাক গলানো একেবারে উচিত হয়নি তোমার। একেবারেই নয়। ভুল করেছ তুমি, চরম ভুল…”

মিতুল কাঁদো গলায় ফরিয়াদ করে বলে উঠলো,
“ক্ষমা করো আমায়। ক্ষমা করে দাও আমায় জোহান। আমি জানতাম না এখানে ঠিক কী আছে। যদি জানতাম, তাহলে জীবনেও আসতাম না। আমাকে মাফ করো। কথা দিচ্ছি, কাউকে কিচ্ছু বলবো না। ক্ষমা করে দাও আমাকে। তোমার পায়ে পড়ছি!”

“উহু, নো। কোনো ক্ষমা পাবে না তুমি। যারা যারা আমার এই জঙ্গলে পা রেখেছে, তাদের সবার একটাই শাস্তি হয়েছে। সেটা শুধু, মৃত্যু!”

“আমি মরে গেলে আমার মা, বাবা, ভাইয়েরা খুব কাঁদবে জোহান। আমার বড়ো ভাইটা তো কাঁদতে কাঁদতে আধমরা হয়ে যাবে। দয়া করো। মেরো না আমায়।”

জোহান মিতুলের চোখের পানি মুছে দিলো। মিতুলের মাথায় এক হাত রেখে অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আই অ্যাম স্যরি মিতুল। আই হ্যাভ নো ওয়ে। তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে আমি নিজের মৃত্যুর পথ এভাবে খুলে রাখতে পারি না। এটাকে তুমি মৃত্যু ভেবো না। মনে করো আমার জীবন বাঁচিয়ে রাখতে, তুমি তোমার জীবন উৎসর্গ করেছো। ওদিকটায় দেখো…”

জোহান হাত দিয়ে সমাধি ক্ষেত্রের এক দিক দেখিয়ে বললো,
“এরা সবাই তোমার মতো আমার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তুমি চিন্তা করো না। এদের খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছিলাম আমি। তোমায় সেই কষ্টটা দেবো না। ছুরিটা একেবারে ঠিক তোমার হৃদপিণ্ড বরাবর আক্রমন করবে। তুমি খুব সহজেই মারা যাবে। খুব বেশি কষ্ট হবে না। বিশ্বাস করো আমায়। আমি এ বিষয়ে খুবই দক্ষ। এতগুলো প্রাণ নিজ হাতে ধ্বংস করেছি আমি। খুব বেশি কষ্ট হবে না তোমার। ট্রাস্ট মি!”

মিতুলের চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু ধারা ঝরতে লাগলো। অসহায় গলায় ডেকে উঠলো,
“জোহান…”

“আই অ্যাম স্যরি। রিয়েলি স্যরি। আমি মারতে চাইনি তোমাকে। কিন্তু তুমি নিজ থেকেই নিজের মৃত্যুর দুয়ারে এসে কড়া নেড়েছো। আমি উপায়হীন। তোমাকে মারা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। স্যরি…”

বলতে বলতে জোহান ছুরি উঠালো মিতুলকে আঘাত করার জন্য। মিতুল দুই চোখ খিঁচে ধরে, জীবনের সব থেকে বড়ো আত্মচিৎকার করলো,
“না…”

সমগ্র জঙ্গল কেঁপে উঠলো মিতুলের আত্মচিৎকারে।

আর সেই আত্মচিৎকার এতটাই বিকট ছিল যে, মিতুলের ঘুমকেও নাড়িয়ে দিলো সেই চিৎকার। মিতুল ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বুক দ্রুত ওঠা নামা করছে। নিশ্বাস পড়ছে ভারী এবং ঘন। শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। মস্তিষ্কে অসহ্য যন্ত্রনার উপলব্ধি।
কী… কী দেখলো এই মাত্র? কী ছিল এটা?
মিতুল আশেপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলালো। কোথায় জঙ্গল? কোথায় জোহান? এ তো ওর বেড রুম। স্বপ্ন ছিল? কোনো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছে ও? মিতুল বুকের উপর দু হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। যাক বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছে এবারের মতো। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল! আল্লাহ অনেক রহমত তোমার!
মিতুল কেঁদে দিলো।
জঙ্গলের দৃশ্যটা ভেসে উঠছে চোখে। আহ! কী ভয়াবহ ছিল!

