চৈত্রিকা পর্ব-১১+১২

0
308

#চৈত্রিকা (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
______________

রাত বাড়ছে। সাথে প্রহরের জ্বরও বাড়ছে। জ্বরে মুখ পর্যন্ত লাল হয়ে আছে। গোঙানোর শব্দও বেড়ে চলেছে। চৈত্রিকা অনেক ভেবে চিন্তে শেষে আর বসে থাকতে পারলো না। দৌড়ে উঠে গোসলখানা থেকে এক বালতি পানি এনে খাটের কাছে রেখে কোনো রকমে প্রহরের মাথা খাাটের কোণায় এনে রাখে। নড়াচড়া করায় প্রহর একবার চোখ মেলে তাকিয়েছে। চোখ দুটো তে যেনো রক্ত জমে গেছে। চৈত্রিকা কয়েক বার বড় বড় শ্বাস নিয়ে আগে মাথায় পানি ঢালে। বেশ অনেকটা সময় মাথায় পানি দিয়ে চোখ, মুখও ধুয়ে দেয়। জ্বর কোনোমতেই কমছে না। শরীর মুছিয়ে দিলে জ্বরটা বোধহয় কমতো কিন্তু সে প্রহরের শরীর মুছাবে না। যে মানুষগুলোর প্রতি আকাশ সমান ঘৃ’ণা সে মানুষগুলোর একজনকে সে সেবা করছে এটাই তো প্রহরের ভাগ্য। প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসে সে। টাওয়েল এনে চুলগুলো মুছিয়ে দিয়ে ঠিকমতো শুইয়ে দেয়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘খায় কি এই লোক! এতো ভারী কেন? যেনো আস্ত একটা খাম্বা!’

একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে জলপট্টি দিতে শুরু করে। কাপড়ের টুকরো কপালে রেখে পুরো ঘর খুঁজতে শুরু করে কোথাও ওষুধ আছে কি না! পুরো ঘর খুঁজেও কিছু পেলো না। দুটো ড্রয়ার তো টেনেও খুলতে পারলো না। শেষে রেগে এসে বিছানার ওপর বসে রইলো। এখন তো তারও ঘুম পাচ্ছে! বার কয়েক হাই তুলে জলপট্টি দিতে থাকে। এটুকুতে যা কমবে ততটুকুই। না কমলে তার আর কিছু করার নাই। বেশ অনেকটা রাত পর্যন্ত একাধারে জলপট্টি দেয়। কাপড় দিয়ে গলা, হাতও মুছিয়ে দেয়। জ্বরটা হালকা হয়ে আসে ভোর রাতের দিকে। জ্বর হালকা দেখে ঘুমু ঘুমু চোখে আরো একবার প্রহরের দিকে তাকিয়ে শেষ বারের মতো জলপট্টি মাথায় দিয়ে যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারা রাত ঘুম না হওয়ায় সহজেই সেই ঘুম গভীর হয়ে যায়।

২৭.
রোদের তীব্র আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় প্রহরের। জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় পুরো গা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। বাহিরে সূর্য মামাও তার তেজ দেখানো শুরু করেছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসে। কপাল থেকে জলপট্টিটা ততক্ষণে পড়ে গেছে। হাই তুলে আড়মোড়া কাটিয়ে পাশে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। চৈত্রিকা এলোমেলো ভাবে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। শাড়ি ঠিক নেই। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চৈত্রিকা হঠাৎ এভাবে ঘুমাচ্ছে কেনো? মেয়েটা তো তার ঘুম থেকে উঠার আগেই উঠে যায়। আজ এখনো ঘুমিয়ে আছে যে! আড়চোখে একবার পাশে তাকিয়ে কাথা টেনে দেয় চৈত্রিকার কোমড় অব্দি। চোখ যায় পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলের ওপর। সেখানে পানির জগ আর বিছানার ওপর জলপট্টি দেখে যা বুঝার বুঝে যায়। সাথে সাথেই কপালে ভাজ পড়ে। মনে মনে হাজারটা চিন্তা ভাবনা করেও হিসাব মিলাতে না পেরে গম্ভীর আওয়াজে বিড়বিড় করে বলে,

‘শ’ত্রুর ওপর হঠাৎ এতো দয়া! তবে কি প্র’তিশো’ধের চেয়েও বেশি মনুষ্যত্ব কাজ করে?’

বাঁকা হাসে প্রহর। পকেটে হাত গুজে শিষ বাজাতে বাজাতে গোসলখানায় ঢুকে পড়ে। প্রহরের গোসল শেষ হওয়ার আগেই বাহির থেকে ডাক আসে অর্থির। দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বেশ জোড়ে ডাকে,

‘ওহ ভাবীজান কই আপনি? দরজা খোলেন!’

