জোয়ার-ভাটা পর্ব-২৭+২৮

0
304

#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া-সাত্তার-ঊর্মি
২৭
বিষন্নতা একাকীত্বের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো মার্জান।
অনুভূতি গুলো আজ ওঁর এলো মেলো। নিকষ কালো মেঘের মতো ঘিড়ে আছে যেন মার্জানের জীবন। মার্জান রাতের আঁধারের খোলা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। দম বন্ধ অনুভূতি। তাই জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই আসা দমকা হাওয়া উড়িয়ে দিলো ওঁর খোলা চুল। মার্জানের ধ্যান ভাঙ্গে ফোন কলে। মার্জান ভাবলেশহীন ভাবে ফোন তুলল,

” মমি আমিকে নিয়ে যাও, আমি থাকবো না এখানে…”

মৃণালে কান্নারত কন্ঠে মার্জানের বুক ধক করে উঠলো,
” কি হয়েছে বাচ্চা। আচ্ছা..আচ্ছা আগে কান্না থামাও খুলে বলো আমায়?”

মৃণাল হিচকি তুলে কাঁদে বলল,

” মমি পাপা আমায় বকেছে, সে আমায় চিনা না।”

মার্জানের ভ্রু সংকুচিত হয়ে গেলো,

“কি বলেছে তোমাকে?”

মৃণাল কিছুক্ষণ আগের সব ঘটনা খুলে বলতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণ আগে।
তুলতুলকে কোলে তুলে ওঁর ঘরে নিয়ে গেলো গ্রীষ্ম। তুলতুলের রুমটি আজো সেই রকম আছে, যেমনটি ছিলো। তুলতুল নিজে রুম দেখ বিস্মিত হয়ে তাকালো,

” আমার রুম আজো এমন আছে?”

গ্রীষ্ম বাঁকা হাসলো,
” তুমি না থাকলেও তোমার সব কিছুই আমি ঠিক করে রেখেছি। অথচ আজ তুমি সবার সামনে আমায় রেপিস্ট বললে?”

গ্রীষ্মের হাসির পিছনে তুলতুল আষাঢ়ের প্রতি ছবি খুঁজে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে ওঁর হাত ধরে বলে উঠলো,

” নাহ্ নাহ্ আমি তোমাকে বলিনি। আমি আষাঢ়…। গ্রীষ্ম তোমার শরীর এত গরম কেনো? মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর আসছে?”

গ্রীষ্ম ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো তুলতুলকে। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমি ঠিক আছি।”

তুলতুল চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি একদম ঠিক নেই। তোমার এখনি মেডিসিন নেয়া উচিত।”
বলেই তুলতুল এদিক ওদিক ঔষধ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। তা দেখে গ্রীষ্ম বলে উঠলো,

” তুমি কেন চাইছো আমি চলে যাই?”

তুলতুল ওঁর কথাটুকু বুঝলো না। ওঁর দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে চাইতেই। গ্রীম্ম বেড়িয়ে গেলো তুলতুলের ঘর থেকে। এবং ঠিক তখনি মুখোমুখি হয় মৃণালের। মৃণাল রাগে, ক্ষোভ তাকিয়ে আছে কোমরে হাত দিয়ে। গ্রীম্ম ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

” কি চাই।”

মৃণাল রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলো,

“পাপা তুমি এইটা করতে পারো না… তুমি ওই আন্টিকে বের করে দাও। ওটা শুধু আমার মমির জায়গা। নয়তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

গ্রীষ্ম মৃণালকে দেখে কি যেন ভাবলো। পরক্ষণেই ধমকে উঠে বলল,

” আমি তোমার বাবা নই, আমি তোমার।আঙ্কেল হই। তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। কোথাও যেতে দিবে না। যাও এবার ঘরে যাও।”

মৃণাল গ্রীষ্মের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। কান্না করে চলে গেলো ঘরে। এবং ফোন করলো মার্জানকে। সব শুনে মার্জান বলে উঠলো,

” বাচ্চা চিন্তা করো না। আমি তোমাকে খুব শীঘ্রই নিয়ে যাবো। এবং এদেশ থেকে চলে যাবো।”