ধীরে ধীরে মিতুলের কান্না থামলো। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। কিন্তু মাথায় নতুন চিন্তার উদ্ভাবন ঘটলো। কী মানে ছিল ওই স্বপ্নের?
মিতুলের চোখে স্বপ্নের জোহানের সেই ভয়ংকর মুখ, হাসি ভেসে উঠছে। আবার সেই সাথে বাস্তবের জোহানের বাচ্চা বাচ্চা হাসি মুখও ভেসে উঠছে। মিতুল নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে বিড়বিড় করে একবার বললো,
‘মিতুল, এটা কেবলই দুঃস্বপ্ন ছিল। বাস্তবের জোহান আর স্বপ্নের ওই হিংস্র জোহান এক নয়।’

______________

মিতুল ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে নিচে নামলো। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। ওই জঙ্গল নিয়ে ভাবতে ভাবতে এখন এমন ভয়াবহ দুঃস্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে। আর মাথার অবস্থাও কাহিল! এই বাড়িতে থাকতেও কেমন ভয় করছে এখন। খুব বড়ো একটা গড়বড় আছে ওই জঙ্গলে! জানে না ঠিক স্বপ্নের মতো এমন কিছু আছে কি না, তবে কিছু একটা আছে সে বিষয়ে ও নিশ্চিত। আর সেসবের পিছনে কি সত্যিই জোহান আছে? কোন কেস? যদি মার্ডার কেস হয় তাহলে তো…
মিতুল ভাবতে পারলো না আর। মস্তিষ্কে অধিক চাপ পড়ছে। না, এই জঙ্গল নিয়ে এখন ভাববে না একদম। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ঠিক কী আছে ওই জঙ্গলে?

মিতুল এসব ভাবতে ভাবতেই লনে চলে এলো সকালের মুক্ত বাতাস গায়ে জড়াতে। প্রথমেই ওর চোখ পড়লো লনের চেরি ব্লসম ট্রি গুলোর উপর। গাছে এখনও অনেক চেরি ব্লসম আছে। খুব ধীরে ধীরে ঝরছে ফুল গুলো। মনে হচ্ছে পুরো বসন্ত জুড়েই নিজেদের বিচরণ রাখতে চাইছে। মিতুলের হঠাৎ ভ্যাঙ্কুভারের কথা মনে পড়লো। রেশমী আন্টি বলেছিলেন বারবিকিউ পার্টির পরে ভ্যাঙ্কুভার নিয়ে যাবেন। মিতুলের ইচ্ছা করছে এখনই একটা প্লেন ধরে ভ্যাঙ্কুভার চলে যায়। ভ্যাঙ্কুভারের চেরি ব্লসমের রাজ্যে হারায় বহু দিনের জন্য। কিন্তু বলা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন। বললেই তো আর এক দৌঁড়ে ভ্যাঙ্কুভার চলে যাওয়া যায় না।
মিতুলের মনটা আকুপাকু করছে ভ্যাঙ্কুভার যাওয়ার জন্য। মিতুল গাছের ছায়ায় থাকা ইজি চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল। মাঝের চেয়ারটায় বসলো। সাথে এখন মেহরিন থাকলে ভালো হতো। মেহরিন হলো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। এই বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্যই ও মা, আব্বুর সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে ঢাকা ছেড়ে রাজশাহী ভর্তি হয়েছে। ইশ, এখন যদি সাথে মেহরিন থাকতো তাহলে কতই না ভালো হতো। দুই বান্ধবী একসাথে কানাডা ঘুরে বেড়াতো। শপিং করতো, রেস্টুরেন্টে গিয়ে এক সাথে খেতো। কার্লকে নিয়ে কথা হতো দুজনের মাঝে সারাদিন। কতই না ভালো হতো।
ইতোমধ্যে মেহরিনকে কার্লের ব্যাপারে সব বলে দিয়েছে। মেহরিন কার্লের ছবি দেখতে চেয়েছে।
মিতুল ভাবছে আজকে কার্লের রেস্টুরেন্টে গিয়ে, কার্লের অগোচরে একটা ছবি তুলবে। মেহরিনকেও পাঠানো হবে, আবার যখন তখন কার্লকে মনে পড়লে নিজেও দেখতে পারবে।

লনে জোহানের আগমন মিতুলের ফুরফুরা মনটাকে হঠাৎ কালো রঙে ছেয়ে দিলো। মিতুলের মনে পড়লো, স্বপ্নের কথা। এই জোহান ওকে কীভাবে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করেছিল! যদিও করতে পারেনি। তার আগেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করতে তো নিয়েছিল!

