ডাকপাড়ি পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
327

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৩
#আফনান_লারা
________
শাহেদ কি কারণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা বোঝেনি পূর্ণতা।আড় চোখে তাকিয়েছিল একবার
তারপর নিজেই একটু সরে দাঁড়ায়।ওমা! শাহেদ আরেকটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো এবার।পূর্ণতা বুঝে উঠতে পারছেনা কি করবে।শেষে হাসি মাখা মুখে বললো,’আপনার কিছু লাগবে?’

শাহেদ এতটা লজ্জা পাচ্ছিল পূর্ণতার কথায় যে কিছুই বলতে পারছিল না সে।পূর্ণতা একটা বাহানা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেছে।শাহেদ সেটা দেখে নিজের মাথায় নিজে একটা বাড়ি বসিয়ে দিলো।লজ্জার কারণে চান্স মিস হলো তার।
ফারাজকে শায়লা মনমত প্রশ্ন করছে।বলতে গেলে একবারে পাগল করে ছাড়ছে।ফারাজ কথা বলতে বলতে ওর মুখটাই ব্যাথা হয়ে গেছে এখন।
শাহেদ আবারও আগের জায়গায় বসে পূর্ণতার আসার অপেক্ষা করছিল সেসময় কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেলো।মতিন পেঁয়াজ কাটা বাদ দিয়ে ছুটে গেছে দরজা খুলতে।দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে একজন সুশ্রী তরুণী।পরনে হলুদ থ্রি পিস,
চুলগুলোকে ছেড়ে দেয়া।সব দিক দিয়ে ঠিকঠাকই লাগলো।মতিন সালাম দিয়ে জানতে চাইলো কাকে চাই।মেয়েটি হাসি মুখে বললো,’আমার ভাইয়া আর আপু এই বাড়িতে এসেছে।আমার আসতে দেরি হয়ে গেলো একটু।’

মতিন জিভে কামড় দিয়ে বলে,’ওহ তাহলে আপনে ফারাজ ভাইয়ের হবু বউ?’

এটা বলে মতিন ওকে ভেতর ঢোকার জন্য জায়গা করে দিলো।
মেয়েটি ভেতরে গিয়ে জনসমক্ষে সালাম দিতেই সবাই এক সাথে তার দিকে তাকায়।
ফারাজ ও তাকিয়েছিল।শাহেদ হেসে বললো,’ঐ তো আমার বোন মিফতু এসে গেছে।’

ফারাজ একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলেছিল।মেয়েটি শাহেদের পাশে গিয়ে বসেছে।শাহেদ ফারাজকে বললো তার দাদাজানকে ডাকতে এবার।
মিসেস সোনালী রান্নাঘর থেকে মিফতুকে দেখছিলেন।
তার কাছেও ভালই লাগলো মেয়েটিকে।পূর্ণতাকে ডেকে ওকেও দেখালেন।পূর্ণতা খুশি হলো।অবশেষে তাকে আর ফারাজকে বিয়ে করতে হবেনা।বাঁচা গেলো।ফারাজ তার দাদাজানকে ডাকতে উঠে চলে গেছে।
মানিক সাহেব তার রুম থেকে বেরিয়েছেন হইচই শুনার পর।নিচে এসে সোনালীর কাছে জানতে পারলেন ফারাজকে দেখতে একটা মেয়ের পরিবার এসেছে।তিনি বেশ আগ্রহ দেখিয়ে ওনাদের সাথে কথা বলতে সামনে এগোলেন।পূর্ণতা উঁকি দিয়ে দেখছিল মিফতুকে।এদিকে শাহেদ ঠিক সেময় মুগ্ধ চোখে পূর্ণতাকে দেখে যাচ্ছিল।
ফারাজ দাদাজানকে ডেকে নিজে আর আসতে চাইলোনা কিন্তু দাদাজান তো ওকে নিয়ে আসা ছাড়া আসবেনই না।জোর করে ধরে নিয়ে এসেছেন। মিফতু ফারাজের দিকে তাকিয়ে বারবার হাসছিল।ফারাজের কাছে বিষয়টা কেমন যেন লাগছে।শাহেদ বলে উঠলো ফারাজ আর মিফতুকে একান্তে কথা বলতে দেয়া উচিত।

সবাই মেনে গেলো এক কথায়।তাদের দুজনকে বাগানে পাঠানো হলো তখন।ফারাজ যতই দূরে সরে আসার চেষ্টা করছে ততই মিফতু মেয়েটা কাছে আসার চেষ্টা করে।
মনে হয় যেন গায়ে পড়া স্বভাবের।কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যায়নি শুরুতে।
শেষে ফারাজ চেয়ার টেনে বসেই গেলো।কারণ যতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল ততক্ষণ মিফতু মেয়েটা ওর কাছে ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিল।
——
‘আচ্ছা আপনার গার্লফেন্ড কয়টা ছিল?’

‘১’

‘রিয়েলি?বিশ্বাস করলাম না।’

‘কেন বিশ্বাস করলেন না?’

‘কারণ আপনাকে দেখে অতিরিক্ত সাধাসিধা মনে হয়।আর এমন সাধাসিধা গুলাই বেশিরভাগ মিচকা শয়তান হয়।ভেতরে ভেতরে একশোটা প্রেম করে।তাই আমার ধারণা আপনারও সেম’

‘আপনার ধারণা ভুল,আমি প্রেম করলে একটাই করেছিলাম।এর আগে পরে আর নেই’

‘স্বীকার না করলে কি করার আছে?আচ্ছা,আমার কাছে জানতে চাইবেন না?’

‘নাহ।অতীতে কি ছিল না ছিল তা নিয়ে ঘাটাঘাটি করার ইচ্ছে আমার নেইই’

‘গুড।তবে যেহেতু আমাদের বিয়ে হবার চান্স আছে, আপনার তো জানা উচিত ‘

‘বললাম তো অতীত নিয়ে জানতে চাইনা।’

মিফতুু এবার চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,’বিয়ের জন্য সাদামাটা ছেলেরাই বেস্ট।বেশি চাল্লু গুলা ভাল না’

‘এই যে বললেন সাদাসিধা গুলা প্রেম করে বেশি?’

