জল-ফড়িঙের খোঁজে পর্ব-৭+৮

0
523

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৭
.
সৌহার্দ্য তখন থেকে বিহানের রুমে নক করে যাচ্ছে কিন্তু বিহান খুলছে না। বিহান রেগে গেলে যে কতটা ভয়ঙ্কর কিছু করতে পারে সেটা বোঝা কঠিন। আসার পথে জ্যামে আটকে গেছিল। আর আজকের জ্যামটা আরো বেশিই সময়ের জন্যে ছিল। সৌহার্দ্যর এখন ভীষণ টেনশন হচ্ছে, রাগের বশে যদি ছেলেটা উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে? এসব চিন্তা করে আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। বেশ অনেকটা সময় পর বিহান দরজা খুলল। বিহানকে দেখে সৌহার্দ্য চমকে উঠল। বিহান চোখ কচলে একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

” কী শুরু করলি বলত? কাল সারারাত লকাপে ছিলাম তাই ঘুমোতে পারিনি। একটু ঘুমোচ্ছিলাম ভাই। তুইও পাশের রুমে ঘুমিয়ে পরতি। সবে একটু ঘুমিয়েছি।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ বিহানের চোখমুখ একদম স্বাভাবিক। ওকে দেখে মনেই হচ্ছেনা কিছু হয়েছে। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে কিছু বলবে তার আগেই বিহান বলল,

” এভাবে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছিস কোন দুঃখে? উঠিয়ে যখন ফেলেছিস আমি খাবার ওর্ডার করে দিচ্ছি। খেয়ে তারপর আবার ঘুমাব। আয় রুমে আয়।”

বলে ভেতরে চলে গেল বিহান। আর সৌহার্দ্যও বেশ অবাক হয়েই ভেতরে ঢুকল। বিহান আয়েশ করে বিছানায় বসে খাবার ওর্ডার করে চুপচাপ বসে গেমস খেলতে শুরু করল। সৌহার্দ্য সুক্ষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। এতোবড় একটা ঘটনার পরেও বিহানের শান্ত থাকাটা ভালো লাগছেনা সৌহার্দ্যর কাছে। এটা কেমন যেন ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা মনে হচ্ছে। ও বিহানের হাত থেকে ফোনটা একটানে নিয়ে গেল। বিহান ভ্রু কুচকে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য ফোন রেখে দিয়ে বলল,

” কী চলছে তোর মাথায়?”

বিহান ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হেসে টি-টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,

” সে তো সারাদিন আমার মাথায় কতকিছুই চলে। কেন বলত?”

” দেখ রিখিয়ার কিন্তু এসবে কোন দোষ নেই। ওর জায়গা থেকে ও একদম ঠিক ছিল। ওকে প্লিজ ‘মায়া…”

বিহান পানি খেতে খেতে এতক্ষণ সৌহার্দ্যর কথা শুনছিল। সৌহার্দ্য এটুকু বলতেই বিহান থামিয়ে দিয়ে বলল,

” এসব ছাড়। খাবার আসছে খেয়ে বাড়ি চলে যা। মামু জানলে রেগে যাবে।”

তখনই সৌহার্দ্যর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের নাম্বারটা দেখে সৌহার্দ্য ফোনটা কেটে দিতে নিলেই বিহান বলল,

” রিসিভ কর। আর ফোন লাউডে দিস। অনেকদিন নিজের প্রশংসা শোনা হয়না।”

বলে আবারও লম্বা হাই তুলল। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করলেও লাউডে দিলো না। কিন্তু বিহান নিজেই লাউডে দিয়ে দিল। ওপাশ থেকে সৌহার্দ্যর বাবা শফিক রায়হান বললেন,

” কোথায় আছো তুমি? নিশ্চয়ই ঐ লোফার টার ফ্লাটে? এক্ষুনি বেড়িয়ে এসো। মান-সম্মান যেটুকু ছিল সব শেষ করে দিয়েছে।”

সৌহার্দ্য একপলক বিহানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,

” শুধু কাল রাতের নিউসটাই দেখেছ নাকি সকালের টাও দেখেছ?”