মৃণাল খুশি হয়ে গেল।

আকাশের বুক চিড়ে আলোর ফলন হলো। ঘর দুয়ারে নিখিল জগৎকে সূর্যের সোনালী আলো স্পর্শ করে গেলো। মার্জান রোজকার মতো সড়ক ধরে হাটতে লাগল। শীত শীত দিনে গরম স্পর্শ কতটুকু মজার বলে বোঝানো দায়। কিন্তু মনের শীতল স্পর্শে উষ্ণ ছোঁয়া কবে লাগবে মার্জানের? মার্জান আর শীপ্রা এসে দাঁড়ালো একটু শপিং মলের সামনে। দেশের বাহিরে চলে যাবার আগে কিছু শপিং করা উচিত। তাই শীপ্রা আর ওঁ দুজনেই মিলে শপিং মলে ডুকে গেলো। শীপ্রা মার্জানকে প্রশ্ন করলো,

” সব ঠিক আছে তোদের মাঝে?”

মার্জান একটি ড্রেস দেখছিলো। শীপ্রার কথা বুঝতে না পেরে তাকালো ওঁর দিক। শীপ্রা তখন অন্য দিকে তাকিয়ে। ওঁর নজর ফোলো করে সামনে তাকাতেই মার্জান নিজেও থমকালো। তুলতুল গ্রীষ্মের বাহু ধরে হেটে হেটে শপিং করছে। মার্জানের বুকের ভিতর এমনটি দেখে তোলপাড় শুরু হলো। কিন্তু নিজেকে ঠিক রেখে শীপ্রাকে জবাব দিলো,

” আমাদের মাঝে কখনো কিছু ছিলোই না যে কিছু হবে।”

শীপ্রা মার্জানের ম্লান কন্ঠ শোনে, আহ্! করে শ্বাস ছাড়লো,

” বেডা মানুষ, খন খনে রং পাল্টায়। বাদ দে। ”

মার্জান বিদ্রুপের হাসি দিলো। কিন্তু পরক্ষণেই তুলতুল ওঁদের সামনে এসে বলে উঠলো,

“হ্যালো মার্জান। আমি দুঃখীত সেদিনের গ্রীষ্মের ব্যবহারে।”

মার্জান চমকালো না। হেসে বলল,

” আমি কিছু মনে করিনি। আমিতো এসবে ইউস টু হয়ে গেছি। কিছু মানুষের ছেড়ে যাওয়ার অভ্যাস সারা জীবনের। দেখো মাঝ পথে না আপনাকেও চমকে দেয়।”

কথাটুকু ঠাট্টার সুরে বললেও তুলতুল বুঝে গেলো। গ্রীষ্মের দিকে তাকাতেই গ্রীষ্ম অন্য দিকে তাকিয়ে যেন চিনেই না মার্জানকে। যেন কর্ণপাত পর্যন্ত পৌঁছায় নি ওঁদের কন্ঠ। তাই মার্জান সরে এলো। নিজের জন্য একটা ড্রেস চুস করতেই আরেকটি হাত ওঁর সেই ড্রেসে পড়লো। তা দেখে ভ্রু কুচকে গেলো মার্জানের,

” সমস্যা কি? মিঃ গ্রীষ্ম!”

“এই ড্রেসটি আমি নিবো তুলতুলের জন্য। তুমি অন্য কিছু দেখো।”

মার্জান ড্রেসটি কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো,
” আমি আগে দেখেছি আমি নিবো।”

গ্রীষ্ম নাছড় বান্দা,
” তুমি অন্য কিছু ট্রাই করো। বিল না হয় আমি পে করে দিবো।”

মার্জানের রাগের সীমা খতম। নিজের আত্মরক্ষার জন্য সবমসয় কাছে রাখা ছোট ছুরি বের করে ড্রেসটি ইচ্ছে মতো কেঁটে কুটি কুটি করে গ্রীস্মের মুখে মেরে দিলো। রাগে ওঁর গা কাপছে, এত অপমান, গ্রীষ্ম কি ওঁকে ভিক্ষারী মনে করে? মার্জান যেতে বলে উঠলো,

” নিন এবার পে করে দিন।”