‘প্রেম করে তবে সবসময় সিরিয়াসলি করে।মানে যখন যে প্রেম করে তখন সেটা সিরিয়াসলি নেয়’

‘আপনার কথা তো দু রকম হয়ে গেলো।’

‘এখনই দোষ খুঁজছেন?’
———
পূর্ণতা উঁকি দিয়ে দেখছিল ফারাজ আর মিফতুকে।ওমনি পেছন থেকে শাহেদের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে পেছনে ফিরে তাকালো সে।শাহেদ বললো,’আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল’

‘জ্বী বলুন’

‘আসলে আমার বোনের বিয়ের আগে আমি চাচ্ছি আমার বিয়েটা হয়ে যাক।’

‘তো করুন না।সমস্যা কোথায়?’

‘আসলে আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করেছি কিন্তু সে আমায় মেনে নেবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবনায় পড়ে আছি’

‘তাকে বলুন আপনার অনুভূতির কথা।’

‘বলেছি,সে উল্টা বুঝেছে ‘

‘কি বুঝেছে?’

‘আমি আসলে আপনাকে পছন্দ করে ফেলেছি।’

পূর্ণতা চোখ বড় করে শাহেদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।শাহেদ আবার বললো,’আমার বরাবরই ইচ্ছে ছিল ম্যাচিউর একটা মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবো।যদিও খুঁজিনি তবে মনে হয় পেয়ে গেছি’

‘ততততততত’

‘ততততত কি?’

‘তো কি বলতে চাইছেন?’

‘বিয়ে।’

‘অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠলে আশেপাশের যত মানুষ আছে সবাই বিয়ে নামক শব্দ ছাড়া আর কিছু নিয়ে আলোচনা করতে পারেনা?আমি ইদানিং বিয়ে শব্দটা এত এত শুনছি যে ঘুমের ঘোরেও বিয়ে বিয়ে বলছি।আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।’

‘দেখুন পূর্ণতা,এই সময়টা মোক্ষম সময় বিয়ে করার।আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার পড়াশুনার ক্ষতি হবে,তা কিন্তু না।আমি আপনাকে পড়ালেখায় পুরো সার্পোট দিবো।’

‘সেটা নয় আমি তৈরি না আসলে’

‘তবে কথা হয়ে থাকুক, যেদিন তৈরি হবেন সেদিন বিয়ে হবে’

‘দেখুন শাহেদ ভাই,আমি বাবার সাথে দেশ ছেড়ে চলে যাবো।এখন এসব নিয়ে ভাবছিনা একেবারে’

শাহেদ মন খারাপ করে থাকলো।আর কিছুই বললোনা।

পূর্ণতা পালিয়ে চলে গেছে বাবার কাছে।এখানে আর থাকা যাবেনা।দেখা গেলো দাদাজানের কানে কথা গেলে উনি একই স্টেজে দুই জোড়ার বিয়ে পরিয়ে ছাড়বেন।
———-
মিফতু ফারাজকে পেরেশান হতে দেখে আবার বললো,’আপনি কি চিন্তা করছেন?আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি বুঝি?’

‘নাহ সেটা নয়।’

‘চিন্তা তো আমাদের মেয়েদের করা উচিত।আপনি ছেলে হয়ে এত চিন্তা করছেন?কি ভাবছেন এত?

‘ভাবছি কি করে আপনার পরিবারকে মানা করবো’

এটা বলে ফারাজ উঠে চলে গেলো।মিফতু তাজ্জব হয়ে বসে আছে।তার পরিবারকে মানা করার কোনো কারণ সে দেখছেনা।তাহলে ফারাজ কেন মানা করবে?
————
সারথিকে আনাফের খালা দেখছেন ভাল করে।সারথি তখনও জানেনা তাকে কয়েকজন মানুষ গভীর ভাবে দেখে যাচ্ছে।খালা মামিকে ফিসফিস করে বললেন,’মেয়েটাকে আনাফ এনেছে?’

মামি বললেন,’হুম তাই তো মনে হয়।আনাফের গার্লফ্রেন্ড নাকি?’

‘হয়ত তাই।নাহলে এর আগে তো এমন ঘটনা দেখিনি’

ফিসফিস আওয়াজ সারথির কানে আসলো তাও সে চুপ করে থাকলো।ভেতরের রুম থেকে আনাফকে নিয়ে নানু বের হতেই সোফায় সারথিকে দেখে জানতে চাইলেন ও কে।
আনাফ সোজা কথায় বললো সে এই মেয়েটিকে কয়েকদিন পর বিয়ে করবে।এই শুনে বাড়ির সবাই সারথিকে ঘিরে বসে পড়েছে।
মামি আনাফের দিকে চেয়ে ধীরে বলেন,’কি ব্যাপার?মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে কেন?আমাদের দিকে তাকায় না কেন?লজ্জা পাচ্ছে নাকি?’

‘আসলে মামি ও অন্ধ’

এটা শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেছে।নানু অমনি আনাফের হাত ধরে সোজা বাড়ির বাইরে নিয়ে আসলেন।শক্ত গলায় জানতে চাইলেন আনাফ কি সত্যি এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়,
তার কি মাথা আছে নাকি গেছে।তিনি এর আগে এই গ্রামের বিশটা মেয়েকে রিজেক্ট করেছেন আনাফের উপযুক্ত না বলে, শেষে আনাফ কিনা এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করে নিয়ে আসলো সবাইকে দেখাতে।

আনাফ স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো সে যা বলেছে তার সবটাই সত্যি।
নানু মুখ গোমড়া করে চলে গেছেন।আনাফ তার পিছু পিছু আসলো, খালা সারথির চোখের সামনে হাত নাড়াচাড়া করে টেস্ট করছিলেন আসলেই সে চোখে দেখে নাকি দেখেনা।
আনাফ তখন বললো,’সারথি আমার সংসার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে আর তাই ওকে আমি জীবনসঙ্গী বানাতে যাচ্ছি,এটা ফাইনাল’

খালা আনাফের কাছে এসে বললেন,’আপা জানে তুই যে চোখে দেখতে পারেনা এমন একটা মেয়েকে বউ করবি?’