শফিক রায়হান হুংকার দিয়ে বলল,

” সবই দেখেছি। সকালের নিউসটা সত্যি নাকি তুমি তোমার ক্ষমতা দিয়ে সত্যি বানিয়েছ সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।”

বিহান নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য বেশ অবাক হল নিজের বাবার কথায়। এতটা অবিশ্বাস? একটা ঘটনা, শুধু একটা ঘটনা, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে সবচেয়ে ঘৃণ্য করে তুলতে পারে? তখন ওপাশ থেকে আরেকটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো,

” বাবান আমি তোমার ফুপা বলছি ওখান থেকে চলে এসো। ওই ছেলের সাথে থাকলে তুমিও নষ্ট হয়ে যাবে।”

বিহান হেসে সৌহার্দ্যকে চোখ মারল। সৌহার্দ্য ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” তোমার ছেলে হয় ও ফুপা।”

বিহানের বাবা আমিনুর খান বললেন,

” দরকার নেই এমন ছেলের যেই ছেলের জন্যে পদে পদে অপমানিত হতে হয় এমন ছেলে না থাকাই ভালো। তাইতো অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। ”

এবার বিহানের মা আসমাও বললেন,

” বাবান আমি বলছি চলে এসো ওখান থেকে। তোমাকে কতবার বলি ওই ছেলের কাছে যেওনা। কেন শোননা? ও নিজে তো জাহান্নামে গেছেই তোমাকেও আমাদের অবাধ্য করে দিচ্ছে।”

নিজের মায়ের গলা শুনে বিহানের যেন আরও হাসি পেল। ভীষণ কষ্টে হাসি চেপে রাখছে ও। সৌহার্দ্য জানে বিহান এভাবে কখন হাসে তাই বলল,

” সরি, বাট কাল দুপুরের আগে আমি আসতে পারব না। রাখছি।”

বলে ফোনটা রেখে দিল সৌহার্দ্য। ফোনটা রাখতেই বিহান শব্দ করে হেসে দিল। এভন ভাবে জেনো ওর সামনে মিরাক্কেল এর লেটেস্ট জোকস্ বলা হয়েছে। এরমধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠল। বিহান হেসে বলল,

” খাবার এসে গেছে, চলো ব্রো, জমিয়ে খাওয়া হবে।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। কালকের এমন ঘটনার পর এরকম রেগে যাওয়ার পরেও হঠাৎই ছেলেটার এতটা শান্ত, স্বাভাবিক হয়ে যাওয়াটা ভাবাচ্ছে সৌহার্দ্যকে। রাগ যে খুব ভয়ংকর জিনিস, এই রাগের বসে নিয়ে নেওয়া কোন সিদ্ধান্তের পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। এখন বিহানের মাথায় কী চলছে সেটাতো বিহানই জানে। এদিকে তুর্বী মেয়েটা সেই কবে থেকে ওকে নিরন্তর মেসেজ করে, ওর আর.জে পরিচয়ের পেজ টাতেই বড় বড় করে ওকে নিন্দা করে, গালিগালাজ করে পোষ্ট করতেই থাকে, কমেন্ট সেক্শনও ভরিয়ে ফেলে কমেন্ট করে করে। এসব নিয়ে ইদানিং একটু বেশি পরিমাণ বিরক্ত ও। কিন্তু সরাসরি কিছু বলতেও পারছেনা। কারণ ওরা কেউ জানেনা ওই আর.জে SR.

