চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-১৪+১৫

0
375

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৪
_____________

আজ জোহানের মুখে গান শুনলো মিতুল। পার্টিতে থাকতে। বন্ধুদের অনুরোধে গান গেয়েছিল জোহান। রিকার্ডোর গিটার বাজিয়েছিল। গিটার বাজাতে তো আগেই দেখেছে, কিন্তু গান…
মিতুল ভাবতে পারছে না এই জোহান এত সুন্দর গান গাইতে পারে। বদমাইশটাকে দেখলে মনেই হয় না যে গান গাওয়ার মতো এত সুন্দর প্রতিভাও ওর আছে। গান গাওয়ার থেকে আরও বড়ো বিস্ময় ছিল, যে গানটা ও গেয়েছে, সেটা ওর নিজেরই লেখা। এটা মিতুলকে খুব খুব বেশি অবাক করেছে। গানের কথা গুলো মিতুলের কানে এখনও বাজছে।

‘You are my little angel,
You are my dream,
You are my only favorite in this long world!’

আর শুধু এতটুকুই নয়। মিতুল এর থেকে আরও বিস্ময়কর জিনিস শুনলো ওর ফ্রেন্ডসদের থেকে। জোহানের নিজস্ব গানের অ্যালবামও বের হয়েছে। মিতুল তো প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি কথাটি। কিন্তু যখন রিকার্ডো জোহানের গানের অ্যালবাম বের করে দেখালো, তখন বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। জোহানের গানের এলবামের নাম, ‘Guilty Summer’

জোহান তেমন ফেমাস নয়। ওর গানের কদর কম। আজকে মিতুল জোহানের স্বপ্ন সম্পর্কেও জেনেছে। জোহানের স্বপ্ন হলো, একটি ব্যান্ড গ্রুপে এড হওয়া। কিন্তু এই সুযোগটা আসে না ওর জন্য! এই প্রথম মিতুল একটু দুঃখ অনুভব করলো জোহানের জন্য। আহারে বেচারা! নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটছে অথচ স্বপ্নটা ধরা দিচ্ছে না।

জোহান মিতুলকে নিয়ে অনেক আগেই পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এখন প্রায় নিজেদের এলাকার কাছাকাছি এসে গেছে।
মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। জোহানের দৃষ্টি সামনে। দৃষ্টি সামনে থাকেলও মিতুল যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
জোহানের প্রতি যে রাগটা ছিল, সেটা এখন আর নেই মিতুলের। সে রাগ পার্টিতে বসেই শেষ। ওর বন্ধুদের সাথে পরিচিত হওয়ার পরই সেই রাগ পালিয়ে গিয়েছিল। মিতুল আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“এটা আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

“কোন বিষয়ে কথা বলছো?”

“তোমার গান।”

“এটা আগে জানানোর কী আছে? এটা কি আগে জানানোর মতো কোনো বিষয়?”

“নয় বলছো?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে, না থাকলে নয়।”
মিতুল বাইরে চোখ দিলো। নিরিবিলি রাস্তা। আজকে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে সুন্দর একটা চাঁদ। চাঁদের মোহনীয় আলোর মেলা আশপাশ সমস্তটা জুড়ে। দেখতে দেখতে গাড়ি চেরি ব্লসমের রাজ্যে ঢুকে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে চেরি ব্লসম ট্রি। ঘন নয়। পাতলা করে কয়েকটা গাছ আরকি। নিঝুম রাতে, জোৎস্না মেখে অপরূপ সৌন্দর্যে ঝরে পড়ছে চেরি পাপড়ি। এরকম অল্প অল্প করে না ঝরে, যদি গাছ থেকে সব পাপড়ি গুলো একসাথে ঝরে পড়তো, তাহলে কেমন হতো? মিতুল খোলা উইন্ডো থেকে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো।
হাতে একটা পাপড়ি এসে পড়তেই, হাত মুঠো করে আঁকড়ে ধরলো পাপড়িটা। বাইরে থেকে হাত নিয়ে এলো আবার কারের ভিতরে।
মুঠো খুলে পাপড়িটাকে দেখতে লাগলো। কী কোমল মনে হচ্ছে এই পাপড়িটাকে। যেন বিশ্বের সমস্ত সুখ নিজের এই ছোট্ট শরীরেই আবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু বিশ্বের যত সুখ তা তো কেবল মানুষ লুটছে। মানুষ ছুটছে আর ছুটছে কেবল সুখ পাওয়ার সন্ধানে।

গাড়ি হালকা ঝাঁকি দিয়ে ব্রেক কষলো আচমকা। মিতুল নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। প্রথমেই বিস্মিত চোখ জোড়া চলে গেল জোহানের মুখের উপর। তারপর জোহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে।
মিতুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। ও আবার তাকালো জোহানের দিকে। জোহানের মুখে হঠাৎ রাগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মুখটা কঠিন হয়ে আছে।
মিতুল জোহানের থেকে নিজের বিস্মিত চোখ জোড়া সরিয়ে, আবারও গাড়ির গ্লাস ভেদ করে সামনে তাকালো। গাড়ির সামনে চারটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। ওদের পথই আটকেছে ছেলে গুলো। মিতুল কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলে গুলো কেন ওদের গাড়ি থামালো?
জোহান দ্রুত ওর কারটা রাস্তার পাশে নিয়ে পার্ক করলো। তারপর ব্যস্ত গলায় বললো,
“কার থেকে নামবে না মিতুল, আমি আসছি।”

নিজের সিটবেল্ট খুলে দরজা খোলা দিলেই, মিতুল জোহানের এক হাত টেনে ধরলো।
“কী হচ্ছে এখানে? ছেলে গুলো আমাদের গাড়ি কেন থামালো?”

