চৈত্রিকা পর্ব-১৩+১৪

0
305

#চৈত্রিকা (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

চৈত্রিকার ‘মা’ ডাকে নাসিমার আত্মা বের হয়ে আসার উপক্রম। হাতের তালুতে হাত ঘষছে অনবরত। আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছে বার বার। ঘেমে ঘাম কপাল দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। পাশেই চৈত্রিকা বসে তাকিয়ে আছে নাসিমার মুখের দিকে। চৈত্রিকার চোখে মুখে ক্ষো’ভ স্পষ্ট। বার বার বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে ব্যর্থ। উপায়ন্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ায় নিজ জায়গা থেকে। কন্ঠের কাঠিন্যতা ধরে রেখে বেশ কড়া স্বরেই বলে,

‘এবার আর আপনাদের নিস্তার নেই মিসেস নাসিমা সাদিক রেনওয়াজ। আমার আর আমার বাবার সাথে যা যা করেছেন তার গুণে গুণে শা’স্তি আপনাদের সবাইকে দেবো। একবার যখন এই বাড়ির সাথে জুড়েছি তখন এই বাড়িতেই আপনাদের পাপের হিসাব নিবো৷’

চৈত্রিকা চলে যায়৷ নাসিমা চেয়ে থাকে চৈত্রিকার যাওয়ার দিকে৷ সে খানিকটা অবাকই হয়েছে। তার মেয়ে তো এমন ছিলো না! চৈত্রিকার তো এতো দাপট, তেজ, কন্ঠের এতো কাঠিন্যতা ছিলো না! মেয়েটা তো সব সময় মাথা নিচু করে নরম স্বরে কথা বলতো। সবসময় সবার সাথে সুন্দর ভাবেই কথা বলতো। এই চৈত্রিকা তো তেমন নয়! এই চৈত্রিকার মাঝে অন্যকিছু আছে। এবার কি সত্যি তাদের পত’নের সময় এসে গেছে? শিউরে ওঠে নাসিমা। ভয়ে, চিন্তায় নিজ জায়গা থেকে উঠে যায়। ভয়ে তার পা-ও যেনো নড়তে নারাজ। কোনো রকম ভারী শরীরটা টেনে নিয়ে এগিয়ে চললো তার স্বামী সাদিক রেনওয়াজের দিকে। বিষয়টা সাদিককে জানানো দরকার!

৩৪.
অর্থি খাওয়া শেষেও বসে বসে হাড্ডি চিবুচ্ছিলো। অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অর্থি খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। যেনো পৃথিবীতে এই মুহুর্তে খাওয়া ব্যাতীত তার কোনো কাজ নেই৷ আর এতোটাই ধীরে সুস্থে খাচ্ছে যে মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি খেলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে নয়তো বড় সড় কোনো পাপ হবে। শেষমেশ ধৈর্য রাখতে না পেরে অর্থির মাথায় গা’ট্টা মে’রে দেয় অর্পিতা। অর্থি খেতে খেতেই উল্টে পড়তে নেয়। মুখ ফুলিয়ে তাকায় অর্পিতার দিকে৷ অর্পিতা বেশ রাগী স্বরে বলে,

‘কখন থেকে দেখছি গি’লেই যাচ্ছিস! খাবি একটু জোড়ে খা! এমন কচ্ছপের মতো কে খায়? নিজে তো খাওয়া শেষ করছিসই না আবার আমাকেও যেতে দিচ্ছিস না।’

‘তুমি আমাকে খাওয়ার জন্য বকা দিলা আপু? আমারে বকা দিলা? এইটা তুমি করতে পারলা?’

‘তাড়াতাড়ি না খেলে এবার তুই মা’ইর খাবি আমার কাছে। দেখ তো কার খাওয়া বাকি আছে? তুই বাদে আর কে খাচ্ছে এখানে!’

‘কেউ নাহ তো। এজন্যই তো আমি বেশি বেশি খাচ্ছি।’

অর্পিতা কপাল চাপড়ায়। অর্থির মাথায় আরেকটা গা’ট্টা মে’রে নিজেই উঠে যায়। অর্থি ঠোঁট উল্টে নাক টানে৷ এক হাতে চুল ঠিক করে অন্য হাতে হাড্ডি খাওয়া শুরু করে। অর্পিতা তাকে মে’রে যাওয়ায় দুঃখে একটু পর পর নাক টানছে কিন্তু খাওয়া বন্ধ করছে না। তাকে এই অবস্থায় দুর থেকে দেখে নিবিড়৷ খাওয়ার সময় এমন করছে কেনো তাার বুঝে আসে না৷ চুপচাপ এগিয়ে আসে অর্থির কাছে। অর্থির সামনের চেয়ারে বসে ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে তাকায়। অর্থি নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে ফের নাক টেনে হাড্ডি মুখে পুড়ে দেয়। নিবিড় গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

‘কান্নার তো লেশ মাত্র নেই চোখে মুখে তবে খাওয়ার সময় এমন নাক টানো কেন? ঝাল লেগেছে? ঝাল লাগলে খাচ্ছো কেনো?’