‘জানেনা,তবে জানবে’

‘জলদি জানা।আপা রাজি থাকলে আমরা কেউ তোকে কিছু বলবোনা।তোর জীবন তোর ডিসিশান’

‘একদম ঠিক।মাকেও এটা মানতে হবে।আমার জীবন,আমার ডিসিশান আমি কাকে বিয়ে করবো নাকি করবোনা’
————-
শাহেদ ভাবলো পূর্ণতা মেয়ে মানুষ হয়ত লজ্জায় বারবার কথাটাকে এড়িয়ে চলছে, সে বরং এ বিষয়ে ওর বাবার সাথেই সরাসরি কথা বলবে।তাই কৌতূহল বশত সে দাদাজানের কাছে পূর্ণতার বাবার কথা জানতে চাইলো।তিনি সোজা দেখিয়ে দিলেন উপরের তলায় রেডিওতে গান শুনছে এখন।শাহেদ বললো সে কথা বলতে চায়।এই বলে সে উপরের দিকে চলে গেলো।ঐদিকে ফারাজ ছুটে এসে দাদাজানের সামনা সামনি বসে বললো,’আমার জরুরি কথা আছে দাদাজান’

‘জানি কি বলতে চাও’

‘জানেন?’

‘তুমি যে পূর্ণতাকে পছন্দ করে ফেলেছো তাই এখন কাউকেই তোমার পছন্দ হবেনা,এবং আমি এটাও জানি তুমি মিফতুকে বিয়ে করবেনা এটা বলতে এখন ছুটে এসেছো’

‘নাহ কথা সেটা না।মিফতুকে মানা করে দেয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে আমার কাছে। ‘

‘কারণ তো দেখাবেই।ঐ যে বললাম একজনকে চোখে ধরলে সামনে বিরাট সুন্দরী বসে থাকলেও বলবে এ তো সুন্দর না’

‘দাদাজান ভুল ভাবছেন, আমি আসলে পূর্ণতাকে পছন্দ করিনা’

‘তাহলে এত ভাল পরিবারের এত সুন্দর একটা মেয়েকে মানা করার পেছনে কি কারণ আছে তোমার কাছে?’

‘আমি ওর সাথে কথা বলেছি এগারো মিনিট।এই এগারো মিনিট আমার দম বন্ধ ছিল।অস্বস্তিতে ছিলাম।’

‘এই আর এমন কি?বিয়ের পর দম ছুটে যাবে😂’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৪
#আফনান_লারা
________
“বিয়ে সেই পবিত্র বন্ধন যেখানে দুজন সঙ্গী শান্তি খুঁজে পায়।একজন আরেকজনের পরিপূরক ও হতে পারে।তাই আমরা তাকেই বিয়ে করি যার দ্বারা শান্তি পাবো,যাকে নিয়ে জীবনটাকে স্বাচ্ছন্দ্যে পার করা যাবে।সেখানে মিফতুর সাথে কথা বলে আমার মনে হলোনা সে আমার সেই জীবনসঙ্গী।আমায় মাফ করবেন দাদাজান,ওকে আমি বিয়ে করতে পারবোনা।’

‘হয় তুমি মিফতুকে বিয়ে করবে নাহয় পূর্ণতাকে।আমি এর বেশি কিছু শুনতে চাইনা’

এই কথা বলে দাদাজান উঠে চলে গেছেন।ফারাজ মন খারাপ করে পাশ ফিরে বসতেই দেখলো মিফতু এসে হাজির।হাসিমুখে সে ফারাজের পাশে ধপ করে বসে পড়ে বললো,’কি হলো?সবাইকে বলে দিছেন যে আমায় বিয়ে করবেন না?’

ফারাজ চুপ করে মিফতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ণতা সেসময় মাথার বেনি ঝুলিয়ে হাতে কমলার বাটি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।ফারাজ মিফতুর থেকে চোখ সরিয়ে পূর্ণতার দিকে চেয়ে থেকে বলে,’ধরুন একটা মানুষকে আপনি অনেকদিন ধরে চিনেন।মোটামুটি তার স্বভাব,ব্যবহার আপনার জানা হয়ে গেছে।আর আরেকটা মানুষকে আপনি চিনেনই না।এবার আপনি ঐ মূহুর্তে বিয়ে করতে হলে কাকে বিয়ে করবেন?’

মিফতু গালে হাত দিয়ে অনেক ভেবে বললো,’যাকে চিনি তাকেই বিয়ে করবো।কারণ অচেনা মানুষকে যদি বিয়ে করে এরপর দেখি তার আচরণ মিল খাচ্ছেনা তখন তো ভুলটা আমারই হবে।তাই যাকে চিনি তাকেই বিয়ে করবো’

ফারাজ উঠে চলে গেলো তখনই।
পূর্ণতা রান্নাঘরে থেকে মাথা বের করে মিফতুকে দেখছে।মনে হয় বেশি লম্বা না।পায়ে উঁচু জুতা পরেছে।তবে গায়ের রঙ ফর্সা একদম।দারুণ মানাবে ফারাজের সাথে।কমলার কোয়া মুখে পুরে এসবউ ভাবছিল সে ওমনি মিফতু ওকে দেখে ফেলে।সোফা থেকে উঠে পূর্ণতার কাছে এসে সে নিজেই এবার পূর্ণতাকে দেখছে।অনেকক্ষণ দেখাদেখি করে বললো,’তুমি কে হও এই বাড়ির?’

‘দূর সম্পর্কের আত্নীয়’

‘ওহ!ফারাজের সাথে কথা হয় তোমার?’

‘হুুম।অল্প’

‘কেমন উনি?আসলেই এমন সাদাসিধা নাকি নাটক করছে?’

‘নাটক করবেন কেন?উনি এমনই’

‘আমি ওনাকে বিয়ের পর টাইট দিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারবো।এটা কোনো বড় ব্যাপার না।’

পূর্ণতা অবাক হয়ে মিফতুর কথাটা শুনলো।দেখে একেবারে পাকা মনে হয় মেয়েটাকে।যাই হোক,ভালই হলো।উনি যে রকম মানুষ, ওনার আসলেই এমন টাইট দেয়া মেয়ে দরকার।বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুলই ঠিক আছে’

পূর্ণতা মুচকি হেসে মিফতুর দিকে চেয়ে থাকলো।শায়লা মিসেস সোনালীর সাথে কথা বলছিল এতক্ষণ।কথা শেষে মিফতুকে এখানে দেখে হাত ধরে এক কোণায় নিয়ে আসলেন।ফিসফিস করে জানালেন পূর্ণতাকে শাহেদ পছন্দ করে।

এই শুনে মিফতু অবাক হয়ে পূর্ণতাকে আবারও চেয়ে দেখলো এরপর বললো,’তা কি করে হয়?আম্মু তো রাজি হবেনা,মেয়ে আমার মতন বেশি সুন্দর না তো’

‘সেটাই তো তোর ভাইরে বুঝাইলাম,বুঝেইনা।কি জাদু করছে এই মেয়ে কে জানে!’

