জোনাকি প্রদীপ পর্ব-১২+১৩

0
176

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১২.১)
নুসরাত জাহান লিজা

“নীরা,
তোকে আমার একটাই কথা বলার ছিল। খুবই ছোট্ট একটা কথা, কিন্তু তাতেই পুরো আমিটাই আটকে আছি। না বুঝেই তোর ফেলা ছিপের বড়শী গলায় বিঁধে গেছে। কথাটা না বলা পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই। আমি জানি তুই ইচ্ছে করেই আমাকে এড়িয়ে গেলি। এতে যদি তুই সুখে থাকিস, তবে আমি সেই ছোট্ট অথচ অপরিহার্য কথাটা বলব না। যা গোপনে আছে, তা অন্তঃপুরেই থাকুক নাহয়। তবে আমাকে এড়িয়ে যেতে গিয়ে যদি তোরও বুকে টনটনে ব্যথা হয়, একবার শুধু আমায় জানাস, আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি, ছুটে চলে আসব তোর কাছেই। না বললেও তুই বুঝতে পেরেছিস, জানি। তোর উত্তরটাও জানি হয়তো। তবুও বুকে আশার হিমালয় জমিয়ে রাখলাম।

গতকাল তোকে নিয়ে ভীষণ মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন, বাস্তব সবজায়গায় তোর অবাধ বিচরণ ইদানিং। তুই যদি পিছু না ডাকিস কখনো, তবে সেই স্বপ্নটুকু অন্তত আমার সাথে থাকবে। সেটা তুই হাজার চেষ্টা করলেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবি না। ওটুকু অনধিকার চর্চার দোষ আমি মাথা পেতে নিলাম। যা ইচ্ছে সাজা দিস।

জানি, ভালো থাকবি। এলেবেলে বকবক শুনে বিরক্ত হলে চিঠিটা আগুনে পুড়িয়ে ছাঁইগুলো শূন্যে উড়িয়ে দিস।
ইতি,
পেয়েও হারিয়ে ফেলা হতভাগ্য আফনান।”

নীরা ঘরের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় বসে চিঠিটা অত্যন্ত মন দিয়ে পড়ল, পরপর তিনবার। যেন পুরো চিঠিটা আত্মস্থ করে নিল সর্বান্তকরণে।

এরপর ফ্যানটা বন্ধ করল। জানালা ভালো করে এঁটে নিল। কয়েল ধরাবার জন্য একটা দিয়াশলাই ছিল ওর কাছে। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রাখল। চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরে আরেকবার সাদা কাগজের কালো অক্ষরগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় আফনানের দেয়া প্রথম চিঠিটার একটা প্রান্ত সেঁধিয়ে দিল। টুপ করে আগুন ধরে গেল সেখানটায়। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো চিঠিটায়।

নীরার হৃদয়ের ছাঁইচাপা অগ্নিকুণ্ড যেন লেলিহান দাবানল হয়ে আফনানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। কেমন পৈশাচিক এক আনন্দ হচ্ছিল নীরা, কেমন বিষাদ মুড়ানো সুখ ওকে তৃপ্তি দিচ্ছিল। জ্বলন্ত চোখে সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল সেই সুখ।

ভেবেছিল, এবার ওর প্রতিশোধ চরিতার্থ হলো। ষোলকলা পূর্ণ হলো বুঝি। কিন্তু ভালোবাসা আর ঘৃণার প্রতিশোধ যেন একটা ঠিক একটা শাঁখের করাত। ওই প্রান্তে পুড়িয়ে যে সুখ, তাতে এই প্রান্তও যে জ্বলে খাঁক হয়ে যায় তা নীরার জানাই ছিল না আজকের আগে।

যে মুহূর্তে চিঠিটা ভস্মীভূত হলো, সেই মুহূর্তে ছাইগুলোকে মনে হচ্ছিল নিজের ভালোবাসাকে আপন হাতে দাহ করল সে। আচমকা বুক জুড়ে নীল নীল ব্যথার টনটনে এক অনুভূতি ওকে গ্রাস করল। ছাই উড়িয়ে দিতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল নীরা।