জোহান লনের এদিক ওদিক ঘুরঘুর করলো কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেল।
খানিক ক্ষণ বাদে মিতুলের মোবাইলে জোহানের থেকে একটা ম্যাসেজ এলো।

‘কী ভেবেছিলে তুমি, তোমার সাথে কথা বলতে আমি লনে গিয়েছিলাম? মোটেই না। তোমার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। আজকে একটা কথাও বলবো না আমি তোমার সাথে। কিন্তু তুমি আমাকে এমন ভাবে দেখছিলে কেন? আমি তো লক্ষ্য করেছি, তুমি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে একটানা। আড় চোখে আমাকে দেখছিলে কেন? আমি তো বলেছিলাম আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা আমি একদম পছন্দ করি না। কি বলিনি? শোনো, আর কখনো ওভাবে তাকিয়ে থাকবে না আমার দিকে। বুঝেছো? আর আজকে কোনো কথাও বলতে আসবে না আমার সাথে।’

জোহানের ম্যাসেজ পড়ে মিতুল থ হয়ে গেল। কখন আড় চোখে জোহানের দিকে তাকালো ও? তাও না কি আবার একটানা! যে সময় জোহান এসেছিল, সে সময় একবার একটু দেখে আর তো তাকায়ইনি জোহানের দিকে। ও তো মেহরিনের সাথে চ্যাটিং করছিল। কীসব বলছে এই জোহান?
মিতুল দ্রুত টাইপ করলো,
‘কখন তাকালাম আমি তোমার দিকে? কখন একটানা তাকিয়ে থাকলাম? কখন? নিজেকে কি ওয়ার্ল্ড হ্যান্ডসাম মনে করো তুমি? যে তোমার দিকে মানুষের তাকিয়ে থাকতে হবে?’

ম্যাসেজ সেন্ড করে দিলো মিতুল।

জোহানের থেকে এর প্রতিউত্তরে কোনো ম্যাসেজ এলো না। খানিকটা পর স্বয়ং জোহান নিজেই এসে হাজির হলো। এসেই গলায় বেশ জোর দিয়ে বললো,
“কোন সাহসে তুমি আমার সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলো? কোন সাহসে? তুমি জানো কত মেয়ে আমার জন্য পাগল? দিনে দুই, তিনশ মেয়ের প্রপোজাল আসে আমার কাছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারি না আমি মেয়েদের জ্বালাতনে। দেখেছ আমাকে কখনো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে? আমি হাঁটি না। আমি রাস্তা দিয়ে কখনও পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারি না। সব সময় আমাকে কার ইউজ করতে হয়। মাঝে মধ্যে যখন ক্লাবে যাই, মেয়েরা তখন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে আমাকে। আমার তখন পালিয়ে আসতে হয় ক্লাব থেকে। এত এত মেয়ে আমাকে প্রোপজ করে যে, কাকে রেখে কার সাথে ডেট করবো সেটাই ভেবে উঠতে পারি না আমি। আর তুমি আমার সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলো?”

মিতুল হা হয়ে জোহানের কথা গিলছিল। একটা মানুষ কীভাবে এমন বানোয়াট কথা বলতে পারে? মিতুল বললো,
“তোমার জন্য যদি এত মেয়েই পাগল থাকে, তাহলে একটা পাগলের কারখানা তৈরি করলেই পারো। তাহলে এত ভোগান্তি হবে না তোমার। যে যে মেয়ে পাগল হবে তোমার জন্য, সেই মেয়েগুলোকে এনে ওই কারখানায় রাখবে। তারপর একটা একটা করে সিরিয়াল দিয়ে প্রেম করবে। দেখবে কোনো ভোগান্তিই হবে না।”