‘আচ্ছা বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও।আমি দেখছি।’
——-
শাহেদ অরিন্দমের রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়।সাহসে কুলিয়ে পারছেনা।এ প্রথম কোনো মেয়ের বাবার কাছে সে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
দরজার কড়া নেড়ে সে সালাম দেয় অরিন্দমকে।অরিন্দম মাথা তুলে তাকিয়েই আছে।শাহেদ হালকা কেশে অনুমতি চাইলো ভেতর আসার।অরিন্দম দিলো অনুমতি।
শাহেদ এবার ওনার কাছাকাছি এসে চেয়ারে বসে পড়েছে।

‘কে বাবা তুমি?’

‘আমি শাহেদ।শাহেদ হোসেন।আমার বোনোর জন্য ফারাজকে আজকে দেখতে এসেছিলাম পরিবার নিয়ে’

‘ওহ হো তাই?বেশ বেশ।খুব ভাল।ফারাজ খুব ভাল একটা ছেলে’

‘হুম।’

‘তা আমায় কিছু বলবে নাকি?’

শাহেদ এবার আমতা আমতা করছে।কি থেকে কি বলবে তার শুরুটা কেমন হবে অনেক ভেবে সাহস নিয়ে বলেই ফেললো,’আমি পূর্ণতাকে বিয়ে করতে চাই’

এ কথা শুনে অরিন্দম চোখ বড় করে ফেললেন।এরপর স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলেন শাহেদ কিসে চাকরি করে।কতদূর পড়ালেখা করেছে।
শাহেদ তখন সানন্দ্যে বলা শুরু করে দিলো নিজের ব্যাপারে সবটা।
যে সে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে।মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।সব খুঁটিনাটি যা যা বলার সব বললো সে।

সব শুনে অরিন্দমের বেশ ভাল মনে হলো।শাহেদ দেখতে শুনতেও ভাল।অতোটাও খারাপ না।এখন সব চাইতে বড় ভাববার বিষয় হলো পূর্ণতা কি রাজি হবে?সে তো সবসময় বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দেয়।শাহেদের বেলায় ও মানা করবেনা তার কি গ্যারান্টি?
শাহেদ উত্তরের অপেক্ষায় ছিল বলে অরিন্দম বললো,’আচ্ছা আমি পূর্ণতার সাথে কথা বলে তোমায় জানাবো’

‘ঠিক আছে আঙ্কেল।’

এই কথা বলে শাহেদ উঠে চলে আসলো বাইরে।
শায়লা অপেক্ষা করছিল শাহেদ আসার।
ও আসতেই চেপে ধরলেন ।জানতে চাইলেন শাহেদ পূর্ণতার বাবার সাথে গোপনে কি এমন কথা বললো এতক্ষণ ধরে।

‘আমি বিয়ে নিয়ে কথা বললাম’

‘তোকে না বললাম এই মেয়েটাকে মা পছন্দ করবে না’

‘করবে।অবশ্যই করবে।মানিয়ে নিতে হবে’

শায়লা নিজের কপালে নিজে চড় দিতে দিতে মিফতুকে গিয়ে ধরলো শাহেদকে বোঝানোর জন্য।
কিন্তু শাহেদ মিফতুর কোনো কথাই শুনলোনা।
তার কথা হলো সে বলেছে পূর্ণতাকে বিয়ে করবে তার মানে ওকেই করবে।কারো কোনো কথা সে শুনবেইনা।
——–
পূর্ণতাকে এর আগে মিফতু শ’খানেক প্রশ্ন করে চলে গেছিলো।আগে কোথায় থাকতো?প্রেম-টেম ছিল কিনা সব খবর সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে তারপর গেছে।
পূর্ণতার কাছে মিফতুর এই স্বভাব একটুও ভাল লাগেনি।কেন যেন একবারের জন্য মনে হলো সে ফারাজের যোগ্য না।
ফারাজকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা।কথা দিয়ে আঘাত করতে জানে।
————-
ফারাজ তার মাকে খুঁজছে।একমাত্র মা পারবে দাদাজানকে রিকুয়েস্ট করে বিয়েটা আটকাতে। অনেক খোঁজার পর ছাদে সে মাকে পেয়ে গেলো।মা ছাদ থেকে শুটকির ডালা নিয়ে ফিরছিলেন। ফারাজকে দেখে হাসি মুখে বললেন,’বউ হলো নিচের তলায়, উপরের তলায় কি করিস শুনি?’

‘মা আমার একটা কথা আছে ‘

‘কি কথা?’

‘একটু দাঁড়াও না’

ফারাজ মায়ের হাত ধরে আটকে রাখলো।হাতের ডালাটা রেখে মাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,’মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়নি’

‘কেন কেন??এত সুন্দর একটা মেয়ে,কি ভাল পরিবার।কি সমস্যা? আচ্ছা সত্যি করে বল দেখি,তুই কি পূর্ণাকে পছন্দ করে ফেলেছিস?’

‘সবাই এক কথা কেন বলছে!ওকে কেন পছন্দ করবো?আমার কাছে মিফতুকে ভাল লাগেনি তাই বিয়ে করছিনা এর মাঝে পূর্ণতা কেন আসছে?’

‘কারণ মিফতুকে মানা করবার তো কোনো কারণ আমরা কেউ দেখছিনা’

‘সব কারণ চোখে দেখা যায়না।ওর সাথে কথা বলে আমার ভাল লাগেনি আর তাই আমি বিয়েটা করতে চাচ্ছিনা।তুমি দাদাজানকে বোঝাও আমার পক্ষে মিফতুকে কোনো মতেই বিয়ে করা সম্ভব না’
———
চলে যাবার আগে শাহেদ আরও একবার পূর্ণতার কাছে আসলো।পূর্ণতা তখন টেবিলের উপর থেকে নাস্তার প্লেট সরাচ্ছিল।

‘একটা কথা বলি?’