বলে ধপাধপ পায়ে বেড়িয়ে গেলো। উপস্থিত তুলতুল আর শীপ্রা হা হয়ে গেলো।

দিনের আলোয় ফক ফক করছে। জানালা দরজা ভেজ করে মৃণালের ঘরটি আলোকিত করে চলে যাচ্ছে। কোথা থেকে উঁড়ে এসে দু’টো পাখি চি চু চা শব্দ করে চলছে। মৃণাল কম্পিউটারে বসে কি যেন করছিলো। পাখিদের শব্দে বিরক্তি নিয়ে উঠে এসে ওঁর বিস্কুট ভেঙ্গ দিলো ওঁদের। এখানে আসার পর থেকে এই দুজনই ওঁর খেলার সাথী যেন। মৃণাল খাবার দিয়ার পর মুখে ওঁর ছোট আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বলল,

” শু। একদম ডিস্টার্ব করবে না। আমি ইমপর্ট্যান্ট কাজ করছি। ”
বলেই আবারো কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লো। ছোট ছোট আঙ্গুলে ট্যাপ ট্যাপ করে কিছু লিখে ফেললো। সব শেষে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো। ঠিক তখনি রহিম চাচা ঢুকলো ঘরে। কম্পিউটার স্ক্রীনে তাকাতেই চোখ দু’টো ছানাবড়া। মার্জানের জন্য মেইড ফর ইচ আদার একটি এপ্যাসে পার্টনার খুঁজছে মৃণাল। উনার কঁপালে হাত। কারণ মৃৃণাল শুধু ওঁর মা নয় নিজের জন্যও বাবা খুঁজছে। এমন কেউ যে ওঁর মাকে বিয়ে করবে, এবং মৃণাল ফ্রী….। ইনফেক্ট রিতীমত রেসপন্স চলে আসছে। রহিম চাচা বেড়িয়ে গেলো দ্রুত অনিতা মেডামকে খবরটা যে দিতে হবে। বংশেরবাতি যদি এভাবে চলে যায়? কেমন হবে???? অনিতার কানে যেতেই অনিতা দৌঁড়ে এলো। এতটুকুন বাচ্চা এমন কাজ করবে? ভেবেই পেলো না। অনিতা জিগ্যেস করলো,

” দাদু ভাই তোমার কি মন খারাপ?”

মৃণাল গোমরা মুখে বলল,

” আমি জানের কাছে যাবো।”

অনিতা মৃণালের মাথায় হাত রেখে বলল,

” ঠিক আছে আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু তুমি নাকি তোমার জন্য বাবা খুঁজছো?”

মৃণাল হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।

” কিন্তু তোমার বাবাতো আছেই।”

গ্রীষ্ম ছলছল চোখে বলল,
” উনি আমার বাবা নয়, উনি নিজেই বলেছেন।”

অনিতা অবাক হয়ে গেলো। তুলতুল এসেছে পর থেকে ছেলেটা এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছে? বুঝলো না।নাকি ওঁর মাঝে আবারো আষাঢ়ের পার্সোনালিটি ভর করেছে??? অনিত সময় বিলম্ব না করে ডাক্তারকে আসতে বলল অনিতা।

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২৮।

মধ্য রাতে মার্জানের কাছে কল এলো,
” মার্জান আমি গ্রীষ্মের মা বলছি, আই নিড অ্যা হেল্প!”
মার্জান কটাক্ষ করে বলল,
” আপনাদের কাছে এখনতো আপনাদের বউ রানী আছিই, তাহলে আমার কি দরকার?”
অনিতার কাছে উত্তর নেই। কি বা বলবে সে? কিন্তু যেভাবেই হোক এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবার একটি উপায় হলো মার্জান। তাই অনিতা বলল,
” মার্জান মৃণালের অনেক জ্বর। জ্বরের ঘরে তোমাকেই ডাকছে।”
মার্জান সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। ‘আসছি ‘ বলে ফোন কেঁটে দিলো। এবং বেড়িয়ে পড়লো তখনি। আর যাই হোক ওদের ঝামেলার মাঝে নিজের ছেলেটাকে কি করে কষ্ট দিবে মার্জান? ঘন্টা খানেকের মাঝে পৌঁছে গেলো মার্জান। দৌঁড়ে মৃণালের রুমে যেতেই দেখলো ঘুমিয়ে আছে ওঁ। আলতো করে মৃণালের কঁপালে স্পর্শ করতেই মার্জান অবাক হয়ে যায়। কই জ্বর নেই তো। অনিতা আন্টি তাহলে তাকে মিথ্যা কেন বললো?? মার্জানের রাগ উঠে গেলো। ধপাধপ পায়ে অনিতার রুমে আসতেই দেখতে পেলো অনিতা বাহিরে শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে।হাতে ওঁর একটি ছবির ফ্রেম। পিছনে না ফিরেই জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমি জানি তুমি আমার উপর এই মুহুর্তে রেগে আছে তুমি মা। কিন্তু আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। সেদিন তোমায় আমি অর্ধেক সত্যি বলেছিলাম আজ আর কিছু লুকবো না।”