জোহান নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো,
“গাড়ি থেকে নামবে না। যাই হোক না কেন।”

মোবাইল, গাড়ির চাবি নিজের সিটের উপর রেখে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল জোহান।

মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
জোহান এগিয়ে গেল ছেলেগুলোর দিকে। রাস্তা বলতে গেলে প্রায় জনমানবহীন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না তেমন। মিতুলের ভয় করছে। ছেলেগুলোর এভাবে রাস্তা আটকানো মোটেই সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। মিতুল গাড়িতে বসে তাকিয়ে রইল সামনে।
জোহান ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছে। মিতুল শুনতে পাচ্ছে না ঠিক। একটু শব্দ পাচ্ছে শুধু। গাড়ির থেকে দূরে দাঁড়ানো ওরা।
মিতুলের চোখের সামনেই হঠাৎ একটা ভয়ংকর দৃশ্য ঘটলো। একটা ছেলে জোহানের পেট বরাবর ঘুষি মারলো! মিতুলের চোখ বিস্ময়, আতঙ্কে ছেয়ে গেল। ঘুষির জোর বেশি ছিল। জোহান নুইয়ে পড়েছে।
মিতুলের বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে। একেকটা হাতুড়ি পেটানোর শব্দ খুব ভয়াবহ ভাবে শুনতে পাচ্ছে ও।
আর একটা ছেলে জোহানের চুলের মুঠি ধরে জোহানের মুখ উচুঁ করলো। কী একটা বলতে বলতে জোহানের মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। জোহানের মুখ হেলিয়ে গেল এক দিকে। জোহানের মুখে আরও কয়েকটা থাপ্পড় পড়লো। একটা ছেলে জোহানের মুখে এত জোরে একটা ঘুষি মারলো যে জোহান রাস্তায় পড়ে গেল! ছেলেগুলো হাত দিয়ে জোহানকে আঘাত করে চলছে। ঘুষি মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া ছেলেটা হঠাৎ জোহানের পেট বরাবর একটা লাথি মারলো। লাথিটা ছিল সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক। মিতুলের হৃদস্পন্দন থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য। চোখের সামনে দেখলো জোহান ব্যথায় কুঁচকে গেছে ।
এক হাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে নিজের যন্ত্রনা হজম করলো জোহান। এত মার খেয়েও জোহান কোনো শব্দ করলো না তেমন। ছেলে গুলোর মার যেন শেষ হচ্ছে না। মিতুলের চোখে পানি এসে গেছে। কখন থেকে যেন ঝরেও পড়তে লাগলো। মিতুল চোখের সামনে জোহানকে এভাবে মার খেতে দেখতে পারে না। মিতুল গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য দরজা খুলতে চাইলো, কিন্তু দরজা খুলছে না। দরজা খুলছে না কেন? মিতুল টানাটানি করলো। কিন্তু খুললো না। মিতুল ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটার দিকে এগিয়ে এলো। খোলার চেষ্টা করলো, খুললো না। অনেক চেষ্টার পর দরজাটা খুললো। মিতুল গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড়ে জোহানের কাছে এলো। ছেলে গুলো এতক্ষণে চলে গেছে। জোহানের মুখ দেখে মিতুলের আত্মাটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। জোহানের নাক থেকে রক্ত বের হয়েছে। গাল লাল। ঠোঁটের কোণেও রক্ত। জোহান চোখ খিঁচে রেখেছে। পেট চেপে ধরে আছে। মিতুল কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কেঁদে যাচ্ছে শুধু। দুই হাতে জোহানকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো,
“জোহান ওঠো।”

জোহান উঠলো না। মিতুল এবার একেবারে অসহায় হয়ে পড়লো। দ্বিগিদিক কিছু ভাবতে পারছে না।

“কী করা উচিত এখন? ইমারজেন্সি নম্বরে কল করা উচিত? না কি আশেপাশের একটা হাসপাতাল খুঁজে নিজেরই নিয়ে যাওয়া উচিত? কোনটা করা উচিত? হে আল্লাহ পথ দেখাও।”

মিতুল যখন উত্তেজিত ভাবে এসব বিড়বিড় করছিল, তখন জোহানের অস্পষ্ট কণ্ঠ শোনা গেল,
“হেই তুলতুল!”

জোহানের কণ্ঠ কানে আসতে মিতুল থমকে গেল। জোহানের দিকে তাকিয়ে দুই হাতে জোহানের মুখ ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“তুমি জেগেছো? আমি এখন কী করবো? ইমারজেন্সি নাম্বারে কল করা উচিত আমার? কী করা উচিত আমার? বলে দাও না।”

জোহানের ক্লান্ত গলা শোনা গেল,
“আমাকে দ্রুত গাড়িতে নিয়ে বসাও। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে দু জনেই বিপদে পড়বো। পুলিশ দেখলে ধাওয়া করবে। তাড়াতাড়ি নিয়ে গাড়িতে বসাও।”

মিতুল বুঝদারের মতো বললো,
“ঠিক আছে।”

মিতুল জোহানকে ধরে উঠালো কোনো রকম ভাবে। কিন্তু জোহানের এত লম্বা দেহ মিতুলের মতো খাটো মেয়ে ঠিক সামলে ধরে রাখতে পারছে না। তাছাড়া জোহানকে ধরলেই জোহান কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলছে,
“হেই, আস্তে ধরো। ব্যথা পাচ্ছি। আমাকে কী মনে হয় তোমার? এমন ভাবে ধরছো মনে হচ্ছে তোমার আঙ্গুল আমার শরীর ফুঁটো হয়ে ঢুকে যাবে। ভালো করে ধরো।”

এত মার খাওয়ার পরও বেশ ভালো জোরই আছে গলায়। মিতুল সেসবে পাত্তা দিলো না। জোহানকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিয়ে, দরজা আটকে দিলো। নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। জোহান এতক্ষণ চোখ বুজেই ছিল। এবার চোখ মেললো। লক্ষ্য করলো ড্রাইভিং সিটে নেই ও। জোহান মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই…এখানে বসিয়েছো কেন আমায়? গাড়ি কি… নিজে থেকে চলবে?”

“নিজে থেকে চলবে কেন? আমি চালাবো।”

“কী? ওখান থেকে…বেঁচে ফিরেছি, এখন তুমি কি আমায় কার এক্সিডেন্ট করিয়ে মারতে চাইছো? তোমার গাড়ি ড্রাইভ করার অভিজ্ঞতা আছে?”

মিতুল মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আছে। আমার ছোট ভাই আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছে। আমি ড্রাইভ করতে পারি।”

জোহান আর কিছু বললো না। সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।
মিতুল গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও আবার থামলো। জোহানের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আ-আচ্ছা… আমার কাছে তো… কোনো লাইসেন্স নেই। বলছি যদি বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাই…তাহলে কি পুলিশে ধরবে না?”

জোহানের কাছে জিজ্ঞেস করার পর আবার নিজে নিজেই বলতে লাগলো,
“আমি কি কানাডা জেল খাটতে এসেছি? কিছুতেই জেল খাটতে পারব না আমি!”