তবে সে পিছু ডাকবে না, কিছুতেই না। কখনোই না। ওর মানসপটে হানা দিল দুঃস্বপ্নের শুরুর দিনটা, যখন ওর মনে জোয়ার তুলেছিল আফনান। যার জন্য বোকার মতো ভেসে যেতে চেয়েছিল নীরা।
……….
ক্রমশ

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১২.২)
নুসরাত জাহান লিজা

নিলয়ের বন্ধুদের যখন এই বাড়িতে আনাগোনা শুরু হয়, তখন আদ্যোপান্ত এক কিশোরী মেয়ে নীরা। এই বাড়ির ছেলেরা বাদে অন্য কোনো ছেলেদের সাথে সংশ্রব ছিল না। পড়ত গার্লস স্কুলে। ওই বয়সে স্বভাবতই নীরার বন্ধুদের মধ্যে প্রেম নিয়ে নানারকম ফ্যান্টাসির জন্ম হচ্ছিল। কয়েকজন তো বয়েজ স্কুলের ছেলেদের সাথে চুটিয়ে প্রেমও করছিল। ওরও তখন প্রবল ঝোঁক মাথায় চেপে বসেছিল। কিন্তু রাস্তাঘাটে যারা কখনো সখনো এগিয়ে এসে কথা বলতে চাইত, নিজের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে তাদেরকে সে ভাবতে পারত না।

সে-বার নাইনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর কিছুদিন বন্ধ ছিল স্কুল। ওদের দোতলার বারান্দা থেকে বাইরের ঘরটা স্পষ্ট দেখা যেত। ছাদ থেকে পুরোপুরি দৃষ্টিসীমায় পুকুর পাড়। চার-পাঁচজন অপরিচিত মানুষ আসত নিলয়ের সাথে। ইচ্ছেমতো শিকারে যেত, রাতে বাড়ির ওই ঘরটার ছোট্ট খোলা ছাদে তুমুল আড্ডা চলত, গিটার বাজিয়ে সমবেত স্বরে গান হতো, ঝালমুড়ি ছিল সেই আড্ডার অনুসঙ্গ। তখনই নীরার আটকেছিল একটা ছেলেকে দেখে। হালকা নীল আর খয়েরী রঙের দুটো শার্ট পরত সবসময়। কিছুটা কুঁচকানো থাকর ইস্ত্রি না করার কারণে। তবুও নীরার মনে হতো ওই রঙটা বোধহয় সেই ছেলেটার জন্যই তৈরি হয়েছিল। পুকুরপাড়ের আড্ডাতেই কেবল ছেলেটা খানিকটা নিষ্প্রভ ছিল। একমনে ছিপ ফেলে অপেক্ষা করত। সৌম্য চেহারায় কী যেন একটা চৌম্বকীয় শক্তি ছিল, যা প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত ওকে। নিলয়ের কাছ থেকে জেনেছিল ছেলেটার নাম আফনান।

নীরার বাবা সবসময় বলতেন, “আমি জানি আমার ছেলেমেয়েরা ভুল করবে না। এতটুকু বিশ্বাস আমার তাদের প্রতি আছে।”

তাই তেমন বিধিনিষেধ ছিল না কোনোকিছুতেই। নিলয়ের সাথে গিয়ে সে পরিচিত হয়ে এসেছিল তার বন্ধুদলের সাথে। ওরাও প্রত্যেকে ভীষণ বন্ধুসুলভ ছিল যে নীরাও খুব সহজেই ওদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।

পরেরবার নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার পরে যখন তারা আবার এসেছিল, নীরা আফনানকে চেপে ধরে সে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে শিখবে। প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে সাচ্ছন্দ্যে রাজি হয়ে যায়। প্রথম দিকে সে কেবল আফনানকেই দেখত। ঘামে ভেজা মুখটা যত্ন করে ওড়না দিয়ে মুছে দেবার লোভ হতো ভীষণ। মনে হতো তারপর আফনান প্রশ্রয়ের সুরে হয়তো বলবে, “এটা কী হলো?”

নীরা ভুবনমোহিনী হেসে বলত, “তুমি আমাকে মাছ ধরা শেখাচ্ছ, এটা তার পারিশ্রমিক।”

“এত কষ্টের এই যৎসামান্য পারিশ্রমিক?”