_______________

তুর্বী রান্নাঘরে একপ্রকার যুদ্ধ করছে। উদ্দেশ্য কফি বানাবে। কিন্তু কফি বানাতে গিয়ে রান্নাঘর লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। প্রথমেই কফি খুজতে গিয়ে সব এলোমেলো করেছে। এরপর চিনি খুজতে গিয়ে রান্নাঘরে একপ্রকার তান্ডব চালিয়েছে। দুধটা যদিও সহজেই পেয়ে গেছে। তুর্বী রান্নাটা কোনকালেই তেমন পারেনা। সৎ মায়ের কাছে বড় হলেও ওর ওপর অত্যাচার করার কোন সুযোগ দেয় নি। ওকে রান্না করতে বললে কখনই করত না কারণ ওর কলেজ, প্রাইভেট ছিল। কথা না শোনায় ওর সৎ মা মারতে এসছিল কয়েকবার কিন্তু প্রথম প্রথম সহ্য করলেও পরে আর চুপ থাকত না তুর্বী। তাই তুর্বীর সাথে টিকতে না পেরে ওর মা এমনিই চুপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন ও কফি বানাচ্ছে রিখিয়ার জন্য কারণ রিখিয়া বাড়ি ফেরার পর থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে। আপাতত বেলকনির ফ্লোরে বসে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখছে। মনটা একটু বেশিই খারাপ ওর। কিছু খায়ও নি। তাই তুর্বী ওর জন্যে কফি আর বিস্কুট নিয়ে যাচ্ছে। অন্যকোন রান্না তুর্বী পারেনা। কোনরকমে কফি বানিয়ে দুটো মগে ঢেলে দিয়ে, একটা হাফ-প্লেটে বিস্কুট নিয়ে ট্রে তে নিয়ে রুমে চলে এল। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে রিখিয়া এখনও মন খারাপ করে বসে আছে। তুর্বী ওর পাশে গিয়ে বসে বলল এরপর কফির মগ নিয়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল,

” বাবাহ। রান্না মানুষ কেমনে করে? আমার তো এই কফি বানাতেই ঘাম বেড়িয়ে গেছে।”

রিখিয়া অবাক হয়ে তাকাল। ট্রে তে রাখা কফি দেখে বলল,

” তুমি কফি বানিয়েছ?”

” হ্যাঁ? তোর কী মনে হয়? আমি পারিনা? আমি চাইলে সব পারি। খেয়ে নে। দেখ, না ভুল করেও করবি না অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি আমি।”

রিখিয়া কিছু না বলে কফির মগ আর হাত একটা বিস্কুট নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করল। তুর্বী এবার রিখিয়ার একটু কাছ ঘেসে বসে বলল,

” মন খারাপ কেন করছিস বলত? এতে তো তোর দোষ নেই? একটা মিসআন্ডারস্টান্ডিং হয়েছিল। ব্যাস! এতে কারো কোন দোষ নেই। এমন কেন করছিস তুই?”

রিখিয়া অস্হির হয়ে বলল,

” তুমি বুঝতে পারছো না। ছেলেটাকে আমি সবার সামনে চড় মেরেছি। মিডিয়া, ক্যামেরার সামনে ক্যারেক্টারলেস, অমানুষ আরো কত কী বলেছি। এমনকি পুলিশে দিয়ে দিয়েছি। কত খারাপ খারাপ কথা লিখেছিল ওনাকে নিয়ে চ্যানেলে। সারারাত কোন দোষ ছাড়াই লকাপে কাটিয়েছে। ব্যাক্তিগত জীবনে উনি যেমনই হোক। এসেছিলেন তো আমাকে সাহায্য করতেই তাই না? আর আমি কিছু না বুঝেই কী করে ফেললাম? সরিটাও বলতে পারলাম না।”

তুর্বী মগটা পাশে রেখে রিখিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,

” দেখ। ছেলেটা হার্ট হয়েছে সেটা আমিও বুঝতে পারছি। যেটা হয়েছে সেটা পুরোটাই এক্সিডেন্ট ছিল। তাই এত চাপ না নিয়ে পরেরবার দেখা হলে ভদ্রভাবে সরি বলে দিবি। সিম্পল।”

” কিন্তু..”

” ছাড়তো এসব। এই শোন, কালকে সকালে ঐ SR এর শো আছেনা। কী যেন নাম?”