‘জ্বী’

‘ আমি আপনার বাবার সাথে বিয়ে নিয়ে কথা বলেছি।উনি রাজি আছেন যতদূর বুঝলাম।এবং এখন আপনার সাথে কথা বলবেন এ ব্যাপারে।আপনি যদি রাজি থাকেন তবে বলবেন ওনাকে।ধরাবাঁধা নেই। ‘

‘ঠিক আছে’

‘আমি যাই?’

‘যান’

‘জান??জান বললেন আমায়?’

‘হুম যান বলেছি’

‘চলে যাবার যান নাকি আদর করে ডাকা জান?’

এই কথা শুনে পূর্ণতা চোখ বড় করে পেছনে তাকালো শাহেদের দিকে।শাহেদ জিভে কামড় দিয়ে সরি বলতে বলতে চলে যাচ্ছে।

হাসি পেলো ভীষণ।এমন ভদ্র,চুপচাপ লাজুক স্বভাবের মানুষ ও যে মজা করতে জানে তা পূর্ণতার জানা ছিলনা।
“”””আসলে কিছু মানুষ আসলেই অবাক করার মতন হয়।
তাদের বাইরেটা দেখে ভেতরটা বোঝা যায়না।মিফতু মেয়েটা কতই না সুন্দর তাও তার ব্যবহার কেমন যেন!!
আর এই লোকটা!!
ফারাজকে নিয়ে তো কি বলবো আর!একটা মেয়েকে নিজের সবটা দিয়ে ভালবেসেও পেলেননা।এখন তিনি কাউকে বোঝাতে পারছেন না কেন তিনি বিয়ে করতে ইচ্ছুক না”””””
———–
আনাফের কথা শুনে সবাই নিরাশ হয়ে বসে আছেন।তাদের ধারণা সারথিকে কোনো কিছুতেই আনাফের মা পছন্দ করবেন না।সারথির সব ঠিক থাকলেও সে চোখে দেখতে পায়না।এটা অনেক বড় একটা বিষয়।নানুর নিজেরই এই বিষয় নিয়ে মেজাজ গরম হয়ে আছে।আনাফের আম্মু এটা জানলে কি হবে তা ভাবতে গিয়েই দোটানায় পড়ে আছেন তিনি।
আনাফ কিছু সময় থেকে এবার বললো সে চলে যাবে। নানু ওকে বললেন আরও কিছু সময় থাকতে কিন্তু আনাফ রাজি হয়নি।সারথিকে নিয়ে চলে গেলো।গাড়ীতে কিছুদূর যাবার পর সারথি মুখ খুললো।বললো,’আপনি কেন সব কিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন??আমি নিজেও চাইনা এই বিয়েটা হোক।আপনার সাথে আমাকে মানায় না।আপনি আরও ভাল কিছু পাবার যোগ্যতা রাখেন।তার পরেও সমাজকে কটু কথা বলার সুযোগ কেন করে দিচ্ছেন?’

‘লাইফটা তো আমার,সমাজের না।আমি জানি আসলে আমার জন্য কি ভাল হবে,আর কি হবেনা’

‘আপনি আপনার মায়ের কথা শুমবেন না?আমি সবসময় চাইতাম আমার শাশুড়ি আমায় খুব ভালবাসবে।তেমন পেয়েছিলাম ও।
সজীবের আম্মু আমায় অনেক ভালবাসেন’

‘সজীব তো ভালবাসেনা।সবসময় পারফেক্ট কিছুই হয়না।শাশুড়ি ভালবাসলে স্বামী ভালবাসেনা।স্বামী ভালবাসলে,শাশুড়ি ভালবাসেনা।তোমার বেলায় এবার সেটায় হবে।
তবে আমার মনে হয়না মা বেশিদিন তোমায় ভাল না বেসে থাকতে পারবে।তোমায় মা অল্প দিনের মধ্যেই ভালবেসে ফেলবে’

সারথি বিরক্ত হয়ে বললো,’চাপাচাপি তে বিয়ে করতে চাইনা আমি’

‘তবে তাই হোক।আগে মা মেনে যাক।তারপর নাহয় বিয়ে করবো?অপেক্ষা করানোই তো তোমার স্বভাব।বয়স পার হয়ে যাচ্ছে আমার সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। শুধু অপেক্ষা করিয়েই যাচ্ছো’

‘আপনাকে যে আমি বিয়ে করবো তার সিউরিটি কোথায়?’

‘না করলে জোর করে বিয়ে করবো।সিরিয়ালের নায়কদের মতন উঠিয়ে নিয়ে এনে ধরে বিয়ে করে বাসর সেরে ফেলবো।মুহাহাহাহাহাহা’

‘ভয় পেলাম না একটুও’

‘ভয় পাও নাই,তো পাইবা।যখন উঠিয়ে আনবো, তখন ভয় পাইবা।এখন কেন ভয় পাবা?’

সারথি আর কিছু বললোনা।তবে হাসলো অন্যদিকে ফিরে।আনাফ বুদ্ধি করে অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে।যাতে পৌঁছাতে দেরি হয় আরও বেশি।
রাত হয়ে গেছে অনেক।সারথি ঝিমোতে ঝিমোতে ঘুমিয়ে পড়ে শেষে।আনাফের ও ঘুম আসছে।এরই মাঝে ওর কলিগ ফোন করে জানিয়েছে আনাফের কেবিনে রুগী এসে ভরে যাচ্ছে অথচ অানাফ নেই বলে তাকে রুগী দেখতে হচ্ছে।তার জন্য চাপ হয়ে যাচ্ছে এটা।সে যেন জলদি কাজে ফিরে আসে।
——
সম্ভবত নানু মাকে খবর পৌঁছে দিয়েছে যার কারণে বাসায় যাবার আগেই মায়ের ফোন আসা শুরু হয়ে গেলো।
আনাফ পরে অধরার কাছে না গিয়ে আগে মায়ের কাছে যাবে বলেই ঠিক করে।গাড়ী ঘুরিয়ে সে মায়ের কাছে যাচ্ছে এবার।সারথি জানেও না সে তার হবু শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে।

বেশ কিছু সময় পর একটা ধাক্কায় সারথি জেগে যায়।চোখ ডলে বলে,’ আমরা এখনও পৌঁছাইনি?’