মার্জান অবাক হয়ে বলে উঠলো,
” কি সত্যি? ”

অনিতা হাতের ফ্রেমটা সামনে ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিলো। মার্জানের হাতে ছবির ফ্রেমটি দিয়ে বলে উঠলো,

” এইটা দেখো।”
মার্জান হাত বাড়িয়ে নিলো। অনিতা লাইট জ্বালাতেই গ্রীষ্ম ওঁ আষাঢ়ের র্সুদর্শন একটি ছবি ভেসে উঠলো। খুব কাছে থেকে দেখলে দু’ভাইয়ের মাঝে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রীষ্মের চোখের নিচে তিল আছে পরপর দু’টি, ও-দিকে আষাঢ়ের বাম গালে গাড় তিল। মার্জান জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চাইলো। অনিতা বলতে শুরু করলো।

” আষাঢ় গুম হবার পর থেকেই গ্রীষ্মের শরীরে বাসা বাঁধে,
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। আষাঢ় চলে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই গ্রীষ্ম নিজেকে আষাঢ় ভেবে বসত। কখনো এটি একবার বা কখনো হাজার বার হতো। এই রোগের আধিপত্য দেখা যাওয়া প্রথমে অনেকে ভূতে ধরা বলতো বা কেউ কেউ পাগল বলতো। অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক ও বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া দেখা যায় ওঁর মাঝে। বিশেষ করে সেই জন্য মেয়েদের থেকে দূরে থাকতো। সব থেকে বড় কথা নিজেকে নিজেই মেরে ফেলার ট্রাই করতো। এমনি অন্যকে মারবার প্রবণতা রাখতো। ”

মার্জান আত্নকে উঠলো। একবার নদীর পাড়ে নিজেকে মারার চেষ্টা করতে দেখেছে মার্জান। ওঁ বাজাতে গেলে গ্রীষ্ম ওঁকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছে। সব কিছু ভেবে মার্জান হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। অনিতা এবার কেঁদে দিলো। অনিতার কান্নার কন্ঠ ভেসে আসতে মার্জানের ধ্যান ভাঙ্গে। অনিতা আবার বলে উঠে,

” গ্রীষ্মে প্যানিক অ্যাটাক টা আবার এসেছে। যার ফলে আষাঢ়ের মতো ব্যবহার করছে। ডাক্তার বলছে, যদি খুব শীগ্রই ওঁ মেডিসিন না নেয়, তাহলে নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলবে।”

মার্জান চিন্তায় পড়ে গেলো। তাহলে কি যা কিছু করেছিলো সব কি আষাঢ়ের ব্যক্তিত্ব করেছে? তাহলে তো মৃণালের জন্য ওঁ খতরনাক হবে। কেন জানি মার্জানের গ্রীষ্মের এই রোগ শোনেও ওঁর মনে কোনো ফিলিংস কাজ করলো না। হয়তো গ্রীষ্মের ব্যবহারে তেতো হয়ে গেছে মার্জানের মন! যদিও মার্জান সব ভুলেও যায়? তবেও কি হয়ে যাবে? গ্রীষ্মের জীবনে কি আর মার্জানের জায়গা হবে? সে বাঁধবে তো অন্য কারোই ঘর।মার্জান সপ্তপর্ণে শ্বাস লুকালো। প্রশ্ন করে বসলো,

” আমাকে কেন এভাবে ডেকেছেন? আমি কি করতে পারি?”

