ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-১১

0
125

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#একাদশ_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

বসার ঘরে থমথমে পরিবেশ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই।সাজিদ বলল,”দেখো তোমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা অনেক বছর আগে। আমার মনে হয় সে রাগ অভিমান ধরে রাখা উচিত নয়। এবার তা শেষ করো।আমি চলে যাওয়ার আগে একটা হাসিখুশি পরিবার দেখে যেতে চাই।”

শায়লা বলে,”তুই চলে যাওয়ার আগে মানে তুই কি একেবারের জন্য চলে যাচ্ছিস নাকি।শোন সাজিদ তুই যাচ্ছিস ভালো কথা কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। নইলে কিন্তু যেতে দেবো না।”

আনোয়ার আর মিনহাজ চুপচাপ বসে আছে।”তোমরা কি এমন চুপ করে থাকবে? বাবা আমার ছোট বেলায় সামান্য একটা দুর্ঘটনার জন্য তোমরা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছো। আমি এখন বড় হয়ে গেছি কিন্তু তোমাদের মধ্যকার মনোমালিন্য এখনও দূর হয়নি।আমি মিনহাজ আঙ্কেলকে রাজি করিয়েছি।বাবা প্লীজ তুমি আর রাগ করে থেকো না।”

আনোয়ার সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মিনহাজ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।মনের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে।যদি আনোয়ার সাহেব অপমান করেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,”সাজিদ আমরা বরং আজ আসি।আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের পরিবারে কোনো ঝামেলা হোক। তোমরা ভালো থেকো।আসছি শায়লা আপা।”

“ভাইজান এভাবে চলে যাবেন না। আপনারা যদি আমার বাড়ি থেকে খালি মুখে চলে যান তবে আমার খুব খারাপ লাগবে।”

“আপা অন্য একদিন আসবো।মা চলো।”

মিনহাজ সাহেব কথাগুলো বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো।”দাঁড়াও মিনহাজ!”আনোয়ার সাহেবের গম্ভীর গলা শুনে পা চালানো বন্ধ করে দিলো। আনোয়ার সাহেব এক পা দু পা করে মিনহাজ সাহেবের দিকে এগিয়ে এলো।”নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকদের আমি পছন্দ করি না।চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভালোবাসি। আনোয়ার সাহেবের কথায় মিনহাজ সাহেব মাথা উঁচু করলো।”আমাদের মধ্যে যা হয়েছে আমি সেসব কিছু মনে রাখি নি।সেদিন ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে আমি অন্ধ হয়ে ছিলাম। মানুষকে মানুষ মনে করতাম না।আমি তোমাদের খুব অসম্মান করেছি। একজনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও মিনহাজ।”

“এমন করে বলবেন না ভাইজান। আপনার কোনো দোষ ছিল না। আপনার জায়গায় আমি হলে আমিও একই আচরণ করতাম।”

আনোয়ার সাহেব মিনহাজ সাহেবকে বুকে টেনে নিলেন।শায়লা চোখ দুটো ছলছল করছে।আজ যদি চুমকি বেঁচে থাকতো কতই না খুশি হতো!

আনোয়ার মিনহাজের হাত ধরে বলল পাশে বসালো।সাজিদের খুব ভালো লাগছে।একটু একটু করে সব ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে।

চিত্রার আজ শেষ গানের প্রোগ্ৰাম ছিল।কাল থেকে কিছুদিনের জন্য অবসর নেবে।প্রোগ্ৰাম শেষ করে বাসায় এসে দেখে তার বাবা আর দাদিমা বসে আছে। ওদের দেখে চিত্রার মনটা খুশিতে ভরে উঠল।কত্ত দিন পর বাবা আর দাদিমাকে দেখছে! আনোয়ারের কথা ভেবে চিত্রার খুব ভয় লাগলো।ভয়ে হাত-পা কাঁপছে।”কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?আয় এদিকে!”

শায়লার কথায় হকচকিয়ে উঠলো চিত্রা।চিত্রার দাদিমা ছুটে এসে চিত্রা জড়িয়ে কান্না করে দিলো।দাদিমার চোখের পানি মুছে বলল,”দাদিমা আমি অনেক বড় একটা ভুল করেছি। তুমি আমায় মাফ করে দিও।”

“এমন করে বলিস না বুবু।তুই কোনো ভুল করিস নি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। অতীতের কোনো কিছু নিয়ে কখনো আফসোস করবি না। শুধু ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।যা বাবার কাছে যা।”

চিত্রা মিনহাজ সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।”বাবা! ও বাবা!আমায় কি তুমি মাফ করবে না বাবা? আমি তো তোমার খুব খারাপ মেয়ে। তোমায় সবসময় কষ্ট দিয়েছি। তোমার অবাধ্য হয়েছি। আমার সেই অবাধ্যতার,জেদ ধরার শাস্তি পেয়ে গেছি বাবা।কথা বলো না বাবা!”

“মা ওকে বলো আমার সামনে থেকে চলে যেতে। এতো দিন পরে ও কোন মুখে সামনে এসেছে?ওর জীবনের সবথেকে খারাপ সময়ে কি বাবার বুকে ঠাঁই নেওয়া যেতো না। আমি কি তার এতোটা খারাপ বাবা?আমায় কি একটু ভরসা করা যেতো না!”

“আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা।প্লীজ তুমি আর রাগ করে থেকো না।আমায় মারো ,শাসন করো যা খুশি শাস্তি দাও কিন্তু কথা বলা বন্ধ করো না।”

চিত্রার খুব কান্না পাচ্ছে। মিনহাজের চোখ দুটো ভিজে গেছে।মেয়েকে জড়িয়ে নিলো পরম যত্নে।এতোগুলো দিন পর বাবার স্পর্শ পেলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো।জমানো কষ্ট আর যন্ত্রণাগুলো যেন নিংড়ে বের হয়ে আসছে।প্রতিটার সন্তানের কাছে বাবা বটবৃক্ষের ন্যায়।সকল ঝড় ঝঞ্ঝা দুঃখ কষ্ট থেকে সন্তানদের প্রতিনিয়ত রক্ষা করে যায়।”আর কাঁদিস না মা।এ সময় কান্না করা ঠিক নয়।”আনোয়ার সাহেব চিত্রার মাথা হাত বুলিয়ে বলল,”তোর কোনো চিন্তা নেই মা তোর দুই বাবা তোর সাথে আছে।তোকে কখনো কষ্ট পেতে দেবো। সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে।”

“আঙ্কেল।”

“চিত্রা মা তুই যেদিন এই বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলি সেদিনই আমি তোকে চিনতে পেরেছি।তোর চেহারার সাথে তোর মায়ের চেহারার খুব মিল‌।তোকে দেখার পর আমার সব রাগ অভিমান গলে পানি হয়ে গেছে।”

“যাক অবশেষে সব ভালো হলো।এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি বছরের পর বছর।সাজিদ বাবা তোকে অনেক ধন্যবাদ।তুই আমার বুক থেকে একটা বড় পাথর সরিয়ে দিয়েছিস।”

মিনহাজ বলল,”সাজিদ আমি চিত্রাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই।”

“ভাইজান আগে খাওয়া দাওয়া করুন।তারপর সেসব নিয়ে ভাবা যাবে।চলো সবাই খেয়ে নেবে।”শায়লা সবাইকে খেতে দিলো।সাজিদ খেতে খেতে বলল,”আঙ্কেল আপনার কাছে আমার একটা আবদার আছে!না করতে পারবেন না।”

“কি আবদার বলো?”

“আমি কাল লন্ডন চলে যাচ্ছি।আমি চাই আপনারা আজ রাতটুকু আমাদের বাসায় থাকুন।আমি সবাইকে একসাথে দেখে যেতে চাই।”

আনোয়ার বলল,”হ্যাঁ সাজিদ ঠিকই বলেছে। তুমি আজ থেকে যাও।”

“ভাইজান আপনি না করবেন না।রাতে জেরিন আসবে জামাইকে নিয়ে।মেয়ে জামাইকে দেখে দোয়া করবেন।”

“আপা আমার অনেক কাজ ওদিকে।”

“থেকে যাও না বাবা।”

মেয়ের আবদার ফেলতে পারলো না।”ঠিক আছে।আজ থাকবো।”

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেস্ট নিলো।রাতে জেরিন আসলো মিহানকে নিয়ে। আনোয়ার আর শায়লা মিনহাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।”

পরেরে দিন সকাল বেলায় সাজিদ রেডি হয়ে চিত্রার রুমে এলো।”চিত্রা আসবো?”

“হ্যাঁ সাজিদ ভাইয়া আসুন।”

সাজিদ বলল,”চিত্রা আমি জানি না আমি কখনো ফিরতে পারবো কিনা।আমি যদি কখনো তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও।”

সাজিদ ভাইয়া এভাবে বলবেন না। আপনার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। আপনি না থাকলে আমি আর আমার ভেতরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট প্রাণটা কবেই শেষ হয়ে যেতাম। আপনার কাছে আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো।”

“এটা আমার দায়িত্ব। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি একইভাবে সাহায্য করতাম। তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।”

“অনুরোধ বলবেন না।আপনি আদেশ করুন। আপনার জন্য কিছু করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার।”

“আমার অবর্তমানে মা বাবার একটু খেয়াল রেখো। মিনহাজ আঙ্কেল হয়তো তোমায় নিয়ে চলে যাবে। তুমি মাঝে মধ্যে এসে ঘুরে যেও। যোগাযোগ রেখো।”

“আপনি না বললেও আমি আসবো।শায়লা খালামনির মতো মানুষ হয় না। আমার মায়ের অভাব খালামনির ভুলিয়ে দিয়েছে। মায়ের পরিপূরক হয় না। কিন্তু খালামনির আমার দ্বিতীয় মা।আর আনোয়ার আঙ্কেলের কথা কি বলবো!উনি তো আমায় মেয়ের মতো স্নেহ করেন।তাই এটা আমার কর্তব্য ওনাদের খেয়াল রাখা।আমরা তো একটাই পরিবার।”

“অনেক নিশ্চিন্ত হলাম।”

সবাই মিলে হাসিখুশিভাবে সাজিদকে বিদায় দিলো।শায়লার মনটা খারাপ।ছেলেকে কাছ ছাড়া করতে তার মন সায় দিচ্ছে না।সবাই মিলে শায়লাকে বোঝাতে লাগলো।

——————————————————————————

প্রায় দুইবছর হতে চলল সাজিদের……….

****চলবে****