অর্থি চেয়ারটা একটু এগিয়ে বসে নাক টেনে টেনে বলে, ‘ঝাল লাগেনি মাষ্টারমশাই। অর্পি আপু আমাকে মে’রেছে তাই মনে মনে কান্না করছি আর নাক টানছি।’

অর্থির লজিকে নিবিড় একটুও অবাক হলো না। সে এমন কিছুই আশা করেছিলো। তাই একটুও অবাক না হয়ে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
‘তা কি কারণে অর্পি আপু তোমাকে মা’রলো?’

‘কি কারণ আবার! এই যে আমি নাকি অনেকক্ষণ থেকে হাড্ডি চিবুচ্ছি। আপনিই বলেন আমি কি অনেকক্ষণ থেকে হাড্ডি চিবুচ্ছি? নাহ তো। এই একটু আগে বসেছি।’

‘হ্যাঁ। তুমি তো একটু আগেই খেতে বসেছো! তোমার পরে যারা বসেছিলো সবাই খেয়ে বাড়িও চলে গেছে আর তুমি একটু আগে বসেছো! নাহ, ঠিকই তো আছে।’

অর্থি কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে আবার নিজের খাওয়ার দিকে মন দিলো নিবিড় শুধু বসে বসে অর্থির খাওয়াটাই দেখে গেলো। অর্থির খাওয়া পাক্কা ২০ মিনিট পর শেষ হয়৷ হাত ধুয়ে পানি খেয়ে উঠে হাসি মুখে তাকায় অর্থি। তার হাসিতে ছাই ফেলে নিবিড় বেশ সাবলীল গলায় বলে,

‘এতোক্ষণ ধরে আজাইরা হাড্ডি চিবুতে পারো আর পড়ালেখার ‘প’ টাও পারো না! তোমার মাথায়, মস্তিষ্কে ব্রেইনের ‘ব’ টাও কি আছে?’

অর্থির হাসিমুখ মিলিয়ে গেলো৷ ঠোঁট উল্টে বললো, ‘আপনি আমাকে এভাবে কেনো বলছেন মাষ্টারমশাই? আমি তো ‘প’ ‘ব’ এগুলো পারি। ‘ক-ঁ’ তো আমার মুখস্থ।’

নিবিড় কিছু বলার ভাষা পেলো না। সে কি বুঝালো আর মেয়েটা কি বুঝলো! হতাশ না হয়ে ফের নিজেই জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কি কি পারো?’

অর্থি দুষ্টু হেঁসে বলে, ‘জাতীয় সঙ্গীত পারি। শোনাবো?’

নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোমার ওই সার ছাড়া মাথায় জাতীয় সঙ্গীত গেছে?’

‘হুম গেছে তো। গেয়ে শোনাবো?’

‘শোনাও দেখি!’

‘আমার সোনার বাংলা
আমি আপনাকে ভালোবাসি মাষ্টারমশাই!’

অর্থি ছুটে পালিয়েছে। নিবিড় হা করে তাকায় অর্থির যাওয়ার দিকে। মেয়েটার চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাপ দেখে ভেবেছিলো কিছু তো একটা উল্টা পাল্টা বলবে তবে এভাবে এটা বলবে তা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি নিবিড়। তাই তার মুখ আশ্চর্য হা হয়ে গেছে।