অনিতা অপরাধীমতো মার্জানের হাতে হাত রেখে বলে উঠলো,
” শুধু এতটুকু করো, আমার ছেলেটিকে মেডিসিন নিতে সাহায্য করো। ওই কারো কথা শুনছে না।”

“কিন্তু আমি কিভাবে….”

মার্জানের কথা শেষ হবার পূর্বেই বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচি শুনে অনিতা আর মার্জান দৌঁড়ে বেড় হলো। সিড়ির উপরের দাঁড়িয়ে তুলতুলে জোর করছে গ্রীষ্মকে মেডিসিন খাবার জন্য কিন্তু গ্রীষ্ম ওঁর কথায় বসে আছে,

” আমি খাবো না। আমি তোমার থেকে দূরে যেতে চায় না। আমাকে কেন দূর সরাতে চাইছো?”

তুলতুল বুঝালো,

” আমি কোথাও যাচ্ছিনা তুমি দয়া করে ঔষধ টুকু খাও।”

এক পর্যায় দু’জনের মাঝে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো। এমন করতে করতেই গ্রীষ্ম আর তুলতুল দু’জনেই নিচে পড়ে গেলো। এসব দেখে অনিতা চিৎকার করে উঠলো। তুলতুলের তেমন কিছু না হলেও গ্রীষ্মের মাথা কেঁটে গেলো। এবং ওঁ সেন্সলেস হয়ে গেলো। উপস্থিত দূর্ঘটনায় সকলেই হতভম্ব।

কিছু ঘন্টা পর।
ডাক্তার জানালো,
” গ্রীষ্ম আউট ওফ ডেঞ্জার। ”
অনিতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। মার্জান কাচের আড়ালে গ্রীষ্মকে এক পলক দেখলো। তখনি তুলতুল ওঁর হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে অনিতার পাশে বসলো। তুলতুল অনিতাকে সান্তনা দিতে বলল,
” আন্টি মা চিন্তা করো না গ্রীষ্ম ঠিক হয়ে যাবে।”
অনিতা তাঁর পরেও মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠে বলল,
” এক ছেলেকে হারিয়েছি আরেক ছেলেকে হারাতে চাই না আমি।”
” কিছু হবে না আন্টি মা দেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তুলতুল। মার্জানের মনে হলো এখানে বুঝি ওঁ তৃতীয় ব্যক্তি। তার চলে যাওয়া উচিত। তাই চলে যেতে লাগলো। হাসপিটালের মেইন দরজার কাছে আসতেই তুলতুল পিছন থেকে ওঁকে ডেকে উঠে বলল,

” মিস মার্জান , ক্যান আই টক্ টু ইউ এবাউট সামথিং?”

মার্জান হ্যাঁ না কিছুই বলল না। তুলতুল ওঁর কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো,

” তোমার কি মনে হয় না? উই আর কানেক্টেড ইচ আদার?”

মার্জানের এই মুহুর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। তুলতুলের কথাও না। দুনিতে এমন ৭ জান আছে একজনের মতো। তাহলে সেখানে তাঁদের মিলিয়ে যাওয়া কি বড় কোনো কথা?? তুলতুলের মতো দেখতে অনেকটাই তাই তো গ্রীষ্ম ওঁকে পছন্দ করেছিলো। কিন্তু যখন আসল ব্যক্তিই চলে এসেছে তাহলে ডুপ্লিকেটের কি কাজ? তাই পোলাইটলি মার্জান বলে উঠলো,

” সরি টু সে.. আমার মনে হয় না। বিষয়টি কাকতালীয় ছাড়া কিছুই নয়।”

মার্জান পা বাড়ালো সামনে। তুলতুল মার্জানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওঁর এখনো মনে হচ্ছে এঁকে অপরের সাথে দু’জন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। এঁকে বাড়ে নিবিড় ভাবে।তুলতুল কাউকে ফোন করলো,

” মা আমি তুলতুল। সত্যি করে বলো তো তোমার কি অন্য কোনো মেয়ে আছে নাকি? সেইম আমার মতো দেখতে? বা আমার কোনো জমজ বোন? মেলায় হারিয়ে যাওয়া মেয়ে?”