‘আমরা মায়ের কাছে যাচ্ছি’

এই কথা শুনে সারথি অবাক হয়ে গেলো।জানতে চাইলো কি কারণে।
আনাফ জানালো সবটা।সারথি ভয়ে শেষ।মা আনাফের সাথে সাথে ওকেও ঝাড়বেন এটা সে নিশ্চিত। সে বলছে তাকে অধরার কাছে নামিয়ে দিয়ে আসতে কিন্তু আনাফ শুনছেনা কিছুতেই।সে গেলে সারথিকে নিয়েই যাবে।
———
কলিংবোলের আওয়াজ পেয়ে মা এসে দরজা খুললেন।আনাফ মুচকি হেসে এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।আনাফ ঝুঁকতেই তার পেছনে সারথিকে দেখলেন তিনি।এরপর গাল ফুলিয়ে আনাফকে ছাড়িয়ে সোফায় এসে বসলেন।

সবাই চুপ করে বসে আছে ওখানে।অনেকক্ষণ পর আনাফের মা বললেন,’তোর কি মাথা গেছে??আমি ঐদিন সজীবকে বাসায় দেখলাম।একটা বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করবি তুই?সজীব জানলে কি হবে ভাবছিস?’

‘ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে মা’

‘অন্য কোনো অন্ধ মেয়ে হলেও হতো।বেছে বেছে সামনের ফ্ল্যাটের এই মেয়েটাই তোর চোখে পড়লো?তাও বিবাহিত! ‘

‘মা ওকে আমি ভালবাসি’

‘তোর থেকে এইসব বাচ্চামি আশা করিনি’

‘সারথি যে ভাল এটার সার্টিফিকেট মনে হয় তোমায় দিতে হবেনা।কারণ তুমি আগ থেকেই জানো ও কেমন ।’

‘এটাও জানি সারথি নতুন এই বাড়িতে আসায় সজীব আর ওর বাসর আমাদের বাগানের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল।আর সেই ফুল গাছ শখ করে তুই লাগিয়েছিলি’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৫
#আফনান_লারা
________
মায়ের কথা শুনে সারথির চোখ দিয়ে তখনই এক ফোটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলো।আনাফ সেটা দেখে নিয়েছে, কারণ তার চোখ সারথির উপরই ছিল।
মা আবার বললেন,’আমার ছেলেকে আমি সব এফোর্ট দিয়ে বড় করেছি।তাকে শিক্ষিত বানিয়েছি,আমার ছেলে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট।তার জন্য কেন আমি সেক্রিফাইস করে একটা অন্ধ মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবো?আমি কি আশা করতে পারিনা একটা সুন্দর,পারফেক্ট পুত্রবধূ?? বুড়ো বয়সে বউমার সেবা খাওয়া কি আশা করতে পারিনা আমি?বুয়া কি সব পারে?
এই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলে আমার তো উল্টে ওর সেবা করতে হবে মনে হচ্ছে’

‘দেখো মা,সেবার বিষয়টা যে বলছো এটা একেবারেই অযৌক্তিক। আমার যে টাকা আছে সেটা দিয়ে আমি এখন যেমন দুইটা বুয়া রাখছি, দরকার পড়লে বিয়ের পর আরও দুজন বুয়া বাড়িয়ে দেবো।তোমার সেবার কোনো ত্রুটি থাকবেনা।আর যে নরমাল সেবা তুমি আশা করো সারথি সেটা অবশ্যই করতে পারবে,আমি বিশ্বাস করি।সে চোখে দেখেনা তো কি হয়েছে??সজীবের বাসায় কি ছিল না সে??সজীবের মায়ের সেবা করে নাই?”

‘আমার বেলায় কেন এমন হবে আনাফ??’

‘মা এসব কি বলতেছো?আমরা ছেলেরা এই কথা বলা উচিত যে আমরা কেন বিবাহিত মেয়ে বিয়ে করবো।সেখানে তুমি শাশুড়ি হয়ে বলতেছো তোমার অবিবাহিত মেয়ে লাগবে!!যেখানে আমার কোনো সমস্যা নাই সেখানে তোমার সমস্যা লাগলো?’

‘শুন আনাফ!আমি নাহয় বুকে পাথর বিধে রাজি হয়ে গেলাম।কিন্তু তোর বাবা?তোর বাবাকে কি করে রাজি করাবি?দশদিন পরে কানাডা থেকে আসবেন উনি, এসে যদি এগুলা শুনে তখন কি করবি?
আমি বাবা মিথ্যা কিছু বলতে পারবোনা।সারথির অতীত যা যা আছে সব বলে দিব।কারণ উনি আমার স্বামী।তার থেকে এত বড় কথা লুকানো আমার পক্ষে সম্ভব নাহ।’

সারথি চোখ মুছে নেয়ার সুযোগ খুঁজছে।আনাফ চুপ করে বসে আছে এবার।আসলেই মা রাজি হলেও বাবাকে রাজি করানো অসম্ভব।
মা উঠে চলে গেছেন হঠাৎ করে।
আনাফ ওমনি সারথির দিকে ফিরে ওর চোখ জোড়া মুছিয়ে দিলো।এরপর বললো,’তোমার চোখের অশ্রু কমাতেই আমি তোমায় বিয়ে করতে চাচ্ছি,সেই তুমি বিয়ে হবার আগে থেকেই অশ্রু ঝরালে??এমনটা তো চাইনি আমি।তবে কেন এমন হয়?’