৩৫.
রাতের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে সবকিছু নীরব, নিস্তব্ধ। যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে অনবরত। পুরো বাড়িটা ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই চৈত্রিকার চোখে। প্রহর এখনো আসেনি। তাই সে চুপচাপ শুয়ে আছে। হাতটা কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাতের আঁধারে নিজের সমস্ত রাগ, কষ্ট একের পর এক মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। নিজের মা কিভাবে বে’ইমানী করতে পারে সে আজও তা ভেবে কুল কিনারা পায় না। মায়েরা নাকি নিজের সন্তানকে তাদের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে তবে তার নিজের মা কেনো তাকে এভাবে নিঃশেষ করতে চেয়েছিলো! সেই ভ’য়ং’কর রাতের কথা মনে পড়লে আজও চৈত্রিকার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্ব’লে ওঠে। যে মেয়েটা সহজ, সরল, নরম মনের মেয়ে ছিলো সেই মেয়েটাই আজ এতোটা কঠিন যে নিজের উদ্দেশ্য থেকে এক পাও নড়ছে না। নিজের মা’কেও তার পাপের শা’স্তি থেকে বঞ্চিত করেনি। যতটা শা’স্তি জমিদার বাড়ির একেকটা সদস্য পাবে ঠিক ততটাই শা’স্তি সে নিজের মায়ের দিকেও ছুড়ে দেবে৷ চোখ বন্ধ রেখেই বড় শ্বাস নেয় চৈত্রিকা। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোটা অশ্রু। পানি যেমন আগুন নিভাতে সক্ষম হলেও মাঝে মাঝে আগুনের তাপ বাড়িয়ে দেয় তেমনই এই চোখের অশ্রুকণাও মনের ভেতরের আগুন একফোঁটাও না কমিয়ে বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুণ। মনে মনে শক্ত প্রতিজ্ঞা করে নেয়। চোখের জল মুছতে মুছতেই দরজা খোলার শব্দ হয়। চৈত্রিকা চোখ খোলে না। চোখ বন্ধ করেই রাখে। প্রহর একপলক চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। সাদামাটা শাড়িতেও মেয়েটার সৌন্দর্য এতটুকুও কমে না৷ এই মেয়ের সৌন্দর্যে পুরুষ নির্দ্বিধায় পু’ড়ে যাবে। নিজের চোখ নামিয়ে আগে শার্ট বদলে নেয়। ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে শুধু সেন্ডো গেঞ্জি পড়েই হাত মুখ ধুয়ে আসে৷ আড়চোখে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে চলে যায় ব্যালকনিতে। তামাকের ধোঁয়ায় ভেতর পু’ড়িয়ে ফের চলে আসে ঘরে। চৈত্রিকা তখনো একরকম ভাবেই শুয়ে আছে। একটুও নড়াচড়া করেনি৷ প্রহরের সিগারেটের গন্ধে নাক মুখ কুঁচকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চৈত্রিকা। প্রহর চুপচাপ এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে,

‘না ঘুমিয়ে জেগে আছো কেনো?’

চৈত্রিকা ভেতরে চমকালেও বাহিরে একদম স্বাভাবিক হয়েই শুয়ে রইলো। প্রহর জানলো কিভাবে সে যে ঘুমায়নি! প্রহর চৈত্রিকার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে চৈত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অতীত চোখের সামনে ভাসলে মানুষের ঘুম হয় না চৈত্রিকা।’

এ পর্যায়ে চৈত্রিকা চট করে চোখ মেলে তাকায়। প্রহরের দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই প্রহর হাসে। চৈত্রিকার মনে হলো এ হাসিতে জীবন নেই৷ শুধু তাকে তাচ্ছিল্য করে নয়তো ভেতরের সংঘর্ষ থেকে টেনে বের করলো হাসিটা। ব্যাস! প্রহরের দিকে তাকিয়েই থাকে চৈত্রিকা। অতীতের কথা কেনো বললো প্রহর? প্রহর কি জানে কিছু? পরক্ষণেই মনে হয় জানবে না কেনো? যে অপ’রাধের অংশীদার প্রহর নিজেই সেখানে নাসিমা যে প্রহরকে জানায়নি চৈত্রিকা তার মেয়ে এটা কিভাবে হয়! নিজের অবাকতা সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। প্রহর চৈত্রিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়। চলন্ত সিলিং এর দিকে তাকিয়েই বলে,

‘সবসময় আমরা যা দেখি, যা জানি তার পেছনে আরও কিছু দেখা, জানা থাকে। আমরা চোখের সামনের মানুষটাকে প্রতিদিন দেখেও তাকে চিনতে পারি না। আমরা ভাবি হয়তো সামনের মানুষটাকে পুরোপুরি চিনি, জানি। তবে আমাদের চেনা, জানার মধ্যেও আরো চেনা জানা থাকে। তোমার বয়স কম যা জানবে, শুনবে, দেখবে তাই সত্য মনে হবে। তুমি জমিদার বাড়ির বউ হয়ে এসেছো! এই জমিদার বাড়ির একেকটা খড়কুটোও যেনো রহস্য হয়ে দাঁড়াবে তোমার সামনে। সেখান মানুষগুলো তো জ্বলজ্যান্ত প্রাণী! যত জানবে তত জড়িয়ে যাবে। মনে হবে মৃ’ত্যু ধেয়ে আসছে তোমার দিকে। নিজেকে নিজে বাঁচাও।’