” প্রভাতের আলো।”

” হ্যাঁ ওটাই। এতদিন তো সব সোসাল সাইটে জ্বালিয়েছি। সেসব নিয়ে অলরেডি গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর হচ্ছে। কালকে কল করে ইচ্ছেমত ধলাই দেব। ধপবাজি করা না?”

রিখিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

” তুমি হঠাৎ করে ওনার পেছনে কেন পরলে বলবে একটু?”

” কেনো পরবোনা? সবার সাথে ধপবাজি করে বেড়ায়। উনি নাকি সব জানতা। হুহ, অথচ আমার একটা প্রবলেমের সলুশন দিতে পারল না। কাল যদি ওনার পর্দা ফাঁস না করেছি। তো আমার নামও তুর্বী আহমেদ নয়।”

বলে গা দুলিয়ে একটা হাসি দিল তুর্বী। রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” কী উল্টাপাল্টা করতে চাইছ আবার তুমি? দেখ তোমার ওসব উদ্ভবট প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবেনা তাই ওই বেচারাকে প্যারা দিও না।”

তুর্বী কিছু না বলে চুপচাপ কফির মগে চুমুক দিল। ওর মাথায় তো এখন অন্যকিছু ঘুরছে। রিখিয়া যত যাই বলুক। কাল বড়সর একটা কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে ও। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিল ওরটা কেন দিলনা? এটাই দোষ ঐ S.R এর। এবার এমনভাবে শায়েস্তা করবে যে মানুষের সাথে ধপবাজি করার শখ তো মিটবেই তারসাথে আর.জে গিরি করার শখও মিটে যাবে।

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৮
.
শীতের প্রভাব আবার কমে এসছে। ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়াতে এখন শীতও বিদায় নেবে বলে পটলা বাঁধছে। হঠাৎ তুলনামূলক কম ঠান্ডা পরাটা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে হয়ত। রিখিয়া রান্নাঘরে রান্না করছে। তুর্বী সোফায় আসাম করে বসে, কানে ইয়ার ফোন গুজে বসে আছে আর অপেক্ষা করছে কখন, ঠিক কখন ‘প্রভাতের আলো’ শুরু হবে। রিখিয়া বারবার ওকে বলে গেছে উল্টোপাল্টা কিছু না করতে। কিন্তু তুর্বী কী আর ওসব শোনার মত মেয়ে না কী? হঠাৎই S.R. এর গলা পেয়ে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি ঠিকঠাক হয়ে বসল ও। S.R. প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাগুলো সব বলে প্রশ্ন-উত্তর শুরু করতেই তুর্বী দ্রুত কল লাগাল। কিন্তু কলটা কানেক্ট হওয়ার আগেই অন্যকারো কল কানেক্ট হয়ে গেল। এভাবে দু-তিনবার কল করার পর কানেক্ট হল। S.R. হ্যালো’ বলতেই তুর্বী চড়া গলায় বলল,

” রাখুন আপনার হ্যালো! আমি এমনিতেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছি। এরচেয়ে বেশি হেলতে গেলে সোফা ভেঙ্গে পরে যাবো।”

স্বাভাবিকভাবেই যারা যারা ‘শো’ টা শুনছিল সবাই হাসছে। কিন্তু সৌহার্দ্যর হাসি পেলো না একটুও। উল্টো রেগে গেল ও। ওর বুঝতে একটুও বাকি নেই যে এটা সেই তুর্বী। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” ওকে। বলুন আপনি কী বলতে চান?”

” বলব? বলে কী লাভ? আপনি তো শুধু শোনেন, কিন্তু ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেন? বিগত এক মাস যাবত আমি আপনাকে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছি, কিন্তু আপনি? কোন রকম কোন উত্তর দিতে পেরেছেন। সবার সামনে দ্যা গ্রেট আর.জে. SR সেজে বসে আছেন। আপনি জানেন আপনি একটা গাধামানব? এরকম গাধামানবকে কীকরে কোন রেডিও স্টেশন আর.জে. হিসেবে নিল লোকে সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছিনা। তারওপর এত হিট শো করেন? হাউ?”