জোহান চোখ খুলে মিতুলের দিকে তাকিয়েছে। মিতুলের কথা শুনে এমন মুহূর্তেও হাসি পাচ্ছে।
জোহান বললো,
“দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করো। নয়তো এখানে বেশিক্ষণ গাড়ি নিয়ে থাকার কারণে জেল খাটতে পারো।”

“এ্যা?”

“হ্যাঁ।”

জোহান আবারও চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে দিলো সিটে।
মিতুলের ভয় করছে। সত্যিই পুলিশে ধরবে? মিতুল গাড়ি স্টার্ট করলো। ভালোই ড্রাইভ করেছে মিতুল। রাস্তায় কোনো পুলিশ ছিল না। এর জন্য মিতুল বার বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল। হয়তো এটা এলাকার রাস্তা সে জন্য। মেইন রোডে থাকলে যে জেলে যেতে হতো, সেটা সুনিশ্চিত।
বাড়ি পৌঁছে গেছে। মিতুল গ্যারেজে নিয়ে এলো গাড়ি। গাড়ি ব্রেক করলো। জোহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো জোহান চোখ বুজে আছে এখনও। মুখের রক্ত এখনও শুকায়নি। মিতুল গাড়ি থেকে নামলো। জোহানকে ধরে নামালো তারপর। জোহানকে দুই হাতে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু জোহান মাঝপথে হঠাৎ থেমে গেল। মিতুলও থেমে গেল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড জোহান?”

কেন যে ফিস ফিস করে কথা বললো, সেটা ও নিজেও জানে না। ফিস ফিস করে কথা বলছে সেটা ওর খেয়ালই নেই।

জোহান বললো,
“ঘর নয়।”

“মানে?”

“বাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে চলো।”

“বাড়ির পিছনে কী আছে? বাড়ির পিছনে কেন নিয়ে যাব?”

“বেশি কথা বাড়িয়ো না। দেখতে পাচ্ছ না আমি আহত? কোনো রোগীর সাথে এমন কথা প্যাঁচানো উচিত নয়। তাহলে রোগীর অবস্থা আরও গুরুতর হয়। যা বলছি তাই করো।”

মিতুলের কী যেন হলো। ওর উচিত ছিল এখানে জোহানের সাথে একটু হলেও তর্ক করা। কিন্তু ও তর্ক করলো না। এমনকি একটা কথাও বললো না। চুপচাপ জোহানের কথা অনুযায়ী ওকে বাড়ির পিছনে নিয়ে এলো। কেন জোহানের কথা মেনে নিয়ে এখানে নিয়ে এলো, সেটা ও জানে না।
গার্ডেনে লাইট জ্বলছে। বাড়ির মানুষের কোনো সাড়া শব্দ নেই। খুব নিঝুম পরিবেশ। মিতুল আবার ফিসফিস করে বললো,
“বাড়ির পিছনে তো নিয়ে এসেছি তোমায়, এখন কী করবো?”

জোহান জঙ্গলের ভিতরে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটা দেখিয়ে বললো,
“ওই রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে যাও।”

মিতুলের টনক নড়ে উঠলো। জঙ্গল? ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ওকে কি জঙ্গলে যেতে বলছে? মিতুলের মনে ভয়ের দানা জমতে লাগলো। মাথার ভিতর সবকিছু কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে। জঙ্গলের ভিতর তাকালে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। মিতুল ঢোক গিললো। জোহান ওকে নিজ থেকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে বলছে? কেন?

“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
জোহানের প্রশ্ন কানে এলো।

মিতুলের কৌতূহল হচ্ছে। এতটাই কৌতূহল হচ্ছে যে ভয়কে পরোয়া না করে একবার জঙ্গলে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। দুই বার যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। আর জঙ্গলের রহস্য উদঘাটন করাও হয়নি। একবার জোহান নিজে বাধা দিয়েছে, আরেকবার জায়িন। আর আজ সেই জোহানই ওকে জঙ্গলে যাওয়ার কথা বলছে! বিস্ময়কর!
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহানের অবস্থা কাহিল। মিতুল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ও যাবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক না।
মিতুল জোহানকে নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। এক হাতে জোহানকে আগলে, আরেক হাতে মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ধরে জঙ্গলে ঢুকলো। সরু রাস্তা। রাস্তায় পাতা জমে স্তুপ হয়ে থাকার কথা, কিন্তু তেমন কোনো পাতা নেই। আশে পাশে গাছ গাছালি। কয়েকটা পাখি ডাকছে। মিতুলের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। ও কি ঠিক করছে? না কি ভুল? ভুল শব্দটা সোজা হৃদয়ে এসে আঘাত করলো। আর সেই আঘাতে একটা চাপা পড়া দুঃস্বপ্ন ক্রমশ জেগে উঠতে লাগলো। চারিধারে কবর, শরীর মোটা দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বাধা, আর কালো পোশাকে আবৃত জোহানের ভয়ংকর মুখটা মিতুলের চোখে ভেসে উঠলো। মুহূর্তেই মিতুলের হাত পায়ে কাঁপন ধরে গেল। জোহান টের পেল কি না কে জানে। ওকে বলতে শোনা গেল,
“হেই মিতুল, তুমি কি কাঁপছ না কি?”

মিতুল কিছু বলতে পারল না। হাত পা কেঁপেই চলছে। কী করা উচিত এখন? কেন আসলো জোহানের কথা মতো এই জঙ্গলে? কী আছে কপালে এখন? এই জোহান যদি সত্যিই স্বপ্নের জোহানের মতো হয়? যদি আক্রমণ করে? তাহলে কী হবে? কী করবে তখন? এখান থেকে চিৎকার করে ডাকলে কি কেউ শুনবে?
যদি স্বপ্নের মতো সত্যি সত্যি একটা গাছের সাথে বাঁধে তখন? মিতুলের মনে পড়লো, আরে জোহান নিজেই তো আহত। আহত অবস্থায় কি আক্রমণ করতে পারবে? বাঁধতে পারবে গাছের সাথে? মিতুলের মনটা একটু নিশ্চিন্ত হতে নিয়েছিল, কিন্তু পারলো না। নতুন একটা চিন্তা তীরের মতো এসে মস্তিষ্কে বিঁধলো। আচ্ছা, জোহানের কোনো সাঙ্গপাঙ্গ আছে? তারা এখানে ওঁৎ পেতে নেই তো? প্রশ্নটা মনে হতেই মস্তিষ্কের চাপ বেড়ে গেল। চিন্তাময় মাথাটা আরও দ্বিগুন চিন্তায় ডুবে গেল। জোহান আহত সেটা ঠিক আছে, কিন্তু ওর সাঙ্গপাঙ্গরা? তারা তো আর আহত থাকবে না। তারা তো চাইলেই আক্রমণ করতে পারবে। গাছের সাথে বেঁধে ফেলা তো তাদের কাছে ওয়ান টু এর ব্যাপার। মিতুলের হাত পায়ের কাঁপন আরও বেশি বৃদ্ধি পেল। জোহানকে ধরে রাখার বাঁধন আলগা হয়ে এলো।
জোহান মিতুলের এমন কাঁপা কাঁপি অবস্থা দেখে মেজাজ দেখিয়ে বললো,
“হেই কী করছো তুমি? ভালো করে ধরে রাখো আমায়। কী চাও এখানে ঠাস করে পড়ে গিয়ে আমার মাথা ফেঁটে যাক? সেটাই চাও তুমি?”