চৈত্রিকা বিস্ময় নিয়ে তাকায় প্রহরের দিকে। প্রহর কি তাকে সাবধান করলো! নিজের প্রতিপক্ষকে কি কেউ সাবধান করে? চৈত্রিকার মাথায় চিন্তার পোকা ঢুকিয়ে প্রহর চোখ বন্ধ করে নেয়। বিড়বিড় করে বলে, ‘বে’ঈমা’নীর শা’স্তি কেবলই মৃ’ত্যু।’

সিলিংয়ের শব্দ আর নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকা চৈত্রিকা শুনতে পেলো না সেই ছোট্ট বাক্য। সময় যেতে শুরু করলো অথচ চৈত্রিকার চোখে ঘুম ধরা দিলো না। প্রথমবারের মতো পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রহরের দিকে। সামনে যেনো জ্বলজ্যান্ত এক রহস্য মানব শুয়ে আছে! যার রহস্য তার থেকেও অনেক বেশি গভীর।

৩৬.
মধ্যরাতে ঘুম না আসায়, অস্থিরতায় অর্পিতা নিজ ঘর ছেড়ে উঠে এসেছে৷ স্মরণরা জমিদার বাড়িতে থাকবে কিছুদিন। এরপর পাকা কথা বলে তারা সবাই একসাথেই ফিরবে শহরে। ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে অর্পিতার। কি হবে, কি হবে না ভেবেই তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারংবার। চিত্রর সাথে একটাবার কথা বলা উচিত। গত ৪ টা বছর সে যেমন একপাক্ষিক ভালোবেসে গেছে তেমন করেই না হয় শেষ একটাবার বে’হায়ার মতো দাঁড়াবে চিত্রর সামনে। একটাবার সবকিছু ভেবে তাকে ভালোবাসতে বলবে! এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত হৃদয়ে চিত্রর ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো৷ বড় বড় শ্বাস নিয়ে ঘরের দরজায় হাত দিতেই দরজা আপনাআপনি খুলে যায়৷ চিত্রর ঘরের দরজা খোলা দেখে বেশ অবাকই হয় অর্পিতা। চিত্র তো দরজা খুলে ঘুমায় না! দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে চারদিকে নজর বুলিয়েও যখন চিত্র কে ঘরে দেখতে পেলো না তখন চিন্তারা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ইতস্তত মন নিয়ে গোসলখানায় উঁকি দিয়ে দেখে সেখানেও নেই চিত্র। অর্পিতা দ্রুত ব্যালকনিতে আসে। সেখানে এক কোণায় বসে আছে চিত্র। এলোমেলো ঘুমন্ত অবস্থায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। অর্পিতা চিত্রর পাশে বসে। চিত্রর এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে বেশ ভয় পায়৷ ভয়ে ভয়ে মাথাটা চিত্রর বুকের বাম পাশে নিয়ে হৃদপিণ্ডের বিট শোনে। হাফ ছেড়ে স্বস্তির শ্বাস নেয়। মাথাটা তু্লে নিতে গিয়েও নেয় না। চুপচাপ মাথাটা চিত্রর বক্ষে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকে। ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। এতক্ষণের অশান্ত, বিক্ষিপ্ত হৃদয়টা মুহুর্তেই শান্তিতে ভরে ওঠে। মনে মনে প্রার্থনা করে সময়টা থেমে যাক। তাদের এই মুহুর্তটা অনন্ত কাল এভাবেই থাকুক। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। তবুও বেহায়া চোখ ফেটে জল গড়ায়। কোনো রকমে শব্দ না করে ওভাবেই বেশ অনেকক্ষণ থাকে। এরপর আস্তে করে নিজের মাথা উঠিয়ে চিত্রর মুখের দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা হাতে চিত্রর চুলগুলো নেড়ে দিয়ে কান্নারত অবস্থাতেই হাসে। চিত্রর চোখ মুখ ছুঁয়ে আক্ষেপ নিয়ে বলে,

‘তুমি আমার এ অসীম ভালোবাসা বুঝলে না চিত্র ভাই। আমার এ বিক্ষিপ্ত হৃদয়ের প্রশান্তি হয়েও হলে না। কেনো ভালোবাসলে না চিত্র ভাই? আমাকে কি সামান্য পরিমাণও ভালোবাসা যায় না? আমি যে বিরহে গত ৪ টা বছর পু’ড়ছি এই বিরহের একেকটা দিন, একেকটা রাতও কেনো তুমি পেলে না? কেনো আমার সুখ হলে না চিত্র ভাই?’