জোহান মিতুলের কথার বিদ্রূপটা বুঝতে পারলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ, সেটাই করবো আমি। একটা পাগলের কারখানাই তৈরি করবো। আর আমার সেই কারখানার প্রথম মেম্বার হবে―তুমি!”
জোহান মিতুলের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশন করলো।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৩
____________

মিতুল ইজি চেয়ারে বসে আছে। তিনটা ইজি চেয়ারের মাঝের চেয়ারটা ফাঁকা। ওপাশের ইজি চেয়ারে জোহান।
জোহানের মুখে ফেস প্যাক লাগানো। ইজি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছে। চোখ বুজে থাকলেও মিতুল যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে ও।
“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খুব শীঘ্রই আমার পাগলের কারখানায় এডমিট হতে চাইছো বুঝি?”

মিতুলের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হলো। চোখ সরিয়ে নিলো জোহানের থেকে। আবার তাকালো। বললো,
“তোমার ওই পাগলের কারখানা নিয়ে তুমিই থাকো। ওখানে এডমিট হওয়া তো দূরের থাক, তোমার ওই কারখানার হাজার হাজার মাইল দূরত্বেও আমার পদচিহ্ন পাবে না।
আমি তো শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে এত সকাল সকাল তোমার রূপ চর্চার মানে খুঁজছিলাম। সকাল সকাল এত রূপচর্চা করার মানে কী?”

জোহান চোখ বুজেই বললো,
“তুমি আর রূপচর্চা করার কী মানে বুঝবে? হাজার হাজার মেয়ে তো ঘোরে আমার পিছন পিছন। আমি জানি চেহেরার যত্ন আত্তি করা কতটা জরুরি।
বাই দ্য ওয়ে, কালকে রাতটা কেমন ছিল?”

“মানে?”

“কালকে রাতের বারবিকিউ পার্টির কথা বলছি আমি। কেমন ছিল কালকের বারবিকিউ পার্টি?”

মিতুলের কালকে রাতের কথা মনে পড়ে গেল। কালকে রাতে বারবিকিউ পার্টি হয়েছিল। রেশমী আন্টির এক নেইবরহুডের বাড়িতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। তাদের লনটা বাকি সবার লনের থেকে বেশ দীর্ঘ বলে, সেখানেই বেশি পার্টির আয়োজন করা হয়। আশেপাশের অনেক প্রতিবেশীরা এক সাথে জড়ো হয়েছিল সেখানে। বাতাসে বারবিকিউ’র লোভনীয় সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। মানুষের সমাগম ছিল বেশ ইনজয়অ্যাবল। মিতুল বললো,
“হুম, ভালো ছিল।”

“ভালো থাকবে না! দেখলাম তো সবই। একটা ছেলের সাথে খুব হাসাহাসি হচ্ছিল। পার্টি ফুরিয়ে যায়, অথচ তোমাদের দুজনের কথা ফুরোয় না।”

জোহানের কথা শুনে মিতুল অবাক।
“কোন ছেলে? কার কথা বলছো তুমি?”

“ভাণ করো না একদম। আমি নীল চোখের কথা বলছি।”

মিতুল বুঝতে পারলো জোহান কার কথা বলছে। পার্টিতে পরিচয় হয়েছে ছেলেটার সাথে। খুব অমায়িক ছিল।
“ওর সাথে আমি মাত্র আট, নয় মিনিটের মতো কথা বলেছি। আর তুমি সেটাকে পুরো পার্টি বানিয়ে দিলে? আর আমি পুরো পার্টি জুড়ে কথা বললেও তোমার কী? তুমি যে ওই বাড়ির মেয়েটার সাথে বলতে গেলে এক প্রকার নাচানাচি করছিলে, সেটা কী? কেউ কিছু বলেছে তোমায়? তাহলে তুমি মানুষের ব্যাপারে কেন নাক গলাচ্ছ?”

মিতুলের কথা শুনে জোহান আর স্থির থাকলো না। চেয়ারের সাথে হেলিয়ে দেওয়া মাথাটা চকিতে সোজা করে উঠে বসলো।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মিতুলের দিকে।

মিতুল জোহানের এমন করে তাকানোর মানে বুঝতে পারছে না। তাই বললো,
“এমন ভাবে কী দেখছো?”