“বা রে, আমার ভালোবাসাটা বুঝি ঠুনকো?” অভিমানী গলায় বলে দূরে গিয়ে বসে থাকবে, আর আফনান তখন ওর অভিমান ভাঙাবে। কিন্তু কিছুই বলা হয় না। আফনানের ঘার্মাক্ত মুখ দখিনা বাতাসে শুকিয়ে যায়। পাছে ধরা পড়ে যায়, সেই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় নীরা।

ওর মনে এরকম নানা দৃশ্যপটের জল্পনার আঁকিবুঁকি চলতে থাকে। বেলা শেষে খেলা ভাঙার মতো নিলয়ের বন্ধুরা যার যার নিজস্ব গন্তব্যে ফিরে যায়।

নীরার জন্য তখন সময়টা অসহনীয় প্রতীক্ষার। এমনিতে যখন হুটহাট তারা আসত, তখন ওর সাথে কারোর দেখা হতো না। সেই আবারও মাস ছয় সাত মাস পর নতুন করে নতুন আয়োজনে তারা হাজির হতো। নিলয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেল, আফনানও। তখন নীরার সামনে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততা। তবুও সে আফনানের সাথে কথা বলতে গেল।

নিলয় যেমন কাঙ্ক্ষিত জায়গায় চান্স পেয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত তেমনটা যেন আফনানের মধ্যে তখন ছিল না একেবারেই। অন্যবারের চেয়ে ভীষণ মৃয়মান মনে হচ্ছিল। কী হলো মানুষটার, কয়েকবার প্রশ্ন করেও উত্তর মিলল না। পরে নিলয়ের কাছে শুনল আফনানের মায়ের কী যেন অসুখ করেছে৷ চিকিৎসা ব্যয়বহুল। ওদের পারিবারিক অবস্থার কথা শুনে সেদিন ছেলেটার জন্য এত কষ্ট হয়েছিল, যে সেদিন পড়তে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল নীরা৷

মঈদুল পর্যন্ত এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী হয়েছে তোর মা? কেউ বকেছে? কেউ কিছু বলেছে?”

নীরা তবুও আকুল হয়ে বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে কেঁদেছে। বাবাকে বলেছে, “কিছু হয়নি বাবা। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কেন, জানি না।”

মঈদুল সেদিন বেশ কিছুক্ষণ মেয়ের পাশের চেয়ারে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।

নীরার কিছু করতে ইচ্ছে করছিল আফনানের জন্য। নামাজে দোয়া করেছে তার মায়ের সুস্থতার জন্য। হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটার মুখ অমন ম্লান হলো বলেই বুঝি ভালোবাসা হু হু করে বাড়ল। নীরা সেই কৈশোরকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করল, ওই হাসিমুখ সে সারাজীবন দেখতে চায়। ঘুম ভেঙে প্রতিদিন ওই সৌম্য মুখটা চোখের সামনে চায়৷

নীরার গত জন্মদিনে ছোটচাচা একটা সোনার চেইন উপহার দিয়েছিলেম, সেটা খুলে নিয়ে সে গিয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে নিলয় বাবাকে বলে টাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। তখনই যেন নীরা ভীষণভাবে চাইল আফনানকে। নিলয়ের বন্ধুদের নতুন নতুন প্রেমের গল্প শুনে মনে হলো, আফনান নিশ্চয়ই ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে না। যা বলার তা দ্রুত বলতে হবে। নইলে যদি হারিয়ে যায়।

তাতেই সে ডুবল। সেইদিনের কথাটা নীরা আজ আর মনে করতে চাইল না। তবুও মন তো প্রবোধ মানে না। চিঠির ছাই ওর হাতে লেগে আছে এখনো। থাকুক, আফনান ওকে বয়স নিয়েও জ্ঞান বিতরণ করেছিল। নীরার বয়স হয়তো বেড়েছে, কিন্তু বয়সের ব্যবধান তো মেটেনি। যখন সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আফনানকে চেয়েছিল, তখন সে আসেনি। এখন চাইলেই ওকে ধরে ফেলা যাবে! এটা যদি ভেবে থাকে তবে সে ভুল। নীরা মোটেও সহজলভ্য কিছু নয়।

***
“মা ফোন করেছিল। আমাকে যেতে বলছে একেবারে।” ওষুধ খেয়ে বিতৃষ্ণ মুখে বলল শায়লা, তবে মুখে হাসি।

“তুমি কি বলো?” শায়লার কথায় রবিন প্রশ্ন করল।

“মা বলল, মেয়েদের প্রথমবার প্রেগন্যান্সির সময় মায়ের কাছে থাকতে হয়।”

“সেটা তো যত্নের জন্য। এখানে কি তোমার যত্ন হচ্ছে না ঠিকঠাক?”

