ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-১২

0
196

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#দ্বাদশ_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

প্রায় দুই বছর হতে চলল সাজিদের কোনো খোঁজ নেই। লন্ডন যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে কিন্তু সেখানে যায় নি।সাজিদ কোথায় গেল তা সবার অজানা। আনোয়ার সাহেব তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছে।শায়লার অবস্থা আরো খারাপ।রুম থেকে বের হয় না। সারাক্ষণ সাজিদের জামা কাপড় বুকে জড়িয়ে কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একদিকে ছেলে অন্যদিকে স্ত্রী অসুস্থতায় আনোয়ার সাহেব একটু একটু করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে লাগল।চিত্রা জেরিন আর মিহান সবসময় সাহস যুগিয়েছে। হঠাৎ একদিন আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলছে। অধৈর্য্য হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো।ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরুষ সহজে কাঁদে না। পরিস্থিতি তাকে পাথরের ন্যায় কঠিন আবরণে মুড়িয়ে নেয়।কলিং বেলের শব্দে চোখের পানি মুছে নিলো।”শেফালী শেফালী!”

“জি বড় সাহেব বলুন।”

“কে এসেছে দেখো তো! দরজা টা খুলে দাও।”

শেফালী গিয়ে দরজা খুলে চিৎকার শুরু করল।”বড় সাহেব বড় সাহেব দেখে যান তাড়াতাড়ি।”

আনোয়ার ছুটে আসলো।”কি হলো শেফালী এমন চিৎকার করলে…..সা সাজিদ বাবা!”

আনোয়ার দৌড়ে সাজিদকে জড়িয়ে ধরলো।অশ্রু যেন বাঁধ মানছে না। হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে।

“বাবা।”

“কোথায় ছিলি এতদিন? একবারের জন্য কি আমাদের কথা মনে পড়ে নি?এত পাষাণ কি করে হতে পারলি?তোর খোঁজ না পেয়ে আমাদের কি অবস্থা হয়েছে বোঝাতে পারবো না।তোর মা দিনরাত তোর স্মৃতি আঁকড়ে মরার মতো বিছানায় পড়ে আছে।”

“শান্ত হও বাবা।আমি সব বলবো।মা কোথায়?”

“তোর মা অসুস্থ।”

সাজিদ শায়লার রুমে গেল। মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”মা ও মা? তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে?”

ছেলের স্পর্শ পেয়ে শায়লা উঠে বসতে চাইল। কিন্তু পারলো না। শায়লার এমন অবস্থা দেখে সাজিদের চোখে পানি টলমল করতে লাগলো। ধীরে ধীরে শায়লাকে বসিয়ে আদুরে গলায় বলল,”মা দেখো তোমার ছেলে ফিরে এসেছে।”

শায়লা একটু একটু করে শক্তি পাচ্ছিলো।সাজিদকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করলো।”প্লীজ মা কান্না করো না।আমি চলে এসেছি তোমার কাছে।আর কখনো তোমায় ছেড়ে যাবো না।”

সাজিদ শায়লাকে শান্ত করলো।ছেলে ফিরে আসায় শায়লা অনেকটা সুস্থবোধ করলো।শায়লার সেবা যত্ন করার জন্য আনোয়ার সাহেব একজন নার্স রেখেছেন।নার্স বলল,”ওনার এখন ওষুধ খাওয়ার সময় তারপর বিশ্রাম নিতে হবে।”

“আমার ছেলে চলে এসেছে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।ওসব কড়া কড়া ওষুধ আর খাবো না।”

“না ম্যাডাম। ওষুধ খেতে হবে। নইলে আপনি আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন।”

নার্সের কথা শুনে সাজিদ শায়লাকে বুঝিয়ে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তারপর নিচে নেমে আনোয়ার সাহেবের কাছে গিয়ে বলল,”বাবা তোমাদের অনেক কিছু বলার আছে।আমি সব জানাতে চাই।”