তুলতুলের কন্ঠে হকচকিয়ে উঠলো রাইসা। বুকের ভেতর কামড় দিলো যেন। সত্যি কি সে বেঁচে আছে?

————–

মার্জান হসপিটাল থেকে ফিরেই মৃণালকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসলো নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে। বিছানায় মৃণালকে শুয়ে দিয়ে শীপ্রাকে কল করলো,

” শীপ্রা আমাদের টিকেট কবে ফাইনাল করেছিস?”

“পরশু রাত ৮ টায় আমাদের ফ্লাইট। ”

মার্জান ফোন কেঁটে দিলো। চোখের জল ছেঁড়ে দিয়ে ভাবলো গ্রীষ্মের দাদিজানের কয়েকদিন আগের বলা কথা গুলো।

কিছুদিন আগে হুট করেই উপস্থিত হোন দাদিজান। মার্জানকে দেখেই গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

” আমি তোমার সম্পর্কে খোঁজ লাগিয়েছিলাম। তুমি তোমার বাবার নাজায়েজ মেয়ে। তুমিই বলো তো তুমি কি ডিজার্ভ করো গ্রীষ্মকে?”

মার্জানের মনের কোনের লুকিয়ে থাকা আঘাতে আবার যেন কুড়াল মারলো কেউ। মার্জানকে আরো ভেঙে ফেলতে বলে উঠে,

“যেখানে তোমাকে তোমার বাবার বাড়ির লোকজন নাম দেয় নি সেখানে আমার থেকে কি একসেপ্ট করবো?? নিহাত তুমি মৃণালের মা কিন্তু ও আমার গ্রীষ্মের অংশ। আমি আমার নাতীকে ঠিক নিয়েই যাবো সময় মতো…।আইনি ভাবে।”

মার্জানের বুকের মাঝে কথাটি বিঁধে গেলো। ওঁ মৃণাল ছাড়া কিভাবে বাঁচবে?

কথা গুলো মনে হতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মৃণাল ছাড়া ওঁর আছেই বা কে?

—————–

কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। নির্জন নিস্তব্ধ। গ্রীষ্ম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মার্জানকে দেখলো। মার্জান কাঁদছে, গ্রীষ্ম হন্তদন্ত হয়ে গেলো ওঁর কাছে। মার্জানের গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

“জান.. কাঁদছো কেন??”
গ্রীষ্মের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। মার্জান হাত সরিয়ে দিলে গ্রীষ্মের। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো ওঁ। চোখের জল মুছে বলে উঠলো,

” আমি চলে যাচ্ছি। আমি আর মৃণাল চলে যাচ্ছি। সুখে থাকো তুমি। বায়।”

বলে চলে যেতে লাগলো মার্জান। গ্রীষ্ম-ও ছুটলো ওঁর পিছনে,
” মার্জান যেও না… কথা শোনো.. প্লিজ মার্জানননননননন।”

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো গ্রীষ্ম। সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। পাশেই থাকা গ্রীস্মের এসিস্ট্যান্ট পার্থ বলে উঠলো,

” স্যার আপনি ঠিক আছেন?”

গ্রীষ্ম জবাব দিলো না। উল্টো বলে উঠলো,

” মার্জান? মার্জান কোথায়?”

পার্থ মাথা নত করে বলে উঠলো,
” স্যার মেম আর আসে নি।”

গ্রীষ্ম হতাশার শ্বাস ছাড়লো। এত কি রাগ মার্জানে, গ্রীষ্মকে একবার দেখতে এলো না? গ্রীষ্ম হেলে বসলো বিছানায়। পার্থকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, ফোন লাগাও ওকে। আমি যা যা বলছি তা বলো। পার্থ আমতা আমতা করে ফোন লাগালো,

” মেম, স্যার… ”

বলেই ফোন কেঁটে দিলো পার্থ। গ্রীষ্ম হাসলো। এতটুকুতে কাজ হবে। হলোও তাই। পার্থে হঠাৎ ফোন কলে এমন কথা শোনার পর এক মুহূর্ত ব্যয় না করে ছুটে এলো ওঁ। গ্রীষ্মের কথা পার্থকে জিজ্ঞেস করতেই পার্থ বলে উঠলো,