ঘুমন্ত চিত্র হয়তো শুনলোও না বাক্যগুলো। অর্পিতা মুখ এগিয়ে চিত্রর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় গভীর ভাবে। নড়ে ওঠে চিত্র। অর্পিতা সরে আসে। দুরে বসেই তাকিয়ে থাকে চিত্রর মুখের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মনের সমস্ত কথা আবারও মনেই থেকে গেলো। নিজেকে উজাড় করে প্রকাশ করা হলো না তার চিত্র ভাইয়ের কাছে। ভারী শরীরটা টেনে নিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে এগোতে এগোতে আওড়ালো,

‘আমার হৃদয়ে ক্ষ’ত করে তুমি কি সুন্দর করে ঘুমাও চিত্র ভাই! এতোটা শান্তিতে তুমি কিভাবে ঘুমাও? আমার ভালোবাসা কেনো তোমার হৃদয়ে ক্ষ’ত করে না? ৪ বছর অপেক্ষার পরও তুমি ভালোবাসলে না আমাকে। আদৌও কি কখনো আমার ভালোবাসা অনুভব করতে পারবে নাাকি আমার অনুভূতি গুলো তোমার কাছে অবহেলিতই রয়ে যাবে? আমি জানি তুমি বুঝবে! তবে সেদিনটা যেনো খুব বেশি দেড়ি না হয় চিত্র ভাই!’

চলবে..

#চৈত্রিকা (১৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৩৭.
সকাল থেকে অর্থির বমি আর পেট ব্যাথা। বেশ কয়েকবার বমি করে সে ক্লান্ত হয়ে পেট ব্যাথা নিয়ে কাঁদছে। পল্লবী, নীরা, চৈত্রিকা, নাসিমা, অর্পিতা, শায়লা সবাই বসে আছে অর্থির ঘরে। মেয়েটা ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। চিন্তায় পল্লবীর অবস্থা খারাপ। বার বার মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,

‘একটু সহ্য কর মা! এই তো ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কখন ঠিক হবে আম্মাজান? আমার তো পেটে অনেক ব্যাথা করছে!’

পল্লবী কোনো কথা না বলে মেয়ের মাথায় হত বুলাতে থাকে। চৈত্রিকা অপরপাশ থেকে বললো, ‘আম্মা ওরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলেন! ওর মনে হয় বেশিই ব্যাথা করছে।’

পল্লবী এক পলক চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। যেনো সে চৈত্রিকার কথা শুনেও শুনলো না। তবে বাহিরে দাঁড়ানো প্রহর, চিত্র, চয়ন সবাই শুনলো। প্রহর কোনো রকম কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ওপাশ থেকে চিত্র কিছু বলতে চেয়েও বলছে না। তার এই মুহুর্তে এই ঘরে ঢোকা নিষেধ। নিজের ছোট বোন অসুস্থ তবুও তার এই ঘরে ঢুকে তার বোনকে দেখা যাবে না। অর্থির হঠাৎ অসুস্থতায় চিন্তায় ভেতরটা অস্থিরতায় ছেপে গেছে। বার বার হাতের তালুতে হাত ঘষছে আর পায়চারি করছে। পুরোটাই পর্যবেক্ষণ করে চয়ন। মনে মনে তিনি হাসেন। ভাইদের বোনের প্রতি ভালোবাসা দেখে তার কেনো জানি বুকটায় শান্তি শান্তি লাগে। ৩ ছেলের পর ১ মেয়ে তার। এই মেয়ের প্রতি যে তার কি পরিমাণ ভালোবাসা আছে তা বোধহয় মুখে প্রকাশ করার মতো না! হায় আফসোস! এই ভালোবাসাটা যদি অন্যের মেয়ের প্রতিও থাকতো তবে হয়তো দিনগুলো অন্যরকম হতো। ভেতর থেকে অর্থির আবারও কান্না ভেসে আসে। চৈত্রিকা অর্থির পাশে বসে তেল নিয়ে পেটে মালিশ করতে থাকে। অর্থি মাথা খাটের সাথে এলিয়ে দিয়ে বলে,

‘ভাবীজান! আমার পেটের মধ্যে এমন হলো কেনো? আমার কি মনে হয় জানেন! কাল খাওয়ার সময় অর্পি আপু আর মাষ্টারমশাই নজর দিয়ে দিছে।’

অর্পিতা খ্যাক করে ওঠে। ভ্রু কুঁচকে ধমক লাগিয়ে বলে, ‘আমরা নজর লাগাবো কেন? আর নজর লাগাইলে তোর বমি আর পেট ব্যাথা হতো না সোজা বেডরুম টু বাথরুম আর বাথরুম টু বেডরুম হইতো।’

অর্থি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। অর্পিতা চোখ বুজে জিভ কাটে। তারপর আদুরে ভাবে অর্থির পাশে বসে বলে, ‘কাঁদিস না বোন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর দেবো না ধমক। সরি!’