জোহানের বলা একটা শব্দও মিতুলের কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। ওর কাঁপাকাঁপি চলতে লাগলো আগের ন্যায়।
জোহান নিজে মিতুলের হাতটা টেনে নিজেকে ভালো করে আগলে রাখতে চাইলো।

মিতুলের মাথায় এখন চিন্তার ঝড় বইছে। কান্না পাচ্ছে, খুব কান্না পাচ্ছে। মা, বা, আর দুই ভাইয়ের হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠছে চোখে। মিতুলের এখন তাদেরকে ডাকতে মন চাচ্ছে। কিন্তু ভয়ে গলাটা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। মিতুলের ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে জোহান এরকম করতে পারে ওর সাথে! কী করে করতে পারে জোহান এটা? যে মানুষটা এত সুন্দর গান গায়, সেই মানুষটা এত নৃশংস হয় কীভাবে? কীভাবে হয়? মিতুলের কানে জোহানের গানের কণ্ঠটা ভেসে উঠছে,
‘You are my little angel
You are my dream…’

গানটার কথা মনে হতেই মিতুলের চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। যে এত সুন্দর গায়, যার মুখটা দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগে, সে কী করে এমন নির্মম হতে পারে? জোহান কি আসলেই নির্মম?
মিতুলের কেন যেন মনে হচ্ছে জোহান অবশ্যই ওর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আক্রমণ করবে ওকে। না হলে এই রাতে কেন এভাবে জঙ্গলে নিয়ে আসার কথা বললো? আচ্ছা, জোহান যে মার খেলো একটু আগে, সেই রাগটা ওর উপর মিটাতে চাইছে না তো?
মিতুলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। জোহান ওর উপর রাগ মিটাতে চাইছে? এত দিন যে ও জোহানের সাথে কঠিন আচরণ করেছে, তার সব শোধ যদি জোহান আজ এক সাথে নেয়, তাহলে? মিতুলের শরীরে ভয়ের স্রোত বইছে। গায়ের ফোরাক বোধহয় ভিজে গেছে ঘামে। জোহান সত্যিই এটা করতে পারবে ওর সাথে? কী করে এত নিষ্ঠুর পরিচয় দিতে পারে জোহান? কী করে?
মিতুল চাইছে নিজের পা দুটোকে থামাতে। কিন্তু পা দুটো থামছে না, কোনো এক মায়া যেন ওর পা দুটোকে বশ করে ফেলেছে। ও থামছে না। ক্রমাগত হেঁটে চলছে, আর চলছে।

এতক্ষণে জঙ্গলের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে বোধ হয়। আশপাশে তাকাতেও খুব বেশি ভয় লাগছে। তবুও একবার তাকালো চারপাশটায়। আরে গাছ পালা তো আরও বেশি ঘন হওয়ার কথা। কিন্তু না। গাছপালা ঘন তো নয়ই বরং যেন খুব বেশি পাতলা হয়ে এসেছে। চাঁদের আলো হুড়মুড় করে জঙ্গলে ঢুকে আশপাশটাকে আলোকিত করেছে। মিতুল আকাশের দিকে তাকালো। চাঁদটা যেন ওর সাথে সাথে হাঁটছে। মিতুল ভেবেছিল জঙ্গলে এত গাছপালা থাকবে যে আকাশের তিল পরিমানও দেখতে পাবে না। কিন্তু এখন তো দেখলো আকাশটা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। তেমন কোনো গাছই নেই। বলতে গেলে ফাঁকা। মিতুল পিছনে ফেলে আসা পথটাকে দেখলো একটু পিছন ফিরে। ওদিকটায়ও ভালোই চাঁদের আলো। তবে একেবারে ওই দূরের জায়গাটা নিকষ কালো। আর ওই কালো অন্ধকার জায়গাটা ভেদ করেও ওপাশে সোনালী রঙের আভা দেখা যাচ্ছে ঝাপসা ভাবে। বাড়ির গার্ডেনের লাইটের আলো না কি?
মোবাইলে লাইট জ্বলছে। তবে মনে হচ্ছে লাইট না জ্বললেও ভালোই পথচলা যাবে। কারণ প্রচুর চাঁদের আলো প্রবেশ করেছে জঙ্গলে। মিতুলের মনে হচ্ছে ও যেই জঙ্গলকে দেখতো গার্ডেনে বসে, এটা সেটা নয়। মনে হচ্ছে ও ভুল করে অন্য কোনো জঙ্গলে এসে পড়েছে। কিন্তু এলো তো সেই পথ দিয়েই। কিছু বুঝতে পারছে না। মিতুল আশপাশটা ভালো ভাবে দেখছে। স্বপ্নের কথা মনে করলো খুব ভালো ভাবে। স্বপ্নে দেখেছিল সারি সারি কবর আর প্রচুর গাছপালা। স্বপ্নে যা দেখেছে তার কানা কড়িও মিলছে না বাস্তবতার সাথে।
সরু রাস্তাটা বাঁক নিলো বামে। মিতুল বেশ কিছুটা দূরে আলোর মতো কিছু দেখতে পাচ্ছে। কী ওগুলো? মিতুল এগিয়ে যেতে লাগলো ওই আলো লক্ষ্য করে। কিন্তু আর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে যা দেখলো, তা ছিল ওর কাছে অভাবনীয়!

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৫
_____________

মিতুলের সামনে ছোট্ট একটি ঘর। মিতুল বিস্ময়ে হতবাক! জঙ্গলের ভিতর ঘর এলো কোত্থেকে? ও কি ঠিক দেখছে? মিতুল দুই চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই তো!