” আজ সকালেই স্যারের জ্ঞান ফিরেছে। স্যার কাউকে চিনছে না। ডাক্তার বললো, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে। ”

মার্জানের বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। গ্রীষ্মের কেবিনে ঢুকতেই, গ্রীষ্মকে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। মার্জানের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

” আপনি আবার কে? ”

মার্জানের সন্দেহ সন্দেহ লাগছিলো। আচ্ছা গ্রীষ্ম নাটক করছে না তো? মার্জান গ্রীষ্মের কাছে এসে বলে উঠলো,

” এখন কেমন আছেন আপনি?”

প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করলো গ্রীষ্ম,
” আমি কি আপনাকে চিনি? মনে হচ্ছে আপনি আমার বড্ড কাছের?”

মার্জান কি বলবে বুঝতে পারছে না। যার স্মৃতি নেই ওঁর সাথেই বা কি কথা বলবে মার্জান? অনেকক্ষন এভাবে কেঁটে যেতেই।মার্জানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো গ্রীষ্ম,
” আপনি কি আমাকে খাইয়ে দিবেন?”

মার্জান দেখলো সামনে খাবার রাখা আছে। মার্জান সাত, পাঁচ ভেবে খাইয়ে দিলো। অসুস্থ মানুষের জন্য এইটুকু তো করাই যেতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই মার্জান চমকে উঠলো, গ্রীষ্ম মার্জানের ওড়না টেনে নিজের মুখ মুছে ফেললো। মার্জানের ভ্রু জোড়া সংকুচিত হয়। গ্রীষ্ম এমনটি প্রায়ই করতো। এমন করার কারণ কখনো খুঁজে পেতো না মার্জান। কিন্তু আজও কি সে ইচ্ছে করেছে? এর মানে কি, গ্রীষ্মের স্মৃতি যায় নি?

মার্জান বলে উঠলো, আপনি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি। গ্রীষ্ম মাথা হ্যা বোধক কাত করলো। মার্জান বের হতেই পার্থ ঢুকে বলে উঠলো,

” স্যার আপনি যেভাবে অ্যাক্টিং করলেন না? আমি নিজেই সত্যি ভেবেছি। ”

গ্রীষ্ম বিজয়ের হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
” তোমার মেম এর রাগ ভাঙ্গানো বায় হাতে কাজ।”
” ওঁ। তাই।”

মার্জান কিড়মিড় করে চাইলো। নিজের ব্যাগ হাতে তুলে বলে উঠলো,

“আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। সত্যি ড্রামা বাজ আপনি।খবরদার যদি আমার পিছনে আসেন তো?”

বলেই ধপাধপ পায়ে বেড়িয়ে গেলো। গ্রীষ্ম নিজেও বেডের পিছন পিছন দৌড়াল। কিন্তু ততক্ষণে মার্জান গাড়িতে উঠে গেছে। মার্জানের পিছন পিছন ওঁর ফ্ল্যাটের সামনে এসে পড়লো গ্রীষ্ম।কিন্তু এখানে এসেই ওঁর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। মার্জান গাড়ি থেকে নামতেই একটি গাড়ি এসে ওঁর সামনে থামে। এবং খুব সুদর্শন একজন ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে এসে মার্জানের সামনে দাঁড়ায় । মার্জান ব্যক্তটিকে চিন্তে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

” হু আর ইউ?”

ব্যক্তিটি মার্জানের খুব কাছে এসে পড়ে দেখে মার্জান পিছিয়ে পড়ে। এক পর্যায় দেয়ালের সাথে লেগে যায়। ব্যক্তিটি মিষ্টি করে হেসে বলে উঠে,

” তোমার পার্টনার।”

মার্জান ভ্রু কুচকে ফেলে,
” যাতা কি বলে যাচ্ছেন। আর আপনি দূরে গিয়ে দাঁড়ান তো। ”

ব্যক্তিটি হাসলো। গ্রীষ্মের গাড়িটিকে পিছনে আসতে দেখে বাঁকা হাসলো। উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