সব শ্রোতারা অবাক হয়ে গেছে। সবার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। কে এই মেয়ে? পাগল না কী? আর সৌহার্দ্য এতটাই অবাক হয়েছে যে লাইপ কাটবে সেই কথাও মাথায় আসছেনা ওর। ওকে চুপ থাকতে দেখে তুর্বী বলল,

” কী হল টা কী? এখন চুপ হ্যাঁ? কী এমন জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি? আমি রিলেশনশীপে যেতে চাই কোনরকম কোন কমিটমেন্ট ছাড়া, সেটাতে কোন ছেলেকে রাজি কীকরে করাব। এই সিম্পল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না?”

সৌহার্দ্য ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” দেখুন মিস আপনার এসব আজব প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবেনা। আপনার অন্যকোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। ”

তুর্বী অবাক কন্ঠে বলল,

” কেন হ্যাঁ? যদি প্রশ্ন করতেই হয় আমি এটাই করব। আর আপনাকে উত্তর দিলে এটারই দিতে হবে। আর না পারলে সবার সামনে স্বীকার করুন যে আপনি নামেই একজন আর.জে কাজের বেলায় জিরো।”

সৌহার্দ্য চাইলেও লাইনটা কাটতে পারবেনা কারণ তাহলে ব্যাপারটা সবার সামনে অন্যরকম ভাবে আসবে, তাই একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করে বলল,

” দেখুন মিস, লাইফটা এক্সপিরিমেন্টের জিনিস নয়। সব কিছুরই এক্সপিরিয়েন্স থাকা আবশ্যক নয়। কিছু কিছু জিনিসের সাথে আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা মিশে থাকে। আর কোন সম্পর্ক এক্সপিরিমেন্টের জন্যে তৈরী করা উচিতও নয়। সম্পর্ক মন থেকে আসে। সেটাকে নিয়ে পরীক্ষা করার বা অভিজ্ঞতা অর্জনের কোন দরকার নেই। একদিন এমনিই আপনার জীবণে কেউ না কেউ চলে আসবে যাকে আপনি আপনার সবটা দিয়ে ভালোবাসতে পারবেন। তার জন্য আগের কোন অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হবেনা।”

সৌহার্দ্যর এত জটিল কথা মাথায় ঢুকলোনা তুর্বীর । তবে সৌহার্দ্যর বচনভঙ্গি মুগ্ধ করল ওকে। কত সুন্দর করে কথা বলে ছেলেটা। শুনলেই মন ভরে ওঠে একেবারে। কিন্তু না! এত সহজে হার মেনে নিলে তো চলবেনা। ছেলেটাকে জব্দ করবে বলে এতকিছু করল অথচ ছেলেটা উল্টে সবার কাছে আরও ‘হিরো’ হয়ে গেল? তুর্বী চেচিয়ে বলল,

” দেখুন একদম কথা ঘোরাবেন না। ‍যদি আমার প্রশ্নের উত্তর জানা থাকে তো ‘হা’ বলুন আর জবাব দিন। আর যদি জানা না থাকে তাহলে ‘না’ বলুন আর স্বীকার করুন যে আপনি একটা ইউসলেস আর.জে.।”

সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড থমকে ছিল। এখানে সংসদ বসেছে নাকি? একটু সামলে নিয়ে গলা ঝেড়ে বলল,

” দেখুন মিস..”

” আরে মিস-টিস পরে করবেন আগে প্রশ্নের উত্তর দিন।”

” আমার মনে হয় আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। সো..”