“কালকে রাতে মদ টড কিছু খেয়েছো না কি তুমি? আই মিন ভদকা, বিয়ার, ওয়াইন এমন কিছু?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মেজাজ দেখিয়েই বললো,
“আমাকে কি তোমার মতো মদখোর মনে হয়?”

“যদি মদই না খেয়ে থাকো, তাহলে এমন কথা কেন বলছো? ওই মেয়েটার সাথে আমি নাচানাচি করলেই বা কী? শী ইজ লাইক অ্যা মাই ইয়াংগার সিস্টার। আমরা ছোট বেলা থেকে এক সাথে বড়ো হয়েছি। আমাদের এক সাথে নাচানাচি করা স্বাভাবিক।”

“তাহলে ওই ছেলেটার সাথে আমার কথা বলাটা কি অস্বাভাবিক?”

“অবশ্যই। না ছেলেটা তোমার ছোট ভাইয়ের মতো, আর না তোমরা এক সাথে বড়ো হয়েছো। সুতরাং এটা অস্বাভাবিকই।”

বলতে বলতে জোহান ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখের ফেস প্যাক শুকিয়েছে কি না চেক করতে করতে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিছুটা দূর গিয়ে থামলো আবার। পিছন ফিরে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার চেহেরার অবস্থা ভালো নয়। আধমরা লাগছে দেখে। আমার সাথে এসো ফেস প্যাক লাগিয়ে দেবো তোমার মুখে। কাম, কাম।”
জোহান হাত দিয়ে মিতুলকে নিজের সাথে আসতে ইশারা করে আবার হাঁটতে লাগলো।

অপমানে মিতুল বাকরুদ্ধ হয়ে পাথরের ন্যায় বসে রইল। আধমরা? এতদিন এটা ওটা নিয়ে অপমান করে, শেষ পর্যন্ত চেহারা নিয়েও অপমান করলো?

_____________

দরজায় একের পর এক করাঘাত হচ্ছে। মিতুলের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যাচ্ছে করাঘাতের শব্দে। দরজার ওপাশের ব্যক্তিটি একের পর এক করাঘাত করেই চলেছে। থামার নাম গন্ধ নিচ্ছে না।
মিতুলের ঘুমটা একেবারেই ভেঙ্গে গেল। মিতুল মনে মনে একশটা কথা শোনালো দরজায় করাঘাত করা ব্যক্তিটিকে। তারপর এগিয়ে গেল দরজা খুলতে।
দরজা খুলতেই জোহানের ব্যস্ত কণ্ঠ শোনা গেল,
“তুমি এখনও রেডি হওনি? কী করছিলে এতক্ষণ? পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলে? পার্টিতে যাব কখন আমরা? পার্টি শেষ হলে?”

“পার্টি? কীসের পার্টি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মিতুল।

“এতদিন জানতাম তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা খুব বেশি বোকা। কিন্তু আজ জানলাম তোমরা বোকার পাশাপাশি খুব বেশি স্মৃতিভ্রষ্টও। বিকাল পাঁচটা নাগাদ তোমায় আমি ম্যাসেজ করে সব জানিয়ে দিলাম। কোথায় পার্টি, কী উপলক্ষে পার্টি, আমরা কখন যাব, সব। আর তুমি এখন আমায় জিজ্ঞেস করছো কীসের পার্টি? শোনো মাত্র দশ মিনিট সময় পাবে তুমি। এর ভিতর রেডি হয়ে সোজা গ্যারেজে চলে যাবে। ও কে?”

জোহান যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ালেই, মিতুল বললো,
“দাঁড়াও।”

জোহান দাঁড়ালো। পিছন ফিরতেই মিতুল বললো,
“কী ভাবো কী তুমি নিজেকে? তুমি যা অর্ডার করবে সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে?
একটা ম্যাসেজ দিয়ে জানাবে পার্টিতে যাবে, আর আমি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে তোমার সাথে চলে যাব? যাব না আমি। দশ মিনিট কেন, দশ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও গ্যারেজে উপস্থিত হবো না। আমার চেহেরা দেখে না আধমরা মনে হয়? তাহলে কেন এই আধমরা চেহারার মেয়েটিকে নিয়ে তুমি পার্টিতে যাবে? নিজের জীবন্ত, প্রাণবন্ত, সতেজ চেহারা নিয়ে একাই চলে যাও।”

বলে জোহানের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো মিতুল। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।
রাগে হাত পা নিশপিশ করছে। এখানে এসে অপমান আর মানুষের হুকুম কুড়াতে হচ্ছে ওকে। এত এত অপমান করতে জানে এরা! শেষ পর্যন্ত চেহারা নিয়েও অপমান করলো!

