#ডাক্তার_মিস [০১]
কলমেঃ Hasin Rehana
ব্যাস্ত ঢাকার কোলাহল ছেড়ে মফস্বল এলাকার হাওয়া গায়ে লাগতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল বুশরার। বৃষ্টি থেমেছে একটু আগেই। রাস্তাঘাটে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। অন্য সময় হলে বিরক্ত হত ও। কিন্তু আজ কেন জানি সবই ভাল লাগছে। একটা ভ্যান ঠিক করে বান্ধবীর দিকে এগিয়ে এল রুকাইয়া।
” কি রে? কোথায় হারালি?”
“তোদের এলাকাটা অনেক সুন্দর।”
“এই কাদামাখা রাস্তা তোর সুন্দর লাগল?”
“হ্যাঁ কাদা। কিন্তু কি নির্মল বাতাস। ঢাকার মত দম আটকে আসছে না।”
“গ্রামে চল, পথে খুব ভাল্লাগবে। আয় ভ্যানে উঠি। সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”
“এমা, এটাতে কিভাবে বসে? সিট কই?”, অবাক ভংগিতে বলল বুশরা।
রুকাইয়া নিজে পা ঝুলিয়ে বসে বান্ধবীকে দেখিয়ে দিল। ওর দেখাদেখি বুশরাও পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। একটু ভয় লাগলেও, ভ্যান চলতে শুরু করার পরে ভালই মজা পেল।
“এই রুকু, তোদের এলাকার পলটিশিয়ানগুলা সব হ্যান্ডসাম নাকি খুব?”
“কেন বল তো?”
“বাস থেকে নামার পর থেকেই চারিদিকে হিরোমার্কা চেহারার পোস্টার দেখতেছি।”
“ওহ.. হ্যান্ডসাম না ছাই। গ্রামের পথ শুরু হলে আর এইসব গাদা গাদা পোস্টার চোখে পড়বে না। দেখবি খালি সবুজ আর সবুজ।”
বুশরা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ালো।
দশ পনেরমিনিট বাদে মফস্বল থেকে বেরিয়ে ওদের ভ্যান চলল মেঠো পথ ধরে। আসলেই দুপাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ ধানক্ষেত। আম, কাঠালের বাগানও আছে কিছু।
“হ্যাঁরে রুকু, তোর বাড়ি থেকে হসপিটালে কতদূর?”
“কাছেই। হেঁটে গেলে দশ মিনিট।”
“এত কাছে?”
“হুম্ম। চিন্তা করিস না, আমি নিয়ে যাবো তো কাল তোকে। আমার যে কি মজা লাগছে। তুই আমাদের এলাকায় থাকবি। অনেক মজা হবে।”
“ভাবখানা এমন যেন ঢাকায় ফিরবি না আর।”
“মাঝে মাঝে তো আসবো। তখন কিন্তু সারা রাত গল্প করব আমরা। পরের দিন ডিউটির অজুহাত দিবি না কিন্তু বলে দিলাম “আগেই।
“আচ্ছা শোন, কাল কিন্তু বিকালে বের হবি আমার সাথে।”, সিরিয়াস মুখ করে বলল বুশরা।
“আস্তে ধীরে বন্ধু। কাল রেস্ট নে, তারপর পুরা গ্রাম ঘুরাবো, প্রমিস।”
“ঘুরবই তো। কিন্তু আগে বাসা খুঁজে দিবি।”
বান্ধবীর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল রুকাইয়া।
“কিসের বাসা?”
“আমি কি সারা জীবন তোর বাড়িতে কাটাবো নাকি?”
“আলবৎ। দুই বছরই তো বড়জোর।”
“দোস্ত আমি আগেই বলছি তোকে কিন্তু। বাসা খুঁজে দিবি আমাকে। তুই গ্রামে আসলে মাঝে মাঝে তোর সাথে গিয়ে থাকব তো। কথা দিচ্ছি।”
“এই অজ পাড়াগাঁয়ে ভাড়া বাসা কই পাবো দোস্ত?”, অসহায় মুখ করে বলল রুকাইয়া।
সারাজীবন ঢাকায় বড় হওয়া বুশরা এটা চিন্তা করেনি। ভেবেছিল রুকাইয়ার এলাকা, একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।
বান্ধবীর চিন্তিত মুখ দেখে হাতটা আলতো করে চেপে ধরল রুকাইয়া। অভয় দিয়ে বলল, ” একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের পথে ঢুকে গেল ওদের ভ্যান। একটার পর একটা মাটির বাড়ি দেখে অবাক হল বুশরা। মাটির বাড়ি যে দোতলা হতে পারে জানা ছিল না ওর।
একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে ভ্যানটা থামল। এই বাড়িটাও মাটির। তবে সুন্দর করে রঙ করা। উঁচু পাচিলের বাহিরে থেকেও বাড়ির আভিজাত্য নজর কাড়ছে অনায়াসে।
মূল দরজা পেরোতেই মধ্যবয়সী এক লোক ছুটে এসে ওদের ব্যাগপত্র বগলদাবা করল মুহুর্তের মধ্যে।
“কফিল চাচা, ভালো আছেন?”
“জী মা জননী। আপনাদের আসতে সমস্যা হয়নি তো?”