” না! না! না! আপনি রাখতে পারেন না। কেমন মানুষ আপনি হ্যাঁ ? নিজের অক্ষমতা স্বীকার করার ক্ষমতা নেই? যতক্ষণ আপনি এটা না বলবেন আমি থামবোনা। আমি আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। ”

সৌহার্দ্যর এবার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এরকম পাগল মেয়ে বাইরে খোলা কীকরে ঘুরে বেড়োচ্ছে? এর তো পাগলা গারদে থাকা উচিত ছিল। ও কিছু বলবে তার আগেই লাইনটা কেটে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্যর রাগ একটুও কমলোনা। শো ওখানেই অ‍্যাবট করে বেড়িয়ে গেল ওখান থেকে।

এদিকে তুর্বী রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কাটলি কেন? সবে ওই SR কে বাঁশ দেওয়া শুরু করেছিলাম।”

রিখিয়া সোফার মোবাইলটা ছুড়ে রেখে বলল,

” তোমার কী মনে হয় তুর? তোমার এসব মিনিংলেস কথায় ওনার ওপর কোন এফেক্ট ফেলবে? উল্টো সবাই তোমাকেই পাগল বলছে দেখ গিয়ে।”

তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,

” কেন ফেলবে না? ফেলা উচিত। আমার সিম্পল একটা প্রশ্নের..”

রিখিয়া রেগে গিয়ে বলল,

” শাট আপ তুর! রিলেশনশীপ কোন খেলা? তুমি যা করছ ভেবে দেখেছ সেটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? ভালোবাসা শব্দটার মানে বোঝ? কেউ তোমার এসব উদ্ভট প্রস্তাবে রাজি হবেনা। কত করে বারণ করলাম কিন্তু তুমি তো…। এসব ছেড়ে নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দাও। দেশের সেরা আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন এভাবে বসে বসে পূরণ হবেনা। স্বপ্নপূরণের পথ জলফড়িং এর মত হয় তুর। নিজে এসে তোমার কাছে ধরা দেবে না খুঁজতে হবে। যাই হোক রান্না হয়ে গেছে খেতে এসো।”

বলে উঠে আবার কিচেনে চলে গেল। তুর্বী মুখ ফুলিয়ে পা দুটো সোফার ওপর তুলে বসে রইল।ও তো খুব মন দিয়েই কাজ করে। অবহেলা তো করেনি। কিন্তু ও তো চায় রিলেশনশীপে যেতে। রিলেশনশীপে মানুষ কী কী করে, কী কী বলে, কীভাবে কথা বলে, সব কিছু জানতে চায় ও। পার্সোনালি সবকিছু এক্সপিরিয়েন্স করতে চায়। এতে ভুলটা কী আছে সেটাই বুঝতে পারছেনা ও। ওর ওই চঞ্চল মস্তিষ্কে সৌহার্দ্য বা রিখিয়ার গম্ভীর সত্যি কথাগুলো কিছুতেই ঢুকলো না।

_______________

রিখিয়া ব্যাংক থেকে চারটা বাজে বেড় হল। তুর্বীর আজ অফিস থেকে ফিরতে রাত হবে তাই কফি কিনতে ওকেই যেতে হবে। মার্কেটে গিয়ে কফি কিনে বেড়িয়ে চমকে গেল ও। কারণ বিহান বেড় হচ্ছে ওখান থেকেই। বিহানকে দেখে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। বিহানকে সেদিনের জন্যে ‘সরি’ বলটা খুব জরুরি। সেদিন অকারণেই প্রচন্ড রকম অপমানিত হতে হয়েছে ছেলেটাকে। যেটার দ্বায় রিখিয়া চাইলেই এড়াতে পারে না। রিখিয়া পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ‘এই যে শুনছেন?’ বলে ডাকল কিন্তু বিহান শুনল না। উপায় না পেয়ে ‘বিহান’ বলে ডাকতেই বিহান দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। রিখিয়া দ্রুত পায়ে বিহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিলো। রিখিয়া কিছু বলবে তার আগেই বিহান বলল,

” আ’ম সরি। সেদিন আমার আপনার ড্রেসে ওভাবে হাত লাগানো ঠিক হয়নি। অন্যভাবে ব্যপারটা হ্যান্ডেল করা উচিত ছিল। তখন আমার মাথায় হুট করে এতকিছু আসেনি। আর আমার আপনাকে টাচ করার কোন ইনটেনশন ছিলোনা। এক্সিডেন্টলি লেগে গেছে। আ’ম সরি।”

রিখিয়া তো চরম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। ও তো নিজে ‘সরি’ বলতে এসছিল। উল্টে ছেলেটাই ওকে ‘সরি’ বলে দিল। বিহান চলে যেতে নিলেই রিখিয়া আবার ডেকে উঠল। বিহান রোদচশমাটা খুলে ভ্রু কুচকে বলল,

” কিছু বলবেন?”