মিতুল দূরে দেখা আলো অনুসরণ করে এগোচ্ছিল। কিন্তু ওই দূর আলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। একটু হাঁটতেই এই ঘরটা চোখে পড়তেই থেমে যায়। ঘরটা আগে একেবারেই খেয়াল করেনি। ওর দৃষ্টি ছিল কেবল ওই আলোর উপর। মিতুল হা হয়ে ঘরটা দেখছে। এই গভীর জঙ্গলে ঘর কেন? কার ঘর এটা? মিতুল ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ফেলেছে ঘরের উপর। একটা সাইন বোর্ড চোখে পড়ছে। কী লেখা ওতে?
‘Ti… Time…House’? লেখাটা পড়তে পড়তে মিতুলের ভ্রু কুঁচকে গেছে। ‘Time House’ লেখা কেন? কী মানে এই লেখার? এই ঘরটার নাম ‘Time House’ না কি?

মিতুল ঘরটা দেখছে। দেখতে তো পুরোনো মনে হচ্ছে না। একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজার দুই পাশের দেয়ালে আবার দুইটা জানালা। কাঁচের জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভিতরে পর্দা টানানো জানালাতে। পর্দা গুলো পুরোনো না কি বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘর কীসের? এই জঙ্গলের ভিতর ঘর নির্মাণ করলো কে?

“মিতুল…”

হঠাৎ করে জোহানের কণ্ঠ মিতুলকে ভয় পাইয়ে দিলো। জোহান যে ওর সাথে আছে সেটা ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিল।
জোহান পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মিতুলের সামনে ধরে বললো,
“ইট’স মাই হাউজ কী!”

মাই হাউজ? জোহানের ‘মাই হাউজ’ বলা কথাটা মিতুলকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এলো। মিতুল একবার ঘরের দিকে, আরেক বার জোহানের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“ইট’স ইওর?”

জোহানকে দেখে মনে হলো ওর কষ্ট হচ্ছে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে বললো,
“ওপেন দ্য ডোর!”

মিতুল মোবাইল ধরা হাত দিয়ে জোহানের হাতের চাবি নিলো। এই ঘর কি সত্যিই জোহানের? মিতুল আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে। জোহানকে বসিয়ে দিলো ঘরের সামনে, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। তারপর জোহানের দেওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুললো। একটা ভোঁতা শব্দ হলো দরজা খোলার। মিতুল ভেবেছিল দরজা খুলতে না খুলতেই ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগবে। কিন্তু না, তেমন কোনো গন্ধ পেল না। বরং একটা মিষ্টি সুগন্ধ টের পাওয়া গেল। মিতুল অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল লাইটের আলো বেখেয়ালে ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে। ও দেখছে সামনে শুধু অন্ধকার। চাঁদের আলো গ্লাস উইন্ডো এবং পর্দা ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তাও একটু আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে দরজার এক পাশ দিয়ে।

জোহান বললো,
“দেয়ালের ডান দিকে সুইচ বোর্ড।”

মিতুল এবার খেয়ালে এলো। মোবাইলের আলো ফেলে সুইচ বোর্ড খুঁজে, লাইট জ্বালালো ঘরে। মিতুলের চোখের সামনে এখন একটি ছোট লিভিং রুম ফুঁটে উঠেছে। মিতুল রুমটা দেখছে। মেঝে কার্পেটে ঢাকা। পশ্চিম দেয়ালের জানালার কাছে কয়েকটা নীল রঙের ফ্রিসিয়াস ফুলের টব। মিতুল বুঝতে পারলো, এই ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুগন্ধই পাচ্ছে ও। এই জানালা থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে রাখা আছে একটা কাউচ। উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে একটা ওয়ার্ডোব, তার পাশে ছোট্ট একটি টি টেবিল। টেবিলের উপর একটা ল্যাম্পশেড। আরও কিছু জিনিস পত্র দেখা গেল লিভিং রুমে। ওগুলো রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। পূর্ব দিকে আরও একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজার গায়ে ছোট একটি সাইন বোর্ড। কী যেন লেখা তাতে। কী লেখা আছে? মিতুল কয়েক পা এগিয়ে এলো দরজাটার দিকে। লেখা,
‘My lonely bedroom’

লেখাটা দেখে মিতুল ভীষণ অবাক। এটা আবার কেমন কথা?
উত্তর পূর্ব দেয়াল ঘেঁষে উত্তরের ওদিকটায় আরও একটা দরজা দেখতে পাচ্ছে। দরজাটা খোলা। মিতুল উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিচেন টিচেন হবে বোধহয়।

মিতুল সত্যি সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক। কী দেখছে এসব? লিভিং রুম, বেডরুম, কিচেন! তাও আবার এত সাজানো, গোছানো, পরিপাটি? মনে হচ্ছে যেন এখানে কেউ নিয়মিত বসবাস করে। আচ্ছা, এটা কি কোনো সিক্রেট হাউজ না কি? মিতুল এর আগে কখনও এরকম সিক্রেট হাউজ দেখেনি। প্রথম দেখছে বলে একটু খুশি খুশি লাগছে। জোহান জঙ্গলের ভিতর সিক্রেট হাউজ তৈরি করেছে? বাহ, বেশ ভালো তো!
মিতুলের মাথায় হঠাৎ এক নতুন ভাবনা খেললো। জোহান কি তাহলে জঙ্গলে ঢুকে ওর এই সিক্রেট হাউজে আসতো?
মিতুল হীনমন্য, বিমূঢ়তায় নিজের মুখ চেপে ধরলো। ছি ছি! জোহান নিজের এই সিক্রেট হাউজে আসতো, আর ও কি না জোহানকে নিয়ে কীসব আজগুবি…
মিতুল আর ভাবতে পারছে না। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে। কী করে জোহানকে নিয়ে ওই রকমের চিন্তা ভাবনা করেছিল?

বাইরে থেকে জোহানের কণ্ঠ শোনা গেল,
“হেই…আমাকে কি এখানেই বসিয়ে রাখবে? বাইরে শীত পড়েছে। হাত পা জমে যাবে আমার!”

জোহানের কথায় মিতুলের ঘোর কেটে গেল। মিতুল হাতের মোবাইল এবং চাবি টেবিলে ল্যাম্পশেডের পাশে রেখে, দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। জোহানকে ধরে নিয়ে এলো ঘরের ভিতর। কাউচের উপর শুইয়ে দিলো ওকে। তারপর আবারও ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরটাকে দেখতে লাগলো ভালো ভাবে। মিতুলের ভাবতে অবাক লাগছে জোহানের একটা সিক্রেট হাউজ আছে। আচ্ছা সিক্রেট হাউজে থাকতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই ভালো লাগে খুব?