অর্থি নাক টানে। পল্লবী নীরাকে গরম পানি আনতে বলে। শায়লা বের হয়ে যায় ঘর থেকে। নাসিমা এক পলক তাকায় চৈত্রিকার দিকে। মেয়েটা একদম শান্ত ভঙ্গিতে নিজের কাজ করছে। কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে চুপচাপ নিজেও ঘর থেকে বের হয়ে যায়। থেকে যায় শুধু অর্পিতা, চৈত্রিকা আর পল্লবী। অর্থি তখনো কান্না করছে। এতো বড় একটা মেয়ের কান্না দেখে অর্পিতা আর চৈত্রিকা বার বার নিজেদের
দিকে তাকাচ্ছে। এর মধ্যেই প্রহর ডক্টর নিয়ে ঘরে আসে। ডক্টর মাথা নিচু করে এসে জমিদার গিন্নিকে সালাম দেয়। ডাক্তার দেখে অর্পিতা ঘর থেকে বের হতে নেয়। অদ্ভুত ভাবে সে সময়ই চিত্র হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে নিলে অর্পিতার সাথে জোড়ে একটা ধাক্কা খায়। দুজনই এক পলক শুধু নিজেদের দিকে তাকিয়ে চলে যায়। চৈত্রিকা আড়চোখে দুজনকে খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকায়। প্রহর চৈত্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

‘নিজের শাড়ি ঠিক আছে কি না ভালো করে দেখে মাথায় ঠিক মতো কাপড় টানো। নয়তো ঘর থেকে যাও!’

চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রহরের দিকে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সব ঠিক আছে। হুট করে প্রহরের এহেন কথার কোনো মানে খুঁজে পায় না। তবে ঠিকই চুপচাপ ঘর থেকে চলে যায়। রয়ে যায় শুধু পল্লবী, প্রহর আর চিত্র। পুরো ঘর ফাঁকা হতেই বোনের প্রতি তাদের অস্থিরতা প্রকাশ পায়। দু ভাই দুইদিক থেকে বোনকে আগলে নিয়ে বসে।

৩৮.
চৈত্রিকা ঘরে না গিয়ে সোজা চলে আসে ছাঁদে। রোদের তাপে ছাঁদে পা রাখা-ই যেনো দায়। তবুও সে ছাঁদে এসে এক কোণায় দাঁড়ায়। মনের মাঝের হাজারো চিন্তাকে নাড়িয়ে দেখতে থাকে। এর মধ্যেই পেছন থেকে নাসিমার স্বর আসে। চৈত্রিকা শান্ত ভঙ্গিতে পেছনে তাকিয়ে দেখে নাসিমা দাঁড়িয়ে আছে। নাসিমা নিজেই এসে চৈত্রিকার সামনাসামনি দাঁড়ায়। চৈত্রিকা হাত বগলদাবা করে দাঁড়াতেই নাসিমা কন্ঠ রূঢ় করে বলে,

‘তুই প্রহরকে বিয়ে করেছিস কেনো? দেখ চৈত্র! যা হওয়ার তা এক বছর আগে হয়ে গেছে। তুই ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছিস যখন তখন চুপচাপ শান্তিতে বাঁচ!’

চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে৷ এই মহিলাকে তার মা বলতেও ভীষণ ঘৃ*ণা হয়। কিন্তু ভাগ্যের জোড়ে মহিলাটা আসলেই তার মা। এটা ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়লেও ওপরে ওপরে নিজেকে শান্ত করে। ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলে,

‘যা হওয়ার তা ১ বছর আগে হলেও সেই ঘটনাগুলো আমার মনে দাগ কে’টে গেছে। তাই সেসব ভুলে যাওয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নাহ। যদি ভাবেন আমার সাথে সমঝোতা করবেন আর আমি তা ভদ্র মেয়ের মতো মেনে নিবো তবে আপনি ভুল।’

নাসিমা দমে না। কন্ঠের রুক্ষতা ধরে রেখেই বললো, ‘তুই কিন্তু আগুনে হাত দিচ্ছিস চৈত্র! এখনো সময় আছে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যা!’