“আমরা শুনবো বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি! চিত্রা আর জেরিনকে খবর দেওয়া হয়েছে।ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছাবে।”

চিত্রা আর জেরিন বসে আছে শায়লার রুমে। আনোয়ার সাহেব পায়াচারি করছে।সবার মনে একটাই প্রশ্ন সাজিদ এতো দিন কারোর সাথে যোগাযোগ করে নি কেন!বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর জেরিন‌ বলল,”ভাইয়া তো এখনও এলো না”

আনোয়ার সাহেব পায়াচারি বন্ধ করে দিলেন।”যাওয়ার সময় বলে গেল একটা সারপ্রাইজ আছে। তাড়াতাড়ি আসবে।”

“তুমি একটু ধীরস্থির হয়ে বসো। এমন অস্থির অস্থির করছো কেন‌!”

“শায়লা আমার কেন জানি না খুব টেনশন হচ্ছে।”

“বাবা আমি ফিরে আসার পরও তোমার এতো চিন্তা কিসের?”

সাজিদের কন্ঠস্বর শুনে আনোয়ার সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।”তোমায় হারানোর ভয় মনের ভেতর এতোটা প্রখরভাবে ঢুকে গেছে।অল্পতেই টেনশন শুরু হয়।”

সাজিদ সবার দিকে একনজর তাকালো। সবার চোখেমুখে প্রশ্নের ঝুড়ি।সাজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দুই পা পিছিয়ে বলল,”কই ভেতরে এসো।”

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালো।বাইরে থেকে একটা মেয়ে রুমে প্রবেশ করলো।মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর।পুরো মুখে মায়ার ছড়িয়ে আছে।সাজিদ আলতোভাবে মেয়েটার হাত ধরে বলল,”ও হচ্ছে ডাঃ সিদরাতুল মুনতাহা সিরাত।”

সাজিদ সিরাতকে নিয়ে সোফায় বসলো।” অপেক্ষা করার সবাইকে ধন্যবাদ।আমি জানি আমার কি হয়েছে কোথায় ছিলাম এসব নিয়ে তোমাদের মনে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি সব বলছি।”