“তুমি কি চাও আমি মরে যাই?”

জোহানের কথা শুনে মিতুল জোহানের দিকে তাকালো।
“কীসব কথা বলছো তুমি? আমি কেন চাইবো যে তুমি মরে যাও? আমাকে কি তোমার হার্টলেস মনে হয়? আমি মোটেই হার্টলেস নই। আমি কখনও কারো জন্য মৃত্যু চাইতে পারি না।”

“না চাইলে এমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার কি উচিত নয় আমার ট্রিটমেন্ট করা?”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“ট্রিটমেন্ট? আমি কি ডাক্তার? না কি আমি ডাক্তারি পড়ি? আমি কীভাবে তোমার ট্রিটমেন্ট করবো? আর তাছাড়া ট্রিটমেন্ট করতে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। আমার কাছে কি আছে সেসব?”

“আমি কোনো অপারেশনের রোগী নই যে, আমার ট্রিটমেন্ট করতে তোমার ডাক্তার হতে হবে। এটা একটা সিম্পল ট্রিটমেন্ট। তুমি চাইলেই পারবে…ওই যে ওখানে বেডরুম লেখা ডোরটা দেখতে পাচ্ছ? ওই রুমের ভিতর ফার্স্ট এইড বক্স আছে। নিয়ে এসো সেটা। এবং ট্রিটমেন্ট করো আমার।”

মিতুল নিরাশ চেয়ে আছে জোহানের দিকে। ও বুঝতে পারছে না ও কী করে জোহানের ট্রিটমেন্ট করবে? ট্রিটমেন্ট করা কি ওর কাজ? সেটা তো ডাক্তারের কাজ।

“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।”

জোহানের অবস্থা ভালো লাগছে না মিতুলের। রক্ত…
মিতুল বললো,
“যাচ্ছি।”

মিতুল জোহানের বেডরুমে প্রবেশ করলো। দেয়াল হাতড়ে সুইচ বোর্ডটা পেল। লাইট জ্বালালো। বেড রুম আলোকিত হয়েছে। লিভিং রুমটাই ছোট ছিল, বেড রুমটা তার থেকে আরও ছোট। সব জিনিস পত্র গাদাগাদি করে রাখা। তেমন কিছু নেই এখানে। একটা সাদা চাদরে ঢাকা বেড। বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা ক্লোজেট। ক্লোজেটের পাশে একটা ওয়ার্ডোব। জানালার কাছে একটা টেবিল। টেবিলের সাথে আবার একটা চেয়ার। বই, পেন, নোটবুক, সাদা পেপার এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলের উপর। রুমের ওই কোণে আবার গিটার সহ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র। গিটারটা চেনা চেনা লাগছে না মিতুলের। জোহানের কাছে আগে যে গিটারটা দেখেছে, এটা সেটা না। জোহানের কি দুটো গিটার?
একটা গিটার নিয়েও এমন গভীর চিন্তা করার কারণে, মিতুলের নিজের প্রতিই নিজের বিরক্ত লাগলো।
ফার্স্ট এইড বক্স কোথায়? জোহান তো বললো রুমের ভিতর আছে, কোথায় আছে সেটা তো বললো না। মিতুল এখান থেকেই চেঁচিয়ে জানতে চাইলো,
“এ রুমের কোথায় রেখেছো ফার্স্ট এইড বক্স?”

জোহানের থেকে কোনো উত্তর এলো না। গলার শক্তি কমে গিয়েছে না কি ওর? গিয়েছে বোধহয়। তা না হলে বজ্র কণ্ঠ ভেসে আসতো ওখান থেকে। মিতুল ওয়ার্ডোবের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়ার্ডোবের ভিতরই রেখেছে বোধহয়। মিতুল উপরের ড্রয়ার খুললো। কীসব কাগজ পত্র দেখা যাচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্সের চিহ্ন নেই কোথাও। দ্বিতীয় ড্রয়ারটি খুললো। কতগুলো ইংলিশ নভেল রাখা। তার সাথে…এটা কী? নোটবুক? মিতুল নোট বুকটা হাতে তুলে নিলো। খুলে দেখতে চাইছিল কী লিখে রেখেছে। কিন্তু, খুললো না। কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়ার শিক্ষা ও পায়নি। নিশ্চয়ই এর ভিতর গান টান লিখে রেখেছে? হ্যাঁ, সেটাই। গান ছাড়া আর লিখবে কী? আর কিছু জানে? নিজের জীবনী লেখার মতো মানুষ তো আর জোহান না! মিতুল রেখে দিলো নোটবুকটা। তৃতীয় ড্রয়ার খুলতে ফার্স্ট এইড বক্স দেখতে পেল। মিতুল বক্সটা নিয়ে বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে।
দেয়ালের ওই দিকে একটা টুল ছিল সেটা নিয়ে এসে জোহানের কাছে বসলো। ফার্স্ট এইড বক্স খুলে দেখলো, প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে। প্রথমে কী করা উচিত? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মিতুলের মনে হলো আগে নাকের রক্ত মুছে দেওয়া উচিত। মিতুল একে একে জীবাণুনাশক দিয়ে ক্ষত স্থান গুলো পরিষ্কার করলো সব। তারপর পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে দিলো। এসব করতে বার বার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছিল মিতুলকে। কারণ, জোহান পুরো সময়টা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল।
আর এসব কি ওর কাজ? মিতুল জোহানের কপালে ফুলে থাকা স্থানে প্লাস্টার লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“যতটুকু পারলাম, ততটুকু করে দিলাম। ঔষধ যা লাগে তুমি খেয়ে নিয়ো। আর ডক্টরও দেখিয়ে এসো একবার।”

মিতুল একটু থেমে আবার বললো,
“আচ্ছা, তোমার এখানে ঘর ওঠানোর রহস্যটা কী? এটা কি তোমার সিক্রেট হাউজ? শখের বশে তৈরি করছো না কি?”
বেশ কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করলো মিতুল।

“সিক্রেট হাউজ হলে কী করবে?”

“কিছু না। এমনিই জানতে চাইলাম। সিক্রেট হাউজে থাকাটা বোধহয় মজার। আমি কোনো দিন ভাবতে পারিনি এখানে এসে আমি একটা সিক্রেট হাউজ দেখতে পাবো। তাও ভালো, যা ভেবেছিলাম তা অন্তত হয়নি।”

জোহান বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“কী ভেবেছিলে?”