” পাগল গ্রীষ্মের চেয়ে মৃণ্ময় বেস্ট ওপশেন।”

বলেই মার্জানের ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে নিজের আঙ্গুলে কিস করলো মৃন্ময়। মার্জার এমন কাজে পাথর হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখেই গ্রীষ্ম তেড়ে এলো কিন্তু ওঁর আগেই ব্যক্তিটি গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। গ্রীষ্মে রেগে মেগে মার্জানের কাছে এলো। ওঁর হাতে শক্ত করে ধরে চেচিয়ে উঠলো,

” নতুন নাগর পেয়েছো বলেই আমাকে ইগনোর করছো? ভুলে যেওনা গ্রীষ্ম তোমাকে অন্য কারো হতে দিবে না…। ”

গ্রীষ্মের কথায় মার্জান ক্ষেপে গেলো। এত দিনের রাগ দুঃখ সব বেড়িয়ে এলো। কসিয়ে চর বসিয়ে দিলো গ্রীষ্মের গালে। চিৎকার করে বলে উঠলো,

” নিজেকে কি ভাবেন আপনি? হ্যাঁ। সবাই কি আপনার মতো নাকি? আজ এঁর সাথে কাল ওঁর সাথে। বিয়ে একজনকে, ভালোবাসা আরেকজনকে? নিজের চরিত্র ঠিক করুন। পরে অন্যকে গালি দিন।”

বলেই মার্জান দৌঁড়ে চলে গেলো নিজে ফ্ল্যাটে। এদিকে পাথর হয় গেলো গ্রীষ্ম। বিগত কিছু দিন কি হয়েছে মনেই গ্রীষ্মের। সে কি আবারো হার্ট করেছে মার্জানকে?

গ্রীষ্মের মাথার চোট তখনো ঠিক হয় নি। মার্জানের থাপ্পড়ের সময় হাতটা ওঁর মাথায় লাগে। যার ফলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করেছে কঁপাল বেয়ে। দেখতে ভয়ংকর লাগছে। ওঁ নিজের দিকে খেয়াল করলো না। বাড়ি গিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। এর পর তিন নাম্বার ড্রয়ার থেকে সিক্রেট ডাইরি বের করলো। গ্রীষ্ম যখন আষাঢ় হতো তখন সব লিখে রাখতো ডায়েরিতে। আবার যখন নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে আসতো তার উত্তর দিতো। আজ তার ব্যতিক্রম নয়। তুলতুলকে পাওয়ার ঘটনা এবং এর পরের ঘটনা গুলো পড়ে চোখের কোনে ওঁর জল চলে এলো। সে লিখলো,

” ভাই তুমি বরাবর আমার জানকে কেন কষ্ট দাও। ওঁর এখানে দোষ কোথায়?”

গ্রীষ্ম লিখে বিগত পেইজ গুলো উল্টোতে লাগলো। মার্জানকে একবার সে মারতে চেষ্টা করেছিলো পানিতে ফেলে। দ্বিতীয় বার ওঁকে আয়ল্যান্ডে রেখে চলে এসেছিলো।কিন্তু গ্রীষ্ম যখন ঠিক হয় ওঁ গেছিলো মার্জানের কাছে। কিন্তু এঁর আগেই মার্জান চরে গেছিলো। তৃতীয় বার তুলতুলকে পেয়ে মার্জানকে ভুলে গেলো। গ্রীষ্ম তো মার্জানকে পাবার জন্যই নিজের ট্রিটমেন্ট শুরু করেছিলো কিন্তু…..।গ্রীষ্ম নিজের চুল টেনে ধরলো। ঠিক তখনি ওঁর কষ্ট বাড়িয়ে দিতে পার্থের মেসেজ এলো,

” স্যার মার্জান মেম মৃণাল স্যারকে নিয়ে আজ রাতেই দেশ ছাড়ছে।”

গ্রীষ্ম রাগে হাত মুঠ করলো শক্ত করে। কিন্তু ওঁর মুখ ভাবলেশহীন । কি করবে গ্রীষ্ম এবার? আটকাবে মার্জানকে নাকি যেতে দিবে ওঁর পথে??

চলবে,