রিখিয়া বেশ অবাক হয়ে গেল। সেদিনের ওরকম ঘটনার পরেও ছেলেটা ওর সাথে এত নরমালভাবে কথা কীকরে বলছে? এত ভদ্র কবে হল? নাকি ওই এতদিন চিনতে ভুল করেছে। রিখিয়া ইতস্তত মাথা নিচু করে বলল,

” আপনি কেন সরি বলছেন। আসলে সেদিনের জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। আমার জন্যে আপনার সাথে এরকম কিছু হল। আমার কিছু না জেনেই এরকম করাটা ঠিক হয়নি। সত্যিই আমি খুব দুঃখিত।”

রিখিয়া কথাগুলো শেষ করে কোন সাড়া পেলোনা, তাই মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখল বিহান নেই। ও চরম মাত্রায় অবাক হল। তাকিয়ে দেখল বিহান পার্কিং এড়িয়াতে চলে গেছে। রিখিয়া ওখানে গিয়ে দেখে পনেরো-ষোল জন চার-পাঁচ থেকে নয়-দশ বছরের কিছু বাচ্চাদের হাতে একটা একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দিল। প্যাকেটে কী আছে জানে না রিখিয়া তবে সেগুলো পেয়ে বাচ্চাগুলোর মুখে ভুবনভোলানো হাসি। এই হাসি দেখেই যেন স্বর্গীয় সুখ পাওয়া যায়। বাচ্চাগুলো একজন একজন করে গিফট নিচ্ছে আর বিহানের গালে চুমু দিচ্ছে। বাচ্চাগুলোর কাছে থেকে বিহানের চোখে মুখের খুশির আমেজ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে বিহান ওদের খুব পরিচিত। রিখিয়া অবাক হয়ে দেখছে। রিখিয়া ওখানে যাওয়ার আগেই বিহান বাচ্চাগুলোকে নিয়ে চলে গেল। রিখিয়ার বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে যে বাচ্চাগুলো কারা, আর বিহানই বা কী করছে এদের সাথে? কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই আর রিখিয়া ওখানে থাকতে পারল না। ‘ ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভাবতাম, হয়ত অতোটাও খারাপ না’ নিজের মনে কথাটা আওরে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল রিখিয়া।

_______________

বিহান ওর ফ্লাটে গিয়ে দেখে ওর রুমে সৌহার্দ্য বেডে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বিহান একটু অবাক হলো, কারণ ও জানে সৌহার্দ্য এরকম তখনই করে যখন ও ভীষণ রেগে যায়। বিহান কিছু না বলে আগে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এল। তারপর সৌহার্দ্যর পাশে বসে নিজের ফোন দেখতে দেখতে বলল,

” কী হয়েছে, রেগে আছিস যে? মামু আবার কিছু বলেছে? নাকি তোর ফুপা-ফুপি বলেছে?”

সৌহার্দ্য একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” সেই মেয়েটা আজ আবার শো’তে কল করেছিল। এতদিন যা ইচ্ছা করেছে আজ তো লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।”

” আজ আবার কী বলেছে?”