মিতুল হকচকিয়ে গেল। কিন্তু দ্রুতই বললো,
“নাথিং।”

মিতুল বক্সের ভিতর সব গুছিয়ে রেখে বক্সটা ফ্লোরে নামিয়ে রাখলো। জোহান চোখ বুজেছে। মিতুল বললো,
“এখানেই ঘুমাবে তুমি?”

উত্তর দিলো না জোহান।
মিতুলের রাগ হলো। মিতুল এবার একটু বেশি জোরেই বললো,
“তুমি কি এখানেই ঘুমাবে?”

“কেন? তুমিও কি ঘুমাবে এখানে?”

ঘুমানোর কথা মনে হতেই মিতুলের মনে পড়লো, আরে ও তো এখন এক গভীর জঙ্গলের ভিতর আছে! বাইরের কী অবস্থা সেটা তো ও জানে না। রেশমী আন্টি এখনও বাড়িতে না দেখলে কী বলবে? খুঁজবে না? মিতুলের চিন্তা শুরু হয়ে গেল আবার। মিতুল জোহানকে ডাকলো,
“এই জোহান।”

জোহান চোখ বুজে থেকেই বললো,
“কী?”

“আমি বাড়ি যাব।”

“তো যাও।” জোহানের গা ছাড়া ভাব।

“যাও মানে? আমাকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে এসেছো তুমি। এখন আমি এই গভীর জঙ্গল পেরিয়ে যাব কী করে?”

“যেভাবে এসেছো, সেভাবে চলে যাও।” জোহানের যেন বিন্দু মাত্র চিন্তা নেই ওর জন্য।

মিতুলের মাথায় রাজ্যের চিন্তা ভর করলো। এসেছিল তো কৌতূহলে পড়ে। কৌতূহলের কাছে এসব ভয় ডর তুচ্ছ করে দিয়েছিল। তাছাড়া জোহানও তো সাথে ছিল। কিন্তু এখন? না না কিছুতেই এখন একা একা যেতে পারবে না। ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতে পারে! মিতুল জোহানের দিকে তাকালো।
জোহান চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছে।
মিতুল বললো,
“আমি কিছুতেই একা একা যেতে পারব না। কিছুতেই না।”

জোহান চোখ মেলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কেমন একটা ভাব নিয়েই যেন বললো,
“ঠিক আছে, যাওয়ার দরকার নেই। আজকে রাতে এখানেই থাকো আমার সাথে।”

মিতুল টুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল।
“অসম্ভব! কিছুতেই এখানে থাকবো না আমি। এখানে থাকার থেকে তো জঙ্গল পেরিয়ে একা একা চলে যাওয়াও ভালো…”

“ঠিক আছে, যাও তবে।” বলে জোহান আবার চোখ বুজলো।

মিতুল পড়লো মহা মুশকিলে। এখানে জোহানের সাথে থাকার কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাববে না ও। কারণ এখানে থাকলে তো ওদিকে বাড়ির সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাবে। তারা তো আর জানবে না যে এখানে জোহানের সাথে সিক্রেট হাউজে আছে। তারা তো জঙ্গলকে হিসেবের ভিতরেই ধরবে না। আর তাছাড়া, জোহানের সাথে এই ঘরে একা থাকা, এটা জাস্ট ও ভাবতেই পারবে না। থাকা তো অনেক দূরের কথা।
আবার ওদিকে, একা একাও যেতে পারবে না এই জঙ্গল পেরিয়ে। কী করবে এখন?
মিতুলের মাথায় হঠাৎ সমাধান এলো। জোহানের দিকে তাকালো। ঘুমিয়ে পড়েছে না কি? মিতুল ডাকলো,
“এই জোহান, শুনছো?”

জোহান চোখ খুলে বললো,
“এ কি তুমি এখনও যাওনি?”

“বলছিলাম কী, তুমি আমাকে জঙ্গল পেরিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসো না।”

“হোয়াট?”

“তুমিই তো এখানে নিয়ে এসেছো। এখন তোমার কি উচিত নয় আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসা?”

“তোমার কি কোনো কমনসেন্স নেই? আমি একজন আহত মানুষ। যেই আহত মানুষটিকে তুমি নিজে এখানে আসতে সাহায্য করলে, সে একা একা হেঁটে আসতে পারছিল না বলে। সেই মানুষটাকে তুমি আবার হেঁটে হেঁটে এই জঙ্গল পেরিয়ে তোমাকে দিয়ে আসতে বলছো? আমি এই জঙ্গল পেরোনো তো দূরের কথা, এই কাউচ ছেড়ে নামবো সেই শক্তিটুকুই তো নেই আমার। আমি ভীষণ দুর্বল।”

মিতুলের রাগ হচ্ছে, খুব খুব রাগ হচ্ছে। রাগ নিয়েই বললো,
“তোমাকে কে বলেছিল এখানে ঘর নির্মাণ করতে? তুমি এখানে সিক্রেট হাউজ তৈরি করেছো কেন? আর করেছো করেছো, আমাকে কেন আনলে এখানে? নিজের দিকটাই ভাবো শুধু? আর মানুষের ভাবনা কে ভাববে? খুব দুর্বলতা দেখাচ্ছ তাই না? যখন তুমি এতটাই দুর্বল যে কাউকে নিয়ে আসলে, তাকে আবার ফেরত দিয়ে আসতে পারবে না, তাহলে এনেছিলে কেন এখানে? কেন এনেছিলে?” চাপা গর্জন করে উঠলো মিতুল।

মিতুল রাগে ফুঁসছে।
নাক ফুলো তুলতুলকে দেখতে পাচ্ছে জোহান। জোহান মিতুলের মতো কোনো রিয়াক্ট করলো না। খুব শান্ত ভাবেই বললো,
“সিসকে ফোন করো।”

“কাকে ফোন করবো?”

“ক্যামিলা। ফোন করে এখানে আসতে বলো।”

“মানে?” মিতুল অবাক হলো।
“ক্যামিলা জানে তোমার এই সিক্রেট হাউজের ব্যাপারে?” মিতুলের রাগ কেটে গিয়ে এখন আবার কৌতূহলে পরিণত হলো।

জোহান কোনো উত্তর দিলো না।
মিতুলই আবার হতাশ হয়ে বললো,
“যাক, আমি তো ভেবেছিলাম এটা তোমার সিক্রেট হাউজ। কিন্তু না, এখন তো দেখছি তুমি ছাড়াও তোমার এই হাউজের ব্যাপারে আরও মানুষ জানে। আচ্ছা, তোমার ফ্যামিলির সবাই-ই কি জানে? তাহলে এটা কি তোমার সিক্রেট হাউজ নয়?”