অর্থির চেঁচানো আর দরজার শব্দে চমকে লাফিয়ে বসে চৈত্রিকা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মস্তিষ্কের চলাচল কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতেই অর্থির ডাক ভেসে আসে। চৈত্রিকা উঠে আগে দরজা খুলে দেয়। অর্থি চোখ ছোট ছোট করে বলে,

‘আপনি এখনো ঘুমাচ্ছিলেন? এতো দেড়ি হলো যে!’

‘হ্যাঁ! আসলে কাল রাতে তোমার ভাইজানের জ্বর ছিলো। সারারাত জেগে ছিলাম তো তাই এতো বেলা করে ঘুমিয়েছি। তুমি বসো আমি গোসলটা সেড়ে আসি!’

প্রহরের জ্বরের কথা শুনে অর্থি লাফিয়ে ওঠে। দ্রুত চৈত্রিকার কাছে এসে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘ভাইয়া কোথায় ভাবীজান? জ্বর কিভাবে হলো? এখন কেমন আছে? জ্বর কমেছে ভাইজানের?’

চৈত্রিকা থামায় অর্থিকে। বিছানার দিকে তাকিয়ে প্রহরকে না দেখে বুঝতে পারে প্রহরের জ্বর কমে গেছে। হয়তো গোসল করতেছে! তাই অর্থিকে বেশ ছোট করে বলে,

‘তোমার ভাইজানের জ্বর ভালো হয়ে গেছে। গোসল করতেছে হয়তো!’

তাদের কথার মধ্যেই প্রহর চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে আসে। অর্থি তাকে দেখেই ছুটে যায়। পা উচিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘ভাইজান তোমার জ্বর আসছে? এখন কমছে? তোমার কি অনেক খারাপ লাগছে? চলো আব্বাজানের কাছে! নাহ নাহ ডাক্তারের কাছে যাই চলো!’

প্রহর গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে বোনের দিকে তাকায়। মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। অর্থির কপালের এক পাশে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে বলে, ‘আমি একদম ঠিক আছি পুচকি। তুই এতো চিন্তা করছিস কেনো?’

‘আমি চিন্তা না করলে কে করবে? তুমি পাক্কা ঠিক আছো?’

প্রহর হেঁসে মাথা নাড়ায়। দুই ভাইবোন কথা বলতে শুরু করে। চৈত্রিকা পুরোটা সময় নিঃশব্দে দাড়িয়ে রয়। প্রহরের দিকে তাকিয়ে ভাবে। বোনকে এতো ভালোবাসে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গোসলখানায় যায়। তখনো দুই ভাই বোনের খুনশুটি, গাল ফুলানো চলছে।

২৮.
আজ চৈত্রিকা আর প্রহরের বিয়ের ৩য় দিন। দুইদিনের মধ্যেই চয়ন রেনওয়াজ সবাইকে নিমন্ত্রণ করে ফেলেছে। অনুষ্ঠান কাল হবে। নিয়ম মতো বিয়ের পরেরদিনই চৈত্রিকা তার মামার বাড়িতে ফিরতি যাওয়ার কথা থাকলেও তা নির্ধারণ হয়েছে ৭ দিন পর। তাই আজ সাথী আর আজম আলী জমিদার বাড়িতে এসেছে। সাথীর মূল উদ্দেশ্য চৈত্রিকার সাথে দেখা করা হলেও আজম আলী এসেছে অন্য কোনো কারণে। সাথী সন্দেহ করলেও কিছু বলেনি। জমিদার বাড়িতে সাথী আর আজম আলী আসার পর পরই ডাক পড়ে চৈত্রিকার। সাথীকে নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও আজম আলীকে দেখেই পল্লবীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আছে। আজম আলী মুখ ভঙ্গী এমন করে আছে যেনো তার মতো ভদ্র, সুশীল কোনো মানুষ এই পৃথিবীতেই নেই। অথচ মনে মনে শ’য়’তা’নীর বুদ্ধির কারখানা খুলে রেখেছে। চৈত্রিকা নিচে এসেই প্রথমে সাথীকে জড়িয়ে ধরে। সাথী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,

‘তুই ঠিক আছিস চৈত্র? ওরা তোর কোনো ক্ষ’তি করেনি তো?’

চৈত্রিকা নিঃশব্দে হেঁসে ওর মতোই ফিসফিস করে বলে, ‘জ্বলজ্যান্ত আমি দাঁড়িয়ে আছি তোর সামনে তাও বলছিস ওরা আমার ক্ষ’তি করেছে কি না!’

সাথী চৈত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকায়। আজম আলী মুখে মধু নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

‘কেমন আছিস মা? তোকে কতদিন দেখি না! অনেক মনে পড়ছিলো তোর কথা। আয় মা বুকে আয়!’