মিতুল একই জায়গায় স্থির বসে রইল অনেকক্ষণ। এর মাঝে দরজায় আবার করাঘাতের শব্দ হলো। মিতুলের মাথায় রক্ত উঠে গেল। আবার এসেছে বদমাইশটা? আসুক। খুলবে না এবার। নক করতে করতে মরে যাক ওখানে বসে।

“মিতুল, ওপেন দ্য ডোর…” ক্যামিলার কণ্ঠ কানে আসতে মিতুলের টনক নড়লো। দরজায় ক্যামিলা নক করছে? মিতুল দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ক্যামিলার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখা গেল দরজায়।
ক্যামিলা বললো,
“দ্রুত রেডি হয়ে নাও। বাইরে বের হবো তোমাকে নিয়ে।”

“বাইরে?”

ক্যামিলা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। কেন? যাবে না?”

মিতুল হেসে বললো,
“যাব না কেন, অবশ্যই যাব। গিভ মি জাস্ট ফিফটিন মিনিটস।”

“ও কে।”

ক্যামিলা মিতুলকে রেডি হওয়ার সময় দিয়ে চলে গেল।
পনেরো মিনিটের জায়গায় মিতুলের বিশ মিনিট লাগলো। মিতুল ছোট্ট করে একটা স্যরি বললো ক্যামিলাকে। ক্যামিলা বললো, কোনো ব্যাপার না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। মিতুল ক্যামিলার পাশে বসে আছে। রাতে শহরটাকে যেন দিনের বেলা থেকে অধিক সুন্দর দেখাচ্ছে। বাহারি আলোর সাজে মাতোয়ারা হয়ে আছে পুরো শহর। গাড়ি অনেকক্ষণ চললো। টুকিটাকি কথা হলো ক্যামিলার সাথে। হঠাৎ করে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করলো ক্যামিলা।
মিতুল বলেই ফেললো,
“কী ব্যাপার গাড়ি থামালে কেন?”

“জোহান আসবে।”

মিতুলের চোখ কপালে উঠলো।
“জোহান আসবে মানে?”

“হ্যাঁ। জোহানই তো বললো তোমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসতে। ও না কি তোমাকে নিয়ে পার্টিতে যেতে চেয়েছিল? তুমি না কি ওর সাথে রাগ করেছো, বলেছ পার্টিতে যেতে চাও না। সে জন্যই ও বললো যাতে আমি তোমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসি। ও তোমার রাগ ভাঙ্গাবে এবং পার্টিতে নিয়ে যাবে।”

মিতুলের মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। জোহান এভাবে টেকনিক খাটিয়ে ওকে এখানে আনলো? মিতুল মুখে কিছু বলতে পারল না, ভিতরে ভিতরে রাগে ফুসলো জোহানের জন্য। মিতুলদের কারের সামনে একটা কালো কার এসে থামলো। মিতুল চেনে এই কার। এই কার জোহানের।
ক্যামিলা পাশ থেকে বলে উঠলো,
“আরে ওই তো জোহান এসে গেছে।”

গাড়ি থেকে জোহানকে বের হতে দেখা গেল। জোহানের গায়ে সাদা শার্ট, তার উপর নীল কটি। পরনে নীল জিন্স। জোহানকে দেখে মিতুলের ভিতরটা রাগে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জোহান এসে মিতুলের সাইডের দরজাটা খুলে দিলো। মিতুলকে নামতে বললো।
মিতুল জোহানের দিকে তাকাচ্ছে না। জোহানের দিকে তাকাতে দু চোখ জ্বলে যাচ্ছে ওর।