“না চাচা। আব্বা কই?”
“ভাইজি তো মসজিদে গেল এন্যা আগেই। ভাবী রান্নাঘরে। আপনাদের ল্যাগে নাশতাপানি বানাচ্চে।”
“আর ভাইয়া?”
“বাজানের তো নিঃশ্বাস ফেলানোরও টায়েম নাই। ম্যালা ব্যাস্ত। বিহান রাইতে বাড়িত আসে।”
“চাচা আমাদের ব্যাগগুলা আমার ঘরে দিয়ে আসেন। আমরা একটু আম্মার সাথে দেখা করে আসি।”
বুশরার হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে ছুটল রুকাইয়া।
রান্নাঘর বলতে আসলে বাড়ির পাঁচিল বরাবর টানা একটা বারান্দা। কোমর পর্যন্ত ইটের দেয়াল তুলে বাকিটায় রেলিং দেওয়া। ভেতরে অনেকগুলো মাটির চুলা।
আধুনিকতার ছোঁয়া এখানেও লেগেছে অবশ্য। একপাশে একটা বিশাল ফ্রিজ আর গ্যাসের চুলা সেট করা। সেখানেই মেয়ের জন্য নানা পদের তেলে ভাজা পিঠা বানাচ্ছেন রুকাইয়ার মা, শিউলি বেগম। পাশে একটা অষ্টাদশী মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সম্ভবত পিঠা ভাজার কারিকুরি শিখছে।
ওদের দেখে চুলার আঁচটা কমিয়ে এগিয়ে এলেন শিউলি বেগম। মেয়েটাকে বললেন পিঠাগুলো নামিয়ে নিতে।
“এত দেরি হল যে?”
“দেরি কোথায় আম্মা? এই হল বুশরা, আমার বান্ধবী। আর বুশরা, এই হল আমার আম্মা।”
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম সালাম মা। পথে সমস্যা হয়নি তো?”
” না না। কোনও সমস্যা হয় নি।”
“রুকু, ওরে ঘরে নিয়ে যা। আমি নাশতা নিয়ে আসতেছি। হাতমুখ ধুয়ে নে।”
বান্ধবীকে নিয়ে ঘরে গেল রুকাইয়া। যাওয়ার আগে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে গেল।
গ্রামের আর পাঁচটা মাটির বাড়ির মতই এবাড়ির কলপাড়টাও নিচেই। গোসলখানা, টয়লেট কলপাশ সব একসাথে। ছেলেদেরটা দক্ষিণকোনায়, আর মেয়েদেরটা উত্তরকোনায়।
রুকুর ঘরটা দোতালায়। মাটির ঘরের দোতালায় প্রথমবার উঠতে ভয় পাচ্ছিল বুশরা। অবশ্য জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখার পর দুচোখ ভরে গেছে প্রশংসায়। জামাকাপড় চেঞ্জ করতেই অনেক রকম পিঠাপুলি নিয়ে হাজির হলেন শিউলি বেগম।
“এত কিছু কি দরকার ছিল আন্টি?”
“এত কিছু কই? মেয়েটা এত ফাজিল আগে জানায়নি। কিছুই তো করতে পারলাম না।”
“আন্টি ওর দোষ নাই কোনও। আসলে জয়েনিং লেটার পেয়েছি মাত্র দুইদিন আগে। পোস্ট অফিসের কি ঝামেলার কারনে আটকে গেছিল।”
“আম্মা চিন্তা কইরো না, ও তো পলায়ে যাচ্ছেনা। এলাকার ডাক্তার আফা বলে কথা। সারা বছর খাওয়াইয়ো। তাইলেই না ভাল করে চিকিৎসা করে দিবে।”
“চুপ ফাজিল। খাও মা তুমি।”
দুধপুলি পিঠা এগিয়ে দিলেন রুকুর মা। পিঠায় একটা কামড় দিতেই বুশরার দুচোখ ভিজে এল। স্মৃতি হাতড়েও কেউ ওর জন্য কখনো ভালবেসে পিঠা বানিয়েছে বলে মনে করতে পারল না। চশমার আড়ালে টুপ করে একফোঁটা মুক্তোদানা গড়িয়ে পড়ল। সবার অলক্ষ্যে সেটা মুছে ফেলতে দেরি করলনা ও।
শিউলি বেগম চলে গেলেন রান্নাঘরে। রুকুর বাবা রুস্তম শেখ নিজে আজ বাজারে গেছিলেন। বড় দেখে রুই মাছ, মেয়ের পছন্দের তেলাপিয়া মাছ, দেশি মুরগীসহ আরো অনেক কিছু বাজার করে এনেছেন। রাতে টাটকা রান্না হবে আজ।
চলবে…
(বিঃদ্রঃ কভার দেখেই বুঝছেন, এটা একটা প্রেমের গল্প। আগেই বলে রাখছি গল্পটা একটু দীর্ঘ হবে, কিছুটা উপন্যাসের আদলে। #বন্ধুচল আসবে এটার ফাঁকে ফাঁকে।)
(বিঃবিঃদ্রঃ লাইক, কমেন্ট শেয়ার করে পাশে থাকুন। অনুগ্রহ করে কপি করবেন না)