আজম আলী চৈত্রিকাকে জড়িয়ে ধরতে আসলে সাথে সাথেই পেছন থেকে ভেসে আসে প্রহরের কন্ঠ। বেশ ঝাঁঝালো, গম্ভীর স্বরে বলে,

‘ভাগ্নীকে কেবল ২ দিন না দেখেই তুমি কতগুলো দিন বানিয়ে দিয়েছো আজম আলী! এতো ভালোবাসো ভাগ্নীকে? আবার জড়িয়েও ধরতে যাচ্ছো!’

আজম আলীর শরীরের শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে। সে জানতো প্রহর আজ বাড়িতে নেই। তবে! প্রহরের কন্ঠস্বর শোনার পর সাহস করে চৈত্রিকাকে জড়িয়ে ধরার মতো কলিজা তার নেই। চুপচাপ সরে যায় চৈত্রিকার থেকে খানিকটা দুরে। চৈত্রিকা তখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আজম আলীর হঠাৎ এতো মধুর স্বর! পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে আওড়ায়,

‘কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে এখানে? দেখে তো ভাবসাব ভালো ঠেকে না!’

প্রহর এগিয়ে এসে সোফায় বসে। হেসে বলে, ‘আরেহ তুমি তো আমার মামাশ্বশুর। নিজের শ্বশুর আব্বার আদর যত্ন তো কপালে নেই তাই তুমিই ভরসা। আসো আসো এখানে বসো!’

আজম আলী ফাঁকা ঢোক গিললেন। পরপর কয়েকবার এদিকে ওদিক তাকিয়ে প্রহরের দিকে তাকাতেই তার দম বের হওয়ার মতো অবস্থা হয়। প্রহরের তীক্ষ্ণ, লাল চোখদ্বয় যেনো আজম আলীর য’মের মতো কাজ করে। আশে পাশে তাকিয়ে পিয়াসকে খুঁজেও পেলো না। মনে মনে পিয়াসকে গালি দিতে দিতে কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রহরের পাশে বসে। প্রহর আজম আলীর কাছ ঘেঁষে বসে কাঁধে হাত রাখে। হাসি হাসি মুখ রেখেই কন্ঠ শক্ত করে নিচু স্বরে বলে,

‘স্বভাব পাল্টাবে না তোমার তাই না আজম আলী? যেই না সুযোগ পেয়েছো আবার আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়াচ্ছো! আমার কিন্তু ১ মিনিটও সময় লাগবে না তোমার কলিজা টে’নে বে’র করে ফেলতে। লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি! এরপর যদি দেখি আমার বাড়ির বা গ্রামের একটাও মেয়ের দিকে তুমি কু’ন’জর দিয়েছো তবে সত্যি সত্যি আমি তোমার কলিজা ফু’টো করে তা বাহিরে বের করে আনবো। আর প্রহর রেনওয়াজের কতটুকু করার মতো সাহস আছে তা নিশ্চয় তোমার জানা!’

আজম আলী ভয়ে, গরমে ঘেমে উঠে। প্রহর সরে এসে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আমার মামাশ্বশুর আর শালিকাকে ভালো মতো আপ্যায়ন করো। আর দেখো মামা কেমন ঘামছে! উনাকে একটু বাতাাস করো বেশি করে। অতিথি রুমে বসিয়ে ফ্যানের হাওয়া খাওয়াও।’

চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রহর আর আজম আলীর দিকে। কি এমন বললো প্রহর! রীতিমতো মামার ঘাম ছুটে যাচ্ছে! সাথীকে বসিয়ে চৈত্রিকা রান্নাঘর থেকে হালকা নাস্তা এনে দেয়। সাথী ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা মিষ্টি তুলে মুখে নেয়। তারপর কোনো রকমে চৈত্রিকাকে টেনে নিয়ে আসে দুরে। আজম আলী বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। প্রহর নিজেও এই সময় নেই বলে চৈত্রিকা সাথীকে নিয়ে তাদের ঘরে আসে। চেপে ধরে বলে,

‘পিয়াস রেনওয়াজ কাল আমাদের বাড়িতে আসছিলো। আব্বা আর উনি কতক্ষণ ঘরের দরজা আটকে কি সব নিয়ে কথা বললেন। তুই কিন্তু সাবধানে থাকবি! আমার মোটেও ভালো ঠেকছে না ওদের উদ্দেশ্য।’

২৯.
মন খারাপ করে জমিদার বাড়ির পেছনের বাগানে এসে বসে আছে অর্থি। সাথে অর্পিতাকেও টেনে এনেছিলো কিন্তু অর্পিতা দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে আছে। তাই একা একাই সে বসে আছে। কোথা থেকে নিবিড় এসে হাজির হয়। পেছন থেকে অর্থির মাথায় গাট্টা মে’রে বলে,

‘এখাানে একা একা কি পে’ত্নীর সাথে গল্প করো নাকি? কোনো কাজ নেই? একা একা বসে আছো কেনো?’