“হচ্ছে, কিন্তু তুমি তোমার কাজকর্ম, ব্যবসা ফেলে সারাদিন বাসায় বসে থাকো, আমার খারাপ লাগে।”

রবিনের ব্যবসায় বড়সড় একটা ঝামেলা চলছে। এটা এই অবস্থায় স্ত্রীকে বলে চিন্তায় ফেলতে চায় না। তাই সে বলল,

“কেন? আমি পাশে থাকলে তোমার ভালো লাগে না? চাও না?”

“নিজের সৌভাগ্যকেও মাঝেমধ্যে ঈর্ষা হয়। আমি কী করে তোমার পেলাম বলো তো?” গর্বিত একটা ভঙ্গি শায়লার মুখাবয়বে ফুটে উঠল।

“তাহলে?”

“আমিও তোমাকে নিয়ে অনেক ভাবি বুঝলে! তোমার জন্যই…”

“আফনানের কী খবর বলো তো?” প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে শ্যালকের কথা জিজ্ঞেস করল রবিন। নিজের স্ত্রীকে তো চেনে সে, নইলে দেখা যাবে আবেগপ্রবণ হয়ে কান্নাকাটি করতে শুরু করবে।

শায়লা সহসা মনে পড়েছে এমনভাবে বলল, “ওর কথা আর বলো না। আমি ভীষণ রাগ করেছি এবার। সেই এসে আমাকে দেখে গেল, এরপর বন্ধুর বিয়েতে গেছে। মা বলল আজ নাকি ফিরবে।”

রবিনের তিনটা শো-রুম রয়েছে স্থানীয় শপিং কমপ্লেক্সে। বছর দুয়েক হয় এই এলাকায় এসেছে ওরা। এতদিন কোনো ঝামেলা না হলেও গত কয়েকদিন ধরে হু ম কি – ধা- ম- কি আসছে চাঁ /দা/ র জন্য। সে দিতে রাজি নয়। এলাকার প্রভাবশালী লোকের চ্যালাপেলা এটা নিয়ে ঝামেলা করছে। রবিনের কাছে নিজের সততাটুকু আগে। সে সৎভাবে ব্যবসা থেকে উপার্জন করছে, কেন শুধুশুধু অন্যকে তার ভাগ দেবে। জিডি করেও লাভ হয়নি। ক্ষ ম তার কাছে কখনো কখনো সততা বড্ড অসহায় হয়ে যায়। তবে সে চায় মীমাংসা হোক, কিন্তু এভাবে আপোষ করতে চায় না।
……..
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা

নীরা ধ্যানমগ্ন হয়ে পুকুর পাড়ে বসে আছে। কয়েকবছর আগে যার জন্য এই এখানটাতেই হৃদয়ে সমুদ্রপ্লাবী আবেগের উথাল পাথাল নিয়ে ছুটে আসত, গতকাল সেই মানুষটার এতটা নৈকট্য থেকেও সে পুরোপুরি নিস্পৃহ থাকতে পেরেছে। এখন মনসমুদ্রে অবশ্য উল্টো স্রোতের টান। পরস্পরের অনুভূতিও নয়-ছয় হয়েছে।

এটুকু ভাবতেই মনে হলো, কথাটা পুরোপুরি বোধহয় ঠিক নয়। নইলে আকাশে মেঘের ঘনঘটার মধ্যেও এখন ওর মনের ভেতরটায় এমন প্রখর উষ্ণতায় জ্বলছে কেন! সেখানটায় এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষায় চাতকের মতো কত সহস্র বছরের প্রতীক্ষা, সে-ই অনন্ত প্রতীক্ষা কেন ফুরোয় না।

“নীরা, একটু কথা বলা যাবে আপনার সাথে?”