‘কেনো যাবো? আমি না আপনাকে দেখে ভীষণ অবাক হই। পৃথিবীতে কি সত্যিই এমন নি’ষ্ঠুর মা হয়? যে মা ১০ মাস গর্ভে রেখে আবার নিজের প’র’কী’য়ার জন্যই সেই সন্তানকে মা’রতে চায়! আপনাকে দেখলেই আমার না আপনার মুখে থু’থু মা’রতে ইচ্ছে করে।’

চৈত্রিকার ঠান্ডা গলার অপমানে ক্ষেপে ওঠে নাসিমা। নিজের দোষ সামান্যও স্বীকার না করে উল্টো আরো রেগে যায়। কয়েকটা অকথ্য ভাষায় গা’লি দিয়ে চৈত্রিকার কাছে এগিয়ে আসে। চৈত্রিকা দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। নাসিমা বড় বড় শ্বাস নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘আমাদের না এবার তোর প’ত’ন হবে। দেখে নিস!’

গটগট করে নিচে নেমে যায় নাসিমা। চৈত্রিকা রাগে নিজের হাতই দেয়াল বা’রি মা’রে। রাগের মাথায় আ’ঘাত করলেও ব্যাথাটা বেশ ভালোই পায়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে৷ নিজ মনেই আওড়ায়,

‘আমার আর আমার বাবার জীবন ন’ষ্ট করে তুমি খুব সুখে আছো! তোমার ন”ষ্টা’মির জন্য আজ আমার বাবা দুনিয়ায় নেই৷ তোমরা যেভাবে পু’ড়িয়ে মা’রছো আমার বাবাকে, যতটা কষ্ট দিছো তার প্রত্যেকটা কষ্ট আমি তোমাদের দিবোই দিবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা।’

৩৯.
দুপুরে খাবার টেবিলেই কথা ওঠে অর্পিতার বিয়ে নিয়ে। খাবার টেবিলে তখন চয়ন, শিমুল, সাদিক, প্রহর, পিয়াস, চিত্র, স্মরণ খাবার খাচ্ছে। পল্লবী, নাসিমা আর নীরা খাবার পরিবেশন করছে। চৈত্রিকা, অর্থি, অর্পিতা, অর্পিতার খালা শিল্পা, শায়লা একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। শায়লা উঠে গিয়ে খাবার টেবিলেই শিমুলকে হালকা করে গুতো দিয়ে ঈশারা করে অর্পিতার বিয়ের কথা তুলতে। শিমুল গলা পরিষ্কার করে চয়নের উদ্দেশ্যে বলে,

‘বড় ভাইজান আপনাকে কিছু বলার ছিলো!’

চয়ন খাওয়া ছেড়ে তাকায় শিমুলের দিকে। বাকি সবাইও আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছে শিমুলের কথা শোনার জন্য। শুধু প্রহর আর চিত্রই নিজেদের মতো খেয়ে যাচ্ছে। শিমুল বেশ সাহস নিয়ে বলে,

‘ভাইজান আমার মেয়ে তো বড় হয়েছে। বয়স হয়েছে বিয়ের। আমরা ভাবছিলাম এবার ওর বিয়েটা দেবো। সুপাত্রও পেয়েছি। আপনি কি বলেন?’

চিত্রর খাওয়া থেমে যায়। প্রহর নির্বাক। সবকিছু এক কানে শুনছে অন্য কানে বের করে নিজের খাবার আপনমনে গিলছে। চিত্র সরাসরি তাকায় হল রুমে বসে থাকা অর্পিতার দিকে। মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে মেঝেতে খুঁ’টছে। চিত্রর ভাবনার মাঝেই চয়ন বলে ওঠে,

‘সব যখন ভেবেই রেখেছিস তখন আমাকে জিজ্ঞেস কেনো করছিস? পাত্র ভালো হলে বিয়েটা দিয়ে দে। সমস্যা নেই।’

‘ভাইজান পাত্র আমাদের স্মরণ।’

স্মরণ লজ্জা পায়। চয়ন খাওয়া বন্ধ করে বলে, ‘তা বেশ ভালো তো। বিয়ের কথা বার্তা কি এগিয়েছিস কিছু? ছেলে যখন ভালো তখন দেড়ি করে লাভ কি!’