অর্থি ফ্যালফ্যাল করে নিবিড়ের দিকে চেয়ে বললো, ‘আপনি কোথা থেকে আসলেন মাষ্টারমশাই? আপনি কি সত্যি আসছেন নাকি আমি স্বপ্ন দেখতেছি!’

নিবিড় নিজের কপাল চাপড়ালো। সে কি করে ভুলে গেলো এটা যে আসলে অর্থি! বোকা, গা’ধা অর্থি। মেয়েটার মাথায় হয়তো সামান্যতম বুদ্ধি টুকুও নেই। থাকলে কেউ এমন হয়? ১৫ বছরের একটা মেয়ে এতোটাও বোকা হয়? কিছুদিন পরই হয়তো ১৬ তে পা দেবে অথচ এতো বোকা! অসম্ভব! নিবিড় ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,

‘তুমি কি জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখো?’

‘নাহ তো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি এখন দেখছি। কারণ আপনি তো আমার ওপর রেগে আছেন আর তাছাড়া এই সময় এখানে আসবেন কোথা থেকে? তাহলে তো আমি জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছি তাই না!’

নিবিড় কোনো কথা না বলে চুপচাপ একটা গাছের নিচে বসে পড়লো। শান বাঁধানো হওয়ায় তেমন সমস্যা হলো না। তবে অর্থির দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়েই থাকলো। অর্থি খানিকটা সময় গালে হাত দিয়ে বসে তাকিয়ে রইলো নিবিড়ের মুখপানে। ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো,

‘আপনি অনেক সুন্দর মাষ্টারমশাই। এভাবেই আমার স্বপ্নে এসে বসে থাকবেন। আমি আপনাকে দেখবো। কেমন!’

নিবিড় হা হয়ে গেলো। অর্থি কি বললো এগুলো! তাকে বিস্ময়ে রেখে অর্থি আবারও বললো, ‘আপনাকে দেখতে আমার এতো ভালো কেনো লাগে মাষ্টারমশাই?’

নিবিড় বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয় অর্থির দিকে। অর্থি তখনো ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটা তাকে ভাষাহীন করে দিয়ে কেমন নি’র্ল’জ্জের মতো ফ্যালফ্যাল করে দেখছে! শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে অর্থিকে ধমক লাগায়। সাথে সাথেই অর্থি চমকে পড়ে যেতে নেয়। নিজেকে সামলে মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বলে,

‘আপনি খুব খা’রাপ মাষ্টারমশাই। আপনি সবসময় আমাকে ধমকান কেনো? স্বপ্নে এসেও ধমকাতে হবে আমাকে?’

নিবিড় হতাশ। এতো বড় ধমক খাওয়ার পরও মেয়েটা বলছে এবং ভাবছে সে এখনো স্বপ্ন দেখছে! এগুলো কি নেওয়া যায়! দিন দুপুরে এই মেয়ে নাকি স্বপ্ন দেখছে! কবে যেনো এই মেয়ের মাথায় সার উৎপাদন করতে গিয়ে নিজেই গা’ধা হয়ে যায়!

চলবে..

#চৈত্রিকা (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৩০.
আজ চৈত্রিকা, প্রহরের বউভাতের অনুষ্ঠান৷ পুরো বাড়ি সাজানো শেষ। মেহমানের আগমন কাল বিকেল থেকেই শুরু হয়ে গেছে। অনেক আত্মীয়ই কাল এসেছে। বাদ বাকি সবাই আজ আসবে। প্রহরের হঠাৎ বিয়েতে সবাই খানিকটা অবাকই হয়েছে। পিঠপিছে এ নিয়ে অনেক কথা হলেও সামনাসামনি সবাই নিশ্চুপ, নীরব। প্রহরের জ্বরও ভালো হয়ে গেছে। চৈত্রিকা নিজের ঘরে বসে আছে। একে একে এসে সকল আত্মীয় দেখে যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রশংসায় পঞ্চমুখ তো কেউ কেউ হিংসায় জ্ব’লে পু’ড়ে যাচ্ছে। চৈত্রিকা সবই দেখছে তবুও কিছু বলছে না। সে অপেক্ষায় আছে বিশেষ একজন মানুষের। কখন সে আসবে! পল্লবী দেখলো চৈত্রিকার দৃষ্টি। ভ্রু কুঁচকে মুখ কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো,

‘এমন ছটফট করছো কেনো মেয়ে? কি হয়েছে?’