আচমকা সায়মনের গলা পেয়ে সম্বিৎ ফিরল নীরার।

“হ্যাঁ। তবে একটুই কিন্তু।”

সায়মন স্মিত হেসে খানিকটা দূরত্ব রেখে নীরার পাশে বসল। কিন্তু সহসাই কথা শুরু করতে পারল না। আজ আকাশ জুড়ে মেঘ জমে আছে। তার গুড়গুড় ডাকে বৃষ্টির আভাস। নীরাই শুরু করল,

“কী হলো, কথা বলবেন অথচ চুপচাপ বসে আছেন।”

“আপনি বৃষ্টি ভালোবাসেন?”

নীরা ঈষৎ হেসে সুদূরে ভেসে বেড়ানো পাখির পানে দৃষ্টি রেখে বলল,

“ছিমছাম বৃষ্টি পছন্দ। যে বৃষ্টি কেবলই শীতলতার পরশ বুলিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। ঝড়ো বৃষ্টি আমার ভারি অপছন্দ। কেন যেন অপছন্দ বয়ে বেড়ানোই আমার নিয়তি।” বলতে বলতে মৌনতা এসে গ্রাস করল নীরাকে। ওর হৃদয়ে সবসময় কালবৈশাখীর তাণ্ডব বয়।

সায়মন বলল, “আপনি ভীষণ গুছিয়ে কথা বলেন।”

“এমন মনে হলো কেন?”

“বা রে, আপনার কথা শুনে।” ঈষৎ থেমে সায়মন আবারও মুখ খুলল,

“আপনি বললেন, নিয়তির কথা, মনে হলো কোনো অপ্রাপ্তি থেকেই কথাটা বলা। আমি…”

“সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। অনধিকার চর্চা আমি একদম পছন্দ করি না।”

সায়মনের অভিব্যক্তি ম্লান হলো, সে নতমুখে বলল, “স্যরি, আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারিনি।”

বলতে বলতে আবারও হাসি ফুটল সায়মনের মুখে, “মাত্রই বললেন, অপছন্দ বয়ে বেড়ানোই আপনার নিয়তি। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, নিয়তি খণ্ডাবার সাধ্য আমার নেই বলেই হয়তো আপনার অপছন্দের বিষয় নিয়ে কথা বলে ফেলেছি। আমার কিন্তু কোনো দোষ নেই।” গোবেচারা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে কথাগুলো বলল সায়মন।

নীরা হেসে ফেলল। হাসলে ওর চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। হাসি ধরে রেখে সে বলল,

“আপনি ভীষণ মজার মানুষ। যদিও কৌতূহলটা বড্ড বেশি।”

“স্বভাবদোষ বুঝলেন! কী আর করার? আচ্ছা, আরেকটা অনধিকার চর্চা করে ফেলি? আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে কিংবা…”

নীরা আবারও নিজেকে আবৃত করে নিল খোলসে, কঠিন গলায় বলল,

“বয়ফ্রেন্ড নেই। তবে আপনি যে জন্য জানতে চাইলেন, সেটাও সম্ভব নয়। আপনি ভালো মানুষ, বুদ্ধিমান। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

কথাটা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না নীরা। উঠে হনহনিয়ে চলে গেল। সায়মন একদৃষ্টে ওর যাবার পথে তাকিয়ে রইল। এই দুর্বোধ্য রমনীকে জয় করবার এক সুতীব্র বাসনা সায়মনকে তাড়িত করল।

সে সংকল্পবদ্ধ হলো, এই কঠিন চোখের মায়া মুখের তরুণীকেই সে নিজের সমস্ত ভালোবাসা নিংড়ে দিয়ে হলেও জয় করবে। আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিজ্ঞা ব্যর্থ হয়নি ওর।

***
“তোর প্রিয় আলু ভর্তা আর ঘি। মতিকে ইলিশ আনতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু পায়নি। এক সপ্তাহ আগে শায়লা আর রবিন ইলিশ এনেছিল। এসব আনতে বারণ করলেও কানে তোলে না মেয়েটা। অগত্যা ওটা দিয়েই ঝোল করলাম।”