জোহান আবারও বললো,
“মিতুল, বের হও কার থেকে।” জোহানের কণ্ঠ বেশ শান্ত শোনালো।

মিতুল আগের ন্যায় বসে রইল। জোহানের দিকে তাকালো না। জোহান মিতুলের রাগে ফুলো নাকটা দেখতে পাচ্ছে। মিতুল নিজ থেকে না নামার কারণে, জোহান মিতুলের হাত ধরে জোর পূর্বক টেনে নামালো মিতুলকে।
মিতুল হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইছে কিন্তু পারছে না। জোহান খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে।
ক্যামিলা গাড়ির ভিতর থেকে ওদেরকে সুন্দর একটি পার্টি ইনজয় করার শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেল। জোহান ক্যামিলার ছুটন্ত গাড়িটার থেকে চোখ এনে মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের চোখে রাগ, নাকেও রাগ। জোহান বললো,
“এত রাগ কোথা থেকে আসে তোমার?” জোহানের কণ্ঠ শান্ত।

মিতুল কিছু বললো না, শুধু দুই চোখে জ্বালা নিয়ে তাকিয়ে রইল।
জোহান একটু মিষ্টি হাসি উপহার দিলো মিতুলকে। মিতুলের কাছে ওই হাসি বিষের মতো মনে হলো। জোহান বললো,
“গেট ইন দ্য কার।”

জোহান মিতুলের হাত ধরেই কারের কাছে নিয়ে এলো। দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিলো মিতুলকে। এতক্ষণে মিতুলের হাতটা জোহানের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে মুক্তি পেল। জোহান দরজা বন্ধ করে দিলো। গাড়ির সামনে থেকে ঘুরে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। সিট বেল্ট বেঁধে লক্ষ্য করলো, মিতুল নিজের সিট বেল্ট বাঁধেনি। জোহান মিতুলের সিটবেল্ট বেঁধে দিলো।

“বাংলাদেশি মেয়েরা এত রাগী হয় সেটা আগে জানা ছিল না আমার।”
কথাটা বলতে বলতে জোহান গাড়ি ঘুরালো।

গাড়ির ভিতর মিতুল একেবারে নিশ্চুপ বসে রইল। ঠিক একটা পাথরের মতো। জোহান অনেক কিছুই বক বক করলো মিতুলের সাথে। কিন্তু মিতুলের কানে সেসব কিছুই ঢোকেনি। প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে জোহান নিজের গন্তব্যে এসে পৌঁছলো। একটা বড়ো এপার্টমেন্টের পার্কিং লটে এসে গাড়ি থামালো। সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নামলো।
মিতুল নিজ থেকে নামলো না। জোহান গিয়ে নামালো। মিতুলের মুখে এখনও বেশ জোরদার রাগ দেখা যাচ্ছে। জোহান গাড়ি লক করে বললো,
“চলো।”

মিতুল জোহানকে অনুসরণ করে লিফটে এলো। জোহান নয় নাম্বার ফ্লোরের বাটন চাপলো। লিফট উপরে উঠছে। মিতুল আগের মতোই নিশ্চুপ। জোহানের থেকে অনেকটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে ও। জোহান মিতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
“এভাবে কি চুপ করেই থাকবে তুমি? আমার বন্ধুরা তো ভাববে তুমি বোবা।”

জোহানের কথা কানে এলে মিতুল চোখ তুলে তাকালো। কী তেজ সেই তাকানোতে।
জোহান বললো,
“হেই তুলতুল, এমন করে তাকিয়ো না। এমন কঠিন চোখে কোনো মেয়ে তাকায় না আমার দিকে। তুমি আমার জীবনের ইতিহাস পাল্টে দিয়ো না।”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?” মিতুলের পাথুরে মুখটাতে কথা ফোঁটে। ভীষণ রুক্ষ কণ্ঠ।

“এ কি, বিকেলেই তো বললাম তোমাকে! তাছাড়া আসার আগেও তো বললাম পার্টিতে যাচ্ছি আমরা।”

“কী রকম পার্টি?”

“ম্যাসেজেই তো তোমাকে সব বললাম। তুমি কি ম্যাসেজ দেখোনি?”