চৈত্রিকা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। বড় বড় শ্বাস নেয়। হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘আসলে এতো মানুষের মধ্যে একটু অস্বস্তি হচ্ছে।’

পল্লবী আর কথা বাড়ায় না। সবাই কে ঘর থেকে বের করে দিয়ে চৈত্রিকাকে একা সময় দেয়। সাথী সকাল সকাল চলে এসেছে। সনিয়া বেগম দেড়িতে আসবে। সাথী, অর্থির সাথে কথা বলতে বলতে চৈত্রিকার ঘরে ঢোকে। প্রহর, চিত্র দুজনেই বাহিরের কাজ দেখতে ব্যস্ত। অর্পিতা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। অর্থি কয়কবার ডেকেছিলো কোনো লাভ হয়নি। শেষে হতাশ হয়ে একাই চৈত্রিকার কাছে আসার উদ্দেশ্য বের হয়। সাথীকে রাস্তায় পেয়ে তার সাথেই অর্থি গল্প জুড়ে দেয়। সাথী শুধু অর্থির মুখের দিকে তাকিয়ে তার গল্প গুলো শুনলো কোনো রকম টু শব্দটিও করলো না। তার ভয় হয়। পুরো জমিদার বাড়ির একেকটা সদস্যকেই সে ভয় পায়। তার মধ্যে অর্থিও বাদ পড়েনি। অর্থির রাজ্যের গল্প ফুরোতে ফুরোতে চৈত্রিকার কাছে এসে বসে। চৈত্রিকা তখন কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়ে বিছানার মাঝে বসে বসে নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন। অর্থি চৈত্রিকাকে দেখেই খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। ধপাস করে চৈত্রিকার পাশে বসে বেশ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,

‘ভাবীজান আপনি যা পড়েন তাতেই অনেক সুন্দর লাগে। আচ্ছা আজ তো আপনাদের বউভাত তাই না? অনেকে আসবে!’

চৈত্রিকা অর্থির কথার মানে বোঝে না। আসলে মেয়েটা বলতে কি চাইছে! তাই অর্থির কথায় শুধু মাথা নাড়ে। অর্থি মন খারাপ করে বলে, ‘কবে যে আমার বিয়ে হবে! আমার বউভাতেও তো আপনারা সবাই যাবেন তাই না? নিশ্চয় অনেক মজা হবে!’

চৈত্রিকা আর সাথী চোখ বড় বড় করে তাকায়। পরমুহূর্তেই দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলে। বলে, ‘তুমি এখনো ছোট অর্থি। তাই তোমার বিয়ের দেড়ি আছে। বুঝেছো?’

অর্থি ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ায়। সেসময় ঘরে ঢোকে নীরা। চোখ মুখ কালো করে গম্ভীর স্বরে চৈত্রিকার উদ্দেশ্যে একটা ডালা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এগুলো পড়ে তৈরী হও। আমি একটু পর এসে নিয়ে যাবো তোমাকে।’

চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীরার মুখ পর্যবেক্ষণ করে। তারপর নরম স্বরে বলে, ‘জ্বি রেখে দিন! আমি পড়ে নিচ্ছি।’

নীরা চুপচাপ ডালা রেখে দেয়। চৈত্রিকার এতো রুপ, এতো প্রশংসা তার সহ্য হয় না৷ এর একমাত্র কারণ পিয়াস। পিয়াস যদি চৈত্রিকাকে বিয়ে করতে না চাইতো তবে হয়তো নীরার কাছে চৈত্রিকা ক্ষো’ভ হয়ে দাঁড়াতো না। সম্পর্কটা মিষ্টি হতো। তবে এখন নীরা চাইলেও চৈত্রিকার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। হয়তো এই নারীর প্রতি তার স্বামীর মুগ্ধতায় তার হিংসা, ক্ষোভ, রাগের কারণ। চৈত্রিকা নীরার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সাথী চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তৈরী হবি না?’

চৈত্রিকা নিঃশব্দে শাড়ি হাতে তুলে নেয়। দুজনকে বসতে বলে নিজে যায় গোসলখানায়৷ অর্থি একবার সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপু তুমি এখানে থাকো! আমি নিচে যাই। একটু চক্কর দিয়ে আসি।’

সাথী মাথা নাড়ায়। অর্থি এক ছুটে নাচতে নাচতে ঘর থেকে বের হয়৷ চৈত্রিকা শুধু শাড়ি পড়ে ঘরে এসে দাঁড়ায়। সাথী বেশ আতঙ্কিত স্বরে বলে,

‘আজ কি হবে বুঝতেছিস? তুই উনার সামনে গেলে যদি উনি তোকেও মে’রে ফেলতে চায়?’