” রেকর্ডিং আছে শুনে নে।”

বিহান তাড়াতাড়ি ইয়ারফোন নিয়ে ওই অংশটুকু শুনলো। শুনতে শুনতে তো হেসেছেই, শোনার পরেও হাসতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ হ্যাঁ তুই তো দাঁত কেলাবিই। ফাঁসতে তো হচ্ছে আমাকে। তুই কীকরে বুঝবি।”

বিহান হাসি থামিয়ে বলল,

” আচ্ছা শোন আমার কথা। তুই এক কাজ কর। তুই নিজেই ওর সাথে রিলেশনশীপে চলে যা।”

সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” ওর সাথে? আমি? যে মেয়েটা ভালোবাসার মানেটাই বোঝে না। তার সাথে রিলেশনশীপ? যদিও তোকে কী বলছি? তুই নিজেও কী বুঝিস ভালোবাসার মানে?”

বিহান হেসে বলল,

” ও রিলেশনশীপের একটা এক্সপিরিয়েন্স চায়, আর তোরও কোন এক্সপিরিয়েন্স নেই। সো করতেই পারিস। আর আমার মনে হয়না তোর ব্যান্ড না বাজিয়ে এই মেয়ে থামবে। আফটার ওল মেয়ে মানুষ তো। ভ্যাম্পায়ারদের মত। ঘাড়ে একবার চাপলে রক্ত চুষে শেষ করে দিয়ে তবেই নামে।”

বিহানের এইকথার উত্তরে কিছু বলতে গিয়েও বলল না সৌহার্দ্য। আগে অনেকবার বলেও লাভ হয়নি। মেয়েদের নিয়ে বিহানের মনের এই ধারণা বদলাতে পারেনি ও। তাই চুপচাপ গম্ভীর স্বরে কিছু একটা ভেবে বলল,

” এক্সপিরিয়েন্স চাই না ওর? তো ঠিক আছে। দেখা যাক এক্সপিরিয়েন্স নেওয়ার পর মিস তুর্বী আহমেদ কী করে।”

বিহান অবাক হয়ে বলল,

” ওয়েট, ওয়েট। দ্যাট মিনস্ তুই…”

সৌহার্দ্য হাসল। বিহান অবাক চোখে তাকিয়েই বলল,

” কী করতে চাইছিস?”

” পরের বার আমায় কোনভাবে ডিসটার্ব করার আগে যাতে হাজারবার ভাবে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

বিহান গেমস খেলায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

” ওকে। বাট ভাই মেয়েটা খুব চঞ্চল, সবকিছু অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। তাই বেশি কষ্ট দিস না।”

সৌহার্দ্য এবার বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” সেটা আমি বুঝে নেব। এবার বল তুই কী করতে চাইছিস? সেদিনের ঘটনার পরেও এত শান্ত থাকাটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। উল্টোপাল্টা কিছু ভাবিস নি তো?”

বিহান গেমস খেলতে খেলতেই বলল,

” কী আর ভাবব? সব তো এখন ঠিক হয়েই গেছে। সো চিল কর।”

কথাটা সৌহার্দ্যকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। কিছু একটা ভেবে ও বলল,

” বিকেলে কোথায় গিয়েছিলি?”

” আজ কী বার?”

” রবিবার। ওহ! মনে পরেছে। আমাকেও ডাকতে পারতি?”

” ভেবেছিলাম ব্যস্ত আছিস। আমি কী করে জানব তুই রেগে আমার ফ্লাটে এসে বসে আছিস। বাই দা ওয়ে, আজ দুপুরে তো বাড়িতে যাওয়ার কথা তোর। এখানে বসে আছিস মামু জানলে রেগে যাবে তো।”

” ছাড়! এসব নতুন কী? চল কিচেনে যাই। অনেকদিন রান্না করা হয়না। কিছু বানানো যাক?”

বিহান ফোনটা রেখে উঠে বলল,

” চল। বাইরের খাবার রোজ রোজ ভালো লাগেনা। হোমমেড কিছু খাওয়া যাক।”

এরপর দুই বন্ধু মিলে গেল রান্না করতে। রেগুলার অভ্যাস না থাকায় সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে তছনছ করে, শীতেও ঘেমে একাকার হয়েই রাতের জন্যে খাবার বানালো দুজনে।

#চলবে…