“না।”

জোহানের বিশ্বাস হলো না। ও দ্রুত মোবাইল বের করে নিজের মোবাইল চেক করলো।
না ম্যাসেজ সিন হয়নি। জোহান এটা আগে একেবারেই খেয়াল করেনি।
জোহান মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো,
“এটা আমাদের ফ্রেন্ডস পার্টি। আমরা অনেক সময় এরকম পার্টি করে থাকি। আমার বন্ধু রিকার্ডোর ফ্ল্যাটেই সব সময় পার্টি হয়। রিকার্ডো এই অ্যাপার্টমেন্টের নয় নম্বর ফ্লোরে থাকে।”

“নিজেদের ফ্রেন্ডস পার্টিতে আমাকে আনলে কেন?”

জোহানকে অপ্রস্তুত দেখালো।
“এ-এনেছি আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই।”

মিতুল আর কথা বাড়ালো না। নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে রইল। লিফট নয় নম্বর ফ্লোরে এসে থামলো।
জোহানকে অনুসরণ করে রিকার্ডোর ফ্ল্যাটের দরজায় এসে থামলো মিতুল।
জোহান দরজায় নক করতে গিয়ে আবার থামলো। মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো। মিতুলের পরনে গ্লো পিঙ্ক কালারের ফোরাক, কালো সোয়েটার, জিন্স আর গলায় ওড়না পেঁচানো। কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ ঝুলছে। চুল খোলা। পাথরের একটা ক্লিপ শোভা পাচ্ছে চুলে। কানে ডায়মন্ডের ছোট দুল। মিতুলকে ভালো করে এক ঝলক দেখে নিয়ে দরজায় নক করলো জোহান। সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল। একজন চঞ্চল মুখের যুবক ছেলে জোহানকে হাগ করলো। তারপর মিতুলকে লক্ষ্য করে বললো,
“হাই! ইউ মিটুল, রাইট?”

মিতুল অবাক। ছেলেটা ওর নাম জানলো কীভাবে? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহান বললো,
“হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড রিকার্ডো।”

মিতুল রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“হ্যালো! নাইস টু মিট ইউ।”

রিকার্ডো ওদেরকে ভিতরে আসার তাগিদ করলো। বসার রুমে এসে মিতুল দেখলো অনেক ছেলে মেয়ে বসে আছে এখানে সেখানে। অনেকে এগিয়ে এসে জোহানকে হাগ করলো। এমনকি একটা মেয়েও হাগ করলো।
মিতুলকেও হাগ করলো সেই মেয়েটা।
মিতুল অবাক যে সবাই ওর নাম আগে থেকেই জানে। মিতুল হাসি মুখে সবার সাথে পরিচিত হলো। অনেক সময় নিয়ে আড্ডা চললো। খাওয়া দাওয়া হলো। কম বেশি সবাই ড্রিংক করলো। শুধু মিতুল বাদে। ওর জন্য কয়েকটা ফলের রস একসাথে মিক্সড করে বিশেষ একটা পানীয় তৈরি করা হয়েছিল, সেটা পান করলো ও। জোহানের ফ্রেন্ডস গুলোকে বেশ পছন্দ হলো মিতুলের। সবাই খুব সহজেই মিশে গেছে ওর সাথে। এদের মধ্যে এক জোড়া এনগেজড কাপলও আছে। জুটিটাকে বেশ ভালো লেগেছে মিতুলের। জেমস এবং সারা। জোহানের প্রত্যেকটা ফ্রেন্ডই খুব ভালো এবং মিশুক। মিতুল ভাবতে পারছে না জোহানের ফ্রেন্ডস গুলো এত ভালো, আর জোহান কি না একটা বদমাইশ। এই ফ্রেন্ডস গুলোর সাথে থেকেও একটু ভদ্রতা শিখলো না!
মিতুল এর মাঝে আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। সেটা হলো জোহানের এক মেয়ে ফ্রেন্ড, নাম লেনি। মিতুলের মনে হলো মেয়েটা জোহানকে অনেক পছন্দ করে। হয়তো কখনও জোহানকে বলেনি সে কথা। কিন্তু না বললেও জোহানের বোঝা তো উচিত। কিন্তু গাধাটাকে দেখো, ও এই লেনির সাথেই বেশি দুষ্টমি করে। এতটাই দুষ্টমি করে যে, লেনির অনুভূতি গুলোই হয়তো ওর দুষ্টমির নিচে চাপা পড়ে যায়।

(চলবে)