চৈত্রিকা ফট করে তাকায় সাথীর দিকে। পুরো ঘরে একনজর তাকিয়ে সাথীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। চেপে ধরে বেশ আস্তে বলে, ‘চুপ! এখানে কিচ্ছু বলবি না। দেওয়ালেরও কান আছে!’

সাথী মাথা নত করে নেয়। চৈত্রিকা বেশ সাবধানে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নেয়। তারপর আয়নার সামনে বসে গহণা পড়তে পড়তে বলে, ‘অর্থি কোথায়?’

‘নিচে গেছে।’

চৈত্রিকা নিঃশব্দে হাসে। নিজের মতো তৈরী হতে শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পল্লবী আর নীরা আসে। নিজেদের মতো চৈত্রিকাকে গুছিয়ে নেয়।

৩১.
অর্থি দুতলা থেকে নিচ তলায় একবার উঁকি মারে। অনেক লোকজন দেখে ঠোঁট কামড়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। চারপাশে নজর বুলিয়ে খোঁজে নিবিড়কে। মাষ্টারমশাই আজ আসেনি? সবাই তো এসেছে নিমন্ত্রণে তবে কি মাষ্টারমশাই আসেনি? ভেবেই ঠোঁট ফুলায় অর্থি। সাথে সাথেই পেছন থেকে কেউ তার মাথায় গাট্টা মা’রে। অর্থি চমকে, আর্তনাদ করে চোখ মুখ কুঁচকে পেছনে তাকায়। পেছনে স্বয়ং নিবিড়কে দেখে খানিকটা অবাকই হয়। চোখ বড় বড় করে বলে,

‘আপনি কখন আসলেন মাষ্টারমশাই? আপনাকে তো নিচে দেখলাম না!’

নিবিড় গতকাল দুপুরের ঘটনায় এমনিতেই বড় সড় আতঙ্কে আছে। মেয়েটা সাংঘাতিক! মানে দিনদুপুরে যে মেয়ে জ্বলজ্যান্ত মানুষকে বলে স্বপ্ন সে যখন তখন যা তা বলে দিতে পারে! নিবিড়কে চুপ করে থাকতে দেখে অর্থি ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকায়। বলে,

‘মাষ্টারমশাই কিছু বলছেন না কেনো? কোথায় হারাইছেন?’

নিবিড় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে, ‘কোথাও হারাইনি। আর একটু আগে এসেছি। তুমি হয়তো দেখোনি! তা তোমার স্বপ্নের কি খবর? দিন দুপুরে কি এখনো স্বপ্ন দেখো?’

অর্থি লাফিয়ে ওঠে। ফ্যালফ্যাল করে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি কেমন করে জানলেন আমি দিন দুপুরে স্বপ্ন দেখি? আপনিও কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেন মাষ্টারমশাই?’

নিবিড় কোনো কথা বললো না। এখন কিছু বলা মানে এই মেয়ের বোকা বোকা কথা শুনে নিজের মাথা খারাপ করা। তাই সে নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ অর্থির দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্থি তখনো নিজের জবাবের আশায় নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিড় উল্টো ঘুরে নিচে নামতে নামতে বললো,

‘সারাদিন বোকা বোকা কথা না বলে নিজের দিকে ধ্যান দাও! বাড়ি ভর্তি মেহমান অথচ তুমি পড়ে আছো নিত্যদিনের শাড়ি। তাই শাড়িটা বদলে তোমার বড় ভাবীজানের কাছে যাও!’

অর্থির খেয়াল হলো। চমকে নিজের দিকে তাকিয়ে ছুট লাগালো নিজের ঘরের দিকে। সে তো সব সময় সবার আগেই তৈরী হয় তবে আজ এমন ভুল করলো কেনো? গাল ফুলিয়ে এক পলক পেছনে তাকিয়ে দেখলো নিবিড় তার যাওয়ার পথের দিকেই চেয়ে আছে। অদ্ভুত ভাবে অর্থির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।

৩২.
২ দিন থেকে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিলো অর্পিতা। তেমন একটা বেরও হয়নি, কারোর সাথে কথাও বলেনি। আগের মতো চঞ্চলতাও নেই তার মাঝে। বিষয়টা খেয়াল করেও বেখেয়ালী ভাব নিয়ে ছিলো শায়লা। আজ এতো মেহমানের মধ্যে তার আত্মীয়ও এসেছে। সেই সুবাদে তিনি মেয়ের ঘরে নিয়ে এসেছে তার পছন্দের বোনকে। তার মনের চিন্তাধারা যে ভিন্ন তা তার চোখে মুখের উপচে পড়া হাসিতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। মেয়ের ঘরে ঢুকে দেখে অর্পিতা তখনো বিছানার ওপর বসে আছে। শায়লা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,

‘কিরে অর্পি তুই এখনো বসে আছিস কেনো? তৈরী হবি কখন? ওদিকে তো সব মেহমান চলে এসেছে। নতুন বউও তৈরী হয়ে গেছে। জলদি ওঠ! আর দেখ কাকে নিয়ে এসেছি!’