“নো, এটা আমার সিক্রেট হাউজ নয়। এটা আমার টাইম হাউজ। সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। যদি এখান থেকে যেতে চাও, তবে সিসকে ফোন করো। আর যদি না যেতে চাও, তবে থেকেও যেতে পারো আমার সাথে আমার টাইম হাউজে। তোমাকে থাকতে দেবো আমি।”

“দরকার নেই। কোনো দরকার নেই তোমার এখানে থাকতে দেওয়ার। মরে যাব, তবুও এখানে থাকবো না আমি।”
বলে নিজের মোবাইল আনতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ক্যামিলাকে ফোন করলো। মিতুলের মনে হয়েছিল যে ও এই জঙ্গলের ভিতরে জোহানের সিক্রেট হাউজে আছে শুনে, ক্যামিলা অবাক হবে। কিন্তু ক্যামিলা অবাক হলো না। তার কণ্ঠ শোনালো খুবই স্বাভাবিক। যেন এখানে থাকাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

ক্যামিলার আসতে যতক্ষণ সময় লাগলো, ততক্ষণ মিতুল জোহানের ধারে কাছেও গেল না আর। ঘুরে ঘুরে ওর টাইম হাউজ দেখতে লাগলো। কিচেনটা আগে দেখেনি। সেটাও দেখে নিলো একবার। কিচেনটা খুবই ছোট। তবে বেশ ভালোই দেখা গেল। চুলো আছে, কফি তৈরির মেশিন আছে, ফ্রিজ আছে, বসে খাওয়ার জন্য একটা ছোট টেবিল, আর দুটো চেয়ারও আছে। মিতুলের মনে হলো বেশ ভালো সিক্রেট হাউজই বানিয়েছে জোহান। ওহ না, সিক্রেট হাউজ তো না। এটা না কি আবার টাইম হাউজ। কিন্তু এটা বানাতে কত টাকা খরচ হয়েছে? এটা নির্মাণের জন্য টাকা পেল কোথায়? শুনেছে তো জোহান কোনো কাজ কর্ম করে না। গান গেয়ে কয় টাকাই বা পায়? আচ্ছা এটা কি তবে রেশমী আন্টি নির্মাণ করে দিয়েছে? হ্যাঁ, রেশমী আন্টিই দিয়েছে নিশ্চয়ই। মিতুল এসব ভাবতে ভাবতে লিভিং রুমে পায়চারি করছিল। এর মাঝেই দেখতে পেল ক্যামিলা এসেছে।
ক্যামিলা এসে প্রথমে তাকালো জোহানের দিকে। মিতুলকে একনজর দেখে নিয়ে জোহানের কাছে গেল।

“আর ইউ ও কে?”

“মনে হচ্ছে ও কে আছি। তুলতুল আমার যে চিকিৎসা করলো, ও কে না থেকে উপায় কী?”
কথাটা বলতে বলতে মিতুলের দিকে তাকালো।

মিতুল বুঝতে পারলো না, জোহান ওর প্রশংসা করলো? না কি অপমান?

ক্যামিলা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মিতুল, লেট’স গো।”

মিতুল ক্যামিলার পিছন পিছন বের হচ্ছিল ঘর থেকে। জোহানের কথায় থেমে গেল,
“মিতুল শোনো।”

“কী?”

“বাড়ির অন্য কেউ যেন না জানে আমার মার খাওয়ার ব্যাপারে। যদি জানে, তবে তোমার কপালে খারাপ আছে। বুঝলে? ভীষণ খারাপ আছে।”

“আমার বয়েই গেছে তোমার কথা বলে বেড়াতে। আর তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে ভয় পাই? ভয় দেখাচ্ছ আমায়? কান খুলে শুনে রাখো, আমি তোমাকে কখনও ভয় পাইনি, আর ভবিষ্যতেও পাবো না। অযথা ভয় দেখাতে আসবে না বলে দিলাম।”
কথা গুলো বলে মিতুল মনে মনে হেসে উঠলো। ও না কি জোহানকে ভয় পায়নি কোনো দিন। আজকের দিনটা পর্যন্তও জোহানকে কতটাই না ভয় পেয়েছিল। এমনকি ভয়ে কাঁপাকাঁপিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এগুলো তো গোপন। বেশ ভালোই কথা শুনাতে পেরেছে জোহানকে। মুখেও নীরব হাসি ফুঁটলো এবার।
মিতুল ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। দরজাটা টেনে দিয়ে গেল।

জোহান তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজার দিকে। চোখে মার খাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। লাথি, থাপ্পড় সবই ভেসে উঠছে। জোহান ভাবছে আজকে কেন মার খেলো ও? ওর কাছে তো গাড়ি ছিল। ও না থেমে তো সোজা গাড়ি চালিয়েই চলে আসতে পারতো। গাড়ি চালিয়ে আসলে ওই রাবিশগুলোই তো নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকতো। কিন্তু ও কেন করলো না সেটা? আর গাড়ি চালিয়ে ওদেরকে অতিক্রম না করে, আবার ওখান থেকে ব্যাকও তো করতে পারতো। কেন করলো না? বোকার মতো কেন গাড়ি থেকে নেমে ওদের কাছে গিয়ে, নিজের মার খাওয়ার রাস্তাটা নিজেই পরিষ্কার করলো? কেন?
আর শুধু ওরাই কেন মেরে গেল? ঘুষি, থাপ্পড় ও নিজেও তো মারতে পারতো। মারলো না কেন? নিজেকে ওদের কাছে মার খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়ে কেন বলেছিল,
“মারবি? মার তবে। নিজেকে আজ তোদের কাছে ছেড়ে দিলাম। নে শুরু কর।”

কেন বলেছিল এই কথা?
কোথাও ওর নিজেরই মার খাওয়ার ইচ্ছা জাগেনি তো আজকে? নিজ ইচ্ছাতেই কি মারটা খেলো?
কথাটা মনে করে হাসলো জোহান।
আর হাসির সাথে এক ফোঁটা পানিও গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ বেয়ে। হয়তো একটু কষ্টে, একটু দুঃখে, কিছুটা বা অভিমানে!

(চলবে)