সাদিকও তাল মেলায়। চিত্রর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো রকমে ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে অর্পিতার দিকে। অর্পিতা একবারও তাকায়নি৷ দেখেওনি একটা মানুষ কি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে! খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হয় না। খাবার শেষে হল রুমে বসে সবাই ঠিক করে নেয় এই মাসেই স্মরণ আর চিত্রর আকদ করিয়ে দেবে। তারপর বড় কোনো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণ নিজের বউ ঘরে তুলবে। যেহেতু এখন সবাই একসাথে আছে তাই কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়। সবকিছুই শোনে চিত্র। কিন্তু কোনোরকম টু শব্দও করে না। একপলক অর্পিতার দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা না খেয়ে খাবার শুধু নাড়াচাড়া করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো রকমে পা চালিয়ে ঘরে চলে যায় চিত্র। পুরো বিষয়টাই খেয়াল করে চৈত্রিকা। বুঝতে পারে গভীর কিছু আছে চিত্র আর অর্পিতার মাঝে।

খাওয়ার পর্ব শেষে শায়লা নিজেই অর্পিতাকে বিয়ের কথা জানিয়ে দেয়। অর্পিতা কোনো রকমে কথাগুলো হজম করে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। খানিক বাদেই দরজায় নক পড়ে। অর্পিতা প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেয়। কিছু বলতে গেলে দেখতে পায় চৈত্রিকা দাড়িয়ে আছে। চৈত্রিকাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে সরে যায় অর্পিতা। চৈত্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

‘আপনার সাথে গল্প করতে আসলাম আপু৷ গল্প করবেন তো নাকি তাড়িয়ে দেবেন!’

অর্পিতা ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘আরেহ ভাবীজান নাহ নাহ। তাড়িয়ে কেনো দেবো? আসেন না!’

চৈত্রিকা বিছানায় বসে। অর্পিতা দরজা লাগিয়ে এসে নিজেও বসে। হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘হঠাৎ আমার সাথে গল্প?’

‘ভেবেছিলাম আপনার সাথে ধীরে ধীরে গল্প সল্প করবো কিন্তু আপনার আব্বাজান তো দেখি আপনার বিয়ে ঠিক করে আপনাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তাই ভাবলাম একটু গল্প করে আসি। ক’দিন পর বিয়ে হয়ে গেলে যদি সুযোগ না পাই!’

অর্পিতা ভীষণ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না আবার সয়তেও পারে না। চৈত্রিকা স্মরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তবে অর্পিতা আশানুরূপ কোনো জবাব দেয় না। কথার ধরণেই বোঝা যায় অর্পিতা স্মরণকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক না। তাই সে কথায় কথায় হুট করে বলে বসে,

‘চিত্র ভাইকে আপনার কেমন লাগে আপু?’

অর্পিতা চমকায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় চৈত্রিকার মুখের দিকে। চৈত্রিকা অর্পিতার চোখের দিকে তাকিয়েই যা বোঝার তা বুঝে নেয়। আলগোছে অর্পিতার হাত ধরে বেশ শান্ত কন্ঠে বলে,

‘আমি একজন মেয়ে অর্পিতা আপু। একজন মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়ের চোখের ভাষা বোঝাটা আমার জন্য কঠিন কিছু নয়। সেদিন আপনার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে কিছু আন্দাজ করলেও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।’

অর্পিতা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। চৈত্রিকা অর্পিতার এমন অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করে তার গালে হাত রাখতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চৈত্রিকা চমকে ওঠে৷ সাথে সাথেই অর্পিতা ডুকরে ওঠে। চৈত্রিকা অর্পিতাকে ছাড়াতে গেলে অর্পিতা না ছেড়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। চৈত্রিকা হাল ছেড়ে অর্পিতার মাথায় হাত বুলায়। মেয়েটার হাহাকার করা কান্নায় তার বুক কেঁপে ওঠে। অর্পিতা কাঁদতে কাঁদতেই ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘আমি চিত্র ভাইকে ভীষণ ভালোবাসি ভাবীজান। কিন্তু সে যে আমাকে বাসে না! আমার যে অন্য কারো হতে মন সায় দেয় নাহ। কেনো চিত্র ভাই আমাকে ভালোবাসে না ভাবীজান?’

চৈত্রিকা চুপ করে থাকে। অর্পিতা নিজের ভেতরের কষ্ট গুলো একটু একটু করে উগলে দিতে শুরু করে। চৈত্রিকা সবটা শুনে বলে, ‘চিত্র ভাই যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসে তবে আপনি বিয়েটা করে নিন আপু। যে আপনাকে ভালোবাসে না সে কি আপনার মূল্য কখনো বুঝবে?’

অর্পিতা জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। তার ঘরের বাহিরে দাঁড়ানো চিত্র কাঁপতে থাকে। অর্পিতার কান্নার শব্দ সে স্পষ্ট শুনেছে। ভেতরটা কেমন চিনচিনে ব্যাথায় ছেয়ে গেছে। দেয়ালের এপাশে আর ওপাশে দাঁড়ানো দুটি মানুষ একই ব্যাথায় নিজেদের আষ্টেপৃষ্টে রেখেছে অথচ তাদের মাঝের দূরত্ব যেনো বিশালতর থেকেও বিশাল।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)