‘ আমায় বিয়ে করে আপনি নিজের পরিবারে কেন অশান্তি করছেন?
আপনার বাবা মায়ের চেয়ে আমি বেশি হয়ে গেলাম?আন্টি তো ঠিকই বলেছে।আপনি আরও ভাল ডিজার্ভ করেন’

‘শোনো!!টিপিক্যাল হবু বউয়ের মতন কথা বলবানা।অন্তত তোমার থেকে এই কথা আমি আশা করিনা।
আর কে বলেছে বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করবো?বিয়ে করলে তাদের হাসিমাখা মুখ ধরে রেখে করবো,সেটার জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি তাই করবো।তোমায় কিছু করতে হবেনা।শুধু দেখে যাও আমি কি কি করি’
——–
আনাফের আম্মু হাতে চায়ের কাপ আর চিনি,লবণ,বেকিং সোডা নিয়ে সারথির সামনে ট্রেটা রাখলেন তারপর বললেন,’সারথি তোমার সামনে তিনটে বোয়ামে তিনটে উপকরণ আছে।কি কি সেগুলা বলছিনা।পাশে চায়ের কাপ আছে, চিনি ঢেলে নাড়ো।আমি দেখবো’

সারথি হাত বাড়িয়ে বোয়াম ১মটা ধরে ছিপি খুলে ভেতরের চামচ দিয়ে একটু খানি বের করে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁতেই তার কাছে দানাগুলো চিকন মনে হলো।তারপর সে ঐ বোয়াম রেখে পরের বোয়াম ধরলো।এটাতে দানাই নেই।দানাগুলো মিহি করে পিষানো।এটাও সে রেখে শেষেরটা হাতে নিলো।এটার দানাগুলো চিনির মতন বড় বড়।এটা থেকে এক চামচ চিনি নিয়ে সে চায়ের কাপ হাতিয়ে তাতে ঢেলে নাড়ছে এখন ।
আনাফ মুচকি হেসে বললো,’হলো তো বিশ্বাস??আমি জানতাম সারথি ঠিক পারবে।’

আনাফের মা গাল ফুলিয়ে রাখলেন,ভালমন্দ কিছুই বললেননা।আনাফের ইচ্ছা করছিল সারথিকে জড়িয়ে ধরতে।
মায়ের কারণে পারছিলনা।মা না থাকলে নির্ঘাত ঝাপটে ধরতো।তার এই ইচ্ছা কেমন করে যেন পূরণ হয়ে গেলো।মা চায়ের কাপটা নিয়ে তার রুমের দিকে চলে গেলেন তখন।ওমনি আনাফ খুশি হয়ে সারথিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,’ভালোবাসিরে তোরে!!’

‘ইইইইইইইইই!!ছাড়ুন!এটা কিরকম অসভ্যতামি!!তুমি থেকে এবার তুইতোকারি শুরু করে দিলেন’

‘মানুষ খুশিতে পাগল হয়ে যায়।আমি তার প্রমাণ ‘
————
মানিক সাহেবের সামনে বরাবর টুলে বসে আছে ফারাজ।তার পেছনে দাঁড়ানো ফাহাদ।সবেমাত্র এসেছে বাড়িতে।আসতেই বাবার ডাক পড়ে গেলো।মিসেস সোনালী ফাহাদের জন্য বিরিয়ানি রাঁধবেন তাই মশলাপাতির লিস্ট নিয়ে আনলেন মানিক সাহেবের হাতে দেবেন বলে।এখন ওনাকেও মানিক সাহেব দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
ফাহাদ বাবার ভয়ে দীর্ঘ দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফারাজ গেছে বিরক্ত হয়ে।ব্রু কুঁচকে বললো,’বাবা কিছু বলবেন??আমার একটা কাজ আছে’

‘বসে থাকতে কি পা চুলকায় তোমার?দাঁড় করিয়ে রাখবো নাকি?’

ফারাজ এবার মাথা নিচু করে বসে থাকলো।মানিক সাহেব ওকে দাঁড়াতে বলে ঐ টুলে ফাহাদকে বসতে বললেন।তাই দুজনে অদলাবদলি করে নিলো।অবশেষে মানিক সাহেব এবার মুখ খুলে গম্ভীর গলায় কথা শুরু করেন।

‘ফাহাদ জীবনের বড় ভুল করেছিল প্রেম করে বিয়ে করে।তার সেই ভুলের মাশুল আমরা আজ অবধি দিয়ে যাচ্ছি ।জীবনে বড় ছেলের বউয়ের হাতের এক কাপ চা খাইতে পারি নাই।আমার পোড়া কপাল!
আর সেই ভুল আমার ছোট ছেলে করতে চলেছে।কদিনের আসা একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। কেমন সুন্দর একটা মেয়ের পরিবার থেকে প্রস্তাব আসলো আর উনি বলেন উনি ওকে বিয়ে করবেননা কারণ নাকি কেবল ব্যবহার।
আরে ব্যবহার ধুই কি পানি খাইবা তুমি?’

‘বাবা আমি পূর্ণতাকেও বিয়ে করবোনা।’

‘কাকে করবা দেখবো তো শেষ অবধি’

মিসেস সোনালী কাগজটা এগিয়ে ধরে বললেন,’ফারাজ পূর্ণতাকে বিয়ে করলে কি সমস্যা তোমার?ফাহাদের বউয়ের হাতের চা খাওনি তো কি হয়েছে,পূর্ণতার হাতের চা কয়বার খাইছো হিসেব আছে তোমার?’

‘বাড়িতে থাকলে চা তো বানাবেই।ফাহাদের বউ তো বাড়িতেই থাকেনা।কার সাথে কাকে মেলাচ্ছো?চা বানিয়ে খাওয়ালেও পূর্ণতাকে আমি ফারাজের পাশে মানতে পারবোনা’

‘কারণ তোমার কাছে ওর বাবাকে ভাল্লাগেনা।তাই তো?’

মানিক সাহেব বড় বড় চোখে তাকালেন সোনালীর দিকে।আর কিছুই বললেননা।ফাহাদ তখন হালকা কেশে ধীরে বলে উঠলো,’বাবা ওকে তো বলেছি বাবুকে নিয়ে বেড়াতে আসতে।ও আসলে একটু অসুস্থ ‘

‘তোর বউ বারো মাসই অসুস্থ থাকে, এ আর নতুন কি!’
——–
পূর্ণতা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাবার পা ধরে বসে আছে এই বলে যে সে আর এই বাড়িতে থাকবেনা।থাকলেই তাকে ধরে হয় শাহেদ নাহয় ফারাজের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে যেটা সে কিছুতেই করবেনা।

‘দেখ মা আমার মতে ফারাজ,শাহেদ দুজনেই ভাল ছেলে।তোর ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়া উচিত।
এটা তোর বিয়ে করার মোক্ষম সময়।রাজি হয়ে যা মা’

‘বাবা তুমি বোঝো!!এদের দুজনের একজনকেও আমার পছন্দ নয়।আমার জন্য কি ছেলের অভাব??তাহলে এদের দুজনের মাঝে একজনকেই কেন বেছে নিতে হবে?’