সাজিদ সিরাতের দিকে তাকালো।সিরাত চোখের ইশারায় ভরসা দিলো।”আজ থেকে তিন বছর আগে ভার্সিটিতে পড়ার সময় একটা মেয়েকে আমার খুব ভালো লাগে। পছন্দ করতাম।সেই মেয়েকে ভালোবাসার কথা জানানোর পর সে আমায় প্রত্যাখান করে।সে প্রত্যাখান আমার জীবনটা এলোমেলো করে দেয়। সেদিন আর বাড়ি ফিরি নি। কয়েকদিন আমার বন্ধু্র বাসায় ছিলাম।যেদিন বাড়ি ফিরবো সেদিন সকালে ঘুম ভাঙছিলো না। আমার বন্ধু আমায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওখানকার ডাক্তার কতগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়।সে পরীক্ষায় ধরা পড়ে আমার দুটো কিডনির মধ্যে একটা পুরোপুরি আরেকটার অর্ধেকের বেশি ড্যামেইজ হয়ে গেছে।ডাক্তার বললেন যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে। ওষুধ দিলেন।আমি ওষুধ খেতে লাগলাম। নিজের উপর বিশ্বাস ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো।মনে হতে লাগলো আমার বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। কাউকে কিছু জানাতে পারি নি। আমার এই অবস্থার কথা জানলে পুরো পরিবার ভেঙ্গে পড়বে।রিপোর্ট মেডিসিন সব আমার স্টাডি রুমে লুকিয়ে রাখলাম। সবাইকে স্টাডি রুমে ঢুকতে বারণ করে দিলাম।হঠাৎ একদিন চিত্রা সে রুমে ঢুকে রিপোর্টগুলো দেখে ফেলে।আমি সেদিন চিত্রাকে ভুলভাল বুঝিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিলাম।তারপর লন্ডনে যাওয়ার নাম করে আমেরিকায় পাড়ি জমালাম।যে ডাক্তার আমার চিকিৎসা করছেনে ওনার পরিচিত ডাক্তারের কাছে পাঠালেন।। কিডনি অপারেশন করতে গিয়ে একটার পর একটা সমস্যা শুরু হলো। এদিকে ডাক্তারের দেওয়া সময়ও শেষ হয়ে আসলো। এতো কিছু করেও বোধহয় বাঁচাতে পারবো না নিজেকে। মনের মধ্যে ভয় বাসা বাঁধলো।সে সময় আমার সিরাতের সাথে পরিচয় হয়।সে ওই হাসপাতালে নতুন জয়েন করে।আমায় সবসময় ভরসা দিতে। লাগলো। অবশেষে সকল বাঁধা কাটিয়ে সাকসেসফুলি কিডনি অপারেশনটা হলো। নতুন করে দুটো কিডনি প্রতিস্থাপন করলো।ডাক্তার বলেছেন ছয় মাস বেড রেস্ট। সিরাতের উৎসাহে নিজের উপর আত্নবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করলো। এবার বোধহয় বাড়ি ফিরতে পারবো। মায়ের আদর খেতে পারবো। কিন্তু আমার সে অপারেশনের চার মাস পর হঠাৎ একদিন আমার ডান পাশটা অবস হয়ে এলো।চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।ডাক্তার এসে চেক আপ করলেন। কিছু পরীক্ষা দিলেন। দুইদিন পর রিপোর্ট আসলো।ডাক্তার বললেন ব্রেন টিউমার হয়েছে।এটা প্রথম স্টেজ। ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হবে। যেহেতু আগে একটা বড় অপারেশন হয়েছে তাই শরীরটা খুব দুর্বল।ডাক্তার বললেন দুই মাস পর অপারেশন। ধীরে ধীরে অপারেশনের দিনটা এগিয়ে এলো।আবার দমবন্ধ করা অবস্থা।জানো সেদিন তোমাদের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। ওখানকার ডাক্তার নার্স খুব সাহায্য করেছেন। মনে সাহস দিয়েছে। অপারেশন হওয়ার পর সিরাতের সেবা যত্নে আর ভালোবাসায় একটু একটু করে সুস্থ হলাম। তারপর তোমাদের কাছে ফিরে এলাম।”

সাজিদের কথায় সবার চোখে পানি আসলো।এত কষ্ট যন্ত্রণা সব একাই ভোগ করেছে।কাউকে কিছু জানতে দিলো না। আনোয়ার সাহেব বললেন,”ভালো তো।আমরা তো তোমার পর তাই আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে হয় নি।শায়লা তোমার ছেলে মেয়েদের কাছে আমাদের কোনো মূল্য নেই গো।”

সাজিদ আনোয়ার সাহেবের সামনে এসে বলল,”বাবা আমায় ক্ষমা করে দাও। হাসপাতালের প্রতিটা বস্তু জানে আমি তোমাদের ঠিক কতটা মিস করেছি‌।ইচ্ছে হতো দৌড়ে গিয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরি। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাই। তোমাদের দেখার আসায় প্রতিটা দিন কাটতো।সিরাত যদি আমার পাশে না থাকতো তবে আমার কি হতো নিজেই জানি না।”

আনোয়ার সাহেবের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো‌। সাজিদকে বুকে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।”এই বুড়ো বাপটাকে একটা খবর দিতে পারতিস।ছুটে যেতাম তোর কাছে।”

শায়লা বিছানা থেকে নেমে বলল,”আমার সোনা বাবা আর কখনো কিছু লুকাবি না।যা হবে আমরা সবাই মিলে মুখোমুখি হবো।

সাজিদ বাবা মায়ের চোখের পানি মুছে দিলো।জেরিন বলল,”ভাইয়া আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোকে ফিরে পেয়েছি।আর আমাদের কিছু চাই না।”

“মা তোমাদের আরেকটা কথা……….

****চলবে****