অর্পিতা অনিচ্ছা স্বত্বেও নিজের মায়ের দিকে তাকায়। তারপর তার পাশে দাঁড়ানো নিজের খালামনির দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়। শিল্পা ভাগ্নীর অবাক মুখ দেখে হেঁসে বলে,

‘কিরে খালামনিকে আশা করিসনি? আমি এসে থেকে তোকে খুঁজে যাচ্ছি আর তুই তখন থেকে লুকিয়ে আছিস নিজের ঘরে!’

অর্পিতা নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে। বিছানা থেকে নেমে শিল্পাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কখন আসলে খালামনি? তুমি যে আসবে তা তো বলোনি!’

‘তোকে একটু অবাক করে দিলাম। খুশি হয়েছিস?’

অর্পিতা হেঁসে বলে, ‘অনেক!’

শিল্পাও হাসে। তারপর অর্পিতাকে তাড়া দিয়ে বলে, ‘জলদি যা শাড়ি পড়ে আয়! আরও একজন কিন্তু অপেক্ষা করছে তোর!’

অর্পিতা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে তা অগ্রাহ্য করে শায়লা আর শিল্পা। অগত্যা দুজনের জোড়াজুড়িতে অর্পিতা আগে শাড়ি পড়ে নেয়। শাড়ি পড়ে আসলে শিল্পা আর শায়লা ধরে হালকা গহণাও পড়িয়ে দেয়। তারপর বাহিরে নিয়ে আসে৷ অদ্ভুত ভাবে সেই সময়ই চিত্রও নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। অর্পিতার সাজহীন রুপ দেখেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। অর্পিতা অনুভূতি শূণ্যের মতো তাকিয়ে রইলো চিত্রর মুখপানে। চিত্র তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই অর্পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মা আর খালামনি তাকে টেনে আনে নিচে। শিল্পা একটা ছেলের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,

‘স্মরণ! দেখ তো অর্পিকে কেমন লাগছে?’

অর্পিতা আর স্মরণ দুজন একসাথেই নিজেদের দিকে তাকায়। স্মরণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেও অর্পিতার চোখে মুখে বিস্ময়। তার বিস্ময় কাটার আগেই শায়লা বলে,

‘আমার অর্পিকে কি খারাপ লাগার সুযোগ আছে? তাছাড়া তোর ছেলেট হবু বউ আমার অর্পি। খারাপ লাগার প্রশ্নই আসে না। কি বলিস স্মরণ!’

স্মরণ খানিকটা লজ্জা পায়। অর্পিতা অবাক হয়ে, বিস্ময়ে হতভম্বের মতো চেয়ে রয় তার মায়ের দিকে। স্মরণের হবু বউ মানে! অবাকতার রেশ না কাটিয়েই বিড়বিড় করে বলে,

‘আমি আর স্মরণ ভাই!’

৩৩.
চৈত্রিকা আর প্রহর পাশাপাশি বসে আছে। প্রহরের চোখ মুখ দেখে বোঝা দায় সে খুশি নাকি অখুশি! চৈত্রিকা কয়েকবার তার মুখের দিকে তাকিয়েছে৷ চৈত্রিকা সবার সাথে বেশ হাসিখুশি মুখেই কথা বলছে। কেউ বুঝতেই পারবে না মেয়েটা বিয়ে নিয়ে অখুশি৷ চৈত্রিকার এতো খুশি খুশি রুপ হজম হলো না অনেকেরই। দুর থেকে পিয়াস, আজম আলী দুজনেই মনে মনে ফুঁসছে। আজম আলীকে প্রহর এতোভাবে আতঙ্কিত করার পরও শুধরেছে বলে মনে হয়না৷ প্রহর আড়চোখে পুরো পরিবেশটাই পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছে। পাশাপাশি বসা দুটি মানুষের মনেই চলছে একই কথা অথচ একজন জানলেও অন্যজন তা জানে না। দুজনেই অপেক্ষায় আছে আসন্ন চমকের। এরমাঝেই সব মেহমান এসে গেছে। সবার সাথে দেখা হলেও যার জন্য অপেক্ষা সেই মানুষের দেখা এখনো পায়নি চৈত্রিকা। ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে আছে কখন তার দেখা পাবে! তার অস্থিরতা খেয়াল করে প্রহর বাঁকা হাসে। মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে চৈত্রিকার কাছে৷ ফিসফিস করে বলে,

‘তোমার অপেক্ষার সমাপ্তি প্রিয় বউ!’