আফনান ভেবে পায় না, মায়েরা কীভাবে নিজের ভালোলাগা ভুলে কেবল সন্তানের খুশিতে সুখ খুঁজে নেন। সে তো বাবারও সন্তান। কই তিনি তো কেবল নিজের স্বার্থই ভেবেছেন৷ নিজের সন্তানের মা, প্রিয়তম স্ত্রী, সন্তান সব ফেলে কেমন নিজের আলাদা পৃথিবী গড়ে নিয়েছেন। ওর বন্ধুদের বাবারা তো এমন নন। তবে ওর বাবা কেন এমন। পৃথিবীতে একটা মাত্র মানুষকেই অপরিসীম ঘৃণা করে আফনান।

“মা, তুমি যা রাঁধো তাই অমৃত। তুমি কিছু রাঁধবে, সেটা মজা হবে না এটা হতেই পারে না। ওখানে এসব যে কী মিস করি! চলো না, এবার তো আমার সাথে যাবে বলেছিল। শেষে এসে কিনা ক্যান্সেল করলে।”

মা সস্নেহে আফনানের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “শায়লার সাড়ে ছ’মাস চলছে। এখন তোর সাথে কীভাবে যাই বল?”

“এরপরেরবার কিন্তু পাকাপাকিভাবে আমার সাথে যেতেই হবে তোমাকে, মা। নইলে আমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে তোমার আঁচলের তলায় ফিরে আসব।”

“দেখো ছেলের কাণ্ড। বলেছি তো যাব। তোর জন্য যা যা দেবার সব দিয়েছি। তুই মনে করে ব্যাগে ভরিস।”

“সে নেব নাহয়। ওদিকে তোমার আদরের মেয়ে আমার সাথে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।”

“তোকে ভালোবাসে বলেই অভিমান হয়েছে। তাছাড়া এই সময় মেয়েরা কাছের মানুষদের কাছ থেকে একটু বেশিই যত্ন আশা করে, মনোযোগ চায়। তোর ট্রেন কয়টায়? যাবার আগে একবার ঘুরে যাস নাহয়। দেখবি অভিমান গলে জল হয়ে গেছে।”

“ট্রেন তো বিকেলে। সাড়ে চারটায়। ভাবছি সকাল সকাল তোমাকে নিয়ে বেরোব। তারপর ওখান থেকেই ট্রেন ধরব।”

“ঠিক আছে, শোন…”

বাকি কথা বলার আগেই আফনানের মোবাইল ফোন সশব্দে বেজে উঠল। সে হেসে বলল,

“আজ অষ্টম আশ্চর্য ঘটেছে। তোমার মেয়ে রেগে থেকেও নিজে আগে কল করেছে মা।”

মা আফনানের পিঠে চাপড় মেরে কপট ধমকের সুরে বললেন,

“পাজি হিংসুটে ছেলে, আমার ভালো মেয়েটাকে নিয়ে খালি নিন্দা করা। কলটা ধর, নইলে আর রাগ ভাঙাতে পারবি না।”

আফনান বাম হাতেই কল রিসিভ করল, কানে ধরতেই ওপাশে শায়লার কান্না শুনতে পেল।

“কী হয়েছে শায়লা, কাঁদছিস কেন?”

“রবিন এখনো ফেরেনি আফনান। ওর ফোনটাও বন্ধ।”

“তুই টেনশন করছিস কেন? মাত্র সোয়া নয়টা বাজে।

“গত একমাস ধরে ও বিকেলেই ফিরে আসে। শফিকরা বসে শো-রুমে। আজও আগে ফেরার কথা বলেই বেরিয়েছে। শফিক বলল, ওখান থেকে বেরিয়েছে সেই বিকেল চারটায়। এরপর ওকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ভেবেছি হয়তো কোনো কাজে গেছে। কিন্তু… আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে আফনান৷ এই অবস্থায় আমি কিছু করতেও পারছি না।” কান্নার বেগ বাড়ছিল শায়লার।

“তুই একটু শান্ত হয়ে বস প্লিজ। আমি এক্ষুণি আসছি। তুই ঘর থেকে বাইরে বের হোস না যেন৷ আমি এক্ষুণি বের হচ্ছি।”

“প্লিজ কিছু একটা কর, দ্রুত, প্লিজ…”
……..
(ক্রমশ)