‘তোর যাকে খুশি বিয়ে করিস।কিন্তু আমি বেলায়েত বাবুর আদেশ ছাড়া এই বাড়ি ছাড়তে পারবোনা।তুই তাকে না মানলেও আমি মানি।সেই ছোটকাল থেকে আমার বাবার মতন হয়ে তিনি আমায় মানুষ করে ছিলেন।আমায় যদি তিনি বলেন ফারাজের সাথেই তোর বিয়ে দিবেন তবে আমি তাতেই রাজি হয়ে যাবো’

পূর্ণতা বুঝে গেছে সে যত চিল্লাফাল্লা করুক,বাবার মত বদলাতে পারবেনা।তাই সে ঠিক করেছে রাতের আঁধারে বাড়ি ছেড়ে পালাবে।তার হাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় খালি নেই।

ওদিকে বাবা ইচ্ছামত ঝেড়েছেন ফারাজকে।সাথে ফাহাদকে ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে রোদেও শুকাতে দিছেন।এবার ইস্ত্রি করা বাকি শুধু।ফাহাদ জানত আজ সে বাড়িতে আসা মানে বাবার বকুনি খেতে খেতে পেট ভরিয়ে ঘুমাতে যাওয়া।মা কত স্বাদ করে বিরিয়ানি রান্না করছে।বাবার বকুনি খেয়ে সেই বিরিয়ানি আর গলা নিয়ে নাববে না।

ফারাজ ঝাড়ি খেয়ে তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।বাবার কথা গায়ে লাগার মতন।
কষ্ট দিয়ে কথা বলে ঠিক তবে সব সত্যিই বলে,ফাহাদ ভাইয়াকে যা যা বলেছে সব সঠিক।ভাইয়া বাড়িতে থাকেনা এটা একটা অপরাধ।বকা খাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ফারাজ নিজে কেন বকা খেলো!
তার কি দোষ!!পূর্ণতাকে বিয়ে না করলে দাদাজান মাথা খাবে,আর বিয়ে করলে বাবা মাথা খাবে।কি একটা ফ্যাসাদে পড়ে আছে ফারাজ!!এর চেয়ে বরং বাড়ি ছেড়ে পালানোই শ্রেয়!
———-
সারথিকে নিয়ে আনাফ চেয়েছিল অধরার কাছে ফিরে যেতে।কিন্তু মা দিলোনা কারণ মা খুব ভাল করে জানেন এই রাতে ওদের দুজনকে একা দেওয়ার মানে কি দাঁড়ায়।তিনি সারথিকে একটা রুম দেখিয়ে দিলেন ঘুমানোর জন্য।এরপর নিজে ঘুমাতে চলে গেলেন।আনাফ সারথিকে দেখতে চেয়েছিল একবার কিন্তু মায়ের ভয়ে পারছিল না।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফ্রেশ হয়ে সোজা মায়ের রুমের বাইরে গেলো দেখতে মা ঘুমিয়েছে কিনা।
দরজা একটু ফাঁক করে সে উঁকি দিয়ে দেখে মা ঘুমে।নাক ডাকছেন।দাঁত কেলিয়ে পা টিপে টিপে আনাফ এবার সারথির রুমের দিকে গেলো।এসে দেখলো সারথি বিছানার মাঝখানে বসে আছে,ঘুমায়না।

‘আসি?’

‘নাহ’

‘মা ঘুমে।জানতে পারবেনা কিছু’

‘আসতে হবেনা।আপনি নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান’

আনাফ তাও ত্যাড়ামি করে রুমে ঢুকে গেলো।সারথির পাশে বিছানায় উঠে বসে বলািশ বুকে ধরে বললো,’দেখলে মা রাজি হয়ে গেছে’

‘আপনার বাবা তো রাজি হোননি’

‘আরে সেটাও হয়ে যাবে।কিছু খাবে তুমি?কি খাবে বলো, আমাদের ফ্রিজে সবসময় খাবার-দাবার থাকে। তুমি যেটা বলবে সেটাই খাওয়াবো’
——-
বোরকা পরে নিকাব টেনে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পূর্ণতা।উদ্দেশ্য যেখানে পারবে সেখানে যাবে।
কিছুদূর এসে একটা বাসেও উঠে পড়েছে সে।মনে মনে শান্তি লাগলো, সব কিছু থেকে সে নিজেকে ছাড়াতে পেরেছে।
বাসের সিটে বসে জানালা পুরো মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো সে।কিছুক্ষণ পর মনে হলো তার পাশে কেউ একজন এসে বসেছে।
তাও সে চোখ খোলেনি।আরামসে চিল করছে।

‘প্লিজ জানালা বন্ধ করবেন?আমার হাঁপানির সমস্যা আছে’

এই কথা শুনে চমকে পূর্ণতা চোখ খুলে তাকালো পাশে।তার পাশেই ফারাজ বসে আছে। ফারাজের হাতেও ব্যাগ।সম্ভবত সেও পালিয়েছে।
পূর্ণতা নিজের কপালে নিজে একটা বাড়ি দিয়ে নিকাবটা খুললো।এবার ওকে দেখে ফারাজ নিজেই চমকে গেছে।

‘আপনি!!!’

‘আমি পালিয়েছি বলে আমায় কপি করলেন?’

‘যে সমস্যায় পড়েছি পালাবো না তো কি করবো?’

‘আর বাস পাইলেন না?’

‘জানালা বন্ধ করো।আমার অস্বস্তি লাগছে।’
——-
মতিন ফারাজ আর পূর্ণাকে একসাথে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।এখন সে হল রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে চামচ দিয়ে কড়াই পিটতে পিটতে বললো,’সবাই এসে দেখে যাও।ফারাজ ভাই আর পূর্ণতা আপা পালাই গেছে।তাদের বিয়ো করালেনা বলে তারা পালালো, সবাই দেখে যাও’

মতিনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই যে যার রুম থেকে বের হয়ে আসে।মতিনের কাছে জানতে চায় সে কেন এত চিৎকার করছে।
এরপর মতিন যা বললো তা শুনে মানিক সাহেবের মাথা ঘুরে পড়ার মতন অবস্থা হলো।কিন্তু এই ক্ষেত্রে দাদাজান,আজিজ খান আর অরিন্দম বড়ই খুশি হয়।তাদের খুশি তারা প্রকাশ করলোনা তবে মনে মনে খুশিতে গদগদ হয়ে আছে।

চলবে♥