সাথে সাথেই চমকে তাকায় চৈত্রিকা। প্রহরের দিকে তাকাতেই ভেসে আসে এক মহিলা কন্ঠের আওয়াজ। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে চৈত্রিকার। পল্লবী হাসতে হাসতে এক মহিলাকে নিয়ে এগিয়ে আসে। চৈত্রিকাকে দেখিয়ে বলে,

‘এটা আমার বাড়ির নতুন বড় বউ চৈত্রিকা। আর বড় বউ এটা তোমার কাকি শ্বাশুড়ি হয়।’

চৈত্রিকার নাম শুনেই চমকায় নাসিমা। চৈত্রিকা একদম স্বাভাবিক ভাবেই সালাম দেয়। নাসিমা মুখ দেখে আরো এক ধাপ চমকায়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে কোনো রকমে নিজেকে সামলায়৷ সালাম নিয়েই কোনো কথা না বলে সরে যায়। চৈত্রিকা হাসে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায় নিমিষেই৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাসিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একবার পাশে তাকায়। প্রহর তখন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রহরের এহেন দৃষ্টিতে খানিকটা চমকে যায় চৈত্রিকা। প্রহর অদ্ভুত ভাবে হেঁসে নিজ জায়গা থেকে উঠে যায়। সাথী ছুটে আসে চৈত্রিকার কাছে। ফিসফিস করে বলে,

‘চৈত্রিকা! উনি…’

চোখের ঈশারায় থামিয়ে দেয় চৈত্রিকা। সাথী বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। অর্থি, অর্পিতা এসে চৈত্রিকার সাথে গল্প করে। যদিও বেশির ভাগ কথা বোকা অর্থিই বলতেছে আর তারা চুপচাপ শুনছে। একপর্যায়ে খাওয়া দাওয়ার পর্ব আসলে সবাই ধীরে ধীরে খাওয়ার জন্য যায়। প্রহর আর চৈত্রিকাকে একই প্লেটে খাবার দেওয়া হয়। গ্রামের রীতি অনুযায়ী এক প্লেটে খাবার খেলে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বাড়ে৷ কথাটা শোনার সাথে সাথেই চৈত্রিকা চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েছে। বিড়বিড় করে বলে,

‘মিথ্যা হোক বা সত্যি যদি এক প্লেটে খাবার খেলে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বাড়ে তাহলে আমি খাইলাম না এই লোকটার প্লেটে। আসছে! এটার প্রতি ভালোবাসা বাড়বে শুনলেই তো আমি মেপে মেপে ১০ হাত দুরে থাকবো।’

প্রহর চৈত্রিকার মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট চেপে হাসে৷ এর মধ্যেই প্রহরের বন্ধুমহলের একজন খোঁচা মে’রে বলে, ‘প্রহর নিজ হাতে খাইয়ে দিস ভাবীরে। এতে ভালোবাসা একদম সাগরের জলের মতো বাড়তেই থাকবে।’

মুহুর্তেই হাসাহাসিতে ভরে ওঠে পরিবেশ। অন্য সময় হলে প্রহর নিজেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতো তবে চৈত্রিকার মুখের অবস্থা দেখে তার আর ইচ্ছে করলো না ধমক দিতে। চুপচাপ মজা নিতে থাকে। চৈত্রিকা পড়ে আছে চিপায়! না পারছে উঠে চলে যেতে আর না ইচ্ছে করছে লোকটার হাতে বা তার প্লেটে খেতে! মুখটা কাঁদো কাঁদো করে অবশেষে অনেক অযুহাতেও যখন ছাড় পেলো না তখন প্রহরের হাতেই খেয়ে নিতে হলো। ইচ্ছে করলো ঠা’স করে প্রহরের মাথাটাই ফা’টিয়ে দিতে!

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার মতো বসে রেস্ট নিচ্ছিলো। নাসিমা ঘেমে একাকার হয়ে আছে। চৈত্রিকা দুর থেকে একবার তা দেখে হেঁসে এগিয়ে আসে৷ হাতে থাকা রুমাল টা এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ঘেমে যাচ্ছেন কেনো কাকিশ্বাশুড়ি? নিন রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে নিন!’

নাসিমা চমকে তাকায়। ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে একদমে বলে, ‘এটা অসম্ভব! তুই কিভাবে!’

‘কেনো মা? খুব বেশি অবাক হচ্ছো নিজের পেটের মেয়েকে বেঁচে থাকতে দেখে!’

চলবে..